নিউজিল্যান্ডের গল্প : মৃতদের আবাসভূমি

মূলঃ এলিনর ক্যাটন
অনুবাদঃ ফজল হাসান

‘আমার মগের ভেতরের কফির দাগগুলো দেখ,’ শ্যারন বললো । ‘এই মগের দিকে তাকালে তুমি ভড়কে যাবে । কফির দাগগুলো দেখতে অনেকটা আবহাওয়ার মানচিত্রেুর মতো । মনে হয়, এতে দিনক্ষণ, সপ্তাহ এবং বছর – সবই আছে । মগের দাগগুলো আমাকে রীতিমতো বিষিয়ে তুলেছে ।
মনে হয় যেন আমার ব্যর্থ জীবনের সমস্ত কলঙ্কের চিহ্ন কফির এই দাগগুলো ।’

শ্যারন তার কথার যথার্থতা প্রমাণ করার জন্য আমার দিকে কফির মগ উঁচু করে উল্টেপাল্টে দেখায় । তারপর কাউন্টারের দিকে ফিরে যাওয়ার সময় বললো, ‘আমি প্রতিদিনই ঘষামাজা করে মগ পরিস্কার করি ।’

‘আপনার কাছে কি ডকেট আছে ? আপনার নাম কি ?’ কাউন্টারের সামনে অপেক্ষারত লোকটিকে উদ্দেশ্য করে শ্যারন জিজ্ঞেস করে । সেই সময় শ্যারন হয় সরাসরি লোকটির মুখের দিকে তাকিয়েছিল, নতুবা হাসি মুখে বলেছে । তবে এই দু’টো পরিস্থিতি কোনোভাবেই একসঙ্গে নয় । কেননা সে এই দু’টো অঙ্গভঙ্গি একই সাথে করতে পারে না ।

লোকটি পকেটে হাত ঢুকিয়ে এলোপাথারি ডকেট খুঁজতে থাকে এবং খোঁজার ফাঁকেই সে তড়িঘড়ি করে তার নাম বললো, ‘রিচার্ড ।’ তার উচ্চারণ অষ্ট্রেলিয়ানদের মতো হওয়ায় শ্যারন শুনতে পেল ‘রেচড্’ এবং সে তাই দ্রুত টাইপ করে । তারপর সে রিচার্ডের মাথার উপর দিয়ে দৃষ্টি মেলে হাসি মুখে তাকায় ।
একসময় লোকটি শ্যারনের কাছ থেকে রশিদ সংগ্রহ করে দরজার দিকে পা বাড়ায় । মুহূর্তেই শ্যারন মুখের হাসি মুছে ফেলে লোকটির গন্তব্যের দিকে পলকহীন দৃষ্টি আবদ্ধ করে ।

‘হায় ঈশ্বর, এই অফিস একটা নরকের গর্ত,’ লোকটি চলে যাওয়ার পর দরজা বন্ধের শব্দ শুনে শ্যারন অনেকটা আপন মনে মন্তব্যের সুরে বললো । তারপর সে প্রত্যাশার চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে হতাশার ভঙ্গিতে বললো, ‘আমার কেন যে মরণ হয় না?’

‘আমারও অবস্থা তথৈবচ,’ শ্যারনের কথার সঙ্গে সহমত পোষণ করে আমি বললাম । তারপর তার কথার পুনরাবৃত্তি করে বললাম, ‘আমারও কেন যে মরণ হয় না?’

‘আমি কিছুতেই বিশ্বেস করতে পরছি না, এখনো আমরা এখানে কেন আছি ?’ শ্যারন বললো । ‘এরই মাঝে দু’বছর কেটে গেছে এবং এখানে আমরা বহাল তবিয়তে আছি ।’

‘আমারও বিশ্বেস হয় না,’ কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমি বললাম । ‘হতাশা থেকে মুক্তি লাভের জন্য কেন আমাদের মৃত্যু হয় না ?’

শ্যারনের গল্প করার মূল বিষয় হলো হতাশা এবং অসুস্থতা । যাদের মধ্যে এই ধরনের মানসিক উপসর্গ আছে, তাদের সঙ্গে ওর একটা আলাদা সম্পর্ক রয়েছে। অন্যেরা যেমন শব্দজট খেলা পছন্দ করে, সে-ও তেমনই হতাশা এবং রোগ-বালাইয়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সময় কাটাতে পছন্দ করে । এটাই তার নিজস্বতা, বলা যায় বিশেষ গুণ ।

‘ক্ষুধামান্দ্য,’ সকালে এক মহিলা নাটবল্টু, ওয়েদার বোর্ড নিষ্কাষণ এবং পশমি কাপড়ের বায়না দিতে এসেছিল, তাকে দেখে শ্যারন মন্তব্য করে ।

শুধু তাই নয় । রীতিমতো শ্যারন আমাকে আরো বললো, ‘পাঁচ ডলারের বাজি । জানি, তুমি জানতে চাইবে আমি কেমন করে বললাম, তাই না ? দেখ, মহিলার ঠোঁট শুস্ক, কঙ্কালসার হাতের মুঠো এবং চোখের নীচে কালি পড়েছে ।’

কিন্তু আমাদের এই কথাবার্তা ছিল কয়েক ঘন্টা আগে । ইতিমধ্যে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করে আমরা রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছি ।

বিরক্তি কাটনোর জন্য আমি একসময় প্রস্তাব করি, ‘চলো, দশ মিনিটের জন্য বাইরে গিয়ে সিগারেট ফুঁকে আসি ।’

শ্যারন বিনা বাক্যে আমার প্রস্তাব লুফে নেয় । আমরা বাইরে এসে ময়লা ফেলার বিশাল পাত্রের পাশে একটা বেঞ্চের উপর বসি এবং সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করি । সেই সময় নির্মাণ শ্রমিকেরা গাড়ির পার্কিংয়ে আসা-যাওয়ার পথে আমাদের দেকে হাত নেড়ে অভিবাদন করে । ওদের চেহারা তামাটে, রোদে পোড়া তামাকের মতো গোলাপী এবং ধূসর রঙের মিশেল ।

একসময় দু’ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরা জ্বলন্ত সিগারেট সরিয়ে শ্যারন জিজ্ঞেস করে, ‘ওটা কি ?’

যেদিকে তাকিয়ে শ্যারন জিজ্ঞেস করে, সঙ্গে সঙ্গে আমি সেদিকেই তাকাই । টেলিফোন বুথের কাছে জীর্ণশীর্ণ রড্যাডেনড্রন গাছের ঝোপঝাড় । গাছটা মৃতপ্রায় । গেটের বাইরে যেখানে ট্রাকগুলো বাঁক নিয়ে বড় রাস্তায় যায়, সেখানে গাছটা লাগানো হয়েছিল । সেই রড্যাডেনড্রন ঝোপের ভেতর একটা মৃত প্রাণী পড়ে আছে ।

‘এটা একটা মুন্ডুহীন কুকুরের মৃত দেহ,’ উত্তেজিত হয়ে সিগারেটে একটা দীর্ঘ টান দিয়ে শ্যারন বললো । তারপর নিজেকে খানিকটা আশ্বস্ত করে বললো, ‘চলো, খবরটা কাউকে জানাই । হায় ঈশ্বর, একটা কুকুরের মৃত দেহ । তা-ও আবার মাথা নেই ।’

কাঠমিস্ত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য শ্যারন হাত নাড়ে । তার হাত নাড়ানো দেখে দোকান থেকে প্রায় সবাই ছুটে আসে । আমরা রড্যাডেনড্রন গাছের নীচে ঝোপের ভেতর পড়ে থাকা মৃত কুকুরটার দিকে তাকিয়ে আছি । হ্যামিশ তো প্রায় তার ফর্ক-লিফট বিশাল গাড়িটা মৃত কুকুরের উপর দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছিল । অফিসের হিসাব-রক্ষণ বিভাগের মেয়েগুলো একঝলক দেখার জন্য বাইরে ছুটে আসে । আমরা সবাই দর্শক, তবে খুব কাছাছাছি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম না । আমরা আনুমানিক পাঁচ বা ছয় ফুট দূরে দাড়িয়ে দেখছিলাম । কেননা মৃত প্রীণী তো মৃত প্রাণীই ।

‘এটা মুন্ডহীন একটা কুকুরের মৃতদেহ,’ উত্তেজিত হয়ে সিগারেটে কয়েকবার ঘনঘন টান দিয়ে পুনরায় শ্যারন বললো । ‘চলো, অন্যদের খবরটা দিয়ে আসি । হায় ঈশ্বর, মাথা ছাড়া একটা মরা কুকুর ।’

‘এমন পাষন্ড কে আছে যে, কুকুরের মাথা কাটতে পারে?’ উৎসুক দর্শকেরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বলাবলি করে ।

‘অসহ্য !’ কুকুরের মাথা যেখানে থাকার কথা, ভালো করে দেখার জন্য আমরা সেদিকে তাকাই । কুকুরটার গায়ের রঙ সাদা এবং পশম ছোট করে ছাটা ।

লন্ড্রি দোকানের গ্লেন বললো, ‘প্রাণী সংরক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ বিভাগের লোকজনদের খবর দেওয়া প্রয়োজন।’

বলেই সে একটা ফিতা দিয়ে মাপামাপি শুরু করে । তারপর একসময় সে আরো বললো, ‘ওরা গড়ি নিয়ে এসে কুকুরটা তুলে নিয়ে যাবে ।’

জটলা বেঁধে আমরা সেখানে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি । শ্যারন এবং আমার হাতের জলন্ত সিগারেট প্রায় শেষ হয়ে এসেছে । তবুও শ্যারন সিগারেট ফুঁকতে থাকে।

‘জানি না, কতক্ষণ ধরে কুকুরটা এখানে পড়ে আছে,’ শ্যারন সমবেদনার সুরে বললো ।

গ্লেন বললো, ‘আমি কুকুর ভালোবাসি ।’ তার কন্ঠস্বর দুঃখ-ভারাক্রান্ত শোনালো । সে ফিতা বন্ধ করে বললো, ‘আমিই কুকুর রক্ষণাবেক্ষণ করার লোক ।’

প্রাণী সংরক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ বিভাগ থেকে বলা হলো যে, ওদের লোক এক ঘন্টার মধ্যে আসবে । ইতিমধ্যে আমাদের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে । শ্যারন এবং আমি অফিসের ভেতর ফিরে আসি এবং যার যার নির্ধারিত জায়গায় বসি । ঢোকার মুখেই দু’টি নীল রঙের কাউন্টার । এগুলোই আমাদের বসার জায়গা । অফিসের ভেতরে ঢোকার সময় আমরা খদ্দেরদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাই । খদ্দেররা যুবতী মেয়েদের হাসিমুখ পছন্দ করে । আমি যদিও বেশ হাসিখুশী, তবুও কেন জানি খদ্দেররা শ্যারনকে বেশী পছন্দ করে ।

‘আমার মনে হয়, কুকুরটা আগে মারা গেছে,’ আমি বললাম । ‘এবং পরে কেউ মাথাটা কেটেছে । আসলে এটাই সহজ ।’

‘কুকুর নিয়ে আমি ভীষণ বিরক্ত,’ শ্যারন বললো ।

বলেই সে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে ।

সেই সময় কাউন্টারের কাছে এসে একজন বৃদ্ধ মহিলা বললো, ‘ওয়াশার ।’

‘চার নম্বর সারিতে,’ নির্দিষ্ট জায়গার দিকে তর্জনী উঁচিয়ে হাসিমুখে শ্যারন বললো । ‘হাতের বাম দিকে দস্তা এবং ডান দিকে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ।’

মহিলা চলে যাওয়ার পরে শ্যারন পুনরায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে । একসময় সে বললো, ‘আমাদের ট্রেড অফিসের কর্মী চার্লির বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ রয়েছে’ । সে টেবিলের উপর রাবার ব্যান্ড নাড়াচড়া বন্ধ করে । তারপর সে পানির নলের মুখ আটকানোর স্টপার থরেথরে সাজিয়ে একটা টাওয়ার বানাতে চেষ্টা করে ।

‘তোমাকে কে বলেছে ?’

‘উইলি ।’

শ্যারনের তৈরী স্টপারের টাওয়ার ধ্বসে পড়ে । টেবিলের উপর থেকে সে স্টপারগুলো দ্রুত সরিয়ে বিরক্তির সঙ্গে বললো, ‘এই অফিসে কাজ করা এবং মৃতদের আবাসভূমিতে কাজ করা – দু’টো একই জিনিস । কেমন করে যে এখানে এই নিরামিষ জায়গায় আরেকটা গরমকাল কাটাবো, কিছুতেই ভেবে পাই না । মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাবো ।’

‘কুকুরের মাথা কে কাটতে পারে ?’ স্বগোক্তির মতো করে আমি বললাম । ‘কে এই অমানবিক কাজটা করেছে ? আমি আসলে সত্যি ঘটনা জানতে চাচ্ছি ।’

কুকুরের খবর শোনার পরে টেনিফোনের অপর প্রান্তে প্রাণী সংরক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ বিভাগের মহিলাকে ভীষণ উত্তেজিত মনে হলো ।

‘কি বললেন, মরা কুকুরের মাথা নেই ? তাহলে তো এটা কোনো দুর্বৃত্তদলের কাজ । ওরা নৃশংস কাজ করায় পটু। সত্যি, এটা চিন্তার বিষয় । মুন্ডহীন কুকুর মরে পড়ে আছে, এটা ভয়ানক । যাহোক, শীঘ্রই আমরা একজনকে পাঠাচ্ছি ।’ মহিলা টেলিফোনের লাইন কেটে দেওয়ার সময় আমি অপর প্রান্ত শুনতে পেলাম চিৎকারের মতো উঁচু গলায় সে কাউকে ডাকছে, ‘এই মার্লিন ।’

প্রাণী সংরক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ বিভাগের ভ্যান এসে যখন পৌঁছে, তখন শ্যারন উপরের চা-ঘরে ময়লা জিনিসপত্র পরিস্কার করছিল । অন্য কেউ করার আগে আমি তড়িঘড়ি করে তাদের স্বাগত জানানোর জন্য গাড়ী পার্কিংয়ে ছুটে যাই । ভ্যান থেকে অল্পবয়সী এক যুবতী মেয়ে বেরিয়ে আসে । ওর চুল খাটো করে কাটা এবং হাতের কব্জিতে চামড়ার বন্ধনী ।

‘চলুন, মুন্ডহীন কুকুরটা দেখে আসি,’ তাড়া দিয়ে যুবতী মেয়েটি বললো । বলেই সে দু’হাতের তালু ঘষে এবং শব্দ করে দু’বার তুড়ি বাজায় ।

আমরা রড্যাডেনড্রন গাছের দিকে হাঁটতে থাকি । তখন অপরাহ্নের শেষ বেলা এবং ব্যবসার প্রয়োজনে লোকজনের চলাফেরা স্তিমিত হয়ে এসেছে । গাড়ির পার্কিং এলাকায় হাতে গোণা কয়েকটা ট্রাক । চতুর্দিকে সূর্য্যের আলো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে । অস্তমিত সূর্য্য ধীর গতিতে নীচে নামছে এবং আস্তে আস্তে বিলবোর্ড, ওভারব্রীজ আর ট্রামের তারের নীচে হারিয়ে যাচ্ছে । গ্লেন আপন মনে ঝাড়ু দিয়ে আমাদের পেছনের উঁচুনীচু জায়গা পরিস্কার করছে ।

প্রাণী সংরক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ বিভাগের মেয়েটির সঙ্গে আমরাও রড্যাডেনড্রন গাছের কাছে যাই । সেখানে পৌঁছানোর পরপরই মেয়েটি সোজা হেঁটে গিয়ে খানিকটা সামনের দিকে ঝুকে আশেপাশের শুকনো ডালপালা এবং মরা পাতা সরিয়ে ভলো করে মুন্ডহীন মরা কুকুরটাকে দেখার চেষ্টা করে । সেই সময় বাতাসের তোড়ে কয়েকটা ঝরাপাতা উড়ে এসে তার মুখে পড়ে । আমি মেয়েটির পেছনে দাঁড়িয়েছিলাম । কাছাকাছি থেকে দেখার জন্য সে আমাকে কাছে ডাকে। তার মুখের সামনে একঝাঁক মাছি ধোঁয়ার মতো উপরে উড়ে গেল । সে থমকে দাঁড়ায় । তারপর আমার দিকে হাত বাড়িয়ে সে চিৎকার করে উঠে, ‘এদিকে আসুন । দেখে যান, কি এটা ।’

আমি সন্তর্পণে পা টিপে সামনে এগিয়ে যাই এবং মুন্ডহীন কুকুরটার দিকে তাকাই । মরা কুকুরটার আশেপাশে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র, বিশেষ করে হালকা পানীয়ের দুমড়ানো-মোচড়ানো খালি ক্যান, শুকনো ঝরাপাতা, রুপালি রঙের ছেঁড়া ঠোঙা এবং ভাঙা ময়লা পাত্র, ইতস্ততঃ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ।

আসলে ওটা কুকুরের মৃতদেহ নয়, বরং মগি প্রজাতির খাড়া পশমওয়ালা বিশাল দেহের একধরনের বিড়াল । ছোট মাথাটা নীচে পড়ে থাকার জন্য মনে হয়েছে মাথা নেই । এখনো মাথায় রক্তে দাগ লেগে আছে । চোখের পাতা খোলা, তবে বিড়ালটা মৃত ।

‘আহ্,’ আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে । তবে সেই মুহূর্তে আমি শুধু ওটুকুই বলতে পেরেছি ।

‘আমার ধারনা, আপনারা কেউ কাছাকাছি যাননি,’ যুবতী মেয়েটি বললো । প্রসঙ্গ টেনে সে আরো বললো, ‘তাই ভালো করে দেখতে পারেননি ।’

‘আসলে আমরা দেখতে চাইনি,’ আমি বললাম ।

বলেই আমি কয়েক কদম পেছনে সরে যাই এবং ভালো করে দেখার জন্য মাথাটা একদিকে কাত করে পুনরায় তাকাই । তবে এবার মুন্ডহীন বিড়াল নয়, বরং রড্যাডেনড্রন গাছের নীচে ঝোপের ভেতর পড়ে থাকা একটা সাধারণ মরা বিড়াল দেখি ।

‘মরা বিড়াল আমরা যেদিক থেকে যেভাবে দেখেছি, সেভাবে দেখলে আপনিও মনে করতেন ওটা মুন্ডহীন একটা কুকুরের মৃতদেহ,’ যুবতী মেয়েটির কথার প্রতিবাদ করে আমি বললাম ।

মহিলা রড্যাডেনড্রন গাছের নীচ থেকে খানিকটা পিছিয়ে এসে আমার মতো তাকিয়ে পুনরায় পরখ করে। কয়েক মুহূর্ত আমরা বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখি ।

কিছুক্ষণ পরে মেয়েটি বললো, ‘হ্যাঁ, এখন আমি দেখতে পাচ্ছি । কুকুমের মাথার চেয়ে বিড়ালের মাথা ঢের ছোট। তাই আপনারা হয়তো দেখতে পাননি ।’

‘হ্যাঁ, তাই,’ চটজলদি আমি মহিলার কথার সঙ্গে সহত পোষণ করে বললাম । ‘ঠিকই বলেছেন, কুকুরের মতো লম্বা নাক বা শরীরের অন্য কিছুই আমরা দেখিনি ।’

মেয়েটি সোজা হয়ে দাঁড়ায় এবং দু’হাতের তালু দিয়ে মুখ মোছে । তার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ ফুটে উঠেছে ।

‘আপনারা হয়তো বুঝতে পারছেন না,’ যুবতী মেয়েটি বললো, ‘মুন্ডহীন কুকুর আমাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ । আমি আসলে বলতে চাচ্ছি, মাথাবিহীন কুকুর একধরনের বর্বরতা । পুলিশকে খবর দেওয়া আমাদের উচিত, কেননা এই হত্যাকান্ডের আড়ালে যদি কোনো সূত্র লুকিয়ে থাকে । তবে মরা বিড়াল কখনই কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় । মরা বিড়াল কিন্তু মরা বিড়ালই । হয়তো রাস্তা পেরোনোর সময় গাড়ীর নীচে চাপা পড়েছে এবং কেউ একজন তুলে এই ঝোপের ভেতর ছুড়ে ফেলেছে । এধরনের দূর্ঘটনা হরহামেশা ঘটছে । এটা খুবই মামুলি একটা ঘটনা ।’

মেয়েটির কথায় সায় জানিয়ে আমি বারবার মাথা দোলাই ।

‘মরা বিড়াল নিয়ে আমি অফিসে ফিরে যাচ্ছি,’ একসময় কন্ঠস্বরে বিরক্তির খানিকটা তেতো রস মিশিয়ে যুবতী মেয়েটি বললো । ‘চুল্লিতে পোড়ানোর জন্য আরেকটা বিড়াল,’ তারপর স্বগোক্তির মতো করে বলার সময় সে একটা অশ্লীল শব্দও উচ্চারণ করে ।

পাশের উঁচু ব্রীজ পেরিয়ে সাঁই সাঁই করে একের পর এক ট্রাক চলে যাচ্ছে এবং একসময় দিগন্তের নীলিমায় মিশে যাচ্ছে । অন্যমনস্ক ভাবে মেয়েটি হাতের কব্জিতে চামড়ার বন্ধনী শক্ত করে চেপে ধরে । তারপর সে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে জিঙ্গেস করে, ‘মরা বিড়াল তুলে নেওয়ার জন্য কি আমাকে কয়েকটা প্লাস্টিকের ব্যাগ দেওয়া যাবে ?’

আমি দ্রুত কয়েকটা প্লাস্টিকের ব্যাগ এনে মেয়েটিকে দিই । সাধারণ বাজার-সওদা বহন করার মতো প্লাস্টিকের ব্যাগের একপাশে আমাদের হার্ডওয়্যার দোকানের লোগোর ছাপ আছে । মেয়েটি নীচু হয়ে মরা বিড়ালের পা ধরে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে । আমি কয়েক কদম পিছিয়ে যাই । মেয়েটি বিড়ালসহ ব্যাগটা আরেকটা প্লাস্টিকের ব্যাগের ভেতর ভরে, যেন একটা ব্যাগ ছিঁড়ে গেলেও কোনো অসুবিধে না হয় । মেয়েটি যখন দাঁড়িয়ে ব্যাগের ভেতর ভরছিল, তখন ব্যাগের মুখ খোলা ছিল এবং ব্যাগের সেই ফাঁক গলিয়ে বিড়ালের পা বের হয়েছিল । যাহোক, আমি দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করেছি যে, মেয়েটি আগে বিড়ালের মাথা ঢুকিয়েছে । কিন্তু বিষয়টি আমার কাছে অস্বাভাবিক লেগেছে ।

‘ওটা একটা বিড়াল,’ আমি অফিসে ফেরার পথে দোকানের ভেতর ঢুকে গ্লেনকে বললাম । ‘ওটার মাথা ছিল, কিন্তু আমরা দেখতে পাইনি ।’

‘ওটা বিড়াল ছিল ?’ গ্লেনের চোখেমুখে আনন্দ এবং কন্ঠস্বরে স্বস্তির চিহ্ন ফোটে উঠে । ‘যাক, ওটা একটা বিড়াল ছিল । ভালো, খুব ভালো ।’ বলেই সে পুনরায় ঝাড়পোছের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ।

আমি যখন কাউন্টারে ফিরে আসি, তখন অফিস বন্ধ করার সময় । শ্যারন দিনের বিক্রীর হিসেব গুণছিল । তার দু’হাতের মুঠো ভর্তি দশ সেন্টের খুচরো । আমার উপস্থিতি টের পেয়ে সে মাথা তুলে তাকিয়ে বললো, ‘অই মেয়েটি সমকামী ।’

একটু থেমে শ্যারন রীতিমতো আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পুনরায় বললো, ‘মেয়েটি সমকামী – এ নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে পাঁচ ডলারের বাজি ধরতে রাজি আছি । নিশ্চয় তুমি ভাবছো, আমি কেমন করে নিশ্চিত হলাম?’



লেখক পরিচিতিঃ নিউজিল্যান্ডের ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার এলিনর ক্যাটনের জন্ম কানাডার ওন্টারিওতে, ১৯৮৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর । সেই সময় ওখানে তার বাবা ডক্টরেট ডিগ্রী করছিলেন । ছয় বছর বয়সে তিনি বাবা-মার সঙ্গে নিউজিল্যান্ডে ফিরে আসেন এবং ক্রাইস্টচার্চে বসবাস করেন । তবে এই সময়ের মাঝে এক বছর তিনি তার পরিবারের সঙ্গে ইংল্যান্ডের লীডস্ শহরে ছিলেন । তিনি ক্রাইস্টচার্চের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যান্টারবেরীতে ইংরেজী সাহিত্যে পড়াশুনা করেন । পরে তিনি ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েলিংটন থেকে ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে মাষ্টার ডিগ্রী অর্জণ করেন । তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য রিহার্সেল’ প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে, যা তার মাষ্টার ডিগ্রীর জন্য গবেষণামূলক প্রবন্ধ ছিল । ‘লুমিনারিস’তার দ্বিতীয় উপন্যাস এবং এই উপন্যাসের জন্য তিনি ২০১৩ সালে সর্বকনিষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে ‘ম্যান বুকার’ পুরস্কার লাভ করেন । তবে আগের বছর তিনি ‘ম্যান বুকার’ পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিলেন । ‘দ্য রিহার্সেল’ এবং ‘লুমিনারিস’ উপন্যাসের জন্য তিনি একাধিক দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার পান । তিনি ২০০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ‘আইওয়া রাইটার্স ওয়ার্কশপ’ ফেলো নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালে তাকে ‘উপন্যাসের সোনালী কন্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় । ইতিমধ্যে তার ছোটগল্প ‘গ্রানটা’ সহ বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে । কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখার জন্য তাকে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েলিংটন থেকে ২০১৪ সালে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করা হয় । বর্তমানে তিনি অকল্যান্ডে বসবাস করেন ।

গল্পসূত্রঃ ‘মৃতদের আবাসভূমি’ গল্পটি এলিনর ক্যাটনের ‘নেক্রোপলিস’ গল্পের অনুবাদ । গল্পটি ২০০৭ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত নিউজিল্যান্ডের ‘সানডে স্টার টাইমস্’ পত্রিকা থেকে নেওয়া হয়েছে । পরবর্তীতে ২০০৯ সালে গল্পটি ‘দ্য বেস্ট নিউজিল্যান্ড ফিকশন ৫’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ।

‘মৃতদের আবাসভূমি’ গল্পটি ২০০৭ সালে এই ‘সানডে স্টার টাইমস্’ পত্রিকা আয়োজিত প্রতিযোগিতায় উন্মুক্ত বিভাগে সেরা গল্পের পুরস্কার লাভ করে । গল্পটি সম্পর্কে বিচারকমন্ডলীর প্রধান ওয়েন মার্শাল মন্তব্য করে বলেছেন, ‘মৃতদের আবাসভূমি’ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং কৌতুকপূর্ণ ছোটগল্প, যা সাদামাটা ভাষায় অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে উপস্থাপন করা হয়েছে ।

*****





অনুবাদক
ফজল হাসান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ