অনুবাদ : মৌসুমী কাদের
মেয়েটি ছেলেটিকে প্রশ্ন করল: ‘তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো?
ছেলেটি কিছুটা সময় ভাবল, তারপর শান্তভাবে উত্তর দিল,‘মধ্যরাতে ট্রেনের হুইসেলের মতো।
ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি নীরবে অপেক্ষা করল। বলার মত সেখানে অবশ্যই একটা গল্প আছে।
‘কখনো কখনো, ঠিক ওভাবেই, গভীর রাতে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি’, ছেলেটা বলতে শুরু করল। তখন কটা বাজে জানি না। খুব সম্ভবত দুটো বা তিনটের কাছাকাছি। সময়টা আসলে কোন ব্যাপার নয়। মূল বিষয়টি হল তখন গভীর রাত, এবং সম্পূর্ণ একা আমি, চারপাশে আর কেউ নেই। আমি চাই--তুমি আমার এই অবস্থাটা কল্পনা কর, ঠিক আছে? সম্পূর্ণ অন্ধকার, তুমি কিছুই দেখতে পাচ্ছো না এবং একটি শব্দ পর্যন্ত তুমি শুনতে পাচ্ছো না। এমনকি শুনতে পাচ্ছো না ঘড়ির কাটা থেকে সৃষ্ট টিক টিক শব্দও। যতটুকু জানি, ঘড়িটা ভালো আছে। এবং তারপর হঠাৎই আমার মনে হলো আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। প্রত্যেকটি চেনাজানা মানুষ ও জায়গা থেকে আমি অবিশ্বাস্যরকমভাবে সরে গেছি। এই ভাবনা আমাকে কষ্ট দিল। আমি বুঝতে পারছি যে এই গোটা বিস্তৃত বিশ্বের কেউ আর আমাকে ভালোবাসে না, কেউ আমার সঙ্গে কথা বলবেনা; আমি সেই এক মানুষ হয়ে গেছি যাকে কেউ আর মনে করতে চায় না। আমি অদৃশ্যও হয়ে যেতে পারি এবং কেউ তা খেয়ালও করবে না। আমার মনে হল কেউ যেন মোটা লোহার বাক্সের মধ্যে আমাকে ঠেসে দিয়েছে। বাক্সটি সমুদ্রের গভীর তলদেশে ডুবে যাচ্ছে। এই ডুবে যাওয়ার চাপটা এতটাই ছিল বেশি যে তা আমার হৃদপিণ্ডে আঘাত করছিল; এবং মনে হচ্ছিল যে আমি ফেটে যাবো, দুটুকরো হয়ে ছিঁড়ে পড়বো ---তুমি কি সেই অনুভূতি জানো?’
মেয়েটি মাথা নাড়ল। ছেলেটা কী বোঝাতে চাইছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে।
ছেলেটি বলতে থাকল, ‘আমি মনে করি একজন ব্যক্তির জীবনে সবচেয়ে বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে এটি একটি। আমি ভীষণ বিষন্ন বোধ করি এবং এটা আমাকে এতটাই কষ্ট দেয় যে মনে হয়, যদি পারতাম এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিতাম, সত্যিই। আসলে, আমি যা বলেছি তা ফিরিয়ে নিচ্ছি, এটা এমন নয় যে ‘আমি মরে যেতে চাই’: আমি বলতে পারি, এ ব্যাপারগুলো যদি এভাবে চলতে থাকে তবে বাক্সের ভেতরের বাতাসও খুব কমে আসবে। সত্যিই আমি মারা যাব। এটা কোন রূপক কল্পনা নয়, এটা বাস্তবতা। এর মানে হলো, গভীর রাতে একদম একা জেগে ওঠা। তুমি কি আমাকে বুঝতে পারছো’?
মেয়েটি আবার মাথা নাড়ল। কিছু বলল না। ছেলেটি কয়েক মুহুর্ত চলে যেতে দিল।
‘এবং তারপর, দূরের সেই পথ ধরে, ট্রেনের একটা হুইসেল শুনতে পাই। অবিশ্বাস্যরকম ভাবে অনেক দূর থেকে ভেসে আসছিল সেই হুইসেলটা । রেল লাইনগুলো কোথায় থাকতে পারে তার আমার ধারণায় নেই। ধারণায় নেই কতো দূর থেকে ভেসে আসছে এই হুইসেলের শব্দ। এই শব্দ এতো আস্তে হয় যে, তা ঠিক স্পষ্টভাবে সব কানে আসে না বলা যায়।
শুধু আমিই নিশ্চিত যে এটি একটি ট্রেনের হুইসেল। এতে কোন সন্দেহ নেই। আমি খুব শান্তভাবে অন্ধকারে শুয়ে পড়ি, যত দুরূহই হোক তবু শুনতে থাকি। অনেক চেষ্টা করে শব্দটা শুনি। বারবার শুনি। আমার হৃদয়ের একটানা কষ্ট থেকে যায়। ঘড়ির কাটাগুলো চলতে শুরু করে। ভালোভাবে ও ধীর গতিতে সমুদ্রের পাড়ের দিকে লোহার বাক্সটি উঠতে শুরু করে। এবং এর সব কিছুর জন্যই এই ক্ষীণ হুইসেল ধন্যবাদ পাবে। তুমি দেখো, হুইসেলটি এত ক্ষীণ যে সামান্যই তার শুনতে পাই। আসল কথা হলো, হুইসেলটি যতোটা গভীর ঠিক ততোটাই গভীর করে আমি তোমাকে ভালোবাসি’।
সেই সঙ্গে, ছেলেটির খুদে গল্পটি শেষ হয়। এবং মেয়েটি তার নিজের কথা বলতে শুরু করে।
অনুবাদক পরিচিতি
মৌসুমী কাদের
মৌসুমী কাদের
গল্পকার, অনুবাদক, সঙ্গীত শিল্পী।
টরেন্টো, কানাডাতে থাকেন।
টরেন্টো, কানাডাতে থাকেন।
10 মন্তব্যসমূহ
খুব ভাল গল্প। অনুবাদ প্রাঞ্জল।
উত্তরমুছুনবাহ! অপূর্ব!কাব্য পাঠ হলো যেনো
উত্তরমুছুনআহা, অসাধারণ! সব ঝকঝকে দেখতে পেলাম, ট্রেনের হুইসেলটি ও যেন শুনতে পেলাম। নিখাদ অনুবাদ।
উত্তরমুছুনখুব ভাল অনুবাদ !
উত্তরমুছুনদারুণ…
উত্তরমুছুনবাহ - সাবলীল চমৎকার অনুবাদ। গভীর নিস্তবদ্ধতায় ট্রেনের হুইসেলের ভালবাসাকে ভাষার বন্ধনের বাইরে নিয়ে আসা হয়েছে। অভিনন্দন।
উত্তরমুছুন- দীপেন ভট্টাচার্য
অসাধারণ গল্প।
উত্তরমুছুনএই হুইসিল কানে শোনার চাইতেও মনে বাজে বেশি।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
উত্তরমুছুন