বাঙলায়নঃ শাহানা আকতার মহুয়া
[পারচ্ জেততুনসিয়ান ১৯৩৪ সালে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে তাঁর পরিবার সোভিয়েত আর্মেনিয়ায় চলে আসে। ১৯৬৩ সালে জেততুনসিয়ান বিদেশী ভাষা বিষয়ে পায়াটিগোর্স্ক ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে পাণ্ডুলিপি লেখার ওপরে মস্কো থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। তাঁর প্রধান সাহিত্য কর্মগুলো হলঃ ‘হিজ ফ্রেন্ড’, ‘দ্যা ভয়েজেস অব আওয়ার নেইবারহুড’, ‘ফর প্যারিস (ছোটগল্প সংগ্রহ)’, ‘ক্লদ রবার্ট আইজারলি (উপন্যাস)। তাঁর লেখা ‘দ্যা লেজেন্ড অব দ্যা ডেস্ট্রয়েড টাউন’ এবং ‘দ্যা মোস্ট মেলাঙ্কলি ম্যান’ নাটক দু’ট মঞ্চস্থ হয় ইয়েরেভানের ড্রামাটিক থিয়েটারে।তিনি বেশ কয়েকটি আর্মেনিয়ান সিনেমার চিত্রনাট্যও রচনা করেন।]
যে কোনো সময় ওরা এসে পড়বে ...
‘সিগারেট আছে...?’
‘আমার মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে ... আমি মরতে চাই না ...।’
‘চুপ কর! কিচ্ছু হবে না ...।’
‘বাড়িতে এক বোতল হুইস্কি লুকিয়ে রেখে এসেছি ... কেউ যদি খুঁজে না পায়, তবে যুদ্ধ শেষে ফিরে গিয়ে হুইস্কি খাব ...’
‘জানতে চেয়েছি তোমার কাছে সিগারেট আছে কি না...’
‘এই শহরে একজন জুতো প্রস্তুতকারী আছে... যুদ্ধের পরে তার কাছে গিয়ে কাজ শিখব ...’
‘আচ্ছা, এখন কয়টা বাজে...?’
তারা ছিল অপরিচ্ছন্ন, বিমর্ষ এবং স্বল্পভাষী সৈনিক কিন্তু যখন কথা বলছিল তখন খুবই গুরুত্বহীন, ছোট ছোট বিষয় নিয়ে কথা বলছিল। সকলেই নিজেদের ব্যাপারে কথা বলতে চাইছিল। বেশিরভাগ সময় যুদ্ধের গল্পই ঘুরেফিরে আসছিল। এ নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ নেই, কেউ বলছিল না যে এই গল্পটা সে আগেও শুনেছে, বিরক্ত লাগলেও সবাই ধৈর্য্য ধরে শুনে যাচ্ছিল। আচমকা একজন থামিয়ে দিলঃ
যথেষ্ট হয়েছে! সেই একই কথা বারবার বলে যাচ্ছ!
ওরা একে অন্যের দিকে তাকাল চোখভরা প্রশ্ন নিয়ে। যে বলেছে সে ঠিক কথাই বলেছে। কিন্তু কে বলল কথাটা? সবাই সেই ব্যক্তিকে খুঁজল কিন্তু পেল না। উপস্থিত সকলেই কেবল নিজের নিজের গল্প বলতে চাইছিল।
এরইমধ্যে অন্য এক সৈনিক গল্প আরম্ভ করলঃ
আমি ঘরের কোনায় রাখা ওয়ার্ড্রোবটার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম (ঘরটা ছিল খোলামেলা এবং উজ্জ্বল…)।আমার স্ত্রী বলল এটা ঘরের কোনায় রাখার চেয়ে দরজার কাছে রাখা ভাল …
‘ওটা কি দরজার কাছে নিয়ে যাওয়া যায়নি?’ একজন সৈন্য কৌতুহলে জিজ্ঞেস করে।
এদের মধ্যে কিছু সৈনিক যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এখন তারা ভয় পাচ্ছে, কিছু একটা ঘটবে এই আশঙ্কা তাদেরকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।
“ওরা আসছে!” হত-বিহ্বলভাবে একজন চিৎকার করে বলল। এই কণ্ঠস্বর তাদের খুব পরিচিত কিন্তু ঠাহর করতে পারল না কার কণ্ঠ ...
তাদেরকে শাস্তি দেবার জন্য যে ব্রিগেড গঠন করা হয়েছে, তারা ভয়ঙ্করভাবে এগিয়ে এল।
কেউ একজন আদেশ দিল, “দাঁড়াও!”
তারপর বলল, শুয়ে পড়।
তারা শুয়ে পড়ল।
কেউ কিচ্ছু ভাবতে পারছিল না। একটু দূরে মাঠের মধ্যে দুইটি কুকুর মারামারি করছে। সবাই যেন চেষ্টা করল মনোযোগটা সেখানে নিয়ে যেতে। আচ্ছা, কুকুর দু’টি কি সত্যিই মারামারি করছে নাকি খেলছে?
একজন অফিসার কথা বলতে শুরু করে। তার দীর্ঘ বক্তব্য থেকে সৈনিকেরা একটা বিষয় বুঝতে পারল যেসামরিক আইন অনুযায়ী তাদেরকে বিশ্বাসঘাতক সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং প্রতি দশজনের মধ্যে থেকে একজনকে সামরিক আদেশ অমান্য করার দায়ে গুলি করে মেরে ফেলা হবে।
কেউ ভয় পেল না। ভাবলও না যে তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রতি দশজনে একজন হবে।
হঠাৎ নীরবতা ভেঙে কাঁপা কাঁপা একটা কণ্ঠ শোনা গেল⎯
আমি মরতে চাই না। ওরা আমাকে বাধ্য করেছে ...
এতক্ষণে যেন সৈনিকেরা ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছে। প্রতি দশ থেকে শেষ জনকে মরতে হবেঃ দশ নম্বর, বিশ নম্বর, ত্রিশ নম্বর যে হবে ... সব মিলিয়ে তারা সত্তরজন। এই সত্তরজনের মধ্যে থেকে সাতজন মারা যাবে ...
লাইনের প্রথম সৈনিক মৃদু হাসল। কারণ সে প্রথম। তাই নিশ্চিন্ত মনে অফিসারের দিকে তাকাল। বেঁচে গেছে সে! সবার প্রতি তার অশেষ কৃতজ্ঞতা। ব্রিগেডের যে অফিসারটি পকেটে হাত দিয়ে আয়েশ করে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে ঠিক সিনেমার নায়কের মতো লাগছে দেখতে।
মিলিটারি আদেশ মানবে না এমন সাহস কার? আর তারা তো আহামরি কোন পদে চাকুরি করত না, নিতান্তই সৈনিক। যারা আদেশ অমান্য করেছে, তাদেরকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। সৈনিকটি ভীত, লজ্জিত হয়ে পকেট থেকে হাত বের করে মাটিতে চোখ নামাল। এক নম্বর তখনো চিন্তা করছিল সেই অফিসারটিকে সত্যিই সিনেমার নায়কের মতো লাগছিল কি না।
দুই নম্বর আর তিন নম্বর সৈনিক বিশ্বাস করতে পারছিল না যে তারা মরবে না। তারা গুণতে থাকল এক, দুই... সে দুই নম্বর ... এক ... দুই ... তিন ...। সে তিন ... তা সত্ত্বেও অযথাই তারা একে অন্যকে ঈর্ষা করতে লাগল। প্রথম, দ্বিতীয় অথবা তৃতীয়কে মারা হবে না, তবুও তারা সবাই প্রথম, কেবলমাত্র প্রথম জনকেই ঈর্ষা করতে লাগল। অন্য কোনো কারণ নয়, শুধুমাত্র তার প্রথম অবস্থানের জন্যই।
বাকি সৈন্যরা অপেক্ষা করছিল কারণ তারা তাদের নম্বর জানে না। উঁচু গলায় তারা গুনতে শুরু করল। হঠাৎ স্তিমিত হয়ে এল একেকজনের কণ্ঠ।
এক ...
নয় নম্বর সৈন্য বিবর্ণ হয়ে গেল। আহ্! একটুর জন্য বেঁচে গেল সে! দশ নম্বর সৈন্যের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল সে। আচ্ছা, ভুল করে যদি তাকেই দশ নম্বর হিসেবে গুনে ফেলত! উফ্! বড্ড বাঁচা বেঁচে গেছে!
এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ ...
যাই হোক, সংখ্যার ভিন্নতা মোটেই অগ্রাহ্য করার মতো ব্যাপার নয়। যদি তা-ই হতো তাহলে নবম সংখ্যাটি নাও থাকতে পারত। বিষয়টা আবিষ্কার করে তার মুখে মৃদু হাসি ফুটল।
যদি তাদের মধ্যে পার্থক্য না থাকে তবে ...
সৈনিকরা গুনছে⎯
ষোল...
সতের ...
আঠার ...
উনিশ ...
উনিশ নম্বর বিব্রতবোধ করল আর করুণা বোধ করল বিশ নম্বরের জন্য। যুদ্ধ শেষে ওই লোকটির পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়ে চিঠি লিখতে হবে, তাদের সাথে দেখা করতে যাবে আর যথাসাধ্য সাহায্যও করবে। সে খুশি যে সে বিশ নম্বর হয়নি ... তাকে মরতে হবে না। মানুষ যে আসলে কত নিচ আর কাপুরুষ! সে নিজেকে সবসময় সৎমানুষ বলে ভেবে এসেছে। জীবনে এই প্রথম নিজের ভেতরের রূপ দেখে চমকে উঠল।
না, আমি মরতে চাইনা, মরতে চাইনা ... ভয়ার্ত গলায় কেউ একজন ডুকরে উঠল। সৈনিকরা ভ্রুক্ষেপ না করে গুনে যেতে থাকে ⎯
ছাব্বিশ ...
সাতাশ ...
আঠাশ ...
উনত্রিশ ...
উনত্রিশ নম্বর মৃদু হাসল ।
সে জীবনের প্রতি গভীরভাবে বিশ্বাসী একজন মানুষ, প্রতিদিন প্রার্থনা করে, প্রতি রবিবার ছেলেমেয়েদের নিয়ে গীর্জায় যায়। শিশুদেরকে খুশি করার জন্য মিষ্টি কিনে দেয়। তার স্ত্রীর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল চার্চেই, যিশুর ছবির নিচে দাঁড়িয়ে তারা একে অন্যের দিকে চেয়ে হেসেছিল। একদিন তারা পরস্পরের হাত ধরেছিল, চুমু খেয়েছিল। তাদের মনে হয়েছিল স্বয়ং যিশু যেন দু’জনকে দেখে প্রীত হয়েছেন। ত্রিশ নম্বর না হয়ে উনত্রিশ নম্বর হওয়ার এটাই কারণ। প্রথম থেকেই তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে সে বেঁচে যাবে। আনন্দে চিৎকার করে সবাইকে বলতে ইচ্ছে করছিল- “ভ্রাতৃগণ, তাকে বিশ্বাস কর, একমাত্র তিনিই পারেন তোমাদের রক্ষা করতে!”
কিন্তু স্রষ্টার কাছে এইটুকু চাওয়াতে সৈনিকেরা সন্তুষ্ট হবে বলে মনে হয়না। তাই চাওয়াটা বাড়াল⎯ ‘ঈশ্বর, যুদ্ধ থেকে আমাদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনো… ফিরে গিয়ে ভাল একটা চাকুরি খুঁজব… ধনী হবো … জীবনকে মোটামুটি উপভোগ করে আধুনিকমনস্ক একজন বৃদ্ধ হয়ে মারা যেতে চাই…তবে সবকিছুর বিনিময়ে তোমাকে আমি বিশ্বাস করব … প্রার্থনা করব … পিতা-পুত্র এবং পবিত্র আত্মার নামে। বোঝোই তো, এখন খুব কম মানুষেরই বিশ্বাস আছে তোমার ওপর। আমেন …।
ছত্রিশ …
সাঁইত্রিশ …
আটত্রিশ …
উনচল্লিশ …
উফ্! আরেকটুর জন্য চল্লিশ নম্বর হয়নি ভেবে বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল উনচল্লিশ নম্বর।
কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল। চল্লিশ নম্বর তার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একসাথে দু’জনে স্কুলে পড়েছে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। একসাথে কষ্ট আর আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছে। এইতো, এখনো তারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। আহারে! বন্ধু তার পাশে না দাঁড়ালে তো চল্লিশ নম্বর হতো না । বুকের ভেতরে চিনচিনে একটা কষ্ট… নিজেকে শান্ত রাখতে বড় করে নিঃশ্বাস টানে সে… আনন্দ লাগছে…বেঁচে থাকার আনন্দ। না, তাকে কেউ দোষ দিতে পারবেনা। সবসময় খুব ভাল সম্পর্ক থাকলেও অনেকদিন আগে একবার সে বন্ধুটির সাথে বেশ খারাপ আচরণ করেছিল। তারা দু’জনেই তখন হন্য হয়ে চাকরি খুঁজছিল, একবার একটা চাকরির সন্ধান পেয়ে বন্ধুকে না জানিয়েই সে ওখানে গিয়েছিল। অনুতাপ যে হয়নি, তা নয় কিন্তু নিজেকে প্রবোধ দিয়েছিল; মানুষমাত্রই ভুল করে আর সে তো খুবই সাধারণ একজন মানুষ। নাহ্! মাথা থেকে বিষয়গুলো জোর করে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল সে। এসব ভাবনা এখন যথার্থই গুরুত্বহীন, গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোই যেগুলো সে বন্ধুর জন্য করেছে। তার আশেপাশে যারা আছে তারা যদি তার মনটা পড়তেপারত, তাহলে বুঝত সে কতটা কাপুরুষ! সব বুঝেও নিজেকে সুস্থির রাখার চেষ্টা করে সে; সত্যিই সে খারাপ একজন মানুষ, খারাপ বন্ধু।
ছেচল্লিশ …
সাতচল্লিশ …
আটচল্লিশ …
উনপঞ্চাশ …
উনপঞ্চাশ নম্বর মানুষটি মৃত্যুর হাত থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও সে তেমন অভিভূত হলনা। প্রথম থেকেই তার কেন যেন মনে হচ্ছিল এভাবে তার মৃত্যু হতে পারেনা- দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত যে সে একজন সৎমানুষ এবং একজন সৎমানুষের মরণ …
হঠাৎ অফিসারের গলা শোনা গেল।
থামো, থামো! একটু ভুল হয়েছে। চল্লিশ নম্বর থেকে আবার গোনো তো…
এবার পরিষ্কার হলো যে আসলে পঞ্চাশ নয়, ওটি হবে উনপঞ্চাশ … আর একান্ন নম্বরটি হবে পঞ্চাশ। তাহলে তাকে এভাবেই মরতে হচ্ছে! সে একজন সৎমানুষ, তাইতো তাকে এভাবে প্রাণ হারাতে হচ্ছে …
আগের পঞ্চাশ নম্বর এখন একান্ন ...লোকটি অন্যদেরকে তেমন চিনতনা, তবুও সে খুবই বিড়ম্বিত বোধ করল। মনে হল সবকিছুর জন্য বোধহয় সেই-ই দায়ী। ফিসফিস করে বলল,
আমি … আমি কোনো দোষক রিনি …
মনে হচ্ছিল তার এই বেঁচে যাওয়াটা তার পাশে থাকা মানুষটির জন্য বিশ্রি একটা আঘাত।
সম্ভবত… হতে পারে … আমাকেও মরতে হবে… যুদ্ধ থেকে খুব কম যোদ্ধাই নিরাপদে ফিরতে পারে …
ছাপ্পান্ন ...
সাতান্ন ...
আটান্ন ...
উনষাট ...
আমি মরতে চাই না... বিশ্বাস করো, আমাকে জোর করা হয়েছিল... ষাট নম্বর সৈনিক হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো বলতেই থাকে। লোকটির জন্য কারো তেমন মায়া হলো না, তাদের সমস্ত করুণা যেন সত্তর নম্বরের জন্য। দশ নম্বর, বিশ নম্বর, ত্রিশ নম্বর, সকলেই হিসাব করার আগ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে না বলে একটুখানি আশা ছিল। তারা প্রতি দশজনে একজন না-ও হতে পারে বলে বিশ্বাস নিয়ে ছিল। কিন্তু সত্তর নম্বরের ক্ষেত্রে এমনটি হবে না।
আহা বেচারা! সত্তর নম্বর সৈনিক যে শেষ সৈনিক এ বিষয়ে ভুল হওয়ার কোনোই অবকাশ নেই।
0 মন্তব্যসমূহ