লুসিয়া বার্লিনের গল্প : ফ্রেন্ডস

অনুবাদ : মৌসুমী কাদের

লরেটা যেদিন স্যামে'র জীবন বাঁচালো সেদিনই প্রথম অ্যানা ও স্যামের সাথে পরিচয় হলো ওর।
অ্যানা ও স্যাম এই দম্পতির দুজনই যথেষ্ট বৃদ্ধ। অ্যানার বয়স ৮০ আর স্যামের ৮৯। প্রতিবেশী ইলেইনের সুইমিংপুলে সাঁতার কাটতে যাওয়ার সময় প্রায়ই লরেটার সঙ্গে অ্যানার দেখা হতো।
একদিন, দুজন বৃদ্ধা আরেকজন বৃদ্ধকে সাঁতার কাটতে রাজী করানোর খুব চেষ্টা করছে দেখে লরেটা কৌতুহলী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভদ্রলোক মুখে আত্মবিশ্বাসের হাসি ফুটিয়ে শেষপর্যন্ত পানিতে নেমে পড়্ল। এবং ঠিক তক্ষুনি খিঁচুনী শুরু হওয়ায় বৃদ্ধলোকটি কুকুরের মতন হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতার কাটতে লাগলো। সে সময় বৃদ্ধা দুজন অগভীর জলের দিকে থাকায় ব্যাপারটা ঠিকমত লক্ষ করেনি। লরেটা দৃশ্যটা দেখামাত্রই জুতো জামাকাপড়সহই ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং লোকটিকে টেনে সিঁড়িতে তুলে শেষে পুলের বাইরে নিয়ে এলো। ভদ্রলোকের জ্ঞান ফেরানোর দরকার ছিল না, কিন্তু তাকে বিভ্রান্ত ও ভীত দেখালো। মৃগী রোগের জন্য ওকে কিছু অসুধ খেতে হলো। ওরা সবাই মিলে ওকে ভেজা গা শুকাতে সাহায্য করলো এবং নিচের ব্লকে নিজের বাড়িতে হেঁটে যাওয়ার মতো সুস্থ হওয়া পর্যন্ত ঘিরে বসে থাকল। অ্যানা ও স্যাম বারবার লরেটাকে স্যামের জীবন বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ দিলো এবং পরের দিন দুপুরে ওদের বাড়িতে মধ্যাহ্ন ভোজে যাওয়ার জন্য জোর করতে লাগলো। 

ঘটনাক্রমে লরেটারও কয়েকদিনের জন্য কোন কাজ ছিল না। অনেকগুলো ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় কিছু কাজ জমে ছিল বলে সে তিন দিন বিনা বেতনে ছুটি নিয়েছিল। ওঁদের সঙ্গে একসাথে মধ্যাহ্ন ভোজন মানেই হচ্ছে শহর ছেড়ে অনেকটা পথ দূরে বার্কলেতে যাওয়া, এবং একসাথে সব কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হওয়া, যেমনটা সে করার পরিকল্পনা করে রেখেছিল। 

এধরনের পরিস্থিতিতে লরেটা প্রায়ই অসহায় বোধ করত। এমন অবস্থায় নিজেকে বলতে হতো,  ‘ইশ্বর...! ওরা কত ভাল মানুষ, ওদের জন্য আমি এটা খুব সামান্যই করতে পারছি’। যদি তুমি একাজটি না করো তাহলে অপরাধবোধে ভুগবে; আর যদি করো তাহলে নিজেকে ‘বোকা’ মনে হবে’। 

ঘন্টাখানেক পর, ক্লান্ত অবস্থায়, সে তার ওকল্যান্ডের বাড়িতে ড্রাইভ করে যাবে এবং নিজেকে বলতে থাকবে, এমন কাজ সে বারবার করতে পারবে না। 

এপার্টমেন্টে ঢোকার সাথে সাথেই লরেটার ‘মেজাজ খারাপ’ হওয়াটা থেমে গেল। বাড়িটা রোদেলা, উন্মুক্ত, মেক্সিকোর সেই পুরনো বাড়িটার মত, যেখানে ওরা জীবনের অনেকটা সময়ই কাটিয়েছিল। অ্যানা একজন প্রত্নত্বাত্ত্বিক এবং স্যাম একজন প্রকৌশলী।  ওরা টিয়োটিহকান এবং অন্যান্য সাইটে প্রতিদিন একসাথে কাজ করত। ওদের অ্যাপার্টমেন্টটি ভরা ছিল মাটি্র পাত্র, ফটোগ্রাফ এবং একটি চমৎকার লাইব্রেরি দিয়ে। নিচে, বাড়ির পিছনের দিকের উঠোনটায় একটা বড় সবজি বাগান, অনেক ফল গাছ, যেমন বেরী ফল। লরেটা অভিভূত হয়ে লক্ষ করল, পাখির মতো কোমল দুটো মানুষ নিজেরাই নিজেদের সব কাজ করে ফেলছে। ওঁরা দুজনই হাঁটার জন্য লাঠি ব্যবহার করছিল এবং অনেক কষ্ট করে চলাফেরা করছিল। 

মধ্যাহ্ন ভোজের তালিকায় ছিল টোস্ট চিজ স্যান্ডুইচ, চায়োটে সূপ, আর বাগান থেকে তুলে আনা সালাদ। খাবার তৈরী, টেবিল সাজানো এবং পরিবেশনা সব কাজই অ্যানা আর স্যাম দুজনে মিলে একসঙ্গে করছিল।

গত পঞ্চাশ বছর ধরে ওরা সবকিছু একসঙ্গে করছিল। জমজের মতন একে অন্যের প্রতিধ্বনি অনুসরণ করছে বা একজনের শুরু করা বাক্য আরেকজন শেষ করছে। খাবারের সময়টা মনোরমভাবে কেটে গিয়েছিল যেহেতু ওরা স্টেরিও ব্যবহার করে গল্প বলছিল। মেক্সিকোতে থাকাকালীন সময়ে পিরামিডের উপর করা ওদের কিছু কাজের অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য আরো যে সব খননকাজ করেছিল সেসব নিয়ে কথা বলছিল ওরা। সঙ্গীত এবং বাগান নিয়ে এদুজন বৃদ্ধের ভালবাসাময় জীবন ভাগাভাগি এবং একে অপরকে উপভোগ করা দেখে লরেটা অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া স্থানীয় এবং জাতীয় রাজনীতিতেও ওরা যেভাবে জড়িত ছিল, যেমন মিছিল এবং প্রতিবাদ সমাবেশে যাওয়া, কংগ্রেসম্যান ও সম্পাদকদের সাথে যোগাযোগ করা, ফোন কল করা, এসব দেখেও লরেটা খুব বিস্মিত হলো। ওরা প্রতিরাতে একজন আরেকজনকে উপন্যাস অথবা ইতিহাস থেকে তিন বা চার পৃষ্ঠা পড়ে শোনাত। 

স্যাম যখন ওঁর কাঁপা কাঁপা হাতে টেবিল পরিষ্কার করছিল, লরেটা তখন অ্যানাকে বললো, এমন ঘনিষ্ঠ একজন জীবনসঙ্গী পাওয়া সত্যিই ঈর্ষণীয়; 

‘হ্যা,’ অ্যানা বললো, তবে শিঘ্রীই আমাদের একজনকে চলে যেতে হবে..

লরেটা অনেক পরে এই কথাটা মনে করতে পেরেছিল এবং বিস্মিত হয়েছিল যে অ্যানা তার সাথে এমন একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলা শুরু করেছিল যেন ওদের একজনের মৃত্যু হলে সে সময়টায় লরেটা ইনস্যুরেন্স পলিসির মতন কাজ করবে। 

কিন্তু, না, সে যা ভেবেছিল, এটা তার চেয়ে সহজ ছিল। ওরা দুজনেই এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল, যে সারা জীবনই একে অপরের জন্য যথেষ্ট ছিল, কিন্তু ইদানীং স্যাম বেশ স্বপ্নপ্রবণ এবং অসংলগ্ন হয়ে উঠছিল। ও এক গল্প বারবার পড়ত, যদিও অ্যানা সবসময়ই ওঁর সাথে যথেষ্ঠ ধৈর্য্য ধারণ করত। কথা বলার মত কেউ একজন থাকায় অ্যানা খুশী ছিল বলে লরেটা অনুভব করেছিল। 

কারণ যাই হোক, স্যাম ও অ্যানার জীবনে সে নিজেকে বেশি জড়িয়ে ফেলেছে বলে মনে করে। ওঁরা গাড়ি চালানো বন্ধ করে দিয়েছিল। অ্যানা প্রায়ই লরেটাকে ওর অফিসে ফোন করে বাগানের জন্য মাটি নিয়ে আসতে বলত, অথবা স্যামকে চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে বলত। কখনও কখনও ওরা দুজনেই খুব অসুস্থ অনুভব করত এবং দোকানে যেতে পারত না, তখন লরেটা ওদের জন্য নানা জিনিষ কিনে নিয়ে যেত। লরেটা ওদের দুজনকেই  খুব পছন্দ করত এবং প্রশংসা করত। 

যেহেতু তারা অনেক বেশী সাহচর্য্য চাইতো, তাই সে সপ্তাহে একদিন ওদের বাড়িতে নৈশ ভোজে যেত, সেটা সম্ভব না হলে কম করে হলেও দুসপ্তাহে একবার যেত। কয়েকবার সে নিজের বাড়িতে নৈশভোজের জন্য ওদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, কিন্তু এখানে আসতে ওদের অনেকগুলো সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয় এবং দুজনই ভীষন ক্লান্ত বোধ করে; সেকারণে ওদের আসতে বলাটা থামিয়ে দিয়েছে সে। তারপর থেকে মাছ বা মুরগি, বা পাস্তা রান্না করে সে ওদের বাড়িতে নিয়ে যেত। ওরা সালাদ তৈরী করত আর খাবার শেষে মিষ্টান্ন হিসেবে বাগান থেকে তোলা জামের মত রসালো বেরী ফল পরিবেশন করত।

সবশেষে পুদিনা পাতা অথচা জ্যামাইকান চা নিয়ে যখন ওরা টেবিল ঘিরে বসতো তখন স্যাম নানারকম গল্প করত। ইউকাটানের গভীর জঙ্গলে অ্যানার যখন পোলিও হয়েছিল তখন কিভাবে ওরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল এবং সেখানকার জনগণ কতটা দয়ালু ছিল, সেসব। অথবা মেক্সিকোর হালাপায় তারা যে বাড়িটি তৈরী করেছিল তা নিয়েও অনেক গল্প হতো। মেয়রের স্ত্রী যখন পরিদর্শক এড়ানোর জন্য জানালা বেয়ে উঠতে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলেছিল, সে গল্পও। স্যামের গল্পগুলো সবসময় শুরু হতো এই বলে যে ‘এটা আমাকে সেই সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয় যখন...’

অল্প অল্প করে লরেটা বিস্তারিতভাবে ওদের জীবন সম্পর্কে জানতে পারলো; যেমন, মাউন্ট ত্যামে'র প্রতি ওদের ভালোলাগা, কমিউনিস্ট থাকাকালীন সময়ে নিউইয়র্কে ওদের রোমান্টিক প্রেম ও বিবাহ বহিভূর্ত একত্রবাস, ইত্যাদি। ওদের কোনদিন বিয়ে হয়নি, এবং এই অ-প্রথাসিদ্ধ জীবনেই ওরা সন্তুষ্ট। ওদের দুটো ছেলেমেয়ে আছে এবং দুজনেই দূরের শহরে থাকতো। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার মধ্যভাগে 'বিগ সার' নামক  নির্জণ এক অঞ্চলের 'ঘোড়ার খামার' নিয়ে অনেক গল্প আছে , যখন ওদের ছেলেমেয়েরা অনেক ছোট ছিল। 

যেহেতু স্যামে'র গল্প প্রায় শেষ হয়ে আসছিল, তাই লরেটা বলে উঠলো, ‘যেতে হবে এটা ভাবতেই বিরক্ত লাগছে কিন্তু উপায় নেই কাল খুব সকালে কাজে যেতে হবে’। ‘প্রায়ই এরকম তাকে চলে যেতে হত। তারপরও প্রায় সময়ই স্যাম বলে উঠত, ‘শুধু আমাকে বলতে দাও সেই উইন্ড-আপ ফোনোগ্রাফ রেকর্ড প্লেয়ারটার কি হয়েছিল’। এক ঘন্টা পর, বিদ্ধস্ত অবস্থায়, লরেটা গাড়ি চালিয়ে ওকল্যান্ডের বাড়িতে ফিরে আসে আর নিজেকেই নিজে বলতে থাকে এমনটা সে চালিয়ে যেতে পারে না। সে যাবে, কিন্তু সেটা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। 

তার মানে এই নয় যে ওরা অনেক  একঘেয়ে বা নীরস জীবনে ছিল। বরং এই দম্পতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ-পরিপূর্ণ ও একটি অন্তরঙ-অনুভূতিময় সম্পর্কে ছিল। ওরা ওদের ‘অতীত ও গোটা পৃথিবী’ নিয়ে গভীর ভাবে আগ্রহী ছিল। অন্যের মন্তব্য, তারিখ বা বিবরণ নিয়ে ওরা এমনভাবে বাদানুবাদ করত যে, ওদের সময়টা খুব ভাল কেটে যেত। ওদের কোন কাজে বাঁধা দিতে বা ছেড়ে যেতে লরেটার মন সায় দিত না। ওদের ওখানে যেতে ওর ভালই লাগতো, কারণ ওরা লরেটাকে দেখলে ভীষন খুশী হতো। কিন্তু মাঝে মাঝে তার একেবারেই যেতে মন চাইতো না, বিশেষ করে যখন সে ভীষন ক্লান্ত থাকত অথবা অন্য কোন কাজে ব্যস্ত থাকত। শেষপর্যন্ত লরেটাকে জানাতেই হলো যে এত রাত পর্যন্ত তার পক্ষে থাকা সম্ভব না, কারণ পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে ওর কষ্ট হয়। 

‘রবিবারে ব্রাঞ্চে আসো’, অ্যানা বলল।

আবহাওয়া যখন ফুরফুরে, তখন ওরা বারান্দার টেবিলে বসে খেতো। ওদের চারপাশ ঘিরে থাকতো ফুল আর গাছপালা। খাবারের লোভে শত শত পাখি উড়ে এসে বসতো ওদের পাশে। শীত বাড়ার সাথে সাথে ওরা ঘরের ভেতরে লোহার চুলার পাশে বসে খেতো। স্যাম নিজেকে বেশ একটু দূরত্বে সাবধানে রেখে চ্যালাকাঠগুলো চুলায় ঢুকিয়ে দিতো। খাবারের জন্য স্যামের বানানো স্পেশাল ওমলেট বা ওয়াফেল ছিল। মাঝে মাঝে লরেটা বেগেল আর তার উপরে ছিটিয়ে দেবার জন্য টপিং নিয়ে আসতো। স্যামের গল্প শুনে ঘন্টার পর ঘন্টা, এমনকি সারাদিন কেটে যেত, গল্পের ফাঁকে ফাঁকে অ্যানা মাঝে মাঝে স্যামকে শুধরে দিত অথবা কোন মন্তব্য জুড়ে দিতো। কখনও কখনও বারান্দার রোদে অথবা চুলার গরমে, জেগে থাকাটা খুব কঠিন ছিল।

ওদের মেক্সিকোর বাড়িটা কংক্রিট ব্লক দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল, কিন্তু মূল কাঠামো, কাউন্টার এবং আলমারি গুলো ছিল ‘সিডার কাঠ’ দিয়ে তৈরি। প্রথমেই বানানো হয়েছিল বড় ঘরটি, যেখানে রান্নাঘর এবং বসার ঘর ছিল। বাড়িটি তৈরীর অনেক আগে থেকেই ওরা গাছ লাগাতে শুরু করেছিল। কলা, পামট্রি, ‘জাকারান্দা বেগুনী ফুল, ইত্যাদি। পরের বছর আরেকটি শোবার ঘর; এবং আরও কয়েকবছর পর আরো একটি শোবার ঘর ও অ্যানার জন্য একটি স্টুডিও তৈরী করা হয়েছিল। বিছানা, কাজ করার সুবিধার জন্য একটি বেঞ্চ এবং টেবিলগুলো সব সিডারকাঠ দিয়ে বানানো হয়েছিল। মেক্সিকোর আরেকটি রাজ্যে ক্ষেতের কাজ সম্পন্ন করে ওরা ওদের ছোট্ট বাড়িটিতে এসে পৌছুল। বাড়িটি সবসময় শীতল থাকতো আর সিডার কাঠের সুঘ্রাণ ছড়াতো, যেন বাড়িটার বুকের ভেতর ‘সিডার’ গাঁথা ছিল। 

অ্যানার নিউমোনিয়া হলো আর ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। যতই অসুস্থ হোক না কেন ও শুধু স্যামের কথাই ভাবতো, কি করে স্যাম তাকে ছাড়া থাকবে। লরেটা অবশ্য তাকে প্রতিজ্ঞা করেছিলো যে কাজে যাবার আগে একবার সে স্যামের ওখানে ঢু মারবে এটা দেখতে যে, সে সময়মত অসুধ খাচ্ছে বা রাতের খাবার ঠিকমত খেয়েছে। কাজ শেষে রাতে সে স্যামের জন্য খাবার রান্না করে দেবে এবং তারপর হাসপাতালে নিয়ে যাবে অ্যানাকে দেখতে। 

সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার যেটা হল, স্যাম কথা বন্ধ করে দিল। লরেটা ওঁকে কাপড় পড়তে সাহায্য করবে একথা ভেবে সে বিছানার এক কোনায় বসে কাঁপতে থাকত। যন্ত্রের মত স্যাম অসুধগুলো খেত, আনারসের জুস খেত এবং সকালের নাস্তা শেষে খুব সাবধানে থুতনিটা মুছে নিত। সন্ধ্যায় লরেটা ওদের বাড়ি পৌছে দেখত, স্যাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। স্যাম সবার আগে অ্যানাকে দেখতে যেতে চাইত, তারপর ফিরে এসে রাতের খাবার খেত। ওরা সেদিন হাসপাতালে পৌছে দেখতে পেল যে অ্যানা ফ্যাকাশে-ম্লান অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছে। ওর লম্বা সাদা চুলের বিনুনীটা শিশুর মতন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। হাতে স্যালাইন, শরীরে মূত্রনিষ্কাশন ও অক্সিজেন যন্ত্র লাগানো।  অ্যানা কথা বলছিল না, কিন্তু হেসেছে, যখন স্যাম ওর হাতটা ধরে বলছিল কিভাবে ও একগাদা কাপড় ধুঁয়েছে, টমেটোর গায়ে জল ঝিটিয়েছে, মটরশুটির শিকড়ে খড়-লতাপাতা গুলো ছড়িয়ে দিয়েছে, ধালাবাসন মেজেছে, লেমোনেড বানিয়েছে.....।  স্যাম অ্যানার সাথে রূদ্ধশ্বাসে কথা বলেছে, দিনের প্রতিটি ঘন্টার বর্ণনা দিয়েছে । ওরা যখন ফিরছিল, তখন লরেটা স্যামকে আঁকড়ে ধরে ছিল। স্যাম হাঁটতে হাঁটতে হোচট খাচ্ছিল বারবার। বাড়িতে যাবার সময় গাড়িতে বসে কাঁদছিল সে এবং অ্যানার জন্য অনেক বেশী চিন্তিত ছিল। 

অ্যানা বাড়ি ফিরল। বাগানে অবশিষ্ট কিছু কাজ বাকি ছিল। এটা ছাড়া আর সবকিছু নিয়ে অ্যানা ভালই ছিল। পরের রবিবার জলখাবারের পর লরেটা ওদের বাগানে আগাছা কাটতে সাহায্য করলো। পেছনে কালজাম জাতীয় বেরী ফলগাছের লতাগুলো কাটলো। সে খুব চিন্তায় ছিল যে, অ্যানা না আবার অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে?

নিজেকে পশ্ন করে সে, এই বন্ধুত্বে কেন আছে সে? এই দম্পতির একে অপরের উপর নির্ভরশীলতা, দুর্বলতা, দু:ক্ষ পাওয়া, এসব কিছুই তাকে তাড়িত করছে। 

অফিস শুরু করার পর এসব চিন্তা মাথা থেকে সরে গেল; সেই শীতল কালো ধূলা, পেছনে হেলানো সূর্য, সবকিছুই তার ভাল লাগছিল। স্যাম এমনভাবে ওর গল্প বলছিলো, যেন একইসঙ্গে সে জীবনকে আগাছামুক্ত করছিল। 

পরের রবিবার অ্যানা আর স্যামের বাড়ি পৌছুতে লরেটার অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। সে অনেক ভোরেই উঠেছিল, কিন্তু নিজের বাড়িতেও তো কত কাজ থাকে। সত্যিই সেদিন সে বাড়িতে থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু ওদের ফোন করে যাওয়াটা বাতিল করার সাহস হয়নি। 

রোজকারমত সেদিনও সামনের দরজায় ছিটকিনি দেয়া ছিল না, তাই সে বাগানে যেতে পারলো। উপরে এবং পেছনের সিঁড়িতেও যেতে পারল। চারদিকটা একটু ঘুরে দেখার জন্যই সে বাগানে ঢুকেছিল। টমেটো, লাউ আর মটরদানাগুলো লকলকিয়ে বেড়ে উঠছিল। তন্দ্রায় ঢুলু ঢুলু মৌমাছি। অ্যানা ও স্যাম দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। 

লরেটা ওদের ডাকবে ভেবেছিল কিন্ত ওরা খুব মগ্ন হয়ে কথা বলছিল। 

‘আগে কখনই মেয়েটা দেরী করে আসেনি। হয়ত সে আসবে না।’

‘ওহ, সে আসবে...এই সকালগুলো তার কাছে ভীষন অর্থবহ।’

‘বেচারা। সে খুবই একা। আমাদেরকে তার ভীষন প্রয়োজন। আমরা সত্যিই ওর একমাত্র পরিবার।’

‘সে নিসন্দেহে আমার গল্প উপভোগ করে। ড্যাং, কিন্তু তাকে বলার মতন আজ আর একটি গল্পও মনে করতে পারছি না।’ 

‘কিছু একটা তোমার মাথায় আসবে...’


‘হ্যালো! লরেটা জোরে ডাক দিলো। ‘কেউ বাড়ি আছে?’





অনুবাদকের পরিচয়

মৌসুমী কাদের
গল্পকার। অনুবাদক। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ