লুসিয়া বার্লিনের গল্প : বিএফ ও আমি

বাংলায়ণ : অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায়

আমার তাকে সেই প্রথম মুহূর্তেই ভালো লেগে গিয়েছিল। সেই প্রথমবার ফোনে কথা বলার সময়ে। কাঁচভাঙ্গা'র মত কাটাকাটা, নদীর মত বয়ে চলা, প্রাণময় ছলবলে কণ্ঠ। আর তাতে মিশে আছে সুরেলা হাসি আর যাবতীয় যৌন-ছলা।
মানুষকে যখন তার কণ্ঠ বাবদ বিশ্লেষণ করি, তা' কেমন হয় তাই বলছি। ভাবছি- টেলিফোন কোম্পানির সেই ইনফর্মেশন-মহিলাটির কথা। একটু বেশীই কেতাদুরস্ত, নিয়মমাফিক। অবশ্য সে কোন রিয়েল মানবী নয় একথাও সত্যি। আর কেবল-কোম্পানির ওই লোকটি, যে বলে চলে- আমাদের আনুকূল্য তাদের ব্যবসার পাথেয়, তারা আমাদের সেবা দিতে চায়- খেয়াল করবেন তার গলায় এক টিটকিরি-সুলভ ভাব যেন কিরকম সদা-স্পষ্ট। 

আমি ছিলাম হাসপাতালের সুইচবোর্ড অপারেটার। সারাদিন ধরে কাজ শুধু ডাক্তার'দের কথা বলে যাওয়া,  যে ডাক্তার দের কিনা আমি চোখেই দেখিনি। আমার সহকর্মীদের সবারই একজন করে পছন্দের ডাক্তার ছিল। ছিল অপছন্দের ডাক্তারও ছিল। তাদের গলা আমরা এক্কেরে সহ্য করতে পারতামনা ।

কেউই আমাদের মধ্যে ডক্টর রাইটকে আগে কখনো দেখেনি। কিন্তু আমরা সবাই তার মোলায়েম, মখমলী কণ্ঠের প্রেমে পড়েছিলাম। তাকে যখনই পেইজ করার দরকার হত আমরা একটা খেলা খেলতাম। এটা ছিল একটা প্রতিযোগিতা। একটা ডলার-কয়েন টেবিলের সামনে রাখা হত। যে সবার আগে পৌঁছে তাকে পেইজ পাঠাতে পারত, সে ওই টাকাটা জিতত। দৌড়ে গিয়েই পেইজ করে বলতে হত - "হ্যালো ডক্টর রাইট, আই. সি. ইউ থেকে বলছি"।

ডক্টর রাইটকেই কেবল কখনো চোখে দেখিনি। কিন্তু যখন আমি এমারজেন্সিতে কাজ করার সুযোগ পেলাম, তখন বাকী সব ডাক্তারদেরকেই একে একে চিনতে পারলাম।  তাদের সঙ্গে আগে শুধু ফোনে  কথা বলেছি। আর খুব তাড়াতাড়িই বুঝে গেলাম যে এরা প্রত্যেকেই আমাদের কল্পনার সঙ্গে ঠিক অবিকল মিলে যাওয়া মানুষজন। সবচে ভালোমানুষ বলে যাদের আমরা ঠাউরে ছিলাম, তারা সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরত এবং স্বচ্ছ ও বিনীত গলায় উত্তর দিত। আর খারাপের দলে ছিল তারা যারা ফোন ধরে উঁচু গলায় কথা বলত। এরা ফোন ধরেই বলতে শুরু করত- "আমরা কি প্রতিবন্ধী লোকজনকে ফোন-অপারেটার কাজে বহাল করেছি? "

আমি সত্যিই জানি না, কিছু মানুষ কী'করে তাদের কণ্ঠে এটা আয়ত্ত করে। যেমন কারুর কণ্ঠে দেখবেন সবসময় সদ্য ঘুম-ভাঙ্গা এক জড়ানো স্বর লেগে আছে। আবার কারুর বা ঘুম পাওয়া গলা। টম হ্যাঙ্কস এর গলা শুনে দেখুন একবার । তারপর ভুলে যান। এবার শুনুন হার্ভে কিটেল এর স্বর। এরপরও যদি মনে হয় যে হার্ভে একটুও সেক্সি নয়, তবে চোখদুটোকে বন্ধ করে আরেকবার শুনুন।

তবে এখন কিন্তু আমার এই বয়েসে এসে দারুণ এক কণ্ঠস্বর তৈরি হয়েছে। আমি এখন একজন শক্তিময়ী নারী। কিন্তু আমার কণ্ঠস্বরের কারণে সবাই এখনো আমাকে শান্ত-ভঙ্গুর ভাবে। আমার গলা এখনো অল্পবয়েসীদের মত শোনায়। এই সত্তর বছর বয়েসেও।

পটারি বার্ণের দোকানের লোকরা তো আমার সঙ্গে রীতিমত ফ্লার্ট করে ফোনে। 'হেই- এই কার্পেট যদি কেনো, তো আমি চোখ বুজে বলতে বলতে পারি তুমি এখানেই শুয়ে থাকবে'… এইরকম ইঙ্গিত সব আর কি।

কয়েকদিন ধরে একজন লোক খুঁজছিলাম, আমার বাথরুমের টাইলস গুলো সারাবার ব্যাপারে। যেসব লোকরা কাগজে বিজ্ঞাপন দ্যায় ওই অড-জব, পেন্টিং এইসব কলামে, আমি দেখেছি তারা সত্যি সত্যি কিন্তু কাজ করতে চায়না। হয় তারা সব বুকড হয়ে থাকে, নয়ত তাদের ফোন একটানা মেশিন রেকর্ডিং এ উত্তর বলে যেতে থাকে। আর পেছনে অবশ্যই ওই মেটালিকা টাইপ কিছু একটা অনর্গল বাজে। আর তারা কখনোই ফিরতি ফোন করে না। বেশ বার-ছয়েক চেষ্টা করার পর বি.এফ কেই একমাত্র পেলাম যে অন্তত এটা বলল- সে আসবে। সে ফোনটা তুলল- 'হ্যাঁ, বি. এফ বলছি'। এবং হাসল। সত্যিই বেশ আস্তে করে। আমি তাকে বললাম যে আমার টাইলের কাজ আছে। তার উত্তরে সে বলল- নিশ্চয়ই আমিই তবে তোমার সে লোক। সে এও বলল সে যেকোনো সময়ই আসতে পারবে।

আমি ভেবে নিলাম যে তার বয়স কুড়ি মত হবে। সুদর্শন। শরীরে একটা-দুটো ট্যাটু আছে। চুলটা মনে হয় স্পাইকই হবে। আর কল্পনা করলাম তার আছে অবশ্যই একটি পিক-আপ ট্রাক এবং বড়সড় একটি কুকুর ।

সে যেদিন আসবে বলেছিল, সেদিন কিন্তু সে এলো না। কিন্তু পরের দিন ফোন করল। বলল- একটু আটকে গিয়েছিল। জানতে চাইল- বিকেলের দিকে আসতে পারে কিনা।
নিশ্চয়ই। বললাম আমি। 
একটু বিকেল করে সে এলো। আমি পিকাপ-ট্রাকটা দেখতে পেলাম। তারপরই দরজায় দুমদুম আওয়াজ শুনলাম। কিন্তু আমার দরজা অব্দি যেতে একটু সময় লাগল। আমার খুব বাজে ধরণের আর্থারাইটিস আছে। তাছাড়া আসার সময় অক্সিজেন সিলিন্ডারের হোসটা'তে আবার আমার পা জড়িয়ে গিয়েছিল। 'দাঁড়াও ঘোড়া-গাড়ি ছুটিওনা। আমি আসছি' - চিৎকার করে আওয়াজ দিলাম আমি।

বি এফ দেওয়ালটা ধরে দাঁড়িয়েছিল। সিঁড়ির তিন ধাপ পর্যন্ত উঠে- হাঁপাছিল আর ঘড়ঘড় করে কাশছিল। এ তো একজন বিশাল মানুষ। দীর্ঘদেহী, স্থূল এবং প্রায় বৃদ্ধ। আমি তার গায়ের গন্ধ পাচ্ছিলাম। যদিও সে তখনো বাড়ি'র বাইরেই ছিল। তামাক আর পশম কাপড় মিলে একটা গন্ধ। তার সাথে কড়া, সস্তা অ্যালকোহল আর ঘামের গন্ধের মিশেল। তার রক্তচক্ষুর মত চোখে হাল্কা নীল দুটো তারা। চোখদুটো হাসছিল। আমার সেই মুহূর্তেই তাকে ভালো লেগে গেল।

সে বলল-- আমার থেকে খানিকটা অক্সিজেন ব্যবহার করতে পারে। 
আমি তাকে বললাম- সিলিন্ডার না, তার আসলে একটা অক্সিজেন ট্যাঙ্ক নিয়ে চলাফেরা করা উচিত। 
সে উত্তরে বলল-- সেটা মুশকিল হবে, যদি সিগারেট ধরাতে গিয়ে নিজেকেই ট্যাঙ্ক সহ উড়িয়ে দ্যায়। 

সে ভেতরে ঢুকে এলো। তারপর সোজা বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। আমি একটি ট্রেইলারে থাকি। ফলে ওইটুকু জায়গায় কোথায় কি আছে আন্দাজ করা কোন কঠিন কাজ না। সে প্রায় দপদপিয়ে চলে গেল আমার ঘরের ভেতর দিয়ে। দেখলাম যে সে মাপ নিতে শুরু করেছে। আমি কিচেনে এসে বসলাম। আমি তখনো তার গায়ের গন্ধ পাচ্ছি। তার গায়ের গন্ধে আমার ঝট করে অনেকগুলো স্মৃতি ফেরত এসে গেল।  হঠাৎ যেন ঠাকুর্দা আর জন'কাকা একসঙ্গে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। কটূ গন্ধও তাই সুন্দর লাগে সময়-সময়। শ্যাওলা'র গায়ে স্কাঙ্কের ঝাঁঝালো বদ-বু। বা ঘোড়াশালে ঘোড়ার গু। বা চিড়িয়খানার বাঘ। চিড়িয়াখানার বাঘেদের সবচে ভালো দিক হোল এটাই, তাদের গায়ের এই বন্য গন্ধ। ষাঁড়ের লড়াই দেখতে গেলে যদিও আমি সবসময় উঁচু ধাপটায় বসার চেষ্টা করি যাতে অপেরার মত পুরোটা একসঙ্গে দেখা যায়। কিন্তু যদি আপনি বেড়ার ধার ঘেঁষে বসেন তবে কিন্তু আপনি তাদের গায়ের বুনো গন্ধটা পাবেন।

বি.এফ'কে যে আমার খুব আকর্ষণীয় লাগার  অন্যতম কারণ মনে হয় হোল- সে খুবই অপরিষ্কার। আমি থাকি বোল্ডারে। এ এমন শহর যেখানে খুঁজলেও এতোটুকু ময়লা পাবেন না। আমি অবাকই হলাম, ভাবলাম যে সে মদ্যপানই বা করে কোথায়? কারণ বোল্ডারে আমি সত্যিই কোন অপরিষ্কার পানশালা দেখিনি। আর তাকে দেখে যতটুকু বুঝে গেছিলাম তাতে আমি নিশ্চিত যে সে মাতাল হয়ে কথা-বার্তা বলতে খুবই পছন্দ করবে।

সে আপনমনে বাথরুমে একা একা বকে যাচ্ছিল। কখনো 'উঃ' , ' আহ' করে হাঁপাতে হাঁপাতে, কখনো ঝুঁকে ফ্লোরের লিনেন-ক্লসেট এর মাপ নিচ্ছিল। তারপর নীচু হয়ে বেরিয়ে এসে বলল যে তার লাগবে চুয়াল্লিশ বর্গ ফুটের মত। আমি বললাাম- কি কাণ্ড! আমি ছেচল্লিশ মত কিনেছি।

'তোমার দেখার চোখ বেশ ভালো। দু’জোড়া চোখই।' বলে সে তার বাদামী নকল দাঁতে একমুখ হাসল। 'বাহাত্তর ঘণ্টা এখানে হাঁটতে পারবে না।'

'তা কি করে হয়? এরকম কোথাও কখনো শুনিনি। জম্মেও শুনিনি যে বাথরুম সারানোর সময় লোকে হোটেল ভাড়া করে থাকে বা অন্যের বাড়ি গিয়ে অনুরোধ করে- আজ রাতটা থাকতে পারি প্লীজ?।'

'সে জানিনা, তবে এটাই ঘটনা। টাইলেস গুলো সেট হতে সময় লাগে। তার কারণ বেশীর ভাগ মানুষেরই, যারা টাইলসের কাজ করান, তাদের দুটো বাথরুমের ব্যবস্থা থাকে

'তাহলে যাদের একটা বাথরুম তারা তবে করেটা কি?' 

'তারা কার্পেটে'র ব্যবস্থা রাখে।'


আমি যখন এই ট্রেইলারটা কিনি তখন কার্পেটটা ভেতরেই ছিল। কমলা রঙের দাগ ধরা একটা কার্পেট।
'আমি ওই কার্পেট টা সহ্য করতে পারি না'।

'আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। এ পরিস্থিতিতে, তবে যাই কর না কেন বাহাত্তরটা ঘণ্টা না হলে ওখানে যেওনাকো ।''

'সে আমার পক্ষে সম্ভবই না। আমাকে ল্যাসিক্স খেতে হয় হার্টের কারণে। ফলে দিনে কুড়িবার আমায় বাথরুম ছুটতে হয়।'

'ওকে। তবে তাই কোরো, তোমার যা ভালো মনে হয়। আমাকে পরে দোষ দিওনা। আমি টাইলস এর কাজ খুব ভালো করেই করি।'

আমরা খরচা-খরচির দরাদরি করে একটা সমঝোতায় এলাম। সে বলল-- সে শুক্রবার সকালে আসবে। আমি নিশ্চিত অত নীচু হয়ে মাপজোক করে তার নির্ঘাত পিঠে ব্যাথা হয়ে থাকবে। এবার একটু হাওয়াবাতাসের দরকার ছিল তার। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বের হয়ে এলো। এসে প্রথমে কিচেন কাউন্টারের গায়ে একটু হেলান দিলো। তারপর বসার ঘরে স্টোভের গায়ে। আমি তার পেছন পেছন দরজা অবধি এলাম। সিঁড়ির শেষধাপে পৌঁছে সে একটা সিগারেট ধরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। 'তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভালো লাগল'- বলল সে। তার কুকুরটি শান্ত হয়ে অপেক্ষা করছিল তার ট্রাকটির ভেতর।

সে শুক্রবারে এলো না। তারপরেও এলো না। এমনকি ফোনও করল না। আমি শেষটায় তাকে রোববার ফোন করলাম। কোন উত্তর নেই। আমি কাগজের পাতাটা বের করে আবার সব অন্য নম্বর গুলোতেও চেষ্টা করলাম। কেউই ধরল না।

আমার কল্পনায় একটা দৃশ্য এলো। একটা ওয়েস্টার্ন বাথরুম। টাইল-মিস্ত্রীতে ভর্তি। সবাই হয় একটা বোতল না হয় একটুকরো কাঁচ, না হয় একটা কার্ডবোর্ড ধরে রেখেছে হাতে। আর তাদের মাথাগুলি নেতিয়ে পড়েছে ঘুমে। টেবিলের ওপরে।

সে কাল ফোন করেছিল। আমি হ্যালো বলতেই সে বলল- কেমন আছো এল. বি ?

'উফ। বি. এফ ! আমি ভাবলাম তোমার পাত্তাই পাবো না আর।'

'কাল যদি আমি আসি, চলবে?'

'সে তো ভালো কথা।' বলি আমি।

'এই ধর যদি দশটা ?'

'নিশ্চয়ই, যেকোনো সময়'। বললাম আমি।

---------
বিএফ ও আমি গল্পটির অডিও ভার্সন
কণ্ঠ : অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায়






অনুবাদক
অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায়
চলচ্চিত্রকার। কবি। গল্পকার। প্রবন্ধকার।
মার্কিন দেশে থাকেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ