আলবেয়ার কামু'র সাক্ষাৎকার

আলবেয়ার কামু'র সাক্ষাৎকার

আলবেয়ার কামু জন্ম নিয়েছেন ১৯১৩ সালে, আলজেরিয়ায়। দি আউটসাইডার, দ্য প্লেগ, দ্য ফল তাঁর উপন্যাস। লিখেছেন সিসিফাসের মিথ। পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের একজন। জীবন আসলেই কী, এই ব্যাপারে তিনিই সবচেয়ে বেশি কথা বলেছেন। নিরর্থকতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন। তাঁর সাহিত্যকীর্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- 'দি আউটসাইডার', 'দ্য প্লেগ', 'দ্য ফল'-এই উপন্যাসগুলি; ভাবনাবিস্তারি প্রবন্ধ 'দ্য রিবেল', 'দ্য মিথ অব সিসিফাস'; 'ক্যালিগুলা', 'ক্রস পারপাস', 'দ্য পজেজসড' এই তিনখানি নাটক, এবং ভাবনাবিস্তারি 'নোটবুকস'।
১৯৩৫ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত সময়কালের ভেতরেই তিনি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলি লিখে ফেলেন। নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৫৭'য়। মারা যান ১৯৬০-এ, সড়ক দুর্ঘটনায়। সাক্ষাৎকারটি নেন লেখক জে. সি. ব্রিসভেল, তার মৃত্যুর আগের বছর, ১৯৫৯য়। পরবর্তীতে, এটা সহ মোট ৩টি সাক্ষাৎকার গ্রন্থভুক্ত হয় কামু'র- 'লিরিক্যাল এন্ড ক্রিটিক্যাল এসেজ' বইটিতে; বইয়ের লেখাগুলি অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন ফিলিপ থডি এবং এলেন ক্যানোরি কেনেডি, নিউ ইয়র্কের ভিনটেজ বুকস থেকে বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৭০-এ। অনুবাদ : এমদাদ রহমান।


সাক্ষাৎকারী :
কখন লেখক হওয়ার ব্যাপারে স্থির সিদ্ধন্তে পৌঁছেছিলেন?

আলবেয়ার কামু :
লেখক হওয়ার জন্য অন্তর্গত প্রেরণা, আকুতি কিংবা লেখালেখিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা- এই ব্যাপারগুলি আমার ক্ষেত্রে ঠিক খাটে না, কারণ আমি তো সেই সতেরো বছর বয়স থেকেই লেখক হতে
চেয়েছি! সে-সময় খুব স্পষ্টভাবে না হলেও বুঝতে পারছিলাম যে আমি আসলে লেখক হওয়ার পথেই হাঁটছি।


সাক্ষাৎকারী :
তখন লেখক হওয়ার পাশাপাশি আর কোনও পেশা গ্রহণের কথা ভাবেন নি?

কামু :
হ্যাঁ, তা তো ভেবেছিলামই; তখন শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণের কথা ভাবছিলাম। লেখক হিসেবে স্বাধীনভাবে কাজ করবার জন্য, লেখক জীবনকে নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য দ্বিতীয় পেশা হিসেবে শিক্ষকতার কথা সব সময়ই আমি গুরুত্ব সহকারে ভেবেছি।


সাক্ষাৎকারী :
তখন কি আপনি ভবিষ্যৎ লেখক জীবনের ভাল-মন্দ দিক নিয়ে কিছু চিন্তা করেছিলেন? লেখক হিসেবে সামনের দিনগুলি কেমন হবে, শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবেন কি না, লেখক জীবনের অসহনীয় ভার ইত্যাদি সম্পর্কে কোনও ধারণা করতে পেরেছিলেন?

কামু :
সন্দেহে পড়ে গিয়েছিলাম লেখক-জীবনের ভাল এবং মন্দ দিক সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে; ভেতরে নানামুখি দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল, একসময় লেখালেখি ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভাবতে শুরু করেছিলাম। তারপর হঠাৎ একদিন জীবন সম্পর্কে আচ্ছন্ন করে দেওয়ার মতো, অভিভূত করে দেওয়ার মতো এক দৃষ্টিভঙ্গি যেন আমার ভেতর দিয়ে প্রকাশের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠল। সে ভাবনাগুলিকে একত্রিত করে একটি গদ্যের বই লিখে ফেললাম। তখন 'নোসেস' বই হয়ে বের হল।


সাক্ষাৎকারী :
লেখক হিসেবে, বিদ্যমান সামাজিক বিধিবিধানের সঙ্গে নিজের চিন্তাভাবনার সামঞ্জস্য করতে গিয়ে কি কোনও বিরূপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল? প্রচল বিধিগুলি মানতে বাধ্য হয়েছিলেন? এগুলি কি আপনার কাছে গুরুতর সমস্যা হিসেবে গণ্য হচ্ছিল?

কামু :
অবশ্যই। কিন্তু আমাদের এই শতাব্দী এই পর্যায়ে তো উন্নিত হতে পেরেছে, যেখানে 'সামাজিক চিন্তাবিষ্টতা'কে দিয়েছে হাস্যকর করে ফেলার, উপহাস করবার মতো কিছু মুখ যা আমাদেরকে সাহায্য করেছে প্রচল বিধিবিধানকে ধাক্কা দেওয়ার পক্ষে একটা স্বাধীনচেতা ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে। তখন হয় কী, যখন লেখালেখি করতে থাকি, অন্য লেখকদের মুখ তখন বন্ধ করে দেওয়া হয় কিংবা কারারুদ্ধ করা হয়, হয়ত এভাবেই লেখকদের দমিয়ে দেওয়া যাবে। তখন আমাকে বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবতে হয়, মনে করতে হয় যে লেখকরা তাদের লেখাতেই টিকে থাকবেন আর স্বাধীন মতো প্রকাশের জন্য লড়াই করবেন।

সাক্ষাৎকারী :
লেখক হিসাবে আপনার যে একটি পরিচিটি গড়ে উঠেছে তাকে কীভাবে দেখেন?

কামু :
আসলে, একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে লেখক পরিচয় নিয়ে আমার কোনও সমস্যাই হয় না, যেন এটা আদৌ কোনও পরিচয়ই নয় কিন্তু বাইরের জগতে আমার যে একটি বিশেষ পরিচিতি, আমি যে একজন লেখক, এই ব্যাপারটিকে কোনওভাবেই যেন মেনে নিতে পারি না। পরিচয়টি দিনে দিনে যে মাত্রায় পৌঁছচ্ছে তা অসহনীয়।


সাক্ষাৎকারী :
যদি লেখালেখি ছেড়ে দিতে হয়, কখনও কি ভেবে দেখেছেন তখন কীভাবে বেঁচে থাকবেন? লেখা ছেড়ে দিয়ে কি সুখী থাকতে পারবেন? সেই যে আপনার নাটকের ক্যালিগুলা, মাটি ও মানুষের পায়ের মধ্যকার চুক্তিটি নিয়ে যে কথাগুলি উচ্চারণ করেছিল, তার সেই কথাগুলি কি নিজেকে চূড়ান্তভাবে প্রকাশের অপরাধে

কামু :
ছেলেবেলায় কোনওরকমের লেখালেখি ছাড়া কী সুখিই না ছিলাম, এমনকি আজও আমার ভেতরটা সেই নীরব আনন্দে পূর্ণ হয়ে আছে, আমার জীবন এই আনন্দকে জীবনের পক্ষ থেকেই উপহার হিসেবে গ্রহণ করেছে; তবে যাই বলি না কেন, জীবনচর্যাকে আজীবন ধ্যান মনে করেছি বলেই এখন জানি- আমি আমার শিল্পকে বাদ দিয়ে সম্ভবত একদিনও বেঁচে থাকতে পারব না।


সাক্ষাৎকারী :
আপনি কি মনে করেন যে ইতোমধ্যেই আপনি আপনার প্রধান লেখাগুলি লিখে ফেলেছেন বলে মনে হয়?

কামু :
আমার বয়স এখন পঁয়তাল্লিশের ঘরে আর ভীষণ বিরক্তিকর এক জীবনীশক্তি পেয়েছিলাম!


সাক্ষাৎকারী :
আপনার লেখা যেভাবে এগিয়েছে তা কি আগে থেকে করে রাখা পরিকল্পনা অনুসরণ করেই এগিয়েছে না কি লিখতে লিখতেই পরিকল্পনাটি আবিষ্কার করেন?

কামু :
দুটোই। কখনও পরিস্থিতিই এমন হয়ে ওঠে যে লেখককে তখন সেই অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। এমন এক নকশা থাকে, যা একদিকে চলমান ঘটনাপ্রবাহ, অন্যদিকে আমার বইগুলি লেখার প্রকৃত শৈলীকে পরিবর্তিত করতে পারে।


সাক্ষাৎকারী :
আপনার লেখার পদ্ধতিগুলি কী কী?

কামু :
নোট, কাগজের টুকরো আর ধ্যানমগ্নতা... বছরের শেষে এগুলিই বিশাল আকার ধারণ করে। তারপর ধীরে ধীরে এইসব আইডিয়া, কনসেপ্ট, বিচ্ছিন্নভাবে লিখে রাখা কাগজের টুকরোটাকরা, টুটাফাটা জুড়ে দেওয়ার এক দীর্ঘ আর যন্ত্রণাদায়ক কাজ শুরু হয়- একটি যুক্তি শৃঙ্খলে নিয়ে আসবার জন্য। আমার ভাবনার নৈরাজ্যকর অবস্থাকে একটা অর্থপূর্ণ কিছু গড়ে তুলবার জন্য পক্ষে এই প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর।


সাক্ষাৎকারী :
ধরুন একটি লেখায় হাত দিয়েছেন, লেখা চলছে, তখন কি লেখাটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে কারও সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করেন?

কামু :
সাধারণত এমন হয় না। কিন্তু যখন নিজের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলি তখন কারও সঙ্গে কথা বলতে চাই।


সাক্ষাৎকারী :
লেখা শেষ হলে বন্ধুদের মতামত জানতে চান? লেখাটিকে নিজে নিজে ভেঙে দেখেন, বিশ্লেষণ করেন?

কামু :
হ্যাঁ, এমন কয়েকজন বন্ধু আছেন, যাদেরকে আমি আমার পাণ্ডুলিপি পড়তে দিই, তাদের কথা শুনি, তারা কোথায় কী সমস্যা ধরছেন তা নোট করে রাখি; দশ বারের মধ্যে ন'বারই তারা ঠিক কথাটি বলেন। তারপর, আমি লেখাটির সংশোধন করতে বসি।


সাক্ষাৎকারী :
কাজের জন্য কোন বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেন- ধারণা, প্রথম খসড়া, না কি- ইতোমধ্যে যতটুকু লিখিত হয়েছে, তাকে?

কামু :
ধারণার মুহূর্তটিই তাৎপর্যপূর্ণ।


সাক্ষাৎকারী :
আপনি কি খুব নিয়ম মেনে নিয়মিত লেখালেখি করেন?

কামু :
নিয়মিত লেখার চেষ্টা করি। যখন সবকিছু পক্ষে থাকে, তখন দিনে চার থেকে পাঁচঘণ্টা অবিরাম লিখতে পারি। আর যখন ছন্দটি কেটে যায়, তাল পাই না তখন সবকিছুই বাধা দেয়, মনও আড়ষ্ট হয়ে থাকে।


সাক্ষাৎকারী :
একটি লেখা যখন অসমাপ্ত পড়ে থাকে, পরদিন লিখে শেষ করবেন বলে ভেবেছেন, এসব ক্ষেত্রে কি সেই লেখার মধ্যে কোনও ভুল কিংবা দুর্বলতা ধরা পড়ে?

কামু :
হ্যাঁ, অসমাপ্ত লেখাটির জন্য নিজেকে অপরাধী লাগে, সেটা অনুভব করি; ভাবতে থাকি- কীভাবে এই কথাগুলি লিখতে পারলাম আর তখনই নিজেকে নিজের কাছে অচেনা লাগতে থাকে।


সাক্ষাৎকারী :
আপনার চরিত্রদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট কারও প্রতি কি আপনি দুর্বল?

কামু :
তারা হলেন- মেরি, ডোরা আর ক্যালেস্তে।


সাক্ষাৎকারী :
আপনার চরিত্রদের মধ্যে দুই শ্রেণির মানুষকে দেখতে পাই; যেভাবে ক্যালিগুলায় তারা এনেছেন, যারা 'ব্যক্তি'র শক্তি আর ক্ষমতার দ্বারা সমাজে টিকে থাকেন, আর, অন্যরা, যারা অবশ্যই মারসো'র [আগন্তুক] মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়ে থাকেন; তারা আত্ম-ধ্বংসের প্রলোভনের সাথে নিজেদের যুক্ত করেন। আপনি কীভাবে আপনার চরিত্রদের মধ্যে এই দ্বৈত দিকগুলিকে সনাক্ত করেন?

কামু :
হ্যাঁ, আমি শক্তি, উদ্যম এবং বিজয়কে পছন্দ করি কিন্তু খুব শীঘ্রই- কী পেয়েছি, কী করতে পেরেছি, এসব নিয়ে হতোদ্যমও পড়ি দ্রুত; আগ্রহ হারিয়ে ফেলি, ক্লান্ত হয়ে যাই আর এটাই আমার সবচে বড় দুর্বলতা। তারপর, আমি অজ্ঞাত কিংবা অস্পষ্ট কোনও কিছু কিংবা জীবনের দুর্বোধ্যতাকে পছন্দ করি আত্মবিলোপ কিংবা আত্মধ্বংসের জন্য কিন্তু এরকম হলে কী হবে, জীবনের প্রতি সুতীব্র টানও তো আমার আছে, তাড়না আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে, সেই আকাঙ্ক্ষার কারণেই আমি বারবার উঠে দাঁড়াই, ভেঙে পড়ি না, সামনে পা বাড়িয়ে দিই। এক কথায় বলতে হলে বলব- আমি কোনওভাবেই এই দ্বন্দ্বের, এই উভয়সংকটের সমাধান করতে পারি না।


সাক্ষাৎকারী :
ফিকশন, থিয়েটার কিংবা ক্রিটিক্যাল গদ্য, কোন টেকনিকটি আপনাকে সবচে বেশি আনন্দ দেয়?

কামু :
একটি লেখায় সবক'টি টেকনিক যখন জোট বাঁধে, ঠিক তখন একটি লেখা লিখতে পেরে আনন্দিত হয়ে উঠি।


সাক্ষাৎকারী :
নানা লেখায় আপনাকে আমরা 'থিয়েটারই শিল্প সাধনের উপযুক্ত স্থান' বলতে দেখি। আপনি কি আমার সঙ্গে একমত হবেন?

কামু :
এ ব্যাপারে বলতে হলে আমাকে অনেক কথা বলতে হবে। আমি মাঝেমাঝে অনুভব করি যে আমি আর কিছু না হয়ে স্রেফ একজন অভিনেতা হতে পারতাম; তাহলে হয়ত এই পেশাতেই জীবনটা খরচ করে ফেলতে পারতাম।


সাক্ষাৎকারী :
শিল্পিত একটি কাজের কতটুকু মূল্য, বিশেষ করে সাহিত্যকর্মকে আমরা যখন শিল্প হিসেবে ধরে নিই, তখন সাহিত্য যে শিল্পে রূপান্তরিত হয়, সেই শিল্পের উপাদানের ভেতর, তখন তাঁর কী মূল্য দাঁড়ায়? শিল্পের কোন দিকটির প্রতি আপনি সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল?

কামু :
সত্য। সত্য প্রকাশের ক্ষমতা আর শিল্পের যে উপাদানগুলি সত্যকে প্রকাশের পথ করে দেয়, প্রকাশে সাহায্য করে, সেই আশ্চর্য গুণগুলির প্রতি আমি সংবেদনশীল।


সাক্ষাৎকারী :
আপনার কাজের মধ্যে কোনও একটি বিশেষ থিম যা হয়ত আপনার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আপনার হল বিশ্লেষকদের দৃষ্টি এই থিমটিকে এড়িয়ে গেছে?

কামু :
হিউমার।


সাক্ষাৎকারী :
এ পর্যন্ত যা কিছু লিখেছেন, সেই লেখাকে আপনি নিজে কীভাবে দেখেন?

কামু :
আমি কখনওই সেই লেখা পড়ি না কারণ তখন লেখাগুলি আমার কাছে মৃত। আমি সব সময়ই চাই এমন কিছু লিখতে যে-কথাগুলি আমি লিখতে চেয়েছিলাম।


সাক্ষাৎকারী :
কীভাবে কাউকে লেখক বলে চিহ্নিত করবেন?

কামু :
নিজেকে পুনঃনির্মাণ করার ক্ষমতার মধ্য দিয়েই লেখককে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়। লেখক অনবরত নিজেকে ভাঙবেন, গড়বেন; ভাঙাগড়ার নিরন্তর একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিনি এগিয়ে যাবেন। তিনি হয়তো ক্রমান্বয়ে একই কথা লিখছেন, জগতের সমস্ত লেখকই তো একটা কথাই লেখেন, তিনিও লিখবেন, তাতে আমাদের কোনোই সন্দেহ নেই, কিন্তু দেখতে হবে লেখক যেভাবে বলছেন বা লিখছেন তখন তিনি তার ফর্মটিকে বার বার পুনঃনির্মাণ করছেন। প্রচল ফর্মের প্রতি তার শঙ্কা থাকে, আর তাই লেখক তাঁর নিজের ছন্দকে আঘাত দিয়ে ভাঙবেন।


সাক্ষাৎকারী :
কোন কোন লেখক আপনাকে লেখার পথে নিয়ে এসেছেন, যা বলতে চেয়েছেন সে ব্যাপারে আপনাকে তারা সচেতন করে তুলেছেন?

কামু :
সে তো অনেক... আধুনিকদের মধ্যে আছেন- গ্রেনার, ম্যালরোক্স, মন্তেল্যান্ট; আর ধ্রুপদী লেখক, যারা আমাকে নিরন্তর পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেন, তারা হলেন- পাস্কাল, মলিয়ের; উনিশশতকী রুশ সাহিত্য, এবং হিস্পানি লেখকরা।


সাক্ষাৎকারী :
শিল্পকলার ক্ষেত্রে রূপকারী আর্টকে আপনি কতোটা গুরুত্ব দেন?

কামু :
আমি সব সময়ই ভাস্কর হতে চাইতাম! আমার কাছে ভাস্কর্য হচ্ছে শিল্পকলার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।


সাক্ষাৎকারী :
আর সঙ্গীত?

কামু :
তারুণ্যের দিনগুলিতে কেবলমাত্র সঙ্গীতেই আমি মাতাল হয়ে থাকতাম, দিনরাত। এখন বয়সও বেড়েছে আর খুব কম সঙ্গীতজ্ঞই আমাকে দোলাতে পারেন কিন্তু সেই একজন, ভোল্‌ফগাঙ এমাদিয়ুস মোৎসার্ট, এখনও উন্মাদ করেন, এখনও!


সাক্ষাৎকারী :
সিনেমা সম্পর্কে কী ভাবেন?

কামু :
আপনার কী মত?


সাক্ষাৎকারী :
এখানে শিল্পীদেরকে যেভাবে প্রশংসা করা হয় তা নিয়ে অনেক সময়ই ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়। প্রশংসার কোন দিকটিকে আপনার বিরক্তিকর বলে মনে হয়?

কামু :
সৎ, বোধসম্পন্ন, মানবিক--আপনি তো ভাল করেই জানেন- এই কথাগুলি হচ্ছে আধুনিক মাউথওয়াশ, কুলি করবার মতো করেই এইসব শব্দকে ব্যবহার করা হয়।


সাক্ষাৎকারী :
আপনারই চরিত্রদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য কোনগুলি?

কামু :
আসলে চোখে পড়ার মতো ব্যাপারগুলি সময়ের ওপর নির্ভর করে, তবুও, যে-কথাটি বলব, তা হচ্ছে- এক ধরণের অন্ধ আর চরম একগুঁয়ে আমার চরিত্রগুলি।


সাক্ষাৎকারী :
মানব চরিত্রের কোন দিকটিকে আপনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন?

কামু :
মানুষের চরিত্রে যখন বুদ্ধিমত্তা আর আত্মবিশ্বাসের সংমিশ্রণ দেখতে পাই--যা আসলে বিরল--তাকেই সবচে বেশি পছন্দ করি।


সাক্ষাৎকারী :
আপনি একবার লিখলেন- এই বিশ্বজগতের সবচেয়ে গূঢ় কথা হচ্ছে আত্মার অবিনশ্বরতা ব্যতিরেকে ঈশ্বরের কল্পনা। আপনি কি আরও স্পষ্টভাবে বলতে পারবেন কথাটি দিয়ে ঠিক কী বুঝিয়েছিলেন?

কামু :
ঈশ্বর সম্বন্ধে আমার একটি চেতনা আছে। আমি দ্বিতীয় জন্মে বিশ্বাসী নই। এটাই। আর কিছুই বোঝাতে চাইনি।





অনুবাদক
এমদাদ রহমান
গল্পকার। অনুবাদক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

8 মন্তব্যসমূহ

  1. ঝরঝরে ভাষান্তর। এমন সাক্ষাতকার কামু'কে ফিরে দেখতে আগ্রহ জাগায়, নিজের লেখালেখি ভেঙেচুরে নতুন ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারে লেখককে।

    উত্তরমুছুন
  2. ধন্যবাদ এমদাদকে। সাক্ষাৎকার একধরণের উৎসাহবোধের জন্ম দেয়। কামু’কে আরো বেশি করে জানবার আগ্রহ রাখি।

    উত্তরমুছুন
  3. অসাধারণ সাক্ষাতকার । এমদাদ রহমান , শুভকামনা রইল ।

    উত্তরমুছুন
  4. খুবই প্রাঞ্জল অনুবাদ। পড়তে যেন কোনো বেগ পেতে হলো না। সাক্ষাৎকারটি ভীষণ ভালো লাগল।

    উত্তরমুছুন
  5. খুব সুন্দর লেখা। অনেক কিছু  জানলাম। ঋদ্ধ হলাম।

    উত্তরমুছুন