অনুবাদ : দুলাল আল মনসুর
বিকেলের চা-নাস্তার পর্ব শেষ। স্নান সেরে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানও হয়ে গেছে সবার। কিন্তু প্রচণ্ড তাপদাহের কারণে বাইরে খেলতে যাওয়া যাচ্ছে না কিছুতেই। সারা দিন পার হয়ে গেল বাড়ির ভেতরে বন্দি থেকে। বাড়ির ভেতরেও ঠাণ্ডা আবহাওয়ার লেশ মাত্র নেই; সূর্যের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে শুধু।
বাচ্চারা সবাই বাইরে যাওয়ার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টায় উদগ্রীব হয়ে আছে; মুখ দেখেই বোঝা যায়, কেমন ফোলা ফোলা রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু মা কিছুতেই বাইরের দরজা খুলবেন না। জ্বলন্ত সূর্যের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাড়ির সব কিছু পর্দাঘেরা, অস্থায়ী আবরণে মোড়া। এতে বাচ্চাদের দম বন্ধ অবস্থা আরো বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে, বাইরের আলো-বাতাসে বের হতে না পারলে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে : ফুসফুসের মধ্যে ছেড়া ছেড়া তুলো আর নাকের মধ্যে ধুলার আস্তরণ জমে গেছে।
বাচ্চারা সবাই বাইরে যাওয়ার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টায় উদগ্রীব হয়ে আছে; মুখ দেখেই বোঝা যায়, কেমন ফোলা ফোলা রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু মা কিছুতেই বাইরের দরজা খুলবেন না। জ্বলন্ত সূর্যের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাড়ির সব কিছু পর্দাঘেরা, অস্থায়ী আবরণে মোড়া। এতে বাচ্চাদের দম বন্ধ অবস্থা আরো বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে, বাইরের আলো-বাতাসে বের হতে না পারলে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে : ফুসফুসের মধ্যে ছেড়া ছেড়া তুলো আর নাকের মধ্যে ধুলার আস্তরণ জমে গেছে।
মায়ের কাছে তাদের আবদার, “প্লিজ, মা, প্লিজ। আমরা বারান্দায়ই খেলব। বারান্দা থেকে এক পা-ও বাইরে যাব না।'
‘আমি জানি, তোমরা বাইরে যাবেই। তখন?’
‘না, মা, আমরা যাব না’--ওরা এমন করুণ সুরে অনুরোধ জুড়ে দিল যে মা না শুনে পারলেন না। শেষে মা সদর দরজার খিল খুলে দিলেন। অতিরিক্ত পাকা ফলের ভেতর থেকে বিচি যেভাবে ছিটকে বের হয়, তেমনি করে বের হয়ে গেল উল্লাসে চিৎকার করতে করতে। মা ফিরে এলেন। এখন তার গোসল। করার সময়। গোসল সেরে ট্যালকম পাউডার আর নতুন শাড়ি পরবেন। নইলে গ্রীষ্মের এই বিকেল-সন্ধ্যা সামলানো কঠিন।
কড়কড়ে গরম আর চোখ ধাঁধানো আলো ছড়ানো বিকেল তাদের সামনে। বারান্দার সাদা দেয়ালে আলো পড়ে ঠিকরে বের হচ্ছে। বারান্দার সামনে ঝুলে আছে সিস রঙের বেলুনের মতো নীলাভ আর গাঢ় লাল বাগান বিলাস। বাইরের বাগানটাকে মনে হচ্ছে পেটানো ব্রোঞ্জের তৈরি বারকোষ--লাল সুরকির মধ্যে পেতে রাখা হয়েছে। পাথুরে মাটিতে যেন অ্যালুমিনিয়াম, দস্তা, তামা ইত্যাদির মিশেল। দিনের এই শুষ্ক সময়ে চারপাশের কোনো কিছুতেই জীবনের লক্ষণ নেই। পাখিগুলো পাকা ফলের মতো গাছের কাগুজে তাঁবুতে ঝুলে আছে। বাগানের জলের ট্যাপের নিচে ভেজা মাটিতে কাঠবিড়ালি মরার মতো পড়ে আছে। বাইরের কুকুরটা বারান্দার মাদুরে মরার মতো পড়ে আছে: লেজ, থাবা আর কান চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে আছে যেন পিপাসার্ত পথিক পানির খোঁজে ব্যস্ত। সাদা মার্বেলের মতো চোখের মণি দুটো লালচে গর্তের মধ্যে এমন আকুতি নিয়ে ঘোরালো কুকুরটা যেন বাচ্চাদের বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছে তার প্রতি সদয় আচরণ করার জন্য। বাচ্চাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানোর জন্য লেজ নাড়তে চাইল কুকুরটা। কিন্তু লেজটা কিছুতেই উঠল না।
একটুখানি কেঁপে উঠে নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল।
বাচ্চাদের হৈচৈয়ে ইউক্যালিপটাস গাছ থেকে একদল টিয়া পাখি উল্লাস মাখা প্রাণপ্রাচুর্যে উড়ে বের হয়ে রোদে পোড়া কড়কড়ে আকাশের গায়ে হোঁচট খেল। তারপর সারি বেঁধে মিশে গেল সাদা আকাশের শূন্যে।
বাচ্চারাও হৈহুলোড় জুড়ে দিল। একে অন্যের গায়ে আছড়ে পড়তে পড়তে ধাক্কাধাক্কি-ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গেল তাদের মধ্যে। এখন তাদেরও শুরু করার সময়। কী শুরু করবে? তাদের যে একমাত্র ব্যস্ততা অর্থাৎ খেলা।
‘চলো, লুকোচুরি খেলি।'
‘চোর হবে কে?’
‘তুমি হবে।'
‘আমি কেন হবো? তুমি হবে।'
‘তুমিই তো সবার বড়!’
‘তাতে কী?'
ঠেলাঠেলি আরো বেড়ে গেল। কেউ একজন অন্য কারো লাথি খেয়ে ছিটকে পড়ে গেল। মিরা মাতৃত্বসুলভ ভূমিকা নিয়ে সবাইকে মোটামটি দুই দলে ভাগ করে ফেলল। কার যেন জামা ছিড়ে গেল ফট করে। চিৎকার-চেঁচামেচি আর ধাক্কাধাক্কির মধ্যে অন্য কেউ খেয়ালই করল না কার জামা ছিড়ে কাঁধের সঙ্গে ঝুলতে লাগল।
‘গোল হয়ে দাঁড়াও, গোল হয়ে দাঁড়াও,' মিরা ঠেলাঠেলি করে মোটামুটি একরকম গোল হয়ে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করে দিল সবার জন্য। ‘এখন হাততালি দিতে থাক’, মিরার কথামতো সবাই হাততালি দেওয়া শুরু করল সমস্বরে, সমতালে, “দিপ দিপ দিপ, আমার নীল শিপ,' তারপর একজন একজন করে দল থেকে বাদ পড়ে যেতে লাগল। যার এক হাতের তালু আরেক হাতের তালুতে কিংবা এক হাতের উল্টোপিঠ অন্য হাতের তালুতে পড়ে সেই বাদ। সঙ্গে সঙ্গে সবাই লাফ-ঝাঁপ দিয়ে হৈহৈ করে ওঠে।
তারপর দেখা গেল রঘু চোর হয়েছে। কিন্তু সে এটা মেনে নিতে পারছে না। সে চিৎকার করা শুরু করল, “মিরা কাই করেছে! অনু কাই করেছে! সবাই কাই করেছে আমার বিরুদ্ধে। আমি মানি না। কিন্তু ততক্ষণে সবাই তার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। তার পরও তার চেষ্টা ওদের থামানো, ‘শুধু বারান্দায়, বলেছেন বেশি দুরে যাওয়া যাবে না।' কিন্তু তার কথা শোনার মতো কাছাকাছি দুরত্বে কেউ নেই। সবাই পার হয়ে গেছে। রঘু শুধু দেখতে পেল ওদের কেউ কেউ দেয়াল বেয়ে উঠে যাচ্ছে, কেউবা আগাছার ঝোঁপ, জৈবসারের স্তুপ মাড়িয়ে সামনে দৌঁড়াচ্ছে। ওদের পায়ের নিচের অংশ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না রঘু। বাগান আর বারান্দা বাগানবিলাসের লালচে ছায়ায় আগের মতোই ফাঁকা হয়ে পড়ে রইল। খুঁড়িয়ে চলা কাঠবিড়ালিটাও হঠাৎ কোথায় যেন চলে গেল। চোখ ধাধানো কড়কড়ে আলোয় চারদিক শূন্য হয়ে গেল। রঘু ছাড়া আর কেউ রইল না তার চারপাশে।
পিচ্চি মনু কিছুক্ষণ পর ফিরে এল যেন অদৃশ্য মেঘ থেকে পড়ে গেছে কিংবা কোনো শিকারি পাখির থাবা থেকে নিচে পড়ে গেছে। হলুদ লনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মনু আঙুল চুষতে চুষতে কেঁদে ফেলে আর কী। রঘু বারান্দার দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে গুনে যাচ্ছিল ‘তিরাশি, পঁচাশি, উননব্বই, নব্বই...' রঘুকে দেখে মনু পড়িমরি করে দৌঁড় দিতে গিয়ে পড়ে গেল মহাফাঁপরে। এক মনে চায় দক্ষিণ দিকে যাবে, আরেক মনে চায় উত্তরে যাবে। রঘু মনুর সাদা হাফ প্যান্টের নিচের অংশ আর লাল চপ্পলের চটচট শব্দ শুনে মনুকে ধাওয়া করল। রঘুর রক্ত হিম করে দেওয়া সজোর চিৎকারে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দৌঁড়তে গিয়ে মনু বাগানে পানি দেওয়ার জন্য রাখা হোস পাইপে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। পাইপের রাবারের গোলাকার অবয়বের ওপর পড়ে থেকেই মনু পরাজয়ের গ্লানিতে কেঁদে ফেলল, ‘আমি চোর হব না! তুমি সবাইকে খুঁজে বের করো! সবাইকে এ এ!
পায়ের আঙুল দিয়ে মনুকে গুঁতো দিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে রঘু বলল, ‘ওঠ গাধা! তোকে চোর হতে কে বলেছে? তুই তো মরা!' জিহ্বা দিয়ে ওপরের ঠোটে জমে ওঠা ঘামের বিন্দু। চাটতে চাটতে রঘু উধ্বশ্বাসে দৌড় দিল, যাতে মনুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো শিকার ধরতে পারে। শিকারের উদ্দেশে রঘু জোরসে শিস বাজাতে লাগল, যাতে তার শব্দে ওরা ভয়ে কেঁপে ওঠে।
গ্যারাজের পেছনে উল্টে রাখা একটা ফুলের টবের পেছন থেকে রবি রঘুর শিস বাজানো শুনতে পেল। মনে হলো, এই জায়গাটা লুকিয়ে থাকার জন্য বেশি সুবিধাজনক নয়। রবির একবার মনে হলো, গ্যারাজের পেছনে লুকিয়ে থেকে রঘুর আসার শব্দে একটু একটু করে এদিক-ওদিক এগিয়ে গিয়ে রক্ষা পাবে। কিন্তু রঘুর লোমওলা ফুটবল খেলা পায়ের সঙ্গে নিজের পুঁচকে পায়ের তুলনা করতে গিয়ে মনে আর জোর পেল না। রঘু যখন পায়ের তলায় লতাগুল্ম আর ফার্নের দল মাড়িয়ে এদিক-ওদিক করছিল, রবি ওর পায়ের একাংশ দেখে ফেলল। ভয়ে আর আতঙ্কে ওর দিকে লুকিয়ে এক নজর দেখে নিল রঘুর পা। ধরা পড়ার ভয়ে চুপচাপ রবি নাকে জমা হওয়া একদলা শক্ত পেটা খেয়ে ফেলল।
গ্যারাজের দরজায় বিশাল তালা ঝুলছে। চাবি ড্রাইভারের কাছে। তার ঘরের দেয়ালে ঝোলানো শার্টের তলায় একটা পেরেকের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। উঁকি দিয়ে দেখল, ড্রাইভার দড়ি দিয়ে বানানো একটা খাটিয়ায় ঘুমাচ্ছে। পরনে গেঞ্জি আর আন্ডারপ্যান্ট। তার শ্লেষ্মা ভরা নাক ডাকার শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বুকের আর নাকের ভেতরের লোম ওঠানামা করছে। রবির মনে হলো, যদি চাবি রাখা পেরেকেটা ধরার মতো উচ্চতা তার থাকত! কিন্তু জানে আরো অনেক বছর লাগবে ওই উচ্চতা পর্যন্ত ছোঁয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে । ব্যর্থ মনে সরে গিয়ে রবি ফুলের টবের কাছে বসে পড়ল। আপাতত এই জিনিসটাই তার মাপ অনুযায়ী ঠিক হয়েছে।
গ্যারাজের পেছনে আরেকটা ঘর। সেটাও তালা দেওয়া। চাবি কার কাছে কেউ জানে না। এই ঘরটার দরজা বছরে একবার করে খোলা হয়। মা তখন ভাঙা আসবাবপত্র, অকেজো ফুটো হওয়া বালতি, ছেঁড়া মাদুর ইত্যাদি ফেলে দিয়ে থাকেন। সে সময় ঝাঁটা দিয়ে পিপড়ের বাসাগুলো ভেঙে ফেলা হয়। মাকড়সার জাল আর ইঁদুরের গর্তে ওষুধ ছিটিয়ে দেওয়া হয় যেন হতদরিদ্র কোনো নগর দখল করা হলো। দরজা দুটোর পাল্লাগুলো বেঁকেচুরে গেছে। মরচেপড়া কব্জাগুলো খসে পড়ার উপক্রম হয়েছে, দরজা আর কব্জার মধ্যে বিশাল ফাঁকা তৈরি হয়ে গেছে। ফাঁকার মধ্য দিয়ে ইঁদুর, বিড়াল, কুকুর এমনকি রবিও ঢুকে যেতে পারে অনায়াশে।
রবি আগে কখনো প্রাণীর গন্ধে ভরা আসবাবপত্রের শবাগারের এ রকম অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করেনি আগে। কিন্তু রঘুর শিস বাজানো যতই জোরে জোরে বাজতে লাগল এবং লতাগুল্মেও ওপর দিয়ে তার শক্তপোক্ত পায়ের আওয়াজ যতই ভয়াবহ হয়ে উঠল রবি আর দেরি করতে পারল না। দরজার ফাঁক গলিয়ে সুরুত করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। নিজের কৃতিত্বে নিজেই আস্তে করে হেসে উঠল। ভেতর থেকে রবি দেখতে পেল রঘু লতাগুল্ম মাড়িয়ে ফুলের টবের কাছে চলে এল। কিন্তু রবিকে কোথাও দেখতে না পেয়ে রঘু চিৎকার করে বলে উঠল, “তোমার শব্দ আমি শুনেছি! আমি আসছি। ধরা পড়ার জন্য প্রস্তুত হও।’ গ্যারাজের চারপাশে ঘুরে ঘুরে রঘু কাউকে পেল না। শুধু উল্টে পড়ে থাকা ফুলের টব, হলুদ ধুলো আর দরজার পাশে পিঁপড়ের ঢিবি ছাড়া আর কিছুই পেল না। চিৎকার করতে করতে রঘু উবু হয়ে একটা কাঠি কুড়িয়ে নিয়ে গ্যারাজের দেয়ালের গায়ে বাড়ি মারতে মারতে এগিয়ে যেতে লাগল যেন এই আঘাত তার শিকারের গায়ে লাগছে।
ভয় আর আনন্দে মেশানো অনুভূতিতে রবি কেঁপে কেঁপে উঠল কয়েক বার। ঘরের ভেতরে ভুতুরে অন্ধকার আর কবরের মতো চাপা দম বন্ধ অবস্থা। এ রকম অভিজ্ঞতা রবির আছে : একবার লিনেন কাপড়ের কাভার্ডে বন্দি হয়ে আধ ঘন্টাখানেক অসহায় অবস্থায় কেঁদেছিল। কিন্তু সে জায়গাটা ছিল বেশ চেনাজানার মতো। মায়ের মাড় দেওয়া কাপড়ের গন্ধে একটা আরামের আবেশ ছিল। কিন্তু এই ছাউনির ভেতর ইঁদুর, পিঁপড়ের ঢিবি, ধুলো আর মাকড়সার জালের পচা গন্ধে ভরা। বলে বোঝানো যায় এমন সব ভয়ভীতির আখড়া যেন একটা। দরজার ফাটল দিয়ে আসা সামান্য আলো ছাড়া জায়গাটা প্রায় অন্ধকার। ভেতরে কোনোরকম আলোর ব্যবস্থা নেই। ছাদটাও খুব নিচু। উচ্চতা কম হলেও রবির একবার মনে হলো, আঙুলের ডগা দিয়ে ছাদটা ছুয়ে দেয়। অবশ্য এর জন্য দাঁড়ানোর দরকার হলেও রবি এক চুল নড়ল না। নিচে পাছা ঠেকিয়ে বলের মতো গোল হয়ে বসে পড়ল, যাতে কোনো কিছুর সঙ্গে ছোঁয়া না লাগে। এই অন্ধকারে তাকে ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য কত কী-ই তো থাকতে পারে। ঠাণ্ডা পিছলে সাপের মতো...সাপ! বাইরে রঘু দেয়ালের গায়ে জোরসে বাড়ি মারতে মারতে যাচ্ছে। বুঝতে পেরে রবির মনে হলো বাঁচা গেল, তাহলে সাপ নয়। |
কিন্তু রঘুও চলে গেল খুব শিগগিরই। গ্যারাজের বাইরে পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে গেলে আর কোনো শব্দই শোনা গেল না। পর মুহুর্তেই রবি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে গেল। কী যেন কাঁধের ওপর। | সুড়সুড়ি দিল মনে হলো! কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল হাত তুলে দেখার সাহস সঞ্চয় করতে। হয়তো কোনো কীট; হতে পারে মাকড়সা; দেখতে এসেছে তাদের জগতে এ আবার কে এল। হাত দিয়ে থাবা মেরে গলিয়ে দিতে দিতে রবির মনে হলো না জানি আর কত শত কীটপতঙ্গ আছে এই রাজ্যে। তার মতো অচেনা আগন্তুকের আকস্মিক আগমনহেতু জানতে অপেক্ষা করছে হয়তো।
এখন আর কিছুই নেই। মিনিটের পর মিনিট, ঘণ্টার পর ঘণ্টা--ওইভাবে পিঠের ওপর হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে রবি টের পেল পোকাটার গলে যাওয়া শরীরের রস শুকিয়ে তার হাতের সঙ্গে লেগে গেছে। এত দীর্ঘ সময় অনড় দাঁড়িয়ে থেকে পা কাঁপতে শুরু করল। এতক্ষণে ভেতরের জিনিসপত্রগুলো কিছুটা
স্পষ্ট দেখার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
পুরনো ওয়ার্ডরোব, ভাঙা বালতি, ছেঁড়া বিছানাপত্র তার চারপাশে গাদাগাদি করে রাখা। চোখে পড়ল একটা পুরনো ভাঙা বাথটাব--এনামেলের চকচকে টুকরোগুলো যেন তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আছে। শেষে সে ওই ভাঙা টুকরোর ওপর নিচু হয়ে বসল।
একবার ওখান থেকে বের হয়ে সবার সঙ্গে খেলার মূল স্রোতে মিশে যাওয়ার কথা মনে হলো। রঘুর হাতে ধরা না পড়লে সূর্যালোকের মধ্যে ভাইবোন আর অন্যদের হৈচৈয়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে পারত। বাগানের খোলা চত্বর আর পরিচিত পরিবেশের কথায় মন টানতে লাগল। খুব শিগগিরই সন্ধ্যা নামবে। খেলার সময় শেষ হয়ে যাবে। একটু পরই মা-বাবা লনে বেতের চেয়ারে বসবেন। চারপাশে অন্যান্য বাচ্চারা ছোটাছুটি করবে, নয়তো চুরি করে আনা তুতফল কিংবা দাঁত টক করে দেওয়া যমুনফল খাবে কাড়াকাড়ি করে। মালি পানির পাইপের মুখ ট্যাপের মুখে লাগিয়ে বাগানে পানি দেওয়া শুরু করবে। পানির ধারা শূন্যে উঠে তৃষ্ণার্ত শুকনো মাটির বুক, হলুদ ঘাস আর লাল সুরকির পাজর ভিজিয়ে দেবে। ভেজা মাটি থেকে একটা প্রাণ ঠাণ্ডা করা ঘ্রাণ বের হবে। আহ কী মধুর সুবাস! রবি ভেতর থেকেই শ্বাস নিতে থাকে। বাথটাব থেকে অর্ধেকখানি ওঠার পরই শুনতে পেলো শুনতে পেল একটা মেয়ের আর্তচিৎকার এবং ফোঁপানির শেষে নালিশ, ‘না, তুমি ছুঁতে পারনি!’ আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল ওদের ঝগড়ার শব্দ। তারপর আবার নীরবতা।
বাথটাবের ভাঙা চকচকে টুকরোর ওপর বসে মনে হলো, আরেকটু দেরি করা উচিত। যদি সবাই ধরা পড়ে যায় আর শুধু রবি বাদ থেকে যায়, অপরাজেয় অপরাজিত--তাহলে কী মজাটাই না হবে! এ রকম অভিজ্ঞতা খুব একটা নেই তার। একবার এক কাকামণি চকলেটের আস্ত এক টুকরো শুধু রবির একার জন্য এনেছিলেন। আরেকবার লালচে দাড়িওলা কান খাড়া কোচোয়ান তার ঘোড়ার গাড়িতে তোলার মতো প্রশ্রয় দিয়েছিল। বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত রবি গাড়ি চালিয়ে এসেছিল সেবার। লোমশ পায়ের, হেড়ে গলার, ফুটবল চ্যাম্পিয়ন রঘুকে হারিয়ে দিতে পারলে বড়দের আর অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সামনে রবির গৌরবের সীমা-পরিসীমা থাকবে না। এ রকম মজা যেন শুধু কল্পনায়ই সম্ভব। নিজের বিজয়ের কথা ভেবে রবি লজ্জা মেশানো আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে নিজের হাঁটু চেপে ধরল বুকের সঙ্গে।
ওখানে বসে থেকে রবি বাথটাবের ভাঙা টুকরোর গায়ে পায়ের আঙুল ঘষতে ঘষতে কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার ফাটলের কাছে কান লাগিয়ে শুরুতে চেষ্টা করল খেলার কী খবর। তারপর ফিরে এসে অটল সিদ্ধান্তে বসেই রইল। সে এত সহজে বের হবে না। খেলায় জিততেই হবে। সবার রেকর্ড ভাঙবে সে। চ্যাম্পিয়ন তাকে হতেই হবে।
ছাউনিটার ভেতরে অন্ধকার বেড়ে যাচ্ছে। দরজার বাইরেও আলো নিভে আসছে। আর আবছা আবহে বাইরে ফেসোর মতো ভাঙা ভাঙা সবুজ, নীল, ধূসর পুষ্প রেণুর মতো আলোর রেখা ছড়িয়ে পড়ছে। গোধূলির এই লগ্ন ইঙ্গিত দিচ্ছে, এখনই সন্ধ্যা নেমে আসছে। বাগানে পাইপের মুখ থেকে পানির ধারা পতনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তৃষ্ণার্ত মাটি পিপাসা মিটিয়ে সেই সবুজ সতেজ ঠাণ্ডা হাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে। দরজার ফাটল দিয়ে উঁকি মেরে দেখল রবি বাইরে ছাউনিটার এবং গাড়িঘরের ছায়া এখনো বাইরের উঠোনে শুয়ে আছে। তার পরই বাড়ির সাদা দেয়াল চোখে পড়ছে। বাগানবিলাসের ডালে রঙের আভা একটু যেন কমে এসেছে। ডালগুলো এদিক-ওদিক দুলছে। ওখান থেকে চড়ুইয়ের দলের কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। ঘরে ফেরা চড়ুইয়ের দল বাগানবিলাসের ডালে আশ্রয় নিয়েছে। ছাউনির ভেতর থেকে লনের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আহ যদি ওদের কণ্ঠ একবার শোনা যেত! মনে হলো রবি ওদের কণ্ঠ। শুনতে পাচ্ছে। ওরা হাসছে, গান গাচ্ছে, হৈহল্লা করছে। কিন্তু খেলার কী হলো? খেলা কি শেষ? শেষ হয় কী করে? রবি তো এখনো অপরাজিত!
হঠাৎ মনে হলো অনেক আগেই সে তো ওখান থেকে বের হয়ে বারান্দার পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে কোট ছুঁয়ে দিতে পারত । খেলায় জিততে হলে এটা ছাড়া উপায় নেই। এ কথাটা রবি ভুলেই গিয়েছিল। তার শুধু মনে ছিল লুকিয়ে থাকার কথা, খোঁজকারীর চোখকে ফাকি দেওয়ার কথা। লুকিয়ে থাকার কাজটা সে এতই সফলভাবে করেছে যে বাকি অংশটার কথা তার মনেই নেই। মনে নেই যে কোট ছুঁয়ে চিৎকার দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে সে জিতে গেছে।
আর্তনাদের চিৎকার করে রবি দরজার ফাঁক গলে বের হয়ে ছায়াঘেরা উঠোনে বোধহীন পায়ে হাঁটু মুড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। প্রাণ উজাড় করা কান্নাজুড়ে দিয়ে বারান্দা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। সাদা থাম পেরিয়ে খেলার কোট পর্যন্ত যেতে যেতে কান্না আরো বেড়ে গিয়ে রাগ আর ক্ষোভে মিশে গেল। রাগেঅপমানে কণ্ঠ ভেঙে সমস্ত গ্লানি যেন চোখের জলে বের হয়ে এল।
লনে অন্যান্য ছেলে মেয়েরা খেলা থামিয়ে বিস্ময়ে থমকে দাঁড়াল। বিস্ময়ে গোধূলির আলোয় সবার মুখ যেন লম্বা হয়ে গেছে। চারপাশের গাছপালা অন্ধকারের কালিতে লেপে যাচ্ছে। বিষন্নতার নীরব পতনে কবরের আবহ চলে আসছে। গাছপালার ভেতর দিয়ে লম্বা ছায়াগুলো জলের মতো গড়িয়ে পড়ছে। অন্যরা সবাই রবির দিকে তাকিয়ে ভেবে পাচ্ছে না সে কোথা থেকে এল, পশুর মতো হাউমাউ করে কান্নার কারণটাই বা কী। বিরক্তি আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে মা চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন রবির কাছে, ‘কী হচ্ছে রবি! থাম। বোকার মতো কাঁদছ কেন? ব্যথা পেয়েছ?' রবিকে মা দেখছেন দেখে অন্যরা নিজেদের খেলায় ফিরে গেল। ছন্দে ছন্দে হাততালি দিয়ে সুর মেলাতে লাগল সবাই, ‘ঘাসগুলো সবুজ, গোলাপগুলো। লাল...।'
কিন্তু রবি ওদের খেলা এভাবে চলতে দিতে পারে না।
মায়ের হাত থেকে ছুটে মাথাটা নিচু করে এত জোরে দৌড়ে রবি ওদের দলের কাছে পৌঁছে গেল। ‘আমি জিতেছি, আমি জিতেছি' বলে রবি এত জোরে মাথা ঝাঁকাতে লাগল যে বড় বড় অশ্রুবিন্দু ছিটকে পড়তে লাগল এদিক-ওদিক। রবি আবারও চিৎকার করে বলতে লাগল, 'রঘু আমায় খুঁজে পায়নি! আমি জিতেছি, আমি জিতেছি!'
রবি কী বলছে, এমনকি রবিটা আদৌ তাদের জগতের কেউ কি না এটা বুঝতেই সময় লেগে গেল অন্যদের। অনেকক্ষণ আগেই রঘু সবাইকে খুঁজে পেয়েছে। ওরা রবিকে ভুলেই গিয়েছিল প্রায়। সে পর্বে রঘুর পরে কে চোর হবে সে নিয়ে অনেক ঝগড়াঝাটিও হয়েছে। শেষে মা উঠে এসে মিটমাট করে বলে দিলেন অন্য খেলা খেলতে। তারপর অন্য খেলা খেলেছে, তারপর আরেকটা গাছ থেকে তুত পেড়েছে, মালিকে বাগানে পানি দেওয়ার কাজে সাহায্য করতে গিয়ে জ্বালিয়েছে। শেষে মালি বিরক্ত হয়ে মা-বাবার কাছে নালিশ করে দেবে বলায় ছেড়েছে। মা-বাবা বাগানে এসে চেয়ার নিয়ে বসেছেন। এরপর রঘু, মিরা সবাই এই খেলাটা শুরু করেছে। | এতক্ষণ রবির কথা কারো মনেই পড়েনি। চোখের আড়ালে ছিল বলে রবি ওদের মন থেকেই হারিয়ে গিয়েছিল । পুরোপুরি নেই হয়ে গিয়েছিল।
ধাক্কা দিয়ে রবিকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে রঘু চিৎকার করে বলল, “বোকার মতো করো না তো! মিরা তাকে এক কোণায় শক্ত করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, 'হাউ মাউ করে কেঁদো না রবি! যদি খেলতে চাও তো এই লাইনের এক কোণায় দাঁড়াও!”
খেলা আবার শুরু হলো। দুই জোড়া মাথার ওপরে অর্ধচন্দ্রাকারে মিলিত হতে লাগল ছন্দে ছন্দে। সবাই দল বেঁধে গোলাকার চক্রে বিষন্ন সুরে একতালে গাইতে লাগল :
সবুজ সবুজ ঘাসগুলো।
আর গোলাপগুলো লাল,
তোমরা আমায় ভুলো না গো
মনে রেখো চিরকাল!
ওদের হাতের অর্ধচন্দ্রাকারের ছবি গোধূলির আলোয় কেঁপে কেঁপে উঠছে। সবার মাথা বিষন্নতায় নোয়ানো হচ্ছে আর। পাগুলো মুখে উচ্চারিত সুরের তালে তালে মাটিতে পড়ছে। সুর আর তালে বিষন্নতা আর অসহায়ত্ব এত গভীরভাবে ছড়িয়ে পড়ছে যে রবি আর পারছে না। রবি আর ওদের তালে তাল মেলাবে না। ওদের এই দাফনের গানে আর নিজেকে জড়াবে না। রবি চেয়েছিল বিজয়, এই বিষন্নতা চায়নি সে। কিন্তু ওরা তাকে ভুলে গেছে। ওদের সঙ্গে কিছুতেই মেশা যাবে না।
তাকে ভুলে যাওয়ার অপমান কী করে সইবে সে? বুকের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠছে, সামলানো কঠিন। ভেজা ঘাসের মধ্যে মুখ গুজে পড়ে গেল রবি। আর সশব্দ কান্না নেই। অমর্যাদার গ্লানি বুকের ভেতর চেপে বসেছে পাথরের মতো।
1 মন্তব্যসমূহ
bal
উত্তরমুছুন