১.
জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) উপন্যাসগুলো যেন ট্রেনের (কিংবা ট্রামের) পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা বগি। সেই ট্রেন দেশ ভাঙনের পূর্ব মুহূর্তে এক নির্জন পথে যাত্রা শুরু করে ডুকে পড়েছে এক হট্টগোলের দেশে। তাঁর কথাশিল্প সেই যাত্রাপথের চলমান কথাবার্তা। সেই ট্রেন বিরামহীনভাবে চলছে ভারতবর্ষের সবচাইতে অস্থিরতম রাজনৈতিক প্রেক্ষপটের ভেতর দিয়ে। সবচাইতে বেশি হত্যা আর রক্তপাত জিও পলিটিক্সের ভেতর দিয়ে। আবার সবচাইতে বেশি বিপ্লব-প্রতিবাদ-আন্দোলন-প্রতিরোধেরও সময় সেটি, একই সাথে ঐক্য আর অনৈক্যের অদৃষ্টপূর্ব বিরোধী অবস্থান চলছে তখন। রাষ্ট্র সীমানা-মৃত্তিকা ঘিরে রক্তাক্ত ভাগাভাগির অগ্নিগর্ভ মুহূর্ত লেখকের দেশবদল ঘটে।
তেত্রিশে রচিত ‘কারুবাসনা’ কিংবা ‘জীবন প্রণালী’ কে প্রারম্ভিক কথাশিল্পের নমুনা বিবেচনা করা হয় যেখানে লেখক তরুণ মফস্বলে পেশাগত ও দাম্পত্য সকল প্রকার ব্যর্থতায় তিনি মূহ্যমান, প্রকৃতিকে অবলম্বন করে আপ্রাণ বেঁচে উঠবার চেষ্টারত। (হয়তো ‘রূপসী বাংলার’ সনেটসমূহ এই সময়েরই সৃষ্টি, যেখানে দেশ-কাল-জনপদ বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি কেবলই প্রকৃতির শুশ্রƒশা গ্রহণ করেছেন।)
‘প্রেতিনীর রূপকথার নায়ক দেশবদলের উদ্দেশ্যে স্টীমারে চড়ে বসেছে, কিন্তু দেশের বট অশ্বত্থের অন্ধকার থেকে পৌরাণিক প্রেতিনীরা তাকে ডেকে চলেছে। এইসব পিছুটানকে বুকে চেপে পুরষকেন্দ্রিক পরিবারের প্রধান রোজগেরে ব্যক্তি হওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি এবং তার নায়ক ‘জলপাই হাটি’তে পৌছেঁ গেছেন নগর কোলকাতার ভিড়ে, যে ভিড়ে নিঃসঙ্গতা আরো প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
তখন দেশ বিভাগের দগদগে ক্ষত এই জনপদ জুড়ে বিরাজমান। মানুষের মিছিল সর্বত্র, কোথাও বা শবযাত্রা। কেউ এপারে আসছে, কেউ ওপারে যাচ্ছে। ট্রামে কিংবা ট্রেনে, পথে কিংবা ফুটপাথে।
মোট কত মানুষের আসা-যাওয়া ঘটেছিল ঐ সময়ে? ভারতের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৫১ সালে ২ মিলিয়নের বেশি লোক উদ্বাস্ত হয়ে ওপারে যায়, যার অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীত্ব লাভ করে। ১৯৭৩ সালে এই সংখ্যা ৬০ লাখ ছাড়িয়ে যায়।
অপরদিকে পাকিস্তানের হিসাব অনুযায়ী ১৯৫১ সালে সেখানকার উদ্বাস্তর সংখ্যা ছিল ২ লাখের ওপর যা ১৯৬১ সালে সাড়ে আট লাখ ছাড়িয়ে যায়।
এরপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা সাময়িক বিরতির পর পর সংঘটিত হতে থাকলে এই স্থানান্তর প্রক্রিয়াও চলমান থেকে যায়। তবে বলা বাহুল্য যে বাংলাদেশ ছেড়ে যাবার সংখ্যাটিই বৃহত্তর নানবিধ কারণে।
‘জলপাইহাটি’ উপন্যাসের নায়ক নিশীথ, নিশীথের অন্ধকারে গ্রাম থেকে শহরে এসে ক্রমশ উপরে উঠতে থাকা ক্যাপিটালিস্ট বাল্যবন্ধু জিতেনের দরোজায় কড়া নাড়ে। যেন স্বয়ং জীবনানন্দ দাশই ভারতবর্ষের ভোর হবার পূর্বমুহূর্তে কোলকাতার ফুটপাথে এসে দাঁড়ান ল্যান্সডাউন রোডের কোনো বাড়িতে, ট্রাম লাইনের কাছাকাছি কোথাও।
২.
দেশভাগের হৃৎপিন্ডভেদী ইতিহাস মুহূর্তটি ছিল জীবনানন্দ দাশের লেখক হয়ে ওঠার পরিণতির কাল। দেশভাগের (১৯৪৭) ঘটনাটি ভারতবর্ষের সুদীর্ঘ ইতিহাসের সম্ভবত সবচাইতে বেদনাদায়ক অংশ। দেশভাগের সাথে সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। আর এ দুয়ের সাথে ছিল এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের ইতিহাস। শিক্ষায় অনগ্রসরতা এবং ব্রিটিশ সংসর্গ পরিত্যাগের ফলে মুসলিম সম্প্রদায় বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র মুসলিম ও হিন্দু দলিত কৃষক সম্প্রদায়। ১৮৭১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দু জমিদারগণ প্রাধান্য বিস্তার করেন। এই সুযোগ আলেম সম্প্রদায় গ্রামাঞ্চলে ধর্মভিত্তিক ঐক্যবদ্ধতা সৃষ্টির সূচনা ঘটায়। এর বিপরীতে জেলায় জেলায় ‘হরিসভা’ এবং আর্যধর্ম প্রচারিণী সভাসমূহ যজ্ঞ ও কীর্তন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে থাকে হিন্দু ঐক্য গড়ে তুলতে।
খিলাফত আন্দোলন ছিল বাংলার সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে আরো একটি মাইল ফলক। আন্দোলন শুরুর আগে হিন্দু-মুসলিমের ঐক্য ঘটেছিলো, কিন্তু আন্দোলন ভেঙে গেলে সাম্প্রদায়িক রোষ পরিণত হয় প্রচন্ড ক্ষোভে। ১৯২৫ সালের চিত্তরঞ্জন দাশের বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিল হয়। ভঙ্গুর এই প্রয়াসটি ব্যর্থ হলে বাংলার মুসলমান নেতাগণ স্বরাজ পার্টির বিকল্প খুঁজতে থাকেন। মুসলিমদের রাজনৈতিক সত্তা সন্ধানের এক পর্যায়ে এ.কে ফজলুল হক ও মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বেঙ্গল মোসলেম কাউন্সিল পার্টি। ১৯২৬ সালের বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন সভা নির্বাচনের ফলাফলে দলীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক ধারার সূচনা ঘটে। ১৯৩৭ পরবর্তী সময়ে লীগ মন্ত্রিসভার শাসনামলে চাকুরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান অনুপাত গভীরভাবে অনুসরণ করার ফলে শিক্ষিত হিন্দু বেকারের সংখ্যা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এভাবেই ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে সাতচল্লিশের দেশভাগ ঘটে যায়। চল্লিশের দশকে ক্রমাগত চলতে থাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক চেতনা সুস্পষ্টভাবে রাজনৈতিক রূপ ধারণ করে।
তবে সমাজের সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে সুদীর্ঘকাল সাম্প্রদায়িকতা কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। একদিকে সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান এবং ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতি, অপরদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সাম্প্রদায়িক রেষারেষির রাজনীতির মধ্যে বিরাজ করছিল অব্যাহত উত্তজনা। ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বর হিন্দু-মুসলমানগণ পরস্পরের সাথে কোলকাতার রাস্তায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আবার তারাই রাওলাট আইনের সময় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সত্যাগ্রহ আন্দোলনে একে অপরের পাশে এসে দাঁড়ায়। ১৯৩০-এ জনগণ প্রথম দিকে যৌথভাবে আইন অমান্য আন্দোলন পরিচালনা করলেও শেষ দিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়; ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোলকাতার ব্রিটিশ সরকারের আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করার সময় ঐক্যবদ্ধ হয়। অথচ মাত্র পাঁচ মাস যেতে না যেতেই তারাই প্রচন্ডতম সাম্প্রদায়িক হত্যাকান্ডে লিপ্ত হয়। ১৯৪৬ সালের ভয়াবহ কোলকাতা হত্যাকান্ড এবং নোয়াখালী-ত্রিপুরার চরম নিষ্ঠুরতা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল যার রেশ আজো এই উপমহাদেশে ছাই চাপা আগুন হয়ে বিরাজ করছে। সুযোগ পেলেই তা দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। জীবনানন্দ দাশ ঠিক এমনই এক অগ্নিকাল অতিক্রম করেছেন খোদ কোলকাতায়। চল্লিশের দশকের লেখাগুলোতে সেই অস্থির সময়ের সুস্পষ্ট স্বাক্ষর বহন করেছে।
জাতি-বর্ণ-ধর্ম-শ্রেণি বৈষম্যের প্রকট নগ্ন চেহারাদৃষ্টে ক্রমেই তিনি সমগ্র মনুষ্য সম্প্রদায়ের প্রতি বিক্ষুদ্ধ বিতৃষ্ণ হয়েছেন।
প্রথম কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘হিন্দু-মুসলমান’ কবিতার বিষয়বস্তু, আঙ্গিক শব্দচয়নে খুব একটা নতুনত্ব না থাকলেও কিছু কিছু উচ্চারণ অত্যন্ত ইঙ্গিতবহ তাতে সন্দেহ নেই। যেমন--
‘কাফের’ ‘যবন’ টুটিয়া গিয়াছে-ছুটিয়া গিয়াছে ঘৃণা দ
মোসলেম বিনা ভারত বিফল-বিফল হিন্দু বিনা’
এখানে ‘কাফের’ এবং ‘যবন’ শব্দ দুটি পরস্পরকে আন্তরিক ঘৃণা আর নিন্দাসূচক। ঐতিহাসিক নানান শৈল্পিক ষড়যন্ত্রের সুচারু ফাঁদে বন্দী সময়ের ছাপচিহ্ন এই সব শব্দে ফুটে আছে যে সময় আজো বহমান। সম্পুর্ণ কবিতায় সম্প্রীতির বন্ধন ফিরে পেতে চাওয়ার আড়ালে এক ধরণের হতাশ্বাসও যেন খুঁজে পাওয়া যায়। ‘যবন’ শব্দটি সচেতন বিদ্বেষের অনুষঙ্গ হিসেবে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র।
মূলত ‘ঝরা পালকের’ পর থেকেই জীবনানন্দ দাশের কবি চারিত্র্য বদলে যায়। সুনির্দিষ্ট বিষয়কে নির্ধারণ করার পরিবর্তে তার কবিতা ক্রমেই ভাবপ্রধান হয়ে ওঠে। ‘পতিতা’, নিখিল আমার ভাই’ কিংবা ‘হিন্দু-মুসলমান’ শীর্ষক বিষয়কেন্দ্রিক কবিতার বিষয়গুলোও পরবর্তীকালের কবিতায় ভাবের আধারে ছড়িয়ে পড়েছিল, কোলকাতা পর্বের কবিতায়। তাই ‘হিন্দু-মুসলমান’ কবিতার ‘ইন্দ্রপ্রস্থ’ ভেঙেছি আমরা- আর্যাবর্ত ভাঙি/গড়েছি নিখিল নতুন ভারত নতুন স্বপনে রাঙি!-- অনুপ্রাণিত অনুকরণের এই সুর ক্রমেই বদলে যেতে থাকে নিঃসীম বাগার্থিক গভীরতায়। বিশ্বযুদ্ধের করাল গ্রাসে মানুষের অস্তিত্ব যখন মৌলিক শূন্যতায় বিরাজমান তখন ধর্ম-বর্ণ বৈষম্য কেবলি বুর্জোয়া মোড়কে অস্থি-চর্ম সর্বস্ব দারিদ্র্যের বিজ্ঞাপনী প্রচার হয়ে দাঁড়ায়।
১৯২৭-এ তিনি সাম্প্রদায়িক নাম ধরে কবিতা লেখেন। আরো সাতাশ বছর পর ১৯৫৪ তে মৃত্যুর কিছুকাল আগে প্রকাশিত ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’য় সংকলিত ’১৯৪৬-১৯৪৭’ কবিতাটিতে ব্যক্তির নামই প্রতিনিধিত্ব করছে সম্প্রদায়ের।
যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হয়ে
বলে যাবে কাছে এসে, ইয়াসিন আমি ো
হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ-
আর তুমি? আমার বুকের পরে হাত রেখে
মৃত মুখ থেকে চোখ তুলে শুধাবে সে-
রক্তনদী উদ্বেলিত হয়ে চলে যাবে।
‘গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার;
--- ---- ----
জীবনের ইতর শ্রেণীর মানুষ তো এরা সব;
ছেঁড়া জুতো পায়ে বাজারের পোকাকাটা
জিনিষের কেনাকাটা করে;
--- ---- ----
যেখানে সময় তার অনুপম কন্ঠের সংগীতে
কথা বলে; কাকে বলে? ইয়াসিন মকবুল শশী
--- ---- ----
কেউ নেই, কিছু নেই-সূর্য নিভে গেছে।
(১৯৪৬-৪৭/শ্রেষ্ঠ কবিতা)।
সাম্প্রদায়িকতা চিরকালই রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের সবিশেষ মুহূর্তের মেকিয়াভেলিয় ষড়যন্ত্রের চাবিকাঠি। ধর্ম-সমাজ-মানবিকতা থেকে বহুদূরে অবস্থিত এই কূটচাল সর্বকালেই জনগণ নামক তুলসীগাছকে পদদলিত করতে ব্যবহৃত হয়েছে এবং হচ্ছে। ইয়াসিন-মকবুল কিংবা গগন-বিপিনদের স্থলে রসরাজ-বিশ্বজিৎ আর অনন্ত-অভিজিৎদের পরাজিত হবার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রযন্ত্রের চাকায় পিষ্ট হওয়ার মত চলমান রয়েছে আজো। দোষারোপে অবশ্য সাময়িক মুক্তি মেলে। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাতে গোষ্ঠীবদ্ধতার শুরু হয়েছিল আদিম যুগেই। সেই গোষ্ঠীবদ্ধতার পরাকাষ্ঠা রূপটিই কখনো ধর্ম, কখনো রাষ্ট্র নামক দানবে রূপান্তরিত হয়েছে। ডিভাইড ন রুলের মাধ্যমে ব্রিটিশ শেয়ালেরাই কি সম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করেছিল সর্বপ্রথম, নাকি চারাগাছ জলসেচন করেছিল মাত্র? বীজ উপ্ত হয়েছিল তো গোড়াতেই যার চূড়ান্ত ফলাফল দেখা গেছে সিরাজদ্দৌলার বিরুদ্ধে গঠিত ষড়যন্ত্রকারীদের ভেতর জন-জনি-জনার্দন অর্থাৎ সকল ধর্ম-বর্ণেরই সম অংশগ্রহণ ছিল। এখনো প্রতিবছর পূজার সময় এপারে মূর্তিভাঙার খবর নিয়মিত। ওদিকে ওপারে কুরবানির সময়ে গরুজবাই উপলক্ষে মানুষ হত্যা পর্যন্ত সংঘটিত হয়েছে। মানুষ মেরে চলেছি আমরা। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে, শতাব্দি কাল ধরে। তার রক্তে আমাদের শরীর শুধু নয়, মাখামাখি হয়ে ডেকে গেছে আকাশ-বাতাসও।
৩.
‘সুতীর্থ’ উপন্যাসে নায়ক সুতীর্থ শহর কোলকাতার ফুটপাতে হেঁটে বেড়ায় নিশিগ্রস্তের মতো। হাঁটতে হাঁটতে যেন স্বপ্নের ঘোরেই দেখা হয়ে যায় ছেলেবেলার বন্ধুদের সাথে। এভাবেই একদিন দেখা হয় হারান নামের এক পকেটমার ছেলের সাথে যার বাবার নাম একই সাথে শোভান মিঞা এবং শোভান ঘোষ। দেশের ভাঙন, সম্প্রদায়ের ভাঙন অথবা সম্প্রীতির ভাঙনের চেহারা আরো ব্যঙ্গাত্মক হয়ে ফুটে ওঠে এই দ্ব্যর্থবোধক দ্বি-নামকরণের মধ্য দিয়ে। পকেটমার হারানের চরিত্রটি এই একটি দৃশ্যের জন্যই এসেছে। যেখানে দেখা যায়, সুতীর্থর পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়ে ইতস্ততভাবে বাবার নাম একবার শোভান মিয়া একবার শোভান ঘোষ নামে বিবৃত করে। হয়তো দেশভাগের বিদীর্ণ রেখাটি বয়ে গেছে এই অসহায় বালকটির জীবনের উপর দিয়ে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্পের তুলসীগাছের মত শুকিয়ে উঠেছে তার অনাগত ভবিষ্যত। সুতীর্থর মত স্বপ্নচারী মধ্যবিত্তের সাময়িক আবেগে সাহায্য করবার প্রতিশ্রুতিতে তার মত ইতিহাসের হাতে মার খাওয়া বালক আস্থা রাখতে পারে না। তাই আকস্মাৎ সে সুতীর্থর হাত ছেড়ে পালায়। হারানের বাবার ভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত দুটি নামের মাধ্যমে ভারতবর্ষের বিভ্রান্ত সময় আর তামাশার শিকার জনগণের কুয়াশাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের চিত্র ফুটে উঠেছে অসম্ভব মিতবাক ভঙ্গিমায়।
১৯৩৯-এ যুদ্ধের আরম্ভের পর থেকে ১৯৪২ এর আগস্ট আন্দোলন এবং ডিসেম্বর কোলকাতা শহরে জাপানি সৈন্যদের বোমা বর্ষণের ঘটনা পর্যন্ত ভারতে যুদ্ধ সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনার পাশাপাশি চলতে থাকে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যাকে দুটি সম্প্রদায়ের অমানবিক সম্পর্কের নৃশংসতম রূপ বলা যেতে পারে। ‘জলপাইহাটি’ উপন্যাসে রবিশঙ্কর মজুমদার তার বন্ধু নিশীথের কাছে ব্যক্তিগত ঘটনা বলতে গিয়ে কথায় কথায় এই দাঙ্গা, সংক্রান্ত বীভৎস অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করে। লাহোর দাঙ্গার পর পশ্চিমে গেলে মুসলমানরা তাকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। সে মিথ্যেভাবে মুসলিম নাম বলে নিজের, কিন্তু তাতেও যখন লাভ হয়না তখন প্যান্ট খুলে তাকে ভুয়া মুসলমানিত্ব প্রমাণ করতে হয়। জীবনের কোন এক সময়ে টিউমারজনিত কারণে তাকে ঐ স্থানে অপারেশন করাতে হয়েছিল বলে বাঁেচায়া। কিন্তু দিল্লিতে একই কারণে হিন্দু হয়েও হিন্দু প্রমাণ করবার উপায় থাকেনা। তাই সে প্রকাশ করে সময়ের হাহাকার ধ্বনি--
‘কেমন যেন আমাদের এই পৃথিবী। ক্ষুরঘর্ষণ-ক্ষুরবর্ষণ চিড়িক-চিড়িক পানি। এই পৃথিবীর মতিগতির কান টেনে মাথা পাকড়ে কাজ না করতে পারলে রক্ষা নেই মানুষের। লাহোরে তো বুঝিয়ে এসেছি আমি হিন্দু নই, দিল্লিতে বোঝাতে হবে আমি মুসলমান নই। ভারতবর্ষের হিন্দু মুসলমান দুটো জাত বলা হচ্ছে আজকাল; কিন্তু চেহারা তো একইরকম .... লাহোর জয় করে এসেছে। দিল্লিতে জয় করতে হবে তাকে। একা বেচারি কত পারবে?’ (পৃ. ২৩০-২৩১/জলপাইহাটি)
এই বেচারিটির অবস্থাই সবচাইতে করুণ। যে না হতে পারে হিন্দু-মুসলমান, না হতে পারে ভারতীয় বাঙালি কিংবা বাংলাদেশি। কেবলি ঘুরপাক খেতে থাকে, ওপরে উঠতে গিয়ে বানরের মত তৈলাক্ত বাঁশ পিছলে পতন ঘটে তার। বিয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলন এই উপন্যাসে উল্লেখিত হয়েছে ‘বড় দাঙ্গা’ হিসেবে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা একাধিকবার উচ্চারিত হয়েছে উপন্যাসে। নিশীথের বন্ধু জিতেন তার শাশুড়ির চরিত্রের মহৎ দিক উল্লেখ করতে গিয়ে বড় ‘দাঙ্গা’ বিষয়ে প্রাসঙ্গিকভাবে সেই ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরে।
সে জানায়-- ওরা আজকাল কোলকাতায় আছে, পার্ক সার্কাসে থাকে। বড় দাঙ্গাটার সময়েও এখানেই ছিল। হেঁটে বেড়িয়েছে, হামলা দেখেছে; পুলিশের ট্রাকে ছুটে, রেডক্রশের গাড়িতে চড়ে দিনরাত একঠাঁই করে দিয়েছে। ঐ ওদের রকম। মানুষকে মানুষ খুন করেছে, ম্যানহোল থেকে আধকাটা মানুষ টেনে বের করে হাসপাতালে দৌড়ানো তাকে বাঁচিয়ে তুলবার জন্যে, মার্টিন মুখুজ্যে এইতো করেছে দাঙ্গার সময়। মরা মানুষ, আধ-মরা মানুষ, ডাক্তার আর হাসপাতাল, টেলিফোন আর ট্রাক চার্টার। (পৃ.৬/জলপাইহাটি)
নিশীথের যক্ষাক্রান্ত কন্যা ভানুকে বাঁচাতে তৎপর ডাক্তার সুবল। দাঙ্গার সময় সেও একই জায়গায় ছিল, অর্থাৎ পার্কে সার্কাসে। সেও কথা প্রসঙ্গে জানায় দাঙ্গার সময় একাধিকবার মৃত্যুর মুখোমুখি সে হয়েছিল। একটি মুসলিম পরিবারের মেয়েরা অগ্রগামী হয়ে তাকে রক্ষা করেছি। অর্থাৎ নৃশংসতা আর মানবিকতা পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটে ইতিহাসের পথে তবে নির্ভয়ে নয়, নিভৃতে সংখ্যালঘু হয়ে। বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ বা ‘জলপাইহাটি’ শীর্ষক সৃষ্টিগুলো পাঠকের কাছে সময়ের প্রামাণ্য দলিল থাকে।
প্রায় সতেরো পৃষ্ঠাব্যাপী গফুর ও প্রভাসবাবুর সংলাপ বিনিময়ে সম্প্রদায়, দেশভাগ সহ নানা বিষয়ের অবতারণা ঘটে। যেমন-বাঙালি মুসলমানের ধর্মীয় সংস্কৃতির একটি নিয়মানুগ প্রক্রিয়া হচ্ছে স্ত্রীকে তালাক দেয়ার ক্ষমতা। আর এই ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহারও তাদের অপসংস্কৃতির অংশ বলে ধরে নেয়া যায়। বাটলার গফুর মিয়া প্রভাসবাবুকে চ্যালেঞ্জ করে তার রান্নার দক্ষতা সম্পর্কে এভাবে জানায় যে, তার মতো পাঙাশ মাছ রান্না করে দিতে না পারলে সেই বিবিকে তালাক দেয়ার উপক্রম করবে যে কোন ভদ্রলোক। উল্লেখ থাকে যে, বাঙালি মুসলমানদের একটি অংশের মধ্যে এই ধারনা প্রচলিত যে, মৌখিকভাবে তিন তালাক দিলেই বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে যায়।
গফুরের অসাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা সমকালীন অসম্প্রীতির ইতিহাস স্মরণে নিয়ে আসে। ¯্রষ্টার নাম নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি না করে সে ধর্মের (অর্থাৎ সকল ধর্মের) দিব্যি কেটেছে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে জাহাজের বড় চাচা শুনলে হয়তো খুব রেগে যেতে পারে। এমনকি ভয়ংকর শাস্তিরও ব্যবস্থা হতে পারে।
‘মোছলমানের বাচ্চা হইয়া আল্লাহতায়ালার নাম না কইয়া কইলাম ধম্মো-মাসুদা চাচা শুনলে যাতে চ্যাগাইয়া হাঁটতে হয় হেই ব্যবস্থা করতো।’ (পৃ.৩১) কিন্তু গফুর নির্ভীক; অসাম্প্রদায়িক ভাবনা তার সরল মনে প্রোথিত হয়ে আছে। সে বিশ্বাস করে কোন মানুষই অমর নয়, কিন্তু ধর্ম চিরকালীন। এই অনুভূতিকে সে প্রকাশ করছে অদ্ভুত এক উপমার সাহায্যে-- ‘মাসুদ চাচার মাটির উপুর তাল-নাইরকোল গজাইব, হেইয়ার পিডা আর লাড়– খাইব তামাম দ্যাশ, চাচা কোথায় তখন? (পৃ.৩১) গফুর আর বলে, ‘খোদাও যা ধম্মোও তা- ‘অ-কার’ ‘আ-কার’ ব্যাসকম।’ (পৃ.-৩২) ।
গফুর বারংবার তার অন্তরে অন্তস্থল থেকে প্রভাস বাবুকে ভালোবাসা জ্ঞাপন করে। অনুরোধ করে দেগশভাগ হয়ে গেলেও পূর্ববঙ্গে থেকে যেতে। কিছুটা ব্যঙ্গের সুরে পাকিস্তান হবার প্রাক্কালে সুবিধাবাদী মানুষদের কথাও বলে যারা দেশবিভাগের সময় থেকেই আখের গুছিয়ে নেবার আয়োজন করছিল।
-- জবরদস্তির কথা কইমুনা। কইলকাতার দিকে দৌড় বাজাইতে খুব ফুর্তি হইব অনেকের, কিন্তু এই দেশে না থাকনের কিছুই নাই, ভালোবাইস্যা থাকোন লইয়া কথা।’ (পৃ.৩৫)।
জীবনানন্দ দাশ কি কোলকাতামুখী এইসব অভিবাসীদের যাত্রা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন? কারণ পরিসংখ্যানেও জানা যায়, সরকারি চাকুরীজীবীরা ছিলেন সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী। তাদের রুচি পছন্দ অনুযায়ী তারা অভিবাসন গ্রহণ করেছিলেন। বলা বাহুল্য, চিরকালের দলিত সম্প্রদায় কৃষকের কোন বিকল্প (ঙঢ়ঃরড়হ) ছিল না। তাদের প্রধান পেশাগত দক্ষতা ছিল কৃষিনির্ভর যা পশ্চিমবঙ্গের নগর কোলকাতায় অভিযোজিত হওয়ার জন্য ছিল সম্পূর্ণই বেমানান।
প্রভাসবাবু প্রসঙ্গক্রমে রমাকে বলেছেন--
‘পচিশ-ত্রিশ ঘর মোছলমান রয়েছে ওখানে, তা আছে বটে, কিন্তু আমাদের কোনোরকম লেনদেন নেই, ওিখানে কোন মুন্সি মোল্লা, কোন গ্র্যাজুয়েট ছোকরা নেই। ওদের ছেলেরা স্কুল কলেজে পড়ে না। মেয়েরা বোর্খা এঁটে আবডালে পড়ে থাকে; ওদের ভেতর গফুরের মত কেউ একজন নেই, কিংবা থাকলেও এখনো তাকে আবিস্কার করতে পারিনি আমরা।’ মেয়ে রমাও বলেছে, ‘অমন লোকটি হয়না- এ পাড়ায় সে রকম মানুষ পাবে কোথায়? (পৃ.-৩৯)
বোঝাই যাচ্ছে রোকেয়ার ছাত্রীরা তখনো অপ্রকাশ্য অপরিচিতা রূপে বিরাজমান। নাকি এখানেও দূরত্ব কিংবা পারস্পরিক অসম্পূর্ণ জানাজানি?
এই দূরত্বকেই কি অনতিক্রম্য করে তুলেছিল দেশবিভাগ নামক রাজপুরষগণ কর্তৃক সৃষ্ট (গান্ধীও ছিলেন তাদের ভেতর) ঐতিহাসিক এক মহা ভাঙন? তারপর থেকে দূরে সরে গেছে গ্রাম ও শহর, আরো দূরে সরে গেছে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি। জিতেনের মত উঠতি পুঁজিপাত আর হতদরিদ্র মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী। তারপর থেকেই কি আমরা ঝকঝকে ড্রইংরুমে ময়লা কাপড় পরা মানুষ দেখলে চমকে উঠি? পাশের ফ্ল্যাটে মানুষ মরে পচে উঠলে খবর রাখিনা। তশতরি ভরা হালুয়া-রুটি কিংবা ভোগের খিচুড়ি-প্রসাদ আর ভাগাভাগি হয় না। আমরা মাইক্রো পরিবার ক্রমেই সব বাহুল্য বর্জিত হয়ে ওপরে উঠতেই থাকি, উঠতেই থাকি। পিছলে পড়লে ব্যর্থ অভিবাসীর ধীরগতি ট্রামের সাথেও দুর্ঘটনা ঘটে যায়। অভিবাসী মজিদ যেমন নাম পরিচয় গোপন করেছিল, জীবনানন্দ দাশও তার নাম থেকে ছেঁটে ফেলেছিলেন গুপ্ত পদবী। উপন্যাসে এ নিয়ে বিদ্রুপোক্তিও রয়েছে। নগরের প্রাণের সাথে একাত্ম হতে পারেননি তিনি স্বাভাবিকভাবেই। ট্রামের ধাতব গতিময়তা, ফুটপাথের কর্কশ স্পর্শকে তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন নিয়তি হিসেবে। মজিদের পুঁজি ছিল আমসিপারা, কাজে লাগিয়ে পুঁজিপতি হয়েছিল সে। জীবনানন্দ তাঁর পুঁজি ‘রূপসী বাংলা’কে ট্রাংকে ফেলে রেখে গিয়েছিলেন। তার আর ওপরে ওঠা হয়নি, সোজা হেঁটে চলে গিয়েছেন। হয়তো এখনো হাঁটছেন হাজার বছর ধরে।
৪.
‘জলপাইহাটি’ উপন্যাসের একটি দৃশ্য সবিশেষ প্রতীকী। বন্ধুকে দেখে জিতেন বলে ওঠে ‘যত মফস্বলের মানুষ এখন শহরে এসে নিরিবিলি খোঁজে।’ বলেই কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় মধ্যরাতেই। ক্ষুধার্ত নিশীথ বিবেচনা বোধ হারিয়ে ফেলে। বন্ধুর বাড়িতে খুঁজে খুঁজে খাবার, পানীয় সবকিছু চুরি করে খেয়ে ফেলে। পয়সায় কেনা বলেই পানিও তার কাছে সুস্বাদু মনে হতে থাকে। তখন বোঝা যায় রাজা রাজ-রাজড়ার জিও পলিটিক্স-নয়, নিতান্ত টিকতে না পেরেও মানুষ বাড়ি-ঘর ছাড়ে। রূপসী বাংলার রূপের আড়ালে ফোঁপর হয়ে ওঠা অন্তসার: শূন্য পূর্ব-বাংলার কলেজগুলোর অর্থনৈতিক চিত্রের নগ্ন বর্ণনাকে অনেকে ‘উচ্চকিত’ বলে অভিহিত করেন। অথচ শিল্পের শিল্প হয়ে ওঠা ভাগ্যিস কখনো কোন কালে কোন শর্তকেই অনুমোদন করে চলেনি। চল্লিশের দশক ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের জন্য এক ভাঙন-উৎসবের কাল। যখন ঈশ্বরকে অস্বীকার করে মানুষই মানুষের ঈশ্বর হয়ে ওঠে, তখন অবশিষ্ট মানুষেরা উন্মূলিত হয়, হতেই থাকে। সেই চিত্রায়ণ উচ্চকিত, নাকি হিজল গাছের বাকল তুলে ফেলা টকটকে রক্তাক্ত ক্ষত চিহ্নের পোট্রেট, তা নির্ধারণ করে দেবে সময়। বিজ্ঞ এবং নির্ভুল ভাবে।
রোখসানা চৌধুরী
প্রবন্ধকার, গবেষক।
শিক্ষক।
সুনামগঞ্জে কর্মসূত্রে থাকেন।
2 মন্তব্যসমূহ
আমি রীতিমতো আশ্চর্য হচ্ছি এতগুলো উপন্যাস লিখেছেন জীবনান!আলোচনা পড়ে যতটা বুঝতে পারছি, এর সবগুলো আপনার পড়া। আমার পাঠের আগ্রহ বাড়িয়ে দিলেন। পরিশ্রম করে লেখা। শুভেচ্ছা।
উত্তরমুছুনগল্পের আলোচনা থাকলে ভালো হত।
উত্তরমুছুন