মার্গারেট মিচেল'এর ধারাবাহিক উপন্যাস : যেদিন গেছে ভেসে--একাদশ পর্ব

অনুবাদ : উৎপল দাশগুপ্ত

দশম পর্বের লিঙ্ক
------------------------
পরের সপ্তাহের এক বিকেলবেলা স্কারলেট হাসপাতাল থেকে খুব অবসন্ন দেহে গজগজ করতে করতে ফিরল। সারা সকাল ঠায় দাঁড়িয়ে কাজ করার জন্য ক্লান্ত, আর রাগ হয়েছে মিসেজ় মেরিওয়েদারের ওপর, কারন ভাঙ্গা হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধবার জন্য ও একজন সৈন্যর বিছানায় বসেছিল বলে উনি ওকে তীব্রভাবে ভর্ৎসনা করেছেন। আন্ট পিটি আর মেলানি, ওয়েড আর প্রিসিকে নিয়ে, সেজেগুজে বারান্দায় অপেক্ষা করছিলেন। সকলে মিলে সাপ্তাহান্তিক দেখাসাক্ষাত করতে যাবার জন্য তৈরি। স্কারলেট জানাল যে ওর আর বেরনোর ইচ্ছে নেই। তারপর সোজা দোতলায় নিজের ঘরে চলে এল।

গাড়ি আর ঘোড়ার খুরের আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই – যখন ও বুঝতে পারল কেউ আর ফিরে আসবে না – তখন নিঃশব্দে মেলানির ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। পরিপাটি করে রাখা কুমারীসুলভ ছোট্ট একটা ঘর। নিস্তব্ধ, বিকেল চারটেয় সূর্যের তির্যক আলো এসে পড়ায় উষ্ণ ভাব। ঝকঝকে মেঝেতে উজ্জ্বল কিন্তু জীর্ণ কার্পেট পাতা। বাহুল্যবর্জিত সাদা দেওয়াল – কেবল এক কোনে মেলানি একটা উপাসনার জায়গা বানিয়ে নিয়েছে। 

এখানে কনফেডারেট পতাকায় জড়ানো – সোনার হাতল দেওয়া একটা বাঁকানো তরবারি। মেলানির বাবা এই তরবারি নিয়ে মেক্সিকোর যুদ্ধে গেছিলেন। চার্লসও এই তরবারি নিয়েই যুদ্ধে গেছিল। চার্লসের পাগড়ি আর পিস্তলের বেল্টটাও ওখানে টাঙানো। খাপে রিভল্ভারটাও রাখা আছে। দুটোর মাঝখানে চার্লসের একটা বড় ফোটো লাগানো। ধূসর ইউনিফর্মে ওকে খুব আড়ষ্ট কিন্তু গর্বিত দেখাচ্ছে। মুখে লাজুক হাসি, বাদামী চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। 

ছবিটার দিকে স্কারলেট একবার তাকিয়েও দেখল না। নির্দ্বিধায় মেলানির সরু খাটের পাশে টেবিলের ওপর রোজ়উডের যে লেখার বাক্সটা রয়েছে সেখানে চলে গেল। নীল ফিতে দিয়ে বাঁধা একতাড়া চিঠি তুলে নিল বাক্স থেকে। অ্যাশলের লেখা চিঠি – মেলানিকে। আজই সকালে যে চিঠিটা এসেছে সেটা ওপরেই রাখা ছিল। ওটা খুলল। 

এই লুকিয়ে চিঠি পড়ার ব্যাপারে প্রথম প্রথম বিবেকদংশনে আর ধরা পড়ে যাবার ভয়ে হাত এমন কাঁপতে থাকত যে খাম থেকে চিঠি বের করতেই পারত না। কিন্তু একই পাপ বার বার করার ফলে ওর নীতিপরায়ণহীন বিবেকের তাড়না একেবারে স্তিমিত হয়ে এসেছে। এমনকি ধরা পড়ে যাবার ভয়টাও কাটিয়ে উঠেছে। কখন সখন অবশ্য একটা কথা ভাবলেই বুকটা কেঁপে ওঠে, “মা যদি জানতে পারেন তো কি ভাববেন?” ও জানে এইরকম অন্যায় কাজ ও করেছে জানার থেকে এলেন ওর মরা মুখ দেখাই বেশি ভাল মনে করবেন। এই ব্যাপারটাই প্রথমদিকে ওকে খুব ভাবিয়েছিল, কারন ও সব ব্যাপারেই এলেনের মত হতে চায়। কিন্তু চিঠিগুলো পড়বার প্রলোভন এত বেশি ছিল যে এলেনের ভাবনাটাকে মন থেকে জোর করে সরিয়ে দিয়েছিল। অপ্রীতিকর ভাবনাকে মন থেকে সরিয়ে দেবার ব্যাপারে আজকাল ও বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছে। মনে মনে বলে, “এই বিরক্তিকর চিন্তা আমি এখন করব না। কাল ভেবে দেখা যাবে।” সাধারণত, পরের দিন ওই চিন্তাটা হয়ত ওর মাথাতেই এল না, কিংবা যদি আসেও, তবে বিলম্বিত হওয়ার জন্য তার ধার হয়ত কমে গেছে। তাই অ্যাশলের চিঠি পড়ে নেওয়ার ব্যাপারটা ওর বিবেককে আর তেমন কিছু পীড়া দেয় না। 

মেলানি চিঠির ব্যাপারে যথেষ্ট উদার ছিল। আন্ট পিটি আর স্কারলেটকে কিছু কিছু জায়গা থেকে জোরে জোরে পড়ে শোনাত। কিন্তু যে সব জায়গাগুলো ও পড়ে শোনাত না, সেগুলো জানবার জন্য স্কারলেট অসহিষ্ণু হয়ে পড়ত আর ননদের চিঠি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়বার জন্য কৌতুহল দমন করতে পারত না। অ্যাশলে বিয়ের পর ওর বউকে ভালবাসতে শুরু করেছিল কি না, সেটা জানা ওর খুব দরকার হয়ে পড়েছিল। এটা জানাও খুব দরকার ছিল যে ও ভালবাসার ভান করে কি না। ও কি ওকে চিঠিতে খুব আদর করে সম্বোধন করে? চিঠির মধ্যে ওর যে অনুভুতিগুলো প্রকাশ পায় তার মধ্যে উষ্ণতা কতটুকু? 

যত্ন করে চিঠিটার ভাঁজ খুলল। 

অ্যাশলের পরিচ্ছন্ন ছোট ছোট হস্তাক্ষর ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল। “আমার প্রিয় বউ” কথাটা পড়েই ও একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। যাক, এখনও তাহলে “প্রিয়তমে” কিংবা “আমার সোনামনি” বলে সম্বোধন করছে না! 

“আমার প্রিয় বউঃ তোমার শেষ চিঠিতে তুমি আশঙ্কা প্রকাশ করেছ যে আমি হয়ত আমার মনের কথা তোমাকে খুলে বলছি না। তুমি জানতে চেয়েছ ইদানিং কোন ভাবনা আমার মনকে আচ্ছন্ন করে আছে ___” 

কি সর্বনাশ!” স্কারলেট একটা পাপবোধ নিয়ে ভাবল, “মনের কথা খুলে বলছে না? তাহলে মেলি কি ওর মনের কথা বুঝে ফেলেছে? না কি আমার মনের কথা?” অ্যাশলে আর আমাকে নিয়ে কি কিছু সন্দেহ ____” 

চিঠিটা ধরা অবস্থায় ওর হাত ভয়ে কাঁপতে শুরু করল। পরের প্যারাগ্রাফ পড়ে অবশ্য নিশ্চিন্ত হল। 

“প্রিয় বউ, যদি আমি কোন কথা তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে থাকি, সেটা শুধু তোমাকে অযথা চাপ দিতে চাই নি বলে, তোমাকে আমার নিরাপত্তা সম্বন্ধে দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাই নি বলে। কিন্তু তুমি তো ভাল করেই জান, আমি কিছুই তোমাকে না বলে থাকতে পারি না। চিন্তা কোরো না। আমার কোন আঘাত লাগেনি আর আমার শরীরও ভালই আছে। যথেষ্ট খাবার-দাবার রয়েছে। আর ঘুমোবার জন্য মাঝে মাঝে বিছানাও জুটে যাচ্ছে। একজন সৈনিক এর থেকে বেশি কিছু আশাও করে না। কিন্তু মেলানি, একটা ভাবনা আমাকে খুবই ভারাক্রান্ত করে রেখেছে, সেটা আমি তোমাকে বলতে চাই। 

“ক্যাম্পের সবাই যখন উষ্ণ রাতগুলোতে ঘুমিয়ে পড়ে, আমার চোখে ঘুম আসতে চায় না। আমি আকাশের অগুন্তি তারাদের দিকে চেয়ে থাকি আর ভাবি, ‘তুমি এখানে কি করছ অ্যাশলে উইল্কস? কিসের জন্য তুমি যুদ্ধ করছ?’ 

“নিশ্চয়ই সম্মান কিংবা গরিমার জন্য নয়! যুদ্ধ বড় নোংরা জিনিষ, আর আমি নোংরামি পছন্দ করি না। আমি সৈনিক নই। কামানের মুখে আত্মবলি দিয়ে বুদ্বুদের মত ক্ষণস্থায়ী গৌরবের জন্যও আমি লালায়িত নই। তবু আমি যুদ্ধ করতে এসেছি – অথচ ভগবান চেয়েছিলেন আমি বই মুখে বসে থাকা সাধারণ একজন গ্রাম্য মানুষ হই। কারনটা কি জান মেলানি? বিউগলের আওয়াজে আমার রক্তে কোন উন্মাদনা জাগে না। ড্রামের তালে তালে আমার পা ছুটে যাবার জন্য নিশপিশ করে না। আমি স্পষ্ট দেখতে পারছি আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে হয়েছে। আর সেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছি আমরাই – আমাদের মত দাম্ভিক দক্ষিণের মানুষরা। আমরা ভেবেছি ইয়াঙ্কিদের আমরা মেরে তাড়িয়ে দিতে পারি। আমরা ভেবেছি তুলোর সাম্রাজ্যের জোরে আমরা সারা পৃথিবী শাসন করতে পারি। যে সব মানুষ ক্ষমতায় রয়েছেন – যাঁদের আমরা সম্মান করতাম, শ্রদ্ধা করতাম – তাঁদের বাগাড়ম্বর, তাঁদের একদেশদর্শিতা, ঘৃণার মনোভাব – আমাদের প্রতারিত করেছে। ‘তুলোর সাম্রাজ্য, দাসপ্রথা, রাষ্ট্রের অধিকার, ইয়াঙ্কিরা চুলোয় যাক!’ 

তাই আমি যখন কম্বলের ওপর শুয়ে আকাশের তারাদের দিকে চাই আর বলি, ‘তুমি কেন যুদ্ধ করছ?’ তখন মনে হয় আমি তো রাষ্ট্রের অধিকার, তুলোর সাম্রাজ্য রক্ষা করা, নীগ্রোদের জন্য অথবা ইয়াঙ্কিদের – যাঁদের আমরা ছোটবেলা থেকেই ঘৃণা করতে শিখেছি – শেষ করে দেওয়ার জন্য এই যুদ্ধ করছি না। আমার মনের চোখে টুয়েল্ভ ওক্স ভেসে ওঠে, চাঁদের আলো সাদা থামগুলোর ওপর পড়ার দৃশ্য দেখতে পাই, দেখতে পাই জ্যোৎস্নার আলোয় ম্যাগনোলিয়া ফুল ফুটতে, লতানে গোলাপ গাছগুলো বারান্দায় ছায়া দিত – এমনকি প্রচণ্ড গরমের মধ্যাহ্নেও। মাকে দেখতে পাই ওখানে বসে উল বুনছেন – ছোটবেলায় যেমন দেখতাম ঠিক সেরকম ভাবে। শুনতে পাই সন্ধ্যেবেলা মাঠ থেকে ক্লান্ত নীগ্রোরা গান গাইতে গাইতে ফিরছে সাপারের জন্য। কুঁয়ো থেকে শীতল জল তোলার জন্য বালতি ফেলার শব্দ। আমার দৃষ্টি সেই লম্বা রাস্তা ধরে তুলোর খেত পেছনে ফেলে নদীর কাছে চলে যায়, যেখানে নাবাল জমি থেকে গোধূলির আলোয় আকাশে কুয়াশা ছড়িয়ে পড়ে। আমি শুধু এইজন্যই এখানে আছি। মৃত্যুর কিংবা দুরবস্থার প্রতি আমার কোন ভালবাসা নেই, কোন গৌরব লাভের ব্যাপারেও আমি উদাসীন, না আমার কারো ওপর কোন ঘৃণা রয়েছে। হয়ত দেশাত্মবোধ বলতে এটাকেই বোঝায় – স্বগৃহ আর দেশের প্রতি ভালবাসা। কি জানো মেলানি – ব্যাপারটা আরও গভীর। আমি যেসব জিনিষের নাম করলাম, মেলানি, এগুলো হল আমার জীবনের ঝুঁকি নেবার প্রতীকী কারন। আমি যেরকম জীবন প্রত্যাশা করি তার প্রতীক। আমাদের জীবনযাত্রার চিরাচরিত ধারাটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি যুদ্ধ করছি – যে পুরোনো জীবনধারা আমি এত ভালবাসি – কিন্তু মনে হচ্ছে হয়ত সেটা একেবারেই হারিয়ে গেল – যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক না কেন। হারি কিংবা জিতি, সেই সব দিন আর ফিরে আসবে না। 

“ধর আমরা জিতে আমাদের স্বপ্নের এই তুলোর সাম্রাজ্য বজায় রাখতে পারলাম, তবুও আমরা হেরেই গেলাম। কারন আমাদের সেই শান্ত নিবিড় জীবন আর থাকবে না। আমরা নতুন ধরনের জীবন শুরু করব। সারা পৃথিবী আমাদের দরজার গোড়ায় তুলো কেনার জন্য হুড়োহুড়ি করবে, আমরাও আমাদের পছন্দমত দাম হাঁকতে পারব। তাহলে ইয়াঙ্কিদের সঙ্গে আমাদের তফাতটা রইল কোথায়? ওদের এই বেনিয়া মনোবৃত্তি, অর্থ উপার্জনের ধান্ধা আর সব কিছু দখলে করে নেবার চেষ্টা –এগুলোকেই তো আমরা নিন্দে করি? 

“যদি আমি যুদ্ধে বন্দী হই, কি গুরুতর আহত হই কিংবা ধর মরেই যাই – তাতে আমার কোন ভয় নেই। আমার শুধু ভয় যুদ্ধের শেষে আমরা আমাদের পুরোনো জীবনযাত্রায় ফিরে যেতে পারব না। আর আমি তো সেই জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। বর্তমানের এই নৃশংসতার পাগলামি আমার সহ্য হয় না। হয়ত ভবিষ্যত জীবনধারার সঙ্গে আমি নিজেকে খাপ খাওয়াতেই পারব না। তুমিও পারবে বলে মনে হয় না প্রিয়, কারন তোমার আর আমার শরীরে সেই একই রক্ত বয়ে চলেছে। জানিনা ভবিষ্যত কেমন হবে, কিন্তু সেটা কোনমতেই ফেলে আসা দিনগুলোর মত এত সুন্দর হবে না। 

“আমি শুয়ে শুয়ে আমার আশেপাশে যে সমস্ত ছেলেরা ঘুমোচ্ছে তাদের দিকে তাকাই আর ভাবি ওই দুই যমজ ভাই, বা অ্যালেক্স বা কেডও কি আমার মত করে ভাবছে? ভাবি ওরা কি জানে যে মহান কারনে আমরা যুদ্ধ করছি, প্রথম গোলাগুলি চলার মুহুর্তেই সেই কারনটা হেরে ভুত হয়ে গেছে! আসল কারনটা হল আমাদের চিরপরিচিত জীবনযাত্রাকে বাঁচিয়ে রাখা, কিন্তু সে তো কবেই অতীত হয়ে গেছে। মনে হয় না ওরা এসব নিয়ে ভাবে, তাই ওরা সত্যিই ভাগ্যবান। 

“যখন তোমার পাণিপ্রার্থনা করেছিলাম, তখন এসব কথা আমার মনে আসেনি। ভেবেছিলাম টুয়েল্ভ ওকসে যেভাবে আমাদের জীবন চলত – এক অপরিবর্তনীয় শান্তিতে – ঠিক সেভাবেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারব। মেলানি, তুমি আর আমি – আমাদের একরকম মানসিকতা। আমরা একই ধরনের শান্ত, নিস্তরঙ্গ লম্বা জীবন কামনা করি যেখানে থাকবে শুধু বই পড়া, সঙ্গীতচর্চা আর স্বপ্ন দেখা। কিন্তু এরকম জীবন কল্পনার বাইরে ছিল! এ আমরা কখনওই চাইনি! ভাবতেই পারিনি যে এরকম হতে পারে! ধারাবাহিক জীবনের ছন্দ ভেঙ্গে যেতে পারে! এত মৃত্যু! এত ঘৃণা! রাষ্ট্রের অধিকার, ক্রীতদাস, তুলো – তার জন্য এতটা মূল্য দিতে হবে? যা ঘটছে অথবা যা ঘটতে চলেছে, তার জন্য যে মুল্য চোকানো হচ্ছে সেটা অস্বাভাবিক! ধর আজ যদি ইয়াঙ্কিরা আমাদের হঠিয়ে দেয় তাহলে আমাদের দিন কাটবে আতঙ্কে। প্রিয় আমার, ইয়াঙ্কিদের কাছে আমাদের হেরে যাবার সম্ভাবনা খুবই প্রবল! 

“এগুলো আমার লেখা উচিত ছিল না। এমন কি এই কথাগুলো আমার মনের মধ্যে আনাই উচিত নয়। কিন্তু তুমি আমার মনের মধ্যে কি চলছে জানতে চাইলে, তাই বলছি, সেখানে কেবলই হেরে যাবার গ্লানি। তোমার কি মনে পড়ে – আমাদের বাগদানের দিন – বারবেকিউতে – রেট বাটলার বলে চার্লসটন থেকে আসা এক ভদ্রলোক, দক্ষিণীদের অজ্ঞতা নিয়ে মন্তব্য করে প্রায় ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছিলেন? মনে পড়ে উনি বলেছিলেন আমাদের কারখানা, মিল, যুদ্ধাস্ত্র, জাহাজ এগুলো কোনটাই যথেষ্ট পরিমানে নেই, আর তাই যমজভাই দুজন ওঁকে গুলি চালাতে গেছিল? উনি বলেছিলেন যে ওদের যুদ্ধজাহাজ দিয়ে ইয়াঙ্কিরা আমাদের চারদিক থেকে এমনভাবে ঘিরে ধরবে, যে আমাদের তুলো চালান দেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। ঠিকই বলেছিলেন উনি। ওদের আধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করছি মান্ধাতার আমলের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। আর অল্পদিনের মধ্যে অবরোধ এত আঁটসাঁট হয়ে পড়বে যে এমন কি হাস্পাতালের সরঞ্জাম পর্যন্ত তার ফাঁক দিয়ে গলতে পারবে না। আমাদের মহান দেশনায়কদের বাগাড়ম্বরের কর্ণপাত করার বদলে বাটলারের মত ছিদ্রান্বেষীদের কথাই আমাদের শোনা উচিত ছিল, কারন ওরা সঠিক পরিস্থিতিটা জানত – দক্ষিণীদের শুধু দম্ভ আর তুলো ছাড়া যুদ্ধ করার মত কোন রসদই ছিল না। আমাদের তুলোর কোন মূল্যই নেই। তাহলে যা পড়ে রইল, সেটা হল দম্ভ। আমি অবশ্য দম্ভ না বলে বলব দুঃসাহস। যদি ____” 

বাকি চিঠিটা না পড়েই ওটা সাবধানে ভাঁজ করে ফেলল স্কারলেট, তারপর খামের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। পড়ার ধৈর্যই হারিয়ে ফেলেছিল। তাছাড়া হেরে যাওয়ার মত বোকা বোকা কথা পড়তে পড়তে ওর মনটা বিষন্ন হয়ে যাচ্ছিল। মেলানির চিঠি পড়ে অ্যাশলের নীরস আর জটিল ভাবনাগুলো জানার কোন ইচ্ছেই ওর নেই। এসব কথা অ্যাশলের কাছে ওকে অনেক শুনতে হয়েছে, সেই যখন ও আর অ্যাশলে টারার বারান্দায় বসে গল্প করত। 

একটা জিনিষ জানার জন্যি ওর এত আগ্রহ – অ্যাশলে বউকে আবেগপূর্ণ চিঠি লেখে কি না। এখন অবধি তো লেখেনি। ওই লেখার বাক্সের মধ্যে রাখা সব চিঠিই ও পড়ে ফেলেছে। তাতে ও এমন কিছু পায়নি যেটা কোন ভাই তার বোনকে লিখতে পারে না। চিঠিগুলোর মধ্যে স্নেহের প্রকাশ আছে, কৌতুকপূর্ণ, যুক্তি তর্কের অবতারণা রয়েছে – কিন্তু কোনটাকেই ঠিক প্রেমিকসুলভ বলা যায় না। স্কারলেট নিজে এত প্রেমপত্র পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে কোনটা প্রেমের চিঠি আর কোনটা নয় সেটা বুঝতে ওর একটুও দেরি হয়না। এই চিঠিগুলোতে সেই ব্যাপারটাই নেই। গোপনে চিঠিগুলো পড়ার পর ওর মধ্যে একটা পরিতৃপ্তির ভাব আসে, কারন ও বুঝতে পারে অ্যাশলে এখনও ওকেই ভালবাসে। মনে মনে মেলানির সারল্যকে ও একটু বিদ্রূপের চোখেই দেখে – কারন মেলানি বুঝতেই পারে না যে অ্যাশলে স্কারলেটকে শুধু বন্ধু হিসেবেই দেখে না। অবশ্য বেচারা কি করেই বা বুঝবে? আর কোন ছেলের কাছ থকে মেলানি তো কোন প্রেমপত্র পায়নি যে সেগুলোর সাথে অ্যাশলের চিঠি মিলিয়ে তফাতটা ধরতে পারবে! 

“কি যে বোকার মত সব চিঠি লেখে!” স্কারলেট মনে মনে ভাবল। “আমার বর যদি এরকম হাবিজাবি কথায় চিঠি ভরিয়ে দিত তাহলে আমি নির্ঘাত কথা শুনিয়ে দিতাম। চার্লিও এর থেকে ভাল চিঠি লিখত!” 

ও চিঠি গুলো উলটে পালটে তারিখগুলো দেখতে লাগল। কোনটাতে কি লেখা আছে মনে পড়তে লাগল। একটাতেও ছাউনি কিংবা লড়াইয়ের বর্ণনা নেই, যেমন ডার্সি মীড ওর মা বাবাকে লিখেছে, অথবা বেচারা ডালাস ম্যাকলিয়োর ওর আইবুড়ো বয়স্ক দিদি মিস ফেথ আর মিস হোপকে লিখে থাকে। মীডরা আর ম্যাকলিয়োররা খুব গর্বের সাথে এই চিঠিগুলো সবাইকে পড়ে শোনায়। স্কারলেট মনে মনে একটা গোপন লজ্জা পোষণ করে যে ওদের সেলাইয়ের দায়িত্বে থাকা মেয়েদের বৃত্তে মেলানির অ্যাশলের চিঠি থেকে সেরকম কিছুই পড়ে শোনাবার থাকে না। 

মনে হয় মেলানিকে চিঠি লেখার সময় অ্যাশলে যুদ্ধ ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণ অবহেলা করে যায় আর নিজেদের মধ্যে একটা অন্তুহীন সময়ের যাদুবৃত্ত রচনা করে নেয়, যেখানে ফোর্ট সামটারের ঘটনার পর যেন সব কিছু স্থির হয়ে গেছে। যেন ও নিজেকে বিশ্বাস করাতে সচেষ্ট যে যুদ্ধটা হয়ইনি। মেলানি আর ও যেসব বই পড়েছে, ও সেগুলোর কথা লেখে। ওরা দুজনে যে সঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হয়েছে, যে সমস্ত পুরনো বন্ধুদের ওরা জানে, যে সমস্ত জায়গা ও ঘুরে বেড়িয়েছে, সেসব নিয়ে লেখে। ওর চিঠিগুলোতে ঘরে ফেরবার আর্তি থাকে – কবে আবার টুয়েল্ভ ওকসে ফিরে আসতে পারবে, শিকারে আর লম্বা সফরে যেতে পারবে বনভুমি পেরিয়ে, বারবেকিউর কথা, চাঁদের শান্ত আলোর কথা আর পুরনো বাড়ির স্নিগ্ধ পরিবেশ – এসব নিয়ে আক্ষেপ। 

একটু আগে যে চিঠিটা পড়ল তার কয়েকটা কথা মনে পড়ল, “কিন্তু এরকম জীবন কল্পনার বাইরে ছিল! এ আমরা কখনওই চাইনি!” যেন একটা ব্যাকুল হৃদয়ের আর্তনাদ, যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে! ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে! যদি ওর আঘাত লাগবার বা মরে যাবার ভয় না থাকে, তাহলে ওর এত কিসের ভয়? বিশ্লেষণ করবার ক্ষমতা না থাকায় বিষয়টা ওর কাছে খুব জটিল হয়ে পড়ল। 

“যুদ্ধে ওর মনের শান্তি নষ্ট হয় .... যেসব জিনিষে ওর শান্তি নষ্ট হয় সেসব জিনিষ ওর পছন্দ নয় ... আমাকেই ধরা যাক ... ও আমাকে ভালবাসত কিন্তু ও আমাকে বিয়ে করতে ভয় পেল কারন .... ও ভয় পেল আমি হয়ত ওর চিন্তা ভাবনাগুলোকে – জীবনধারা – এলোমেলো করে দেব। না ও ঠিক ভয় পেয়েছিল তা নয়। অ্যাশলে মোটেই ভীতু নয়। যদি তাই হত তাহলে খবরে ওর নাম এতবার বলা হত না। তাছাড়া কর্নেল স্লোন নিজে মেলানিকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন যে ও কিরকম বীরের মত সাহসের সঙ্গে লড়াই করে। ও যখন কিছু করবে বলে ঠিক করে ফেলে, তখন কেউ ওকে সেই কাজ থেকে বিরত করতে পারে না। যদিও ও বাস্তব জীবনের থেকে বেশি নিজের ভাবনা চিন্তার মধ্যেই বেশি থাকতে ভালবাসে। আসলে ও এই বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না ... জানি না কোনটা ঠিক। সেই অনেক বছর আগে, আমি যদি ওর অনুভুতিটা একটুও আন্দাজ করে থাকতে পারি, তাহলে বলব ওর আমাকে বিয়ে করা উচিত ছিল।” 

একটু সময় চিঠিগুলো বুকের কাছে ধরে অ্যাশলের কথা চিন্তা করল। ওর প্রতি অনুভুতি এখনও একইরকম আছে – সেই যেদিন থেকে ও ওর প্রেমে পড়েছিল, বাক্যহারা হয়ে গেছিল। সেই যখন ওর বয়স ছিল চোদ্দো বছর – ও টারার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল – অ্যাশলে ঘোড়ায় চড়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছিল – সকালের আলোয় ওর রূপোলি চুল হাওয়ায় উড়ছে। তখনও ওর ভালবাসার অনুভুতিটা ছিল এক কিশোরী মেয়ের আবেগ, এমন একজন পুরুষকে ঘির্‌ যাকে সে বুঝে উঠতে পারে না, বিশেষ করে সেই নাগাল না পাওয়া স্বভাবটাই ওকে আকর্ষণ করে। অ্যাশলে ছিল তার স্বপ্নে দেখা নিখুঁত একজন বীরপুরুষ যার কাছ থেকে ওর কিশোরী মনের প্রত্যাশা বেশি কিছু ছিল না – ভালবাসার স্বীকৃতি হিসেবে কেবল একটা চুম্বন। 

চিঠিগুলো পড়ার পরে ওর ধারণা আরও দৃঢ় হল যে অ্যাশলে ওকে - স্কারলেটকেই ভালবাসে, যদিও ও মেলানিকে বিয়ে করেছে। এই একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়াটাই ওর একমাত্র আকাঙ্ক্ষা। কি আর এমন বয়স হয়েছে ওর, আর মনটাও অনাঘ্রাত থেকে গেছে। চার্লসের এলোমেলো অপটুত্ব আর অপ্রতিভ নৈকট্য যদি ওর হৃদয়তন্ত্রীতে কোন সাড়া জাগিয়ে থাকত তাহলে অ্যাশলেকে নিয়ে ওর স্বপ্ন শুধু একটা চুম্বনের প্রত্যাশায় শেষ হয়ে যেত না। স্বল্পমেয়াদী জ্যোৎস্নালোকিত যে সব রাত্রি ও চার্লসের সঙ্গে কাটিয়েছিল, তাতে ওর মনে সেরকম কিছু অনুভুতির বিকাশ ঘটেনি। চার্লস ওর মধ্যে সত্যিকারের আবেগ বা কোমলতা জাগিয়ে তুলতে পারেনি কিংবা দেহ ও মনের সত্যিকারের ঘনিষ্ঠতার স্বাদ দিতে পারেনি। 

আবেগ বলতে ওর মনে হয়েছিল এক উদ্দাম পুরুষসুলভ কামনার কাছে একটা মেয়ের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ – যন্ত্রণাদায়ক আর হতবুদ্ধিকর এক অনুভুতি যার পরিণতি সন্তানের জন্ম দেওয়ার মত আরেকটা যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতায়। বিবাহ ব্যাপারটা যে এরকমই হয় সেটা ওর কাছে আশ্চর্যজনক মনে হয়নি। এলেন ওকে বিয়ের আগে বলেছিলেন যে মেয়েদের কাছে বিয়ে ব্যাপারটা সম্ভ্রম বজায় রেখে সহ্য করার ক্ষমতা। বিধবা হবার পরে আরও অন্যান্য বিবাহিত মহিলাদের কানাকানি থেকে বুঝতে পেরেছিল কথাটা মিথ্যে নয়। তাই স্কারলেট এই বিবাহ আর আবেগের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে খানিকটা হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। 

বিবাহবন্ধন থেকে মুক্তি পেলেও স্কারলেট কিন্তু ভালবাসার ব্যাপারে নির্মোহ হল না। অ্যাশলের প্রতি ওর ভালবাসা যেন বিয়ে কিংবা আবেগের থেকে আলাদা কিছু। এমন কিছু যা খুবই পবিত্র আর অসম্ভব সুন্দর। এই অনুভুতি সেই স্বারোপিত মৌনতার দিনগুলোতে অত্যন্ত গোপনে ওর আশা আর স্মৃতিজর্জরিত মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। 

চিঠিগুলো বেঁধে রাখতে রাখতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল – হয়ত এই নিয়ে হাজার বার – অ্যাশলের চিন্তা ভাবনার নাগাল পাওয়া সত্যিই খুব দুষ্কর। ব্যাপারটাকে নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসার ব্যর্থ চেষ্টা করল, কারন ওর জটিলতাহীন ভাবনা চিন্তার জগতে সিদ্ধান্তে আসা সোজা নয়। চিঠিগুলো যথাস্থানে রেখে ও ঢাকনা বন্ধ করে দিল। তারপর ভ্রুকুঞ্চিত করল, কারন সদ্য পড়া চিঠির শেষের অংশটা ওর মনে পড়ল, যেখানে ক্যাপটেন বাটলারের কথা বলা আছে। খুবই আশ্চর্যের কথা যে অ্যাশলে, ওই পাজী লোকটা এক বছর আগে কি বলেছি্‌ সেটাকে এত গুরুত্ব দেবে! অস্বীকার করার উপায় নেই যদিও উনি খুব ভাল নাচতে পারেন, তবুও উনি খুবই পাজী লোক। পাজী লোক না হলে কি আর কনফেডারেসি আর মেলা সম্বন্ধে ওই সব আজেবাজে কথা কেউ বলতে পারে? 

ও আয়নার কাছে গিয়ে নিজের চুলের ওপর সযত্নে হাত বোলাল। যেমন হয়ে থাকে, নিজের সাদা ত্বক আর তির্যক সবুজ চোখ দেখে ওর মনের মধ্যে উৎসাহ সঞ্চার হল । একবার হাসল যাতে গালে টোল পড়ে। তারপর রেট বাটলারের কথা মন থেকে সরিয়ে দিয়ে খুশি মনে আয়নায় নিজের চেহারার প্রতিফলন দেখতে লাগল। মনে পড়ল ওর গালে টোল পড়লে অ্যাশলে কত খুশি হত। অন্য মেয়ের বরকে ভালবাসার জন্য, কিংবা সেই মেয়ের চিঠি লুকিয়ে পড়ার জন্য ও বিবেকের কোন দংশন অনুভব করল না, কিংবা ওর প্রসন্নতাতেও ব্যাঘাত ঘটল না। অ্যাশলে যে ওকেই ভালবাসে এ সম্বন্ধে ও নিশ্চিত হয়ে গেল। 

খুব হালকা মনে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে স্বল্পালোকিত ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। মাঝপথে এসে গু্নগুন করে গান ধরল “জানি নিষ্ঠুর যুদ্ধ স্তব্ধ হলে, তুমি ফিরে এসে ধরবে আমার হাত”।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ