আলফানসো রেয়েস'এর গল্প : মেজর আরান্দার হাত

অনুবাদ : তৃপ্তি সান্ত্রা

যুদ্ধে মেজর আরান্দা তাঁর হাত হারালেন। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এটি তাঁর ডান হাত। লােকজন হাত সংগ্রহ করে থাকেন। সেগুলাে ব্রোঞ্জের, হাতির দাঁতের, কাঁচের আর কাঠের। কখনাে এগুলাে সংগ্রহ করা হয় ধর্মীয় মূর্তি আর ছবি থেকে; প্রাচীন মূর্তির কারবারীরা বাড়িতে এসেও এগুলাে সরবরাহ করেন। সার্জেনরা অ্যালকোহলের বােতলে ফালতু সব জিনিস রাখেন। কেন এই ছিন্ন হাতকে মহান কাজের চিহ্ন হিসাবে, সংরক্ষিত করা হয় না? আমরা কি নিশ্চিন্ত যে মাথা বা হৃদয়ের চেয়ে হাত কম মূল্যবান?

এই নিয়ে একটু চর্চা করা যাক। আরান্দা চর্চা করেননি কিন্তু গােপন এক প্রবৃত্তি তাঁকে আচ্ছন্ন করেছিল। ধর্মীয় মানুষ, ভগবানের হাতে মাটি দিয়ে গড়া পুতুলের মতাে। জৈবিক মানুষ, কাজের জন্য ধন্যবাদ দেয় হাতকে। এই হাত পৃথিবীকে এক নতুন স্বাভাবিক রাজধানী উপহার দিয়েছে। শিল্প এবং সৃষ্টিকলার রাজধানী। যদি বল, অ্যাম্ফিয়নের বীণা শুনে থীবসের শক্ত প্রাচীর উঠেছিল, জেনাে, এ তাঁর মিস্ত্রী ভাই জেথুসের কাজ। নিজের হাতে গেঁথে সে পাথরের দেওয়াল তুলেছিল। প্রত্নপুরাণে দেখা যায় কায়িক শ্রমিকরা জাদু ক্ষমতা সম্পন্ন, তাঁরা বিস্ময়-শ্রমিক। তারা অরাজকোর (Orozco) আঁকা ‘আগুন সরবরাহকারী হাত'। দিয়াগাে রিভেরার মুরালে এই হাত ধরে আছে সৃষ্টিস্থিতি প্রলয়ের আধার জগৎ ব্রহ্মাণ্ডকে; আর শঁপিয়ের ছবিতে শ্রমিকশ্রেণির হাত, পৃথিবীর দখলদারি ফিরিয়ে নেবার দাবিতে সােচ্চার। প্রস্তুত।

অন্য অনুভূতিগুলাে নিষ্ক্রিয়। কিন্তু কায়িক বােধ নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে, পৃথিবীর কাটুম-কুটুম ফেলা ছেঁড়া থেকে তৈরি করে এক মানব শৃঙ্খলা—মানব-পুত্র। এই ছাঁদেই বয়াম আর গ্রহ; এটাই ঘােরায় কুমােরের চাকাকে আর খুলে দেয় সুয়েজ ক্যানাল।। 

একটা সূক্ষ্ম এবং শক্তিশালী যন্ত্র, যার রয়েছে সমস্ত সৌভাগ্যশালী শারীরিক উৎসঃ জোড়, সাঁড়াশি, চিমটা, আকড়া, ছােটো শক্ত শৃঙ্খল, নার্ভ, লিগামেন্ট, পীঠ, উপত্যকা এবং টিলা। এটা একই সঙ্গে নমনীয় এবং শক্ত, উগ্র এবং মিষ্টি। 

যেন পাঁচ পাপড়ির একটা আশ্চর্য ফুল, বাইরের সামান্য ইশারাতেই ফুটে ওঠে, পাপড়ি গােটায়। পাঁচ সংখ্যাটি কি বিশ্বের ঐকতানে একটি বিশেষ সংখ্যা? ডগ-রােজ, ফরগেট-মী-নট, এদের বিন্যাস সারণীতে কী হাতকে ফেলবাে? হস্তরেখাবিদরা সম্ভবত তাদের বিষয়ে সঠিক, ব্যাখ্যায় নয়। অনেকদিন আগে যদি তাঁদের ভুল বিচার ক্ষমতা বুঝতে পেরে মুখ থেকে হাতে ফিরে আসেন, তবে বলতে হয় তাঁরা সঠিক নিরূপণ করতে পেরেছিলেন যে, মুখ আয়না যা প্রকাশ করে। কিন্তু কাজ করে হাত। 

হাত যে অস্বাভাবিক গুরুত্ব দাবি করে এই নিয়ে কোন সন্দেহ নেই—স্বাভাবিকভাবেই মেজর আরান্দার গৃহদেবতার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় জায়গাটি দখল করে হাত। 

খুব যত্ন করে ঢাকা একটা রত্ন পেটিকায় রাখা হয় হাতটিকে। কোঁচকান সাদা সাটিনের ভাঁজগুলাে যেন আলপাইনের নিসর্গভূমি। সময় সময়ে ঘনিষ্ট বন্ধুরা কয়েক মিনিটের জন্য এটি দেখতে পারে। খুবই মনােমুগ্ধকর, সবল আর ধীমান এই হাত, যেন তরবারির হাতল ধরার উত্তেজনায় এখনও আবেগমথিত।

ক্রমে ক্রমে এই রহস্যময় বস্তু এই গােপন কবচ বিখ্যাত হয়ে গেল। আর রত্ন ভাণ্ডার থেকে উঠে এলাে বসার ঘরের শাে-কেসে। উচ্চ সামরিক স্মারক প্রদর্শনী ঘরে স্থান হল তার। 

ধীরে, নিঃশব্দে গুপ্ত জীবন প্রবাহের জানান দিয়ে, নখ বাড়তে শুরু করল। কখনও মনে হল এই বৃদ্ধি খুবই ধীর, আবার পরক্ষণেই মনে হল স্বাভাবিকভাবেই বাড়ছে। প্রথম প্রথম খানিকটা বিরুদ্ধতা ছিল, পরে পরিবারের হস্তপরিচর্যাকারী, প্রতি সপ্তায় হাতের যত্ন নিতে রাজী হলেন। যত্ন নেবার ফলে হাত ছিল সব সময় ঝকঝকে তকতকে। 

পরিবারের কেউ কিছু জানল না –(এইরকমই ছিলেন মানুষটা)- তিনি ভগবানের মূর্তিকে শিল্প-বস্তুতে পরিণত করলেন—হাত তার আসন হারালাে; স্মৃতিহীনতায় ভুগলাে, প্রত্ন শিল্পের গরিমা হারিয়ে সাংসারিক জিনিসের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ছমাস বাদে, পেপার ওয়েটের কাজে ব্যবহার হতে লাগল। পান্ডুলিপির পাতা ধরার কাজেও ব্যবহৃত হত এটা। মেজর, নিজের আত্মকথা লিখছিলেন বাম হাত দিয়ে। আহত হাতটা নড়াচড়া করতে পারে, সেটি প্লাস্টিকের এবং অনুগত আঙ্গুলগুলিকে যেভাবে ব্যবহার করতে চান, করা যায়। 

শীতল নির্লিপ্ততা সত্ত্বেও, বাড়ির শিশুদের হাতের ওপর কোন শ্রদ্ধা ছিল না। বছর শেষে, তারা এটা দিয়ে নিজেদের খামচাতাে অথবা এর আঙুল ভাঁজ করে আন্তর্জাতিক লােককথার অনুকরণে বিভিন্ন নিষিদ্ধ যৌন ভঙ্গি তৈরি করে নিজেরা মজা নিত।। 

এইভাবে সম্পূর্ণ ভুলে যাওয়া অনেক জিনিসের কথা মনে পড়ে হাতের। চোখে পড়ার মতাে স্বকীয়তা ফুটে উঠলাে ব্যক্তিত্বে। নিজের সচেতনতা এবং চরিত্র ফিরে পেল। চেষ্টা করল কাজ শুরুর আগে অন্যের চিন্তা জানতে। তারপর শুরু করল মাকড়সার মতাে চলতে। সব কিছুতেই যেন খেলার আবহ পেল। আর একদিন যখন দেখা গেল সে নিজের হাতে নিজে নিজেই দস্তানা পরতে পেরেছে আর ঘাম হওয়া হাতে একটা বালা পরাতে পেরেছে, সে আর কারাে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারল না। 

কাঁকড়ার মতাে চলনে, ছােট বিচ্ছু কুকুর ছানারমতাে সে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাে। পরে সে দৌড়াতে শেখে। প্রায় খরগােসের মতাে লাফাতে পারে, নখের ওপর বসে, বিচক্ষণের মতাে বড় লাফও দিতে পারে। একদিন দেখা গেল বাতাসের এক স্রোতে সে ভেসে আছে, উড়ে যাবার ক্ষমতা অর্জন করেছিল সে। 

এই সব কাজে সে নিজেকে কীভাবে উদ্বুদ্ধ করে, কীভাবে দেখে? আহ! কোনও কোনও সন্ত বলেন, শিক্ষা এবং অনুশীলনে দীক্ষিত হলে রেটিনায় অভেদ্য এবং অন্যান্য অঙ্গে ভেদ্য এক মেদুর আলাে দেখা যায়। হাত কী দেখতেও পায় না? স্পর্শের অনুভূতি দিয়ে দেখে হাত, তার আঙুল প্রায় চোখের মতাে। বাতাসের স্পন্দনে হাতের তালু দেখতে পায়, যেভাবে বাদুরেরা মস্তিষ্ক দেখে। মেরু অভিযানে মেঘাচ্ছন্ন যাত্রায় নানুক, এস্কিমােরা নিজেদের একটা সুবিধা মতাে পরিবেশে আনতে পেরে হাত নাড়ান। চোখ পেশি এড়িয়ে যায় যে তরঙ্গগুলি, যে তরঙ্গগুলি অদৃশ্য এবং প্রতিরােধহীন—এমন হাজার প্রবাহমান জিনিসের দৃষ্টি আকষর্ণ করতে পারে হাত। 

ঘটনা হল, স্বাবলম্বী হতে না হতেই হাত হয়ে উঠলাে অবাধ্য, হয়ে উঠলাে মেজাজী। বলা যায়, তখন সবটাই 'আমাদের হাতের বাইরে'। নিজের খুশি মতাে সে যায়। আসে। যখন খুশি অদৃশ্য হয়ে যায়, ফিরেও আসে নিজের মর্জি মতাে। বােতল আর মদের গেলাস থেকে সে অসম্ভব ভারসাম্যর দুর্গ তৈরি করেছিল। বলা হত, তার কখনও নেশাও হয়ে যেত। কখনও কখনও সে নেশা সারারাত থাকতাে। 

কারাে কথা মানত না। সে ছিল দামাল এবং দুষ্টু। কেউ ডাকলে নাক খামচে দিত, দরজায় কেউ কিছু নিতে এলে দিত চড় কষিয়ে। নড়াচড়া না করে স্থির হয়ে থাকতাে মৃতের মতাে। যারা এসবের সঙ্গে পরিচিত ছিল না তাদের বিলাপ করার সুযােগ করে দিত আর তারপর হঠাৎ একটা অশ্লীল ভঙ্গি করতাে। পূর্বতন মালিকের চিবুকের নিচে খামচে দিয়ে মজা লুঠতাে। আর যেন মশা তাড়াচ্ছে এমন একটা অভ্যাস পেয়ে বসেছিল তাকে। মালিক এটাকে ভালােবাসা বলেই মনে করতাে। যেন বখে যাওয়া ছেলেকে সমঝে চলছে, চোখ জলে ভরে উঠতাে তার। 

সব কিছু গােলমাল করে দিত হাত। কখনও সে বাড়ি পরিষ্কার আর গােছানাের কথা ভাবতাে। অন্য সময় পাটীগণিতের ক্রম এবং সংমিশ্রণের দক্ষতায় সে বাড়ির সব জুতােকে মিশিয়ে ফেলতাে। পাথর ছুঁড়ে জানালার কাচ ভাঙতাে বা রাস্তায় যে ছেলেরা খেলতাে তাদের বলগুলাে লুকিয়ে রাখতাে।

মেজর এসব লক্ষ্য করতেন এবং নীরবে দুঃখ পেতেন। তাঁর স্ত্রী এটাকে ঘেন্না করতেন। আর অবশ্যই তিনি ছিলেন খুব পছন্দের মুর্গী। হাত হয়তাে অন্য কোন কাজে যাচ্ছে, সেলাই আর রান্নার কাজে গুচ্ছেক জ্ঞান দিয়ে মহিলাকে হেনস্তা করতাে বিস্তর। 

ঘটনা হল পরিবারটি নীতিভ্রষ্ট হল। হাত হারিয়ে লােকটি তার আগের আনন্দময় জীবনের তুলনায় অনেক হতাশ এবং বিষাদগ্রস্ত। তার স্ত্রী অবিশ্বাসী আর সহজেই ভয় পেয়ে যান, ভীতুপ্রকৃতির। অবহেলা পেয়ে ছেলেমেয়েরা পড়াশােনা ছেড়ে দিল আর ভালাে আচরণ ভুলে গেল। সব কিছু হঠাৎ দুম করে হচ্ছে, অপ্রয়ােজনীয় উঞ্ছবৃত্তির পেছনে ছােটা, গােলমাল, দরজায় ধাক্কা—যেন একটা অশুভ আত্মা ঢুকে পড়েছে বাড়িতে। খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে দেরিতে। কখনও উঠোনে, কখনও ঘরে, কারণ মেজরের ত্রাস, তার স্ত্রীর তীব্র প্রতিবাদ এবং বাচ্চাদের হল্লা, আমােদের মাঝে হাতটি নিজের শরীর চর্চার জন্য, ডাইনিং রুমটি দখল করে নিয়েছে। নিজে ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখে, যারা এই কাজে বাগড়া দিচ্ছে, তাদের মাথা লক্ষ্য করে প্লেট ছুঁড়ছে। আরান্দার কথা মতাে অস্ত্রশস্ত্র আর মালপত্র নিয়ে সমর্পণ করা ছাড়া, কারাে কোন উপায় ছিল না। 

পুরনাে ভৃত্য এমনকী নার্স, যিনি বাড়ির মালকিনকে মানুষ করেছে সবাই পালাল। নতুন চাকররা এই ভুতুড়ে বাড়িতে একদিনও টিকল না। বন্ধু আর আত্মীয়স্বজনরা এই পরিবারটিকে বাতিল করল। প্রতিবেশীদের নালিশের জ্বালায় পুলিশ অতিষ্ঠ। জাতীয় প্রাসাদে শেষ যে রূপাের ঝাঝরি ছিল সেটা ম্যাজিকের মতাে উধাও। চুরি ডাকাতি এমন মহামারীর মতাে বেড়ে গেল—সবাই দোষ দিল ওই রহস্যময় হাতকে। যদিও সে প্রায়ই নির্দোষ।

সবচেয়ে নিষ্ঠুর ব্যাপার হল, লােকেরা হাতকে দোষ দিল না। বিশ্বাস করল না নিজের জীবনকে নিয়ে মজা করতে পারে এমন একটা হাত আছে। সব কিছু হতভাগ্য এক হাতওয়ালা মানুষের কুকীর্তি বলে দোষ চাপালাে। তার ছিন্ন সদস্যটি অর্থাৎ হাতটির জন্য আমাদের সেই হ্যাপা পােয়াতে হচ্ছে স্যান্টা অ্যানার পায়ের জন্য যে হ্যাপা পােয়াতে হয়েছিল। নিঃসন্দেহে আরান্দা একজন জাদুকর, যে জোট বেঁধেছে শয়তানের সঙ্গে। লােকে বুকে ক্রশ আঁকতাে।

এর মধ্যে কী হল, কার কী ক্ষতি করেছে সে ব্যাপারে হাত উদাসীন কিন্তু সে অ্যাথেলেটিক পেশী বাড়িয়েছে। সে হয়ে উঠেছে বলশালী, খুব প্রত্যয়ের সঙ্গে সুগঠিত। শিখে ফেলেছে কীভাবে আরাে কাজ করতে হয়। সে কী মেজরের স্মৃতিকথা, নিজে লেখার চেষ্টা করেনি? যে রাত্রে সে ঠিক করল মােটরে করে বাইরে একটু হাওয়া খেতে যাবে, তাকে বাঁধা দেবার ক্ষমতা আরেন্দা পরিবারের  ছিল না। বুঝলাে, পৃথিবী রসাতলে যাচ্ছে। কিন্তু একটাও দুর্ঘটনা হল না, পুলিশকে জরিমানা বা ঘুষ কিছুই দিতে হল না। মেজর বললেন, শেফাররা গাড়ি নিয়ে গিয়ে খুব ধুলাে মাখিয়ে আনে।  অন্তত তার গাড়িটা যেন এই রকম ভালাে অবস্থায় রাখতে পারে।

নিজের স্বভাব পাল্টে, হাত ক্রমে ক্রমে দখল করার মনােভাব ত্যাগ করে একটা প্ল্যাটেনিক ধারনাকে রূপ দিতে প্রস্তুত হলো। একটা নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছে হলো যখন দেখা গেল মুর্গুগীগুলো মাথা মুচড়ে মারা হয়েছে, বা যখন অন্য লােকের কাছে পাঠানাে মিশ্র দ্রব্যগুলাে, আরান্দা যেগুলাে খুব যত্নে পাঠিয়ে ছিলেন, বাজে ওজর এবং ব্যাখ্যাহীন কারণে ফিরে এলাে—এটা স্পষ্ট হল, হাত পশু হত্যাকারী এবং চোর। 

লােকে এখন আরান্দার সাধুতা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ শুরু করল। তারা বিভ্রম, আত্মাদের হল্লা আর প্রকৃতির নানা শক্তির কথা বলল। যে কুড়ি-তিরিশটা লােক হাতটা দেখেছে, তারা বিশ্বাসযােগ্য নয় কারণ তারা ভৃত্যস্থানীয়, খুব সহজেই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন; আর যারা মাঝারি সংস্কৃতি সম্পন্ন, তারা নিশ্চুপ। সমঝােতা করার ভয়ে বা হাস্যস্পদ হবার ভয়ে, উত্তর দিলেও বলে বাঁকা ভাবে। পুরাণের উৎস নিয়ে, নির্দিষ্ট নৃবিদ্যার গবেষণামূলক প্রবন্ধের আলােচনার জন্য—দর্শন এবং সাহিত্য বিভাগের আলােচনা চক্র বসল।।

এই গল্পে কোমল এবং ভয়ংকর কিছু একটা আছে। একদিন মাঝরাতে ভয়ঙ্কর ভয়ে আরান্দার ঘুম ভেঙে গেল। ছিন্ন ডান হাত গভীর প্রণয়ে বাম হাতের কাছে এসেছে। সারা জীবনের সঙ্গী ছিল তার, যেন নিবিড় সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য কতদিনের প্রতীক্ষা। এদের বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব। বাকি রাত্রি এটা সেখানেই কাটালাে এবং সেখানেই সিদ্ধান্ত নিল সেদিন থেকে রাত্রি ওখানে কাটাবে। প্রথা দানােদের বিখ্যাত করে। মেজর হাতের দিকে নজর দেওয়া ছেড়ে দিলেন। তার এটাও মনে হল এই অদ্ভুত সংযােগ তার অঙ্গহানিকে সহনীয় করে তুলেছে এবং যেভাবেই হােক এটা তার একলা হাতটিকে আরাম দিতে পেরেছে। 

বেচারী বাম হাত, স্ত্রী-হাতটি চুমু চায়। পুরুষ-ডান হাতের সান্নিধ্য চায়। এটাকে তুচ্ছ জ্ঞান করব না। মূল্যবান নুড়ি যেভাবে প্রাগৈতিহাসিক বৈশিষ্ট্য ধরে রাখে, ধীরগতিতে, হাতও বাঁচিয়ে রাখে ধীরগতি... শতাব্দী ব্যাপী নিষ্ক্রিয়তা ... আমাদের প্রজাতি এইভাবেই বেড়ে উঠেছে। ডান হাতের স্পর্ধার পাগলামিকে, উচ্চাকাঙ্খাকে—শােধরায় এই বাম হাত। বলা হয়, আমরা সৌভাগ্যবান কারণ আমাদের দুটো ডান হাত নেই। সেটা হলে নিখাদ সুক্ষ্মতা এবং জটিল চারুশিল্পর মধ্যে আমরা হারিয়ে যেতাম, আমরা প্রকৃত মানুষ হতে পারতাম না। আমরা হতাম হাত দিয়ে ভােজবাজি দেখানাের কারিগর। তাঁর পরিশীলিত সংবেদনশীলতাকে সংযত করে, গগ্যা যখন তার ডান হাতকে তাঁর বা হাতের স্বতঃস্ফূর্ততা, অকপটতা দিয়ে আবার আঁকতে বলেন, গঁগা জানেন তিনি কী করতে যাচ্ছেন। 

যাইহােক, এক রাত্রে, পাঠাগারের দরজা খুলে, হাত নিবিড় পাঠে মগ্ন হল। গীদ্য মপাঁসার একটা গল্প পড়ল যেখানে ছিন্ন হাতটি, গলা টিপে শত্রুকে মারছে। নার্ভালের একটা সুন্দর কল্পগল্প পড়লাে যেখানে একটা জাদু হাত সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছে, সৃষ্টি করছে সৌন্দর্য। তাড়াচ্ছে দুষ্টু আত্মাদের। সে দার্শনিক গ্রোস-এর হাতের দর্শন বা ঘটনা নিয়ে কিছু নােটস পড়ল। হায় ভগবান! এই বর্ণমালার ওপর ভয়াবহ বহিরাক্রমণের ফল কী ?

ফল হল দুঃখজনক এবং গভীর। উদ্ধত স্বাধীন হাত, যে নিজেকে ব্যক্তি মনে করতাে, মনে করতাে সর্ব শক্তিমান এক অস্তিত্ব, নিজের আচরণের আবিষ্কারক—তার এই ধারণা দৃঢ় হল যে এটা এলাে সাহিত্যিক বিষয় মাত্র, একটা কাল্পনিক বিষয়, যা নিয়ে বহু কলমচি বহু লিখেছেন। দুঃখ নিয়ে, অসুবিধা নিয়ে—আর আমি এও বলব অনেক চোখের জল ফেলে—সে বসার ঘরের শাে-কেসে নিজের জায়গা করে নিল, রইল তার রত্নখচিত বাক্সে, যেখানে প্রথমে খুব যত্নের সঙ্গে তাকে রাখা হয়েছিল সামরিক বৈভব, সাজসজ্জা প্রদর্শনীর মাঝে। স্বপ্ন ভঙ্গতা আর বিষাদ, সে নিজের মতাে করে আত্মহত্যা করল। মরতে দিল নিজেকে।

দীর্ঘদিন হাতের অনুপস্থিতি, সারা রাত নিদ্রাহীন কেটেছে মেজরের। সূর্য উঠছে। মেজর রত্ন মঞ্জুষায় আবিষ্কার করলেন হাতটিকে। একটু কালাে হয়ে গেছে। যেন কেউ মেরে ফেলেছে শ্বাসরােধ করে। তিনি তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। যখন তিনি অবস্থাটা বুঝতে পারলেন, নার্ভাস হয়ে চালু চাকরিতে ইস্তফা দেবার জন্য যে দরখাস্ত লিখেছিলেন, সেই কাগজটা কুঁচকে ফেললেন। সামরিক ঔদ্ধত্যে তিনি টানটান হয়ে পূর্ণ দৈর্ঘ্যে খাড়া গলা একদম তুঙ্গে চড়িয়ে বাড়িকে ত্রস্ত করে বললেনঃ সাবধান! ঝাঁপিয়ে পড়াে। সমস্ত ভেরীবাদকরা, যুদ্ধ জয়ের দামামা বাজাও।'


লেখক পরিচিতি
আলফানসো রেয়েস
মেক্সিকান লেখক, দার্শনিক ও কুটনীতিক। নোবেল পুরস্কারের জন্য তিনি পাঁচবার মনোনয়ন পেয়েছিলেন। জন্ম : ১৮৮৯। মৃত্যু :১৯৫৯। জাদুবাস্তববাদী ঘরানার কথাসাহিত্যের অন্যতম পাইওনিয়ার। হোর্হে লুইস বোর্হেস তাকে মেক্সিকোর যে কোনো সময়ের শ্রেষ্ঠ লখক মনে করতেন।



অনুবাদক পরিচিতি
তৃপ্তি সান্ত্রা
কথাসাহিত্যিক। অনুবাদক।
প্রবন্ধকার।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ