ইয়ূরি বুইদা'এর গল্প : সামুরাইদের স্বপনটি

অনুবাদ : অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় 

সাখালিনের ইউকিও সারুকাভা। তিনি ছিলেন আধা জাপানী, আধা রুশী বংশীয় এক মাণুষ। কাগজ ও কাঠ শিল্পের কারিগরি ইস্কুল থেকে হাতেকলমে কাজের প্রশিক্ষণ শেষে চলে আসেন আমাদের এই ছোট্ট মফস্বলে। কাজের সন্ধানে। আমাদের কাগজের প্লান্টে ফোরম্যানের কাজ পেয়ে যান। তবে ইউকিও'র পাসপোর্টের নাম কিন্তু ছিল অন্য। সেখানে তাঁর নাম লেখা থাকত- ইউকিও তোইয়ামোভিচ। আর এদিকে, আমাদের এই ছোট শহরটায় তিনি আবার ক্রমে পরিচিত হলেন- ইউরি তোলিয়ামোভিচ নামে। আমাদের বয়স্কা এক মুরুব্বী যখন তাকে প্রথমবার দেখলেন, তখন প্রথম দেখাতেই জিগিয়ে বসলেন-

"আচ্ছা- বাছা, সত্যি বলতো বাপু- তুমি আসলে ইহুদী, তাইনা?" 

তাকে, ক্রমে এবং অতঃপর আরও একটা নাম দেওয়া হল আবার। এবার তা' হল- সামুরাই। যদিও ইউকিও নিজে বরাবর এই শেষোক্ত নাম-পরিচয়টি থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে।নিজেকে সে এইভাবে বারবার প্রশ্ন করত - আমার বাবা যখন একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট আর মা যেখানে হলেন গিয়ে শিক্ষক, আমি বাপু কিকরে বা কেমন ধারায় একজন সামুরাই হই? তাঁর একমাত্র জাপানী যোগসূত্র বলতে বোধহয় ছিল আয়নার পাশে ঝোলানো ওই ওফুদাটা। একটা ভাঁজ করা ডায়মন্ড আকৃতির কাগজ, যার ওপরে হিয়েরোগ্লিফিকে লেখা- সার্বভৌম স্বর্গরাজ্যের খোদা, ঈশ্বর, কিম্বা দেবী আমাতেরাসু মিকিমির নাম। 

যাই হোক, এই কাগজ কারখানাতেই তার দেখা হল লিডা কর্তুনোভা নামের এক উজ্জ্বল, সুন্দরী ও উজ্জীবিত নারীর সাথে। খুব তাড়াতাড়িই তারা বিবাহের বন্ধনেও আবদ্ধ হলেন এবং সাত নম্বর স্ট্রীটে একটা বাসা নিয়ে সেখানেই সংসারও পাতলেন। 

লিডার শরীরে পরিবর্তন এলো। তার তলপেট তখন সবে সামান্য আকার নিচ্ছে, ইউকিও একটা ঝুলা টাঙ্গিয়েই ফেল্লেন তাদের বাগানে। আগত সন্তানের কথা ভেবে। বসন্ত এসে গেল। ইউকিও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে রোজ বেড়ালেন বাড়ীর বাইরে। অনুভব করলেন ফুলন্ত চেরীগাছের অনুপম শোভা। এল হেমন্ত। ইউকিও স্ত্রীকে পরম সাবধানে মোটরসাইকেলে বসান। বেড়াতে যান লেকের ধারে। হেমন্তের সন্ধ্যাগুলো ঘন্টার পর ঘন্টা তাদের কাটে দেতদোমভস্কি লেকের জলে চাঁদের অনন্য আভা অবলোকন করে। পরম নির্জনতায়, শান্তিময় ক্ষণে। হেমন্তের ঠান্ডা ক্রমে গাঢ় হলে লিডা'র যখন কষ্ট হতে লাগল, তার পশ্চাদ্দেশ ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে বলে মনে হলে লিডা তখন প্রশ্ন তুলত- কেন তারা এই হিম-জলের ধারে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা ।' আমাদের সন্তান যাতে এই চন্দ্রমার মত উজ্জ্বল, সুদর্শন হয় বা সুদর্শনা'- ইউকিও চকিতে উত্তর দিত। আর তারপর কবিতার পংক্তিগুলি আবৃত্তি করত- 

একি উজ্জ্বল 
একি উজ্জ্বল, কত উজ্জ্বল 
একি উজ্জ্বল, কত উজ্জ্বল, কী দারুন উজ্জ্বল এই চাঁদ

'সেতো জাপানী গাথার চাঁদ। তা কেমন করে পুরোপুরি আমাদের হবে'- মৃদু যন্ত্রণা মেশানো গলায় বলে উঠত লিডা। 

লিডার মিসক্যারেজ হয়েছিল। লিডা দিন রাত এক করে কেঁদেছিল। বাইরে তুষারপাত হচ্ছিল। আর ইউকিও তার টাঙ্গানো ঝুলাটার ওপর নিশ্চুপ বসে বসে শুধু সিগারেট খেয়েছিলো বিরামহীন। 

'আমাদের জাতি-রক্তের কোন মিল নেই। অনেক দূরের আমরা। ধর্মেও । আমি অর্থোডক্স আর তুমি একজন বিদেশী'- একদিন বলল লিডা। 

'তুমি যদি চাও, আমি তবে তোমার ধর্মে দীক্ষিত হতে পারি। করতে পারি ধর্ম পরিবর্তন। আমার কোন দুঃখ হবেনা।' 

লিডা মাথা নাড়ে। তার মনে ধোঁয়াশা। 'তোমার সবকিছু আলাদা। ভিনদেশী তুমি। এমনকি তোমার স্বপ্নগুলোও তাই। ভিনদেশী।' 

'কেমন করে তা জানছো লিডা?'- ইউকিও বলে। 

'ঈশ্বরকে তুমি বোকা বানাতে পারবেনা। বানানো যায়না।'- লিডা বলে ওঠে উত্তরে।

দ্বিতীয়বার মিসক্যারেজের পর লিডা এবার রীতিমত পানাসক্ত হয়ে পড়ল। মদের নেশার পাশাপাশি অন্য পুরুষদের সাথে মেলামেশাও শুরু করলো। 

ইউকিও একদিন কাবারতাই গেলো। নিজেকে ধর্মান্তরিত করলো খ্রীস্টধর্মে। অর্থোডক্স খ্রিস্টান হয়ে সে যখন ফিরে এল, দেখল- লিডা তখন রসুইঘরের ভেতর। তার এক পুরুষ-সঙ্গীর সাথে মগ্ন। প্রেমালাপে। লোকটির ডাকনাম সে জানে- স্টিঙ্ক। ভালো নামও জানে- বানাতিইয়া। 

লিডা ইউকিওকে দেখেই ক্ষেপে উঠল। সে বাড়ীতে ঢুকেছে কি ঢোকেনি, লিডা চিৎকার করে তার সঙ্গীকে নির্দেশ দিল- 'মারো ওকে।' ক্রোধে পাগল হয়ে সে এলোপাথারি বকতে থাকল- 'আমি যার সাথে খুশী শুইনা কেন, অন্তত আমাদের রক্তের জাত এক। বুঝলে??'

ইউকিও একটিও কথা না বলে বেরিয়ে যায়। তাদের ছোট্ট বাগানটিতে এসে বসে। সেই ঝুলাটির ওপরে। তখন খুব আস্তে আস্তে নরম তুষারপাত হচ্ছিল। যেন স্বপ্ন কোন এক। ইউকিও মনে মনে বলে- সবাই আজ যারা ঘুমিয়ে আছে, তাদের সবার জাতিরক্ত এক।

ভোরের দিকে, যখন গান গাওয়া মোরগপাখীর দীর্ঘ গানপর্ব শেষ, লিডা তখন ধীর পায়ে বাড়ীর বাইরে বের হয়ে এল। তার স্বামী তখন মৃত। তার বুকের ধুকপুকুনি স্তব্ধ হয়ে গেছে। 

ঝুলাটি দুলছে। ঝুলার দুইদিকে দুইখানি হাত। একদিকে দয়াময় প্রভু যীশুর, অপর দিকে আমাতেরাসু মিকামি- এই সর্বব্যাপী আকাশের জাপানী ঈশ্বরী। 

তখন নিস্তব্ধ তুষারপাত হচ্ছিল। আর চাঁদ উঠেছিল । রাশিয়ায়।


--------------------------------------------------------------------------------------------------------
লেখক পরিচিতি-
ইউরি ভাসিলিয়েভিচ বুইদা একজন রাশিয়ান গল্পকার, উপন্যাসিক। জন্ম ১৯৫৪ তে, রাশিয়ার কালিনিনগ্রাদ অঞ্চলে। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য - দ্য জিরো ট্রেইন, দ্য প্রাশিয়ান ব্রাইড, মোর অ্যান্ড মোর অ্যাঞ্জেল্‌স অ্যান্ড দ্য সামুরাই'স ড্রিম। বুইদা'র 'দ্য জিরো ট্রেইন' উপন্যাসটি ১৯৯৪ সালে রাশিয়ান বুকার প্রাইজের জন্য মনোনীত হয়েছিলো। তার গল্পসসংগ্রহ '' দ্য প্রাশিয়ান ব্রাইড" গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন অ্যাপোলন গ্রিগোরিয়েভ পুরষ্কার।



অনুবাদক
অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. এ লেখককে পড়িনি আগে। অসাধারণ এই গল্প। এই মুহূর্তে পড়া জরুরি। সাবলীল অনুবাদ। ধন্যবাদ, অনামিকা।

    উত্তরমুছুন