হোসে সারামাগো

কবীর চৌধুরী

হোসে সারামাগো জন্মগ্রহণ করেন ১৯২২ সালে। পর্তুগিজ এই লেখক সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯৯৮ সালে। তাঁর একাধিক গ্রন্থ নানা ভাষায় অনূদিত হয়ে সাধারণ পাঠক ও বিদগ্ধ সমালোচক উভয়ের বিপুল প্রশংসা অর্জন করেছে। সারামাগোর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘অন্ধত্ব’ প্রকাশিত হয় পর্তুগিজ ভাষায়, ১৯৯৫ সালে। উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে ।

সারামাগোর অন্য উপন্যাসগুলির মধ্যে আছে দি গসপেল অ্যাকর্ডিং টু জিসাস ক্রাইস্ট, দি হিস্ট্রি অব দি সিজ অব লিসবন, দি স্টোন র‍্যাফট, দি ইয়ার অব দি ডেথ অব রিকার্ডে রিস, দি টেইল অব দি আননোন আইল্যান্ড, দি ম্যানুয়াল অব পেইন্টিং অ্যান্ড ক্যালিগ্রাফি, বালথাজার ও ব্লাইমুন্ডা, সিইঙ্গ, দি ডাবল, দি কেইভ, অল দি নেইমস এবং ডেথ অ্যাট ইন্টারভালস ।

শেষ উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় এই বছর, অর্থাৎ ২০০৮ সালে । ‘অন্ধত্ব একটি অসামান্য উপন্যাস । এর বিষয়বস্তু অগতানুগতিক, বিচিত্র, বিস্ময়কর। এর রচনাশৈলীও অভিনব এবং নিরীক্ষাধর্মী । অকস্মাৎ একটি শহর একটি অভূতপূর্ব মহামারিতে আক্রান্ত হয় । একের পর এক মানুষ অন্ধ হয়ে যায়, কোনো কারণ ছাড়াই। চোখে কোনো ক্ষত হয় না, চোখ ব্যথা করে না, চোখ লাল হয় না, এক মুহূর্ত আগে সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল, পরের মুহুর্তে মানুষটি অন্ধ হয়ে যায় । এবং এই অন্ধত্বের প্রকৃতিও বিচিত্র। আমরা জানি যে, অন্ধ মানুষের সামনে সবকিছু কালো এবং অন্ধকার দেখায়, কিন্তু এখানে অন্ধ মানুষটি সবকিছু দ্যাখে সাদায় আচ্ছন্ন, তার চোখ যেন একটা দুধের সাগরে ডুব দিয়েছে ।

এই রোগের নামকরণ করা হয়েছে শ্বেত অন্ধত্ব । চক্ষু চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর কোনো উল্লেখ নেই। রোগটি ছোঁয়াচে কিনা তাও বলা যাচ্ছে না। কিন্তু সরকার কঠোর সাবধানতা অবলম্বন করে । যারা এই শ্বেত অন্ধত্বে আক্রান্ত হয়েছে এবং যারা সেই সব লোকের কোনো প্রকার সান্নিধ্যে এসেছে, যাদেরকে সংক্রমিত হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয় ওই দুই শ্রেণীর লোকের সবাইকে বিচ্ছিন্ন করে একটি পরিত্যক্ত মানসিক হাসপাতালে অন্তরীণ করে রাখা হয় । কিন্তু সেখানে নানা অপ্রত্যাশিত ও ভয়ঙ্কর সব কাণ্ড ঘটতে থাকে। অপরাধী শক্তি ওই অসহায় অন্ধ মানুষগুলিকে বন্দি করে রাখে, তাদের খাবার চুরি করে খেয়ে ফেলে, মেয়েদের সম্ভ্রমহানি করে। এই দুঃস্বপ্নতাড়িত বিভীষিকার চক্ষুষ সাক্ষী মাত্র একজন, সে সাতজন অন্ধ মানুষকে পথ দেখায়। এদের মধ্যে আছে একটি মাতৃহীন ছোট ছেলে, একটি কালো চশমা পরা মেয়ে, একটি গাড়ি-চোর, এক ডাক্তার। দুঃস্বপ্নের ওই চাক্ষুষ সাক্ষী সাতজন অপরিচিত মানুষকে নির্জন রাস্তা দিয়ে নিয়ে চলে। শোভাযাত্রাটি একটি উদ্ভট, অপার্থিব, রহস্যময় রূপ ধারণ করে, আর তার চারপাশের পরিবেশও হয়ে ওঠে মর্মবিদারী ।

‘অন্ধত্ব একটি রূপকাহিনী। নিঃস্ব হয়ে যাওয়া, কোনোকিছু বুঝতে পারার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা, পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বর্তমানকালের এই ভয়াবহতাকে সারামাগো অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে তাঁর ‘অন্ধত্ব’ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন । এই উপন্যাসে মানুষের নিকৃষ্টতম ক্ষুধা ও প্রবণতাসমূহ যেমন দক্ষতার সঙ্গে রূপায়িত হয়েছে, তেমনি এই সত্যটিও শৈল্পিক কুশলতার সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে যে শেষ পর্যন্ত মানুষের মধ্যেই আছে সেই অবিনাশী শক্তি, যা সবকিছুকে মুক্তি, আনন্দ ও উল্লাসের সমুদ্রে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে ।

সারামাগোর কাহিনী আমাদের অপ্রতিরোধ্যভাবে টেনে নিয়ে যায় । তাঁর ভাষার সূক্ষ্ম কারুকাজ এবং বর্ণনার স্থাপত্যসৌন্দর্য পাঠককে অভিভূত করে । আর তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে যে করুণা আর মানবিকতা বোধ পাঠক নির্ভুলভাবে লক্ষ করেন তাও তাঁর এই উপন্যাসকে একটা স্বতন্ত্র মাত্রায় ভূষিত করে। জনৈক সমালোচকের বিবেচনায় ‘অন্ধত্ব’-এর আকর্ষণের মূলে রয়েছে উপন্যাসটির বিশেষ কণ্ঠস্বর । এখানে লেখক-পাঠকের মধ্যে একটি রসসমৃদ্ধ আদান-প্রদান চলতে থাকে। যার সঙ্গে জড়িয়ে যায় বর্তমানকালের যাবতীয় আতিশয্যের বিরুদ্ধে একটা প্রচণ্ড ক্রোধ । এই সমালোচক বলেছেন

যে, অন্ধত্ব তাকে কাফকার কথা মনে করিয়ে দেয়, যে-কাফকা বন্ধুদেরকে তার গল্প পড়ে শোনাবার সময় হাসিতে ফেটে পড়তেন ।

বর্তমান সময়ের একটি সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘স্নো ফলিং অন সিডারস' গ্রন্থের লেখক ডেভিড গুটারসন ‘অন্ধত্ব’ সম্পর্কে বলেছেন, “গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লাভ ইন দি টাইম অব কলেরা’র পর আমি যেসব উপন্যাস পড়েছি তার মধ্যে সারামাগোর ‘অন্ধত্ব সর্বোত্তম । এই উপন্যাসে আছে অসামান্য কুশলতা ও শক্তি। ... সকল শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের মতো এই গ্রন্থও একই সঙ্গে সমকালীন ও কালাতীত... । সারামাগোর ‘অন্ধত্ব’, শ্লেষাত্মকভাবে, তাঁর অসামান্য দৃষ্টিশক্তিরই ফসল।”

উপন্যাসটির ভাষাশৈলীও আমাদের সপ্রশংস মনোযোগ দাবি করে । মনোযোগ শব্দটি আমি ভেবেচিন্তে ব্যবহার করছি । সাধারণত যে কোনো রচনায়, বর্ণনার পর সংলাপ তুলে ধরতে হলে প্রথমে কমা, তারপর সংলাপ শুরু হবার আগে উপরের দুটি উর্ধ্বকমা, এবং সংলাপের শেষে আবার দুটি উর্ধ্বকমা উল্টো করে ব্যবহার করা হয়। আর প্রশ্ন থাকলে প্রশ্নবোধক চিহ্ন,অবাক করা ঘটনা ঘটলে বা অবাক করা উক্তি উচ্চারিত হলে বিস্ময়সূচক চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সারামাগো তাঁর লেখার এই সবকিছুই সম্পূর্ণ বর্জন করেছেন। পাঠক অবশ্য সচেতন থাকলে, একটু মনোযোগ দিলেই বুঝতে পারবেন কোনটা সংলাপ এবং কার সংলাপ, কোনটা প্রশ্ন এবং কার প্রশ্ন এবং কোনটা উত্তর এবং কার উত্তর । 

‘অন্ধত্ব' সম্পর্কে ‘কার্কাস রিভিউস' নামক পত্রিকায় প্রকাশিত একটা মন্তব্য উদ্ধৃত করে আমি আমার এই লেখার ইতি টানবো । মন্তব্য হলো : 'দি ট্রায়াল' এবং ‘দি প্লেগ” তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে এবং নিজস্ব সময়ে যে রকম বৈপ্লবিক ছিল ‘অন্ধত্ব'ও তার নিজস্ব ভঙ্গিতে এবং নিজস্ব সময়ে সেই রকম একটি বৈপ্লবিক সৃষ্টি ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ