এন পেট্রি'র গল্প : একাকী ঢাকের কাঠি

অনুবাদক : তানবীরা তালুকদার 

এন পেট্রি আমেরিকার কানেকটিকাটে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।তিনি একাধারে লেখক ও সাংবাদিক। ছোটো গল্প, উপন্যাস, শিশু সাহিত্য রচনা করেছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস  an African-American woman দশ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল। এর আগে আর কোনো কৃষ্ণ-আমেরিকান লেখকের বই এতো সংখ্যায় বিক্রি হয়নি।
বেয়াল্লিশ নম্বর ব্রডওয়ের রেন্ডল্রেট থিয়েটারে অর্কেষ্ট্রা পুরো এক সপ্তাহ বাজিয়েছে। মারকুই এর আলো থেকে তার নামটি নির্বাচন করা হয়েছিলো। অর্কেষ্ট্রা আর ওর নাম দুটোই তালিকার বেশ নীচের দিকে ছিলো। 

এক সময়ে এসবে সে খুব আমোদ অনুভব করতো। এখন ভালবেসেই সে তার মন আর চোখকে এসবে ঘোরাফেরা করা থেকে বারণে রাখে। কিড জোন্স, সেই নাম, তার নাম, একসময় পিতলের আলোর মত জ্বলজ্বল করে নাচতো। আর রাতে তার নাম মারকুইয়ের মধ্যে যেনো হীরের দ্যুতি ছড়াতো। ভীড়ের রাস্তায় মানুষজন ধাক্কাধাক্কি করে দেখতো, চিনতো তারপর হাসতো। 

তার অসাধারণ অনুভূতি হতো। কিন্তু আজ ভাল লাগছে না। আজকে সকালের ঘটনার পর আর কিছুই ভাল লাগছে না। সে তার নাম চিহ্নটার দিকে শুধু একবার তাকালো। ওখানেই ছিলো। তারপর সে খেয়াল করলো, সূর্য উঠে গেছে, তারপর উড়িয়ে দিলো সব, থিয়েটারের ভেতরে গিয়ে একটি ক্রীম কালারের স্যুট পরে নিজের বাজনা তৈরীতে মন দিলো। 

পোষাক পরিবর্তন শেষ করে, ড্রেসিং রুমের লম্বা আয়নাতে নিজেকে এক পলকের জন্যে দেখলো সে। তার কোন পরিবর্তন নেই। সে একই চেহারা। না মোটা না পাতলা। চুল পাকে নি। কিছুই না। সে ভ্রু কোঁচকালো। কারণ সে ভেবেছিলো, যে সমস্ত কারণ তাকে ভেতরে ভেতরে পোড়াচ্ছে, তার কিছু ছায়া বাইরে নিশ্চয় দেখা যাবে। কিন্তু না। 

মঞ্চে ওঠার যখন সময় এলো, সে চুপচাপ উঠে ড্রামসের পেছনে গিয়ে বসলো, কারো সঙ্গে কোন কথা নয়, শুধু চুপচাপ বসা। অর্কেস্ট্রা মৃদু সুরে বাজতে শুরু করলো। মনে মনে সে ভেবে রেখেছিলো, ছেলেগুলো এভাবে এক সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করছিলো, মনে হচ্ছিলো, একে অপরকে যেনো তেল মাখিয়ে দিচ্ছে। 

ধূসর লম্বা পর্দা খুলে গেলো। এক মুহূর্তের জন্যে পর্দা বন্ধ ছিলো। এরপর পর্দা তুলে দেয়া হলো। নিঃশব্দে। অনেকটা যাদুর মত। উজ্জল আলো দিয়ে মঞ্চ ভেসে উঠলো। সাদা চড়া আলোয় পরে থাকা ধূলিকণাগুলোও দেখা যাচ্ছিলো। ব্যান্ডের নীচের বড় জায়গাটাতে আলো পড়ে একটা ছায়া তৈরী হয়েছে। চেহারাগুলো আস্তে আস্তে নির্গত হয়ে, বিদেহী মাথা এবং কাঁধগুলো ক্রমশ ঢালু হয়ে ছাদে মিলিয়ে গেলো। 

সে আস্তে করে ড্রামটা বাজালো। নিয়মিত সে বাজনা। খুব নরম, শোনা যায়, এই ছন্দে। নেপথ্যে। জোর দিয়ে বারবার একই ছন্দে পিয়ানো, বেহালা আর ট্রাম্পেট এর জন্যে বাজিয়ে চললো। ট্রাম্পেট বাদক দাঁড়িয়ে পড়লো, এবং তার প্রথম সুরটি বেরিয়ে এলো, মিষ্টি, পরিস্কার আর জোরালো। 

কিড জোন্স তার ড্রামস দিয়ে সঙ্গত দিয়ে যাচ্ছিলো। ধীরে, সতর্কভাবে, নরম। সে অনুভব করছি্লো তার বাম ভুরুটি নিজ থেকেই ওপরে উঠেএসেছে-- ট্রাম্পেটের বাজনার সঙ্গে নেচে যাচ্ছে। যখন ট্রাম্পেটের আওয়াজ শুনলেন তখনই এটি হলো। বাজনা জোর থেকে জোরে-- আরও জোরে বাজতে লাগলো। এত জোরে যে তার পেট নিজেকে চুষতে লাগলো। তারপর কিছুটা ধীরে কিন্তু আরো জোরালো হলো। শব্দটি গুঞ্জরিত হতে লাগলো। সুরের ছন্দটি তার কানে বাজতে থাকলো, যতক্ষণ না, যতক্ষণটা সে পরিপূর্ণ অনুভব করল, এবং ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। 

সে দুহাতে তার কান দুটো ঢেকে রাখতে চাইলো কারণ তার কানে কেউ একই সেই শব্দ বার বার গুঁজে দিতে থাকলো। ছাঁদের নীচে কোথাও শব্দটি যেনো গেঁথে ছিলো, সেখানেই আটকে থেকে ট্রাম্পেটের মধ্যে বেজে যাচ্ছিলো, “আমি যাচ্ছি, আমি যাচ্ছি, আমি যাচ্ছি।“ 

শব্দটি তাকে বৃষ্টির মাঝে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো, ভোরের সঙ্গে যে বৃষ্টি এসেছিলো। সে দিনের শুরুটা দেখতে পেয়েছিল—দিনটা ছিল যন্ত্রণাদায়ক আর ঠান্ডা। সে বাড়িতেই ছিলো। সে উষ্ণ ছিলো কারণ ও তার কাছে ছিলো, তার বাহু ধরে রেখেছিলো সে। বৃষ্টি আর বাতাস জানালার বাইরে খুব করুণ গলায় কাঁদছিলো। 

আর এখন – হুম, তার মনে হচ্ছিলো সে যেনো ট্রাম্পেটের নীল সুরে ভেসে যাচ্ছে ওপর থেকে ওপরে। সে তার চোখ আধ বোজা করে এর সঙ্গে ভেসে যাচ্ছিলো। এটি সংগীত হওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। এটি সেই গুঞ্জরিত সুর যা তাকে কাঁপাতে লাগলো। এটাকে ঘৃণা করলেও, কিছু করার কোন উপায় ছিলো না। “আমি যাচ্ছি, পিয়ানো বাজায় যে তার সঙ্গে যাচ্ছি, আমি তার প্রেমে মত্ত, আর আমি আজই তার সঙ্গে যাচ্ছি।“ রাস্তায় বৃষ্টি ঝরছে। গরম উধাও। খাবার নেই। সবকিছু চলে গেছে কারণ প্রেয়সী চলে গেছে। সে ভাবছিলো, এই কি সব, যা সে চেয়েছিলো? এইই সব যা সে পায় নি। সব যা তোমার ছিলো, সব যা তুমি হারালে। সবকিছু এখন ট্রাম্পেট, যন্ত্রণা ও ঘৃণা, কষ্ট আর শান্তি, নিঃশব্দ আর ভালবাসা। 

শেষ সুরটা ছাদে আটকে গেছে, আটকে আছে তো আছেই। ট্রাম্পেট বাদক বাজনা থামিয়ে দিয়েছে, কিন্তু কিড জোন্স এখনও শেষ সুরটা শুনতে পাচ্ছিলো। তার কানে, তার মনে। 

স্পটলাইট তার স্থান পরিবর্তণ করে কিড জোন্সের মাথার ওপর স্থির হলো, ড্রামের পেছনের সেই মানুষটি। সাদা আলোর লম্বা রশ্মিটা তার মাথার ওপরের ভাগ এমন করে ছুঁয়ে গেলো যে আলো আধারি তৈরি হলো সেখানে। ক্রিম রঙের স্যুট আর শার্টের কারণে, মনে হচ্ছিলো সে আলোর বেষ্টনীর মধ্যে আবদ্ধ। কিন্তু মুখের ওপর ছায়া ছিলো, তাতে মাখামাখি হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। তার চুলগুলো পেছনের দিকে এত কম যে, মুখটা এমন দেখা যাচ্ছিলো যার কোন শেষ নেই। একজন উঁচু, লম্বা মানুষ যার গাঢ়ো এবং ভীষন গাঢ়ো রঙ। 

সে ড্রামগুলোকে তার হাতের ব্রাশ দিয়ে চুমু খেলো। তারা মৃদ্যু শব্দ করে তাতে সাড়া দিলো। শুনতে ইচ্ছে করবে এমন বাজনা বেজে উঠলো। অনেকক্ষণ এর গুঞ্জন রয়ে গেলো। গোপনে মৃদ্যু লয়ে বাজতে থাকলো। তারপর সে বড় বেস ড্রামকে গর্জন করালো এবং সেই তালেই বাজাতে থাকলো। বড় দলের পিয়ানিস্ট, পিয়ানো খুলে নিলো। ড্রামস আর পিয়ানো একই সুরে বাজতে লাগলো। পিয়ানো জোরে। ড্রামের চেয়ে একটু বেশি জেদের সুরে। পিয়ানোর পাশে রাখা টেবলে বড় বাদক বসলো। বা পা দিয়ে চাপড় মেরে ছন্দ মেলাতে লাগলো। তার শরীরের বাঁক ভেদ করে, তার ক্রিম রঙের শার্টের ভাঁজ নষ্ট হয়ে গেলো, পিয়ানোর তীব্র আলোর ছটা দিয়ে দেখা যাচ্ছিলো। ড্রামার আর পিয়ানিস্ট দুজনেই দুটো আলাদা আলোর রেখা পরিভ্রমণ করছিলেন। আস্তে আস্তে ড্রামার পিয়ানিষ্টকে পেছনে ফেলে দিচ্ছিলেন। 

সুর পরিবর্তন হলো। খুব দ্রুত। কিড জোন্স ড্রাম বাজাতে বাজাতে লোকে পরিপূর্ণ হলটার দিকে তাকালেন। তার মনে হতে লাগলো ড্রামগুলো সে নিজে কিংবা ড্রামগুলোর মনে হতে লাগলো তারা কিড জোন্স। 

ড্রামের শব্দে পুরো থিয়েটার স্পন্দিত হতে লাগলো। সামনে বসা একজন কাঁপতে লাগলো আর ছন্দে ছন্দে মাথা ঝাঁকাতে লাগলো। একজন নাবিক তার পাশে বসা মেয়েটির গায়ে হাত রাখলো। হাত দিয়ে মেয়েটির মুখটি তুলে ধরে, তার মুখটি খুব কাছে নিয়ে এলো। কাছে, আরও কাছে আরও আরও কাছে, যতক্ষণ না তাদের মুখ দুটি একসঙ্গে মিলে গেলো। তার হাত দুটো শক্ত করে মেয়েটার কাঁধ আঁকড়ে ধরলো তারপরও দুজন নড়লো না। 

পাশের দরজা দিয়ে একটি বাচ্চা ঢুকে পরে করিডোরে রাখা সীটের ওপর বসে পরলো। বড় হা করে তার মুখটি খোলা ছিলো, সে দু হাত দিয়ে শক্ত করে তার টুপিটা ধরে রেখেছিলো, শক্ত করে আর জোরে বুকের কাছে ধরে রেখে সে বাজনা শুনছিলো। 

ড্রাম বাদক ভুলে গেছে যে সে একটি অনুষ্ঠানে বাজাচ্ছে। শুধু সে ছিলো আর তার ড্রামস, বাকি সবকিছু যেনো বহু দূরে। অনেক আগে। সে লুলু, হেলেন, সুজি, মামি সবাইকে তার বুকের কাছে ধরে রেখেছিলো। এবং সবাই – ঐ সবগুলো মেয়ে যেনো মিলেমিশে তার স্ত্রীর মধ্যে একাকার হয়ে গেছিলো। যে তাকে বলেছে, “আমি চলে যাচ্ছি”। আজ সকালে, এই কথাটি তাকে সে বারবার বলছিলো। জানালা গড়িয়ে তখন বৃষ্টি নীচে পড়ছিলো। 

যখন সে আবার ড্রামে আঘাত করলো তার মনে হতে লাগলো সে পিয়ানো বাদকের সঙ্গে যেনো যুদ্ধ করছে। সে মারকুইস ব্যান্ডের গলা টিপে ধরছে। সে পরিস্কার তার পাজরে ছুরি চালাচ্ছে। সে ধারালো কোন ব্লেড দিয়ে তার গলা লম্বালম্বি চিরে ফেলছে। আমার স্ত্রী নাও। তোমার জীবন নেবো। 

তার উন্মত্ততার সঙ্গে ড্রাম ও লাফিয়ে উঠে। ব্যান্ডের অন্য বাদকরা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখতে লাগলো। তাদের মুখে অবাক আর ভয়ার্ত চিহ্ন ফুটে উঠলো। 

সে তাদের উপেক্ষা করলো। ড্রাম তাকে তাদের থেকে দূরে নিয়ে গেলো, সময়ের আবর্তে তাকে পেছন থেকে পেছনে আরও পেছনে নিয়ে যেতে থাকলো। সে কল্পনার মায়াজাল তৈরী করলো। সে সবাইকে খবর পাঠাচ্ছিলো। দাদীমা মারা গেছে। শিবিরে থাকা বিদেশির একটি পুরনো রোগ আছে আর সে কখনো সেরে উঠবে না। বড় সমুদ্র পার করে আসা লোকটি তার মনিবের মেয়ের সঙ্গে শুচ্ছে। মরে যাই, মরে যাই আহা মরে যাই। জোরে হাসা আর দুর্গন্ধ আসা মানুষটির সঙ্গে তার যুদ্ধ ভালই চলছে। ময়ূরের মত হাঁটা, গোল মাথাওয়ালা মনিবের সঙ্গে খুব ভাল যাচ্ছে না। 

বনের গভীরে বেশ ভাল ঠান্ডা। ঠান্ডা এবং শান্ত। গাছেরা মৃদ্যু স্বরে কথা বলে। তারা আজ রাতের নৃত্য নিয়ে গল করে। লেক পার হয়ে আসা তরুণীটি আসবে সেখানে। তার কোমর খুব সরু আর উরু গুলো গোল। তারপর যে শব্দগুলো সে ভুলতে চাইছিলো সে শব্দগুলোই কিম জোন্সের কাছে আবার ফিরে এলো। “আমি চলে যাচ্ছি, আমি চলে যাচ্ছি, আমি চলে যাচ্ছি”। 

সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ড্রাম বাজানো বন্ধ করে সে মারকুইস ব্যান্ডের দিকে তাকিয়ে রইলো, প্রসারিত তার দৃষ্টি, হিংসুক, ঘৃণায় পরিপূর্ণ। 

থিয়েটারে একটি অস্বস্ত্বিকর এবং অস্থির পরিবেশ তৈরি হলো। তার মনে পড়লো সে এখন কোথায়। সে আবার বাজাতে শুরু করলো। ট্রাম্পেট একটি অংশ বাজালো, ছোট আর নরম। ড্রামগুলো তার জবাব দিলো। ট্রাম্পেট আবারও একই সুর বাজালো। ড্রামগুলোও আবার একই কথা বাজিয়ে গেলো। পরের বার এটা ছিলো আরও জটিল। সুরটি ঘুরতে লাগলো, সামনে-পেছনে, ওপরে-নীচে। তারপর ড্রামসগুলো সেই একই কথা উচ্চারণ করলো, একই সুরে। 

সে জানতো একটি আতঙ্কজনক মুহুর্ত আসবে। যখন তাকে একা বাজাতে হবে এবং সে নিশ্চিত ছিলো না পারবে কিনা। খুব হালকা করে ড্রামসগুলো ছুঁয়ে দিলো। তারা সতঃস্ফুরিতভাবে তাকে জবাব দিলো। 

আর শব্দটা এমন ছিলো যেনো ড্রামগুলো তার জীবনের কথাই বলছে। শিকাগোতে থাকা মেয়েটি যে তাকে ঘৃণা করতো। গোলাকার নরম দেহের মেয়েটি যে তার স্ত্রী ছিলো আর আজ সকালে বৃষ্টির মধ্যে, যে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সেই বৃদ্ধ মহিলাটি যে তার মা, সেই একই মহিলা যে শিকাগো থাকতো, যে তাকে ঘৃণা করতো সে তার বাবার মত দেখতে বলে, তার বাবা যে তাকে প্রলুব্বধ করে তারপর ফেলে চলে গেছে, অনেক অনেক বছর আগে। 

সে থিয়েটার ভুলে গেলো। সে সবকিছু ভুলে গেলো শুধু ড্রামস বাদে। সে যেনো ড্রামসে ঝালাই করা ছিলো, তাদের ভেতরেই ডুবে গেলো। তার পুরো সত্ত্বা। তার নাড়ির স্পন্দন। তায় হৃদয় স্পন্দন। সে যেনো ড্রামেরই অংশ হয়ে গেলো। কিংবা ড্রামগ্যলো তার অংশ হয়ে গেলো। মূল বড় ড্রামটাতে সে গুড়গুড় শব্দ তৈরি করতে আর থামাতে লাগলো। মূল ড্রামটার সঙ্গে খানিকটা পাগলামি করছিল সে। বারবার সে বজ্রের গর্জন তুলে থিয়েটারকে ভরিয়ে তুলছিলো। মনে হচ্ছিলো শব্দগুলো ড্রাম থেকে আসছে না, বরং তার হৃদয়ের ভেতর থেকে উঠে আসছে, তার ভেতরটা দুমরে মুচড়ে বের হচ্ছিলো, উগ্র, প্রবল, গর্জনের শব্দ। যেন তার ভাবনা থেকে আসছে, এটা আমার প্রেমের গল্প, এটা আমার ঘৃণার গল্প, এইই সব যা আমার আছে। আর শব্দটি ধ্বনিত হয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে দূরে ছাদের নীচে এই থিয়েটার হলে গুঞ্জরিত হতে থাকলো। 

অবশেষে, যখন সে বাজনা থামালো, কাঁপছিলো সে, তার সারা গা ভিজে গিয়েছিলো ঘেমে। সে অবাক হয়ে দেখছিলো তখনও তার সামনে ড্রামগুলো পরেছিল। সে ওদের অংশ হয়ে যায় নি। সে এখনও তার নিজেরই আছে। কিড জোন্স। ড্রামের বাদশা। এই পৃথিবীর সেরা ড্রাম বাদক। প্রতিবার নিজের একটি ক্ষুদ্র অংশকে যে বিক্রি করে। প্রতি দুপুরে। প্রতিটি সন্ধ্যায় দু’বার। শুধু এবার সে তার অন্যবারের বাজনাগুলোকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে। এবার, সকালে যা হলো, তারপর এভাবে বাজিয়ে, সে সম্পূর্ণ নিজেকে বিক্রি করলো, সামান্য অংশ নয়। 

একজন তার পায়ে লাথি মেরে বললো, উঠে দাঁড়িয়ে প্রণাম করো উল্লুক, কি হয়েছে তোমার আজ? 

সে কোমর নাড়িয়ে প্রণাম করলো, আর স্পটলাইট এসে তার মুখের পাশে পড়লো, পড়লো তার পায়ের নীচে প্যান্টে। তারপর আলো এসে মারকুইস ব্যান্ডের ওপর পড়লো, পিয়ানো বাদকে মুখে। মারকুইসের চামড়া কালো সমুদ্র-শৈবালের মত ঝকঝক করতে লাগলো। তারপর আলো আবার কিড জোন্সের কাছে ফিরে গেলো। 

তার গরম লাগছিলো আর সে ভাবছিলো, তার গায়ে ঘামের গন্ধ। শেভ করে মুখে যে পাউডার মেখেছিল সেটাকে এখন ঘেমে ভিজে সিমেন্টের মত অনুভূত হচ্ছিলো। খুব পাতলা স্তর কিন্তু অবশ্যই সিমেন্টের স্তর। কোন আলো বাতাস তার চামড়ায় লাগতে পারছে না। সে তার রুমাল বের করতে করতে ভাবছে পাউডার আর ঘাম দিয়ে সে মেঝে মোছার মত মুখ মুছছে। 

তারপর সে আবার নত হলো। এবং আবার – যেমন, যেমন তুমি কোন জিনিসের দড়ি ছিঁড়ে দিলে এটি ঝাঁকাতে থাকে, নাচের গতিতে যায়। টেনে নিয়ে এলে আবার লাথি মারে। হ্যাঁ সে ভেবেছিলো, তুমি উত্তেজিতই থাকবে। দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা তোমাকে খেয়ে নেবে আর তোমার যাওয়ার কোন জায়গা থাকবে না। যেহেতু, এই সকাল থেকে তোমার যাওয়ার কোন জায়গা ছিলো না। “আমি চলে যাচ্ছি পিয়ানো বাজায় যে সেই ছেলেটার সঙ্গে আমি মারকুইস ব্যান্ডের প্রেমে পড়েছি আর ছেলেটা এত মিষ্টি বাজায় আমি চলে যাচ্ছি চলে যাচ্ছি চলে যাচ্ছি –“ 

সে মারকুইস ব্যান্ডের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো। 
তারপর দাঁড়িয়ে নত হলো, আবার এবং বারবার।






অনুবাদক পরিচিতি
তানবীরা তালুকদার
গল্পকার। অনুবাদক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ