
অনুবাদক : শাহাব আহমেদ
গর্ডন ফেয়ারফ্যাক্সের লাইব্রেরীতে তিনজন মানুষ বসেছিল। বাতাস ছিল সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘনীভূত। সিগারেটের ধোঁয়া বেড়ে বেড়ে ভেসে ভেসে যেমন হালকা হয়ে যায় তেমনি কথা বলার টপিক বদলেছে বারবার। অল্পবয়সি ও উচ্চাভিলাষী সাংবাদিক হেন্ডন গে কিছু দিন আগে ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি ফাঁসির কথা উল্লেখ করে বিচারবিহীন শাস্তির প্রসঙ্গ টেনে আনে।
“এভাবে বলা ঠিক নয়”- ফেয়ারফ্যাক্স মতামত দেয়, “কিন্তু বাস্তবে যদি এমন কোন ঘটনা সামনে আসে আমি অবশ্যই তা এড়িয়ে যাবো না।”
“আমি মোটেও দেখব না”, অন্যজন বলে। সে চেয়ারের পেটের ভিতরে বসে সিগারেট ফুঁকছিল অন্যমনস্ক নীরবতায়। কালো চুল দেখে মনে হয় তার বয়স ৪৫ থেকে ৫০। যদিও তার মুখ খুব সিরিয়াস ও বলিরেখায় পূর্ণ এবং কিন্তু খুবই যুবাসুলভ উজ্জ্বল, মনেই হয় না ত্রিশের চেয়ে বেশি।
“কেন ডঃ মেলভিল? আমার তো ধারণা আপনারা চিকিৎসকরা কোন কিছুর সামনেই সন্ত্রস্ত বোধ করেন না।”
“এমন একটি ঘটনা দেখেছি”, ডাক্তার বিষণ্ণভাবে বলেন। “প্রকৃতপক্ষে, আমি সেখানে খুব সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণও করেছিলাম।”
“আচ্ছা, আচ্ছা, আমাদের কি সে সম্পর্কে বলবেন?”- সে খাতা-কলম নিয়ে নোট নেবার জন্য প্রস্তুত হয়, তবে চেষ্টা করে বক্তার দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখতে।
চেয়ার টেনে তারা ডাক্তারের কাছে এগিয়ে আসে। কিন্তু একটি মুহূর্তের জন্য সে যেন তাদের দেখতে পায় না, বরং শূন্য দৃষ্টিতে ফায়ারপ্লেসের আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে। পরে সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে শুরু করে:
সব কিছু আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসছে। এটা ছিল ৭ বছর আগের কোন এক গ্রীষ্মকাল। আমি তখন ব্র্যাডফোর্ড নামে একটি ছোট শহরে ডাক্তারি করতাম। ছোট্ট ও পশ্চাদপদ, সদ্য পাশ-করা একজন ডাক্তারের পেশা শুরু করার জন্য উপযুক্ত একটি শহর। নিয়মিত অফিস করার বদলে, আমি শহরের ধনবান হিরাম ডেলির কাছ থেকে দুটি রুম ভাড়া করেছিলাম। আমি নিজে সেখানে থাকতাম এবং আমার সাদা-কালো রোগীরাও সেখানেই আসতো। সাদারা আসতো সবদিক থেকে, আর কালোরা শহরের পশ্চিমাংশের “নিগার টাউন” থেকে।
আমার আশেপাশের লোকজন ছিল রুক্ষ ও অপরিশীলিত,কিন্তু তারা ছিল অতি সাধারণ ও সদয়। যতই সময় যাচ্ছিল আমি অন্য কোথাও গিয়ে সাফল্য অর্জন করার চিন্তা বাদ দিয়ে সেই ছোট শহরে একজন সাধারণ ডাক্তার হিসাবে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যদিও একজন যুবা বয়সী পুরুষের এমন সিদ্ধান্ত নেয়া খুবই অস্বাভাবিক কিন্তু আমি অস্বীকার করবো না যে, আমার বাড়িওয়ালার সুন্দরি যুবতি মেয়ে অ্যানি এই সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ হয়ে থাকতে পারে। ১৭ বা ১৮ বছর বয়সী অপূর্ব রূপসী এই মেয়েটি ছিল আশেপাশের যে কারো তুলনায় অনেক বেশি ভালো। তার মধ্যে একটি সহজাত মাধুর্য ছিল এবং তার আনন্দদায়ক সান্নিধ্যে যে-ই এসেছে সে-ই তার বিশ্বস্ত ভৃত্যে পরিণত হয়েছে।
সাদা বা কালো, যে-ই তাকে চিনতো, তাকে ভালো না বেসে পারতো না। এবং বাড়ির সবকাজের কাজী, ভৃত্য কালো জুব বেনসন, তাকে ভালোবাসতো ও শ্রদ্ধা করতো সবার চেয়ে বেশি।
সে এমনিই একটি ছেলে ছিল যাকে সবাই বিশ্বাস করতো। খুবই সুস্থির স্বভাবের এবং মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকতো। সে ছিল সম্পূর্ণভাবে মিস অ্যানির হাতের মুঠোয়, যেখানে বা যে কাজেই পাঠানো হোক না কেন, সে বিশ্বস্ত কুকুরের মত ছুটে যেতো।
যখনই সে বুঝতে পারে যে, আমি অ্যানের প্রতি অনুরক্ত, ( যা আদতে কারুরই অজ্ঞাত ছিল না ), সে আমার অনুগত হয়ে ওঠে এবং আমার পরিচারকের দায়িত্বভার গ্রহণ করে। আমি অ্যানের প্রতি খুব বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং জুব স্বতন্ত্র:প্রনোদিত হয়ে তার কিছু কাজ নিজের কাঁধে নেয়ায় অ্যান আমার সাথে একঘন্টা সময় বেশি কাটাতে পারতো।
বুঝতেই পারছেন আমি ছেলেটাকে পছন্দ করতাম এবং এ-ও বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অ্যানের সাথে আমার সম্পর্ক এবং আমার ডাক্তারি প্র্যাকটিস উভয় ক্ষেত্রেই অভাবিত উন্নতি হয়। আমি আমার সব উচ্চাশা পরিত্যাগ করে সেখানেই সন্তুষ্ট ছিলাম।
সময়টা ভালো ছিলো না। শহরে টাইফয়েডের মহামারী ছড়িয়ে পড়ে এবং আমি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ি। প্রিয় অ্যানের সাথে দেখা সাক্ষাত করার সময় বের করা দুরূহ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে আমার বয়সও যথেষ্ট ছিল না তাকে প্রেমিকা হিসাবে দাবী করার। আমার মাঝে মাঝে নিজের উপরে খুব রাগ হতো
কিন্তু দায়িত্ব পালন না করে উপায় ছিল না। দিন রাত কাজ করতাম। এ সময়ে জুব অমূল্য এক সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করে। সে শুধু আমার খবরাখবর এবং চিঠিই তার কাছে পৌঁছে দিত না, মাঝে মাঝে তার কাছ থেকেও দুটো একটি চিরকুট এনে দিত। একদিন সে অ্যানের এমন কিছু গোপন কথা শুনতে পায় যা শুনে আনন্দে আমার গা কেঁপে ওঠে এবং আমি ওকে দিব্যি দিয়ে পূনরাবৃত্তি করতে বলি।
এক কথায়, সে ছিল বিশ্বস্থ প্রহরী কুকুর। তার মত এমন কুশলী একজনও ছিল না যে,
চতুরভাবে অন্য সব যুবকদের অ্যানি’র কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে।
জুব আমাকে মাঝে মাঝে হাসতে হাসতে এমন সব ঘটনার কথা বলতো:
“ডাক্তার, আমি মিঃ হেম্প স্টিভেনকে বলেছি, ক্ষমা করবেন মিঃ স্টিভেন, মিস অ্যানি তো বাসায় নেই। সে তখন বিষণ্ণ বদনে বের হয়ে যায়।”
যখন স্যাম অ্যালকিন্স আসে, আমি বলি, শ্ শ্, মিসেস অ্যানি শুয়ে পড়েছেন। সে বলে, “জুব তুমি নিশ্চয়ই মনে করো না সে সেখানে?” এ কথা বলে ভীত চোখে এদিক সেদিক তাকায়।
(এই ‘সে’ দিয়ে সম্ভবত অ্যানির প্রেমিক ডাক্তারকে বোঝানো হয়েছে-অনুবাদক)
আমি বলি, “আমার তো ভয় হয়, সে এখানেই, মিঃ এলকিন্স।” তখন সে ফর্মালি আমার হ্যান্ডশ্যাক করে বের হয়ে যায়। তার অবস্থা দেখে মনে হয় যেন তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি মারা গেছে।এই পুরোটা সময় মিস অ্যানির পর্দার পেছনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে পেট ফেটে মারা যাবার উপক্রম।
জুব ছিল প্রশংসনীয় রকমের মিথ্যুক। সে জানতো যে আমি অল্পবয়সী এক বাক্যবাগীশ। আমি যখন তাকে তিরস্কার করতাম সে হাসির তোড়ে মেঝেতে গড়াগড়ি যেত এবং সংক্রামকভাবে আমারও ওর সাথে যোগ দেয়া ছাড়া অন্য কোন পথ ছিল না। ওর ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করার কোন লক্ষণই ছিলো না এবং তার কৃত “খারাপ” কাজও চালিয়ে নেয়া প্রয়োজন ছিল। সুতরাং আমার এ নিয়ে নীতিকথা বলার কোন সুযোগ ছিলো না।
এমন করে প্রায় তিন মাস অতিবাহিত হয়। হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যাবার মত আমি শয্যাশায়ী হয়ে পড়ি। আমার রোগীরা ততদিনে প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছে, কিন্তু অত্যধিক পরিশ্রম ফলে আমি চারিদিকে কিলবিল করা জীবাণুদের সহজ শিকারে পরিণত হই। তখন জুব একজন নার্সে পরিণত হয় । সে সবাইকে দূরে সরিয়ে দিয়ে, পাশের শহরের আমার এক ডাক্তার বন্ধুর সাথে আমার চিকিৎসার সমস্ত দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয়। এমনকি অ্যানিকেও কাছে আসতে দেয়নি।
একজন শিশুকে যত্ন করার মমত্ব নিয়ে সে আমার সেবা করে। পরিবর্তীকালে অশ্রুসিক্ত চোখে আমার ডাক্তার-বন্ধু টম এ কথা বলেছিল, যে ছিল এক বিশাল ও নীরস একজন মানুষ এবং সে যা বলতে চেয়েছিল তার অভিব্যক্তিতে তার সবটাই প্রকাশ পায় নাই। সে বলেছিল যে, একটি অসুস্থ ও দুর্বল বিড়াল শাবককে তার মা যেমনভাবে সেবা করে, আমার নিগ্রো ঠিক তেমনি মায়ের মত আমার সেবা করেছে। এবং সেবা করার তার এই অদ্বিতীয় পজিশন কাউকে ছেড়ে দিতে সে রাজী হয়নি, তীব্রভাবে বিরোধিতা করেছে এবং যখন আমার অবস্থা ক্রিটিকাল পর্যায়ে পৌঁছায় সে, কেঁদে কেঁদে পায়চারি করেছে।কিন্তু আশা হারায়নি, এবং বিপদ কেটে যাওয়া পর্যন্ত আমার বিছানার পাশে থেকেছে। ক্লান্ত ও শক্তিহীন অবস্থায় তাকে শেষ পর্যন্ত জোর করে রুম থেকে বের করে দিতে হয়েছিল। আমি এসবের কিছুই জানতাম না এবং এ নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথাও ছিল না। জীবন-মৃত্যুর লড়াই নিয়ে নিজেই ব্যস্ত ছিলাম ভীষণ। তখন আমার দৃষ্টি জুড়ে ছিল এক কৃষ্ণ কিন্তু কমনীয় কল্মাষ যে আসতো আর যেতো এবং তার সাথে স্থান বদল করে আসতো এক সীতাভ স্বর্বধু যে ধীরে ধীরে বড় হতে হতে শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে যেত।
কিন্তু জুবের গল্পের করুণ রস ও ত্যাগের উপাখ্যান আমার কাঠখোট্টা বন্ধুর বর্ণনায় বাদ পড়ে নি।
আমার প্রলম্বিত আরোগ্য লাভের সময়েই কেবল আমি জানতে পাই, কে ছিল আমার এই
হৃতমান ভৃত্য, আমার প্রতি যার উৎসর্জন ছিল আ-জানু দীঘল।
ওর এই অতিরিক্ত হিতৈষায় মাঝে মাঝে আমার নিজেরই লজ্জা লাগতো, আমি ওকে বলতাম আমাকে রেখে অন্য কোন কিছু করতে। সে যেত, কিন্তু সে যে গিয়েছে, আমি তা বুঝে ওঠার আগেই মুখে হাসি নিয়ে ফিরে আসতো।
সে নিজে নিজে কাজ সৃষ্টি করতো এবং তা সম্পন্ন করে অপরিসীম আনন্দ পেত। আমার মধ্যে যে সব ইচ্ছা বা কামনার কখনই উদ্রেক হয় নি, সে তাই আবিস্কার করে নিত এবং আমার প্রেমানুভূতির বিষয়ে আলোচনা তুলতোl আমি যখন হাল ছেড়ে দিয়ে ওকে অভিসম্পাত দিতাম, সে খিল খিল করে হেসে বলতো, “ডাক্তার, আপনি সত্যিই সুস্থ হয়ে উঠছেন, কখনই কোন অসুস্থ লোককে আমি এমনভাবে গালি দিতে শুনি নি।”
কেন যে আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম? হ্যাঁ, ভালোবাসা। কিন্তু আমি কী বলছি?
সব মানুষই ভালোবাসে, কৃতজ্ঞতা স্বীকার সেখানে খুবই নগন্য জিনিস। ভদ্রমহোদয়গণ, আমাকে ক্ষমা করবেন, এটা আসলেই কোন প্রীতিকর গল্প নয়। সত্য খুবই কদর্য জিনিস, তাকে সহ্য করা কষ্ট।
যে বন্ধুত্ব অর্জন করতে জুবকে অনেক বেদনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, ৬ মাস যেতে না যেতেই তা এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। এটা ছিল অন্য এক গ্রীষ্মকাল, কাজ-কর্ম ছিল মন্থর, আমি ঘোড়ায় চড়ে বন্ধু ডা: টমের সাথে দেখা করতে যাই। দিনের বেশ বড় একটা অংশ সেখানেই কাটে। বেলা চারটার পরে ধীরে-সুস্থে ব্রাডফোর্ডে ফিরে আসি। আমার মন প্রফুল্ল ছিল এবং সেখানে আসন্ন কোনো কোন বিপদ বা দুর্ঘটনার বিন্দুমাত্র আঁচ ছিল না। কোনো দু:খ, বর্তমান বা আগত প্রায়, আমাকে আনত করে নি, এমনকি প্রায় শূন্য রাস্তায় হঠাৎ লোকজনের ছুটাছুটি দেখেও।
যখন বাড়ির দৃশ্যমান দূরত্বে পৌঁছাই, দেখি অনেক লোক জড়ো হয়েছে চারিদিকে। আমি অন্য কোন দিকে মনোযোগ না দিয়ে, শ্লথ ঘোড়ার পেটে তীব্র নালের আঘাত করে দ্রুতগতিতে ভীড়ের মধ্যে এসে পৌঁছাই। লোকজনের গম্ভীর, অন্ধকারাচ্ছন্ন ও আতঙ্কিত মুখ দেখে শরীরে আকস্মিক এক শৈত্য প্রবাহ বয়ে যায়। তারা আমাকে ফিসফিস করে কিছু বলে এবং আমি ঘোড়ার জিন থেকে লাফিয়ে নেমে ভীড় ঠেলে ঘরের দিকে ছুটতে থাকি। বুকের গহনে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা অ্যানি ছিল আমার চিন্তায়।
অসহায় অ্যানি! রক্তাক্ত ও কালশিটে দাগে জর্জরিত মুখ, প্রতিরোধে ছিন্ন বসন। তাকে ঘিরে রক্তহীন বিবর্ণ মুখের লোকজন অপরিসীম ধৈর্য সহকারে মৃদু কম্পনশীল ঠোঁট থেকে শুনতে চাচ্ছে ঘাতকের নাম। তারা আমার জন্য পথ ছেড়ে দেয়। আমি তার পাশে জানু পেতে বসি। তার অবস্থা ছিল আমার অর্জিত অভিজ্ঞতার অতীত।
আমার প্রশ্নও সবার প্রশ্নের সাথে মিলে যায়, সবার একটিই প্রশ্ন মনে, “কে?”- আমি প্রশ্ন করি।
তার চোখ অর্ধেক উন্মিলিত হয়, “ওই কালো ……” ।
সে আমার বাহুডোরে পতিত হয় এবং শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করে।
আমরা একে অন্যের দিকে ফিরে তাকাই। অ্যানি‘র মা ভেঙ্গে পড়ে কাঁদছে কিন্তু পিতার মুখ লোহার মত কঠিন।
“যথেষ্ট হয়েছে! জুব পালিয়ে গেছে।”
সে দরজায় গিয়ে অপেক্ষারত জনতাকে জানায়, “সে মারা গেছে।”
আমি প্লাবনের শব্দের মত উত্তেজিত জনতার গর্জন শুনতে পাই।তারপরে অনেকগুলো পায়ের শব্দ। লোকজন বিভক্ত হয়ে অনুসন্ধান দল গড়ে তুলতে শুরু করে। আমি তাদের সাথে যোগ দেবার জন্য অ্যানি‘র মৃতদেহ সোফায় রেখে রাইফেল হাতে বের হয়ে যাই ।
যেহেতু জুব বেনসন পালিয়ে গেছে সুতরাং স্বতঃসিদ্ধভাবেই ধরে নেয়া হয় যে তাকেই খুঁজতে হবে। কমপক্ষে ১ ডজন লোক দেখেছে যে, সে দ্রুতপায়ে বনের দিকে যাচ্ছে এবং তার মধ্যে কেমন একটা অনভিপ্রেত গোপনতার ভাব। কিন্তু যেহেতু সচরাচরের মতই সে দাঁত বের করে হেসেছে কেউ কিছু সন্দেহ করে নাই। এখন সবার কাছে তার শয়তানসুলভ আচরণ জলের মত পরিস্কার। সে তার উপর থেকে সন্দেহ দূর করার জন্য চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে এতক্ষণে অনেক দূরে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। মিসেস ডেলি পর্যন্ত প্রতিবেশির বাসায় বেড়াতে যাবার সময়ে তাকে দেখেছিল বাড়ির পেছন দিয়ে যেতে এবং সে সহাস্যে বলেছে, “কালো পাজিটা বোধ হয় লুকিয়ে কোথাও যাচ্ছে।”
আহা যদি সে তখন জানতো!
“বনের দিকে চলো, বনের দিকে” কেউ চিৎকার করে ওঠে এবং সবাই ছোটে সেই দিকে। সবারই এক উদ্দেশ্য, ওকে গুলি করে মারা নয়, বরং জীবন্ত ধরে এনে অপরাধ মেপে ফাঁসি দেওয়া।
আমার ভেতরে কী অনুভূতিগুলো ছিল আমি বর্ণনা করতে পারবো না। আমি সেই বনের দিকে ধেয়ে গিয়েছিলাম রক্তপিপাসু ব্যাঘ্রকে ধরে আনার জন্য। আমার মধ্যে হৃৎপিণ্ড জ্বলছিল কয়লার মত শিখাহীন। যে শক্তি আমাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল তার অর্ধেক ছিল আমার নিজস্ব, অন্য অর্ধেক ছিল চরম বিদ্বেষপ্রসূত অন্য কোন অপ-প্রভাবের। আমার গলায় এক শুষ্ক খিঁচুনি জমা হয়েছিল। কিন্তু না-জল, না-হুইস্কি কিছুই আমার তৃষ্ণা প্রশমিত করার জন্য যথেষ্ট ছিলো না। আমি এখন তা বিশ্লেষণ করে অনুধাবন করতে পারি, এ ছিল প্যান্থারের রক্তের পিপাসা কিন্তু তখন আমি কোন কিছুই ভাবিনি।। আমি স্বতস্ফুর্তভাবে সেখানে গিয়েছি এবং জ্বলন্ত চোখে তন্ন তন্ন করে সন্ধান করেছি একটি পরিচিত ছায়ার, যা আমি এতকাল খুঁজতে অভ্যস্ত ছিলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন অনুভূতি নিয়ে।
সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য, যেভাবেই তুমি নাও, ও ছিল আমাদের দলের সাথে এবং আকাশে যখন প্রত্যুষের আলোর ধুসরিমা দেখা দেয় আমরা খুঁজতে খুঁজতে একটি বেড়ার কোণায় এসে পৌঁছাই। তখনও আলো সবে আধো আধো এবং আমরা প্রায় অতিক্রম করে গিয়েছি, ঠিক এ সময়ে এক ঝলক ওকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠি। লাইন ধরে আমাদের বন্দুক তাক করে দাঁড়াই এবং সে উঠে এগিয়ে আসে আমাদের দিকে।
“আমি ভেবেছি আপনি আমার দিকে আর ফিরে তাকাবেন না। আমি কোন ক্ষতি করার কথা কখনও চিন্তাও করি নাই।”
“ক্ষতি?”
কিছু লোক শব্দটি উচ্চারণ করে কিরা কাটে, কিছু অশুভভাবে নীরব থাকে। আমরা ক্ষুধার্ত হায়ওয়ানের মত ওকে ঘিরে ধরি এবং তার চোখে ত্রাসের ছায়া নেমে আসতে দেখি। সে আমার দিকে ফিরে তাকায়, “আমি খুবই খুশী যে আপনি এখানে, আপনি নিশ্চয়ই এদেরকে আমার পিঠে চাবুক মারতে দেবেন না?”
“চাবুক মারা! আমি তোর মত কুকুরের ফাঁসী দেখার জন্য প্রস্তুত।” বলে ওর মুখে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করি। সে প্রত্যাঘাতের ভাব করেও শেষ পর্যন্ত আত্ম-নিয়ন্ত্রন করে।
“কেন ডাক্তার?”, সে বিস্মিত হয়ে করুণ কণ্ঠে প্রশ্ন করে। আমি কোনদিন ওর এমন কণ্ঠ শুনি নাই।
“কেন ডাক্তার? আমি তো তোমার কিছু চুরি করি নাই এবং আমি ঘরে ফিরে আসছিলাম। আমি শুধু শহরের সেন্টারে আমার প্রেমিকা লুসির কাছে গিয়েছিলাম।”
“মিথ্যা বলছিস, বানচোত্!” আমার দুই হাত ব্যস্ত ছিল অন্যদের সহযোগিতায় ওকে ঘোড়ার পিঠে বাঁধার কাজে। আমি কেন তা করেছিলাম? আমি জানি না। ভুল শিক্ষা, আমি ধারণা করি, ভুল প্রথম থেকেই। আমি আধো আলোতে ওর বিষণ্ণ কৃষ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে ওকে একজন দানব ব্যতীত আর কিছু ভাবতে পারি নাই। এটাই ট্র্যাডিশন। প্রথমে আমাকে শিখানো হয়েছে অশুভ কালো মানুষ আমাকে এসে ধরবে, এবং যখন আমি তা অতিক্রম করে এসেছি, আমাকে শেখানো হয়েছে শয়তান, শয়তানের রং হচ্ছে কালো। সেই অসুস্থ বিশ্বাস থেকে মুক্ত হতে না হতেই এই তো দেখছি জুব এবং তার বন্ধুদের ভয়ংকর অন্ধ তমিস্রাময় মুখ! উপসংহার ছিল একটিই- “কালো মানুষই হচ্ছে সকল মন্দ, অশুভ ও অমঙ্গলের মূলে”। ছোট কাল থেকে তাই সংগৃহীত হয়েছে মগজের ভেতরে। কিন্তু যা ঘটেছে তার সাথে এর সম্পর্ক ছিল না।
“ওকে ধরা গেছে” এই কথা জানানি দিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে আমরা জুবকে নিয়ে শহরে ফিরে যাই। চারিদিক থেকে দলে দলে মানুষ এসে জড়ো হয়েছে। তাদের মধ্য দিয়ে বিলি কেটে আমরা ঘরে যাই। সবকিছু ছিল অস্বাভাবিক রকমের শান্ত ও শৃংখলাপূর্ণ। সন্দেহ নেই এবং খবরের কাগজগুলোও তাই বলে যে, শহরের সবচেয়ে সেরা নাগরিকরা জড়ো হয়েছিল সেখানে। শহরের সবচেয়ে কঠোর, দৃঢ়চিত্ত ও প্রতিহিংসায় বদ্ধপরিকর নাগরিকদের মিটিং সেটা।
ঘরে যেখানে মৃতদেহটি শায়িত ছিল, আমরা জুবকে নিয়ে সেখানে যাই। জুব এই দৃশ্য দেখে পশুর মত প্রচণ্ড চিৎকারে ভেঙে পড়ে এবং তার অবয়বে দেখা দেয় ঝড়ে-বিধ্বস্ত জলের রং। তাকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য এই ছিল যথেষ্ট। আমরা শোনার চেয়ে কল্পনা করে নেই তার ক্রন্দন, “মিস অ্যান, মিস অ্যান, হা ঈশ্বর! ডাক্তার আপনি নিশ্চয়ই মনে করেন না যে, আমি এই কাজ করেছি?”
ক্ষুধার্ত হাতেরা তৈরি হয়েই ছিল। আমরা ওকে টেনে উঠানে নিয়ে যাই। দড়ি তৈরিই ছিল। পাশেই দাঁড়ানো ছিল বৃক্ষ।
হিরাম ডেলি সরে দাঁড়িয়ে আমাকে ফাঁসের দড়ি টানার সুযোগ করে দেয়। প্রথমে ছিল আল্গা।
তারপরে ধীরে ধীরে টাইট হতে শুরু করে। আমার হাতে অনুভব করি কম্পনশীল হাল্কা ওজন এবং আমার হাত বাঁধাগ্রস্ত হতে থাকে, টানা যাচ্ছিল না। অন্য হাতেরা এসে যুক্ত হয় এবং জুবের পা মাটি ছেড়ে শূন্যে দুলতে থাকে।
কেউ মুখোশে মুখ ঢাকে নি। আমরা একে অন্যকে চিনতাম। এমনকি দুর্বৃত্তের মুখও ঢাকা হয় নি।এবং সর্বশেষ আমার মনে আছে, সে যখন বাতাসে ঝুলে যায় তার মুখে ছিল একটি করুণ ভর্ৎসনার চাহনি, যা আমি ওর সাথে আবার মুখোমুখি দেখা না হওয়া পর্যন্ত কোনোদিন ভুলবোনা।
আমরা রশির শেষ মাথাটি একটি গাছের সাথে বাঁধছিলাম, যাতে মৃতের ঝুলন্ত দেহ তার বন্ধু-বান্ধবের জন্য হুশিয়ারী হিসাবে কাজ করে। এমন সময় একটি ভয়ানক চিৎকার আমাদের অস্থি পর্যন্ত শীতল করে দেয়।
“দড়ি কেটে ওকে নীচে নামিয়ে আনো”, “নীচে নামিয়ে আনো”, “সে দোষী নয়!” “আমরা এটাকে ধরেছি।” “নীচে নামিয়ে আনো, ঈশ্বরের দোহাই।” “এই এটাকে আমরা গোয়াল ঘরে লুকানো অবস্থায় পেয়েছি।”
জুবের ভাই বেন এবং অন্য এক নিগ্রো ছুটে আসছিল এবং তাদের দুইজনের মাঝখানে প্রায় হিঁচড়ে আনছিল একটি অতি দুর্দশাগ্রস্থ নগণ্য ও জঘন্য প্রাণিকে।
কেউ একজন দড়ি কেঁটে দেয় এবং প্রাণহীন জুব ধপ করে মাটিতে পড়ে।
“হায় ঈশ্বর! সে মৃত, সে মৃত!” ওর ভাই কেঁদে ওঠে।
কিন্তু অগ্নিজ্বলা চোখ নিয়ে সে তার বন্দীকে নিয়ে সবার মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। আমরা পূর্ণ আলোতে দেখতে পাই নখড়ে আঁচড়ানো শহরের ঘৃণ্যতম শ্বেত দুর্বৃত্ত টম স্কিনারের মুখ। কিন্তু ওর মুখ ছিল আমাদের সচরাচর দেখা মুখের মত নয়, বরং ময়লা ও কালি মেখে পরিকল্পিতভাবে কালো করা হয়েছে, যাতে একজন নিগ্রোর মুখের মত দেখায়।
ঈশ্বর যেন আমাকে ক্ষমা করেন, আমি জুবের প্রাণস্পন্দন ফিরিয়ে আনার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ি, যদিও আমি জানতাম সে ইতিমধ্যেই বিগত এবং তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। আমি ঘরের ভেতরে ছুটে যাই মৃত মেয়েটির লাশের কাছে। ত্বরা করে তারা এখনও ওকে স্নান করিয়ে সারে নি। আমি অতি সাবধানে তার আঙ্গুলের ভাঙা নখের নীচ পরীক্ষা করি। সেখানে কিছুটা চামড়া ছিল। বের করে নেই। কয়েকটি ছোট কুঞ্চিত ত্বকের টুকরো। অফিসে গিয়ে ম্যাগনিফাইং গ্লাসের নীচে পরীক্ষা করে আমার নিজস্ব সর্বনাশ দেখতে পাই।এটা ছিল একজন সাদা মানুষের চামড়া এবং এর মধ্যে প্রোথিত রয়েছে বাদামী রংয়ের সংক্ষিপ্ত চুল অথবা দাড়ি।
আমি কিভাবে বাইরে গিয়ে অপেক্ষমান জনতাকে খবরটি দেই, জানি না।আমার কানে ছিল শুধুই
একটি কান্নার আওয়াজ, “রক্তের অপরাধী, রক্তের অপরাধী!”
হতভম্ব জনতা নীরবে সরে যেতে শুরু করে।
নতুন বন্দী অপরাধ স্বীকার বা অস্বীকার করার কোন তাড়া করেনি। সবাই চলে যাবার পরে আমি বেনকে সাহায্য করতে যাই তার ভাইয়ের লাশ নিয়ে যেতে। কিন্তু সে ক্রুদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ায়, “আপনি আমার ভাইকে হত্যা করতে সাহায্য করেছেন, আপনি, যাকে সে বন্ধু মনে করতো। সরে যান, সরে যান। আমি আমার ভাইকে নিজেই নিয়ে যাবো।”
আমার পিছু হটা ছাড়া আর পথ ছিল না। সে এবং তার বন্ধুরা মৃত ব্যক্তিকে বহন করে নিয়ে যায়। রাস্তা তখন রোদে ঝলমল করছিল।
দুটি মৃতদেহের মাঝে দাঁড়িয়ে দেখলাম,কয়েকজন লোক, যারা ঠিক লুকিয়ে ছিল না, যেতে যেতে খুলে ফেলল তাদের আবরণ; আর আমার কর্ণকুহরে কে যেন কেবলই কাতরে কাঁদছে, “রক্তের অপরাধী, রক্তের অপরাধী।”
0 মন্তব্যসমূহ