
বলি, চাকরি করা বউ হলে নিজেই কিনে আনতে।
সে নিয়ে তোমার দুঃখ আছে তা জানি। বিদেশে হলে আমার পড়াশুনায় একটা কাজ পেতাম। কিন্তু এখানে বি এ পর্যন্ত পড়া দিয়ে কাজ হয় না। পাশ হলে না হয় বলতে পারতাম বি এ পাশ।
থাক। আর দুঃখ করে কাজ নেই। দেখি তোমার কাঠের বাক্স কোথায় পাওয়া যায়।
খুব বেশি উঁচু না আর অনেকটা কফিনের মত লম্বাটে।
মিরপুরের দোকানে মিরার স্পেসিফিকেশন মত একটাও বাক্স পাওয়া গেল না। কিন্তু একজন দোকানি বললেন রুপনগরের দিকে একটা পুরণো আসবারের দোকান আছে। ওখানে দেখতে পারেন। কিছুদিন আগে ওই দোকানটার সামনে দিয়ে আসতে আসতে আমার মনে হয় আমি একটা ওইরকম বাক্স দেখেছিলাম।
পাওয়া গেল। বেশ চমৎকার একটা কাঠের বাক্স। চারফুটের মত লম্বা। বেশি উঁচু নয় এবং ঢাকনিটাও বেশ কাজ করা। আমাদের বড় খাটের পায়ের দিকে বাক্সটা অনায়াসে মানিয়ে যাবে। মিরা খুশী হবে।
মিরা খুশী হলো। সবে শীত চলে গেছে। লেপ, কাঁথা, কম্বল রাখার জন্য একেবারে যথাযথ। মিরা খুশী। বলে,যাক এতদিন পরে তুমি একটা মনের মত জিনিস কিনলে।
কেন আমার কেনা জিনিস কী খারাপ?
মিরা বলে, ভালোই। তবে আজকেরটা সত্যিই অসাধারণ। কী চমৎকার আমাদের খাটের সঙ্গে মিশে গেছে। মনে হয় খাটটাই এত লম্বা। ও বার বার বাক্সটাকে দেখে। বলে, এমন একটা বাক্স কোথায় থেকে পেলে। দেখে মনে হয় কফিন। আমি বলি, থাক থাক তুমি আর বাক্সটাকে কফিনের সঙ্গে তুলনা করবে না। বল একটা সুন্দর বাক্স।
মিরা সে দুপুরে বাক্স সাজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমাদের দুজনের সংসার। ছেলেপুলেরা এখনো আসতে শুরু করেনি। আরো একটু অপেক্ষার পর সন্তানের চিন্তা। আমার একার রোজগারে সংসার চলে। যে ভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে হয়তো সন্তানের আসাটাকে আরো বেশ কয়েক বছর ঠেকিয়ে রাখতে হবে।
দুপুর রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। মিরা বসে আছে বাক্সটার উপর। দুই চোখে ঘুম। কিন্তু ও এমন করে বসে আছে মনে হলো ও পুরোপুরি জেগে। বলি, কী কাণ্ড তুমি এ ভাবে বাক্সের উপর বসে আছো কেন?
মীরা বলে, ওতো আমাকে বললো বাক্সটার উপরে বসতে।
ও কে? কে বললো?
ওই যে একজন মেয়ে। মানে আমার বয়সী একজন। বুঝলাম বাক্স নিয়ে সারাদিন কাটিয়ে ও হয়তো বাক্সের স্বপ্ন দেখছে। বলি,স্বপ্ন দেখেছো? ঠিক আছে এবার ঘুমিয়ে পড়। মিরা বিড় বিড় করে বলে, মেয়েটাতো বাক্স থেকে বেরিয়ে আমাকে বললো বসতে। এরপর মিরা যখন চোখ তুলে তাকায় দেখে মনে হয় ও চোখ মিরার নয়, আর কারো। তবে আমার সে ধারণা মুহূর্তের জন্য। বলি,খালি বেডকভারের তলায় একা ভালো লাগছে না। এখন চলে আসো দেখি।
মিরা তবু আসে না। কেমন একটু গোঁজ হয়ে বসে আছে।
আমি আর কিছু বলি না। মিরা হয়তো একসময় ঘুমিয়ে পড়বে। মাঝে মাঝে স্বপ্ন টপ্ন দেখে এমন করে জেগে ওঠা নতুন নয় তবে এখন যে ভাবে বসে আছে সে ব্যাপার নতুন।
একসময় সকাল হয়। জানালা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে। আমরা দুজনেই আজ দেরীতে জেগেছি। বন্ধের দিন। পরোটা মাংসের সকাল। ফ্রিজে মাংস রাখা আছে। মিরা ঘুম ঘুম চোখে বলে, তুমি টোস্ট বানিয়ে চা দিয়ে খেয়ে ফেল। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।
ভাবলাম হয়তো শরীরটা হঠাৎ ঋতু বদলের কারণে খারাপ হয়েছে। কপালে হাত দিয়ে জানি জ্বর নেই। বলি, তাহলে আর একটু ঘুমিয়ে থাক। আমি চা আর টোস্ট খেয়ে তোমাকে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করছি।
অনেক পরে উঠে ও। ও বেশ ক্লান্ত বোধ করে। যেন ও সারারাত ঠিকমত ঘুমায়নি।
পর পর কয় রাত এমনই হলো। মিরা ওঠে। সারাঘরে হেঁটে বেড়ায়। না হলে একসময় বাক্সটার উপর বসে থাকে। এবং দেরীতে ঘুম থেকে ওঠে।
কয়দিন পরে বাড়িতে ফিরে আসছি হঠাৎ একটা অচেনা হাতের লেখা খাম পাই। চিঠিটা মিরার। ভাবি কে আবার ওকে চিঠি দিল। চিঠিটা খুলি না। বাড়িতে এসে চিঠিটা মিরাকে দেই। মিরা চিঠি নিয়ে বাইরে চলে যায়। মনে মনে বলি, এত গোপনীয়তার কী আছে? বিয়ের আগে ওর কোন প্রেমিক ছিল না বলেই জানি।
মিরা কেমন করে জানি আর এক জগতের একজন হয়ে উঠছে। এবং তার স্বভাবেরও পরিবর্তন বুঝতে পারছি। কে চিঠি লিখেছিল এমন প্রশ্নের উত্তরে ও বলে,সব কথা তোমার শুনবার কী দরকার? আছে একজন।
আমার পুরো ব্যাপারটি ভালো লাগে না।
মনে হয় ওকে একটু গোপনে লক্ষ করি কী করে ও। কিন্তু স্ত্রীর উপর এমন স্পাইগিরি পছন্দ হয় না। কোন এক কাজে একদিন একটু আগে বাড়ি ফিরতে গিয়ে লক্ষ করি কে যেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে উঠলো। বাড়িতে এসে লক্ষ করি আজ মিরার সাজগোজ একটু নতুন ধরনের ভারতীয় সিরিয়ালের মেয়েদের মত খোলাপিঠ এবং হাতা বিহিন একটি লাল রংএর ব্লাউজে ওকে লাগছে একেবারেই আর একজনের মত।
বাপরে এত সাজগোজ ঘটনা কী?
কী এত নতুন সাজগোজ!
ও সামনে থেকে চলে যায়।
সে রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে লক্ষ করি মিরার হাতে রান্নাঘরের মাংস কাটবার চাপাতি। ও আমার বিছানার খুব কাছে। আমি চমকে উঠে বসি। ও সরে যায়। প্রশ্ন করি -- মিরা তোমার হাতে চাপাতি কেন?
বিছানার নিচে একটা বড় ইঁদুর ঢুকেছে। ওকে মারবার জন্য।
কেমন একটু হিংস্র মুখ ওর। তিন বছর হলো যাকে আমি জানি আজ আর তাকে চিনতে পারছি না। বললাম, এখন একটু চুপ করে ঘুমাওতো মিরা। এত রাতে আর তোমাকে ইঁদুর মারতে হবে না।
এইসব ভাবতে ভাবতে আমি ঠিক করি যে লোকটা বাক্সটা বিক্রি করেছে আমি ওর কাছে যাব। শুনবো কোথায় পেয়েছে ও এই কফিনের মত বাক্স। কাজ থেকে একটু তাড়াতাড়ি বের হই। অফিসের গাড়ি নেই না। রূপনগরের দোকানটা সাতটার ভেতর বন্ধ হয়ে যায়। একজন বুড়ো মানুষ প্রায় একা দোকান চালায়। নানা সব পুরণো জিনিসপত্র সেখানে। কোন এক বড়লোকের বাড়ির নানা সব সৌখিন জিনিসপত্র। এন্টিক। দেখলে এমন মনে হয়। একজন ছেলে বুড়োকে সাহায্য করে। বুড়োর কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় ছয়টা বেজে যায়। বুড়ো চিনতে পারে এবং আমাকে সেখানে দেখে অবাকও হয় না। তেমন কেউ নেই। সেই তরুণ কোন একজনকে চারটা পুরণো চেয়ার ঠেলাগাড়িতে তুলতে সাহায্য করছে। চেয়ার গুলো পুরণো হলেও দেখতে বেশ। বলি তাকে একসময়, এবার বলুনতো যে বাক্সটা আপনি আমাকে বিক্রি করেছেন তার ইতিহাস কী?
বুড়ো প্রথমে কিছুই বলে না। কেবল বলে , বাক্সটা আমি পেয়েছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছে। দুই বার বিক্রি করেছিলাম। দুইবারই বাক্সটা ফেরত এসেছে। কারণ যারা কিনেছে তারা বাক্সটাকে পছন্দ করেনি। বাক্সটা নাকি জীবন্ত। এ নাকি বাড়ির লোকদের চরিত্র বা ব্যবহার বদলে দেয়। আপনি ফেরত দিতে চাইলে দিয়ে যাবেন। আর ফেরত দিলে আমি খুব অবাক হবো না। লোকটার কথাবার্তা চমৎকার। মনে হয় ও একজন বড় কিছু ছিল। আর যে ভাবে বাক্সটা ফেরত চাইলো সেও এক অবাক ব্যাপার। অন্য কেউ হলে বলতো,না না ওসব বিক্রির জিনিস ফেরত নেব না। কিন্তু ও যেন দরজা খুলে বাক্সটার জন্য বসে আছে। বলছে ফেরত দিতে চাইলে দিয়ে যান। বললাম, আপনার সেই বন্ধু কী বেঁচে আছেন?
আছেন। তবে শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ। খুব দূরে থাকেন না। আপনি কী যেতে চান?
আপনি ঠিকানা বলুন। আলমগির হোসেন। ১১ নং বাড়ি। রূপনগর থেকে দুই মাইল উত্তরে যাবেন।
মর মর জর জর একটা বাড়িতে একজন বুড়ো। তার একটি ছেলে আর ছেলের বউ। প্রথমে তিনি কিছু বলতে রাজি হলেন না। কিন্তু একসময় হারিকেনের আলোতে মনে হলো তার চোখ দুটো খুলে গেছে। এবং তিনি দূরে কাউকে দেখতে পাচ্ছেন। বলেন , আফজল আপনাকে পাঠিয়েছে?
উনি পাঠাননি। আমি ওর কাছ থেকে আপনার ঠিকানা নিয়েছি।
ও আমার বিশেষ বন্ধু। প্রাণের বন্ধু বলতে পারেন। আসলে ও এত বুড়ো নয় যত ওকে মনে হয়। অসুখে বিসুখে ভাবনা চিন্তায় মানুষ এমন বুড়ো হয়ে যায়।
বলি তাকে, এই একটা কাঠের বাক্স কিনবার পর আমার বউ মিরা আর একটা মানুষ হয়ে গেছে। কারণ বলতে পারেন? বাক্সটা কী অপয়া বা ওর বিশেষ কী কোন কোন ক্ষমতা আছে? কোন বিশেষ গাছের কাঠ দিয়ে কী বাক্সটা তৈরী?
আলমগির একটু থামেন। বলেন, আসলে বেশ কিছুদিন আগে বাক্সটা আমি একটা নদীর ধারে পাই। মনে হয় কোথাও থেকে ও নদীর স্রোতে ভেসে এসেছিল। বাক্স খুলে ওর ভেতরে একজন নারীকে পাওয়া যায়। গলা কাটা। হাঁটু মুড়ে তাকে বাক্সের ভেতর রাখা হয়েছে। পুলিস আসে। কে মেরেছে, কারা মেরেছে তার কোন খবর কেউ জানে না। আমি বাক্সটাকে বাড়িতে আনি। আমার বউ একদিন অপঘাতে মারা যায়। বাক্সটা আফজলের দোকানে দিয়ে দেই। ও দু একবার বিক্রি করেছে কিন্তু লোকজন সেটা আবার ফেরত দিয়ে গেছে। আলমগিরের ছেলের বউ দুই কাপ চা আর কতগুলো বিস্কুট এনে সামনের টেবিলে রাখে। ঘোমটায় তার মুখ ঠিক বোঝা যায় না।
আমি বলি,বাক্সটা নষ্ট করে ফেললেই তো হতো? কেন ওকে আবার দোকানে রাখা হয় ওকে আবার বিক্রি করা হয়?
আফজল ফেলতে চায় না। বোধকরি আফজলের বাক্সটার উপরে মায়া পড়ে গেছে। বলি,আমি কাল পরশু বাক্সটা ফেরত দিয়ে যাব।
অবশ্যই দেবেন। ও দেখবেন অল্প কিছু টাকা রেখে আপনাকে বাক্সের দাম ফেরত দেবে। আসলে ও একজন সৎ মানুষ।
বুড়ো একটু ক্লান্ত। হাঁপানি আছে তার। আলো চলে গেছে বলে হারিকেন। সেই আলোতে মনে হয় বুড়োর বয়স খুব বেশি নয়। বলি , আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এমন একটা গল্প শেয়ার করবার জন্য।
এ আর এমন কী? কথা বলতে বলতে বুড়ো ইনহেলার নেন। শ্বাস কষ্ট।
বাড়িতে ফিরে মিরাকে কোথাও দেখতে পাই না। কাজের ছোট মেয়েটাকে বলি,কোথায় গেছে তোর মা?
বলতে পারি না। আমি দুপুরে ঘুমাইতেছিলাম তারপর উইঠা দেখি আম্মা নাই। পাতি পাতি করে ওকে খুঁজি। এখানে ওখানে ফোন করি কেউ কিছু বলতে পারে না। বলি নূরী নামের মেয়েটাকে , আচ্ছা নূরী সত্যি করে বলতো আমি না থাকতে এ বাড়িতে কেউ কী আসতো?
নূরী বলতেই চায় না। যখন বলি না বললে তোকে পুলিসে দেব আর জেলের ভাত খাওয়াব ও বলে,আসতো। একজন মোটা গোঁফওয়ালা পুরুষপোলা।
কাল এসেছিল?
আসছিলো। কিন্তু ও আসলেই আম্মা আমারে বাইরে পাঠাইয়া দিত।
মিরার এক টফির টিন ভর্তি গয়না নেই, জমানো টাকাও নেই। এসব নিয়ে ও কী সেই মোটা গোঁফওয়ালা লোকটার সঙ্গে চলে গেছে। তাইতো কিছুদিন হলো ওকে অন্যরকম লাগছে। খুঁজে পাই কিছু পুরণো চিঠি। তার কয়েকটা—
মিরা তুমি আবার আমাকে ডেকেছো। একদিন যাকে দেখেও দেখনি। আজ আবার তাকে তোমার কী প্রয়োজন হলো? এরপর কোন নাম স্বাক্ষর নেই।
একটা খাতায় মিরার হাতের লেখা --বাক্সের মেয়েটা আমাকে বলে এত ভালো মানুষ হয়ে কী লাভ। মন যা চায় তাই কর। দেখি যদি ওকে ডাকি ও কী আবার আসবে। আমার জন্য একদিন ও প্রাণ দিতে পারতো।
কে ওকে এসব বলছে? বাক্সের সেই মেয়েটা? কেন বলছে। আমি তো বুঝতে পারছিলাম কোন এক অশরীরি ওকে ভর করেছে। কিন্তু বিশ্বাস করতে মন চায়নি। এখন গয়না আর টাকা পয়সা নিয়ে কোথায় গেল ও?
বাক্সটা একটা নতুন কাপড়ে ঢাকা। আমি ভাবি ওর ভেতরে যা আছে সব বের করে বাক্সটাকে আবার আফজল সাহেবের দোকানে দিয়ে আসব। একটা ভ্যানগাড়িও ঠিক করা হয়েছে। বাক্সটা খুলতেই চমকে যাই পা মুড়ে শুয়ে আছে মিরা। ওর শ্বাস রোধ করে মারা হয়েছে। মুখটা তখনো টলটলে। নতুন শাড়ি, পিঠ বের করা ব্লাউজ। কিন্তু শরীরে কোন গয়না নেই। নাকের এক কুচি হিরে পর্যন্ত অদৃশ্য। নাক ফুল টানতে গিয়ে নাকের পাতা ছিঁড়ে গেছে। যে এসব করেছে একজন ভয়ংকর নিষ্ঠুর লোক।
আমি দুই হাতে চোখ ঢাকি।
ওর সেই প্রেমিক? সেইতো এসব করেছে? না আর কেউ? ঠিক বুঝতে পারি না।
পুলিস সব কিছু নোট করে চলে যায়। হয়তো খুনী একদিন ধরা পড়বে। মোটা গোঁফ, ভারী শরীর, কোকড়ানো চুল, মুখে চুরুট, এক হাতে সোনার চুরি, গলায় চেন এবং কালো মোটা ঠোঁট সেখানে পানের দাগ। মোটা গলায় কথা বলে। নুরীর বর্ণনা যেমন তা থেকে পুলিস নোট করে। এবং বলে, মনে হয় লোকটাকে আমরা চিনি। চিন্তা করবেন না ওকে ধরা যাবে। ও অনেকদিন বাইরে ছিল। ওখানে কী সব কাণ্ড করে দেশে চলে এসেছিল।
আফজল সাহেব কাঠের বাক্স ফেরত পান। মনে হলো তিনি বাক্সের অপেক্ষায় ছিলেন। আমি তাকে পুরো ঘটনা বলি না। ভালো লাগে না। হয়তো একদিন বলবো এখন এসব নিয়ে আলোচনা করতে ভালো লাগে না। মিরার জন্য আমার কষ্ট হয়।
বন্ধ দোকানের ভেতর আফজল আর আলমগির মুখোমুখি। আজো এখানে ইলেকট্রিক নাই। একটা পুরণো কালের বাতি দূরে টিম টিম করছে। একটি এন্টিক গোল টেবিলের দুই পাশে দুইজন বসে আছে। কালো কালো আঁধার ঝুলে আছে সারা ঘরে। আফজাল আর আলমগির। দুজনের হাত টেবিলে এবং ওরা দুইজন দুইজনের হাত ছুঁয়ে আছে। যেমন করে হাত ছুঁয়ে ওরা একদিন বলেছিল, চিরকাল আমরা একজন আরেকজনের সুখ-দুঃখে থাকব। আলমগির মুখ তোলে। তাকায় আফজলের মুখের দিকে, দোস্ত সেইদিন তুমি মিথ্যা সন্দেহ করে যখন আনুর গলা কেটে দিয়েছিলি সেদিন তুমি হয়ে উঠেছিলে একজন পশু। আজ মনে হয় তুমি আনুর প্রেমিক।
দোস্ত খুব তাড়াতাড়ি তুমি আমি বুড়িয়ে গেলাম এরপর। কারণ আমরা দুজনেই একদিন আনুকে ভালোবেসেছিলাম। তুমি ভুগছো হাঁপানিতে আর আমি ভুগছি শ্বাস কষ্টে। বাক্সটা চলে গেলে আনু কখনো আর আমার সামনে এসে দাঁড়ায় না। আমি বোধকরি আর বাক্সটা বিক্রি করবো না। তুমি বুদ্ধি দিয়েছিল কেমন করে বাক্সটাকে নদীতে ভাসাতে হয় কেমন করে আবার তাকে পাড়ে আনতে হয়। আমাদের পরিকল্পনা এত নির্ভুল পুলিস আমাদের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি।
তা ঠিক। কিন্তু দোস্ত কী করবে তুমি বাক্সটাকে?
বাড়িতে নিয়ে রাখবো। কখনো আনু সামনে এসে দাঁড়াবে, কথা বলবে। আমি ওকে ফিরে পাব। ওই তো আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ নারী। একটু থেমে বলে আফজাল -- আমি জানি ভদ্রলোক কেন বাক্স ফেরত দিয়ে গেল। ঘটনা আমি জানি। কুতুব বলেছে।
কেন ভদ্রলোকের কাঠের বাক্সটাকে ফেরত দিয়ে গেল দোস্ত? কী বলেছে কুতুব তোমাকে?
ওর বউটাতে ভর করেছিল আনু। নষ্ট করেছিল চরিত্র। একজন বাজে মানুষের খপ্পরে পড়েছিল ভদ্রলোকের বউ। এ হলো আনুর প্রতিহিংসা। মিথ্যা ওকে আমি মেরে ফেলেছিলাম, ভুল করে, সন্দেহ করে, তারই প্রতিহিংসা। আমি আর বাক্সটাকে বিক্রি করবো না দোস্ত। আর কারো জীবন আমি নষ্ট করতে চাই না। বাক্সটা আমি আনুকে বানিয়ে দিয়েছিলাম। বার্মা টিক দিয়ে। বাক্সের উপরের নকশা পালিশ সব আমার। আমার ডিজাইন করা। আনুর কিছু পছন্দের নকশি কাঁথার কালেকশন ছিল সেগুলো রাখবার জন্য অনেকদিন থেকে ও আমার কাছে বাক্স চাইছিল। এ বাক্স এখন আমার কাছে থাকবে। আর রাতে আনু এসে কথা বলে যাবে দোস্ত।
সেটাই ভালো। দোস্ত তোমাকে একটা কথা বলি আনু কিন্তু মাঝে মাঝে আমার সামনেও এসে দাঁড়ায় খুব মিষ্টি করে হাসে। আর দোস্ত তখন আমার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। এই বলে আলমগির ওর বুক মালিশ করে। ইনহেলার ব্যবহার করে। তার মুখ কোন এক ব্যথায় নীল, খাবি খাওয়া মাছের মত।
অনেকদিন আগে একজন বন্ধু আর একজন বন্ধুকে সাহায্য করেছিল। দুজনে ছিল জিগরি দোস্ত। চিরকাল একজন আর একজনের সঙ্গে থাকবে কথাও দিয়েছিল। দুজনেই এখন অকাল বার্ধক্যে ধুকে ধুকে বেঁচে আছে। আর সুযোগ পেলেই আনু বাক্স থেকে বেরিয়ে ওর প্রতিহিংসা মেটায়। কিন্তু আনু কেন আফজলকে শেষ করছে না। আলমগীরের দিকে তাকিয়ে কেবল মিষ্টি করে হাসছে? আনু বোধহয় জানে শেষ করলেই সব শেষ। একটু একটু করে ধুকে ধুকে বেঁচে থাক দুই জন বুড়ো। যাদের অকাল বার্দ্ধক্য ব্যধির মত শরীরের সব শক্তি শেষ করে ওদের নারকেলের ছোবড়া বানিয়ে ফেলছে। আনু জানে পুলিসের হাতে ধরা না পড়লেও বিবেকের কারাগারে বেঁচে থাকা সত্যিই কঠিন। দুজন মানুষ জানতে পেরেছিল আনুর নির্দোষিতা ও মারা যাবার পরে। এ দুঃখ নিয়ে বেঁচে থাকা সহজ নয়।
টলস্টয়ের গল্পের সেই ইভান ইলিচের মত বেঁচে থাকা। যখন মৃত্যুই একমাত্র পরিত্রাণ।
0 মন্তব্যসমূহ