ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা'র নাটক : ইয়েরমা


অনুবাদক : জয়া চৌধুরী

লেখক পরিচিতি
ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা (স্পেনীয়: Federico García Lorca) 

আধুনিক স্প্যানিশ সাহিত্যের অন্যতম কবি। তিনি একাধারে একজন কবি, নাট্যকার ও মঞ্চ পরিচালক ছিলেন। তিনি প্রজন্ম ২৭-এর(কবিদের সম্মিলনে গড়ে ওঠা সংগঠন, যারা ইউরোপিয়ান বিপ্লব স্প্যানিশ সাহিত্যে আনার চেষ্টা করে) একজন সদস্য হিসেবেই মূলত বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পান। তার রচিত অসংখ্য রচনা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের পাঠকদের কাছে এবং ধীরে ধীরে তার কাব্য-সাহিত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে স্বতন্ত্র এক ধারায়। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের শুরুর দিকে জাতীয়বাদী কর্মিরা তাকে হত্যা করে, তার লাশ আর কখনও পাওয়া যায়নি। তাকে স্পেনে 'জনগণের কবি' বলে ডাকা হয়। 

১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ইয়েরমা নাটকটি লেখেন লোরকা। নাটকটিকে তিনি বিয়োগাত্মক কবিতা বলতেন। 

অনুবাদ- জয়া চৌধুরী

(প্রথম পর্ব)


চরিত্র

ইয়েরমা            তৃতীয় ধোপানী        বৌ                      খুয়ান

মারিয়া             চতুর্থ ধোপানী         প্রথম  ভাইয়ের বৌ     ভিক্টর

বুড়ি পাগানা       পঞ্চম ধোপানী        দ্বিতীয় ভাইয়ের বৌ     মাচো

দোলোরেস         ষষ্ঠ ধোপানী          প্রথম ভদ্রমহিলা         প্রথম ভদ্রলোক

প্রথম ধোপানী     প্রথম বালিকা         দ্বিতীয় ভদ্রমহিলা        দ্বিতীয় ভদ্রলোক

দ্বিতীয় ধোপানী    দ্বিতীয় বালিকা       বাচ্চারা                   তৃতীয় ভদ্রলোক

      

 

প্রথম অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

পর্দা উঠলে দেখা যায় ইয়েরমা পা পর্যন্ত ঢোলা সুতির আলখাল্লা গাউন পরে শুয়ে আছে। মঞ্চে স্বপ্নের মত একটা আলো। একজন পাদ্রী কোমরে ক্রশ ঝোলানো, পাশ থেকে বেরিয়ে এলেন। নীল আলোটা বদলে গেল বসন্তের সকালের আনন্দ রঙে। ইয়েরমা জেগে উঠল।

                                   গান

কন্ঠ (ভেতর থেকে)- আয় ঘুম আয় ঘুম আয় ঘুম,

                        আমরা ঘুমবুড়ি বানাব যে

                        মাঠের মাঝে সেই যষ্টি মধু

                        ওরই বুকে আমরা মরব রে।

ইয়েরমা- খুয়ান শুনছো? খুয়ান?

খুয়ান-    যাচ্ছি

ইয়েরমা- সময় হয়ে গেছে।

খুয়ান-    ওরা জোড়ে চলে গেছে?

ইয়েরমা- হ্যাঁ সবাই চলে গেছে।

খুয়ান- বেশ, গেলাম। দেখা হবে (যেতে উদ্যত)

ইয়েরমা- এক গ্লাস দুধ ও খাবে না?

খুয়ান- কিসের জন্য?

ইয়েরমা- এত কাজ করো আর তোমার শরীরটাও এত কাজ সইতে পাবার উপযুক্তও তো নয়।

খুয়ান- পুরুষ মানুষ যখন রোগা থাকে শক্তিশালী থাকে, ঠিক যেমন ইস্পাত।

ইয়েরমা- কিন্তু তুমি নও। আমাদের যখন বিয়ে হয়েছিল তুমি অন্যরকম ছিল। এখন মুখটা এমন সাদা হয়ে গেছে যে মনে হয় এক ফোঁটাও সূর্যের আলো পায় না মুখ। তুমি নদীতে গিয়ে স্নান করলে ভাল লাগবে মনে হয়। আমাদের খামারবাড়িটার ওপর যখন বৃষ্টি ঝুপ্পুস করে দেবে তুমি ছাদের ওপর উঠবে। চব্বিশ মাস হল আমাদের বিয়ে হয়েছে আর প্রতিবার তুমি আরও ব্যস্ত আরও রোগা হয়েছ, তুমি যেন উল্টো দিকে বাড়ছ।

খুয়ান- শেষ হয়েছে তোমার?

ইয়েরমা (উঠতে উঠতে)- তুমি খারাপ পেয়ো না। আমি যদি অসুস্থ হয়ে পড়ি আমি চাইব তুমি আমার দেখভাল করো... “আমার বউয়ের শরীর খারাপ । আমি এই ষাঁড়টাকে জবাই করি বেশ লাগসই একটা মাংসের স্টু বানানোর জন্য। আমার বউয়ের শরীর খারাপ, মুরগীর জুসটা রেখে দিই যাতে ওর বরফ চামড়াটা ঢেকে দিতে পারি। আমি এই রকমই... আর তাই তোমায় সাবধান করে দিই।

খুয়ান- আর তাই আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ সোনা।

ইয়েরমা- শোনো... সাবধানতা ছেড়ো না ডিয়ার।

খুয়ান- আসলে আমার কিছুই নেই । সবই তো তোমার মালিকানা সোনা। আমি শুধু খুব খাটি। প্রতি বছরই আমি আরও একটু বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।

ইয়েরমা- প্রত্যেকটা বছর.. তুমি আমি এভাবেই চালিয়ে যাবো প্রতিটা বছর...

খুয়ান (হাসি মুখে) – স্বাভাবিক। বেশ নিশ্চিন্ত হলাম। পরিশ্রমের ফল ভালই হয়। আমাদের ছেলেমেয়েও নেই যে খরচ করবে।

ইয়েরমা- আমাদের ছেলেমেয়ে নেই... খুয়ান !

খুয়ান- বলো

ইয়েরমা- খুয়ান, আমি তোমায় ভালোবাসি না সোনা?

খুয়ান- বাসো তো।

ইয়েরমা- আমি এমন অনেক মেয়েকে চিনি যারা স্বামীর সাথে বিছানায় যাবার আগে কাঁপতে থাকে আর কাঁদতে থাকে। তোমার সঙ্গে প্রথমবার শোয়ার সময় আমি কেঁদেছিলাম? হল্যান্ডের সেই হাতাছাড়া কোটগুলো পরবার সময় গান গাই নি? তোমায় বলি নি “এই কোটগুলোর থেকে কেমন আপেলের গন্ধ বেরুচ্ছে”?

খুয়ান- বলেছিলে তো !

ইয়েরমা- আমার মা কিন্তু কেঁদেছিল, কারণ আমি তো ভাবি নি যে আমি মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছি। এটা তো সত্যি ছিল ! এর চেয়ে বেশি আনন্দ করে কেউ বিয়ে করে না। যাক গে...

খুয়ান- শান্ত হও

ইয়েরমা- আমি শান্তই আছি। যাক গে...

খুয়ান- আমার প্রচুর কাজ আছে। তোমার কথা আমি সব সময় শুনতে পাবো।

ইয়েরমা- না, যা বললে তা আর বোলো না। আমার চোখ দিয়েই বুঝতে পারছি ওটা হতে পারে না... পাথরের ওপর বৃষ্টি পড়লে তার শক্তিতে সে ভোঁতা হয়ে যায় আর তার ফাঁকে শ্যাওলা জন্মায়। যাতে মানুষ বলে ওরা কোন কাজেই আসে না। শ্যাওলা সরষে গাছ তো কোন কাজেই লাগে না... কিন্তু আমি স্পষ্টই দেখি বাতাসে হলদে ফুলগুলো দুলছে।

খুয়ান- অপেক্ষা করা দরকার।

ইয়েরমা- হ্যাঁ চাইতে চাইতে ( স্বামীকে জড়িয়ে ধরে, চুমু খায়। নিজেই এগিয়ে গিয়ে এসব করে।)

খুয়ান- তোমার কিছু লাগলে বলো, আমি নিয়ে আসব’খন। তুমি জান আমি চাই না তুমি বেরোও।

ইয়েরমা- আমি তো কখনো বেরই না।

খুয়ান- তুমি এখানে ভালোই আছো সোনা

ইয়েরমা – হ্যাঁ

খুয়ান- রাস্তায় যত নিকম্মা লোকের ভিড়।

ইয়েরমা( মুখ ব্যাজার করে)- হ্যাঁ

(স্বামী বেরিয়ে যায় আর ইয়েরমা সেলাই কলের দিকে এগোয়। পেটের ওপর আঙুল বোলায়। একটা মিষ্টি হাই তুলে হাত দুটো ওপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙে, তারপর সেলাই করতে বসে।)

আদর, আমার সোনার চাঁদ , কোথা থেকে আসো ?

বরফ হিম হিম মুরগীর ঝুঁটি থেকে, জানো।

(সূঁচে  সুতো পরিয়ে)

সোনা, আমার চাঁদ মণি , কী দরকার? কীসের জন্য ?

তোমার পোশাকের ওম মাখা কাপড়খানির জন্য।

বৃক্ষ শাখ কেমন ওঠে নড়ে সূর্য পানে

আর চারপাশের ঝরণার জল ওঠে লাফিয়ে !

( ইয়েরমা যেন কোন শিশুর সঙ্গে কথা বলছে)

উঠানে চেঁচায় একটা কুকুর

গাছে গাছে গান করে ঝড়।

রাখালের দিকে চেয়ে গান করে গাছ

চাঁদ কুঁচকাতে দেয় আমার কেশকে।

কি, কি চাও বাছা, অত দূর থেকে ?

(একটু থেমে)

তোমার বুকের ওই সাদা পাথর দুটো,

বৃক্ষ শাখ কেমন ওঠে নড়ে সূর্য পানে

আর চারপাশের ঝরণার জল ওঠে লাফিয়ে !

(সেলাই করতে করতে)

তোমাকে বলব সোনা, আমার ধন, হ্যাঁ সত্যি।

ভাঙাচোরা আর সোনার খনি আমি তোমার জন্যই।

কোমর আমার ব্যথা করে যে কতই

প্রথমবার যখন তোমাকে দোল খাওয়াই !

কখন, সোনাবাবা, তুমি আসবে এখানে?

( একটু থেমে)

তোমার রক্তমাংস যখন জুঁই ফুলের বাস ছাড়বে

বৃক্ষ শাখ কেমন ওঠে নড়ে সূর্য পানে

আর চারপাশের ঝরণার জল ওঠে লাফিয়ে !

( ইয়েরমা গান থামায়। দরজা দিয়ে মারিয়া প্রবেশ করে। হাতে তার কাপড়ের আন্ডিল।)

ইয়েরমা- কোত্থেকে এলি!

মারিয়া- দোকান থেকে।

ইয়েরমা- এত সকালে দোকান থেকে !

মারিয়া- ভাবলাম দরজার পাশে অপেক্ষা করি যতক্ষণ না ওরা ওটা খোলে। তুমি জানো না আমি কি কিনেছি?

ইয়েরমা- কি আর ... ব্রেকফাস্টের জন্য তুই কফি কিনবি, চিনি আর ব্রেড।

মারিয়া- না। আমি লেস কিনেছি। আর তিন গজ সুতো, লেস আর রঙ বেরঙের উল যাতে লালচে বাদামী বেরি গাছ বানাতে পারি। বরের যা টাকা আছে ও সব আমাকে দিয়ে দিয়েছে।

ইয়েরমা- তুই একটা ব্লাউজ বানাবি তো

মারিয়া- না... কারণ... জানো?

ইয়েরমা- কি?

মারিয়া- কারণ ও এসে গেছে ! (মাথা নিচু করে।) ( ইয়েরমা উঠে দাঁড়াল । তারপর আদরের চোখে তাকাল।)

ইয়েরমা- পাঁচ মাস !

মারিয়া- হ্যাঁ

ইয়েরমা- ওকে জানিয়েছিস?

মারিয়া- জানে

ইয়েরমা (কৌতূহলী ভাবে)- কি বলে ও?

মারিয়া- জানি না ( ইতস্তত করে) একটু যেন উদ্বেগে আছে।

ইয়েরমা- উদ্বেগে, হুম। ( ইতস্তত করে) কিন্তু... হবে কবে? আমায় বল... তুই কিন্তু খুব অযত্ন করিস।

মারিয়া- হ্যাঁ, অযত্ন।

ইয়েরমা- তুই গান গাইবি? ... না? তাহলে আমি গাই? তুই আমায় বল না।

মারিয়া- আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না। তুমি কখনো হাতের মুঠোয় লেপটে থাকা জ্যান্ত পাখি অনুভব করো নি?

ইয়েরমা- হ্যাঁ

মারিয়া ইয়ে ... একই রকম... তবে ভেতরে যেটা আছে সেটা রক্ত মাংসের।

ইয়েরমা- কী সুন্দর ! ( অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে থাকে)

মারিয়া- আমি পুরো ভেবলে গেছি, কিচ্ছু জানি না।

ইয়েরমা- কি জানিস না?

মারিয়া- ইয়ে... মানে কী করতে হয়। মাকে জিজ্ঞেস করব।

ইয়েরমা- কিসের জন্য? ওনার বয়স হয়েছে আর এসব জিনিষ ভুলে যেতেই পারেন। হাঁটাচলা বেশি করিস না আর যখন শ্বাস নিবি আস্তে আস্তে টেনে টেনে নিবি যেন দাঁতের ফাঁকে গোলাপ আটকে আছে।

মারিয়া- শোনো... ওরা বলছিল আর ক’মাস পরে টেনে টেনে হাঁটতে হবে।

ইয়েরমা- ওরা তখন তোকে আরও ভালোবাসবে,  ও যখন বলবে আমার ছেলে !

মারিয়া- আমার খুব লজ্জা করছে।

ইয়েরমা- বর কি বলছে?

মারিয়া- কিচ্ছু না।

ইয়েরমা- তোকে খুব ভালোবাসে না?

মারিয়া- আমাকে বলে না কিছু। তবে আমার সঙ্গে লেগে থাকে। ওর চোখ দুটো সবুজ পাতার মত কাঁপে।

ইয়েরমা- ও জানে যে তুই...

মারিয়া- হ্যাঁ।

ইয়েরমা- কেন জানে?

মারিয়া- জানি না, তবে বিয়ের রাতে আমার গালের ওপর মুখ রেখে ও সমানে বলছিল । এত বেশি বলছিল মনে হচ্ছিল যেন আমার ছেলে এক আগুন পাখি আর ও তাকে কানের ভেতর দিয়ে গলিয়ে দিচ্ছে।

ইয়েরমা- ভাগ্যবতী !

মারিয়া- কিন্তু তুমি তো এসব আমার চেয়ে বেশিই জানো।

ইয়েরমা- আমার তা কোন কাজে লেগেছে?

মারিয়ে- হুঁ ! সত্যি ! এরকম কেন হয় ? তোমাদের সময়কার সব কজন বউয়ের মধ্যে তুমিই একমাত্র যে এরকম।

ইয়েরমা- এই রকমই। জানি, এখনো সময় আছে। এলেনার তিন বছর পর হয়েছিল। আমার মায়ের সময়কার পুরোনো দিনের সব মহিলারা, তাদের আরও অনেক বেশিদিন পরে হয়েছিল। তবে দু বছর কুড়ি দিন, আমার মতে এটা বড্ড বেশি অপেক্ষা। ভাবছি এটা ঠিক হচ্ছে না... আমি এখানেই তৃপ্ত থেকে যাচ্ছি। অনেক সময় উঠোনে আমি খালি পায়ে হাঁটি ... শেষ মেষ খারাপ কিছু দিয়েই ব্যাপারটা শেষ  হবে।

মারিয়া- কিন্তু... কাম অন... বেচারী ! এমনভাবে বলছো তুমি যেন কত বুড়ো হয়ে গেছ। কি জানো ! এসব নিয়ে কেউ নালিশ করতে পারে না। আমার মায়ের এক বোনের চোদ্দ বছর লেগেছিল। তুমি যদি একবার দেখতে বাচ্চাতটা কি সুন্দর !

ইয়েরমা (উদবিগ্ন স্বরে)- কি করেছিল?

মারিয়া- ষাঁড়ের মত চেঁচাত এমন যেন একই সঙ্গে হাজারটা উচ্চিংড়ে গান গাইছে। আমাদের গায়ে হিসি করে দিত, চুল টেনে ফিতে খুলে দিত , আর বয়স যখন চার মাস হল, আমাদের সারা মুখ অসংখ্য আঁচড় কাটত।

ইয়েরমা ( হাসতে হাসতে)- কিন্তু এসব ব্যাপারে কষ্ট হয় না কি?

মারিয়া- তোমায় কি বলব...

ইয়েরমা- বাঃ ! আমি আমার বোনকে দেখেছি বুকময় আঁচড়ের দাগ নিয়ে বাচ্চাটাকে পিঠ থাবড়াচ্ছে। আর ওই ব্যথাগুলো বেশ টাটায় কিন্তু। তবে এই ব্যথা তো ভালো ব্যথা, শীতল ব্যথা, স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

মারিয়া- লোকে বলে মানুষ সন্তানের কাছ থেকে দুঃখ পায় বেশি।

ইয়েরমা- মিথ্যে কথা । এসব বলের দুর্বল মায়েরা, সারাক্ষণ নালিশ করিয়ে টাইপ মায়েরা। ওদের কিসের জন্য তালে ছেলেমেয়ে থাকে বাপু? ছেলে থাকা মানে গোলাপের ডাল থাকা নয়। আমাদের তাদেরকে বড় করে তোলার যন্ত্রণা সইতে হয় বইকি। আমার মনে হয় অর্ধেক রক্ত এভাবেই বেড়িয়ে যায়। কিন্তু এ-ও ভালো। স্বাস্থ্যকর, সুন্দর। প্রতিটি মেয়ের শরীরে চার পাঁচটা বাচ্চার উপযুক্ত রক্ত থাকে। যদি তাদের ছেলেমেয়ে না থাকে সেই রক্তগুলো বিষ হয়ে যায়। যেমন আমার হয়েছে।

মারিয়া- জানি না আমার কি আছে।

ইয়েরমা- বরাবর শুনেছি প্রথম বাচ্চার বেলা  মেয়েরা ভয়ে ভয়ে থাকে।

মারিয়া( মিনমিন করে) – দেখা যাক... কী ভালো সেলাই করো তুমি...

ইয়েরমা( কাপড়ের বান্ডিলটা টেনে নিতে নিতে)- নিয়ে আয় তোর স্যুটগুলো কেটে দিই। এটা?

মারিয়া- এগুলো ডায়াপার।

ইয়েরমা- বেশ(বসল)

মারিয়া- ইয়ে... চলি তাহলে।

( কাছে এগিয়ে এল আর ইয়েরমা ওর পেটে আদর করে হাত রাখল।)

ইয়েরমা-রাস্তার পাথরগুলোর ওপর দিয়ে দৌড়ে হাঁটিস না।

মারিয়া- গেলাম ( চুমু খেল। তারপর বেরিয়ে গেল।)

ইয়েরমা- তাড়াতাড়ি ফিরিস। ( ইয়েরমা আবার একটা কাজ নিয়ে বসল। কাঁচি নিয়ে কাটতে শুরু করল। মঞ্চে ভিক্টরের উদয়। )... বাই... ভিক্টর

ভিক্টর( বেশ গম্ভীর গলায়)- খুয়ান কোথায়?

ইয়েরমা- মাঠে

ভিক্টর- কী সেলাই করছ?

ইয়েরমা- কিছু ডায়াপার কাটছি।

ভিক্টর (হাসতে হাসতে) – ওহ কাম অন !

ইয়েরমা ( হেসে)-  ওগুলোকে  লেস দিয়ে ঘিরে দেব।

ভিক্টর- ওটা যদি মেয়ে হয় তোমার নামে ওর নাম রাখবে।

ইয়েরমা (স্খলিত স্বরে) কি রকম?

ভিক্টর- তোমার জন্য আমার খুব আনন্দ হয়।

ইয়েরমা ( গলা প্রায় বুজে আসে আবেগে) – না...না... আমার জন্য নয়। মারিয়ার ছেলেটার জন্য।

ভিক্টর- বেশ যে কথা ভেবে আনন্দ পাও। এ বাড়িতে শুধু একটা বাচ্চার অভাব।

ইয়েরমা (মর্ম পীড়ায়)- অভাব।

ভিক্টর- যাই হোক চালিয়ে যাও। তোমার বরকে বোল যেন একটু কম ভাবে কাজ নিয়ে। টাকা ও জমাতে চায় আর ও জমাবেও। তবে মরে গেলে ও কার জন্য টাকা রেখে যাবে? আমি ভেড়া গুলো নিয়ে বেরোলাম। খুয়ানকে বোলো ওর থেকে যে দুটো আমি কিনেছিলাম সে দুটো যেন ও রেখে দেয়। আর অন্যটার বিষয়? গোল্লায় যাক ! ( হাসতে হাসতে চলে গেল।) _

ইয়েরমা ( আবেগ ভরে)- ঠিক তাই; গোল্লায় যাক !

( কি যেন ভাবতে ভাবতে ইয়েরমা  উঠে দাঁড়াল। তারপর ভিয়াকুর প্রবাল দ্বীপের ছবিটা নাড়াল, জোরে জোরে শ্বাস ফেলল যেন সে বুক ভরে পাহাড়ের বাতাস নিচ্ছে। তারপর ঘরের অন্য দিকে গেল কি যেন খুঁজছে। সেখান থেকে ফিরে এসে আবার বসল। আবারও সেলাইয়ের ফ্রেম নিয়ে বসল। সেলাই করতে শুরু করল। একটা বিন্দুতে চোখ স্থির রেখে কাজ করতে শুরু। )

                                        পর্দা পড়ল




(দ্বিতীয় পর্ব)

প্রথম অঙ্ক

দ্বিতীয় দৃশ্য

 

মাঠ। ইয়েরমা প্রবেশ করে। হাতে একটা বেতের ঝুড়ি। প্রথম বৃদ্ধার প্রবেশ।

ইয়েরমা- গুড মর্নিং

প্রথম বৃদ্ধা – মর্নিং । সবটুকু গুড সুন্দরী মেয়েটার হোক।

ইয়েরমা- অলিভ ক্ষেতে কাজ করছে আমার বর, ওর জন্য খাবার নিয়ে এসেছি।

প্রথম বৃদ্ধা- অনেক দিন হলো বিয়ে হয়েছে?

ইয়েরমা- তিন বছর

প্রথম বৃদ্ধা- ছেলেমেয়ে কটা?

ইয়েরমা- নেই।

প্রথম বৃদ্ধা- অ্যাঁ! হবে হবে !

ইয়েরমা- আপনি ঠিক বলছেন?

প্রথম বৃদ্ধা- নয় কেন? ( বসে পড়লেন) আমিও সোয়ামির জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। সে বুড়ো হয়েছে। তবুও কাজ করে। আমার নয় পুত্তুর। ঠিক যেন ন’টা সুজ্যি। আর যেহেতু আমার কোন মেয়ে নেই সেদিক থেকে দেখতে গেলে তুই আমার মেয়ে হলে এরকমই হত।

ইয়েরমা- বুড়িমা তুমি নদীর ওপারে থাকো, না?

প্রথম বৃদ্ধা- হ্যাঁ গমকলের ওখানে। তুই কোন বাড়ির বেটি?

ইয়েরমা- আমি চাষি এনরিকের মেয়ে।

প্রথম বৃদ্ধা- আহ চাষি এনরিক ! ওকে তো আমি চিনি। ঘুম থেকে ওঠা, ঘাম ঝরানো, তারপর মরে যাওয়া। বেশি খেলাধুলো বা অন্য কোন কিছুও করত না। মেলায় যাবে অন্যেরা, সে নীরব কর্মী। তোর বাপের সঙ্গে আমার বিয়ে হতে পারত রে। কিন্তু হাঃ ! আমি ছিলাম খুব ফ্যাশন পরী। কটা তরমুজের টুকরো, কিংবা পার্টিতে গেলে কিংবা কটুকরো চিনির কেক-এই গলে যেতাম। বহু দিন আমি ভোরে দরজা খুলে উঁকি দিয়েছি, ভেবেছি বাইরে যে ছেলেটি বান্দোররিয়া (একধরনের বাজনা, স্পেনের ম্যান্ডোলিনের মত।) বাজাতে বাজাতে চলে যাচ্ছে আর আমি শুনছি তার আওয়াজ হয়ত ফিরে আসবে। তবে আসে নি। (হাসে) একথা শুনে তুই হাসছিস? আমার তো দু দু’জন সোয়ামী ছিল। চোদ্দটা ছেলেপিলে। ছয়টা মরে গেছে। তবে যাই হোক আমি দুঃখী নই। আরো বাঁচতে চাই। তোকে একটা কথা বলি শোন- ডুমুরের গাছ,  কী শক্ত ! বাড়িঘর, কী শক্ত ! শুধু আমরা ডাইনি মেয়েমানুষেরা যে কোন জিনিসকেই গুঁড়ো করে ফেলি।

ইয়েরমা- আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি?

প্রথম বৃদ্ধা- আচ্ছা? (তার দিকে তাকায়) জানি তুই কি বলবি? এসব ব্যাপারে আমি একটা কথাও বলব না। (উঠে দাঁড়ায়)

ইয়েরমা( বুড়ির পথ আটকায়) কেন নয়? আমাকে তুমি বিশ্বাস করে এসব বলেছো। অনেক দিন ধরেই আমি কোন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে প্রশ্ন গুলো করতে চেয়েছি। আমি জানতে চাই তো ! হ্যাঁ, তুমি আমায় বলো।

প্রথম বৃদ্ধা- কি?

ইয়েরমা- (গলা নামিয়ে) তুমি জানো সেটা। আমি বাঁজা কেন?  কেন আমায় সাদামাটা জীবনে প্রতিদিন পাখির দেখভাল করতে হবে কিংবা জানলায়  ইস্তিরি করা পর্দা টাঙিয়েই কাটাতে হবে? না। তোমাকে বলতেই হবে আমাকে কি করতে হবে ? যা যা প্রয়োজন আমি করব। যদি তুমি বলো তালে চোখের সবচেয়ে কমজোরী অংশটা দিয়েও সূচে সুতো পরাব আমি।

প্রথম বৃদ্ধা- আমি? আমি কিছু জানি না। আমি শুধু মুখটা ওপরের দিকে তুলে রাখি আর গান গাই। বাচ্চারা জলের মতই এসেছে। আই ই ই ই! কে বলে আমার এই শরীরটা সুন্দর নয়? তুই এগো। রাস্তার কোণে ঘোড়াটা চিঁহি চিঁহি করে ডাকছে। আই ই ! আমায় ছেড়ে দে মেয়ে। কথা বলাস না আমাকে দিয়ে। আমার মনে অনেক বুদ্ধি আছে আমি তা বলতে চাই না। 

ইয়েরমা- কেন? আমার বরের সঙ্গে তো আমি অন্য কিছু নিয়ে কথা বলি না।

প্রথম বৃদ্ধা- শোন, তোর সোয়ামী কে তুই পছন্দ করিস?

ইয়েরমা- মানে?

প্রথম বৃদ্ধা- তুই ওকে কেমন ভালোবাসিস? ওর সঙ্গে থাকতে চাস?

ইয়েরমা- জানি না

প্রথম বৃদ্ধা- তার কাছে তুই যখন যাস তুই কাঁপিস না? যখন তার ঠোঁটের কাছে আসিস তখন তোর স্বপ্নের মত মনে হয় না? বল, বল আমাকে।

ইয়েরমা- না, কখনো মনে হয় নি আমার এরকম।

প্রথম বৃদ্ধা- কখনো না? যখন নেচেছিলি একসঙ্গে তখনো না?

ইয়েরমা( মনে করতে করতে)- বোধহয়...একবার...ভিক্টর...

প্রথম বৃদ্ধা- বল বল

ইয়্বেরমা- ও আমার কোমর জড়িয়ে ধরল...। আর আমি কিছু বলতেই পারছিলাম না। আর একবার, সেই ভিক্টরই, আমার তখন চোদ্দ বছর বয়স ( ও তখন গাবলুগুবলু কিশোর) আমাকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়ে তারপর হাত দিয়ে আমায় টেনে নিয়েছিল। আমার দাঁতগুলো এমন ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করলো যে নিজের দাঁতের আওয়াজ নিজেই শুনছিলাম। আমি কিন্তু খুব লাজুক ছিলাম...

প্রথম বৃদ্ধা- আর তোর সোয়ামীর সাথে?...

ইয়েরমা- আমার বর অন্য জিনিষ, ও আমার বাবার কাছে সরাসরি প্রস্তাব দিয়েছিল আর আমি সেটা নিয়ে নিয়েছিলাম । আনন্দ করেই। এইটা একদম সত্যি। ইয়ে ...বৌ হবার প্রথম দিনেই আমি সন্তান হবার কথা  ভেবেছিলাম। হ্যাঁ, তবে সে আমায় খুব বাচ্চা মেয়ের চোখে দেখেছিল। যাকে খুব সহজেই চালনা করা যায় , ঠিক যেন আমি নিজেই আমার মেয়ে।

প্রথম বৃদ্ধা- আমি তোর একদম উল্টো ছিলাম। হয়ত সেই কারণেই তোর সময়মত বাচ্চা আসে নি রে। ব্যাটাছেলেদের তো পছন্দ হতে হবে, মেয়ে। বেণী আলগা করতে দিতে হবে আর ওদের নিজেদেরই নিজের মুখে জল খেতে দিতে হবে আমাদের। দুনিয়াটা এভাবেই চলছে মেয়ে।

ইয়েরমা- তোমার দুনিয়া চলে বুড়ি মা, আমার নয়। আমি অনেক কিছু ভাবি, অনেক আর আমি নিশ্চিত যে যে সব বিষয় ভাবি সেগুলো আমার সন্তান পর্যন্ত পৌঁছনোর জন্য দরকারী। আমার স্বামীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে শুধু ওকে পাবার  জন্যই। আমি মিলিত হতেই থাকব যাতে ও আসে। আমি নিজের সুখের জন্য কখনো মিলিত হই না।

প্রথম বৃদ্ধা-  হুঁ , তার ফল হল তোর কোল ফাঁকা।

ইয়েরমা- ফাঁকা? না না ফাঁকা নয়, কারণ আমি ঘেন্নায় ভরে যাচ্ছি। বলো আমায়... আমার দোষ? একজন পুরুষ খুঁজতে গেলে কেন পুরুষটাকেই খুঁজতে হয়? আর কিছু নয়? তা হলে তুমি কি ভাববে যখন তোমার পুরুষ টি ছাদের দিকে  দুঃখ দুঃখ চোখে তাকিয়ে তোমাকে বিছানায় ফেলবে, আধা ডিগবাজি খাবে আর তারপর ঘুমিয়ে পড়বে? ওর কথাটা ভাবা আমার কি প্রয়োজন কিংবা আমার বুক থেকে যা ঝিকমিক করতে করতে বেরোয় সে কথা তার ভাবার দরকার নেই? আমি জানি না । তুমি বলে দাও।  দয়া করে বলো।  

প্রথম বৃদ্ধা-  ইস... পাপড়ি খুলে গেছে রে।! কী ভীষণ সুন্দরী মেয়ে রে তুই ! আর বেশি বলাস না আমাকে দিয়ে। তোর সাথে বেশি বকতে চাই না। এসব মানসম্মানের কথা। আর তুই জেনে রাখ আমি কারো কাঁথায় আগুন দিই না । যাই হোক, তোর এতখানি সরল আর নিষ্পাপ হওয়া চলবে না।

ইয়েরমা(দুঃখী)- আমার মত যারা মাঠে ঘাটে বড় হয়েছে তাদের কাছে সব দরজাই বন্ধ। সবাই আধ খেঁচড়া কথা বলে। হাবে ভাবে বোঝায়। কার লোকে যেসব কথা বলে তারা তো এসব বুঝবেই না। আর তুমি। তুমিও চুপ করে রইলে। ডাক্তার বাবুর মত তুমিও পরিবেশ তৈরী করে তারপর পাশ কাটালে। সব কিছু জেনেও, সব কথা জানবার পরেও। জানার তেষ্টায় আমি মরে যাচ্ছি দেখেও বলতে চাইলে না কিছু।

প্রথম বৃদ্ধা-  অন্য কোন মেয়ে কে বলব আমি। কিন্তু তোকে না, তোকে  বলব না। আমার বয়স হয়েছে তোকে বললাম না।

ইয়েরমা- তাহলে, ঈশ্বর আমার তাঁর পায়ে ঠাঁই দিন।

প্রথম বৃদ্ধা-  ঈশ্বর? না না ঈশ্বর নয়। ওসব ঠাকুর দেবতায় আমি কখনো বিশ্বাস করি নি। ভগবান বলে যে কিছু নেই সেকথা তোরা কবে বুঝবি? ব্যাটাছেলেরা আছে। ওরা তোকে ঠাঁই দেবে।

ইয়েরমা- কিন্তু একথা বলছ কেন, বুড়িমা? কেন?

প্রথম বৃদ্ধা(যেতে যেতে)- যদিও ভগবান লোকটার থাকাই উচিৎ। যদিও বেচারী ছোট্টখাটো, কিন্তু বীজধারী ব্যাটাছেলেরা যারা মাঠের আনন্দে আটকে থাকে তাদের জন্য সূর্যের ছটাই পাঠানো উচিৎ।

ইয়েরমা- আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।

প্রথম বৃদ্ধা(বকবক করতে থাকে)- হুম, বুঝলাম সবই। দুঃখ করিস না বাছা। শক্ত হয়ে আশা রাখ। তুই এখনো বড্ড কচি। তুই কি চাস ওটা আমি করে দিই?

চলে যায়

(দুজন বালিকা মঞ্চে ঢোকে)

প্রথম বালিকা-  সব জায়গায় ছেলেদের সঙ্গেই দেখা হয়।

ইয়েরমা- পুরুষ মানুষ অলিভ ক্ষেতে এত পরিশ্রম করে তাদের জন্য তো খাবার আনাই দরকার। বুড়িদের মত বাড়ি বসে থাকবে না।

দ্বিতীয় বালিকা- তুমি কি গাঁয়ে ফিরছ?

ইয়েরমা- হ্যাঁ ওই দিকেই যাচ্ছি।

প্রথম বালিকা- আমার খুব তাড়া। বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছি। বাড়িতে কেউ নেই।

ইয়েরমা- তাড়াতাড়ি করো মেয়ে। বাচ্চাদের একলা ফেলে রাখতে নেই। তোমাদের বাড়ি শুয়োরের মাংস আছে?

প্রথম বালিকা- না, তুমি ঠিকই বলেছ, তাড়াতাড়িই যাচ্ছি।

ইয়েরমা- চলে এসো। এসব এভাবেই করতে হয়। তুমি নিশ্চয়ই দোর দিয়ে রেখে এসেছ।

প্রথম বালিকা- সে তো বটেই।

ইয়েরমা- হ্যাঁ, তবে তোমরা বোঝো না যে একটা ছোট্ট বাচ্চার দিকে সবসময় খেয়াল রাখতে হয়। আমরা যে বিপদের কথা সবচেয়ে ভাবি দেখা যায় যে শেষ পর্যন্ত সেটা বাচ্চাটার সঙ্গেই শেষ মেষ ঘটেছে। একটা ছোট্ট সুঁই কিংবা এক ঢোঁক জল...

প্রথম বালিকা- ঠিক বলেছ। আমি দৌড়ে যাচ্ছি। আসলে এসব আমারও ভালো লাগে না।

ইয়েরমা- চলো চলো

দ্বিতীয় বালিকা- তোর যদি চার- পাঁচটা বাচ্চা থাকত এমন করে বলতি না।

ইয়েরমা- কেন? চল্লিশটা থাকলেই বা কি?

দ্বিতীয় বালিকা-  সব দিক থেকেই। এই দেখো না তুমি বা আমি, আমাদের কারোরই একটাও বাচ্চা নেই। আমরা অনেক ধীর স্থির জীবন কাটাই।

ইয়েরমা- না। আমি না।

দ্বিতীয় বালিকা- আমি তো বটেই। কি নকল কি নকল বাব্বাঃ! তার বদলে আমার মা কিন্তু আমায় আগাছার বেশি কিছুই গছায় নি, যাতে সেগুলো আমারই থাকে। অক্টোবর মাসে আমরা পাদ্রী মশাইয়ের কাছে যাব। লোকে বলে আমরা যা চেয়ে থাকি উনি সব আমাদের দেবেন তখন। কিন্তু আমি কিছু চাই না।

ইয়েরমা- তুমি বিয়ে করলে কেন?

দ্বিতীয় বালিকা- কারণ বাপ মা আমার বিয়ে দিয়ে দিল। এভাবেই যদি চলতে থাকে তা’লে কচি কচি মেয়ে ছাড়া আর কেউই আইবুড়ো থাকবে না।  এসব ব্যাপারে বুড়িগুলো এত চাপাচাপি করে। আমার উনিশ বছর বয়স। আমার রান্নাবাড়ি করতে ভালো লাগে না, কাপড় কাচতে ইচ্ছা করে না। আমার সারাটা দিন তাই তাই করতে ইচ্ছা করে যা আমার করা বারণ। আর সেটা কার জন্য? কি দরকার ছিল আমার বরের আমার বর-ই হওয়া? কারণ একই কাজ আমরা আগেও করতাম, এখনো সেই কাজই করে চলি। বুড়িগুলোর যত্ত সব পাগলামি।

ইয়েরমা- শান্ত হও। এমন কথা বোলো না।

দ্বিতীয় বালিকা- তুমিও আমায় পাগল বলবে? পাগলী ! পাগলী ! ( হাসে) আমি তোমার একটাই কথা বলতে পারি আমার জীবন থেকে আমি যা শিখেছি। সব কটা পুরুষ বাড়ির ভেতর সেই সেই কাজ করে যা তাদের করতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু বাড়ির বাইরে? সেখানে ওরা কত ভালো থাকে। আমি গেলাম এখন নদীর ধারে। আমাকে পাহাড়ের মাথায় চড়ে ঘন্টা বাজাতে যেতে হবে। তার আগে একটু মৌরী ভেজানো জল খেয়ে নেব।

ইয়েরমা- তুমি একটা বাচ্চা মেয়ে।

দ্বিতীয় বালিকা- হ্যাঁ, তবে আমি কিন্তু পাগলী নই ! (হাসে)

ইয়েরমা- তোমরা গ্রামের ওই উঁচু টিলায় থাকো?

দ্বিতীয় বালিকা- হ্যাঁ।

ইয়েরমা- শেষ বাড়িটায়?

দ্বিতীয় বালিকা- হ্যাঁ।

ইয়েরমা- নাম কি তোমার?

দ্বিতীয় বালিকা- দোলোরেস।  জিজ্ঞেস করলে কেন?

ইয়েরমা- জানি না... এমনি মনে হলো...

দ্বিতীয় বালিকা- তুমি নাঃ ... শোনো আমার বরটাকে খাবার দিতে গেলাম। (হাসে) দেখি সে কোথায় ! হুঁ কি লজ্জা! কি লজ্জা! ওকে আমার নাগরও বলতে পারি না। সত্যি... (খিলখিল করে হাসতে থাকে সে) গেলাম।

ভিক্টরের গলা। (গান গাইছে)-

ঘুমাও কেন তুমি? ওগো চাষি ভাই?

ঘুমাও কেন তুমি? ওগো চাষি ভাই?

আমার পশমী কম্বলের ভেতর

আরও ভালো করে ঘুমাও।

ঘুমাও কেন তুমি? ওগো চাষি ভাই?

 

ইয়েরমা ( শুনছে)-

ঘুমাও কেন তুমি? ওগো চাষি ভাই?

আমার পশম কম্বলে তুমি

পারো আরো ভালো ঘুম ঘুমাতে।

তোমার কালো পাথুরে কম্বল,

চাষি ভাই,

আর তোমার তুহিন জামা

চাষি ভাই,

তোমার রাতের বিছানাতে

শীতের ধূসর খড় ছাওয়া।

ওকে কাঠেরা ছুঁচ  ফোটায়

চাষি ভাই,

তোমার বালিশ তলে

চাষি ভাই,

আর যদি কোন মেয়ের গলা শোনো

তা হলো হলের ভাঙা কন্ঠ

চাষি ভাই, চাষি ভাই।

তোমার পাহাড় খানা কি চায়,

চাষি ভাই?

সেই তিতা ঘাসের পাহাড়ে,

কোন খোকাকে তুমি পাঠাও?

যে তোমার ঝাঁটার কাঠিটাই !

( বেরিয়ে যেতে যেতে, ভিক্টর ঘুরে দাঁড়ালো, তার সঙ্গে ধাক্কা লাগল ইয়েরমার)

ভিক্টর (হাসি মুখে)- সুন্দরী, তুমি কোথায় যাও?

ইয়েরমা- তুমিই গাইছিলে?

ভিক্টর- হ্যাঁ, আমি।

ইয়েরমা- দারুণ । আমি কখনও জানতামই না যে তুমি গান গাও।

ভিক্টর- জানতে না?

ইয়েরমা- কি জোরালো আওয়াজ ! ঠিক যেন জলের ঝাপটা এসে মুখ ধুইয়ে দিল।

ভিক্টর- সুখী হলাম

ইয়েরমা- সত্যি।

ভিক্টর- যেমন সত্যি একথা যে তুমি একজন দুঃখী মানুষ।

ইয়েরমা- আমি দুঃখীই। আসলে এখানে থাকার কারণ আছে আমার।

ভিক্টর- আর তোমার স্বামী তোমার চাইতে ঢের বেশি দুঃখী।

ইয়েরমা- ওঃ। হ্যাঁ ও তো দুঃখীই। ও একটু নীরস মানুষ।

ভিক্টর- সবসময় ও একরকমই রয়ে গেলো। (থামল। ইয়েরমা বসে আছে।) খাবার দিতে এসেছিলে?

ইয়েরমা- হ্যাঁ। ( ওকে দেখে, একটু থামে) এখানে কি হয়েছে তোমার? ( মুখের দিকে আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে।)

ভিক্টর- কোথায়?

ইয়েরমা( উঠে দাঁড়ায়, ভিক্টরের কাছে যায়) এখানে... গালে। যেন ফোসকা পড়েছে।

ভিক্টর- ও কিছু না।

ইয়েরমা- আমার মনে হলো (থামল)

ভিক্টর- ও রোদে পুড়ে হয়েছে, হয়ত...

ইয়েরমা- হয়ত ( থামল, নিস্তব্ধতা বাড়ল। আর কোন রকম ভাব প্রকাশ না করেই মানুষ দুটোর মধ্যে ইগোর লড়াই শুরু হল।। কাঁপতে কাঁপতে) শুনছো?

ভিক্টর- কি?

ইয়েরমা- কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছো না?

ভিক্টর( কান পেতে)- না

ইয়েরমা- মনে হচ্ছে কোন বাচ্চা কাঁদছে।

ভিক্টর- তাই?

ইয়েরমা- খুব কাছে। যেন ডুবে যাচ্ছে এমন করে কাঁদছে।

ভিক্টর- এখানে ফল চুরি করতে অনেক ছোট ছেলেরা আসে।

ইয়েরমা- না না এটা একদম বাচ্চা কারো আওয়াজ( থামে)

ভিক্টর- আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না।

ইয়েরমা- কি জানি মনের ভুল হয়তো (স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। ভিক্টরও তার দিকে চেয়ে রইল। তারপর যেন ভয় পেয়েছে এমন ভাবে চোখ সরিয়ে নিল। খুয়ান প্রবেশ করল)

খুয়ান- তুমি? এখনো এখানে?

ইয়েরমা- কথা বলছি।

ভিক্টর- গুড আফটার নুন ( চলে যায়)

খুয়ান- তোমার বাড়িতে থাকা উচিৎ ছিল।

ইয়েরমা- আমি ভুলে গেছিলাম।

খুয়ান- বুঝি না, ভোলো কি করে?

ইয়েরমা- পাখিদের গান শুনছিলাম।

খুয়ান- ভাল । এভাবে লোকজনের সঙ্গে বিশেষ করে পুরুষ মানুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগও হয়।

ইয়েরমা(শক্ত গলায়)-  কি বলছ! খুয়ান!

খুয়ান- আমি তোমায় বলিনি একথা। আমি লোকজনের কথা বলেছি।

ইয়েরমা- লোকজনের গায়ে লেগেছে কথাটা।

খুয়ান- বাজে কথা বলো না। কোন মেয়েমানুসের জন্য এরকম কাজ করাটা কুৎসিত।

ইয়েরমা- ইস...আমি যদি মেয়েমানুষ হতাম !

খুয়ান- বাদ দাও। বাড়ি যাও (থামে)

ইয়েরমা- বাঃ আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করি?

খুয়ান- না না সারাটাক্ষণ ক্ষেতে জল দিতে হবে। কম জল আসে। আলো ফোটা পর্যন্ত কাজ করতে হবে। তাছাড়া চোর ও তো পাহারা দিতে হবে। তুমি শুয়ে পড়ো। রাতে ঘুমিয়ে পড়ো।

ইয়েরমা( নাটকীয় ভঙ্গীতে)- আমি ঘুমাবো !( চলে যায়)

                  পর্দা পড়ে



( তৃতীয় পর্ব)

দ্বিতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

গ্রামের ঝরনার উৎস মুখ। মেয়েরা জামাকাপড় কাচপছে। বিভিন্ন পাথরের চাঁই –এর ওপরে মেয়েরা বসা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাপড় কাচছে। গান গাইছেঃ

 

বরফ ঝরনা জলে

তোর ফিতে ধুই।

যেন গরম জুঁই

তোর হাসিই সই।

প্রথম ধোপানী- আমার কথা বলতে ভালো লাগে না।

তৃতীয় ধোপানী- কিন্তু এখানে তো লোকে কথাই বলে।

চতুর্থ ধোপানী- আমি কিন্তু এর ভেতর কোন দোষ খুঁজে পাই না।

পঞ্চম ধোপানী- যে জন মান চায়, সে তা ঠিকই পায়।

চতুর্থ ধোপানী-  আমি এক টমেটো বুনেছি

                  তাকে বাড়তে দেখেছি

                  যে মানুষ মান চায়

                  তার ব্যবহার ভাল হয়

হেসে উঠল সবাই 

পঞ্চম ধোপানী-  তা এভাবেই লোকে বলে থাকে।

প্রথম ধোপানী- তবে ব্যাপার হলো এই যে লোকে জানে না কিছুই তবু বলে।

চতুর্থ ধোপানী- এটা ঠিক যে মেয়েটার সোয়ামী তার দু বোনকে নিয়ে এসেছে একসঙ্গে থাকবে বলে।

পঞ্চম ধোপানী- আইবুড়ো মেয়েগুলো?

চতুর্থ ধোপানী-  হ্যাঁ, ওদের ওপর গির্জার দেখভাল করার ভার ছিল। এখন ওরা ভাইঝির দেখভাল করবে। আমি ওদের সাথে থাকতে পারব না।

প্রথম ধোপানী- কেন?

চতুর্থ ধোপানী- কারণ ওদের দেখলে ভয় লাগে। ওরা যেন সেই বড় বড় পাতা যারা কবরখানার ওপর দ্রুত জন্মায়। মোম দিয়ে লেপা, পাতাটা ভেতর দিকে মোড়ানো। মেয়েগুলোকে দেখলেই মনে হয় ওরা কুপির তেলে রান্না চড়ায়।

তৃতীয় ধোপানী- ওরা বাড়িতে?

চতুর্থ ধোপানী- হ্যাঁ। আমার সোয়ামী আবার কাল রাত থেকে ক্ষেত পাহারা দিতে গেছে।

প্রথম ধোপানী- কিন্তু কি ঘটে সেকথা সে জানতে পারে?

পঞ্চম ধোপানী- গত পরশু রাতে এই ঠানাডার মধ্যে মেয়েটা সারারাত গোবরাটে বসে থেকেছে।

প্রথম ধোপানী- কিন্তু, কেন?

চতুর্থ ধোপানী- তেনার বাড়িতে থেকে বাড়ির কাজ করতে কষ্ট হয়।

পঞ্চম ধোপানী- এইসব সমকামীগুলো এই রকমই। যে সময় ওরা লেস বুনতে কিংবা আপেলের জ্যাম বানাতে পারে সেই সময় বরং ওগুলোর ভালো লাগে ছাদে উঠতে, নয় তো খালি পায়ে এই সব নদীর ধারে হাঁটতে।

প্রথম ধোপানী- এসব বলার তুই কে? মেয়েটার ছেলেপিলে নেই সে তো ওর দোষ না।

চতুর্থ ধোপানী- থাকার ইচ্ছে করলে ঠিকই থাকত। আসলে এইসব আদুরী, আলসে, ঢলানি মেয়েছেলেগুলোর পেটে বাচ্চা আসেও না।

সবাই হেসে ওঠে।  

তৃতীয় ধোপানী- আর ওরা সাদা করে পাউডার মাখে, গালে রঙ মাখে। মাথার চুল করবীর ডাল দিয়ে সাজে বটে তবে তা তাদের সোয়ামীদের জন্য সাজ নয়। অন্য কারো খোঁজে সেই সাজ।

পঞ্চম ধোপানী- আবার কী!

প্রথম ধোপানী- কিন্তু তোরা কি ওকে অন্য কারো সাথে দেখেছিস?

চতুর্থ ধোপানী- আমরা দেখি নি , তবে লোকে তো বলে।

প্রথম ধোপানী- সবসময় লোকে বলে !

পঞ্চম ধোপানী- দু’বার অন্ততঃ লোক দেখেছে।

দ্বিতীয় ধোপানী- কি করছিল ওরা?

চতুর্থ ধোপানী- গল্প করছিল।

প্রথম ধোপানী- গল্প করা পাপ না।

চতুর্থ ধোপানী- দুনিয়ায় একটা জিনিষ আছে তা হল নজর। আমার মা বলত। কোন মেয়ে যদি পুরুষ মানুষের শরীরের গত্তি দেখে সেই নজর আর সে যদি ফুলে দিকে চায় সেই নজর ...দুটো এক না। ও দেখে ।

প্রথম ধোপানী- কিন্তু কাকে?

চতুর্থ ধোপানী- কাউকে। তোরা শুনছিস? ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিস তো। তুই কি চাস আরও জোরে বলি কথাটা? ( হাসির আওয়াজ) আর তখন তুই দেখবি না। কেননা ও একা থাকে। কেননা চোখের সামনে কাউকে দেখবি না। ওরে ও ওর নিজের চোখে তার ছবি এঁকে নিয়ে চলে।

প্রথম ধোপানী- এটা মিথ্যা!

পঞ্চম ধোপানী- আর সোয়ামী?

তৃতীয় ধোপানী- সোয়ামীটা তো এক্কেবারে অন্ধ। ঠিক যেন দিন দুপুরে আলোর মাঝখানে চিৎপাত হয়ে পড়ে থাকা কোন টিকটিকির মত থেমে থাকে।

হেসে ওঠে সবাই

প্রথম ধোপানী- ছেলেপিলে থাকল এসব শুধরে যেত।

দ্বিতীয় ধোপানী- এসব প্রশ্ন সেইসব লোকের যাদের কপালের কোন ঠিক ঠিকানা নেই।

চতুর্থ ধোপানী- ঘন্টায় ঘন্টায় বাড়িটা নরক হয়ে ওঠে। মেয়েটা, ওর বৌদিগুলো ঠোঁট বন্ধ করে না একটুও। সারাটাদিন দেওয়াল সাদা করছে।, তামা ঘষছে, স্ফটিকের জিনিষ গুলোকে গরমজলের ভাপে ধুচ্ছে, মেঝেয় তেল ঢেলে চকচক করছে। যাই হোক বাইরে থেকে বাড়িটা যত চকচকে ভেতর থেকে ততটাই পুড়ছে।

প্রথম ধোপানী- পুরুষ টার দোষ, পুরুষ টার। যখন কেউ বাচ্চা দিতে পারে না তার বউকে তখন তো তার বউয়ের আরও বেশি করে যত্ন নেওয়া উচিৎ।

চতুর্থ ধোপানী- এটা মেয়েটার দোষ। মেয়েটার জিভের ধার খুব।

প্রথম ধোপানী- মেয়েটা তোর কি করেছে চুলের ফাঁকে, যে তখন থেকে ওকে নিয়ে এসব বলে যাচ্ছিস?

চতুর্থ ধোপানী- তোর এত সাহস তুই আমায় জ্ঞান দিস?

পঞ্চম ধোপানী- থাম তোরা

হাসির আওয়াজ।

প্রথম ধোপানী- আমার সঙ্গে যদি মোজা সেলাইয়ের সূচটা থাকত না সবকটার মুখ সেলাই করে রাখতাম আমি।

পঞ্চম ধোপানী- থাম!

চতুর্থ ধোপানী- আর আমি সব ঢঙী দের মুখ বুক দিয়ে ঢেকে রাখতাম।

পঞ্চম ধোপানী- চুপ কর চুপ কর। ওই যে বউদিগুলো আসছে, দেখতে পাচ্ছিস না?

গুঞ্জন ধ্বনি। ইয়েরমার বৌদিরা মঞ্চে প্রবেশ করে। পরনে শোকের পোশাক। সবাই চুপচাপ কাপড় কেচে যাচ্ছে। গরুর গলার ঘন্টার আওয়াজ শোনা গেল।

প্রথম ধোপানী- ভেড়া গুলো চলে গেছে?

তৃতীয় ধোপানী- হ্যাঁ। এখন সবকটা জানোয়ারের পাল বেরিয়েছে।

চতুর্থ ধোপানী (গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে) – আ,আর ভেড়ার গায়ের গন্ধ ভালো লাগে।

তৃতীয় ধোপানী- সত্যি!

চতুর্থ ধোপানী- কেন নয়? যার যা গন্ধ। শীতের সময় নদীর জলে যে লালচে কাদা বয়ে আনে আমি তা ভালবাসব না কী?

তৃতীয় ধোপানী- বাতিক।

পঞ্চম ধোপানী ( দেখতে দেখতে)- সবকটা ভেড়া গায়ে গায়ে লেগে আছে।

চতুর্থ ধোপানী- এটা উলের বন্যা একেবারে। সব ভাসিয়ে নেয়। যদি সবুজ গমগাছ গুলোর মাথা থাকত তালে ওদের আসতে দেখে তারা ভয়ে কাঁপত।

তৃতীয় ধোপানী- দেখ দেখ , কেমন দৌড়চ্ছে ! শত্তুরের দল !

প্রথম ধোপানী- সব্বাই বেরিয়ে পড়েছে। একটাও বাকী নেই।

চতুর্থ ধোপানী- দেখি...না ...হ্যাঁ হ্যাঁ একটা বাকি।

পঞ্চম ধোপানী- কোনটা?...

চতুর্থ ধোপানী- ভিক্টরের টা।

 

দুই বৌদি সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। তাদের দিকে তাকাল। মৃদু স্বরে গান গাইতে লাগল।

 

বরফ ঝরনা জলে

তোর ফিতে ধুই

যেন গরম জুঁই

তোর হাসিই সই

সেই জুঁই ফুলেই

বাঁচতে আমি চাই

সেই হিমেল মেয়ের জন্য।

প্রথম ধোপানী- আইই ! শুকনো দরকচা পড়া বিয়ে ওয়ালীর থেকে !

                  আইই! বালির বস্তার মত বুক ওয়ালীর থেকে !

পঞ্চম ধোপানী-  তুই আমায় বল তোর সোয়ামী নাকি

                   পাহারা দেয় বীজ

                   যাতে জল কেঁদে মরে

                   তোর কাপড়েরই জন্য

চতুর্থ ধোপানী-  এইটা তোর কাপড়

                  যেন রুপোলী জাহাজ আর ঢেউএর ওপর

                  ভেসে চলা বাতাস।

তৃতীয় ধোপানী- আমার ছেলের কাপড়

                   আমি এনেছি ধুয়ে নিতে

                   স্ফটিকের কারসাজি

                  যাতে জল নেয় ওটা টেনে

দ্বিতীয় ধোপানী- আমার সোয়ামী এসেই গেছে

                   পাহাড়ের মাথায় ভাত খেয়ে নিতে

                   নিয়ে এসেছে গোলাপ একখানা

                   আমি তাকে দিই গোলাপ তিনখানা।

পঞ্চম ধোপানী- রাতের খানা খেতে সোয়ামী আমার এসেছে

                  সমতল দিয়ে হেঁটে হেঁটে

                  যে গনগনে ছাই আসে আমার নিকটে

                 আমি ঢাকি তাদের মেদিগাছ গুলো দিয়ে

চতুর্থ ধোপানী-  বাতাস বয়ে এসেছে

                  আমার সোয়ামী ঘুম দিতে

                  আমি লাল লবঙ্গ ফুল রাশি

                 আর সে লাল লবঙ্গ ফুলখানা।

তৃতীয় ধোপানী- ফুলের সাথে ফুল জুড়ে নিতে হয়

                  যখন গরম শুকিয়ে দেয় শস্যচ্ছেদকের রক্ত।

চতুর্থ ধোপানী- পাখিদের আর স্বপ্নহীন অন্ত্র খুলে দেওয়া

                  যখন দরজার কাছে এসে ডাক দেয় কাঁপতে থাকা শীত।

প্রথম ধোপানী-  চাদরের ওপর গোঙানো চাই

চতুর্থ ধোপানী-  গান গেয়ে ওঠা চাই!

পঞ্চম ধোপানী- পুরুষই যখন আমাদের

                  এনে দেয় মুকুট আর রুটি

চতুর্থ ধোপানী- কেননা হাতেরা জড়িয়ে ধরে চেপে

পঞ্চম ধোপানী- কেননা আলো ভেঙে দেয় আমাদের স্বর

চতুর্থ ধোপানী- কেননা শাখার অঙ্কুর করে দেয় মধুময়

পঞ্চম ধোপানী- আর ঝড়ের দোকানগুলো পাহাড় ঢেকে দেয়।

ষষ্ঠ ধোপানী ( উঁচু ঝরনার পাশ থেকে উদয় হতে হতে)-  যাতে এক শিশু পুঁতে দেয়

                                                                 ভোরের কঠিন কাচগুলি

চতুর্থ ধোপানী- আর আমাদের শরীরে আছে

                 প্রবালে ফুঁসে ওঠা যত শাখা

পঞ্চম ধোপানী- যাতে সাগরের জেলেতেই

                  থেকে যায় মাঝিরা

প্রথম ধোপানী- একটা ছোট্ট খোকা, ছোট্ট খোকা

দ্বিতীয় ধোপানী- আর পায়রারা খুলে দেয় ঠোঁট আর দুখানা ডানা

তৃতীয় ধোপানী- একটা খোকা গোঙায়, একটা খোকা

চতুর্থ ধোপানী- আর পুরুষ এগোতে থাকে

                 যেন আহত হরিণের দল

পঞ্চম ধোপানী- আনন্দ, আনন্দ, আনন্দ !

                   জামার তলায় গোলাকার পেটের আনন্দ !

প্রথম ধোপানী- কিন্তু আইই ! শুকনো দরকচা পড়া বিয়ে ওয়ালীর থেকে !

                  আইই! বালির বস্তার মত বুক ওয়ালীর থেকে !

চতুর্থ ধোপানী- কী বিদ্যুৎ ঝলক !

পঞ্চম ধোপানী- কী দৌড় !

চতুর্থ ধোপানী- ফিরে ফিরে কী বিদ্যুৎ ঝলক !

তৃতীয় ধোপানী- কী গানই না গায় !

ষষ্ঠ ধোপানী- আমার খোকার বেবি ফ্রকের

                তলায় থাকে দারুণ আলো !

চতুর্থ ধোপানী ( সবাই কোরাসে গায়)- বরফ ঝরনা জলে

                                           তোর ফিতে ধুই

                                           যেন গরম জুঁই

                                           তোর হাসিই সই

                                           হা, হা, হা!

তালে তালে তারা কাপড় ঘষতে থাকে আর আছাড় মারতে থাকে।

                           পর্দা পড়ে

 

 

 ( চতুর্থ পর্ব)

দ্বিতীয় অঙ্ক

দ্বিতীয় দৃশ্য


ইয়েরমার বাড়ি। বিকেল হয়ে আসছে। খুয়ানের দুই বোন দাঁড়িয়ে আছে।

খুয়ান- তুমি বলছ একটু আগে ও বেরিয়েছে? ( বড় বোন মাথা নাড়িয়ে প্রতিবাদ জানাল।) ঝরনার কাছেই ওর থাকা উচিৎ। কিন্তু তোমরা তো জানো আমি চাই না ও একা বের হয়। ( একটু থেমে) তোমরা টেবিলে খাবার সাজাতে পারো। ( বড় বোন বেরিয়ে যায়) বড্ড খিদে পেয়েছে। ( তার বোনের দিকে তাকিয়ে)  কাল একটা দারুণ কঠিন দিন গেছে। আপেল গাছগুলোর ডালপালা ছাঁটছিলাম। বিকেল হয়ে এলে আমার মনে হল কিসের জন্য আমি এমন পাগলের মত কাজ করি যদি মুখে একটা আপেলও না তুলতে পারি ! আমি ক্লান্ত। ( দুহাতে মুখ ঢাকে, থামে) ও আসবে না। ... ( তোমাদের একজনের অন্তত ওর সঙ্গে যাওয়া উচিৎ ছিল, কেননা এর জন্যই তোমরা আমার টেবিলে খেতে বসতে পারো, আমার ওয়াইনে চুমুক দিতে পারো। আমার জীবন মাঠেঘাটেই কাটে কিন্তু আমার সম্মান থাকে আমার ঘরে। আর আমার সম্মান তো তোমরাও। ( বোন মাথা হেলায় । )  খারাপ পেয়ো না। ( ইয়েরমা দুটো কলসি নিয়ে মঞ্চে ঢোকে। দরজায় দাঁড়িয়ে পড়ে।)

ইয়েরমা- খাবার জন্য ঠান্ডা জল আনতে গেছিলাম। ( অন্য বোনটিও বেরিয়ে যায়) ক্ষেতের খবর কি?

খুয়ান- কাল গাছ ছাঁটাই করছিলাম।

( ইয়েরমা কলসি দুটো নামিয়ে রাখে। থামে।)

ইয়েরমা- তুমি থাকবে?

খুয়ান- আমার জন্তুগুলোকে পাহারা দেওয়া দরকার। তুমি তো জানো মালিকেরই এগুলো করা দায়।

ইয়েরমা- আমি খুব ভালো করেই জানি। বারবার বলতে হবে না।

খুয়ান- প্রতিটি পুরুষের নিজের জীবন আছে।

ইয়েরমা- আর প্রতিটি মেয়েরও। আমি তোমায় থাকতে বলি নি। আমার যা যা দরকার সব আছে। তোমার বোনেরা আমায় ভালোই পাহারা দেয়। নরম রুটি, ভেড়ার রোস্ট আর ঘরে বানানো চিজও খেতে পাই এখানে। আর পাহাড় ভর্তি তোমার পোষা জন্তুজানোয়ার চরাই। আমার মনে হয় তুমি শান্তিতে থাকতে পারো।

খুয়ান- শান্তিতে থাকতে গেলে স্থির থাকতেও পারা চাই।

ইয়েরমা- তুমি তা নও?

খুয়ান- না

ইয়েরমা- মনোযোগ টা সরিয়ে ফেলো।

খুয়ান- তুমি আমার স্বভাব জানো না? ভেড়ারা খোঁয়াড়ে আর মেয়েরা বাড়ির ভেতরেই মানায়। তুমি বড্ড বেশি বাইরে বের হও। আমি সব সময় এক কথাই বলি তোমাকে। শোনো নি?

ইয়েরমা- ঠিক বলেছ। মেয়েরা বাড়ির ভেতরে। যতক্ষণ না বাড়ির ভেতরটা কবরখানা হয়ে যায় ততক্ষণ। যতক্ষণ চেয়ার ভাঙচুর হয়, যতক্ষণ সুতোর কাজ করা বিছানার চাদরগুলো ব্যবহারে ছিঁড়ে যায় ততক্ষণ। কিন্তু এখানে, না। প্রতিটি রাতে যখন আমি শুই বিছানাটাকে আর ও নতুন লাগে। আরো চকচকে। যেন এক্ষুণি শহর থেকে কিনে এনেছি।

খুয়ান- অভিযোগ করবার আগে তুমি নিজেই তো জানো কারণটা।

ইয়েরমা- সজাগ থাকো... কিসের জন্য? যাতে কোন কিছুতেই তোমার অসুবিধা না হয়। যাতে আমি তোমার কাছে নত হয়ে বাঁচি। তোমার যা যা খারাপ লাগে তা যেন নিজের মধ্যে ধেকে চেপে রাখি। আর প্রতিটা দিন আরো খারাপ কাটতে থাকে। যাক। চলো আমরা শান্ত হই। আমি আমার ক্রশ কে যতটা ভালোভাবে পারি বইব। কিন্তু তুমি আমায় কোন প্রশ্ন করবে না। যদি সম্ভব হত আমি শিগগিরি বুড়ি হয়ে যেতাম। আর আমার মুখটা চটকানো ফুলের মত হয়ে যেত। তোমার মুখেও হাসি ফুটত আর আমিও তোমার সঙ্গেই গোটা জীবনটা কাটিয়ে দিতাম। এখন, এখন ...আমাকে আমার কষ্ট নিয়ে থাকতে দাও।

খুয়ান- এমন ভাবে কথা বলো যে আমি তোমাকে বুঝতে পারি না। আমি তোমাকে কিছু করতেই বাধা দিই না। আশেপাশের গ্রাম গুলোতেও তোমায় যেতে দিই। যা যা তোমার ভালো লাগে। আমি নিজের দোষ দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু আমি শান্তি চাই। আর তোমার সঙ্গেই শান্ত হয়ে থাকতে চাই। আমি বাইরে ঘুমোতে চাই আর সেই সঙ্গে এও চাই যে তুমি অন্দরে ভালো ভাবে ঘুমোও।

ইয়েরমা- কিন্তু আমি  ঘুমোই না।

খুয়ান- তোমার কি কিছুর অভাব আছে  বল? (থামে) উত্তর দাও।

ইয়েরমা ( তীব্রভাবে স্বামীর দিকে চেয়ে থাকে ) – হ্যাঁ আমার অভাব আছে।

খুয়ান- সব সময় এক কথা। পাঁচ বছর হয়ে গেল। আমি প্রায় এটা ভুলেই যাচ্ছি।

ইয়েরমা- কিন্তু আমি তো তুমি নই। পুরুষ দের অন্য জীবন থাকে। জমিজমা জন্তু জানোয়ার আড্ডা... আর আমাদের মেয়েদের শুধু কাজের মেয়ে হয়ে থাকা, শুধু কাজের মেয়েদের পাহারা দেওয়া।

খুয়ান- পুরো দুনিয়াটাই একরকম নয়। তুমি কেন তোমার ভাইয়ের একটা ছেলেকে নিয়ে আসো না? আমি তো আপত্তি করি নি।

ইয়েরমা- আমি অন্যদের বাচ্চা দেখভাল করতে চাই না। তাদের বুকে নেব ভাবতেই আমার হাত দুটো জমে হিম হয়ে যায়।

খুয়ান- এই দুর্বলতার জন্যই তুমি এমন বাঁধন ছাড়া জীবন কাটাও। তোমার কি করা উচিৎ সেসন কিছুই ভাবো না। আর পাথরের মত মাথা কুটে মরবার ভূমিকায় অভিনয় কর।

ইয়েরমা-  পাথরের যেন পাথর হওয়াটাই একটা কলঙ্ক। কেন সে ফুলের ঝুড়ি নয়। কেন সে মিষ্টি হল না।

খুয়ান- আমি তোমার কাছে থাকলেও তুমি অস্থির, অশান্ত ছাড়া কিছুই থাকো না। অতএব তোমার হার মানাই উচিৎ।

ইয়েরমা- আমি এই চার দেওয়ালের ভেতরে হার মানতে আসি নি। যখন আমার মাথা রুমাল দিয়ে বাধা থাকবে যাতে আমার মুখ না খুলে যায়, আমার হাত বেশ ভালো রকমই কফিনের ভেতরে পচা মাংস হতে থাকবে তখন গিয়ে আমি হার মানব।

খুয়ান- তারপর। কি করতে চাও?

ইয়েরমা- জল খেতে চাই অথচ একটা গ্লাস নেই যে জল খাব। পাহাড়ে চড়তে চাই অথচ আমার পা নেই যে পাহাড়ে চড়ব। পেটিকোট সেলাই করতে চাই অথচ আমি সূচ খুঁজে পাই না।

খুয়ান- আসলে ব্যাপারটা হল তুমি ঠিকঠাক একটা মেয়েই নও। তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেও তুমি তোমার পুরুষের জীবনে ধ্বংস খুঁজতে থাকো।

ইয়েরমা- আমি জানি না আমি কে। আমায় একা একা হাঁটতে দাও। নিজের ভেতরে ডুবতে দাও। তোমার কোন ব্যাঘাত ঘটাব না আমি।

খুয়ান- আমি চাই না অন্য পুরুষেরা আমাকে দেখিয়ে কিছু বলুক। সেই জন্য আমার দরজাটা বন্ধ দেখতে চাই আর প্রতিটা মানুষ কে ঘরের ভেতরেই দেখতে চাই।

মঞ্চে প্রথম বোন আসে এবং ধীরে ধীরে কাবার্ডের দিকে এগিয়ে যায়

ইয়েরমা- পুরুষের সঙ্গে কথা বলা কোন পাপ নয়।

খুয়ান- কিন্তু খারাপ দেখাতে পারে। ( অন্য বোন ঘরে ঢোকে এবং কলসিগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। সেগুলো জলে ভর্তি। ) ( গলা নামিয় বলে) আমার এসব করার শক্তি নেই। ওরা যখন এসব বলে- তুমি চুপ করে থাকো আর ভুলে যাও যে তুমি বিবাহিতা।

ইয়েরমা- বিবাহিতা !

খুয়ান- আর যে সব পরিবার সম্মাননীয় তাদের সবার মধ্যে এই সম্মান বয়ে নিয়ে যাওয়া একটা দায়িত্ব। ( একটা কলসি হাতে এক বোন বের হয়ে যায়।) কিন্তু একই রক্তনালীর ভেতরে তা অন্ধকার ও দুর্বল। ( আর এক বোন একটা থালা হাতে হেঁটে যায় ঠিক যেন মিছিল করে) (থামে) আমায় মাফ কোরো। ( ইয়েরমা স্বামীর দিকে চায়। মাথা উঁচু করে চোখে চোখ রাখে। ধাক্কা খায়।) যদিও তুমি এমন ভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছ...আমার তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ ই নয়। বরং তোমার উচিৎ আমাকে মান্য করা। চোখ নামানো। কারণ আমি তোমার স্বামী হই। ( দুই বোন দরজায় এসে দাঁড়ায়।)

ইয়েরমা- চুপ করো। তোমায় হাত জোড় করে অনুরোধ করছি কথা বলো না। প্রশ্ন বন্ধ করো। (থামে)

খুয়ান- চলো খেতে যাই। ( বোনেরা মঞ্চে ঢোকে। থামে। ) শুনতে পাচ্ছ?

ইয়েরমা( মিষ্টি করে)- তোমার বোনদের নিয়ে তুমি খাও। আমার এখনো খিদে পায় নি।

খুয়ান- তুমি যা চাও ( খাবার ঘরে যায়)।

ইয়েরমা ( যেন স্বপ্ন দেখছে)-

আহ চরাচর জোড়া কী ব্যাথা !]

আহ কী ভীষণ বন্ধ সুন্দরের দরজা,

যেখানে আই চাই সন্তান চাই ব্যাথা আর বাতাস

আমাকে উপহার দেয় ঘুম ঘুম চাঁদের ডালিয়া ফুল!

আমার যে আছে এদুটি ঝরনা

তপ্ত দুধে ভরা, আমার মাংসের

দুটি দলা, ঘোড়ার দুটি নাড়ি,

ওরা মারে আমার হতাশার ডালগুলো।

আহ আমার জামার নিচেকার অন্ধ বুক জোড়া !

আহ চোখ হীন সাদা পায়রারা !

আহ কী দারুণ জেল বন্দী রক্তের কষ্ট

আমার ঘাড়ে ফোটায় বোলতার হুল!

তোকে আসতেই হবে ভালোবাসা, আমার খোকা,

কেননা নুনের জল, ফলের দুনিয়া আর

আনার জঠর নরম খোকাদের ই দেয় পাহারা

মেঘ যেমন করে আনে মিষ্টি বৃষ্টি।

দরজার দিকে চায়

মারিয়া...! কোথায় যাচ্ছিস দরজার কাছ দিয়ে এত তাড়াহুড়ো করে?

মারিয়া( কোলে বাচ্চা নিয়ে প্রবেশ করে)- আমি যখন বাচ্চা নিয়ে যাই সব সময়ই তো এমনই দৌড়োই... ব্যাটা সব সময় কাঁদে !

ইয়েরমা- হুম, তোর কথায় যুক্তি আছে ( বাচ্চাটার হাত ধরে বসায় )

মারিয়া- তোমার হিংসে হয় দেখে আমার দুঃখ হয় ( সে বসে পড়ে)

ইয়েরমা- আমার যেটা হয় সেটা হিংসে নয়। সেটা হলো ভিখিরিপনা।

 মারিয়া- তুমি নালিশ কোরো না।

ইয়েরমা- কেন আমি নালিশ করব না? আমি যখন দেখি তোকে বা অন্য সব মেয়েদের একরাশ ফুলের ভেতর থাকে আর এত সব সুন্দর মানুষের মধ্যে নিজেকে অকেজো লাগে।

মারিয়া- কিন্তু তোমার তো অন্যান্য কাজ আছে। আমার কথা বলি শোনো তুমি সুখী হতে পারবে।

ইয়েরমা-ক্ষেতের মেয়েরা যাদের বাচ্চা হয় না তাদের এক ঝুড়ি কাঁটা গাছের সঙ্গে তুলনা করা হয় । এমন কী খারাপ কথাও বলে! ভগবানে ইচ্ছাতেই এই দুর্ভাগ্য সেটা জানা সত্ত্বেও ওরা বলে। ( মারিয়া বাচ্চাটাকে কোলে আসতে ইঙ্গিত করে) নে ওকে কোলে নে। তোর কাছেই ও বেশি ভালো থাকবে। আমার হাত নিশ্চয়ই মায়ের হাত নয়।

মারিয়া- এমন কথা কেন বলছ?

ইয়েরমা( উঠে দাঁড়ায়)- কারণ আমি ব্যথিত। কারণ আমার এ দুটি বস্তু আছে অথচ এদের কাজে লাগাতে পারি না। কারণ আমার কষ্ট হয়, আমার খারাপ লাগে। আমার শেষ বিন্দু পর্যন্ত নিজেকে নিচু মনে হয়, যখন দেখতে থাকি ক্ষেতে গম হতে থাকে, ঝরনা জল দেওয়া বন্ধ করে না, মাদী ভেড়া কুকুর ওরা শ’য়ে শ’য়ে বিয়োয়, মনে হয় পুরো ক্ষেত পুরো দুনিয়া আমাকে দেখাতে থাকে তাদের নরম ঘুমন্ত সৃষ্টি। আর সেই সময় আমার বাচ্চার মুখে দুধের বোঁটা গুঁজে দেবার বদলে দুটো হাতুড়ির বাড়ি খেয়ে চুপ করে থাকি।

মারিয়া- আমার ভালো লাগছে না তুমি এসব কী বলছ।

ইয়েরমা- মেয়েদের যখন ছেলেমেয়ে হয় তখন তোরা আর ভাবিস না আমাদের আর কি কি নেই। তোরা ঠান্ডা বোকা হয়ে থাকিস ঠিক যেমন যার তেষ্টাই নেই সে বোঝেই না জলের স্বাদ কেমন মিষ্টি।

মারিয়া- সবসময় তোমায় যা বলি সেটা বলতে ইচ্ছে করছে না।

ইয়েরমা- প্রতিবার আমার আরও ইচ্ছে হয় আর আরো নিরাশা বাড়ে।

মারিয়া- ধুর, বাজে ভাবনা।

ইয়েরমা- আমি বিশ্বাস করা বন্ধ করে দেব যে আমিই আমার সন্তান। বহু রাত আমার খাবারটা আমি গোয়ালের গরুদের দিয়ে দিই। আগে এসব করতাম না। কেননা কোন মেয়েই তা করে না। রাতে গোয়ালের পাশ দিয়ে যখন যাই আমার কানে আসে পুরুষের পায়ের আওয়াজ।

মারিয়া- প্রতিটা মানুষের নিজের কথা বলার কারণ আছে।

ইয়েরমা- সবকিছুর পরেও তুই আমায় ভালবেসেই যাস। দ্যাখ আমি কি নিয়ে বেঁচে থাকি !

মারিয়া- আর তোমার ভাইয়ের বউরা?

ইয়েরমা- আমি যদিই বা কখনো তাদের সঙ্গে কথা বলতে যাই আমার দিকে এমন ভাবে তাকায় যেন মুখের ঢাকনা খোলা কোন মড়া আমি।

মারিয়া- আর তোমার বর?

ইয়েরমা- ওরা তিনজনেই আমার বিরুদ্ধে।

 মারিয়া- ওরা কি ভাবে?

ইয়েরমা- কল্পনা করে। যাদের মন স্থির নেই তারা যেমন ভাবে। ওরা ভাবে আমার অন্য কোন পুরুষ ভালো লাগে। ওরা কিন্তু জানে না যে সে কে! তবে আমার ভালো লাগে। আমার জাতের প্রথম কথাই হলো সম্মান। সেগুলো আমার কাছে পাথর। তবে ওরা জানে যে আমি যদি চাই তাহলে ঝরনার জল হতে পারি যা ওদের বয়ে নিয়ে আসবে।

এক বোন মঞ্চে প্রবেশ করে। একটা রুটি নিয়ে বের হয়ে যায়    

মারিয়া- সব দিক থেকেই আমার মনে হয় তোমার বর তোমায় ভালোবেসেই যাবে।

ইয়েরমা- আমার বর আমায় রুটি আর ঘর দেয়।

মারিয়া- কি কাজ পার হচ্ছো তুমি! কি সব কাজ ! তবে মনে রেখো প্রভু যীশুও কতই না সহ্য করেছেন!

ইয়েরমা (বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে)-সোনামণি জেগে গেছে।

মারিয়া- একটু পরেই ও গান গাইতে শুরু করবে।

ইয়েরমা- ওর চোখ দুটো তোর মত। জানিস? দেখেছিস? (কাঁদতে কাঁদতে) ওর চোখদুটো অবিকল তোর মত!

ইয়েরমা মারিয়াকে আলতো করে ঠেলে দেয় আর মারিয়া চুপচাপ বের হয়ে যায়। যে দরজা দিয়ে ইয়েরমার স্বামী ঢোকে সেই দিকে চায় সে।

দ্বিতীয় বালিকা- শ শ  শ !

ইয়েরমা- কে?

দ্বিতীয় বালিকা- আশা করি সে চলে গেছে। আমার মা তোমায় পাহারা দিচ্ছিল।

ইয়েরমা- তুমি একা?

দ্বিতীয় বালিকা- সঙ্গে পাশের বাড়ির দুজন আছে।

ইয়েরমা- ওদের অপেক্ষা করতে বলো।

দ্বিতীয় বালিকা- কিন্তু তুমি কি চলে যাবে? তোমার ভয় ডর নেই?

ইয়েরমা- যাচ্ছি

দ্বিতীয় বালিকা- এই তো !

ইয়েরমা- যতই দেরী হোক ওদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।

ভিক্তরের প্রবেশ     

ভিক্তর- খুয়ান আছে?

ইয়েরমা- হ্যাঁ

দ্বিতীয় বালিকা( যোগ করল)- আমি তালে ব্লাউজটা নিয়ে আসি।

ইয়েরমা- যা খুশি। ( বালিকা বেরিয়ে যায়) বসো।

ভিক্তর- এভাবেই ঠিক আছি

ইয়েরমা  ( স্বামীকে ডাকে ) – খুয়ান !

ভিক্তর- যাবার আগে বিদায় জানাতে এলাম।

ইয়েরমা- ( একটু কেঁপে উঠল। তবে দ্রুত স্বাভাবিকতায় ফিরে এল। ) তুমি তোমার বোনদের সঙ্গে যাচ্ছ? 

ভিক্তর- বাবার তাই ইচ্ছে।

ইয়েরমা- এদ্দিনে তাঁরও বয়স হয়েছে নিশ্চয়ই।

ভিক্তর- হ্যাঁ বেশ বুড়ো হয়ে গিয়েছে বাবা (থামে)

ইয়েরমা- ক্ষেতগুলোকে তুমি ভালোই বদলে দিয়েছ।

ভিক্তর- সব ক্ষেতই এক।

ইয়েরমা- না আমি হলে বহদূরে চলে যেতাম।

ভিক্তর- সবই তো এক। একই ভেড়ার পাল আর তাদের একই রকম উল।

ইয়েরমা- পুরুষদের জন্য। তবে মেয়েদের জন্য বিষয়টা অন্যরকম। আমি কখনও কোন পুরুষকে খেতে খেতে বলতে শুনি নি – এই আপেলগুলো কী ভালো খেতে! তোমরা সূক্ষ্ম ভাবে কোন রকম মেরামতি না করেই চলতে থাকো। আমার দিক থেকে আমি জানি এই সব কুয়োর জল আমি ঘেন্না করি।

ভিক্তর- হতে পারে।

মঞ্চ ধীরে ধীরে আবছা হয়। থামে। 

ইয়েরমা- ভিক্তর

ভিক্তর- বলো

ইয়েরমা- তুমি যাচ্ছ কেন? তোমাকে এখানে সবাই ভালোবাসে।

ভিক্তর- এদের সঙ্গে আমি ভালো ব্যবহারই করেছি ( থামে

ইয়েরমা- তুমি ভাল ব্যবহার করেছিলে। একবার তুমি দু হাত দিয়ে আমায় ধরেছিলে। আমার নিজেকে বড় মনে হচ্ছিল। মনে পড়ে না তোমার? কেউ তো জানে না তার জীবনে কি ঘটবে।

ভিক্তর- সব বদলে যায়।

ইয়েরমা- কিছু জিনিষ বদলায় না। চার দেওয়ালের মধ্যে কিছু জিনিষ বন্দী হয়ে থাকে যারা বদলাতে পারে না। কেননা তাদের কথা কেউই শোনে না।

ভিক্তর- ঠিক তাই

দ্বিতীয় বোনের প্রবেশ। সে ধীরে ধীরে দরজার দিকে হাঁটতে থাকে। সেখানে বিকেলের শেষ আলো এসে রাঙিয়েছে। সেখানে সে থমকে দাঁড়ায়।

ইয়েরমা- যদি না তারা শিগগিরি বেরিয়ে যায় আর চিৎকার করে। দুনিয়াটাকে চিৎকারে ভরে তোলে

ভিক্তর- কেউ এগোতে পারবে না। চাষের খাল, ভেড়ার ভেতরকার ভেড়া, আকাশের চাঁদ, লাঙল হাতে মানুষ... কেউ না।

ইয়েরমা- বুড়ো মানুষ দের শিক্ষা বুঝতে না পারা কী ভীষণ ভুল!

চাষিদের আস্তানা থেকে একটা লম্বা কষ্টের আওয়াজ শোনা যায়।

ভিক্তর- ভেড়ার পাল

খুয়ান (প্রবেশ করে ) – কি, যাবার জন্য তৈরী?

ভিক্তর- ভোর হবার আগেই বন্দরে পৌঁছে যেতে চাই

খুয়ান- আমার জন্য কোন নালিশ এনেছো না কি?

ভিক্তর- নাঃ তুমি তো বরাবরই আমার টাকাপয়সা সব মিটিয়ে দিয়েছ।

খুয়ান (ইয়েরমার প্রতি)- ওকে ভেড়ার পাল কিনে দেব।

ইয়েরমা- হ্যাঁ

ভিক্তর (ইয়েরমার প্রতি)- তোমার গুলো

ইয়েরমা- কিন্তু আমি তো জানতাম না একথা?

খুয়ান ( সন্তুষ্ট গলায়) – হ্যাঁ এমনিই

ভিক্তর- তোমার বরকে তার বিশাল ক্ষেত খামার দেখতেই হবে।

ইয়েরমা- যে শ্রমিক যেভাবে তার কাজের ফল দেখতে চায় সেভাবেই সে পায়।

যে বোন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল সে এগিয়ে আসে।

খুয়ান- আমাদের এত ভেড়া রাখার আর জায়গা নেই।

ইয়েরমা (দুঃখের সাথে)- পৃথিবীটা বিরাট বড় (থামে)

খুয়ান- আমরা একসাথে নদীর ধারে যাব।ভিক্তর- এবাড়ির সব সুখ কামনা করি ( ইয়েরমার দিকে হাত বাড়ায়) 

ইয়েরমা-  ভগবান তোমার কথা শুনবেন! ভালো থেকো !

ভিক্তর বিদায় নিয়ে এগোল, ইয়েরমা এগিয়ে যেতে ভিক্তর ঘুরে দাঁড়াল ।

ভিক্তর- কিছু বললে?

ইয়েরমা ( নাটুকে ভাবে) - বলল বিদায়।

ভিক্তর- ধন্যবাদ

সবাই বেরিয়ে যায়। ইয়েরমা ভিক্তরের দিকে যে হাত বাড়িয়েছিল তার দিকে নিদারুণ যন্ত্রণার সঙ্গে তাকিয়ে রইল। দ্রুত বাঁদিকে  এগিয়ে গিয়ে একটা চাদর টেনে নিল।

দ্বিতীয় বালিকা ( নিঃশব্দে মাথা ঢেকে নেয়)- চলো যাওয়া যাক।

ইয়েরমা- চলো

সবাই চুপচাপ বেরিয়ে যায়। মঞ্চ প্রায় অন্ধকার হয়ে আসে। বোন হাতে লম্ফ নিয়ে মঞ্চে ঢোকে যদিও সেই আলোয় মঞ্চের অন্ধকার কাটে না। স্বাভাবিক টিমিটিমে আলো। সে মঞ্চের এধার থেকে ওধার গিয়ে ইয়েরমাকে খোঁজে। ভেড়ার পালের গলায় বাধা ঘন্টির আওয়াজ শোনা যায়।

প্রথম বৌদি ( নিচু গলায়)- ইয়েরমা!

দ্বিতীয় বোন বেরিরে আসে। দুজনে পরস্পরের দিকে চায়। তারপর দরজার দিকে তাকায়।

দ্বিতীয় বৌদি( একটু উঁচু গলায়)- ইয়েরমা! ( বেরিয়ে যায়)

প্রথম বৌদি( দরজার দিকে মুখ করে একটা কর্কশ গলায় ডাকে)- ইয়েরমা !

বেরিয়ে যায়। ধূসর প্যাঁচার ডাক আর মেষ পালকদের শিঙা ফোঁকার আওয়াজ ভেসে আসে। মঞ্চ একবারে অন্ধকার হয়ে আসে।

যবনিকা পড়ে

 


পঞ্চম পর্ব

তৃতীয় অংক

প্রথম দৃশ্য

দোলোরেসের বাড়ি, দোলোরেস একজন জাদুবুড়ী, জাদু দেখায়। ভোর হচ্ছে। ইয়েরমা, দোলোরেস আর দুজন বৃদ্ধা প্রবেশ করে।

দোলোরেস- তোর বড্ড সাহস আছে।

প্রথম বুড়ি দুনিয়ায় চাওয়ার থেকে বড় কোন শক্তি নেই।

দ্বিতীয় বুড়ি- কিন্তু কবরখানাটা বড্ড বেশিরকমের অন্ধকার ছিল।

দোলোরেস- বহুবার আমি কবরখানায় বসে মন্তর টন্তর পড়েছি। ,মেয়েরা যারা বাচ্চার জন্য উতলা তারা সবাই ভয় আয়। সবাই। শুধু তুই ছাড়া

ইয়েরমা- আমি ফল পেতে চাই। সেজন্যই এখানে এসেছি। মনে হয় তুমি ঠকাবে না।

দোলোরেস- হুম, আমি ঠগী নই। আমি যদি কখনো মিছে কথা কই আমার মুখ পিঁপড়েয় ভরে যাবে। এ মুখ তো মরা মানুষের মুখ। শেষবার আমি এক ভিখিরি মেয়ের জন্য এই মন্তর পড়েছিলাম। সে তোর চাইতেও বেশি শুকনো ছিল। তারপর ওর পেট্টা এমন মিষ্টি করে ভরে উঠেছিল যে ওটার ভেতর দুদুটো বাচ্চা ছিল। ওগুলো নদীতেই হয়। কেননা বাড়িতে পৌঁছোবার সময় পায় নি পর্যন্ত। আর ও নিজেই ওদের কাঁথায় মুড়ে আমার কাছে নিয়ে এসেছিল যাতে ঠিকঠাক করে গুছিয়ে দিই।

ইয়েরমা- মেয়েটা নদী থেকে হেঁটে আসতে পেরেছিল?

দোলোরেস- এসেছিল। চটি শায়া রক্তে মাখামাখি কিন্তু মুখ জ্বলজ্বল করছে।

ইয়েরমা-  আর কিছু হয় নি ওর?

দোলোরেস- ওর আবার কি হবে? ভগবান হল ভগবান।

ইয়েরমা- স্বাভাবিক। তার তো কিছু হতেই পারে না। শুধু বাচ্চাদের টেনে বের করা আর টগবগে জলে ধোঁয়া। পশুরা ওদের চেটে দেয় তাই না? আমার বাচ্চার বেলায় আমি এতেও ভয় পাই না। আমার একটা মত আছে। যাদের সদ্য বাচ্চা হয় তারা ভেতর থেকে ঝলমলে হয়ে যায়। আর বাচ্চারা তাদের ওপরে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুমায়। কানের মধ্যে ভেসে আসে উষ্ণ দুধের স্রোতের আওয়াজ, বুকদুটো ভরিয়ে তুলতে থাকে যাতে তারা ওদুটো টানে, যাতে ওরা খেলা করে এমনকী তাদের চেয়ে বেশি কিছুকেই ওরা আর না চায়, এমনকী মাথাও রাখে তাদের ওপরেই “...অন্য আর একটু বেশি, বাছা...” আর সেটা ওদের মুখ আর বুক সাদা দুধের ফোঁটায় ভরিয়ে তোলে।

দোলোরেস- এবার তোর ব্যাটা হবে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি।

ইয়েরমা- আমার হবে কেননা আমি চাই যে আমার থাকতেই হবে। কিংবা আমি পৃথিবী টাকে বুঝিই না। মাঝে মাঝে যখন নিশ্চিত হই যে কখনো না কক্ষনোই তা হবে না... আমার পা বেয়ে নিশ্চিত একটা আগুনের ঢেউ চড়ে বসে আর চারপাশের সব কিছুকেই শূন্য করে দেয়। পুরুষেরা যারা রাস্তা দিয়ে হাটে আর ষাঁড়রা পাথরেরা ...এই সব কিছুকেই আমার তুলোর মত মনে হয়। আর নিজেকে নিজেই জিজ্ঞেস করিঃ কিসের জন্য ওরা সেখানে থাকবে তাহলে?

প্রথম বৃদ্ধা- এইটা ভাল যে একজন বিয়েওয়ালা মেয়ে বাচ্চা চায়। কিন্তু যদি সেটা তার না থাকে? কিসের জন্য অস্থিরতা তাদের? এই জগতে সবচেয়ে জরুরী হলো বছরগুলো ধরে টিকে যাওয়া সেগুলোকে জিইয়ে রাখা। তোমার খুঁত ধরছি না বাছা। তুমি তো দেখেছ কিভাবে আমি মন্তর বলাতে হাত লাগাই, কিন্তু সন্ত ভেগার দোহাই তুমি কিসের জন্য তা ছেলেকে দেবার অপেক্ষা করো? নিশ্চয়ই সুখের জন্য নয় বা রুপোর চাকতির জন্যও নয়?

ইয়েরয়া- আমি কালকের কথা ভাবি না। আজকের কথাই ভাবি শুধু। তুমি বুড়ি হয়েছ। সব কিছু তুমি পড়া বইয়ের চোখে দেখ। আমি ভাবি আমার তেষ্টা পেয়েছে আর আমার স্বাধীনতা নেই। আমি চাই আমার দুহাতের মধ্যে আমার সন্তান থাকুক যাতে শান্ত হয় ঘুমোতে পারে সে। আর শোনো ভাল করে শোনো, যা বলব আমি তা শুনে চমকে যেও না, যদিও আমি জানতাম যে আমার ছেলে আমাকেও পরে শহীদ বানিয়ে তুলবে, আমাকে ঘেন্না করবে। আমার চুল মুঠোয় ধরে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাবে, আমি ওর জন্ম আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করব, কারণ, এই আমার বুকের ওপর বছরের পর বছর ধরে বসে থাকা এই কাল্পনিক কিছুর জন্য কান্নার চেয়ে, যে আমাদের ছুরি বেঁধায় সেই জীবন্ত পুরুষের জন্য কান্না অনেক ভাল।

প্রথম বুড়ি- তুমি উপদেশ শোনার পক্ষে বড্ড বেশি কম বয়স। তবে ভগবানের দয়া পাবার জন্য অপেক্ষা করার ফাঁকে, তোমার বরের ভালবাসার আশ্রয় তোমাকে নেওয়া দরকার।

ইয়েরমা- আইই! তুমি আমার মাংসের অনেক ভেতরকার ঘায়ে হাত দিয়ে ফেলেছ।

দোলোরেস- তোর বর ভালো লোক।

ইয়েরমা (উঠে দাঁড়ায়)- সে ভালো লোক। ভালো লোক। তো? ইস যদি সে খারাপ হত। কিন্তু না। ওর ভেড়াগুলোকে নিয়ে ও পথে পঠে হাটে আর রাত্রে টাকা গোণে। ও যখন আমায় ঢেকে দেয়, তাঁর সব কর্তব্য সমাধা করে এইভাবে। কিন্তু আমি দেখি ওর ঠান্ডা কোমর মরা মানুষের কোমরের মতই ঠান্ডা। আর আমি, যে কিনা বরাবর উত্তপ্ত মেয়েদের থেকে আতঙ্কে থাকি আমি চাই সেই সব মুহূর্ত গুলোতে আমি যেন আগুনের পাহাড়ের মত হয়ে উঠি।

দোলোরেস- ইয়েরমা !

ইয়েরমা- আমি বদ স্বভাবের বৌ নই। তবে জানি বাচ্চাকাচ্চা পুরুষমানুষ আর মেয়েমানুষের থেকেই হয়। আইই ! আমার যদি একা একাই সম্ভব হত ছেলে পুলে পাওয়া!

দোলোরেস- তুই ভাব একটু, তোর বরও তো কষ্ট পায়।

ইয়েরমা- না পায় না। ঘটনা হল ওর আসলে বাচ্চাকাচ্চা হওয়া নিয়ে কোন মাথাব্যথাই নেই।

প্রথম বুড়ি- ওকথা বলো না!

ইয়েরমা- ওর চোখের তাকানো দেখেই আমি চিনি। যেহেতু ওর মনের মধ্যে এ ব্যাপারে কোন মাথাব্যথা নেই তাই আমাকেউ তা দেয় না। আমার ভালো লাগেন, আমার তো আর ভালো লাগে না এসব। যাই হোক এটাই আমার বাঁচার একমাত্র পথ। সম্মানের জন্য বংশরক্ষার জন্য আমার একমাত্র বাঁচবার পথ।

প্রথম বুড়ি (ভয় পেয়ে)- শিগগিরি ভোরের আলো ফুটে যাবে। তোমার বাড়ি যেতে হবে তো।

দোলোরেস- কোনো কিছুর আগে পশুগুলো বেরিয়ে পড়বে। ওরা তোকে একা দেখলে ঠিক হবে না।

ইয়েরমা- আমার এই রেহাই চাই না। কতবার এই মন্ত্রগুলো জপ করতে হবে?

দোলোরেস- লাউরেল-এর মন্তরটা দুবার, আর সন্ত আনার মন্তরটা ঠিক দুপুরবেলা। যখন পোয়াতি হবি আমার জন্য এক বুশেল গম আনবি। আমায় কথা দিয়েছিস কিন্তু।

প্রথম বুড়ি- পাহাড়ের মাথায় সুজ্যি এর মধ্যেই উঁকি দিতে শুরু করেছে বাছা। যাও যাও।

দোলোরেস- এর পরেই ওরা বড় দরজাটা খুলে দেবে। তুই ক্ষেতের আশেপাশে ওগুলোকে চরাতে নিয়ে যাবি।

ইয়েরমা ( অস্থির হয়ে)- আমি জানি না কেন এলাম !

দোলোরেস- দুঃখ করছিস?

ইয়েরমা- না !

দোলোরেস ( অস্থির গলায়)- তোর যদি ভয় লাগে, তোকে মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দেব।

ইয়েরমা- শান্ত হও !

প্রথম বুড়ি ( চঞ্চল হয়ে)- দরজার কাছে যখন পৌঁছাবে আলো পুরোপুরি ফুটে যাবে ( গলার আওয়াজ শোনা গেল )

দোলোরেস- চুপ ! ( ওরা শুনতে লাগল)

প্রথম বুড়ি- না কেউ না। ভগবানের নাম করে বেরিয়ে পড়।

ইয়েরমা দরজার দিকে এগোল। এই সময়েই তার নাম ধরে বাইরে কারা ডাকছিল। তিন মহিলা দাঁড়িয়ে পড়ল।

দোলোরেস- কে?

খুয়ান- আমি

ইয়েরমা- খোলো ( দোলোরেস ইতস্ততঃ করছিল) খুলব না কি খুলব না?

গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল বাইরে থেকে। দুই ভাইয়ের বৌকে নিয়ে খুয়ান ঘরে ঢুকল।

দ্বিতীয় ভাইয়ের বৌ- এই তো এখানে।

ইয়েরমা- আমি এখানে।

খুয়ান- এখানে কি করছ তুমি? আমি যদি চেঁচাই পুরো গ্রাম উঠে আসবে এখানে এইটা দেখবার জন্য যে আমার বাড়ির সম্মান এখন কোথায় গেছে। তবে আমি সব আলোচনা ফিসফিসানি ডুবিয়ে দিয়ে এসেছি, সব শান্ত করে এসেছি। কারণ তুমি আমার ঘরের বৌ।

ইয়েরমা- তুমি যদি চেঁচাতে আমিও তোমার সঙ্গে সঙ্গে চেঁচাতাম যতক্ষণ না কি পরিচ্ছন্নতা আমায় ঢেকে রাখছে তা দেখবার জন্য মরা মানুষেরা কবর থেকে উঠে আসে।

খুয়ান- ও রকম নয়! সবকিছু যা যা আমি পাহারা দিয়ে রাখি তা এত কিছু নয়। তুমি আমায় ঠকিয়েছ। আমার কাছে ঢেকে রেখেছ। আমি যেহেতু পুরুষমানুষ, ক্ষেত খামারের কাজ করি, তোমার চালাকি সম্বন্ধে আমার কোন ধারণাই নেই।  

দোলোরেস- খুয়ান !

খুয়ান- তোমরা ! একটাও শব্দ নয় !

দোলোরেস (জোর গলায়)- তোর বৌ কোন বাজে কাজ করে নি।

খুয়ান- বিয়ের দিন থেকেই এসব করে যাচ্ছে ও। আমার দিকে তাকায় যেন দুটো চোখ দুটো সূচ। আমার পাশে শুয়ে ও চোখ বুজে সারাটা রাত জেগে কাটিয়ে দেয়। আর আমার বালিশ গুলোকে খারাপ কথার ফিসফিসানি দিয়ে ভরিয়ে দেয়।

ইয়েরমা- চুপ করো তুমি !

খুয়ান- আমি আর পারছি না। কেননা তোমার পাশে একজন মহিলা দরকার। তাকে পেতে হলে তোমাকে ব্রোঞ্জের মূর্তি হতে হবে, সেই মহিলা যে চায় তোমার আঙুলগুলো কে তোমার বুকের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে, যে মহিলা রাতের  বেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। কিসের খোঁজে? বলো ! কিসের খোঁজে বেরোও তুমি? রাস্তা গুলো পুরুষে ভর্তি। রাস্তা একটা ফুলও নেই কেটে ফেলবার মত।

ইয়েরমা- তোমাকে আর একটা কথাও বলতে দেব না। একটাও না। তুমি নিজের কথাই বলছ আর তোমার লোকজনদের কথা যে তোমরাই একমাত্র যারা সম্মান রক্ষা করে চলে। তুমি জানো না যে আমার জাতটাও লুকিয়ে রাখবার মত কোন জাত নয়। এসো। আমার কাছে এসো। আমার জামা কাপড় শুঁকে দেখো সেখানে তোমার ছাড়া আর কার গন্ধ আছে, সেখানে তোমার ছাড়া আর কার শরীর আছে। তুমি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আমায় উলঙ্গ করে দিলে, আমার গায়ে থুতু দিলে। আমার সাথে যা ইচ্ছে হয় করো, কেননা আমি তোমার বৌ। কিন্তু আমার বুকের ওপর পুরুষ মানুষের নাম রাখা থেকে আটকাও।

খুয়ান- আমি তেমন মানুষ নই যে এটা রাখব।সেটা তুমি রাখো তোমার আচার আচরণ দিয়ে।  গোটা গ্রাম একথা বলতে শুরু করেছে। ওরা খোলাখুলি বলছে। যখন সবাই গোল হয়ে বসে আড্ডা দেয় আমি গেলে ওরা থেমে যায়। ভেঙে পড়া সত্ত্বেও আমি যখন যাই সবাই থেমে যায়। এমনকী রাতে ক্ষেতে গেলেও যখন জেগে উঠি আমার মনে হয় গাছগুলোর শাখারাও থেমে গেছে।

ইয়েরমা- আমি জানি না কি করে বদ হাওয়া বইতে শুরু করল যে তোমার গম ক্ষেত ওলোট পালট হয়ে গেল। আর তুমি ! ভাল করে দেখে নাও গম ভালো আছে কি না।

খুয়ান- আমিও জানি না একজন মেয়েমানুষ দিনরাত তার বাড়ির ছাদের বাইরে কি খোঁজে!

ইয়েরমা( হঠাত করে উঠে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে)- আমি তো তোমাকে খুঁজি। তোমাকে! সে তো তুমিই যাকে দিনরাত আমি খুঁজে চলি। তুমিই তো সেই যেখানে আমি শ্বাস নিতে চাই আর ছায়াটুকুনিও  পাই না। তোমার রক্ত তোমার আশ্রয়ই তো আমি চাই।

খুয়ান- সরে যাও।

ইয়েরমা- আমাকে দূরে ঠেলো না। এই শরীর মন তো চায় ওখানেই থাকবে।

খুয়ান- সরো!

ইয়েরমা- দেখো আমি একা আছি। চাঁদ যেমন আকাশে নিজেকেই খুঁজে ফেরে। তাকাও আমার দিকে ( সে তাকায়)।

খুয়ান ( তার দিকে চায় এবং হঠাত ঠেলে সরায়) – একবার অন্ততঃ আমায় ছাড়ো !

দোলোরেস- খুয়ান ! ( ইয়েরমা মেঝেতে পড়ে যায়)।

ইয়েরমা ( চেঁচিয়ে)- আমার কারনেশন ফুলের ওপর দিয়ে যখন  তুমি হেঁটে যাও আমার ধাক্কা লাগে দেওয়ালের গায়ে। আইই! আইই! এ সেই দেওয়াল যেখানে আমার মাথা ঠুকে দেখতে হবে তারাদের।

খুয়ান- শান্ত হও। চলো যাই।

দোলোরেস- ভগবান !

ইয়েরমা( চিৎকার করে)- আমার বাবা জাহান্নামে যাক। একশ ছেলেমেয়েরা বাপ আমার শরীরে তার রক্ত দিয়েছে। আমার যে রক্ত মাথা খোঁড়ার জন্য দেওয়ালই খুঁজে ফেরে সে রক্ত জাহান্নামে যাক ।

খুয়ান- তোমাকে থামতে বলেছি।

দোলোরেস- লোকজন জমে গেছে। গলা নামিয়ে কথা বল তোরা।

ইয়েরমা- আমার কিছু যায় আসে না। উঠুক আমার গলা। আমি যখন কুয়োর সবজায়গাতেই ঢুকছি উঠুক আমার আওয়াজ। ( উঠে দাঁড়ায়) আমার শরীর থেকে যাতে এ সব সুন্দর জিনিষ বেরিয়ে যাক বাতাস ভরিয়ে তুলুক ওরা।

দোলোরেস- ওরা এখান দিয়েই যাচ্ছে।

খুয়ান- চুপ করো সবাই।

ইয়েরমা- ওইটাই ! ওইটাই! চুপ করো। ফেলে রাখো।

খুয়ান- চলো চলো। তাড়াতাড়ি।

ইয়েরমা- ওইটাই! ওইটাই! আমার হাত ঠেকাতে হলে এটা অকেজো। মাথা দিয়ে ভালোবাসাই হল আসল কাজ।

খুয়ান- শান্ত হও

ইয়েরমা (গলা নামিয়ে)- মাথা দিয়ে ভালো বাসা এক জিনিষ আর শরীরের ভালোবাসা অন্য। ওটা আমাদের সাড়া দেয় না। এটা লেখা আছে। আর সমুদ্রের সঙ্গে আলাদা হওয়া জাত দিয়ে আমরা লড়াই বাঁধাবো না। ওইটাই ! ওইটাই! আমার মুখ বন্ধ হওয়াই ভালো ! ( বেরিয়ে যায়)

পর্দা পড়ে।



(শেষ পর্ব)

তৃতীয় অংক

দ্বিতীয় দৃশ্য

 

পাহাড়ের সমতলে একটা সন্ন্যাসীদের আশ্রম। প্রথম বাঁকে কয়েকটা কম্বল আর কটা গাড়ির চাকা দিয়ে একটা দোকান বানানো হয়েছে, ইয়েরমা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। আশ্রমে যাবার জন্য মহিলারা হাতে ডালি নিয়ে মঞ্চে ঢোকে। তাদের সবার খালি পা। মঞ্চে প্রথম দৃশ্যের বুড়ি উপস্থিত।

পর্দা উঠতে উঠতে গান শোনা যাচ্ছে।

আমি তোমায় দেখতে পাই নি

যখন তুমি ছিলে কুমারী ;

বিয়ের বাইরেও তোমার সাথে দেখা করা

তোমার কোন দোষ দেখি নি

যখন তুমি ছিলে কুমারী

তোমাকে নগ্ন করে দেব,

বিবাহিতা আর তীর্থ যাত্রী রোজমেরি ফুল,

যখন ঘন্টা পড়ে বারোটায় অন্ধকারে।

বুড়ি ( ব্যঙ্গের স্বরে)- তুই চন্নামৃত পেয়েছিস?

প্রথম মহিলা- হ্যাঁ

বুড়ি- এখন, দেখা যাক কি হয়।

দ্বিতীয় মহিলা- আমরা ওকে বিশ্বাস করি।

বুড়ি- সন্তের কাছে তুই ছেলেপিলে চাইতে আসিস আর এখানে প্রতি বছরই একারণেই বহু মানুষ আসে। কি হয় এতে? (হাসি)

প্রথম মহিলা- এতে যদি বিশ্বাসই না করো তুমি এখানে আসো কেন?

বুড়ি- দেখতে, দেখবার জন্য আমি পাগল। আর আমার ছেলের দেখভাল করার জন্যও আসি। গত বছর দুজনে দুজনকে মেরেছে একটা শুকনো বিয়ের জন্য। আমি পাহারা দিতে চাই। ওই শেষ কথাটার জবাব হলো আমার ইচ্ছে করে তাই আসি।

প্রথম মহিলা- সন্ত তোমায় ক্ষমা করুন।( ওরা ভেতরে ঢোকে।)

বুড়ি ( ব্যঙ্গের সুরে)- তিনি যেন তোকে মাপ করেন। ( বুড়ি চলে যায় , প্রথম বালিকাকে সঙ্গে করে মারিয়া ঢোকে। )

প্রথম বালিকা- উনি এসেছেন?

মারিয়া- ওদের গাড়ি আছে। ওরা এখানে যাতে আসে সে জন্য আমাকে অনেক কষ্ট করতে হল। মেয়েটা এক মাস চেয়ার থেকে ওঠে নি। আমার ওকে ভয় করছে। ওর একটা ধারণা আছে। আমি জানি না সেটা কি। কিন্তু তারপর থেকে ওটাকে কোন বাজে ধারণাই ভাবি।

প্রথম বালিকা- আমি এসেছিলাম আমার দিদির সাথে। ও সাত আট বছর ধরে এখানে আসছে, কোন ফল নেই।

মারিয়া- ওর বাচ্চা আছে কটা, ও তাই চেয়েছিল।

প্রথম বালিকা- এটাই তো আমি বলছি। ( ওরা গলা শুনতে পায়)

মারিয়া- আমি এই আশ্রমটাকে কখনো পছন্দ করি নি তেমন। চলো মাঠে যাই, সেখানেই লোকজন আছে।

প্রথম বালিকা- গত বছর, যখন আঠারো হয়ে গিয়েছিল কজন ছোকরা আমার দিদির বুকে হাত দিয়েছিল।

মারিয়া- চারপাশের চার লীগ দূরত্বের মধ্যে ভয়ংকর শব্দ ছাড়া কেউ কিছু শোনে নি।

প্রথম বালিকা- আশ্রমে পেছন দিকে আমি দেখেছি চল্লিশ টন ওয়াইনের বোতল পড়ে আছে।

মারিয়া- আর সমুদ্রের মত লোক, কেবল সে-ই একলা পাহাড়টা দিয়ে নামছে।

গলা শোনা যাচ্ছে। ছয় জন মহিলাকে নিয়ে ইয়েরমা মঞ্চে ঢোকে এবং গির্জার দিকে যায়। সবাই খালি পা আর হাতে ছোট মাপের জ্বলন্ত মোম্বাতি। সন্ধ্যা নেমে আসছে।

ইয়েরমা-            প্রভু যিনি ফোটান গোলাপ কুঁড়িটি,

                      তাকে ছায়ায় ফেলে রেখো না এখনই

দ্বিতীয় মহিলা-      তার ক্ষয় হওয়া মাংসের ওপর

                       খেলা করে হলুদ গোলাপ ফুল।

সমবেত-             প্রভু যিনি ফোটান গোলাপ কুঁড়িটি,

                      তাকে ছায়ায় ফেলে রেখো না এখনই ( হাঁটু মুড়ে বসে সকলে)

ইয়েরমা-            স্বর্গের যত উদ্যান আছে

                      খুশীর গোলাপ ভরাঃ

                      গোলাপ ক্ষেত আর ক্ষেতময় গোলাপের মাঝে,

                      অপরূপ সে গোলাপ।

                      মনে হয় ঊষার কিরণ

                      আর দেবদূত পাহারা দেয় তাকে

                      ঝড়ের মত ডানা,

                      চোখেরা যন্ত্রণা যত।

                      তাদের পাতার চারপাশে

                      উষ্ণ দুধের স্রোত যত

                      ওরা খেলা করে আর ভেজায়

                      শান্ত যত তারাদের মুখ।

                      প্রভু, আমার ক্ষয় হওয়া মাংসের ওপর

                      খোল তোমার গোলাপ ক্ষেত।

দ্বিতীয় মহিলা-      প্রভু, তোমার হাত শান্ত করে দেয়

                       তার কপালের জ্বলন্ত অঙ্গার যত।

ইয়েরমা-             শোন তোমার পূত আশ্রমের

                       অনুতপ্ত সেই মেয়ের কথা

                      তোমার গোলাপ খুলে দাও আমার মাংসে

                      যদিও তার হাজার কাঁটা আছে।

সমবেত-             প্রভু যিনি ফোটান গোলাপ কুঁড়িটি,

                      তাকে ছায়ায় ফেলে রেখো না এখনই

ইয়েরমা-            আমার ক্ষয় হওয়া মাংসের ওপর

                      খেলা করে অপরূপ সে গোলাপ।

ওরা মঞ্চে প্রবেশ করে। বাঁদিক দিয়ে দৌড়ে বের হয়ে যায় বালিকারা। হাতে তাদের লম্বা ফিতে। ডান দিকে বাকী তিনজন লম্বা ফিতে নিয়ে পেছনে তাকাতে তাকাতে ঢোকে। গানের সুর যেমন চড়ায় ওঠে, তেমনি মঞ্চে  ক্ষেতের পশুদের পায়ের আওয়াজ আর গলার ঘন্টির শব্দ ক্রমশ জোরালো হতে থাকে। উঁচু সমতলে সাতটি বালিকাকে দেখা যায়, যারা ফিতেগুলো বাঁদিকে বারিয়ে ধরে। আওয়াজ বাড়তে থাকে। দুজন জনপ্রিয় মুখোশ পরা মানুষ মঞ্চে ঢোকে। একজন পুরুষের মুখোশ পরা আর অন্যজন নারীর। হাতে বিশা আকারের মুখোশ ধরা। পুরুষ মুখোশধারী হাতে ধরা ষাঁড়ের শিং নাড়াচ্ছে। তবে তারা কোন ভাবেই বিকট নয়। বরং একটা বিশাল সুন্দর জিনিষ, ঠিক যেন শুদ্ধ পৃথিবী থেকে উঠে আসা। নারী মুখোশধারী ক্রমাগত ঘন্টি বাজিয়েই যাচ্ছে।

বাচ্চাদের দল-  শয়তান আর তার বৌ! শয়তান আর তার বৌ!

( ভেতরে লোকজন চিৎকার করছে আর নাচের কথা বলছে। রাত ঘন হয়ে এসেছে। )

                   পাহাড়ের নদীটির গায়ে

                   স্নান করত দুঃখী বৌ

                   তার শরীর বেয়ে ওরা উঠত

                   জলের চারকোলেরা।

                   তীরের বালুরাশি

                  আর সকালের টাটকা হাওয়া

                 তার হাসিতে আগুন ভরে দিত

                 আর পিঠময় শুধু শিহরণ।

                 আইই কী ভীষণ নগ্ন ছিল

                 জলের ভেতরে থাকা কুমারী মেয়েটি!

বাচ্চাদের দল- আইই কী করে নালিশ করতে ও!

প্রথম পুরুষ- আইই ভালবেসে আবছা হয়ে যাওয়া।

ছোট ছেলে-  ঝড় আর জলের সাথে সাথে!

দ্বিতীয় পুরুষ- বলো কার জন্য অপেক্ষা করে সে!

প্রথম পুরুষ- বলো কাকে ঘিরে পাহারা দেয়!

দ্বিতীয় পুরুষ- আইই শুকনো ঝড় আর

                গিরিখাত রঙের সাথে সাথে !

নারী মুখোশ ধারী- রাত যখন ঘনিয়ে আসবে আমি বল্ব সেকথা

                      রাত যখন ঘনিয়ে আসবে স্বচ্ছ হয়ে।

                      রাত যখন ঘনিয়ে আসবে আশ্রমের মাঝে

                      নিমেষে গুঁড়িয়ে দেব আমার অন্তর্বাসের স্টিয়ারিং

ছোট ছেলে-        আর সঙ্গে সঙ্গেই নেমে এসেছিলো রাত।

                     আইই রাত নেমে আসত যে !

                     তোমরা দেখো চেয়ে কী দারুণ আধার করে দেয় সে

                    পাহাড়ের চোরাস্রোত নদীটিকে।

অনেকগুলি গিটারের আওয়াজ শুরু হয়।

পুরুষ মুখোশধারী উঠে দাঁড়ায়, আর হাতের শিং টি বাড়িয়ে ধরে।

                  আইই কী সাদা রঙ

                  দুঃখী বিয়ের সে রঙ

                  আইই কিভাবে শাখার ফাঁকে অনুযোগ করে যায় !

                  পরে হয়ে যাবে তুমি পপি আর কারনেশন ফুল

                  পুরুষ যখন তার আবরণ খুলে ফেলে দেবে সব।

(কাছে এগিয়ে আসে। )

                     যদি চাওয়া নিয়ে তুমি আশ্রমের মাঝে আসো

                     তোমার গর্ভ যেন অমনি,

                     পরো না তোমার মুখে শোকের ওড়না খানি,

                     পরো হল্যান্ড থেকে আনা মিষ্টি জামাটি।

                     দেওয়ালের আড়ালে একলা চলে যাও,

                     বদ্ধ ডুমুর গাছেরা যেখানে থাকে;

                    আর আমার মাটির শরীর বয়

                    ভোরের শুভ্র গোঙানির পর্যন্ত।

                    আইই কী ভীষণ ঝিকঝিক করে!

                    আইই কী দারুণ ঝলকানি দিত!

                    আইই কী নুয়ে যাবে বিবাহিতা মেয়েটি!

নারী মুখোশধারী-  আইই ভালবাসা যেন পরে নেয়

                     মুকুট ও মালা যত আছে,

                     আর জীবন্ত সোনার তীরেরা

                     তার স্তন দুটিতে আঁচড়ে দেয় তত !

পুরুষ মুখোশধারী- সাতবার কঁকিয়ে উঠত সে

                     নয়বারে উঠে বসত

                     পনের দফায় জড় হত ওরা

                     বানাত জুঁই আর কমলালেবু যত।

প্রথম পুরুষ- ওকে দিয়ে দাও শিং খানা!

দ্বিতীয় পুরুষ- গোলাপ ও নৃত্য সাথে করে।

প্রথম পুরুষ- আইই কীভাবে নুয়ে যাবে বিবাহিতা সে মেয়ে!

পুরুষ মুখোশধারী- এই আশ্রম বাড়িতে

                      চিরকাল পুরুষ পাঠায়।

                      সব যেন ষাঁড় ,

                      চিরকাল পুরুষ পাঠায়,

                      আর শাখারা ভরুক ফুলে ফুলে,

                      তাদের জন্য যারা ওদের জিতে নেয়।

ছোট ছেলে-         ওকে দাও শিং খানা।

দ্বিতীয় পুরুষ-       নাহয় ওকে দাও শাখা

পুরুষ মুখোশধারী-  সেই আঁচ দেখতে আসো তোমরা

                      যা দিয়ে স্নান করে থাকর সে!

প্রথম পুরুষ-        যেন বেণুর মত বাঁকে সে।

ছোট ছেলে-        আর ফুলের মত ক্লান্ত হয়।

পুরুষেরা-           ছোট মেয়েদের বের করে আনা হোক!

পুরুষ মুখোশধারী- নাচ পুড়িয়ে দেওয়া হোক

                     আর বিবাহিতা মেয়েটার

                     ঝিকিমিকি সাদা শরীর পুড়ুক!

(সবাই নাচতে থাকে আর সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিতে থাকে। বাজনা বাজতে থাকে। তারা গান করতে থাকে। )

                   স্বর্গে অনেক বাগান আছে

                   সেখানে সুখের গোলাপ থাকেঃ

                   গোলাপ ক্ষেত আর ক্ষেতময় গোলাপের মাঝে,

                   অপরূপ সে গোলাপ।

( দুজন বালিকা চিৎকার করতে করতে ঘুরপাক খায়। বুড়ি হাসি হাসি মুখে মঞ্চে ঢোকে।)

বুড়ি- দেখি, পরে যেন আমাদের ঘুমাতে দেয় ওরা। তবে মেয়েটা পরে হবে। (ইয়েরমা প্রবেশ করে) তুই? ( ইয়েরমা বিষণ্ণ মুখে থাকে। কোন কথা বলে না।) বল, এখানে কেন এলি তুই?

ইয়েরমা- জানি না।

বুড়ি- তুই বিশ্বাস করিস নি ব্যাপারটা? আর তোর সোয়ামী?

( ইয়েরমা ক্লান্ত চোখে তাকায়। চোখের ভাষাটা এমন মানুষের যার মাথার ভেতরে স্থায়ী ধ্যান ধারণা আছেই আর সে সেটাকে চাপা দিচ্ছে।)

ইয়েরমা- এই তো

বুড়ি- কি করেছে?

ইয়েরমা- বাচ্চা। ( থামে কিছুক্ষণ, কপালে হাত চাপড়ে বলে) আইই!

বুড়ি- আইই, আইই। অন্তত আইই আর বেশিটা মন, আত্মা। একথা আগে তোকে বলতে চাই নি তবে এখন, সেটাই বলছি।

ইয়েরমা- তুমি যা বলবে তা যেন আমি জানি না।

বুড়ি- ব্যাপারটা এমনই যে এখন কেউই শান্ত করতে পারবে না। ব্যাপারটা এমনই যেন সেটা ছাদের ওপরে। দোষ তোর সোয়ামীর। তুই শুঞ্ছিস? আমার হাত দুটো কাটার জন্য রেখে যেত সে। তোর বাবা নয়, দাদু নয় এমনকী তোর প্রপিতামহও নয়। তারা কেউই জাতের অন্য পুরুষদের মত আচার আচরণ করত না। ছেলে পিলে হতে গেলে দরকার আকাশ মাটি এক করা। সেগুলো লালা দিয়ে তৈরী হয়। বদলে তোর লোকটা, না। তোর ভাইবোন আছে, তুতো ভাইবোনেরা আছে চারপাশে একশ লীগ জুড়ে। তোর রূপের ওপর কি অভিশাপ এসে পড়েছে, দ্যাখ চেয়ে!

ইয়েরমা- একটা অভিশাপ। পাতার ফাঁকে থাকা একটা বিষের ডোবা।

বুড়ি- কিন্তু তোর তো পা আছে হেঁটে বেরিয়ে আসবার জন্য।

ইয়েরমা- হেঁটে বেরোনো?

বুড়ি- আশ্রমে তোকে যখন দেখি আমার বুকটায় মোচড় দিয়ে উঠেছিল। এখানে মেয়েরা আসে নতুন নতুন পুরুষ দের সঙ্গে পরিচয় করার জন্য। আর সন্ত একেবারে জাদু দেখান। আমার ছেলে মঠের পেছনে তোর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। আমার বাড়িতে একটা মেয়ে দরকার। ওর সাথে চলে যা। আমরা তিনিজন একসাথে থাকব। আমার বাড়িতে যদি যাস তুই এখনো দোলনার গন্ধ পাবি। তোর বিছানার চাদরের ছাই তোর বাচ্চাগুলোর নুনরুটি হয়ে উঠবে। আয়। লোকের কথায় কান দিস না। আর তোর সোয়ামী যখন আমাদের বাড়ি আসতে চাইবে আমার কোমরের জর আছে আর বাধা দেবার লাঠি, সে যাতে কখনো রাস্তা ডিঙোতে না পারে।

ইয়েরমা-  থামো, থামো তুমি। ওটা না হলে আমি কখনো করতাম না এটা। আমি খুঁজতে যেতে পারব না। তুমি ভেবেছ আমি অন্য পুরুষ খুঁজতে যাব? আমার সম্মান তুমি কোথায় টেনে আনলে? জল কখনো পিছনে যেতে পারে না। ভরদুপুরে চাঁদ ওঠেনা। যাও তুমি। আমি পথে তোমার পেছনে যাব। তুমি সত্যি ই ভেবেছ আমি অন্য পুরুষের দিকে ঝুঁকতে পারি? আমি দাসীর মত তার কাছে ভিক্ষা করব সে যেন আমার থাকে? আমাকে চেনো নি তুমি। যাও আর কখনো এর বেশি কথা বলো না তুমি। আমি অন্য পুরুষ খুঁজি না।

বুড়ি- যখন তেষ্টায় কেউ মরে সে জলের কাছে কৃতজ্ঞ থাকে।

ইয়েরমা- আমি একটা শুকনো জমি, যেখানে হাজার জোড়া বলদ চষার জন্য এঁটে যায়। আর তুমি আমায় যা দিচ্ছ তা কুয়োর জলের তুলনায় একট আছোট গ্লাসের মত। আমার যেটা আছে তাহল যন্ত্রণা। সেটা আর আমার মাংসে আটকে নেই।

বুড়ি (জোর গলায়)- বেশ, এভাবেই চল। তোর নিজের ইচ্ছা এটাই। শুকনো জমিতে জন্মানো কাঁটাগাছের মত।  খোঁচা খোঁচা ফণি মনসার মত।

ইয়েরমা ( জোর গলায়)- খোঁচা খোঁচা, হ্যাঁ। আমি জানি খোঁচা খোঁচা! আমার মুখে লাগতে এলে আমিও ঘষে দিই, আর সেটা সুখের হয় না। আমার সঙ্গে মজা করতে এসো না। ছোট বাচ্চারা যেমন জন্তু জানোয়ারকে কষ্ট দিয়ে মজা পায়। যেদিন থেকে বিয়ে করেছি এই শব্দটা নিয়ে ঘুরে মরেছি। কিন্তু এই প্রথমবার এমন কথা শুনলাম। এই প্রথমবার আমার মুখের ওপর ওরা একথা বলল। এই প্রথমবার দেখলাম এটা সত্যি।

বুড়ি- আমায় কোন দয়া করিস না তুই। কোন দয়া নয়। আমার ছেলের জন্য আমি অন্য পাত্রী খুঁজে নেব।

বুড়ি চলে যায় । দূর থেকে শোনা যাচ্ছে সমস্বরে মন্ত্রপাঠ। ইয়েরমা গাড়ির দিকে গেল আর পেছন থেকে তার স্বামী উঁকি দিল।

ইয়েরমা- ওখানে তুমি ছিলে?

খুয়ান- হ্যাঁ ছিলাম।

ইয়েরমা- গোয়েন্দা গিরি করছিলে?

খুয়ান- হ্যাঁ, গোয়েন্দাগিরি করছিলাম।

ইয়েরমা- তুমি শুনেছো?

খুয়ান- হ্যাঁ

ইয়েরমা- আর কি? আমাকে একলা থাকতে দাও। যাও যারা গান গাইছে সেখানে যাও। ( মেঝেতে চাটাইয়ের ওপরে বসে পড়ে।)

খুয়ান- আমারও সময় হয়েছে কথা বলবার।

ইয়েরমা- বলো!

খুয়ান- অভিযোগ করার।

ইয়েরমা- কি জন্য!

খুয়ান- আমার গলার কাছে একরাশ তেতো জড় হয়ে আছে।

ইয়েরমা- আর আমার সমস্ত হাড়ে।

খুয়ান- প্রতিরোধ করবার শেষ সময় এসে উপস্থিত হয়েছে। ক্রমাগত এই ছায়া যুদ্ধ করা, জীবনের বাইরের বিষয় নিয়ে অভিযোগ করা, যে সব জিনিষের বাতাসেও কোন অস্তিত্ব নেই তা নিয়ে নালিশ জানানোর বিরুদ্ধে।

ইয়েরমা (নাটকীয় ভঙ্গীতে) - জীবনের বাইরের বিষয় নিয়ে? বাতাসের বিষয় নিয়ে?

খুয়ান- সেই সব জিনিষ যা কখনো ঘটেই নি, তুমিও না আমিও না, আমরা কেউই যা নিয়ন্ত্রণ করি না।

ইয়েরমা (উত্তেজত ভঙ্গীতে)- বলে যাও ! বলে যাও!

খুয়ান- সেই সব জিনিষ যাতে আমার কিছু যায় আসে না। শুনছ তুমি? আমার কিচ্ছুটি যায় আসে না। এটা এখন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে যে ব্যাপারটা জানাই। আমার হাতের মুঠোয় যা আসে আমি তা নিয়েই মাথা ঘামাই, যা আমার চোখে পড়ে আমি তাই-ই দেখি।

ইয়েরমা (হতাশ হয়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়ে)- তাই, তাই। তোমার মুখ থেকে ওকথাই আশা করেছিলাম আমি। কারো নিজের ভেতরে যখন কিছু থাকে সে তখন সত্যিটা বুঝতে পারে না। কিন্তু কী বিরাট! কী ভীষণ চিৎকার করতে পারো তুমি যখন বাইরে থাকো! কী ভীষণ দু হাত তুলে দাও! তোমার কিছু যায় আসে না! আমি শুনেছি তোমার কথা!

খুয়ান ( কাছে এগিয়ে আসতে আসতে)- ভাবো তুমি আমায় এসব সহ্য করতে হয়। শোনো তুমি।

(ইয়েরমাকে জড়িয়ে ধরতে যায় বসতে বসতে) বহু মহিলা তোমার জীবন পেলে খুশী থাকত। বাচ্চাকাচ্চা ছাড়া জীবন তো আরও মিষ্টি। আমি তো বরং সুখী ওরা নেই বলে। আমাদের কারো কোন দোষ নেই।

ইয়েরমা- তুমি আমার ভেতরে তাহলে কী খুঁজতে?

খুয়ান- তোমাকে! তোমাকে!

ইয়েরমা (উত্তেজিত উদ্বেল স্বরে)- ওই ওই! তুমি ঘর খুঁজতে, শান্ততা খুঁজতে আর একটা মায়েছেলে। কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। যা বলছি তা সত্যি, তাই না?

খুয়ান- হ্যাঁ এটাই সত্যি। আর সবার মতই।

ইয়েরমা- আর বাকী সব? তোমার সন্তান?

খুয়ান (তীব্র ভঙ্গীতে)- শোনো নি তুমি?... আমার কিছু যায় আসে না! আর বেশি কথা জিজ্ঞেস করো না তুমি। আমাকে চেঁচিয়ে একথা তোমাকে জানাতে হলো যাতে তুমি জানো। দেখি এইবার অন্তত একবার তুমি শান্ত হয়ে থাকতে পারো কি না।

ইয়েরমা- তুমি কি কখনো ভেবেছ তাকে নিয়ে, যাকে আমি এত চাই?

খুয়ান- কখনো না ( দুজনে মেঝেতে বসে পড়ে)।

ইয়েরমা- আমি কখনো তার জন্য অপেক্ষা করতে পারব না?

খুয়ান- না

ইয়েরমা- তুমি?

খুয়ান- আমি তো কখনই না। তুমি ভাবনাটা ছাড়ো।

ইয়েরমা- শুকনো কাঁটাঝোপ !

খুয়ান- আঃ শান্তিতে থাকো। একজন আর অন্যজন, শুধু দুজন... আরাম করে, আনন্দ করে। আমাকে জড়িয়ে ধরো তুমি! (ইয়েরমাকে বুকে জড়ায়)

ইয়েরমা- তুমি কী খুঁজছ?

খুয়ান- তোমার মধ্যে খুঁজি তোমাকেই। চাঁদের আলোয় তোমাকে আরও মোহময়ী লাগছে।

ইয়েরমা- এমন করে খুঁজছ যখন তুমি পায়রার রোষ্ট খাও ঠিক তেমন করে ।

খুয়ান- আমাকে চুমু খাও... এভাবে

ইয়েরমা- ওরকম কখনো না। কক্ষনও না ( ইয়েরমা চেঁচিয়ে ওঠে, আর তার স্বামীর গলা চেপে ধরে। দুজনে পেছনে পড়ে যায়। ইয়েরমা তার গলা এমন মুঠিতে চেপে ধরে যতক্ষণ না সে মারা যায়। বাজনা শুরু হয়)। কাঁটা ঝোপ, কাঁটা ঝোপ, কিন্তু নিশ্চিত। আমি নিশ্চিত করে জানি। আর একা জানি । ( সে উঠে দাঁড়ায়। লোকজনের আসা শুরু হয়।) ভয় পেয়ে জেগে ওঠার অসুখ থেকে  আমি বিশ্রাম নেব । আমি বিশ্রাম নেব এটা দেখার জন্য যে রক্ত আমাদের কোন নতুন রক্তের কথা ঘোষণা করে কি না। চিরকালের মত শুকনো শরীর নিয়ে। তোমরা কি জানতে চাও? তোমরা কেউ আমার কাছে এসো না। কারণ আমি আমার সন্তানকে হত্যা করেছি। আমি নিজেই নিজের সন্তানকে হত্যা করেছি!

মঞ্চের পেছনে একদল লোক এসে জড় হয়। আশ্রমের সঙ্গীত শোনা যায়।

পর্দা পড়ে। 

 

 


অনুবাদক 
জয়া চৌধুরী

কবি। গল্পকার। অনুবাদক। অধ্যাপক।
কোলকাতায় থাকেন।

 

  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ