ময়ূরী মিত্রের দুটি গল্প



পুতুল পুতুল
 
বুড়ো। আমার বুড়ো। আমার খুকিবেলার বড়ো প্রিয় বান্ধবী সে। কোনো মেয়ের নাম যে বুড়ো হতে পারে তা বুঝলাম বুড়োকে দেখার পর।
 
আমরা তখন থাকি অনাথ দেব লেনের ভাড়াবাড়িতে। মায়ের সাথে একদিন বেশ ভোর ভোরই এসে আমাদের বাড়ির বাসনমাজার কাজে লাগলো বুড়ো। মাথার প্রত্যেকটা চুল সমান ছুঁচলো। পায়ের নখ থেকে গলা অব্দি মোড়ানো একটি তেকোনা তেলগন্ধ চাদর। উফ ! বাপরে ! এমনভাবে চাদরে শরীর ডুবিয়ে রাখতে আমি আর কাউকে দেখিনি। বেরিয়ে থাকত কেবল তার খচড়ামি ভরা চোখদুটো।
 
মাসখানেকের মধ্যে বুড়োর মা জানালেন --বুড়োর জোরদার কিডনির রোগ হয়েছে এবং শিগগিরই নাকি মরবে বুড়ো। সেদিন আমি প্রথম ভালো করে লক্ষ করলাম বুড়োকে। বাচ্চাদের লাইন টানা স্কেলের মতো রোগা লেগেছিলো তাকে সেদিন।  সেদিনই তাকে বড়ো আদরে ডেকেছিলাম--- বুড়োসুন্দরী। বুড়োর মা বললেন -- ডাক্তারের মুখে নিজের মরার কথা নাকি লুকিয়ে শুনেও নিয়েছে বুড়ো। তারপর থেকেই বুড়ো চুপ। শুধু শব্দ করে করে বাসন মেজে চলেছে লোকের বাড়ি বাড়ি। এমনকি তার মা যে যে বাড়িতে কাজ করত সেই বাড়িগুলোরও। আসন্ন মৃত্যুবার্তায় শব্দে বুড়োর কেন মহাপ্রেম জাগলো তা বুঝলাম না। কেবল দেখতাম --একতলায় উঠোনে বাসন মাজতে বসেছে বুড়ো। জোরে জোরে মাজছে। ধোয়া বাসন পিটিয়ে পিটিয়ে পাট করছে। কখনো বা বাঁদুরে চোখ নাচিয়ে , ঢিল ছুঁড়ে কাকগুলোকে জ্বালিয়ে মারছে। শীতের ভোরে ঘুমভাঙা কাকের সে কী চেল্লানি রে বাবা। আকাশের দিকে ডাকিয়ে বুড়ো কাকের কলরব খেতো গপগপিয়ে।
 
 বুড়োকে নয়া নয়া শব্দ দিতে আমি ও আমার মা কতদিন যে মিছামিছি চেঁচিয়ে ঝগড়া করেছি ! ঝগড়া থেকে নির্গত ধ্বনি পরম মমতায় কানে নিতো বুড়ো। বিনিময়ে আমার হুকুম শুনে যেতো দিনভর। কখনো --' ফুটন্ত জলে বেগুন চুবিয়ে রাখ বুড়ো !--দ্যাখ ভাসে কিনা ! " কখনো ---" ও বুড়োমনি মেটের লাল ঝোল বানা ! " কিডনির রোগে তখন বুড়োর মাংস ডিম একদম বন্ধ। তবুও দেদার খেতো রোগা মেয়ে। মেটের ঝোল কড়া থেকে নামিয়েই খেতে লাগতো। মাঝে মাঝে ভয় পেয়ে বুড়োকে বুকে জাপটে নিতাম। তবু খেতো। একসাথে হাফ ডজন চড়ও মেরেছি। তবু।
 
মা আমাদের নিয়ে গেলেন নীলের মেলায়। আমি কিনলাম একটি ফাইন মেমপুতুল। আর বুড়ো একটি কথা বলা হাত পা নাড়া পুতুল। বাসন মাজতে বসেও আলসের ওপর পুতুল বসিয়ে রাখতো। কলকব্জা বিগড়ে যেদিন পুতুলটা কথা বলত না মেরে মেরে পুতুলটার দফা করতো বুড়ো। ভেঙে চুরে একসা হয়ে যেতো পুতুলটা। আবার বিকেলবেলা পুতুলটাকে দুজনে মিলে ফিটফাট বানিয়ে ঝিল পার্কে বেড়াতে যেতাম। আমি বুড়ো আর বুড়োর পুতুল।
 
একদিন অনেকটা সন্ধে হয়ে গেলো। বৃষ্টিও নামলো। খুব ভয় করতে লাগলো আমার। যত বলছি --"বুড়ো আয় আমার সাথে লাইটের তলায় বোস -- আমার ভয় লাগছে বুড়ো" --- বুড়ো দেখি তত চলে যাচ্ছে গাছঝাড়ের ঝুপসি আঁধারে। কাছে গিয়ে দেখি --ওমা ! ঐ আধাঁরেই পুতুলটাকে এন্তার গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে বুড়ো। যেন যন্ত্রখেলনা কথা বলে মহা দোষ করে ফেলেছে।
 
বকাবকির পর পুতুলটার কাছে নিজের কান মুলে দিয়ে মাপ চাইলো।
 
দেখামাত্তর বুড়ো আর বুড়োর পুতুল দুটোকেই নিজের গায়ে সাঁটিয়ে দৌড়োতে লেগেছি। কান্না পাচ্ছিলো না খটখটে উনুন হয়েছিল চোখদুটো মনে করতে পারি না। খালি মনে আছে শুধু চেঁচাচ্ছি ---" আয় বুড়ো ! আয় রে আমার বুড়োসুন্দরী। আয় আমার সাথে রাস্তার লাইটের তলায় স্টেপ মিলিয়ে পা ফেল | চল চল দৌড়ে চলি বাড়ি। " 
 
আরে ! দ্যাখ দেখি ! কেবলি আলো থেকে আঁধারে চলে যাচ্ছে শয়তান বুড়ো ! সাপের মতো এঁকে আর বেঁকে। হাতে তার বৃষ্টিভেজা শব্দপুতুল। -- এর কিছুদিন পরই বুড়োসুন্দরী মরে যায়। আর বেঁচে থাকতে থাকতে আমি এক প্রাচীন গাছ হয়ে যাই। হাঁফ ধরেনি পুতুলটার। সে হাঁফালে মহা মুশকিল।


★★★★★★


সুগন্ধ
 
গেল বসন্তে ---- । বিকেলে ঝরে পড়া কুটুশ কুটুশ বৃষ্টি আর ফসফস করে বয়ে চলা বাতাস সব মিলিয়ে বসন্তের সেইদিনটা ছিলো বড় মনোরম । বড় শুদ্ধ । আমি বলি , আমার চমচম বসন্ত ।
 
রাত নটা নাগাদ ফিরছিলাম বাড়ি। রাস্তার ধারে একটি শবদেহের গাড়ি । গাড়িটি তখন ফাঁকা । ছড়ানো ফুল দেখে মনে হয়েছিলো কিছু আগেই কোনো শবদেহ পৌঁছে দিয়ে এসেছে সেটি । ফুল অজস্র আর দামী । যে ধরনের সাদাটে ফুল সাধারণের মরা শরীরে দেয়া হয় তেমনটি নয় একেবারেই । লাল গোলাপি হলুদ নানা রঙের গোলাপ গাড়িতে । দেখে বোধ হলো বড়লোকের বডি বয়েছে যানটি । আসলে বড়লোকরা জীবনে যেমন আলাদা মূল্য পায় মরণেও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। 
 
অবাক হয়ে দেখলাম দুটো মিশকালো ভিখারি মেয়ে শবগাড়ির বেশ কটি ফুল নিয়ে মাথায় গুঁজেছে । ঘাড় পিঠ --যেখানে পারছে একটি করে ফুল রাখছে । মাটিতে পড়ে যাচ্ছে তো কুড়িয়ে নিয়ে আবার নিজেকে সাজাচ্ছে | আর হেসে মরছে।
 
অস্বস্তি লাগছিলো। মৃতের ছোঁয়া লাগলে চান করে চকমকে হতে হয় --এ সংস্কার কোনোকালেই নেই আমার। তবু এহেন বসন্তে এইসব অনাসৃষ্টি দেখে বিব্রত হচ্ছিলাম খুব। দুই বগলে দুটো মেয়েকে নিয়ে পালাতে ইচ্ছে করলো। কেন বলতে পারব না। ময়ূরার চিন্তার গতি ময়ূরা নিজেও জানে না। দ্রুত কাছে গিয়ে একটাকে নামালাম গাড়ি থেকে। আরেকটা তখনো ফুলসাজে শবগাড়িতে দোল খাচ্ছে। বসন্তের দোলা। বললাম -- চ একটা ছোট সাবান কিনে দিচ্ছি। বাড়ি গিয়ে ঘষে ঘষে চান কর পাজি বদমাশ। চান করতে রাজি হলে এক্ষুনি মুড়ির পয়সা পাবি। দুটোর মধ্যে যেটা বেশি বাঁদর, মানে যেটা তখনো ঝুলছে গাড়িতে,ফিক করে হেসে বললে-- দিতে হবে না | আমাদের সাবান আছে।
 
সন্দেহ হলো | বললাম - কি সাবান ? বললে --নিমসাবান। এই তো দেখো না আমার পকেটেই আছে। বার করতেই দেখলাম ঠিক নিমসাবানের মতোই একটুকরো শ্যাওলা চৌকো পাথর। মারতে উঠেছি। মেয়েদুটির জন্য এক আতঙ্ক চাপছে ক্রমশ। কেন আতঙ্ক ,কতখানি মঙ্গল তাদের চাইছিলাম সেসময় , তার কোনো ধারণা আপনাদের দিতে পারবো না। কেবল মনে আছে , আমার সেই পাগলপারা ত্রাস দেখে হি হি হেসে তারা বলেছিলো --" হ্যাঁ গো এই আমাদের নিম সাবান। এ দিয়েই পুতুল পরিষ্কার করি। নিজেদেরও। জোরে জোরে ঘষতে ঘষতে একদিন ঠিক ফর্সা হয়ে যাব।"

--- মৃতের যানে নাচিছে আমার শ্যামা মা। ওমা পাথরে ফরদাফাই হবে তোর নরম চামড়া। অক্ষত থাক ! অখণ্ড থাক। সুগন্ধে ভরে তোল ভূমি আকাশেরে। ও আমার মা ! মা রে ! -----
 
 
 
লেখক পরিচিতি:
ময়ূরী মিত্র
গল্পকার। নাট্যগবেষক। প্রাবন্ধিক
কলকাতায় থাকেন।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. 'পুতুল পুতুল'...বড় মনখারাপ করা।
    এরকমই কত বুড়ো যে আঁধার পানে চলে গ্যাছে।

    উত্তরমুছুন
  2. মনখারাপের মধ্যেও যে মিষ্টি একটু ভালো লাগার ছোঁয়া থাকে.. তোর লেখা পড়লেই বোঝা যায়, চলতে থাকুক কলমবাজের কলম...

    উত্তরমুছুন