ময়ূরী মিত্রের গল্প: কাগা খায় বগা খায়




ভালোবাসার পরিমান কতটা হলে একটি ঠিকঠাক ভালোবাসা জন্ম নেয় কোনোকালেই তা বুঝে উঠতে পারি না ৷ বোঝার চেষ্টাটা যে ততোধিক বোকামি তাও বুঝতে পারি না ৷ ফলে কি হয় ---কেউ আমায় ভালোবাসছে বোঝামাত্তর তার আয়তন হাতড়াতে লেগে যাই ৷ প্রতিবারই ডাহা ফেল ৷ ছিটকে যেতে থাকে আমার সবকটা সবে জন্মানো ভালোবাসা চলন্ত ট্রেনের জানলা থেকে যেমন দ্রুত পিছু হাঁটে নদী গাছ পাহাড় --লাইনের চারপাশে মানুষের সংসার৷


একদা এক মেয়ে এসেছিলো আমার কাছে ৷ শরীরের থেকে বিশাল এক ঝাঁকা চুল ৷ নাদুস ভুঁড়ি দুলছে ৷ নামকরণ করলাম - গণেশ | ভুঁড়িটা চটকাব বলেই ঝপ করে মেয়েটাকে টেনে নিলাম কোলে ৷ নানা কথার পর জিজ্ঞেস করলাম -- বল কাকে সবচেয়ে ভালোবাসিস ? নিশ্চিত ও পরিচ্ছন্ন উত্তর -- কাকে আবার ? মাকে --- ৷
 
ভেতরের রোগটা ঝাঁকাতে শুরু করেছে আমায় ৷ বলেই ফেললাম -- কতটা ভালোবাসিস ? এবারও সে স্থির প্রত্যয়ে বললে --- আমার দুনিয়ার চেয়ে একটু বেশি ৷ বললাম --- তোর আবার দুনিয়া কী রে ? গণশা বললে ----আমার দুনিয়া এই আমার বই পেন্সিল স্কুল ব্যাগ ড্রইং খাতা ,মার বানানো পাস্তা ,পাহাড় জামা ,স্কুলের মিড ডে মিল ৷
 
আচ্ছা কী দেখে বুঝিস তোর মা তোকে ভালোবাসে ? গণেশ মেয়ে গুছিয়ে বলে --- মার হাসি দেখে ,আমার ভালো রেজাল্টে মার আনন্দে ,আমার জন্য পাস্তা বানানোয় আর মার রাগে | অবাক হয়ে বললাম- রেগে গেলে কি কেউ ভালোবাসতে পারে নাকি হাঁদা মেয়ে ? গণেশ বললে - আমার মা যখন রেগে যায় আমার কোনো দুষ্টু কাজে রাগে টসটস করে গো মার চোখ ৷ বলতে বলতে টুপুস হয়ে যাচ্ছে গণেশের চোখ ৷
 
" আরে কী বোকা রে তুই ? রাগে আবার টসটস করে নাকি কারোর চোখ ? বল তোর বাঁদরামিতে কাঁদছিল তোর মা ৷" - হাঁ করে চেয়ে শব্দের ভুল বোঝার চেষ্টা করতে লেগেছিল সেদিন গণেশ ৷ ভুঁড়ির ওপর চাপড় মারতে আপ্রান চেষ্টা করতে লাগল ঠিক কোথায় ভুল তার ৷ বুঝলাম, রাগ আর চোখের জলকে বেশ ভালো মতোই গুলিয়েছে সে ৷ আর এই গোলানোতে বেশ একটা ঝকঝকে সুখ ফুটছে তার চোখে |
 
তার সেদিনের সুখী সে মুখ দেখে আমি তাকে দিয়েছিলাম আমার মায়ের নিজের হাতে বানানো, দু তিনরকম রঙ মেশানো একটি ডিজাইন মোমবাতি ৷ বারান্দা দিয়ে দেখলাম ,মায়ের সাথে ভুঁড়ি দুলিয়ে বাড়ি চলেছে গনেশানী৷ হাতের তালুতে সিধে বসানো নানারং মোমবাতি ৷
 
জ্বাল রে জ্বাল ৷ অনেক বাতি জ্বাল ৷ সেই বাতিতে দগদগে করে দে সবকটা শিয়ালের মাইক্রোফোন ৷
 
তোদের মাঝে জীবন খুঁজি ৷
মৃত্যুক্ষণে তোরা দিবি শৌর্য ৷
Any আপত্তি ?
গর্ভধারিণীরা --- গেলেন কোথা ?
ছাড়বেন তো সন্তানদের মাইকহীন ভুবন গড়তে ?
সে ভুবনে সাত পাখির সাত রঙ ৷
ভালো করে আঁক দেখি একটা ছবি ৷
 
★★★


খেয়েদেয়ে দুপুরের গরম রোদটা পুরো গায়ে নিচ্ছি ৷ বারান্দা থেকেই দেখলাম নীচের বাগানে একটা ছেলে আর একটা মা ভুস করে উঠে দাঁড়াল ৷ আসলে এবার শীতে এত বৃষ্টি হয়েছে যে ঘাসগুলো খুব লম্বা হয়েছে ৷ ফলে ছেলে আর তার কচি মা বাগানের বাইরে থেকে ঘাস মাড়িয়ে যখন এগিয়ে আসছিল মনে হচ্ছিল ঘাস থেকে ওরা গজালো ৷

দুজনে হাত ধরে এবং গলায় দুটো ছেঁড়া মাস্ক হার করে পরে ৷ ওপর থেকে বললাম --কী চাস ? ছেলে বলল --পেসমেকার --পাঁচশো টাকা দাম ৷ দেবে গো পিসি ? আমার বাবার জন্য খুব দরকার গো ৷ ঘুঁষি পাকাচ্ছি দেখে জিভ কেটে বলল --ও sorry পিসি , ভুল হয়ে গেছে ৷ পেসমেকারের তো অত কম দাম না -তাই না ? আচ্ছা ঠিক আছে ৷ তাহলে একটা কোভিড পাফ কিনব বাবার জন্য ৷ ধর - ওই পাঁচশো টাকাই দাম ৷ এবার ঠিক আছে পিসি ? তেড়ে বললাম -- কী ঠিক আছে রে হনুমান ? সমানে মিথ্যে বলছিস ৷ মাথা চুলকে নিজের মনে বিড়বিড় করলে ছেলেটা --না মানে মিথ্যে জিনিষের সাথে মিথ্যে টাকাটা মিলল কিনা ? অনর্গল আমার প্রশ্নে মিছেকে সাজাতে সাজাতে ক্লান্ত বালক ভিখারী ৷ প্রথম থেকে শেষ অব্দি নিশ্চুপ তার মা ৷ চোখে চোখ পড়তেই কেবল মুখ সরিয়ে সামনের মাঠের দিকে মেলে দেয় ৷ এক হাতে ঘাস ছেঁড়ে ৷ ছেলের জলহীন মিথ্যে সারাইয়ের কোনো চেষ্টাই করে না ৷ ছেলেটা নিজেও না ৷ বরং বার বার মিছে জিনিষের নাম বদলে যেতে থাকে ৷
 
এমন সত্য অর্থে মিথ্যের চাষ আমি দেখিনি ৷ নিজের মিথ্যেকে এত সরল করে সাজাতেও কাউকে দেখিনি ৷ মায়া লাগে ৷ নিচে নেমে শুকনো ঠোঁটের বাচ্চাটাকে বলি --তোর আসলে খিদে পেয়েছে না রে? কদ্দিন খাসনি? বল একবার সত্যি করে৷ সরাসরি চা না বাবা ৷ আমি টাকাটা দেব রে সত্যি বললে ৷ ভুখা বাচ্চা বলে -- ওহ না ৷ পাফ না -বাবার এক্সরে হবে ৷ এবার মিলল তো পিসি ? পাঁচশোর সাথে মিলল তো ? এবার দেবে তো টাকাটা ?
 
সামান্য টাকা দিয়ে বারান্দায় উঠে দাঁড়িয়েছি ৷ ছেলেটি ঘুরছে প্রতীক্ষায় থাকা মায়ের দিকে ৷ ঘুরে মায়ের চোখ দেখল একবার ৷ হরিণবেগে ঝাঁপিয়ে এল আমার কাছে ---পিসি ভাত খাব না মুড়ি খাব ? কোনটা খেলে সস্তা হবে গো ?
উত্তর না নিয়েই মায়ের সাথে আপনমনে চলে গেছে ৷ তৃপ্তি আমার এটুকুই -- শেষঅব্দি সত্য বলে গেছে ৷ হয়ত গপগপিয়ে ভাত খাওয়ার আনন্দে --হয়ত -- হয়ত ভিখারীহৃদয়ে লুকিয়ে থাকা একটুকরো লালিত্যে ---

কাল সকালে সূর্য্যি উঠবে গাঁদার মালাটি হয়ে ৷
তাকে বলব --ও আমার প্রিয় মাসি
শিশুকে এট্টু ভাত দিও ৷
কোনো কারণ ছাড়াই দিও ৷
তারা তোমার কাছে পৌঁছোক ৷
 
★★★
 
আরতির বাঁচার আর্তি ফুরিয়ে আসছে ৷ স্মৃতি কৌটোর কোনায়ও আর নেই ৷ আগে যখন বিভিন্ন দিক থেকে মা মা ডাক শুনতেন ববকাট মাথা আর গুল্লু চোখদুটো সেদিকেই ঘুরত ৷ চোখ জানান দিত --পুরো যাই নি রে -আছি - আছি ৷
আরতির মেয়েটা আজ তার মায়ের চারদিকে হনুমান লাফ দিয়ে দিয়ে মা মা ডাকছিল ৷ আরতি কিন্তু বাগানের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন ৷ বোধহয় ভাবছিলেন --মেয়েটার মা মা হাঁকার দেয়ার উৎপাতে এবার তাঁকে বাগানের একটা গাছ হয়ে যেতে হবে ৷ গাছের স্মৃতি নেই - শব্দ নেই - কারোর কথা শুনে চোখ তুলে তাকানোর ব্যাপার নেই ৷ আরে বাবা কাউকে ভ্রূক্ষেপ করার ব্যাপারই নেই গাছের ৷ সে কেবল সবুজ পাতা ও লাল ফলে ভরাট হয়ে থাকে ৷ চাঁদ সূর্য সব এসে আছড়ে পড়ে তার প্রশাখায় ৷ তারপর জীবজগত সেই পয়মন্ত গাছটি হাওয়া ও খাদ্য নিজের চাহিদায় খুঁজে নেয় ৷ সে শুধু উপভোগ করে একটি সম্মানিত জীবন ৷ তেমনি কি একটা গরবিনী গাছ হয়ে যাবেন আরতি ?
হনুমান মেয়ে যখন তার সাতজন্মের মায়ের ব্যাথা সইতে না পেরে কাঁদু কাঁদু হয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল তখন সে শুনল --শান্তা নার্স তার মায়ের পটি মোছাতে মোছাতে বলছে --- মা কেঁদ না৷ কাঁদা মানে হেরে যাওয়া৷ এ তোমার নিজের সাথে লড়াই। রোজ বাঁচার চেষ্টা করাটাই বাঁচা মা ৷
আরতির নেটিপেটি মেয়েটা দরজার ফাঁক এক প্রান্তিক মানুষের মুখে ঋকবেদের এই জোরাল উচ্চারণ এই প্রথম শুনলে ৷
পরেরবার দেখা হলে মেয়ে মা কেউ কাঁদবে না ৷
একজন গাছ হবে ৷
তো একজন বুটিদার পাখি ৷
দুজনে একসাথে চাঁদ খাবে ৷
চাঁদের অতীত নেই ৷
এই চিররোমান্টিক উপগ্রহটি চলমান ৷
 
★★★


বছরখানেক আগের এক দিন ৷ ভরদুপুরে শনিদেবের মন্দিরে জমেছিল ফুলের স্তুপ৷ নীল অপরাজিতা আর লাল জবা। তরুণ পূজারী ,দেখলাম দুই রঙের ফুলের দুটি চুড়ো তৈরি করছেন ৷পাশাপাশি রয়েছে তারা ৷ আর ফুলের স্তূপের তলায় চাপা পড়ে রয়েছে বিগ্রহ ৷ মন্দির থেকে ইচ্ছাকৃত তফাৎ রেখেই বারবার দেখতে লাগলাম ৷ যদি দূর থেকে অন্যরকম এক মানুষ মনে হয় পূজারীকে --- অন্য কোনো অর্থ বেরোয় লালনীল পুষ্পগন্ধে ৷

ধূপের আরতি শুরু হয়েছে ৷ মনে হচ্ছিল , পূজারীর এ স্তুতি ফুলকেই ৷ মৃত পাথরখণ্ডে নয় ৷ তরুণ বলেই বোধহয় ফুলের মোহে পড়েছিলেন ৷ নানাভাবে ফুল ছুঁয়ে দেখছিলেন যুবক পুরুষটি ৷ তাঁর ফুলখেলায় কখনো ফুলের রাশি উঁচু হচ্ছিল ৷ প্রচুর চুলওয়ালা নারীর খোঁপার মত উঁচু ৷ নীলফুল দুপুরের তাপ কমাচ্ছিল ---জমে পাহাড় হয়ে দেবপাথরকে অভিনব আকার দিচ্ছিল ৷ লম্বা করছিল দেবতার টুকরোকে ৷ 
 
বলতেই পারেন -- পাথর আর ছেঁড়া ফুলে তফাৎ কী ? বিগ্রহ চাপা দেয়া ফুল যতই সুন্দর হোক না কেন --তা তো মরেই গেছে এখন ! কিছুক্ষণ পরে খসে পড়বে পাপড়ি ৷ ময়ূরা বলে ---তবু তো একসময় তাতে ছিল জীবন ! জ্যান্ত গাছের পরশ ঘিরে ছিল তাদের ! সে সৌরভ কি যাবার ? প্রাণের স্পন্দন ,প্রাণের আশ্বাস থাকে বহুক্ষণ !
মরা পাথর ছেড়ে একটিবার ভারত যদি খুঁজত জীবন ! একটিবার ! নেতারে ছেড়ে যদি ভজত গরিব মানুষজন ! একটিবার ৷
 
বাঁচার চেষ্টা করছে এখনো কটা মানুষ ৷ এখনো ----- ! একটা অন্তত মালভূমি চাই গো !


লেখক পরিচিতি:
ময়ূরী মিত্র
গল্পকার। নাট্যগবেষক। প্রাবন্ধিক
কলকাতায় থাকেন





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

5 মন্তব্যসমূহ

  1. সব গল্পের বক্তব্য খুব সুস্পষ্ট। লেখিকার মনের গভীরতা ও সামাজিক চেতনার পরিচয় পাওয়া গিয়েছে প্রতিটি গল্পে।

    উত্তরমুছুন
  2. মানুষের মনের তল খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। তাই কতো সহজে তোমার লেখায় প্রকাশ পায়। ভারি চমৎকার !!

    উত্তরমুছুন
  3. পড়ি আর মুগ্ধ হই।
    এরকম ভাবতে শিখবো কবে?

    উত্তরমুছুন
  4. ময়ূর রে তোর লেখায় পাই বেঁচে থাকার আশ্বাস,জীবনের আস্তিকতা ্

    উত্তরমুছুন