আজিমাবাদেসেদিনআমার পঞ্চম দিনছিল। এক বন্ধুর
আমন্ত্রণে অল্প কয়েকদিনের জন্যওখানেযাওয়া। কিন্তু ওখানেযাওয়ার আসল উদ্দেশ্য আমার বাপদাদার বাড়ি থেকে বাইরে থাকার অভ্যেস গড়েতোলা। মনে হয় আমার বন্ধুরও আমাকে আমন্ত্রণের উদ্দেশ্যও তাই। বাপদাদার ভিটেয়
অর্ধ-শতাব্দীরও বেশি সময় বসবাস করে, ছোট একটা বাড়িতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলামতখন। আমার এই সিদ্ধান্ত নিজেকে মানিয়ে নিতে রাতভর আমি পায়চারি করেছি আর
গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করেছি। এমতাবস্থায় বাড়িটা ছাড়ার আগে
জিনিসপত্রেগাদাগাদিএকেকটাঘরআমাকে খালি করতে হবে। ছোট ছোট
তিনটে বাড়িতেও হয়তো এইসব জ্বরাজীর্ণ বিছানাপত্র, টেবিল চেয়ার, দোলনা ইত্যাদির স্থানসঙ্কুলান হবে না।
অতিরিক্ত জিনিসপত্র আগে আমাকে একদিকে করতে হবে আর যেগুলো একেবারে ব্যবহার অনুপযোগী
সেগুলো ফেলে দিতে হবে।
প্রথমে বড় বড় আসবাবপত্রগুলোর রফা
করলাম আর তালগোল পাকিয়ে ফেলে এমন ঝামেলাপূর্ণ কাজগুলো কোনভাবে সুরাহা করে ফেললাম।
কিন্তু খুঁটিনাটি জিনিসপত্র নিয়েই বরং ধন্ধে পড়ে গেলাম। যখনই সিদ্ধান্ত নিই কোনোএকটা জিনিস অপ্রয়োজনীয়, তখনই সেটির গুরুত্ব আর প্রয়োজন টের পেতে থাকি। সেটার কোনো
উপযোগীতা খুঁজে না পেলেও তা ফেলেও দিতে পারি না। দ্বিধান্বিত হয়ে সেগুলোকে একপাশে
রেখে গোছগাছ এগিয়ে নিতে থাকি।
এরকম দ্বিধাদ্বন্দ্বেরমাঝে বাড়ির একটা ছোট চিলেকোঠার দিকে যাই এবং
সেখানে রাখা দেয়াল-আলমারিটা খুলি। এর ভেতর রাখা আমার ছোটবেলাকার টুকিটাকি। আলমারির
কাঠের দরজা ক্ষয়ে যাওয়ায় বাইরে থেকে গর্ত দিয়ে ভেতরে রাখা কোনো কোনো জিনিস গোচরে
আসছে। কাঠের তক্তার ভারে তাকগুলো বেঁকে গেছে। পেছনের দেয়ালের প্লাস্টার খসে গেছে, আর তাকের উপর জমা হয়েছে ময়লার স্তুপ। আসলে সবখানেই ময়লার
স্তুপ। একবার নজর দিলেই বলে দেয়া যায়, ওর ভেতর ব্যবহার উপযোগী তেমন কিছু নাই। তারপরও তাকের ভেতরে ধুলার আস্তর
সরিয়ে প্রত্যেকটা আইটেম বের করলাম এবং সতর্কতার সাথে সেগুলো দেখতে লাগলাম। আমার বড়
ভাই এখন বিদেশে থাকেন। তার জিনিসপাতি মাঝের তাকে। ওগুলোর
মধ্যে আছে তার লেখা অসমাপ্ত গল্প, প্রিয় কবিতায় ভরা খাতা আর ম্যাগাজিন থেকে কাটা ছবি।
একটা শিরোনামহীন পূর্ণাঙ্গ গল্পও
পাওয়া গেল। কাচা হাতে লেখা। প্রচুর বানান ভুল আর সাথে ভাবপ্রকাশের অসম্পূর্ণতা।
লেখকের নাম লেখা হয়েছে নওবাহার গুলরেজ বা এ রকমের রোমান্টিক ছদ্মনাম। গল্পটাতে এক
অসহায় যুবকের কথা বলা হয়েছে, যে প্রেমে পড়ে
বিরহে কাতর। তার ধনী ও নিষ্ঠুর প্রেমিকাকে চিঠি লেখার ঢঙে লেখা। আমাদের ছোটবেলার
সিনেমার গানের বিভিন্ন মুখরা দিয়েগল্পটা
বানানো। শেষ চিঠিটাতে প্রেমিকাকে অভিনন্দন ও আর্শিবাদ করা হয়েছে তার বিয়ের জন্য।
তারপর একটা সিনেমার পুরো গান আর শেষে ফুটে উঠেছে পত্রলেখকের আত্মহত্যার অভিলাষ।
আমার নিজের যা কিছু তা উপর আর
নিচের তাকে রাখা। আমার নানা পেশার অবশেষ যেমন নষ্ট কলম, মরচে পড়া ছুরি, ম্যাজিক দেখানোর কিছু টুকরো টুকরো যন্ত্রপাতি, শিশুতোষ জীর্ণ ম্যাগাজিন - এ ধরনের আরো টুকিটাকিচোখেপড়ল। এক কোণে দুটো খালি বোতল পড়ে আছে যাতে এক সময় বিদেশি নামী
পারফিউম ছিল। সে সময় পারফিউম এমন জনপ্রিয় ছিল যে গল্প-উপন্যাসে প্রায় তার উল্লেখ
থাকতো। বোতলগুলো গাঢ় নীল রঙের - গড়ন চ্যাপটা। ছিপিগুলো হারিয়ে গেছে। বোতলে নাক
দিয়ে গন্ধ নেয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু কোনো গন্ধ পেলাম না।
গল্পটার মতো বোতলগুলো দেখেও কোনো
স্মৃতি মনে পড়লো না। কিন্তু যখন গল্প লেখার পাতাগুলো দিয়ে বোতলগুলো মুড়ে আলমারি
থেকে উঠানে ছুঁড়ে ফেলার জন্য হাত তুললাম তখনই মনে হলো এগুলোরও কোনো না কোনো
প্রয়োজন আছে। আমার হাত নিচে নেমে গেল এবং এগুলো মেঝেতে রেখে দিলাম। আলমারির প্রতিটি জিনিসেই আমার অতীতের কোনো না কোনো
স্মৃতি জেগে উঠছে। ভাবতে শুরু করলাম যে, কোনোকিছুই আমি ফেলে দিতে পারবো না। যখন কিছু একটা ফেলে দেয়ার জন্য দুর্বল এক
চেষ্টা চালাই, তখনই আমার এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার
ইচ্ছেও দুর্বল হতে থাকে। এমনকি জরাজীর্ণ দেয়ালের চুনকামের খসে পড়া ছোপছোপ দাগ, রাজমিস্ত্রিরা যাকে ‘অশ্রুকণা’ বলে, ফেলে রেখে চলে যাওয়ার জন্য আমি মানসিকভাবে তৈরি ছিলাম না।
দেয়ালের ছোপগুলোর দিকে তাকিয়ে এই চিন্তায় ডুবে গেলাম যে, যদি এ ভাবনাগুলো লেখা যেতো তাহলে হয়তো নও বাহার গুলরেজকে
লজ্জা পেতে হতো না। পরে এটুকু বুঝলাম যে, আলমারিটা খুলে শুধু শুধু আমার সময় অপচয় করলাম। মেঝেতে পড়ে থাকা সবকিছু এক
জায়গায় গোছালাম যার অন্যতম হলো গল্পের পাতা দিয়ে মোড়ানো নীল রঙেরবোতলগুলো। সবকিছু আবার আলমারিতে তুলে রাখলাম। আলমারিটা খোলা
রেখেই চিলেকোঠা থেকে বের হয়ে গেলাম।
আমার বেড়াতে যাওয়ার টুকটাকি গুছিয়ে নিলাম। একটা বইও সাথে নিয়ে নিলাম রাস্তায় পড়বো বলে। সেদিনই আজিমাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
২
আমার বন্ধু আমাকে আন্তরিকতার সাথে
গ্রহণ করলেন। তিনি সেখানকার পোস্ট অফিস বিভাগের প্রধান। তার থাকার জন্য বিশাল এক
সরকারি ম্যানশন বরাদ্দ। আমার অনুরোধে তিনি আমাকে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখালেন। আমি
বাড়িটার বিশাল খোলা জায়গার প্রশংসা করলাম আর উল্টো তিনি বাড়িটার একগাদা খুঁত আমাকে
ধরিয়ে দিলেন। তার মতে সবচেয়ে দুর্বল দিক হলোবাড়িটার এক ফ্লোর থেকে আরেক ফ্লোরে যেতে অনেক সময় চলে যায়।
“এ ধরনের বড় ম্যানশনের দিন শেষ হয়ে গেছে,” তিনি অবশেষে বললেন, “ বিশেষ করে---”। এরপর তিনি এ বিষয়ে কথা বলা বাদদিয়েঅন্য প্রসঙ্গে কথা বলা শুরু করলেন। অফিসের কাজে তিনি
ব্যস্ত থাকলেও কাজের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকদিনের মধ্যেই তার স্থানীয় বন্ধুদের সাথে
পরিচয় করিয়ে দিলেন। এমনকি তিনি তার কর্মস্থলেও নিয়ে যেতেন। সেখানে তার অধীনরা মিনিটে মিনিটে তার নির্দেশনা নিতে আসতে থাকে। আর বিরতির মাঝে আমার সাথে কথা চালিয়ে যান। যদিও আমি বেশিরভাগ সময় পার করিআমার বন্ধুর
লাইব্রেরি থেকে আনা বই পড়ে। একদিন, মানুষজন অফিসে আসতে শুরু করার আগে আমরা দু’জন আলাপের সময় পেলাম। তিনি
তার অফিস জীবনের জটিলতার কাহিনি বললেন। তার সবচেয়ে বড় দুঃখের কারণ হলো তার অফিসের
লোকজন সারা শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে। রাস্তাঘাটে মুক্তভাবে এবং উদ্দেশ্যহীনভাবে চলাফেরা
করা তার পক্ষে অসম্ভব।
“যেখানেই যাই,” তিনি উদ্বিগ্ন
হয়ে বললেন, “ কেউ না কেউ আমাকে চিনে ফেলবে এবং চিন্তা করা শুরু করবে
সাহেব এখান কী করছে? ”
“ভাবতে দিন তাকে, ” আমি বললাম।
“তখন সে কিছু আন্দাজ করবে।”
“ তাতে কি?”
“তখন সে তার আন্দাজ বিশ্বাস করা শুরু করবে। তারপর সে তার
বিশ্বাস অন্যদের সাথেআলোচনাকরবে। দ্রুতই আমার সম্পর্কে এ শহরে এমন কিছু রটনা রটবে যা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি”।
“ ঠিকই”, আমি বললাম, “ আপনার খ্যাতির
কিছুটা মূল্য তো দিতেই হবে!”
“ খ্যাতির মূল্য,” তিনি বিনয়ের সাথে কথাগুলো আবার আওড়িয়ে বরং আরো বেশি উদ্বিগ্নহয়ে উঠলেন।
“ নিদেন পক্ষে আপনার ডিপার্টমেন্টে।”
“ আমার ডিপার্টমেন্টে-” তিনি হঠাৎ থেমে গেলেন এবং
তার উদ্বিগ্নতা কেটে গেল। “ সম্ভবত আপনি জানেন না স্যার
যে এই মুহূর্তে আপনার খ্যাতি আমার ডিপার্টমেন্টে আলোড়ন তুলেছে।”
“ আমার? ” আমি জানতে
চাইলাম,
“আমি আবার কি
করলাম?”
“ এই সাহেবের ছায়া যেমন সাহেবের সাথে ঘনিষ্ঠ সেরকম সাহেবের
সাথে ঘনিষ্ঠ এই রহস্যময় ব্যক্তিটি কে তা জানতে প্রত্যেকে মরিয়া হয়ে উঠেছে”।
“ নাকি সেই ব্যক্তি সাহেবের ছায়ার মতো তার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে
আছে?”
“ নাকি সাহেব সেই ব্যক্তিকে তার ছায়ার মতো ঘনিষ্ঠ করে রেখেছে,” বলে তিনি হেসে উঠলেন।
“ তাহলে এইসব মরিয়া লোকগুলোকে আমি কে তা বলেন না কেন এবং তাতে
তাদের শান্তিও হয়? ”
“ যদি তাদের বলি, তবেতারা আরো মরিয়া হবে না কিন্তু আপনার
আর কোনো শান্তি থাকবে না। ”
তখন তিনি জানালেন লোকজনসব সময় তার কাছের বন্ধুদের নজরে রাখে যাতে সেই সব বন্ধু
তার পক্ষ হয়ে তার জন্য সুপারিশ করে। তার মতে যদি আমার নাম ও ঠিকানা তারা জানতে
পারে, আমাকে সব সময় জ্বালাতন করবে
তারা।
“ কিন্তু আমি তো কয়েকদিনের মধ্যেই চলে যাচ্ছি।”
“ যেখানেই যান, পোস্টাল সার্ভিসের পক্ষে খুঁজে বের করা কঠিন কিছু না।”
“ তাহলে আমি অপরিচিত হয়েই থাকি।”
“ ঠিকই, আমি নিজে খুব
সর্তক থাকি এবং আপনাকেও সর্তক থাকার জন্যবলছি।”
এরপর তিনি তার অফিসের কাজ নিয়ে
ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার অধীনকর্মচারীদের
ডেকে ডেকে নির্দেশনা দিতে থাকলেন। আমি মনোযোগ না দিয়ে আমার সাথে আনা বইটা পড়তে
লাগলাম। কোনরকমে আট দশ পাতা শেষ করতেই আমার বন্ধুর গলার আওয়াজ পেলাম।
“ কি বই পড়ছেন?”
“ তেমন কিছু না,” বইটা তাকে দিয়ে
বললাম,
“ বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় এটা পড়ার জন্য সাথে করে এনেছি। আজিমাবাদে আসার পথে বইটা পড়ার ফুসরত পাইনি”।
তিনি জোরে জোরে বইটার নাম উচ্চারণ
করলেন।
“ এটা আমার এক সময় অন্যতম প্রিয় বই ছিল।” আমি বললাম
“ এটা নিয়ে আমি পাগলপ্রায় ছিলাম তখন। এর অনেক অংশ এখনো আমার
মুখস্থ আছে।”
“ আমারও।”
“ আপনি কি জানেন বইয়ের লেখক আজও বেঁচে আছেন আর তিনি এই শহরেই
থাকেন?”
“জানি। ”
“আমার মনে হয়, একদিন উনার সাথে আমরা দেখা করতে পারি,” তিনি বললেন, এবং অলসভাবে বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলেন। এরপর তিনি নিচু হয়ে
মেঝে থেকে কিছু একটা তুললেন। ভালমত পরখ করতে লাগলেন। সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে
বললেন,
“ভদ্রমহিলার পরিচয় ---?”
ওটা এক তরুণীর ফটো। ফটোর কাগজ
হলদেটে হয়ে গেছে। কিন্তু চেহারা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। চুলের গোছা কাঁধের দিকে জলপ্রপাতের মতো নেমে গেছে। চোখে এক রহস্যময় দ্যুতি।
আর ঠোঁটে দুঃখের হাসি। যেন আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে আছে।
কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে
থাকলাম। তারপর বললাম, “ আপনিই বলেন।”
“আমাকে বলেন, ” তিনি বললেন, “যেহেতু তরুণীর
ফটো আপনার কাছ থেকেই বের হয়েছে।”
তিনি আমাকে খোলা বইটা দেখালেন। বইয়েরপাতা ধূসর হয়েগেছে। কিন্তু ডান এবং
বাম পাতায় ফটো সাইজের জায়গাটুকুতে সাদা আয়তক্ষেত্র বোঝা
যাচ্ছে। ফটোটাহাতের তালুতে রাখলাম। মনযোগ দিয়ে পরখ করলাম।
মুখ আমার দিকে তাকানো আর ঘাড় সামান্য বাঁকানো যা আমার পরিচিত লাগছে। কিছুক্ষণের
জন্য মনে হলো ফটোটাকোনো বিখ্যাত নায়িকার। তারপর বুঝলাম আমার
ধারনা ভুল। ফটোটা উল্টালাম। পেছনে কাচা হাতে লেখা, “মরিচিকা নই আমি, আমি বাস্তব।”
এ শব্দগুলো আমার পরিচিত। এটি সেই
নায়িকার ডায়লগ, সম্ভবত তার অভিনীত প্রথম সিনেমা, যা অতিদ্রুত বিখ্যাত
হয়ে যায়। পিছনের দিক উঁচু করে ধরে ফটোটা আমার বন্ধুর হাতে দিলাম। তিনি লেখাটি
পড়লেন এবং অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। তারপর নাটকীয় নানা ভঙ্গিতে শব্দগুলো আওড়াতে লাগলেন। মনে হলো আমার মন যেন পেছনের দিকে, অনেক দূরে মিলিয়ে গেল। ফটোটা যখন আমার হাতে তখন যেন নানা দৃশ্য তৈরি হয়ে আমার
সামনে ভেসে এসে মিলিয়ে যেতে থাকলো। বন্ধুর গলার আওয়াজ পেলাম আবার।
“মরিচিকা নই আমি,” তিনি এমনভাবে
উচ্চারণ করলেন যেন এক বিশাল রহস্য উন্মোচন করলেন। “আমি বাস্তব।”
ফটোর ছবিটার মতো করে মুখ করে তিনি
আমার দিকে তাকালেন।
“উনি আমার বড় বোনের বন্ধু ছিল। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান।” আমি বললাম।
“ আপনি কেন আপনার সাথে তার ফটো বয়ে বেড়াচ্ছেন?”
“ বইটা আমার বোনের, ” আমি উত্তর দিলাম, “ আর মনে হয় চল্লিশ বছর পর এটা খোলা হলো। শেষ যখন এ ফটোটা দেখি তখন এটা নতুন এবং
ঝকঝকে ছিল।”
আমার কাছ থেকে তিনি ফটোটা নিলেন।
কয়েক মুহূর্ত গভীরভাবে দেখে বললেন, “অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান?আপনার সাথে পরিচয় কীভাবে?”
“ ক্রিশ্চিয়ান স্কুলে আমার বোনের সাথে পড়তেন। কয়েক জন ছাত্রীগ্রুপে আমাদের বাড়িতে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেন। আমাদের বাড়িটা
তখন খুব হইহুল্লোড়ে ভরা থাকতো। ”
আমার বন্ধু ফটোটা আবার উল্টালেন। “মরিচিকা নই আমি, আমি বাস্তব, ” পড়লেন।
“ সাহিত্যে কি আগ্রহী ছিলেন?”
“ ঠিক তা না। এটা একটা ফিল্মের লাইন,” আমি উত্তর দিলাম। “কিন্তু উনার ভাই গল্প লিখতেন। নওবাহার গুলরেজ ছদ্মনামে।”
“নওবাহার গুলরেজ?” তিনি ভেঙচি
কাটেন। এ ধরনের কাব্যিক নাম তিনি পছন্দ করেন না।
“ কখনও এ নাম শুনিনি।”
“ আমার ভাইয়ের সাহায্য নিতে গল্পগুলো তিনি নিয়ে আসতেন,” আমি ব্যাখ্যা দিই, “কিন্তু সেগুলো কখনই প্রকাশের উপযোগী হয়নি”।
“ আপনার ভাই ঠিক করে দেওয়ার পরও হয়নি?”
“ আসলে তার গল্পে ঘটনার চেয়ে ফিল্মের গান থাকতো বেশি।”
“ নওবাহার গুলরেজ।” তিনি মুখে আরেক ভঙ্গি করলেন। “মহিলার নামটা কি যেন?”
“সেটাই মনে করার চেষ্টা করছি। উনি কোন সুগন্ধি ব্যবহার করতেন
সেটা আমার মনে আছে। পারফিউমের খালি বোতলগুলো তিনি আমাকে দিতেন। ”
“খালি বোতল?”
“বোতলের গাঢ় নীল রঙ আমি পছন্দ করতাম।”
“ আরে, নীল রঙের কথা
যখন বললেন,” তিনি বলেন “ আপনি কি বিখ্যাত কবিরাজ জালিনুসের নতুন স্বপ্ন সম্বন্ধে
শুনেছেন?
আমি তার কাছ থেকে সম্প্রতি একটা চিঠি পেয়েছি। সেখানে তিনি
বলেছেন নীল রঙ দিয়ে তিনি এক প্যারালইজড
রুগির চিকিৎসা করতে সক্ষম হয়েছেন। আপনার কাছে কোনো চিঠি আসেনি? ”
“ হুম কিন্তু উনি কেবল যেসব রঙ আমাকে এড়িয়ে চলতে হবে সেগুলোর
তালিকা দিয়েছেন।”
“ ভয়ঙ্কর সে রঙগুলো কি?”
“ যে সব রঙের নাম আমার মনে আছে। তারপরও আরো কয়েকটা যার মধ্যে
আবার দুটো আমার মত মেজাজের মানুষের জন্য ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।”
অফিসে বসে বাদবাকি সময় এই কবিরাজকে নিয়ে মজা করে কাটিয়ে দিলাম। অধিক বয়স তার মনের উপর প্রভাব ফেলেছে। আমাকে এবং আমার বন্ধুকে লম্বা লম্বা চিঠি দেন। সেসব চিঠিতে তার চিকিৎসার কথা বেশি থাকে - কী দুর্দান্তভাবে তিনি রোগ সারিয়েছেন। এটা তার বিশ্বাস যে, এ দুনিয়ায় একমাত্র আমরা দুজন তার কাজের মর্ম বুঝতে পারি। তিনি জানেন না যে আমরা তাকে “কবিরাজ জালিনুস” বলে খ্যাপায়।
৩
আমার ফেরত আসার সময় ঘনিয়ে আসছে।
আমার বন্ধুর তিন দিনের ছুটি। তারপর আমারও বিদায় নেয়ার পালা। ছুটি শুরুর একদিন আগে, আমি উনার অফিসে বসা। তিনি তার গাড়ির ড্রাইভারকে নির্দেশনা
দিচ্ছিলেন। ড্রাইভার বিদায় নেয়ার মুর্হূতে তাকে থামালেন এবং আমার দিকে ফিরলেন।
“এখানে যদি আপনি কারো সাথে দেখা করতে চান তাহলে গাড়ি নিতে
পারেন।”
“এখানকার আমার আর আপনার বন্ধু একই। আমার সবার সাথেই দেখা
হয়েছে। একজনের সাথেই দেখা হয়নি আর সেটা হলো আপনি।”
তিনি প্রথমে জোরে হেসে উঠলেন
তারপর গম্ভীর হয়ে অফিসে তার অতিরিক্ত কাজের চাপ নিয়ে অভিযোগ করলেন।
কাল থেকে আমরা এক সাথে বসবো এবং
মনভরে আড্ডা দেবো, ” এই বলে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন এবং ড্রাইভারকে চলে যাওয়ার ইশারাকরলেন।
“ সেদিন বইয়ের ভেতর যে ফটোটা আমরা দেখলাম আপনি চেনেন তাকে?”
“ যে মরিচিকা নয় - বাস্তব সেটা? ”
“ হ্যাঁ। তখনও যিনি ছিলেন না, এখনও নাই,” আমি বললাম, “আমার যতটুকু মনে পড়ছে তাতে মনে হয়
তিনি হয়তো এই শহরে বাস করেন। ”
“ উনার নাম মনে আছে?”
“ পারিবারিক নাম রে এটুকুই শুধু মনে আছে।”
“ আর তিনি এই আজিমাবাদে থাকেন?”
“অনেক বছর আগে শুনেছি, এখন যদিও মনে করতে পারছি না, তারা কীভাবে
আজিমাবাদে চলে এসেছিলেন। জানি না এখনও এখানে বাস করেন কি না।”
“ আমরা খুঁজে বের করতে পারি।”
“ সেটা কঠিন।”
“ আমার ডিপার্টমেন্টের জন্য না। খালি দেখেন। ”
তিনি পিয়নকে ডাকতে ঘন্টা বাজালেন
এবং অর্ডার করলেন, “ফ্রাঙ্ককে আসতে বলো।”
ফ্রাঙ্ক মধ্য বয়সী। ফিটফাট পোশাক
তার। আগেওতাকে এ অফিসে দেখেছি। ভেতরে ঢুকে
আমাদের দুজনকেই সালাম দিলেন। এরপর আমার বন্ধুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
“ ফ্রাঙ্ক” বন্ধু আমার দিকে ইশারা করে বললেন, “ এখানে বাস করে একজন খ্রিষ্টান মহিলার
সাথে উনার দেখা করতে হবে। মহিলার পারিবারিক পদবী রে। আমরা
তার আসল নাম কিংবা ঠিকানা জানি না। ”
“ উনার নাম অ্যাঞ্জেলা,” আমার হঠাৎ নামটা
মনে পড়ে গেল। “অ্যাঞ্জেলা রে।”
“ উনি কোথায় থাকেন তা আমাদের দ্রুত বের করতে হবে। যেহেতু উনি তিন দিন পর চলে যাবেন।”
“ আমরা তাকে খুঁজে বের করতে পারবো, স্যার,” ফ্রাঙ্ক তড়িৎ
উত্তর দিল। “ কাল,
অথবা সর্বোচ্চ পরের দিন। আমি আপনাকে জানাচ্ছি। ”
“ ঠিক আছে। আমরা বাড়িতে অপেক্ষা করবো।”
ফ্রাঙ্ক সালাম দিয়ে বের হয়ে যাওয়ারসময়পেছনে ফিরে দরজার কাছেএসে থামলেন
এবং জিজ্ঞাসা করলেন, “ আমরা যদি খুঁজে বের করতে পারি উনাকে কি বলব?”
আমার বন্ধু উত্তর দিল, “ উনাকে বলবেন এক পুরাতন বন্ধু---” তিনি থামলেন।
“ পুরাতন এক বন্ধুর ভাই,” আমি বললাম।
“ তার পুরাতন এক বন্ধুর ভাই এখানে বেড়াতে এসেছেন এবং তিনি
দেখা করতে চান।”
“ স্যার, যদি উনি নাম
জিজ্ঞাসা করেন?”
“ সব কিছু সময় মতো হবে,” আমার বন্ধু বললেন, “আগে খুঁজে বের
করুন উনি কোথায়?”
৪
ফ্রাঙ্ক দুতিন বাদে ফেরত আসলো।
তখন বিকেল বেলা। তাকে পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে। মুখে লজ্জার ছাপ। সাথে সাথে তিনি
জানালেন,
“রে খান্দানের
কোন সন্ধান পাইনি। ”
আমার বন্ধু আমার দিকে তাকালেন।
“ বাদ দেন তাহলে,” আমি বললাম, “উনারা নিশ্চয়
অন্য শহরে চলে গেছেন।”
“ ঠিকই,” আমার বন্ধু
বললেন,
“ উনি বহুত আগেই, জানতে
পেরেছিলাম---”
“ না, স্যার,” ফ্রাঙ্ক বলল, “ যদি রে খান্দান এখানে কখনও বাস করে থাকতো, তাহলে তাদের আমরাঠিকই খুঁজে বের করতে পারতাম। ছোট একটা জনগোষ্ঠী, সবাই সবাইকে চেনে।” এরপর তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ স্যার, কিছু মনে করবেন না, আপনি কি তাদের নাম ঠিকঠাক মনে করতে পারছেন?”
“ হ্যাঁ, আমার তো তাই মনে
হয়,” বললাম “তার নাম অ্যাঞ্জেলা রে। ভাইয়ের নাম---”
“ আরে, গুলশান-ই-হামেশা
বাহার।” বন্ধু ফিসফিস
করে বলে হেসে উড়িয়ে দিলেন।
“ নওবাহার গুলরেজ,” আমি তার
ফিসফিসের প্রতিউত্তর দিলাম, তারপর ফ্রাঙ্ককে
বললাম,
“ তার ভাইয়ের নাম জুলিয়ান রে। এক বোনের নাম ম্যাডেলিন। সবার বড় একটা বোন----” বোনটার কথা আমার মনে পড়লো। “ আর হ্যাঁ, ” আমার অন্য একটা বিষয় মনে পড়লো, “তাদের মা লক্ষৌতে মারা যান। উনার ক্যান্সার হয়েছিল।”
এবং আমি কেঁপে উঠলাম।
৫
আমি অ্যাঞ্জেলার মাকে তখনও
দেখিনি। কিন্তু উনার অসুস্থতা নিয়ে আমাদের বাড়িতে আলোচনা হতো। তখন শুনেছিলাম তার
বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই। তার জীবনের শেষের দিকে তাকে আমরা দেখতে গিয়েছিলাম।
সেটাই ছিল আমার প্রথম এবং শেষ অ্যাঞ্জেলার বাড়ি যাওয়া। অ্যাঞ্জেলা বাড়িতেই ছিলেন।
বাড়িটা ছোট কিন্তু ছিমছাম। সামনে ছোট খোলা জায়গা, ঘাসে মোড়ানো- একে বাগানই বলা যায়। কারণ দুতিনটে ফুলের সারি, আর একটা চিরসবুজ গাছের ঝাড়। বাড়ির পেছনে দূরে ইউক্যালিপটাস গাছ - বাতাসে দোল খাচ্ছিল। সূর্য
ডোবার সময় আমরা পৌঁছেছিলাম।
বাগানের গেটের কাছে অ্যাঞ্জেলা
আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সাদামাটা পোশাক পরা। তিনি আমার বোন এবং অন্য মেয়েবন্ধুদেরসাথেএক এক করে কোলাকুলি করলেন। তারপর আমাকে দেখে বললেন, “ আরে তুমিও এসেছো!”
এরপর তিনি বাড়ির সামনের অংশের
একটা ঘরে আমাদের নিয়ে গেলেন। আমাদের বসতে দিয়ে ঘরথেকেবের হয়েগেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আবারতিনি ফেরত আসলেন। বন্ধুদের সাথে চাপা গলায় কথা বলতে শুরু করলেন। ঘরের
আসবাব সাধারণ মানের কিন্তু সেগুলো রাখা অতি যত্নের সাথে। মনে
হচ্ছিল যেন এই মাত্র ঝাড়া-মোছা করা হয়েছে। অল্পক্ষণের মধ্যে ম্যাডেলিন ঘরটিতে
প্রবেশ করলেন আর অ্যাঞ্জেলা উঠে দাঁড়ালেন।
“আসো” তিনি মেয়েদের গ্রুপকে বললেন। আমরা যখন ঘরটা থেকে বের হচ্ছিলাম, তিনি আমাকে বললেন, “ তুমি চাইলেএখানেই থাকতে পারো।”
কিন্তু আমি তাদের পেছন পেছন
গেলাম। ডান দিকের সরু বারান্দায় একটা দরজা। আর আরেকটা দরোজা আরো নিচের দিকে। আমরা
শেষ দরোজা দিয়ে ঢুকলাম। ঢুকেই একটা
ছোট রুম। ওষুধের গন্ধ পেলাম। এ গন্ধে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ওষুধের টেবিলটা ছাড়াও, রুমের ভেতর বড় একটা পালঙ্ক আর একটা ছোট শিশুদের খাট। খাটে
সাদা চাদরের উপর বাদামী রঙের তুলার কম্বল দলামোছা হয়ে আছে।
শিশুদের খাটের পাশে পালঙ্কের উপর
মোটাসোটা এক মহিলা বসা। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন তিনি চোখ খুলতে পারছেন না। সব
মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে। আমার কাছে তাকে অসুস্থ মনে হলো না। অন্তত উনাকে নিয়ে যে
হতাশাব্যঞ্জক আলোচনা শুনেছি তার তুলনায়। যদিও তার কথাবার্তায় হতাশা ফুটে উঠছিল।
যখন কেউ তার সাথে কথা বলছিল, তিনি বলছিলেন
সারা রাত ঘুমোতে পারেননি তাই তার মাথা কোনো কাজ করছে না।
তিনি আমাদের বলছিলেন, তারা জুলিয়ানকে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে তার মাকে দেখতে আসার জন্য।
তিনি খুব হতাশ কারণ এখনো দেখতে আসেননি। এ বিষয়ে তিনি অ্যাঞ্জেলাকে কিছু জিজ্ঞাসা
করলেন এবং অ্যাঞ্জেলা মুখে রুমাল ঢেকে কিছু বললেন।
ছোট খাটের কাঠের ফ্রেমে আমার কনুই
ভর করে দাঁড়িয়ে আমি মহিলার দিকে তাকিয়েছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম খাটটি কেঁপে উঠলো।
পালঙ্কে বসা মহিলাকে আমার বোন শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছিল। মহিলার খাটের দিকে
ইঙ্গিত করে দেখালেন। তারচেহারাহতাশায় ভরা।
খাটটা আবার কেঁপে উঠলো এবং বাদামী রঙের কম্বলটা নড়তে শুরু করলো। কম্বলের নিচে শরীর
দেখতে পেলাম না। কিন্তু অনাবৃত মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। একজন বিধ্বস্ত বিবর্ণ বৃদ্ধাআমার দিকে ঘুরলো। তার
চোখ দুটো বন্ধ। কোঠরের গভীরে। মুখে কষ্টের চিহ্ন । বৃদ্ধা
জোরে জোরে কষ্ট করে হাসছেন। তার দুটো সারির শেষ পেষণদাঁত
পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। রুমের নীরবতার মাঝে আমি অ্যাঞ্জেলার জোরে ফোঁপানোর আওয়াজ
শুনতে পেলাম এরপর তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন. “তাকিও না।”
কিন্তু আমি দেখলাম বৃদ্ধার শুকনো ঠোঁট দুটো শক্ত হয়ে গেছে কিন্তু তারপরও তার দু
সারি দাঁত তখনো দেখা যাচ্ছে। তখন বুঝতে পারলাম উনি আসলে হাসছেন না। তার ডান গালের
মাংস ঠোঁটের কোণা থেকে কান পর্যন্ত ক্ষয়ে গেছে।
চেষ্টা করেও উনার সেই হাসির দাঁত
থেকে আমার চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। আমার হাঁটু কাঠের খাটে আটকে গিয়েছিল। এটা যেন
এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। কিন্তু আমার চোখ কিছুতেই বন্ধকরতেপারছিলাম না তা শেষ হওয়ার জন্য। চোখ দুটো বন্ধের আর কোনো উপায়ই খুঁজে
পাচ্ছিলাম না। আমি চেষ্টা করছিলাম কিন্তু আমার চোখ তা করতে দিচ্ছিল না। আমি পেছনে
যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু খাটের কাঠের ফ্রেম আমার হাঁটু ধরেছিল যা থেকে ছাড়া
পাচ্ছিলাম না।
এর রকম দ্বিধার মধ্যে আমার কাঁধে
অ্যাঞ্জেলার হাত অনুভব করলাম। আস্তে আস্তে তিনি আমাকে তার দিকে টেনে নিলেন। আমার
হাত ধরে রুমের বাইরে নিয়ে গেলেন। সরু বারান্দা ধরে তিনি আমাকে মাঝের রুমে
নিয়ে গেলেন।
সেখানে ঝাপসা চোখে দেখতে পেলাম
একটা খাবার টেবিল যাতে নানা রকমের খাবার, গ্লাস এবং পেপার ন্যাপকিন। টাটকা ফল আর পেস্ট্রির সুবাস বেরুচ্ছিল রুমের ভেতর
কিন্তু তা আমাকে আকর্ষণ করল না। অ্যাঞ্জেলা অনেকগুলো খাবার একটা থালায় নিলেন এবং
আমাকে খাওয়ার জন্য দিলেন। কিন্তু আমি তা খেতে অস্বীকৃতি জানালাম। ভাঙ্গা ভাঙ্গা
কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম, “ বড় খাটে বসা মহিলা কে?”
অ্যাঞ্জেলা বললেন তিনি তাদের বড় বোন, তাদের মায়ের অসুস্থতায় তার সেবা করার জন্য এখানে এসেছেন। এরপর তিনি আমাকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলেন, বারবার তিনি বোঝাতে চাইলেন তার মা সবসময় এরকম অসুস্থ থাকেন না। তার রুমাল দিয়ে আমার মুখ মুছিয়ে দিলেন। আমি তার চোখের আর্দ্রতা টের পেলাম এবং গাঢ় নীল বোতলের হালকা সুগন্ধ অনুভব করলাম। অ্যাঞ্জেলাদ্রুত রুম থেকে চলে গেলেন এবং একটা অ্যালবাম হাতে নিয়ে ফেরত এলেন। তিনি তার মায়ের পুরাতন ফটো দেখালেন। তার মুখ অ্যাঞ্জেলার মতই দেখতে এবং হাসিতে টোল ঠিক তার মেয়ের মতই। অ্যাঞ্জেলা আমাদের বললেন কোন অনুষ্ঠানে কোন ফটো তোলা হয়েছে। অনেক ফটোতে তার মাকে অ্যাঞ্জেলা মনে করে ভুল করলাম যদিও বেশিরভাগ ফটোতেই অ্যাঞ্জেলা তার মায়ের কোলে না হয় তার হাত ধরা ছিল। ম্যাডেলিন আমার বোন এবং অন্য মেয়েদের সাথে আসার আগ পর্যন্ত আমি ফটোগুলো অমনোযোগীহয়ে দেখছিলাম।
* * * *
ফ্রাঙ্ক এবং আমার বন্ধু কোনো একটা
বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করছিল তখন আমার মনে হলো অ্যাঞ্জেলা যেন আমার কাঁধ থেকে তার
হাতটা সরিয়ে নিলেন। তারা শহরের নানা পোস্ট
অফিস এবং সেসব অফিসের স্টাফদের নিয়ে কথা বলছিলেন। ফ্রাঙ্ক
আবার আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং আমাকে বললেন, “ স্যার, মহিলা কি কখনও বিয়ে করেছিলেন?”
“ জানি না,” আমি উত্তর করলাম, “ তবে আমার ধারনা তিনি অবশ্যই করেছিলেন। চল্লিশ বছর আগে তিনি বিবাহিত ছিলেন না।”
“ মানে আমি বলতে চাচ্ছি তিনি বিবাহিত হলে তার নামের সাথে আর
রে নাই।”
“ ঠিকই, আমরা এটা চিন্তা
করিনি,” আমার বন্ধু বলা শুরু করলেন, “ যদি তিনি
বিবাহিত হন, ধরে নিই, আমাদের ফ্রাঙ্কের সাথে---”
“ স্যার---” ফ্রাঙ্ক কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু লজ্জা পেয়ে হেসে উঠলেন।
“ ---- তাহলে তিনি এখন অ্যাঞ্জেলা ফ্রাঙ্ক কিংবা শুধু মিসেস
ফ্রাঙ্ক”। তিনি ফ্রাঙ্কের দিকে ফিরলেন।
“ তাহলে আমি কি মিসেস ফ্রাঙ্ককে এই ক্রিসমাসে তার নাম
জিজ্ঞাসা করতে পারি?”
ফ্রাঙ্ক বললেন, “ স্যার,” আবার তিনি লজ্জায় চুপ হয়ে গেলেন।
“ আমার মনে হয় এখন এই মহিলার ব্যাপারটা আমরা বাদ দিতে পারি, ” আমার বন্ধু বললেন, “ ফ্রাঙ্ক এমন একজন মানুষ যে অ্যাঞ্জেলা নামটা দিয়ে উনাকে খুঁজে বের করতে পারবেনা। যদি না পারে---”
“ আসলে স্যার আমি নামের রে অংশটাতে বেশি গুরুত্ব দিয়ে খুঁজেছি
অ্যাঞ্জেলা অংশের চেয়ে।”
“ তারপরও,” আমার বন্ধু
বললেন,
“ আমার মনে হয় না উনি কখন আজিমাবাদে বাস করেছেন।”
“ হতে পারে,” আমি বললাম “মনে হয় আমার স্মৃতি আমার
আমাকে পরাজিত করেছে।”
আমার বন্ধু ফ্রাঙ্ককে ধন্যবাদ
জানালেন আর আমি উনার কাছে ক্ষমা চাইলাম। ফ্রাঙ্ক চলে যাবার সময় বললেন, “ এটা কোনো বিষয় না স্যার।” তিনি কিছুক্ষণ গভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, যেন কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাইছেন। তারপর একটা সালাম দিয়ে
বেরিয়ে গেলেন।
“ তাহলে, ” আমার বন্ধু
নাটকীয় কণ্ঠে বললেন, “ লেডি অ্যাঞ্জেলা রে, কিংবা অ্যাঞ্জেলা এক্স। আমরা আপনাকে খুঁজেপেতে ব্যর্থ হলাম।”
“ আমরা সত্যিকার অর্থে তাকে খুঁজছি না, ” আমি বললাম, “ তাই ব্যর্থতা বা সফলতা----”
“ আর তাই, লেডি অ্যাঞ্জেলা
রে,
কিংবা অ্যাঞ্জেলা এক্স,” বন্ধু সেই
নাটকীয় স্বরে বললেন, “আপনি নিজেকে মরিচিকা প্রমাণ করলেন, বাস্তব নন।”
“ কিন্তু চল্লিশ বছর আগে ---”
“ চল্লিশ বছর আগে, অ্যাঞ্জেলা, আপনি ছিলেন বাস্তব, মরিচিকা নন।”
“ যদি আপনি এমনভাবে বলতে থাকেন, ” আমি বললাম, “ লেডি অ্যাঞ্জেলার অভিশাপ আপনার উপর পড়বে। তখন আপনি শুধু
এভাবে কথাই বলবেন না লিখবেনও এভাবেই। ”
“ লেডি অ্যাঞ্জেলা, যদি আমি অভিশপ্ত হই, আমি প্রতিজ্ঞা করছি আমাদের কবিরাজ জালিনুসের আত্মঘাতী রঙ দিয়ে আত্মহত্যা করবো।” এভাবেই তিনি আলোচনারসমাপ্তি টানলেন।
৬
সে রাতে আমরা দুজন মিলে কবিরাজ
জালিনুসের কাছে যখন যৌথ চিঠি লিখছিলাম তখন ফোন বেজে উঠল। আমার বন্ধু রিসিভার তুললেন। তিনি কিছুক্ষণ কথা শুনলেন এবং
তারপর বললেন, “এক মিনিট,” তারপর আমার দিকে
ফিরলেন। মাউথপিসের উপর একটা হাত রেখে বললেন, “ আমার মনে হয়
বিখ্যাত ছোটগল্পকার গুলজার-ই পূর্বাহারের সন্ধান পাওয়া গেছে।”
“ জুলিয়ান রে?” আমি জিজ্ঞাসা
করলাম।
“ এখানে আসুন,” তিনি রিসিভার
সরিয়ে আমাকে বললেন, “ ওর সাথে কথা বলুন।”
আমি দাঁড়ালাম। “জুলিয়ান নিজেই?”
“ না। ফ্রাঙ্ক।”
“ তাহলে আপনিই কথা বলুন” বলে আমি বসে পড়লাম।
“ হ্যাঁ, ফ্রাঙ্ক---” আমার বন্ধু বললেন এবং অপর
প্রান্তের কথা নীরবে শুনতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, “ কোথায়--- কবে তা ঘটেছিল? --- সেটা
পরিস্কার----না, আমি দানিয়েলকে চিনি, তিনি পাগল হয়ে গেছেন --- প্রতি বছর তিনি তার বয়স পাঁচ থেকে
দশ বছর কমান না হয় বাড়ান --- তো, এর কোনো অর্থ
নাই-- ঠিক আছে দেখুন।”
তিনি রিসিভার রেখে বললেন, “ ফ্রাঙ্ক একজনকে খুঁজে পেয়েছে যে রে পরিবারের এক যুবককে গিটার বাজানো শেখাতো।
তার যুবকের আসল নাম মনে নাই; মনে হয় ফ্রাঙ্ক
তাকে জিজ্ঞাসা করেনি।”
“ কে তিনি?”
“ দানিয়েল বার। তিনি এক শহর থেকে আরেক শহরে গিয়ে গিটার বাজানোশেখাতন। তিনি সাময়িকভাবে স্কুল চালাতেন এবং সেখানে গিটারও
বিক্রি করতেন। তার কাস্টমার স্বাভাবিকভাইে ছিল তারই শিক্ষার্থীরা। ”
“ আর জুলিয়ান?জুলিয়ানের কোথায় রে পরিবারের যুবকের সাথে দেখা হলো? ”
“ এটাই মুশকিল। তিনি আমাদের কবিরাজ জালিনুসের চেয়েও বয়স্ক -
সময় এবং স্থান তার জন্য ধরে নেয়া যেতে পারে আলাদা অর্থ। তিনি বলেছেন যে তার রে -এর
সাথে কুড়ি বছর আগে দেখা হয়েছিল। কিন্তু কুড়ি বছর তার কাছে সহজেই দু’বছর কিংবা দুশো বছর হয়ে যায়।”
“তাহলে কোথায় তিনি তার সাথে দেখা করেছিলেন?” জিজ্ঞাসা করলাম।
আমার বন্ধু দাঁত পড়ে যাওয়া এক
বৃদ্ধের মতো কাঁপা ও নড়বড়ে কণ্ঠে বললেন, “ উত্তরের এক শহর
নাকি সেটা ছিল দক্ষিণে?” তিনি ভেঙচান, “ তিনি পুরোপুরি
খ্যাপাটে মানুষ কিন্তু আর্টে একজন উস্তাদ।”
“ তাহলে আমরা খুঁজে কিছুই পেলাম না। ”
“ কিছুই না। তবে একটা হালকা সম্ভাবনা আছে দানিয়েল রে-ই হলো
আমাদের জুলিয়ান।” এবং তিনি অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে বললেন, “ ফ্রাঙ্ক
প্রার্থনা করছে যে তিনিই সেই ব্যক্তি।”
“ তাকে কি লাভ হবে?”
“ লাভ?তাহলে শোনেন।
দানিয়েল হয়তো মনে করতে পারবেন যুবক রে’কে কারণ গিটার শিক্ষা শুরুর অল্পদিনের মাথায় তিনি আত্মহত্যা
করেছিলেন। ডাক্তার তাকে বলেছিল তার ক্যান্সার হয়েছে।”
আমরা দুজনই নীরবে কিছু সময় বসে
রইলাম।
“ তাকে কি?এটা আমাদের কীভাবে সাহায্য করবে?” আমি অবশেষে বললাম।
“ মানে যদি দানিয়েলের ছাত্র আমাদের নওবাহার হয়, মানে আমাদের জুলিয়ান রে। তাহলে ফ্রাঙ্কের ধারনা তার মাধ্যমে
আমরা অ্যাঞ্জেলার অবস্থানের একটা যোগসূত্র বের করতে পারবো।” তিনি আবার তার অদ্ভুত হাসি
দিলেন। “অজ্ঞাত এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলাকে
খোঁজার চেয়ে বরং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলা যার ভাই আত্মহত্যা
করেছিল তার খোঁজ পাওয়া সহজতর হবে। ”
৭
আমার অফিসার বন্ধুটির নিজেরই কিছু
সমস্যা আছে। আমরা তার এই বিষয়গুলো নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত আলাপ করি এবং পরের দিন
অনেকক্ষণ ঘুমাই। নাস্তার থালাবাটির শব্দে আমার ঘুম ভাঙ্গে। এরপর আমার বিছানার কাছে
বন্ধুর উঁচু গলার আওয়াজ শুনতে পাই।
“ ভয়ঙ্করষড়যন্ত্রকারীরহস্যময়রিংলিডারআরকতক্ষণঘুমোবেন?
”
“ যদি আমাকে বলেন, ” আমি বললাম, “ তাহলে আমি জেগে আছি। ”
“ আমি আপনাকেই বলছি এবং কেবল আপনাকেই।”
এরপর তিনি খারাপ কাগজে খুবই নিম্নমানের ছাপানো একটা ট্যাবলয়েড পত্রিকা আমার কোলে ছুঁড়ে দিয়ে
বললেন, “এটা পড়েন।”
এটা হলো সেই ধরনের খবরের কাগজ যা
নিয়মিত দু তিন দিন পর বের হয় আবার বন্ধ হয়ে যায় আর শিরোনামগুলো ভেতরের খবরের চেয়েও
স্পর্শকাতর হয়। প্রথম পাতায়, অনেকগুলো
শিরোনামের মধ্যে একটা হলো, একজন রাজনৈতিক
উচ্চাকাঙ্খীর নির্বাচনের ভাষণ যেখানে তিনি জাতির উন্নতির অন্তরায় হিসেবে
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নিন্দা করেছেন। আমি শিরোনামের মধ্যে আরো সংবাদ খুঁজছিলাম তখন
আমার বন্ধু বললেন, “এগুলো ছাড়েন। তৃতীয় পৃষ্ঠায় যান। ওখানেই আসল খবর।”
তৃতীয় পাতার শিরোনামের খবর থেকে
বোঝা যাচ্ছে যে, গত তিন চার দিন ধরে কিছু
অপরিচিত লোক পোস্ট অফিস ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী ভান করে একজন কাল্পনিক নারীকে
খোঁজার নামে শহরে খিৃষ্টান জনগোষ্ঠীর গোপন খবর সংগ্রহ করছে। এটা মনে হচ্ছে
শান্তিপূর্ণ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র। এবং খবরের কাগজের
রিপোর্টাররা এই ষড়যন্ত্রের রিংলিডারের গতিবিধি গভীরভাবে নজরে রেখেছিলেন। সংখ্যালঘু
জনগোষ্ঠী এটা নিশ্চিত করেছে যে, তারা এই ষড়যন্ত্র অঙ্কুরেই বিনষ্ট করবে।
খবরের কাগজটি মুড়ে টেবিলের উপর রেখে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কে এই জঞ্জাল
ছাপিয়েছে?”
আমার বন্ধু প্রথম পাতায় লেখা
রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খী ব্যক্তির নামের উপর আঙুল রাখলেন এবং বললেন, “ তার নির্বাচনী এলাকায় কিছু খিৃষ্টান পরিবার বাস করে।”
“ এ খবর এলাকায় দাঙ্গা সৃষ্টি করতে চলেছে, তাই নয় কি?”
“ না। আসল কথা হলো এ কাগজে যে খবর ছাপা হয় তা মিথ্যে বলে
প্রমাণিত।”
“ তারপরও ফ্রাঙ্কের আরো সাবধান হওয়া উচিত ছিল। আপনার তাকে থামানোউচিত।”
“ আমি তাকে অনেক আগে থামাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু---” তিনি থামেন, “ কাল্পনিক মহিলা!” বলে তিনি মুখ ভেঙচান।
“ কিন্তু ফ্রাঙ্কের সামনে এখন রে খান্দানের একজন যুবক আছে
যিনি তাকে সন্ধান দিতে পারবেন। এমনকি উনি যদি দানিয়েলও হন, তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী।”
“ দানিয়েল বরং তার অনস্তিত্বের সাক্ষী, ” আমি বললাম, “ যা হোক, ফ্রাঙ্ককে আগাতে বারণ করেন।”
“ ও থামবে না।”
“ তাকে বলেন আমি আজ চলে যাচ্ছি।”
“তিনি জানেন। আপনি তো ফ্রাঙ্ককে চেনেন না। এ শহর ছাড়ার আগে
তিনি একটা খবর আনবেনই।”
৮
ঐ রাতে আমার ভাল ঘুমের দরকার ছিল।
ট্রেনে ঘুম হবে এমন আশাবাদী ছিলাম না। তাই বিকেলে ছোট একটা ঘুম দিলাম। যখন উঠলাম
তখন প্রায় সন্ধ্যে। আমার বন্ধু বৈকালিক চা পানের জন্য অপেক্ষা করছেন। যখন আমি
উঠলাম তিনি তখন চাকরকে চা আনার জন্য বললেন। নীরবে চা পান শেষ করলাম। চাকর
পেয়ালাগুলো তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
“মিসেস মুর,” আমার বন্ধু
সতর্কভাবে বুঝেশুনে বললেন, “ উনি এখন মিসেস মুর।”
আমি উনার দিকে তাকালাম।
“ ফ্রাঙ্ক এসেছিল,” আপনি এমন অকাতরে
ঘুমোচ্ছিলেন যে, আপনাকে জাগানো বুদ্ধিমানের কাজ
হতো না।
নীরবে আমি উনার দিকে তাকিয়েই
রইলাম।
“দানিয়েলের যুবকটাকে খোঁজ করাটা কাজের হয়েছে, ” তিনি আমাদের বললেন, “ ওর নাম সেবাসটিয়ান।”
“ সেবাসটিয়ান? ”
“ তিনি অ্যাঞ্জেলার ভাই না। ভাইয়ের ছেলে। খুব ছোটকালে সে এতিম
হয়ে গেলে অ্যাঞ্জেলা তাকে দত্তক নেন।”
জুলিয়ান রে’কে আমার মনে পড়লো। আমি কিছু
বলি তার জন্য বন্ধু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন, তারপর তিনি বললেন, “ অ্যাঞ্জেলা এখানে, কিন্তু---” তিনি থামেন। আমার মনে হলো তিনি মনে মনে কথা সাজানোর চেষ্টা করছেন। “ তিনি এখন বিধবা। নিজের বাড়ি
বিক্রি করে দিয়েছেন। তার স্বামীর দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের সাথে থাকেন তিনি।
নিঃসন্তান এবং --” ।তিনি আবার মনে মনে কথা গুছানোর চেষ্টা করছেন “--- তিনিই রে খান্দানের একমাত্র
জীবিত ব্যক্তি”।
ম্যাডেলিন আর ওদের সবার বড় বোনের
কথা আমার মনেপড়ল।
বন্ধু আবার থামলেনআমি যেন কিছুবলি।
আমি বললাম, “ আপনি বললেন উনি এখানে থাকেন।”
“ হ্যাঁ ফ্রাঙ্ক
খুঁজে বের করেছে।”
“ ফ্রাঙ্ক কি উনার সাথে দেখা করেছেন?”
“ ওর দেখা করার প্রয়োজন আছে কি?”
আমার বন্ধুর দিকে তাকালাম।
“ তিনি এখন প্যারালাইজড।
অনেক বছর ধরে। উনার কোনো অনুভূতিই আর সচল নেই। কয়েক বছর হয়ে
গেল তিনি আর কোনোকিছুতেই সাড়া দেন না। তাদের ধারনা তিনি
কোমাতে চলে গেছেন।”
“ তিনি বাড়িতেই নাকি---? ”
“ এখনও বাড়িতেই, ”বন্ধু উত্তর দিল, “ আপনি কি ওর সাথে দেখা করতে চান --- দেখতে চান?ফ্রাঙ্ক ব্যবস্থা করতে পারবে। ”
“ না। ” আমি বললাম, “অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাকে ফেরার
প্রস্তুতি নিতে হবে।”
৯
আমি ট্রেনে চেপে বসার পর আমার
বন্ধু কিছুক্ষণের জন্য আমার পাশে বসলেন যতক্ষণ না ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। তারপর
উঠে দাঁড়ালেন।
“ ফ্রাঙ্ক সব তথ্য পেয়ে গেছে। বিস্তারিত,” তিনি বললেন, “আমি আপনাকে
লিখবো অবশ্য যদি আপনি চান। ”
“আরে আপনি তো এর মধ্যে সব কথা বলেই ফেলেছেন। আমাকে লিখতে
পারেন অবশ্য যদি ফ্রাঙ্ক আপনাকে নতুন কিছু বলে।”
“আচ্ছা তাই করবো।”
ট্রেন চলা শুরু করলো। উনি আমার
সাথে করমর্দন করলেন। “ আপনার নতুন ঠিকানা দিয়েন” তিনি বললেন।
“ আচ্ছা।”
আমার বন্ধু আমার হাত ছেড়ে দিলেন
এবং প্লাটফর্মের দিকে এগিয়ে গেলেন।
============
উর্দু থেকে ইংরেজি অনুবাদ:
মুহাম্মদ উমর মেমন
মূল উর্দুর সাথে মিলিয়ে অনুবাদ
করতে সহায়তা করেছেন: উর্দুকবিশামীম
জামানভী
অনুবাদক পরিচিত
মাজহার জীবন।
সম্পাদক, লেখালেখির উঠান সাহিত্যপত্রিকা (www.uthon.com)। অনুবাদ: হাওয়ার্ড জিনের নাটক এমা এবং কবিতার বই আমিরি বারাকা’র কেউ আমেরিকা উড়িয়ে দিয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ