ভাষান্তর:
নাহার তৃণা কুলদা রায়
শেষপর্যন্ত আমার স্নায়ু বাবার লাগাতার প্রশ্ন করা স্বভাবের কাছে পরাস্ত হতে বাধ্য হয়। একদিন কিছু একটা নিয়ে আগে থেকেই তিনি রাগে ফুটছিলেন। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো সেসময় তার হাতে একটি বেনামী চিঠি এসে পড়ে। তাতে আমার সদ্যকৃত গোপন অপকর্মের বিস্তারিত বিবরণ ছিল। সেদিনটা ছিল সাংঘাতিক গরম। তাপদাহে জ্বলেপুড়ে ঘরে ফেরা আমার মেজাজও ছিল চূড়ান্ত রকমের খারাপ। আমাকে দেখামাত্র কালবিলম্ব না করে বাবা জেরা শুরু করলেন। তিনি আমাকে একগ্লাস পানি পর্যন্ত পান করার ফুরসতও দিলেন না। জবাবে আমিও তার সাথে চরম বেয়াদবের মতো কথা বললাম। এমনকি ঝোঁকের মাথায় এও বলে বসলাম, “এই নাটকের অর্থ কী আপনি যখন এরমধ্যেই সবটা জানেন?” “নাটক” শব্দের অভিঘাত তাঁকে এতটাই ক্রোধান্বিত করে তোলে যে তিনি রীতিমত কাঁপতে লাগলেন। তিনিও আমাকে কঠিন কথার কশাঘাতে কাবু করতে ছাড়লেন না। এবং কফিনের শেষ পেরেকটি ঠোকার মতো করে তিনি আমার উদ্দেশ্যে বললেন, “আমার মেহনতের উপর্জন তোমার মতো অপগণ্ডের উড়ানোর জন্য নয়। তুমি এই পরিবারে জন্ম না নিলেই মঙ্গল হতো।” ওই কথাটা আমার বুকে বড্ড বাজলো। “আচ্ছা, জন্ম তো হয়েই গেছে,” আমি উত্তর দিলাম, “তবে আজ থেকে এই পরিবার আমাকে যেন মৃত মনে করে।”
বেশ, তীব্র গলায় বললেন, “আজ থেকে আমাদের কাছে তুমি মৃত।”
আমার মা ছিলেন নিতান্তই সাদাসিদে নির্বিবাদী একজন মহিলা। বাবাকে তিনি ভীষণ ভয় করতেন। আমার একগুঁয়ে স্বভাবও তার ভালোই জানা ছিল। তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো। কিন্তু মুখে টুঁশব্দটি করতে পারলেন না। আমি ব্যাগে কয়েকপ্রস্হ কাপড় নিয়ে ওই দিনই বাড়ি ছাড়লাম।
দেউড়িতে, রোজকার মতো, আমার অন্ধ দাদিমা খাগড়ার মাদুরে বসে সুপারি কাটছিলেন। আমার পায়ের আওয়াজ শুনে তিনি বললেন, “ও ভাই, এই না এলে আবার বেরোচ্ছো কোথায়?”
দেউড়িতে, রোজকার মতো, আমার অন্ধ দাদিমা খাগড়ার মাদুরে বসে সুপারি কাটছিলেন। আমার পায়ের আওয়াজ শুনে তিনি বললেন, “ও ভাই, এই না এলে আবার বেরোচ্ছো কোথায়?”
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
সটান মুরাদ মিয়ার আড্ডাখানায় চলে গেলাম। সেখানে তখন জুয়া খেলা চলছিল। বাবা মুরাদমিয়ার সাথে আমার মেলামেশাটা বিশেষভাবে অপছন্দ করতেন। মুরাদের বাবা আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। তিনি তার সমস্ত সম্পদ এই জুয়ার পেছনে উজার করে দিয়েছিলেন। তাতেও হুশ ফেরেনি বেহেড জুয়ারি লোকটার। বদভ্যাসটা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি লোকজনের কাছ থেকে ধার করা শুরু করেন। ঋণ জমে পাহাড় সমান হলে আফিম খেয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। বাবার কাছ থেকেও তিনি ঋণ নিয়েছিলেন। গর্হিত উপায়ে বন্ধুর মরা আর নিজের টাকাপয়সা জলাঞ্জলি যাওয়ায় বাবার আফসোসের শেষ ছিল না। তবে তার সৎপথে উর্পাজিত অর্থ জুয়া খেলায় ব্যয়িত হওয়াটা ছিল বাবার জন্য সবচেয়ে দুঃখের। কোনোভাবে তিনি জানতে পেরেছিলেন মুরাদমিয়া জুয়ার আসর চালায়। যে কারণে মুরাদকে তিনি সহ্যই করতে পারতেন না। অথচ মুরাদ মিয়া খুব গর্ব করে বলতো তার জায়গায় অন্যদের খেলিয়ে সে তার বাবার খোয়ানো সমস্ত টাকা পুনরুদ্ধার করছে। সে এমনকি আমার বাবার পাওনা টাকা পরিশোধের চেষ্টা পর্যন্ত করেছিল। কিন্তু বাবা জুয়া থেকে অর্জিত একটা পয়সা গ্রহণ করাকে চরম ঘৃণার মনে করেছিলেন। যেকারণে মুরাদমিয়াকে তিনি তার বাবার চেয়েও অধিকমাত্রায় অপছন্দ করতে শুরু করেন।
আসলে বাবার সঙ্গে তর্ক হওয়ার আগে আমি মুরাদ মিয়ার বাড়ি থেকেই সোজা বাড়ি ফিরেছিলাম। অল্প সময়ের ব্যবধানে আবারও তার বাড়িতেই ফিরে এলাম। মুরাদ মিয়ার অনুমান করতে সমস্যা হলো না যে কিছু একটা ভজঘট হয়েছে। আমার বাড়ির পরিস্হিতি তার ভালোই জানা ছিল। তড়িঘড়ি তাই প্রশ্ন করলো, “বাবার সাথে ঝগড়া হয়েছে?” যা ঘটেছে ঝটপট সে সম্পর্কে তাকে সবটা বললাম। তাকে এটাও জানালাম যে আমি চিরদিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। এখন নিজের একটা হিল্লের জন্য অন্য কোনো শহরে যাচ্ছি। আর কখনও এমুখো হবো না।
“ কক্ষনো না?” সবিস্ময়ে মুরাদ মিয়া জিজ্ঞেস করলো। “কিন্তু যাবেটা কোথায়?”
“যেদিকে দু’চোখ যায়,” আমি বললাম।
“ পেট চালাবে কীভাবে?”
“ কিছু একটা কাজ খুঁজে নেবো, যে কোনো ধরনের কাজ।”
“ একটা পয়সা দিয়েও কেউ তোমাকে সাহায্য করবে না,” সে বললো। “ কাজ খুঁজে পাওয়া খুব সোজা ভাবছো? আর তোমার কী যোগ্যতাই বা আছে?
সত্যি বলতে, আমার কোনো দক্ষতা বা যোগ্যতাই ছিল না। আমার পড়াশোনার হালও তথৈবচ।
“যদি কিছুই না জোটে, মজদুরি করবো।”
“একজন মজুরের কাজ?” মুরাদ মিয়া বললো। “কাজের ভারে চ্যাপ্টা হয়ে তিনের মধ্যে কাজ ছেড়ে দেবে।”
“যেদিকে দু’চোখ যায়,” আমি বললাম।
“ পেট চালাবে কীভাবে?”
“ কিছু একটা কাজ খুঁজে নেবো, যে কোনো ধরনের কাজ।”
“ একটা পয়সা দিয়েও কেউ তোমাকে সাহায্য করবে না,” সে বললো। “ কাজ খুঁজে পাওয়া খুব সোজা ভাবছো? আর তোমার কী যোগ্যতাই বা আছে?
সত্যি বলতে, আমার কোনো দক্ষতা বা যোগ্যতাই ছিল না। আমার পড়াশোনার হালও তথৈবচ।
“যদি কিছুই না জোটে, মজদুরি করবো।”
“একজন মজুরের কাজ?” মুরাদ মিয়া বললো। “কাজের ভারে চ্যাপ্টা হয়ে তিনের মধ্যে কাজ ছেড়ে দেবে।”
ভাবনাটা আমার ভেতরও ঘাই দিয়েছিল মজদুর হওয়া ভিক্ষাবৃত্তির চেয়েও কঠিনতম। শেষমেশ বললাম, “তাহলে তুমিই কিছু একটা উপায় বাতলে দাও মুরাদ মিয়া।” “ঠিক আছে, তবে আগে মুখে কিছু দাও।” সে পান করার জন্য আমাকে একগ্লাস পানি দিলো। একজনকে রেস্তোরাঁ থেকে খাবার আনতে পাঠালো। বেশ কিছুক্ষণ পর, যখন ফ্যানের বাতাসে গা এলিয়ে আরাম করছিলাম, সে এসে আমার পাশে বসলো। প্রথমে সামান্য খেজুরে আলাপ করলো। তারপর বললো, “যদি তুমি আমার মতামত চাও, তবে আমি বলবো তুমি বাড়ি ফিরে যাও। হয়তো এখনই না, কিছুদিন পর রাগ নেমে গেলে তারপর। কিন্তু বাড়িই ফিরে যাও। তুমি যদি তোমার বাবাকে অসন্তুষ্ট করো, জীবনে কখনো উন্নতি করতে পারবে না।”
“জন্ম দিয়ে আমাকে পৃথিবীতে আনার জন্য তিনি অনুশোচনায় ভুগছেন। সহজভাবে একটা কথাও আমার সাথে বলেননি কখনও। আমি যা ই করি না কেন সেটাই তার অপছন্দের হয়ে দাঁড়ায়। তার কাছে এখন থেকে আমি মৃত।”
“ওটা রাগের কথা। থিতিয়ে যাবে একসময়।”
“না, তা হবে না,” আমি বললাম। “আর আমার দিক থেকেও সেটা হবার নয়।”
“তাহলে, আমার এখানে কয়েকটা দিন না হয় থাকো। তারপর…”
“মুরাদ মিয়া, আমি এই শহরেই আর থাকবো না।”
“ঠিক আছে মিয়া, থেকো না। কিন্তু আমার একটু সময় দরকার। এর মধ্যে তোমার জন্য কিছু একটা হদিশ পাবো নিশ্চয়ই।”
“ওটা রাগের কথা। থিতিয়ে যাবে একসময়।”
“না, তা হবে না,” আমি বললাম। “আর আমার দিক থেকেও সেটা হবার নয়।”
“তাহলে, আমার এখানে কয়েকটা দিন না হয় থাকো। তারপর…”
“মুরাদ মিয়া, আমি এই শহরেই আর থাকবো না।”
“ঠিক আছে মিয়া, থেকো না। কিন্তু আমার একটু সময় দরকার। এর মধ্যে তোমার জন্য কিছু একটা হদিশ পাবো নিশ্চয়ই।”
পরের তিন বা চারদিন আমি তার জুয়ার আড্ডার পেছনের ঘরে কাটিয়ে দিলাম। দ্বিতীয় দিনের মাথায় আমাদের কিছু প্রতিবেশী আমার খোঁজে মুরাদ মিয়ার বাড়িতে এসে উপস্হিত হলো। আমি ভেবেছিলাম নির্ঘাত বাবা কিংবা মা তাদের পাঠিয়েছেন। কিন্তু জানা গেল আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি শুনে তারাই আমার সন্ধানে নেমে পড়েছিল। খবরটা তারা আমার অন্ধ দাদিমার কাছ থেকে পেয়েছিল। তিনি আমার রক্তের সম্পর্কীয় দাদি ছিলেন না। পাড়াতুতো এবং আমাদের পরিবারের সব ব্যাপারেই তিনি নাক গলাতেন। আমার ঘর ছাড়ার ব্যাপারটা তার মাধ্যমেই পাড়াময় চাউর হয়েছে। খবরটা আমাকে আরো বেশি মাত্রায় তাতিয়ে দিলো।
আমি ওই লোকগুলোর সামনে বের হইনি। আর মুরাদ মিয়াও অজ্ঞতার ভান করে তাদের ফেরত পাঠালো। চতুর্থ দিন মুরাদ মিয়ার টিকির দেখাও সারা দিনে পাওয়া গেল না। বাড়ির কাজের লোকেরাই আমার খাওয়া-দাওয়া ও আনুসাঙ্গিক বিষয় দেখভাল করলো। রাত ঘনালে মুরাদ মিয়া ভয়ানক পরিশ্রান্ত হয়ে কোথা থেকে ফিরে এলো। এসে বললো, “ তোমার জন্য ব্যবস্হা করে এলাম। কটা দিন এখানে থাকো, তারপর অন্য শহরে চলে যেতে পারো।”
“আমি যদি তোমার সঙ্গে এখানে থাকি, তাহলে আমার অবস্হান গোপন থাকবে না।” মুরাদ মিয়াকে বললাম। “ আমার খোঁজে যে কেউ তোমার এখানেই সটান এসে উপস্হিত হবে।”
“ ওহ্ ভ্রাত, এখানে থাকতে তোমাকে কে বলছে? তোমার জন্য আমি অন্য জায়গার ব্যবস্হা করেছি।”
“ আমার পেট চলবে কীভাবে?”
আমার মনে পড়ে গেল ঠিক এই প্রশ্নটাই মুরাদ মিয়া আমাকে করেছিল। আর আমি তার কাছ থেকেই
উত্তরটা জানতে চেয়েছিলাম। মুরাদ মিয়া উত্তর দিলো, “খাওয়ার ব্যবস্হাও করা হয়েছে।”
“বিনি মাগনার খাওয়া আমি মুখে তুলবো না।”
“হ্যাঁ জনাব সে আমি জানি। শুধু এখনকার মতো দয়া করে আমার অসৎ আয়ে পেটপূর্তি করো তারপর নিজের পথে চলে যেও। আগামী দিন থেকে নিজের রোজগারের পয়সায় খেও। খুববেশি কামাই অবশ্য তুমি করতে পারবেনা। তবে ডাল আর রুটির জন্য তাই যথেষ্ট।
“ আমার পেট চলবে কীভাবে?”
আমার মনে পড়ে গেল ঠিক এই প্রশ্নটাই মুরাদ মিয়া আমাকে করেছিল। আর আমি তার কাছ থেকেই
উত্তরটা জানতে চেয়েছিলাম। মুরাদ মিয়া উত্তর দিলো, “খাওয়ার ব্যবস্হাও করা হয়েছে।”
“বিনি মাগনার খাওয়া আমি মুখে তুলবো না।”
“হ্যাঁ জনাব সে আমি জানি। শুধু এখনকার মতো দয়া করে আমার অসৎ আয়ে পেটপূর্তি করো তারপর নিজের পথে চলে যেও। আগামী দিন থেকে নিজের রোজগারের পয়সায় খেও। খুববেশি কামাই অবশ্য তুমি করতে পারবেনা। তবে ডাল আর রুটির জন্য তাই যথেষ্ট।
“মুরাদ মিয়া আমাকে সব খোলাসা করে বলো। কোথায় থাকবো আমি? রুজি রোজগারের জন্যই বা আমাকে কী করতে হবে?”
“এখন এসব কেন জিজ্ঞেস করছো বাপ? বাড়ি ছেড়ে যখন চলেই এসেছো।”
এরপর সে তার জুয়ার আড্ডায় কর্মরত একটি ছেলেকে ডাকলো। তাকে এককোণে নিয়ে গিয়ে অনেকক্ষণ কিছু একটা বোঝালো। সলাপরামর্শ শেষে ছেলেটি বাইরে গেল। অল্পক্ষণের ভেতর ফিরে এসে বললো, “চলুন রওনা দেই। বাইরে এক্কা অপেক্ষা করছে।”
মুরাদ মিয়া আমাকে আলিঙ্গন করে বললো, “যাও, আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করুন। তোমার খোঁজ-খবর আমি রাখবো। তবে আমাদের দেখাসাক্ষাত সম্ভব হবে না।”
মুরাদ মিয়া আমাকে আলিঙ্গন করে বললো, “যাও, আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করুন। তোমার খোঁজ-খবর আমি রাখবো। তবে আমাদের দেখাসাক্ষাত সম্ভব হবে না।”
কাপড়চোপড়ের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একটা জীর্ণশীর্ণ ঘোড়া এবং সর্বহারা গোছের এক কোচোয়ানসহ এক্কাগাড়িটি ঠিক দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল। একটা ভারি পর্দা দিয়ে গাড়ির চারপাশটা শক্তপোক্তভাবে ঢাকা। কোনো পাদানি না থাকায় ছেলেটি আমাকে গাড়িতে উঠতে সাহায্য করলো। এরপর গাড়ির আচ্ছাদন ঠিকঠাক আছে কিনা খুঁটিয়ে দেখে নিলো। দেখা শেষ করে কোচোয়ানের উদ্দেশ্যে বললো, “ দয়া করে ইনাকে শৈশব প্রেমে পৌঁছে দেবেন। যদি…”
“আমি জানি। মুরাদ মিয়া আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।”
কোচোয়ান ঘোড়ার পিঠে কয়েক ঘা চাবুক কশালো। এক্কাগাড়িটি একটা ঝাঁকুনি দিয়ে এগোতে শুরু করলো।
কিছু সময়ের জন্য আমি শৈশব প্রেম নিয়ে ভাবিত হলাম। কী অদ্ভুত নাম! এই নামটা কী কোনো নারীর? মুরাদ মিয়ার পুরোনো সম্পর্কীয়া কেউ? কী অবস্হায় আছেন তিনি এখন? থাকেনই বা কোথায়? আমাকেই বা তার কাছে কেন পাঠানো হচ্ছে? আমার চিন্তাভাবনা সব কেমন গুলিয়ে গেল। তবে অল্পসময়ের ভেতর এক্কাগাড়ির ছন্দময় দুলুনি আর ঘোড়ার গলায় ঝুলন্ত ঘন্টির শব্দ আমাকে কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন করে তুললো। হুটহাট করে কোচোয়ানটা বিড়ি ধরাচ্ছিল। তখন তার ধোঁয়া আর গন্ধকের তীব্র গন্ধ নাসারন্ধ্রে ঢুকে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলচ্ছিল। পর্দার আড়াল থেকে বাইরে উঁকি দেবার ইচ্ছা হচ্ছিল খুব। কিন্তু কেউ দেখে যদি চিনে ফেলে এই ভয়ে আমি খানিক ইতস্তত করছিলাম। যদিও শহরের কম লোকই আমাকে চিনতো। অগত্যা বাইরে তাকানো বাদ দিয়ে শহরের কোন অংশের উপর দিয়ে যাচ্ছি সেটা অনুমান করার চেষ্টা করলাম। তবে দিক বুঝে উঠতে বেশ সমস্যা পোহাতে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এক্কাগাড়ি তার খেয়ালখুশি মাফিক চলছে আমি যেদিক ভেবে নেই না কেন। মাঝে মধ্যে এমনও মনে হচ্ছিল গাড়িটা বুঝি আমার বাড়ির দিকে বাঁক নিচ্ছে। আবারও আমি ঘুমভাবে আচ্ছন্ন হলাম। গাড়ি তখন যে পথে এগোচ্ছিল তা বড় বড় গর্তে ভালোই সয়লাব ছিল। বার বার ঝাঁকুনিতে আমার শরীর ব্যথা করতে লাগলো। অবশেষে যাত্রা ফুরালো। সুতীক্ষ্ণ স্বরে কেউ নির্দেশ দিলো, “থাম!”
এক্কাটা থামলো। পর্দা উঠে যাওয়ার পর ওই একই কণ্ঠস্বর আমাকে বললো, “নেমে পড়ুন।”
আমি নেমে এলাম। এক্কায় ভ্রমণে আমি মোটেও অভ্যস্ত ছিলাম না। আমার শরীরের কিছু অংশ অসাড় হয়ে গিয়েছিল। যেকারণে গাড়ি থেকে নামামাত্রই আমার গোটা শরীর টলমল করে উঠলো। কোচোয়ান আমাকে ধরে থিতু হতো সাহায্য করলো। রাত বেশ গভীর হয়েছিল চারিপাশ তাই অন্ধারাচ্ছন্ন। যে মানুষটা কথা বলেছিল আমি তার দিকে তাকালাম। তবে অন্ধকারে তার অবয়ব পরিষ্কার ঠাহর করতে পারলাম না। এটুকু বোঝা গেল সে ছোটখাট কাঠামোর একজন পুরুষ। তার কণ্ঠস্বর ছিল নারীসুলভ কিংবা বলা ভালো শিশুর মতো। আমি তাকে সালাম দিলাম, সে অত্যন্ত আদবের সাথে উত্তর দিলো। আমার কাছে খুচরো কিছু পয়সা ছিল। পকেটে হাত রেখে কোচোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম “কত হয়েছে?”
আমি নেমে এলাম। এক্কায় ভ্রমণে আমি মোটেও অভ্যস্ত ছিলাম না। আমার শরীরের কিছু অংশ অসাড় হয়ে গিয়েছিল। যেকারণে গাড়ি থেকে নামামাত্রই আমার গোটা শরীর টলমল করে উঠলো। কোচোয়ান আমাকে ধরে থিতু হতো সাহায্য করলো। রাত বেশ গভীর হয়েছিল চারিপাশ তাই অন্ধারাচ্ছন্ন। যে মানুষটা কথা বলেছিল আমি তার দিকে তাকালাম। তবে অন্ধকারে তার অবয়ব পরিষ্কার ঠাহর করতে পারলাম না। এটুকু বোঝা গেল সে ছোটখাট কাঠামোর একজন পুরুষ। তার কণ্ঠস্বর ছিল নারীসুলভ কিংবা বলা ভালো শিশুর মতো। আমি তাকে সালাম দিলাম, সে অত্যন্ত আদবের সাথে উত্তর দিলো। আমার কাছে খুচরো কিছু পয়সা ছিল। পকেটে হাত রেখে কোচোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম “কত হয়েছে?”
“মুরাদ মিয়া আগেই ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছেন।” কোচোয়ান তার গাড়ির পর্দা উঠিয়ে নিয়ে সেটা ভাঁজ করতে করতে বললো।
“চলুন”, লোকটি কথাটা বলেই একদিকে হাঁটা ধরলো। আমি তার পেছনে হাঁটা শুরু করতেই কোচোয়ান ডাকলো, “এটা নিয়ে যান।”
আমি ঘুরতেই সে আমার দিকে ভাঁজ করা পর্দাটা এগিয়ে দিলো।
“এটা আমার না,” আমি বললাম।
“মুরাদ মিয়া এটা আপনাকে দিতে বলেছেন।”
“চলুন”, লোকটি কথাটা বলেই একদিকে হাঁটা ধরলো। আমি তার পেছনে হাঁটা শুরু করতেই কোচোয়ান ডাকলো, “এটা নিয়ে যান।”
আমি ঘুরতেই সে আমার দিকে ভাঁজ করা পর্দাটা এগিয়ে দিলো।
“এটা আমার না,” আমি বললাম।
“মুরাদ মিয়া এটা আপনাকে দিতে বলেছেন।”
সঙ্গের ব্যাগে গায়ে দেবার মতো গরম কিছুই আমি আনিনি। চাদরটা খোদা মারফত পাঠানো বলে মনে হলো আমার। লোকটি বললো, “নিয়ে নিন। এদিকটায় সকালের দিকে বেশ ঠান্ডা পড়ে।”কথাটা বলে সে একটা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। কিছুক্ষণ পর তার গলার আওয়াজ শোনা গেল, “ভেতরে আসুন।” ভেতরে একটি কেরোসিনের প্রদীপ জ্বলছিল। তার একপাশে ডাঁই করা ছিল পেস্টবোর্ড আর রঙিন কাগজ। কাছাকাছিই একটা ইটের চুল্লি।
প্রদীপের আলোয় যখন লোকটার মুখটা দেখার সুযোগ হলো, আমি তাকে চিনতে পারলাম। আমি তাকে বেশ কয়েকবার বাজারে একটা খোলা গাড়িতে কাগজের স্তূপ ও পেস্টবোর্ড বোঝাই করে নিয়ে যেতে দেখেছি। কখনও কখনও বাঁশের বিশাল বোঝা, কাপড়ের ব্যাগ, ছেঁড়াখোঁড়া কাপড়ও থাকতো সেই গাড়িতে। সে একজন পূর্ণবয়স্ক লোক তবুও তার মুখে দাড়ি বা গোঁফ, কিছুই গজায়নি। এমনি কি তার ভ্রু বলতেও কিচ্ছু ছিল না। এই কারণে তার মুখটা আমার স্মৃতিতে থেকে গিয়েছে। সম্ভবত এই কারণে তাকে ‘শৈশব প্রেম” নামে ডাকা হতো।
সে দ্রুতহাতে মেঝেতে প্রথমে কিছু একটা বিছিয়ে তার উপর আমার বা মুরাদ মিয়ার চাদরটা বিছিয়ে দিলো। তৈরি বিছানার পাশে আমার ব্যাগটা রেখে বললো, “দু একদিনের মধ্যে একটা খাট এসে যাবে।”
“খাটের দরকার নেই। আমি মেঝেতেই ঘুমাবো।”
“খাটের দরকার নেই। আমি মেঝেতেই ঘুমাবো।”
“ঠিক আছে, আমি এখন কিছু খাবার নিয়ে আসি।”
“মুরাদ মিয়ার সাথে আগেই সে পর্ব সেরে এসেছি।”
বেশ কিছুক্ষণ সে আমার সাথে বাসস্হান নিয়ে আলাপ করলো। আমি তাতে খুব একটা মনোযোগ দেইনি। আমার মাথায় তখন ভবিষ্যতের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। আলাপ সেরে অবশেষে সে উঠলো।
“আপনি নিশ্চয়ই ক্লান্ত। বিশ্রাম নিন। আগামীকাল সকালে আপনি কাজ পেয়ে যাবেন।”
মুরাদ মিয়া কী এরই মধ্যে আমার সম্পর্কে তাকে সবকিছু জানিয়েছে? সে চলে যাওয়ার পর আমি ভাবতে লাগলাম। তবে অল্পক্ষণের ভেতর আমার দুচোখ ঘুমে ভারি হয়ে এলো। কিছু সময়ের জন্য আজগুবি নানা ভাবনা আমাকে গ্রাস করে থাকলো। তারই মাঝে কখন জানি আমি ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
“আপনি নিশ্চয়ই ক্লান্ত। বিশ্রাম নিন। আগামীকাল সকালে আপনি কাজ পেয়ে যাবেন।”
মুরাদ মিয়া কী এরই মধ্যে আমার সম্পর্কে তাকে সবকিছু জানিয়েছে? সে চলে যাওয়ার পর আমি ভাবতে লাগলাম। তবে অল্পক্ষণের ভেতর আমার দুচোখ ঘুমে ভারি হয়ে এলো। কিছু সময়ের জন্য আজগুবি নানা ভাবনা আমাকে গ্রাস করে থাকলো। তারই মাঝে কখন জানি আমি ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
পরদিন খুব ভোরে আমার ঘুম ভাঙলো। দেখলাম শৈশব প্রেম চুলায় বড় এক হাঁড়িতে কিছু রান্নায় ব্যস্ত।
এত ভোরে সকালের নাস্তা বানাচ্ছে? অবাক লাগলো আমার। তারপর পাশ ফিরে আবার আমি ঘুমিয়ে গেলাম। আবার যখন ঘুম ভেঙলো তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। আমার খুব কাছ ঘেষে সে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই সময় আমি তাকে বেশ খুঁটিয়ে দেখলাম। ওর বয়স আমার আন্দাজের চেয়েও বেশি। এখন তাকে দেখে বয়স পঞ্চাশ বা পঞ্চান্নের মতো লাগলো। অথচ এখনও তার চেহারা জুড়ে শৈশবের আভা লেপ্টে আছে।
এত ভোরে সকালের নাস্তা বানাচ্ছে? অবাক লাগলো আমার। তারপর পাশ ফিরে আবার আমি ঘুমিয়ে গেলাম। আবার যখন ঘুম ভেঙলো তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। আমার খুব কাছ ঘেষে সে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই সময় আমি তাকে বেশ খুঁটিয়ে দেখলাম। ওর বয়স আমার আন্দাজের চেয়েও বেশি। এখন তাকে দেখে বয়স পঞ্চাশ বা পঞ্চান্নের মতো লাগলো। অথচ এখনও তার চেহারা জুড়ে শৈশবের আভা লেপ্টে আছে।
“ ঘুম ভালো হলো?” শৈশব জানতে চাইলো, তারপর ঘরের অন্যদিকে একটা দরজার প্রতি ইশারা করলো। যাও, মুখহাত ধুয়ে নাও। নাস্তা খেয়ে নাও তারপর কাজ শুরু হবে। দরজার বাইরে আঙিনা। আমি তার সাথে সেখানে গেলাম। একপাশে একটা কুয়ো এবং আঙিনা লাগোয়া পায়খানা-গোসলখানা ইত্যাদি। আদতে সেটা কোনো আঙিনা ছিল না। সেটা ছিল বেশ কিছু বাড়ির পেছনের দেয়াল ঘেরা একটা জায়গা মাত্র। পরে জানতে পারি ওই জায়গাটি “নিঃস্ব আঙিনা” নামে পরিচিত। আমার শহরে অনেক পাড়া ছিল যেগুলো পল্লী বা আঙিনা ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু “নিঃস্ব আঙিনা” নামটা এর আগে আমি কখনও শুনিনি। একটা নিম গাছসহ আরো কিছু গাছগাছালি ছিল আঙিনার চারপাশে। খোদাই জানেন কত বছরের পুরোনো ছিল গাছটা। দেখে বোঝা যাচ্ছিল গাছের শাখা বারকয়েক ছাঁটাই করা হয়েছে। তারপরও ওটাই ছিল ওখানকার সবচেয়ে বড় গাছ। আমার বাড়িতেও একটা নিমগাছ আছে। সেটার বাড়ন্ত শাখাপ্রশাখা আমিই ছাঁটাই করতাম। আঙিনার গাছটা দেখে বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল।
দাঁতব্রাশের জন্য নিমের একটা ডাল ভেঙে নিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা শুরু করলাম। শৈশব প্রেম পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে বললো, “তোমার যদি কিছু লাগে আমাকে জানিও। আমি প্রতিদিনই বাজারে যাই।”
দাঁতব্রাশের জন্য নিমের একটা ডাল ভেঙে নিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা শুরু করলাম। শৈশব প্রেম পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে বললো, “তোমার যদি কিছু লাগে আমাকে জানিও। আমি প্রতিদিনই বাজারে যাই।”
বাড়ি ছাড়ার সময় সঙ্গে কয়েকপ্রস্হ কাপড় আর সামান্য পরিমাণ টাকা ছাড়া কিছুই আনা হয়নি। মনে মনে আমি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর একটা তালিকা তৈরি করতে শুরু করলাম। আঙিনার কোনো এক বাড়ি থেকে তখন একটা কণ্ঠ শোনা গেল, “ শৈশব! চা তৈরি হয়েছে। তাকেও নিয়ে আয়।”
“এক্ষুনি আসছি, বড়ি বেগম।”
“এক্ষুনি আসছি, বড়ি বেগম।”
ওই বাড়ির পিছন-দরজা ফিয়ে আমরা ঢুকলাম। বড়ি বেগম ষাট বছরের বেশি বয়স্ক একজন মহিলা। ফর্শা তার ত্বক। তার মুখে এক ধরনের সম্ভ্রম জাগানিয়া আর দয়ালু ভাব লেপ্টে আছে। কিন্তু তার সবকিছু এবং বাড়ি দেখলে দরিদ্রই বলতে হয়। তাকে আমি সালাম দিলাম। তিনি আমাকে গভীরভাবে দোয়া করলেন। আজাবধি তার দোয়া করার ভঙ্গিটি আমার মনে আছে। কারণ যখনই আমি তাকে সালাম দিতাম, একইভাবে দোয়া করতে তার ভুল হতো না, “খোদা তোমার সৌভাগ্যের বৃদ্ধি ঘটান।”
পিরিচ ছাড়া কাপে তিনি আমাদের চা পরিবেশন করলেন। তারপর শৈশব প্রেমের সাথে আলাপ জুড়ে দিলেন। তিনি তাকে কেবল “শৈশব” বলে ডাক ছিলেন। ওই আঙিনার অধিকাংশই তাকে ওভাবে সম্বোধন করতো। কেউ কেউ তাকে “ভালোবাসা” বলেও ডাকতো। কদাচিৎ কেউ সম্বোধনের জন্য তার পুরো নাম ব্যবহার করতো। আমাদের চা পান শেষ হলে শৈশব চলে যাওয়ার মুখে বললো, “ঠিক আছে, আমি এখনই গিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে আসছি। বড়ি বেগম, কী কাজ করতে হবে আপনি ওকে বুঝিয়ে দেবেন।”
অল্প কিছুক্ষণ পর সে বড়ি বেগমের সামনে পেস্টবোর্ড আর কাগজপত্রের স্তূপ এনে হাজির করলো। তারপর বড় একটা পাত্র খুব সাবধানে বয়ে নিয়ে এলো। ভোরবেলা চুল্লিতে তাকে আমি ওই হাঁড়িতেই কিছু রাঁধতে দেখেছিলাম। “দেওয়ালি(বা দীপাবলি হিন্দুদের একটি ধর্মীয় উৎসব) প্রায় ঘাড়ের উপর।” সে বলল, “বাক্সের চাহিদা প্রচুর।”
“আমরা দুজন মিলে তৈরি করে ফেলবো।” বড়ি বেগম আশ্বস্ত করলেন।
“লেই(আটা বা ময়দা দিয়ে তৈরিকৃত একধরনে আঠা) কি কম পড়বে? হাঁড়ির দিকে ইঙ্গিত করে শৈশব জিজ্ঞেস করলো।
“না। এই যথেষ্ট।”
“বাক্সগুলো আধা সের পরিমাপের চেয়ে বড় মাপে তৈরি করবেন।” কথাগুলো বলে সে বাইরে চলে গেল।
অনেক সময় নিয়ে বড়ি বেগম আমাকে কাজ শেখালেন। পইপই করে বোঝালেন কীভাবে পেস্টবোর্ড আর কাগজ কাটতে হয়। কীভাবে কাটা পেস্টবোর্ডে কাগজ জুড়তে হয়। শিক্ষাপর্ব শেষে দুজনে বাক্স তৈরি শুরু করলাম। বড়ি বেগমের হাত আমার চেয়ে দ্রুত চলছিল। একদম নিখুঁত, প্রত্যেকটা বাক্স এক সমান। নতুন হিসেবে আমিও অনেকগুলো বাক্স বানিয়ে ফেললাম।
তাহলে এই কাজই আমার জন্য বরাদ্দ হলো। ভাবলাম আমি। মুরাদ মিয়ার কথা মনে পড়লো। “কী যোগ্যতা আছে তোমার?” বেশ, অন্তত এখন আমি জানি কীভাবে মিষ্টির বাক্স তৈরি করতে হয়। মিষ্টির দোকানে এধরনের বাক্স দেখেছি। আমি নিজেও সেই বাক্সে মিষ্টি কিনেছি। কিন্তু কখনও ভাবিনি একদিন নিজেও এমন বাক্স তৈরি করবো। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি কাজ করলাম। এই সময়ের ভেতর বড়ি বেগম একবার উঠে খাবার রান্না করে আবার ফিরে এলেন। তিনি দ্বিতীয়বার উঠে আমার জন্য খাবার নিয়ে এসে সামনে রাখলেন। আমাকে ইতস্তত করতে দেখে বললেন, শৈশবও এখানে খায়। সে-ই সবার খাবার আর কাজের হিসাবপত্র রাখে। তোমার উপার্জনও শৈশব সংগ্রহ করবে। যখনই টাকাপয়সার দরকার হবে ওকে বলো, বুঝেছো?” যদিও তিনি আমাকে কিছু বললেন না আমিও আর মুখফুটে জানতে চাইলাম আমার রোজগার কী হবে। তবে এটা জেনে যথেষ্ট স্বস্তি লাগলো যে এখন অন্তত খরচপত্রের জন্য রোজগারে আমি সক্ষম। খাবার ছাড়া খরচের আর কিইবা ছিল আমার।
কিছু দিনের মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলতে শুরু করলো। এখন আমি দিনে বড়ি বেগমের চেয়েও বেশি বাক্স তৈরি করি। শৈশব আমাদের জন্য পেস্টবোর্ড আর কাগজ নিয়ে আসে। লেই তৈরি করে দেয়। আমরা সারাদিন ধরে বাক্স তৈরির কাজ চালিয়ে যাই। আঙিনার বাইরে আমাকে খুব একটা বের হতে হতো না। কারণ আমার প্রয়োজনে লাগে এমন সামান্য জিনিসটা পর্যন্ত শৈশব কিনে আনতো।
আমার যেসমস্ত কর্মকাণ্ড বাবাকে হতাশ করতো সেসব পালা চুকেবুকে গেছে। তবুও আমার দৃঢ বিশ্বাস তিনি এখনো আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবেন না। তার ভয় এখনও তাড়া করে বেড়ায়। এখনো চোরের মতো আমাকে বাড়িতে ঢুকতে হবে। এমনকি তিনি বাড়ির বাইরে থাকলেও যে কোনো সময় হয়তো ফিরে আসতে পারেন। ফিরে এসে আমাকে অবাক করে দিয়ে জেরা শুরু করবেন। তবে সেটা কোন বিষয়ে একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন। তাই কখনো আমার বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে জাগলেও আমি সেটা একপাশে সরিয়ে রাখতাম। সেই সময় নিঃস্ব আঙিনার নিম গাছটিও আমাকে জ্বালানো শুরু করে। যদিও প্রত্যেকের কাছ থেকে অনেকটা দূরত্ব রেখে থাকি, তবুও বড়ি বেগমকে ধন্যবাদ দেই। তিনি এ পাড়ার বাসিন্দাদের সম্পর্কে কিছুটা হলেও খবরাখবর জানাতেন। এদের অধিকাংশ লোক নানা ধরনের হাতের কাজ করে। অথবা ছোটোখাটো কাজ করে পেট চালায়। বেশ কিছু মহিলা কাজ করেন এখানে। এদের মধ্যে অধিকাংশই সেলাই ও সূচিশিল্প করেন। একটি ছোটো পরিবারের মহিলা ও মেয়েরা কাগজের ফুলের মালা বানায়। আরেকটি পরিবার বাঁশের লাঠি জোগাড় করে। সেগুলো কেটেছেঁটে সোজা করে। তারপর সুদৃশ্য ঘুড়ির কাঠামো বানায়। আরো কিছু লোক কুচি কুচি করে সুপারি কাটে। সরতা দিয়ে সুপারি কাটার শব্দে দেউড়িতে বসে থাকা আমার সেই পাড়াতুতো অন্ধ দাদিমার কথা মনে করাতো। ছেলেবেলার প্রতি ভালোবাসার কারণে এইসব লোকদের কাজগুলো মনে আসে। কাজগুলো শেষ হলে তারা সেগুলো বাজারে নিয়ে যেত।
দিনে বেশ কয়েকবারই সে এই পাড়ায় আসতো। কাঁচা মালামাল দিয়ে যেত। আর এখানকার মালপত্র আবার বাইরে নিয়ে যেত। দোকানদারদের কাছ থেকে সে তার নিজের জন্য টাকা তুলতো। এ পাড়ার সবার খাবারদাবার জোগাড়ের ব্যবস্থার করার দ্বায়িত্ব তার কাঁধেই ছিল। এ পাড়ার সবার কাছেই সে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লোক ছিল। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ লোকটি হলেন বড়ি বেগম। তার কাছেই কেটেছে আমার জীবনের অত্যন্ত ভালো সময়। ঘরগেরস্থির নানা বিষয়ে পাড়ার বাসিন্দারা তার কথার উপরই ভরসা করত। তাদের ছোটোখাটো অসুখ-বিসুখের দাওয়াই তিনি দিতেন। নানা উৎসব-অনুষ্ঠানে অন্য যে কারোর চেয়ে তিনিই ছিলেন ভরসা। তাকে সবাই অনেক সম্মানও করত। সবাই তাকে বড়ি বেগম নামে ডাকত। কিছু কিছু মেয়েদের কাছে ছিলেন বড়ি বেগম খালা। কিন্তু তিনি যে কার বেগম ছিলেন সেটা আমি কখনোই খুঁজে বের করতে পারিনি।
এ পাড়ার কারো বিষয়েই আমার কোনো আগ্রহ নেই। সে সময় বা এখনো কেন ঐ জায়গাটিকে নিঃস্বদের জায়গা বলা হতো। আমি জানি না। সেখানকার কেউই নিঃস্ব ছিল না। নিজেদের গায়ে গতরে খেটে তারা প্রত্যেকে টিকে ছিল।
এক সকালে শৈশব প্রেম বলল, আজ কোনো কাজ নয়। তারপর তার ব্যাখ্যা করলো, “বড়ি বেগমকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।”
“কেন? তার আবার কী সমস্যা হলো?”
“আমার কিছু হয়নি’’ আঙিনা থেকে তার গলার শব্দ এলো। “এই শৈশবের মাথা খারাপ হয়েছে।”
“মাথা খারাপ?’' ঘরের ভেতর থেকে তেড়ে বলে উঠল, “তোমার বুকে কতকাল ধরে ব্যথা পুষে আছো খোদা জানে। কালরাতেও তুমি কাতরেছ। আজ তোমাকে ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে।”
“আমি আসছি। আসছি।” বলে তিনি বুরকা পরে এলেন। আমি উঠে তাকে সালাম করলাম।
“বেঁচে থাক। সুখি হ”, তিনি বললেন। বারবার এই কথা বললেন। “খোদা তোর ভালো করুক।”
এরপর কখনোই তাকে আর দেখিনি। ডাক্তার তাকে সোজা হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি নাই হয়ে গেলেন। হাসপাতাল থেকে তার মরদেহ গোসলখানায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে সোজা কবরখানায় বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। অধিকাংশ পুরুষলোকই তার জানাজায় উপস্থিত হয়েছিল। আর মহিলারা জড়ো হয়েছিল তার বাড়িতে। কিন্তু আমি আমার ঘরেই ছিলাম।
বড়ি বেগম চলে যাওয়ার পর মনে হলো এ নিঃস্ব পাড়ায় আমি কোনো না কোনোভাবে একজন আগন্তক মাত্র। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন সেখানকার আর কারো সঙ্গে কোনো ধরনের বাতচিত করার দরকার হতো না। তিনি আমার সঙ্গে অনেক কথা বলতেন। তার মাধ্যমেই এই পাড়ায় কী কী ঘটছে তা জানতে পারতাম। জমিদার বা ধনীদের রুচি মাফিক অগুনতি রান্নাবান্না করতে জানতেন তিনি। আবার কর্মচারী ও সাধারণ গরীবগুর্বা মানুষেরও খুব পছন্দের ছিল তার খাবার। বিভিন্ন ধরনের খানাখাদ্য নিয়ে তাকে আমি প্রায়ই প্রশ্ন করতাম। বিশেষত খাবারের সময়ে এটা ছিল একটা প্রিয় আলোচনার বিষয়। তিনি প্রত্যেকটা খাবার নিয়ে বিষদে বলতেন। আর রান্নার কায়দা সম্পর্কে এমনভাবে বলতেন যে শুনে শুনে মুখে যেন তার স্বাদ পেতাম। সব কিছুর উর্দ্ধে ছিল তার কথা বলার দরদভরা স্বর, যা মনে করে আমি বিচলিত হয়ে উঠছি।
শৈশব আমাকে কাজ দিয়েছে–এমনকি এখনো দিচ্ছে। কিন্তু কখনোই ওই জায়গার সঙ্গে কোনো ধরনের যোগসূত্র অনুভব করতে পারিনি। এক রাতে শোবার সময় তাকে আমি বললাম, “মুরাদ মিয়া কখনও আমার খোঁজখবর নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।”
“শেষপর্যন্ত তুমি তাহলে তাকে মনে করলে”, সে বলল। “না, সে নিয়মিত আমার কাছ থেকে তোমার খোঁজ খবর রেখেছে। জেলে যাওয়ার আগপর্যন্ত।”
“জেলে?” জানতে চাইলাম, “মুরাদ জেলে গিয়েছিল?”
“সে গিয়েছিল বটে, কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই বের হয়ে এসেছিল। তারপর সে অন্য কোথাও চলে গিয়েছে। হয়তো এখন সে ফিরে এসেছে। বেশ কিছুদিন আমি তার এলাকায় যাইনি। সব সময় আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয়।”
পিরিচ ছাড়া কাপে তিনি আমাদের চা পরিবেশন করলেন। তারপর শৈশব প্রেমের সাথে আলাপ জুড়ে দিলেন। তিনি তাকে কেবল “শৈশব” বলে ডাক ছিলেন। ওই আঙিনার অধিকাংশই তাকে ওভাবে সম্বোধন করতো। কেউ কেউ তাকে “ভালোবাসা” বলেও ডাকতো। কদাচিৎ কেউ সম্বোধনের জন্য তার পুরো নাম ব্যবহার করতো। আমাদের চা পান শেষ হলে শৈশব চলে যাওয়ার মুখে বললো, “ঠিক আছে, আমি এখনই গিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে আসছি। বড়ি বেগম, কী কাজ করতে হবে আপনি ওকে বুঝিয়ে দেবেন।”
অল্প কিছুক্ষণ পর সে বড়ি বেগমের সামনে পেস্টবোর্ড আর কাগজপত্রের স্তূপ এনে হাজির করলো। তারপর বড় একটা পাত্র খুব সাবধানে বয়ে নিয়ে এলো। ভোরবেলা চুল্লিতে তাকে আমি ওই হাঁড়িতেই কিছু রাঁধতে দেখেছিলাম। “দেওয়ালি(বা দীপাবলি হিন্দুদের একটি ধর্মীয় উৎসব) প্রায় ঘাড়ের উপর।” সে বলল, “বাক্সের চাহিদা প্রচুর।”
“আমরা দুজন মিলে তৈরি করে ফেলবো।” বড়ি বেগম আশ্বস্ত করলেন।
“লেই(আটা বা ময়দা দিয়ে তৈরিকৃত একধরনে আঠা) কি কম পড়বে? হাঁড়ির দিকে ইঙ্গিত করে শৈশব জিজ্ঞেস করলো।
“না। এই যথেষ্ট।”
“বাক্সগুলো আধা সের পরিমাপের চেয়ে বড় মাপে তৈরি করবেন।” কথাগুলো বলে সে বাইরে চলে গেল।
অনেক সময় নিয়ে বড়ি বেগম আমাকে কাজ শেখালেন। পইপই করে বোঝালেন কীভাবে পেস্টবোর্ড আর কাগজ কাটতে হয়। কীভাবে কাটা পেস্টবোর্ডে কাগজ জুড়তে হয়। শিক্ষাপর্ব শেষে দুজনে বাক্স তৈরি শুরু করলাম। বড়ি বেগমের হাত আমার চেয়ে দ্রুত চলছিল। একদম নিখুঁত, প্রত্যেকটা বাক্স এক সমান। নতুন হিসেবে আমিও অনেকগুলো বাক্স বানিয়ে ফেললাম।
তাহলে এই কাজই আমার জন্য বরাদ্দ হলো। ভাবলাম আমি। মুরাদ মিয়ার কথা মনে পড়লো। “কী যোগ্যতা আছে তোমার?” বেশ, অন্তত এখন আমি জানি কীভাবে মিষ্টির বাক্স তৈরি করতে হয়। মিষ্টির দোকানে এধরনের বাক্স দেখেছি। আমি নিজেও সেই বাক্সে মিষ্টি কিনেছি। কিন্তু কখনও ভাবিনি একদিন নিজেও এমন বাক্স তৈরি করবো। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি কাজ করলাম। এই সময়ের ভেতর বড়ি বেগম একবার উঠে খাবার রান্না করে আবার ফিরে এলেন। তিনি দ্বিতীয়বার উঠে আমার জন্য খাবার নিয়ে এসে সামনে রাখলেন। আমাকে ইতস্তত করতে দেখে বললেন, শৈশবও এখানে খায়। সে-ই সবার খাবার আর কাজের হিসাবপত্র রাখে। তোমার উপার্জনও শৈশব সংগ্রহ করবে। যখনই টাকাপয়সার দরকার হবে ওকে বলো, বুঝেছো?” যদিও তিনি আমাকে কিছু বললেন না আমিও আর মুখফুটে জানতে চাইলাম আমার রোজগার কী হবে। তবে এটা জেনে যথেষ্ট স্বস্তি লাগলো যে এখন অন্তত খরচপত্রের জন্য রোজগারে আমি সক্ষম। খাবার ছাড়া খরচের আর কিইবা ছিল আমার।
কিছু দিনের মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলতে শুরু করলো। এখন আমি দিনে বড়ি বেগমের চেয়েও বেশি বাক্স তৈরি করি। শৈশব আমাদের জন্য পেস্টবোর্ড আর কাগজ নিয়ে আসে। লেই তৈরি করে দেয়। আমরা সারাদিন ধরে বাক্স তৈরির কাজ চালিয়ে যাই। আঙিনার বাইরে আমাকে খুব একটা বের হতে হতো না। কারণ আমার প্রয়োজনে লাগে এমন সামান্য জিনিসটা পর্যন্ত শৈশব কিনে আনতো।
আমার যেসমস্ত কর্মকাণ্ড বাবাকে হতাশ করতো সেসব পালা চুকেবুকে গেছে। তবুও আমার দৃঢ বিশ্বাস তিনি এখনো আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবেন না। তার ভয় এখনও তাড়া করে বেড়ায়। এখনো চোরের মতো আমাকে বাড়িতে ঢুকতে হবে। এমনকি তিনি বাড়ির বাইরে থাকলেও যে কোনো সময় হয়তো ফিরে আসতে পারেন। ফিরে এসে আমাকে অবাক করে দিয়ে জেরা শুরু করবেন। তবে সেটা কোন বিষয়ে একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন। তাই কখনো আমার বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে জাগলেও আমি সেটা একপাশে সরিয়ে রাখতাম। সেই সময় নিঃস্ব আঙিনার নিম গাছটিও আমাকে জ্বালানো শুরু করে। যদিও প্রত্যেকের কাছ থেকে অনেকটা দূরত্ব রেখে থাকি, তবুও বড়ি বেগমকে ধন্যবাদ দেই। তিনি এ পাড়ার বাসিন্দাদের সম্পর্কে কিছুটা হলেও খবরাখবর জানাতেন। এদের অধিকাংশ লোক নানা ধরনের হাতের কাজ করে। অথবা ছোটোখাটো কাজ করে পেট চালায়। বেশ কিছু মহিলা কাজ করেন এখানে। এদের মধ্যে অধিকাংশই সেলাই ও সূচিশিল্প করেন। একটি ছোটো পরিবারের মহিলা ও মেয়েরা কাগজের ফুলের মালা বানায়। আরেকটি পরিবার বাঁশের লাঠি জোগাড় করে। সেগুলো কেটেছেঁটে সোজা করে। তারপর সুদৃশ্য ঘুড়ির কাঠামো বানায়। আরো কিছু লোক কুচি কুচি করে সুপারি কাটে। সরতা দিয়ে সুপারি কাটার শব্দে দেউড়িতে বসে থাকা আমার সেই পাড়াতুতো অন্ধ দাদিমার কথা মনে করাতো। ছেলেবেলার প্রতি ভালোবাসার কারণে এইসব লোকদের কাজগুলো মনে আসে। কাজগুলো শেষ হলে তারা সেগুলো বাজারে নিয়ে যেত।
দিনে বেশ কয়েকবারই সে এই পাড়ায় আসতো। কাঁচা মালামাল দিয়ে যেত। আর এখানকার মালপত্র আবার বাইরে নিয়ে যেত। দোকানদারদের কাছ থেকে সে তার নিজের জন্য টাকা তুলতো। এ পাড়ার সবার খাবারদাবার জোগাড়ের ব্যবস্থার করার দ্বায়িত্ব তার কাঁধেই ছিল। এ পাড়ার সবার কাছেই সে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লোক ছিল। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ লোকটি হলেন বড়ি বেগম। তার কাছেই কেটেছে আমার জীবনের অত্যন্ত ভালো সময়। ঘরগেরস্থির নানা বিষয়ে পাড়ার বাসিন্দারা তার কথার উপরই ভরসা করত। তাদের ছোটোখাটো অসুখ-বিসুখের দাওয়াই তিনি দিতেন। নানা উৎসব-অনুষ্ঠানে অন্য যে কারোর চেয়ে তিনিই ছিলেন ভরসা। তাকে সবাই অনেক সম্মানও করত। সবাই তাকে বড়ি বেগম নামে ডাকত। কিছু কিছু মেয়েদের কাছে ছিলেন বড়ি বেগম খালা। কিন্তু তিনি যে কার বেগম ছিলেন সেটা আমি কখনোই খুঁজে বের করতে পারিনি।
এ পাড়ার কারো বিষয়েই আমার কোনো আগ্রহ নেই। সে সময় বা এখনো কেন ঐ জায়গাটিকে নিঃস্বদের জায়গা বলা হতো। আমি জানি না। সেখানকার কেউই নিঃস্ব ছিল না। নিজেদের গায়ে গতরে খেটে তারা প্রত্যেকে টিকে ছিল।
এক সকালে শৈশব প্রেম বলল, আজ কোনো কাজ নয়। তারপর তার ব্যাখ্যা করলো, “বড়ি বেগমকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।”
“কেন? তার আবার কী সমস্যা হলো?”
“আমার কিছু হয়নি’’ আঙিনা থেকে তার গলার শব্দ এলো। “এই শৈশবের মাথা খারাপ হয়েছে।”
“মাথা খারাপ?’' ঘরের ভেতর থেকে তেড়ে বলে উঠল, “তোমার বুকে কতকাল ধরে ব্যথা পুষে আছো খোদা জানে। কালরাতেও তুমি কাতরেছ। আজ তোমাকে ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে।”
“আমি আসছি। আসছি।” বলে তিনি বুরকা পরে এলেন। আমি উঠে তাকে সালাম করলাম।
“বেঁচে থাক। সুখি হ”, তিনি বললেন। বারবার এই কথা বললেন। “খোদা তোর ভালো করুক।”
এরপর কখনোই তাকে আর দেখিনি। ডাক্তার তাকে সোজা হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি নাই হয়ে গেলেন। হাসপাতাল থেকে তার মরদেহ গোসলখানায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে সোজা কবরখানায় বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। অধিকাংশ পুরুষলোকই তার জানাজায় উপস্থিত হয়েছিল। আর মহিলারা জড়ো হয়েছিল তার বাড়িতে। কিন্তু আমি আমার ঘরেই ছিলাম।
বড়ি বেগম চলে যাওয়ার পর মনে হলো এ নিঃস্ব পাড়ায় আমি কোনো না কোনোভাবে একজন আগন্তক মাত্র। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন সেখানকার আর কারো সঙ্গে কোনো ধরনের বাতচিত করার দরকার হতো না। তিনি আমার সঙ্গে অনেক কথা বলতেন। তার মাধ্যমেই এই পাড়ায় কী কী ঘটছে তা জানতে পারতাম। জমিদার বা ধনীদের রুচি মাফিক অগুনতি রান্নাবান্না করতে জানতেন তিনি। আবার কর্মচারী ও সাধারণ গরীবগুর্বা মানুষেরও খুব পছন্দের ছিল তার খাবার। বিভিন্ন ধরনের খানাখাদ্য নিয়ে তাকে আমি প্রায়ই প্রশ্ন করতাম। বিশেষত খাবারের সময়ে এটা ছিল একটা প্রিয় আলোচনার বিষয়। তিনি প্রত্যেকটা খাবার নিয়ে বিষদে বলতেন। আর রান্নার কায়দা সম্পর্কে এমনভাবে বলতেন যে শুনে শুনে মুখে যেন তার স্বাদ পেতাম। সব কিছুর উর্দ্ধে ছিল তার কথা বলার দরদভরা স্বর, যা মনে করে আমি বিচলিত হয়ে উঠছি।
শৈশব আমাকে কাজ দিয়েছে–এমনকি এখনো দিচ্ছে। কিন্তু কখনোই ওই জায়গার সঙ্গে কোনো ধরনের যোগসূত্র অনুভব করতে পারিনি। এক রাতে শোবার সময় তাকে আমি বললাম, “মুরাদ মিয়া কখনও আমার খোঁজখবর নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।”
“শেষপর্যন্ত তুমি তাহলে তাকে মনে করলে”, সে বলল। “না, সে নিয়মিত আমার কাছ থেকে তোমার খোঁজ খবর রেখেছে। জেলে যাওয়ার আগপর্যন্ত।”
“জেলে?” জানতে চাইলাম, “মুরাদ জেলে গিয়েছিল?”
“সে গিয়েছিল বটে, কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই বের হয়ে এসেছিল। তারপর সে অন্য কোথাও চলে গিয়েছে। হয়তো এখন সে ফিরে এসেছে। বেশ কিছুদিন আমি তার এলাকায় যাইনি। সব সময় আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয়।”
“তার সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই। যতদিন আমি এখানে এসেছি…”
“তুমি অন্য ধাতের মানুষ। এর মধ্যে ষোল বছর কেটে গেছে। এ পাড়ার বাইরে তুমি কখনো পা ফেলোনি”
ষোল বছর? ষোল বছর এই পাড়ায় আমি থেকেছি? বিস্মিত হলাম। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু তারপর আমার মনে হলো ছেলেবেলায় অনেক ছেলেই বড়ি বেগমের কাছে ঘুড়ি ঠিক করতে বা লেই নিতে আসত। তাদের এখন বিয়ে হয়ে গেছে, এর মধ্যে কারো কারো বাচ্চাকাচ্চাও হয়েছে।
শৈশব প্রেমকে খুব নিবিড়চোখে চেয়ে দেখলাম। তার মুখটি এখনও শিশুর মতো। তবে এখন চোখে ভালো দেখতে পায় না বলে ঘ্যান ঘ্যান করতে শুরু করেছে।
সেও আমার দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। শেষে প্রশ্ন করল, এখানে থাকতে বিরক্ত হয়ে উঠেছ? “
“হ্যাঁ।, যখন থেকে বড়ি বেগম… অল্প কদিনের মধ্যেই চলে যাব।”
কী কারণে যেন সে বিষণন হয়ে গেল। চুপ করে শুয়ে রইল। তারপর সে উল্টো দিকে পাশ ফিরলো। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। আমি অনেকক্ষণ জেগে রইলাম। আমার বাড়ি নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। কিন্তু এখন তার কিছুই আমি মনে করতে পারলাম না। দীর্ঘ সময়ের জন্য কখনও বাড়িতে থাকিনি। মা এতো কম কথা বলত যে তাতে তার থাকা না থাকার পার্থক্য বোঝা যেত না। যখনই আমার চোখের সামনে বাবার মুখটি ভেসে ওঠে, তখনি দেখি তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। এখনও দেখি। ষোলটা বছর পার হয়ে গেলেও তাইই দেখতে পাই। আতঙ্ক ছাড়া বাড়ি নিয়ে ভাবতে পারি না। তবে নিমগাছটির কথা আমি এখনও ভালোভাবে মনে রেখেছি। এখনো তার প্রতি আমি একইরকম টান অনুভব করছি। মনে পড়ে শিশুকালে গাছটিতে বহুবার উঠেছি। কয়েকবার গাছ থেকে পড়েও গিয়েছি। মাঝে মাঝে গাছের ঘন পাতার মধ্যে লুকিয়ে থেকেছি। সে সময়ে আমার প্রতি বাবার বেশ ভালোবাসা ছিল। তখন তিনি খুঁজতেন।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে শৈশব প্রেমকে বললাম, “পরশুদিন আমি চলে যাবো।”
“কোথায়? বাড়িতে?” সে জানতে চাইল।
“হয়তো,” আমি উত্তর দিলাম। “কিন্তু প্রথমে মুরাদ মিয়াকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো।”
বেশ কিছুক্ষণ সে চিন্তা করল। তারপর উত্তরে বলল, “ঠিক আছে। গাড়ি নিয়ে আসব। তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতো ভুলো না।”
“কী আবার গোছগাছ? শুধু একটা বিছানা। বাকিগুলো অনায়াসে একটা ব্যাগে ধরে যাবে।”
পরদিন শৈশব প্রেম আমাকে তার পাশে বসাল। সে আমাকে কিছু টাকা দিলো। এতো টাকা আমি আশা করিনি। সে বলল, “এটা তোমার রোজগার। যে টাকা তোমার জন্য খচর হয়েছে সেটা কেটে রাখা হয়েছে।”
আমি কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। টাকাগুলো নিলাম। পকেটে গুঁজে রাখলাম।
খুব ভোরেই সে আমাকে ঘুম থেকে ওঠালো। গাড়ি প্রস্তুতই ছিল। কারো কাছ থেকে বিদায় নেবার কোনো বালাই আমার ছিল না। আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। শৈশবপ্রেম চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তাকে বললাম, “বড়ি বেগম আর তোমার কথা প্রায় আমার মনে পড়বে।”
সে চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম, “তোমাকে দেখতে মাঝেমধ্যে আসব।”
তখনও সে কিছু বলল না। চুপচাপ চলে গেল।
এবার আমি আর পর্দার আড়ালে বসলাম না। কিন্তু শহরের এই অংশ আমার অচেনা। অচেনা রাস্তা দিয়ে বেশ কিছু সময় যাওয়ার পরে, চেনা রাস্তায় পড়লাম। অবশেষে মুরাদ মিয়ার এলাকায় পৌঁছালাম।
কোথাও তার জুয়ার আখড়া দেখা গেল না। কিন্তু তার এলাকার কিছু লোক আমাকে চিনে ফেলল। তাদের একজন বলল, “অনেক দিন আগে তুমি এখানে ছিলে।”
“ষোলো বছর,” আমি বললাম। ‘“মুরাদ মিয়াকে কোথায় পাবো?”
কাছে দাঁড়ানো একটি ছেলেকে সে বলল, “হাজি মুরাদের কাছে নিয়ে যা।” তারপর সে আমাকে বলল, “সে নিজের বাড়ি বানিয়েছে–এখান থেকে দূরে নয়।”
দুই তিনটি বাড়ির পরেই মুরাদ মিয়ার বাড়ি। বাড়িটা সুন্দর। মুরাদ মিয়া তখন বাইরের ঘরে বসেছিল। মুখভরা দাড়ি রেখেছে। তবু তাকে খুব বেশি বুড়োটে লাগে না। আমাকে দেখামাত্রই ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো। গভীর আনন্দে আমাকে বুকে টেনে নিল। সঙ্গে করে ঘরে নিয়ে গেল।
“বাহ মিয়া, তুমি দেখছি ওই ডেরাটিকে তোমার স্থায়ী বসতভিটা বানিয়ে ফেলেছো। সব ভুলে বসে আছো এমন কি আমাদের খোঁজখবর পর্যন্ত নাওনি। তা কখন এলে তুমি?”
“এই মাত্র।”
সকালের নাস্তা নিয়ে আসার জন্য কাউকে বললো। এরপর সে তার নিজের বিষয়ে বলল: জেল থেকে ফিরে সে তার জুয়ার যৌথ ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে হজ্ব করে এসেছে। পরবর্তীতে আরো দু’দফায় সে হজ্ব করেছে। এখন তার নিজের একটা ব্যবসা হয়েছে। আমি কী করছি সেটাও সে জানতে চাইল। আমার উত্তর একটাই, “বাক্স বানাই।”
আমার বাড়ি নিয়ে তার কাছে কিছুই জানতে চাইনি। কিন্তু তার কথাবার্তা থেকে ধারণা করলাম আমার বাবামা আর বেঁচে নেই। আমি তাকে বললাম, আঙিনায় থাকার পাট আমি চুকিয়ে এসেছি। কথা শুনে সে জিজ্ঞেস করল, “এখন তুমি কী করতে চাও?”
“তুমি যা বলবে,” আমি উত্তর দিলাম। “ষোলো বছরের আয়রোজগার আমার কাছে। দয়া করে আমাকে ছোটোখাটো একটা ব্যবসা ধরিয়ে দাও।”
“তোমার কাছে কতো টাকা আছে?”
শৈশব প্রেম যে টাকা আমাকে দিয়েছিল সেটাই তাকে জানালাম। সে বলল, ”এটা খুব বেশি নয়। কিন্তু… বেশ, যাওয়ার আগে কিছুদিন থেকে যাও আমার কাছে।”
তার বাড়িতে কিছুদিন রয়ে গেলাম। শেষ দিন সে আমার কাছে এসে বসল। “তোমার বাবার কাছ থেকে আমার বাবা যত টাকা ধার নিয়েছিল তার পুরো হিসাব আমার কাছে আছে। হজ্ব করে ফিরে এসে তোমার বাবার সাথে দেখা করেছিলাম। তাকে বলেছিলাম অবৈধ এক কানাকড়িও এখন আমার কাছে নেই। আমার বাবার শোধ না করা টাকাগুলো আপনাকে ফেরত দিতে দিন। কিন্তু তিনি আমার কোনো কথাই শুনলেন না। তিনি আমাকে এমন কি আমার বাবাকেও তীব্রভাষায় যা ইচ্ছেতাই গালিগালাজ করলেন।
সে চুপ হয়ে গেল যেন কিছু স্মৃতির ভারে সে অসহায় হয়ে পড়েছে। আমার বাবা তাকে কী ভাষায় কথা বলেছিল–আমি অনুমান করতে পারি। তাই কিছুই বললাম না। কিছুক্ষণ পরে সে বলল, “সেই টাকাগুলো আমার বুকে খুব বেশি ভার হয়ে চেপে আছে। এখন সেগুলো তোমাকে আমি দিচ্ছি। তুমিই তার একমাত্র উত্তরাধিকারী।”
বেশ বড়ো অঙ্কের টাকা। এখন আমি বুঝতে পারছি মুরাদ মিয়ার বাবার উপরে আমার বাবার কেন এতো রাগ ছিল। তারপর মুরাদ মিয়া বলল, “এখন বাড়ি যাও। বাড়িটা সারাও। পরে কিছু কাজের কথা বলব তোমাকে।”
বাড়ি যাওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার মধ্যে ছিল না। তবুও আমার জিনিসপত্র নিয়ে রওনা হলাম।
ষোলো বছর আগের মতোই আছে আমার বাড়ির সামনের পথ। আমাদের ঘরের দেউড়ির দিকে এগোলাম। থমকে দাঁড়ালাম। যেরকম ছেলেবেলায় শুনতে পেতাম ঠিক সেরকম সুপারি কাটার শব্দ দেউড়ি থেকে আসছে।
অন্ধ দাদিমা? চমকে গেলাম। তখন বুঝলাম আমার কানের ভেতরে শব্দগুলো বাজছে। ঘরে ঢুকলাম। সত্যি সত্যিই আমার অন্ধ দাদিমা সুপারি কাটছে। নলখাগড়ার বোনা চাটাইটাও ঠিক একই রকম আছে। আমি বিস্মিত হলাম। একটা ব্যাপারে আরো বেশি বিস্মিত হলাম যে তিনি আমার পায়ের শব্দ চিনে ফেলেছেন। দেউড়ির ভেতরের দরজার দিকে তিনি ঘুরলেন। চেঁচিয়ে উঠলেন, “বউ, ভাই ফিরে এসেছে। তার জন্য যে সোয়েটারগুলো বানিয়েছ সেগুলো বের করো। তার পছন্দের খাবার বানাও।”
বিহ্বল হলে দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। শেষে শুধালাম, “মা বেঁচে আছে?”
আমার চেয়েও বেশি বিস্মিত হলেন দাদিমা। বললেন, “হায় ভাই, এতো দিন কী হয়ে গেছে যে তুমি ভুলে গেছ কীভাবে কাঁদতে হয়, একজন মরা মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়?”
আমি কখনোই কাঁদিনি। কিন্তু মনে করতে পারি জীবিত মানুষ হিসেবে মৃত মানুষের উদ্দেশ্য কীভাবে কাঁদতে হয়।
দাদিমা কিছুক্ষণ কেঁদে চললেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর শেষে বললাম, “আমি ভেতরে যাচ্ছি।” বাড়ির ভেতরের দরজায় তালা ঝুলছিল। আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে দাদিমা কোমরবন্ধ থেকে চাবিটা খুলে বললেন, “ভাই, চাবি নাও।”
দরজা খুলে ভেতরে গেলাম। সব কিছুই উলটেপালটে রয়েছে। শুধু নিমগাছটিই ঠিক আগের মতো আছে। সত্যি বলতে পাতাগুলো আরো ঘন হয়েছে। এই গাছটি ছাড়া এই বাড়ির আর কিছুই মনে করতে পারছি না। অনেক সময় ধরে গাছের নিচে অনুভূতি শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সবই যেন অচেনা। আমার বুকের মধ্যেও কিছু নড়ে উঠল না। বাবামাকে হারিয়েছি। কিন্তু সে কষ্টও বেশি সময় থাকল না।
পরদিন থেকেই বাড়িঘর মেরামতের কাজে মেতে গেলাম।
“তুমি অন্য ধাতের মানুষ। এর মধ্যে ষোল বছর কেটে গেছে। এ পাড়ার বাইরে তুমি কখনো পা ফেলোনি”
ষোল বছর? ষোল বছর এই পাড়ায় আমি থেকেছি? বিস্মিত হলাম। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু তারপর আমার মনে হলো ছেলেবেলায় অনেক ছেলেই বড়ি বেগমের কাছে ঘুড়ি ঠিক করতে বা লেই নিতে আসত। তাদের এখন বিয়ে হয়ে গেছে, এর মধ্যে কারো কারো বাচ্চাকাচ্চাও হয়েছে।
শৈশব প্রেমকে খুব নিবিড়চোখে চেয়ে দেখলাম। তার মুখটি এখনও শিশুর মতো। তবে এখন চোখে ভালো দেখতে পায় না বলে ঘ্যান ঘ্যান করতে শুরু করেছে।
সেও আমার দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। শেষে প্রশ্ন করল, এখানে থাকতে বিরক্ত হয়ে উঠেছ? “
“হ্যাঁ।, যখন থেকে বড়ি বেগম… অল্প কদিনের মধ্যেই চলে যাব।”
কী কারণে যেন সে বিষণন হয়ে গেল। চুপ করে শুয়ে রইল। তারপর সে উল্টো দিকে পাশ ফিরলো। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। আমি অনেকক্ষণ জেগে রইলাম। আমার বাড়ি নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। কিন্তু এখন তার কিছুই আমি মনে করতে পারলাম না। দীর্ঘ সময়ের জন্য কখনও বাড়িতে থাকিনি। মা এতো কম কথা বলত যে তাতে তার থাকা না থাকার পার্থক্য বোঝা যেত না। যখনই আমার চোখের সামনে বাবার মুখটি ভেসে ওঠে, তখনি দেখি তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। এখনও দেখি। ষোলটা বছর পার হয়ে গেলেও তাইই দেখতে পাই। আতঙ্ক ছাড়া বাড়ি নিয়ে ভাবতে পারি না। তবে নিমগাছটির কথা আমি এখনও ভালোভাবে মনে রেখেছি। এখনো তার প্রতি আমি একইরকম টান অনুভব করছি। মনে পড়ে শিশুকালে গাছটিতে বহুবার উঠেছি। কয়েকবার গাছ থেকে পড়েও গিয়েছি। মাঝে মাঝে গাছের ঘন পাতার মধ্যে লুকিয়ে থেকেছি। সে সময়ে আমার প্রতি বাবার বেশ ভালোবাসা ছিল। তখন তিনি খুঁজতেন।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে শৈশব প্রেমকে বললাম, “পরশুদিন আমি চলে যাবো।”
“কোথায়? বাড়িতে?” সে জানতে চাইল।
“হয়তো,” আমি উত্তর দিলাম। “কিন্তু প্রথমে মুরাদ মিয়াকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো।”
বেশ কিছুক্ষণ সে চিন্তা করল। তারপর উত্তরে বলল, “ঠিক আছে। গাড়ি নিয়ে আসব। তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতো ভুলো না।”
“কী আবার গোছগাছ? শুধু একটা বিছানা। বাকিগুলো অনায়াসে একটা ব্যাগে ধরে যাবে।”
পরদিন শৈশব প্রেম আমাকে তার পাশে বসাল। সে আমাকে কিছু টাকা দিলো। এতো টাকা আমি আশা করিনি। সে বলল, “এটা তোমার রোজগার। যে টাকা তোমার জন্য খচর হয়েছে সেটা কেটে রাখা হয়েছে।”
আমি কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। টাকাগুলো নিলাম। পকেটে গুঁজে রাখলাম।
খুব ভোরেই সে আমাকে ঘুম থেকে ওঠালো। গাড়ি প্রস্তুতই ছিল। কারো কাছ থেকে বিদায় নেবার কোনো বালাই আমার ছিল না। আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। শৈশবপ্রেম চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তাকে বললাম, “বড়ি বেগম আর তোমার কথা প্রায় আমার মনে পড়বে।”
সে চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম, “তোমাকে দেখতে মাঝেমধ্যে আসব।”
তখনও সে কিছু বলল না। চুপচাপ চলে গেল।
এবার আমি আর পর্দার আড়ালে বসলাম না। কিন্তু শহরের এই অংশ আমার অচেনা। অচেনা রাস্তা দিয়ে বেশ কিছু সময় যাওয়ার পরে, চেনা রাস্তায় পড়লাম। অবশেষে মুরাদ মিয়ার এলাকায় পৌঁছালাম।
কোথাও তার জুয়ার আখড়া দেখা গেল না। কিন্তু তার এলাকার কিছু লোক আমাকে চিনে ফেলল। তাদের একজন বলল, “অনেক দিন আগে তুমি এখানে ছিলে।”
“ষোলো বছর,” আমি বললাম। ‘“মুরাদ মিয়াকে কোথায় পাবো?”
কাছে দাঁড়ানো একটি ছেলেকে সে বলল, “হাজি মুরাদের কাছে নিয়ে যা।” তারপর সে আমাকে বলল, “সে নিজের বাড়ি বানিয়েছে–এখান থেকে দূরে নয়।”
দুই তিনটি বাড়ির পরেই মুরাদ মিয়ার বাড়ি। বাড়িটা সুন্দর। মুরাদ মিয়া তখন বাইরের ঘরে বসেছিল। মুখভরা দাড়ি রেখেছে। তবু তাকে খুব বেশি বুড়োটে লাগে না। আমাকে দেখামাত্রই ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো। গভীর আনন্দে আমাকে বুকে টেনে নিল। সঙ্গে করে ঘরে নিয়ে গেল।
“বাহ মিয়া, তুমি দেখছি ওই ডেরাটিকে তোমার স্থায়ী বসতভিটা বানিয়ে ফেলেছো। সব ভুলে বসে আছো এমন কি আমাদের খোঁজখবর পর্যন্ত নাওনি। তা কখন এলে তুমি?”
“এই মাত্র।”
সকালের নাস্তা নিয়ে আসার জন্য কাউকে বললো। এরপর সে তার নিজের বিষয়ে বলল: জেল থেকে ফিরে সে তার জুয়ার যৌথ ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে হজ্ব করে এসেছে। পরবর্তীতে আরো দু’দফায় সে হজ্ব করেছে। এখন তার নিজের একটা ব্যবসা হয়েছে। আমি কী করছি সেটাও সে জানতে চাইল। আমার উত্তর একটাই, “বাক্স বানাই।”
আমার বাড়ি নিয়ে তার কাছে কিছুই জানতে চাইনি। কিন্তু তার কথাবার্তা থেকে ধারণা করলাম আমার বাবামা আর বেঁচে নেই। আমি তাকে বললাম, আঙিনায় থাকার পাট আমি চুকিয়ে এসেছি। কথা শুনে সে জিজ্ঞেস করল, “এখন তুমি কী করতে চাও?”
“তুমি যা বলবে,” আমি উত্তর দিলাম। “ষোলো বছরের আয়রোজগার আমার কাছে। দয়া করে আমাকে ছোটোখাটো একটা ব্যবসা ধরিয়ে দাও।”
“তোমার কাছে কতো টাকা আছে?”
শৈশব প্রেম যে টাকা আমাকে দিয়েছিল সেটাই তাকে জানালাম। সে বলল, ”এটা খুব বেশি নয়। কিন্তু… বেশ, যাওয়ার আগে কিছুদিন থেকে যাও আমার কাছে।”
তার বাড়িতে কিছুদিন রয়ে গেলাম। শেষ দিন সে আমার কাছে এসে বসল। “তোমার বাবার কাছ থেকে আমার বাবা যত টাকা ধার নিয়েছিল তার পুরো হিসাব আমার কাছে আছে। হজ্ব করে ফিরে এসে তোমার বাবার সাথে দেখা করেছিলাম। তাকে বলেছিলাম অবৈধ এক কানাকড়িও এখন আমার কাছে নেই। আমার বাবার শোধ না করা টাকাগুলো আপনাকে ফেরত দিতে দিন। কিন্তু তিনি আমার কোনো কথাই শুনলেন না। তিনি আমাকে এমন কি আমার বাবাকেও তীব্রভাষায় যা ইচ্ছেতাই গালিগালাজ করলেন।
সে চুপ হয়ে গেল যেন কিছু স্মৃতির ভারে সে অসহায় হয়ে পড়েছে। আমার বাবা তাকে কী ভাষায় কথা বলেছিল–আমি অনুমান করতে পারি। তাই কিছুই বললাম না। কিছুক্ষণ পরে সে বলল, “সেই টাকাগুলো আমার বুকে খুব বেশি ভার হয়ে চেপে আছে। এখন সেগুলো তোমাকে আমি দিচ্ছি। তুমিই তার একমাত্র উত্তরাধিকারী।”
বেশ বড়ো অঙ্কের টাকা। এখন আমি বুঝতে পারছি মুরাদ মিয়ার বাবার উপরে আমার বাবার কেন এতো রাগ ছিল। তারপর মুরাদ মিয়া বলল, “এখন বাড়ি যাও। বাড়িটা সারাও। পরে কিছু কাজের কথা বলব তোমাকে।”
বাড়ি যাওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার মধ্যে ছিল না। তবুও আমার জিনিসপত্র নিয়ে রওনা হলাম।
ষোলো বছর আগের মতোই আছে আমার বাড়ির সামনের পথ। আমাদের ঘরের দেউড়ির দিকে এগোলাম। থমকে দাঁড়ালাম। যেরকম ছেলেবেলায় শুনতে পেতাম ঠিক সেরকম সুপারি কাটার শব্দ দেউড়ি থেকে আসছে।
অন্ধ দাদিমা? চমকে গেলাম। তখন বুঝলাম আমার কানের ভেতরে শব্দগুলো বাজছে। ঘরে ঢুকলাম। সত্যি সত্যিই আমার অন্ধ দাদিমা সুপারি কাটছে। নলখাগড়ার বোনা চাটাইটাও ঠিক একই রকম আছে। আমি বিস্মিত হলাম। একটা ব্যাপারে আরো বেশি বিস্মিত হলাম যে তিনি আমার পায়ের শব্দ চিনে ফেলেছেন। দেউড়ির ভেতরের দরজার দিকে তিনি ঘুরলেন। চেঁচিয়ে উঠলেন, “বউ, ভাই ফিরে এসেছে। তার জন্য যে সোয়েটারগুলো বানিয়েছ সেগুলো বের করো। তার পছন্দের খাবার বানাও।”
বিহ্বল হলে দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। শেষে শুধালাম, “মা বেঁচে আছে?”
আমার চেয়েও বেশি বিস্মিত হলেন দাদিমা। বললেন, “হায় ভাই, এতো দিন কী হয়ে গেছে যে তুমি ভুলে গেছ কীভাবে কাঁদতে হয়, একজন মরা মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়?”
আমি কখনোই কাঁদিনি। কিন্তু মনে করতে পারি জীবিত মানুষ হিসেবে মৃত মানুষের উদ্দেশ্য কীভাবে কাঁদতে হয়।
দাদিমা কিছুক্ষণ কেঁদে চললেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর শেষে বললাম, “আমি ভেতরে যাচ্ছি।” বাড়ির ভেতরের দরজায় তালা ঝুলছিল। আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে দাদিমা কোমরবন্ধ থেকে চাবিটা খুলে বললেন, “ভাই, চাবি নাও।”
দরজা খুলে ভেতরে গেলাম। সব কিছুই উলটেপালটে রয়েছে। শুধু নিমগাছটিই ঠিক আগের মতো আছে। সত্যি বলতে পাতাগুলো আরো ঘন হয়েছে। এই গাছটি ছাড়া এই বাড়ির আর কিছুই মনে করতে পারছি না। অনেক সময় ধরে গাছের নিচে অনুভূতি শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সবই যেন অচেনা। আমার বুকের মধ্যেও কিছু নড়ে উঠল না। বাবামাকে হারিয়েছি। কিন্তু সে কষ্টও বেশি সময় থাকল না।
পরদিন থেকেই বাড়িঘর মেরামতের কাজে মেতে গেলাম।
এখন আমার নিজের ব্যবসা হয়েছে। এটা মুরাদ মিয়ার সহযোগিতায় বেড়ে ভালোই চলছে। বিয়েও করেছি। অনেকবারই নিঃস্বদের ডেরা ওই শূন্য আঙিনা থেকে ঘুরে আসতে চেয়েছি। কিন্তু এখন আমি জানিও না সেটা কোথায়। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও কেমন একটা দ্বিধা লাগে। শৈশব প্রেমকে বাজারে প্রায় দেখতে পাই। নিজের খোলা গাড়িতে জিনিসপত্র চাপিয়ে চলেছে। সেই একই জিনিসপত্র যা আগের দিনগুলোতে সব সময়ই ডেরা থেকে আগেপিছে তাকে নিয়ে যেতে দেখেছি। যদিও আগের মতো গাড়ি বোঝাই পেস্টবোর্ড আর কাগজ থাকে না। তার দৃষ্টিশক্তি সম্ভবত আরো কমেছে। তাসত্ত্বেও আমি হাত তুলে জানতে চাই তার দিনকাল কেমন চলছে। অবশ্য তার কোনো উত্তর পাই না।
গল্পসূত্র: ‘ডেসটেটিউস কম্পাউড’ গল্পটি নাইয়ার মাসুদের উর্দু গল্পগ্রন্থ ‘গঞ্জেফা(Ganjifa)’র অর্ন্তগত ‘মিসকিন কা আহাতাহ’ এর ইংরেজি অনুবাদ। উর্দু থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ উমর মেমন(Muhammad Umar Memon) ।
লেখক পরিচিতি: নাইয়ার মাসুদ(Naiyer Masud) একজন প্রখ্যাত উর্দু ও পারসিক ভাষার পণ্ডিত, গল্পকার। ১৯৩৬ সালের ১৬ নভেম্বর তিনি ভারতের উত্তর প্রদেশের লখনৌতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মাসুদ হাসান রিজভী এবং মা হুসনে জাহান। বাবা মাসুদ হাসান রিজভি লখনৌ বিশ্ববিদ্যায়লের শিক্ষক ও পারসিক ভাষার একজন পণ্ডিত ছিলেন। বাবার যোগ্যউত্তরসূরী হিসেবে নাইয়ার মাসুদও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যুক্ত হন। লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্সি ভাষার অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণের পর তিনি তাঁর বাবার তৈরি বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। বাড়ির নাম “আদাবিস্তান”, যার অর্থ সাহিত্যের আবাস। সাহিত্যের সাথে যে তাঁদের বন্ধনটা নিবিড় ছিল, এ থেকে স্পষ্ট। অসংখ্য ছোটো গল্প তিনি লিখেছেন। বিভিন্ন ভাষায় তা অনূদিতও হয়েছে। প্রচুর প্রবন্ধও লিখেছেন তিনি। কাফকার অনুবাদক হিসেবেও তিনি সুপরিচিত। তার লেখায় কাফকা, বোর্হেস প্রমুখদের প্রভাব লক্ষনীয়। ‘৭০ এর দশক থেকে তিনি ছোটো গল্প প্রকাশ শুরু করেন। “দ্য স্নেক ক্যাচার(The Snake Catcher),” “এসেন্স অফ ক্যামফর(Essence of Camphor) তাঁর সর্বাধিক পঠিত গল্পগ্রন্থ। বাবার মতো পদ্মশ্রী না পেলেও সাহিত্যিক জীবনে তিনি অসংখ্য পুরুস্কার লাভ করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো উর্দু একাডেমি পুরস্কার(১৯৯৩), সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার(১৯৯৩), গালিব পুরস্কার(২০০১), প্রেসিডেন্ট অফ ইন্ডিয়া পুরস্কার(২০০৩)। ২০০৭ সালে সরস্বতী সাহিত্য সম্মানে তাঁকে ভূষিত করা হয়। তাঁর ছোটো গল্পের সংকলন, “ তাউস চমন কি ময়না”র জন্য তিনি এই পুরস্কার পান। ২০১৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
1 মন্তব্যসমূহ
গল্পটি বিবরণ হলেও অনুবাদ স্বচ্ছ সহজ।
উত্তরমুছুন