অনুবাদ : এলহাম হোসেন
[নাইয়ার মাসুদ (১৯৩৬-২০১৭) ভারতের উর্দু ভাষার জনপ্রিয় ছোটগল্প লেখক। জন্ম লখনৌতে। অধ্যাপনা করেছেন লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনুবাদক হিসেবেও তাঁর বিশেষ খ্যাতি আছে। তাঁর অনেকগুলো ছোটগল্পের ইংরেজি অনুবাদ করেন এম. ইউ. মেমন। তাঁর ছোটগল্পের ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত বইয়ের নাম The Snake Catcher এবং Essence of Camphor. অনূদিত গল্পটি তাঁর ‘‘Obscure Domains of Fear and Desire’ এর বাংলা ভাষান্তর।]
তোমাতেই চোখ দু’টো আটকায়
বিচলিত মন পারে না বলতে যা বলতে চায়।
ফেলে আসা দিনগুলো মনে হয় মম
অতীতের এক একটি বছর সম।
(স্তোত্রগান ৭৭)
একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আগে কখনও এতক্ষণ চেয়ে থাকিনি। মুখের অভিব্যক্তি মনের অনুসন্ধিৎসাকে ঠকাতে পারল না। ওর চোখে ছিল তীক্ষ্ণতা, উজ্জ্বলতা। কিন্তু পুরো সময় জুড়ে কখনও মনে হয়নি যে, ওতে কোন অনুভূতি নেই। বুঝতে পারলাম না ওর চোখ আসলেই কিছু বলার চেষ্টা করছে, নাকি শুধু আমায় দেখছে। তবে মনে হলো, আমরা কোন নীরব বোঝাপড়ায় পৌঁছেছি। হঠাৎ এক ভয়ানক হতাশা আমাকে পেয়ে বসলো। এ বাড়িতে আসার পর থেকে এবারই প্রথম আমার এমন অনুভূতি হলো।
“ঠিক সেই মুহূর্তে নার্স ওর হাতটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। ঘরের বাইরে যেতে বলল। বাইরে এসে যখন ওর নার্সের সঙ্গে কথা বললাম তখন বুঝলাম, আমার কথার কোন অর্থ নেই। রোগী এতক্ষণে সেই পথে পা বাড়িয়েছে যে পথের ব্যাপারে বেমালুম আমি কিছুই জানি না।”
আমি কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। তবে দেখা নয়। চোখ থাকলে না দেখে থাকা সহজ নয়। জিহ্বা থাকলে কথা না বলে পারাটা অপেক্ষাকৃত সহজ। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ রাখার প্রয়োজন মনে হয়। তবে এখনও চোখ দু’টো খুলেই রেখেছি।
এমনটি হতে পারে সেই ব্যক্তির জন্য যে আমাকে খুঁজছে। যে বাড়িতে আমি প্রথম চোখ মেলেছি; যে বাড়িতে আমি প্রথম কথা বলতে শিখেছি সেই বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সে-ই আমার শেষ যোগসূত্র। যখন আমি ঐ বাড়িতে থাকতাম তখন ও ছিল শুধুই একটি পুতুলের মতো। বয়স ছিল তখন এক বা দেড় বছর। আমার প্রতি ওর ছিল অনেক মায়া। বাড়িতে ঢুকেই আমি ওকে ডাকতাম। আমি যতক্ষণ ওখানে থাকতাম ততক্ষণই ও আমার সাথে সাথেই থাকত।
এখন আর ওর সে দিনগুলোর স্মৃতি মনে নেই। তাকে যা বলা হয়েছে, তা হলো- ঐ পরিবারের আমিই সর্বশেষ প্রতিনিধি। ও আমার সম্বন্ধে বেশিকিছু জানে না। তা সত্ত্বেও ও আমাকে খুব পছন্দ করে। মনে করে, ও আমাকে এবারই প্রথম দেখছে। ওর মনে নেই যে, আমি ওকে ‘কনে’ বলে ডাকতাম। ওকে আমি ‘কনে’ বলে ডাকার কারণ হলো পরিবারের কেউ যদি ওকে জিজ্ঞেস করত যে, আমি ওর কে, তখন সে বলত, ‘বর’। এ কথা শোনার পর ও একটু রাগ করলো। যারা ওকে উত্যক্ত করত তাদের মধ্যে বয়স্ক নারী ও পুরুষ আত্মীয়-স্বজনও আছে।
সেই দিনগুলোতে ওর ছোট্ট জগতে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল অনেক। তবুও ওর প্রতিন্দ্বন্দ্বীদের মধ্যে এমন কেউ ছিল না যার জন্য ওর হৃদয়ে উষ্ণ অনুভূতি ছিল। তবে ওর মা আর আমার ব্যাপার ব্যতিক্রম। আর বিনিময়ে এই মহিলা অন্য যে কারো চাইতে এই ছোট্টা মেয়েটাকে বেশি আদর করত। ও আসলে আমার দুই বছরের বড়। আমি অবশ্য বার বছর আগের কথা বলছি। ওকে আমার বড় ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম। ও আমার ভাবীর ছোট বোন। তবে সম্পর্কের জটিল সমীকরণের কারণে ও আমার সম্পর্কে খালাও হয়।
আমার ভাইয়ের বিয়ের সময় ও পূর্ণ যুবতী। আর আমি একরত্তি বালক। লাজুক, আনাড়ি, কিশোর। আমরা প্রায়ই গল্প করতাম। কিন্তু এতসব ঘরোয়া ব্যাপার-স্যাপার সত্ত্বেও ও আমার প্রতি একটি মুরুব্বিয়ানা ভাব ধরে রাখত। তবে তার এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আমি কখনও কোন প্রেমের সন্ধান পাইনি। ওটা সম্ভবত আমাকে পীড়া দিত। এমন আচরণ অবশ্য করত না যেন সে আমার চাইতে বয়সে বেশ বড়। তবে এমন ভাব দেখাত যেন আমি তার চাইতে একটু ছোট। আমার অবশ্য ভালোই লাগত। মাঝে মাঝে আমি সত্যি সত্যিই বুঝতে পারতাম, আমি তার ছোট ভাগ্নে। যখন সে তার জন্ম আমার জন্মস্থানের সঙ্গে তুলনা করত এবং জোড়াজুড়ি করত যে, তারটাই আমারটার চাইতে অধিকতর ভালো, তখন আমি লাফিয়ে উঠে বালকসূলভ যুক্তিতর্ক প্রদর্শন করে যেতাম আর করে যেতাম।
সে সময় ও একবার আমাদের বাসায় এসে অনেকটা সময় থাকলো। সেবার বেড়াতে এসে তিন-চারদিন থেকেছিল।
বাড়িতে পা রেখেই আমি আমার ‘ছোট্ট কনে’কে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু বাড়িতে কারো কোন সাড়াশব্দ নেই। মনে হলো, বাড়িতে কেউ নেই। তবে আন্টি ছিল। সে সবেমাত্র গোসলখানা থেকে বেরিয়ে চুল শুকানোর জন্য একটি রৌদ্রজ্জ্বল স্থানে বসে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, সবাই কোথায়। বলল, সবাই বিয়ে বাড়ি গেছে। কী বলব তা বুঝতে না পেরে আমি আমার ‘ছোট্ট কনে’কে বললাম, সে-ও তো যেতে পারত।
কাছে গিয়ে পাশে বসে পড়লাম। এটা-সেটা নিয়ে খোশগল্প শুরু করে দিলাম। বেশিরভাগ সময়ই আমি আমার ‘ছোট্ট কনে’কে নিয়েই কথা বললাম। আমাদের উদ্ভট আচার-আচরণ নিয়ে হাসি-তামাসা করলাম। চুল শুকিয়ে গেলে একটু পরে সে খোঁপা করার জন্য উঠে দাঁড়ালো। চুলগুলো গুছিয়ে নেওয়ার জন্য দু’হাত মাথার পেছনে নিয়ে গেল। তার নগ্ন কোমর পেছনের দিকে আলতো ভাঁজ হয়ে ঝুকে গেল। বুকটা উঁচু হয়ে উঠল। তারপর আবার কিছুটা নীচু হলো। খোঁপা খুলে গেল। এক সেকেন্ডের চাহুনিতে দেখে নিলাম। তবে আমার মনে কোন প্রভাব ফেলল না। কথা বলতে বলতেই সে একটি ছোট খোঁপা বাঁধতে থাকলো।
হঠাৎ তার একটা কানের দুল খসে পায়ের কাছে পড়ে গেল। আমি যখন ওটা তোলার জন্য হাঁটু গেঁড়ে বসলাম তখন আমার নজর পড়ল ওর গোলাপী পায়ের ভাঁজে। মনে পড়ল, ও তো সবে গোসল সেরে এসেছে। দুলটা কুড়িয়ে নিয়ে ওর কানে পরিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম। সেই সঙ্গে তড়িঘড়ি করে কথাও বলে যেতে লাগলাম। এক ধরনের মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিলাম যা ওর ভেজা শরীর থেকে বেরিয়ে আসছিল। ও তখন চুল বাঁধতে ব্যস্ত। আর আমি ব্যস্ত ওর কানে দুল পরাতে। কি যেন কারণে আমি দুলটি পরাতে পারলাম না। দেখলাম, ওর কানের লতি লাল হয়ে যাচ্ছে। দুলের দ-টা দিয়ে ওকে হয়ত খোঁচা দিয়ে ফেলেছি। এক ধরনের মৃদু চিৎকার ওর গলা দিয়ে বেরুলো। আমাকে মৃদু তিরস্কার করলো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবার হাসালোও। এবার কানের দুলটি নিয়ে ও নিজেই পরলো। একটু পরে ওর ঘওে চলে গেল। আমি গেলাম আমার ঘরে।
কিন্তু শীঘ্রই একটি বই খুঁজতে দোতলায় গেলাম। ফেরার পথে আন্টির ঘরে উঁকি দিলাম। ও বাঁশের কাঠি দিয়ে বানানো পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো। কাঁধের ওপর পড়ে আছে। চোখ দু’টো ঢুলু ঢুলু। যেন এইমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। আমি ওর ঘরে ঢুকে পড়লাম। এটা-সেটা নিয়ে গল্প শুরু করে দিলাম। আবার সে চুল বাঁধতে শুরু করলো। বার বার। যা আগে দেখেছিলাম তার আবার দেখলাম। তবে এবার ওর কোমর পেছনের দিকে ভাঁজ হতে দেখে আমার কেমন এক ধরনের অস্বস্তি লাগলো। এবার বিয়েবাড়ির কথা নিয়ে আলাপ শুরু করলাম। মাঝে মাঝে লাগামছাড়া, অতিরঞ্জিত করে এটা- সেটা বলতে লাগলাম। বললাম, কনে তো বরের কোমর পর্যন্ত লম্বা হবে।
এ কথা শুনে ও হেসে দিলো। বলল, “যাই হোক, সে তো কমপক্ষে তোমার চেয়ে লম্বা হবে।”
আমরা আবার আমার ‘ছোট্টা কনে’কে নিয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করলাম। ওর অনুপস্থিতিতে বাড়িটা খালি হয়ে গেছে। আমি সবে অন্য একটি বিষয়ে কথা বলতে শুরু করতে যাচ্ছি ঠিক তখনই ও বিছানা থেকে উঠে আমার দিকে এলো।
“ দেখি, দেখি, তুমি আমার চেয়ে বেশি লম্বা কি-না,” মুখে হাসি ছড়িয়ে বলল।
দাঁত খিচিয়ে হাসি দিয়ে এগিয়ে এসে আমরা মুখোমুখি দাঁড়ালাম। ও আমার গা ঘেষে দাঁড়ালো। আরেকবার ওর শরীরের গন্ধ আমার ভেতরে আলোড়ন তুললো। উষ্ণ, ভেজা ভেজা গন্ধ। এই গন্ধ মনে করিয়ে দিলো, ও সবেমাত্র গোসল সেরে এসেছে। আমরা আরও এতোটাই কাছাকাছি ঘেষে দাঁড়ালাম যে, ওর কপাল আমার ঠোঁট দু’টোকে স্পর্শ করলো।
“তুমি তো আমার চেয়ে বেশ খাটো,” আমি বললাম। “আরে না, না,” ও সঙ্গে সঙ্গে বলল। তারপর দু’পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ালো। ফিক করে হাসি দিয়ে বলল, “এখন কে বেশি লম্বা বল দেখি?”
আমি দু’হাত দিয়ে ওর কোমর জাপটে ধরে চাপ দিয়ে ওকে খাটো করতে চেষ্টা করলাম। “তুমি কিন্তু চালাকি করছো,” হেলে ওর পায়ের গোড়ালী দু’টো ধরে মেঝেতে ফেলার চেষ্টা করলাম। এরপর যখন দাঁড়ালাম, দেখি, ও আর হাসছে না। আমি দু’হাতে আবার ওর কোমর জাপটে ধরলাম।
“তুমি কিন্তু ঠিক কাজ করছ না”, আমি বললাম। কিন্তু তখনও ওর কোমরটা আমি শক্ত করে ধরে আছি।
ও হাত দু’টি আমার গলা বরাবর তুললো। তারপর থামলো, মনে হলো বিশাল সুনসান নিস্তব্ধতার মধ্যে আমি দাঁড়িয়ে আছি। ওর কোমর আরো শক্ত করে ধরলাম।
ফিস ফিস করে বললো, “দরজাটা খোলা আছে।”
ওকে দরজা পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলাম। কোমর ছাড়লাম না। এরপর অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও ওকে ছেড়ে দরজার হুড়কো লাগালাম। তারপর আবার ওর দিকে ফিরলাম।
আমার মনে আছে, ও সবসময় কিভাবে যেন আমার উপর এক ধরনের মুরুব্বিয়ানা ফলাত। এতে অবশ্য আমার রাগই হতো। কিন্তু এখন আমার রাগ পড়ে গেছে। ওর শরীরের প্রচণ্ড আকর্ষণ অনুভব করলাম। হেলে ওর পা দু’টো শক্ত করে ধরলাম। মনে হলো, ওর হাতের আঙ্গুলগুলো আমার চুলে বিলি কাটাছে। প্রচ- হ্যাচকা টানে ও আমাকে ওর দিকে টেনে নিল। আমার মাথাটা ওর বুকে ধাক্কা খেল। তখনও ওর আঙ্গুলগুলো আমার চুলে বিলি কাটছে। বিছানার দিকে পিছিয়ে গেল। বিছানার ধারে গেলে ওকে ছেড়ে দিয়ে ওর পা দু’টো ধরে বিছানায় তুলে দিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে ও নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
ওর দিকে তাকালাম।
ও ফিসফিস করে বলল, সিঁড়ির দরজাটা খোলা আছে।
খোলা।
কিন্তু বাড়িতে তো কেউ নেই।
কেউ এসে পড়তে পারে।
আমরা সন্তর্পণে সিঁড়ি বেয়ে নামলাম। নীচে গিয়ে দরজার হুড়কো লাগালাম। এরপর আবার এক সঙ্গে ফিরে এলাম। ঘরে ঢুকে হুড়কো লাগিয়ে দিলাম। শুধু আমাদের দু’জনের ধমনীতে রক্তপ্রবাহের ঘূর্ণাবর্তের শব্দ ছাড়া সবকিছু শান্ত বলেই মনে হলো। অন্য স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যেমন আমরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলি, ঠিক তেমনই শান্ত আমরা এখন। ও বিছানার কাছে গিয়ে থামলো। চুলগুলো বেঁধে নিলো। কানের দুলগুলো খুলে বালিশের কাছে রাখলো। এক নিমিষেই আমার কাছে প্রেমের সব গল্পগুলো মনে পড়ে গেল। এই গল্পগুলোতে প্রেমিক-প্রেমিকারা পাশাপাশি দাঁড়ায় তাদের উচ্চতার তুলনা করার জন্য। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম ঐ গল্পগুলো সবই কল্পনাপ্রসূত, মনগড়া কাহিনী। এগুলোর সত্যতা এখন বুঝতে পারছি এই মহিলার সঙ্গে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যে আমার দুর সম্পর্কের আন্টি। যে আবার আমার ভাইয়েল স্ত্রীর ছোট বোনও।
আমি ওকে আলতোভাবে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। ঠিক আমার সেই ‘ছোট্ট কনে’ ভেবে যাকে আমি কিছুক্ষণ আগেও ডাকতে ডাকতে বাড়িতে ঢুকেছিলাম। সম্ভবত ঐ একই ভাবনা ওর মনেও চলছে। যেইমাত্র আমি ওর দিকে ঝুকতে যাব তখনই ও সটান উঠে বসলো। ওর চোখেমুখে ভীতির বিদ্যুৎ খেলে গেল।
“ কেউ একজন আমাদের দেখছে” দরজার দিকে উদ্দেশ্য করে বলল। ওদিকে তাকিয়ে আমারও একই রকম ধারণা হলো। কেউ যেন দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে আমাদের দেখছে। লোকটি একবার উঁকি দেয়, তারপর আবার সরে পড়ে। তারপর আবার। কয়েক মিনিট ধরে এটি চলতে লাগলো। আমরা উভয়ে নীরবে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। অবশেষে উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। যে বাঁশের কাঠির তৈরি পর্দা দরজায় ঝুলানো ছিল সেটি আলতোভাবে এদিক- সেদিক দুলছিল। হাত দিয়ে এতে একটু ধাক্কা দিলাম। তারপর আবার দরজা বন্ধ করে দিলাম। সূর্যের আলো দরজার ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করার সময় বাতাসে পর্দা নড়ার কারণে আলো-ছায়ার সমন্বয়ে একটি অবয়ব তৈরি করেছে।
আমি আবার ওর দিকে ফিরলাম। একটা মৃদু হাসি ওর ঠোঁটে ছড়িয়ে আছে। তবে ওর বুক ভেদ করে বেরিয়ে আসা হৃৎকম্পনের জোর শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। ওর হাত-পাগুলো বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। বিছানার পাশে একটি চেয়ারে বসলাম। ওকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব অলীক ভাবনার লম্বা লম্বা গল্প শোনাতে লাগলাম। ও নিজেও আমাকে এরকম কিছু গল্প শুনাতে শুরু করলো। শীঘ্রই আমরা সচরাচর যেভাবে গল্পগুজব করতাম সেভাবে গল্পের মধ্যে ডুব দিলাম। কয়েক মিনিট আগে আমাদের মধ্যে কী ঘটেছে, সে-ব্যাপারে একটা কথাও আর হলো না। অবশেষে ও বলল, “সবাই খুব শ্রীঘ্রই চলে আসবে।”
আমি জানতাম, সিঁড়ির মাথার দরজাটার হুড়কো ভেতর থেকে লাগানো আছে। ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের পরিবারের সদস্যদের গলা শুনতে পেলাম। উঠে গিয়ে ঘরের দরজার পুরোপুরি খুলে দিলাম। এরপর বাইরে গেলাম। আন্টিও আমার পেছন পেছন বেরিয়ে এলো। সিঁড়ির দরজা খুলে দিলাম। এরপর ঘরে ফিরে এসে অল্পবিস্তর এটা সেটা নিয়ে গল্পগুজব করলাম।
শ্রীঘ্রই হৈ চৈ শুনতে পেলাম। দেখলাম, আমার ‘ছোট্ট কনে’ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে কনের মতোই। আন্টি আনন্দে চিৎকার দিলো। টেনে কোলে তুলে নিয়ে চুমু দিতে শুরু করলো। আবেগের আতিশয্যে। ছোট্ট মেয়েটি আনন্দে চিৎকার করতে লাগলো। পালিয়ে যেতে চাইলো। যে বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে সেখানকার কিছু অতি উৎসাহী কিছু মেয়ে ওকে কনের সাজে সাজিয়েছে। গলায় মালাও পড়িয়ে দিয়েছে। ওর মা অন্যান্যদের নিয়ে যখন ঘরে ঢুকলো তখন ও আমার কোলে বসা। বিয়েবাড়িতে ও কী কী খেয়েছে, সে-ব্যাপারে আমি ওকে জিজ্ঞেস করছিলাম। ও অল্প কয়েকটা খাবারের নাম বলতে পারে। তারপর বারবার ওগুলোর নামই বলতে থাকে। ওর মা ওকে নিয়ে যেতে চাইলে ও কোল থেকে নামতে চায় না।
“ওহ, ওতো নির্লজ্জ কনে রে বাবা,” আন্টি বলল। এতে সবাই হাসিতে ফেটে পড়লো।
এরপর সবাই বারান্দায় এলাম। ওখানে পরিবারের সব সদস্য সমবেত হয়েছে। ও ‘ছোট্ট কনে’কে শেখাচ্ছিল, কিভাবে লাজুক লাজুক ভাব প্রকাশ করতে হয়। এতে উপস্থিত সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল।
সন্ধ্যা নামলে আমি ওকে একা ধরে ফেলার অনেকবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ও তখন মহিলাবেষ্টিত হয়ে বসেছিল। বিয়েবাড়ির গল্প শুনছিল। সে-রাতে তিন তিনবার সিঁড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এটি ভেতর থেকে লাগানো ছিল। জানতাম, আরও দু’জন অবিবাহিত মহিলা যারা এই বাড়িতে সবসময়ই আসা যাওয়া করে, তারাও ওর সঙ্গে ঘুমিয়েছে। তবুও আমি দোতলায় ওর ঘরে যেতে চেষ্টা করলাম।
পরের দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আমি ওকে ঐ মহিলাদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিতে দেখলাম। আমি কখনই মহিলাদের সঙ্গে বেশি সময় ব্যয় করতে পছন্দ করি না। কাজেই, ওর ব্যাপারে কিছু উল্টাপাল্টা মতামত ব্যক্ত করে ওর কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করলাম।
দুপুরের পর পরই পরিবারের সব সদস্য যে যার ঘরে বিশ্রাম নিতে চলে গেল। সবার ঘরের উঠোনের দিকে খোলা দরজাগুলো ভেতর থেকে হুড়কো লাগিয়ে সবাই বন্ধ করে দিলো। সিঁড়ি বেয়ে উঠে আন্টির ঘরের দরজার বাঁশের কাঠির তৈরি পর্দা উঠালাম। ও তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অনেকক্ষণ ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। আমি নিশ্চিত যে ও ঘুমের ভান করছে। ওর মাথাটা বালিশের পেছন দিকে একটু ঝুলে আছে। হাতগুলো শক্ত মুঠো পাকানো। কানের দুলগুলো খুলে বালিশের কাছে রেখে দিয়েছে। ঠিক একদিন আগে এই ঘরে যে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল, তা এবার আমার মনে ঝলসে উঠলো। কিন্তু এরপর মুহূর্তে যা ঘটলো তা মনে করার চেষ্টা করলে আমার মাথাটা ফাঁকা হয়ে যায়। মনে হলো, ওকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিই। দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজাটা কেবল বন্ধ করে দিতে গেছি, দেখি বেলকনিতে ঐ যে সবসময় যে মহিলারা আনাগোনা করে, তাদের একজন উলের সুতা বলের মতো করে প্যাঁচাচ্ছে। উচ্ছ্বাসে গদগদ হয়ে সে আমাকে অভিবাদ জানালো। ভ্রান্ত তথ্য দিয়ে বলল, আন্টি ঘুমাচ্ছে। ভান করলাম যেন একটা বই খুঁজতে ওর ঘরে ঢুকে পড়েছি। অভযোগের সুরে বললাম, বইটা খুঁজে পাচ্ছি না। এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু খোঁজার সময় ওর দিকে বারবার তাকালাম। মোটের উপর ওকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বলেই মনে হলো।
সেদিন বিকেলে ঐ উটকো মহিলাটাকে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে দেখলাম। তখন আরেকবার উপরে গেলাম। আন্টির ঘরে উঁকি দিলাম। দেখলাম, ও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছে। আমি ওর পেছনে। আরেকজন বহিরাগত মহিলা ওর পাশে বসে তার স্বামীর হাতে মার খাওয়ার বেদনাদায়ক ঘটনা বর্ণনা করে চলেছে। এ গল্প আমি আগে অনেকবার শুনেছি। আসল কথা হলো, এই গল্প আমাদের বাড়িতে একটি বিনোদনের উৎসে পরিণত হয়েছে। আন্টি স্মিত হাসলো। তারপর আমাকে দেখে ভেতরে এসে বসতে বলল। কিন্তু আমি ওকে আমার সেই কাল্পনিক বই, যা আমি খুঁজছি, শুধু সেটার কথা জিজ্ঞেস করলাম। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নীচে চলে গেলাম।
পারিবারিক কাজে সন্ধ্যার বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে ছিলাম। সব কাজ জোড়াতালি দিয়ে শেষ করে অনেক রাতে বাড়ি ফিরলাম। সবগুলো ঘরের দরজা ভেতর থেকে লাগানো। ঐ ঘরটারও যার দরজায় সিঁড়ি উঠে গিয়ে ঠেকেছে। আমার ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলাম। কিছুক্ষণ ওর চেহারা কল্পনা করলাম। ব্যর্থ হলাম। কিন্তু ক্ষণিকের জন্য তার শরীরের গন্ধ পেলাম মনে হয়। ঘুমানোর সময় ভাবলাম, নিশ্চয় ওকে আমি স্বপ্নে দেখব। কিন্তু ঘুমের প্রথম প্রহর স্বপ্ন ছাড়াই কেটে গেল। এরপর মধ্য রাতের দিকে স্বপ্নে দেখলাম ঐ উটকো মহিলাদের যারা কনের পোশাক পরে একে অপরের দিকে অশালীন ভঙ্গিতে মুখচাওয়াচাওয়ি করছে। এখন আমি পুরোপুরি জেগে আছি। কিন্তু এরপর আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। অনেক বেলা পর্যন্ত স্বপ্ন ছাড়াই ঘুমিয়ে কাটালাম।
মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছিল। কী করব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। ভাবলাম, গোসল করব। মনে হলো, ও একটু আগেই এখানে এসেছিল। বারবার মাথায় ঝাকুনি দিলাম।
গোসলখানা থেকে বের হয়ে দেখলাম, ও গোসল করে রোদে বসে চুল শুকাচ্ছে। আমার জ্যেষ্ঠদের একজন ওখানে গিয়ে আমাদের বংশের নানান শাখাপ্রশাখা নিয়ে ওর সঙ্গে গল্প শুরু করে দিলো। বারান্দায় গত দিনে দেখা দুই উটকো মহিলা কী যেন কী নিয়ে ঝগড়া করতে লাগল। তবে বৃদ্ধ ভদ্রলোকের উপস্থিতির কারণে ওরা গলা নামিয়ে ঝগড়া করছিল। শীঘ্রই আরও তিনজন মহিলা ওদের সঙ্গে যোগ দিলো। ওরা ওদের বুদ্ধিশুদ্ধি দিয়ে দুজনকে থামাতে চেষ্টা করে বরং আগুনে ঘি ঢাললো। ও আমাদের জ্যেষ্ঠ আত্মীয়ের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো। মাথায় সম্ভ্রমে ঘোমটা দিয়েছে। ভদ্রলোকের সঙ্গে ও যখন গল্প করছিল তখন আমি দোতলায় চলে গেলাম। আর একজন উটকো মহিলা বাঁশের কাঠির তৈরি পর্দার উপারে দাঁড়িয়েছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, আন্টি গোসল করেছে কি-না। আমি ঐ বুড়ি ডাইনটাকে বললাম, ওকে গোসল করানো আমার দায়িত্ব নয়। এরপর সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেলাম। এ পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে কতজন উটকো মহিলা এসে জুটেছে সে ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত আমার কোন ধারণাই নেই। এদের কাজ শুধু বাড়ির সাংসারিক কাজে সাহায্য করা। সেটা কঠিন হোক আর সহজ হোক।
নীচে বয়স্ক ভদ্রলোক তখনও ওর সামনে বসে আছেন। তিনি পরিবারের ইতিবৃত্ত বর্ণনা করা শেষ করে এখন বর্তমান সময় নিয়ে আলোচনা করছেন।
সেদিন সন্ধ্যায় আমাকে আবার বাড়ির বাইরে কাজে পাঠানো হলো। কিন্তু যে পরিস্থিতি নিয়ে আগের দিন আলোচনা করেছিলাম, তার অবনতি ঘটলো। কোন সুফল না নিয়েই ফিরে এলাম।
রাতে অনেকবার আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। মনে হচ্ছিল, এই ও এলো বলে। তার ফিরে আসার সময় ঘনিয়ে আসছিল। সকালে আবারও সেই একইভাবে মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। ঠান্ডা জলে গোসল করা সত্ত্বেও মাথাটা আর হালকা হলো না। আমি নিশ্চিত, ওকে কোথাও একা পেলে একেবারে খুন করে ফেলব। তবে কিভাবে খুন করব, সে ব্যাপারে আমি পরোয়া করি না। মনস্থির করলাম, সারাদিন ওর কাছ থেকে দূরে দূরে থাকব।
বেশ পরে যখন আমার ঘর থেকে বের হচ্ছিলাম ঠিক তখনই ওকে দেখলাম। কয়েকজন মহিলার সঙ্গে ও কথা বলছিল। আমাকে দেখে হাতের ইশারায় ডাকলো। বারান্দাটা সাধারণত নীরব, সুনসান। ছোট্ট মেয়েটা ওর মা’র কোলে ঘুমাচ্ছে। ও অসুস্থ। ওকে কোলে নিয়ে ওর শরীরের ব্যাপারে ওর মা’র সঙ্গে কথা বলতে লাগলাম। এরপর ঐ বৃদ্ধ ভদ্রলোক বারান্দায় এলেন। এবার এখানকার আবহাওয়া ভারী হয়ে উঠলো। গলাটা ঠিক করে নিয়ে উনি বাচ্চাটার শরীরের খোঁজ-খবর নিতে শুরু করলেন। কিন্তু এতে ’ছোট্ট কনে’টি ঘুম থেকে জেগে উঠলো। এমনভাবে ডাকালো যেন ও সেরে গেছে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক ওকে ওর বরকে নিয়ে উত্যক্ত করতে লাগলেন। যেভাবে বাচ্চাটা প্রতিক্রিয়া দেখাতে লাগল তাতে মনে হলো, ও ভুলেই গেছে যে, ও আমার কোলে আছে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক এবার ওকে জিজ্ঞেস করলো, আমি কোথায়। ওর উত্তর শুনে সবাই হেসে উঠলো। অবশেষে ওকে আমি আলতোভাবে সুরসুরি দিলাম। ও বুঝতে পারলো, আমি কে। এরপর বিব্রত বোধ করে হাসতে লাগলো। বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয় ওকে কোলে নিয়ে চলে গেলেন। ও উনাকেও পছন্দ করে। রাতে বার বার ঘুম থেকে উঠে উনাকে ডেকেছে।
যেইমাত্র বৃদ্ধ ভদ্রলোক ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন সেইমাত্র ঘরের পরিবেশ বদলে গেল। বারবার হাসির ফোয়ারা ছুটতে লাগলো। যখন ওরা সবাই কথা বলছিল তখন আমি আন্টির সঙ্গে কথপোকথন শুরু করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, সেদিন ক’ তারিখ ছিল। আমরা উল্টা-পাল্টা সব কথাবার্তা বলতে লাগলাম। বুঝতে পারলাম, সবাই আগ্রহের সঙ্গে আমাদের লক্ষ্য করছে। ও আমার কথা ধরছে না।
যেখানে বসে ছিলাম সেখান থেকে বারান্দার ওপারে একটি ঘরের দেয়ালে ঝুলানো ক্যালেন্ডারের কোণা দেখা যাচ্ছিল। অনেকদিন আগে আমাদের এক আত্মীয় ঐ ক্যালেন্ডার তৈরি করে দিয়েছিলেন। এর সাহায্যে যেকোন বছরের যেকোন দিন জানা যায়। তবে এতে অনেক সময় লেগে যায়, কারণ কয়েকটা দীর্ঘ হিসেব নিকেশ কষতে হয়। আমাদের ব্যাপারটা প্রমাণ করার জন্য উভয়েই উঠে পড়লাম। ক্যালেন্ডার পরীক্ষা করতে। এক সঙ্গে ঘরে ঢুকলাম। কিন্তু দরজার আড়ালে আসা মাত্রই আমরা একে আপরকে ভয়ঙ্কর শক্তভাবে জাপটে ধরলাম, যেন মেঝের মধ্যে ডুবে গেলাম। তারপর হটাৎ করে উঠে বাইরে গেলাম। ছোট্ট মেয়েটার মা জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের মধ্যে কার অনুমান ঠিক হলো। তবে ওরা তখন হাসছিল। আন্টি ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
সেই সময় যেকেউ আমাদের দেখলে নিঃসন্দেহে সন্দেহ করবে যে, আমরা ঘরের ভেতর বেশ দীর্ঘ সময় কাটিয়ে তবেই বের হয়েছি।
যে কাজটি করতে আগে পর পর দু’বার বিফল হয়েছি সে কাজটি সেদিন সফলভাবেই সম্পন্ন করে গতরাতের চাইতে আরও দেরিতে বাড়ি ফিরলাম। সবাই শুয়ে পড়েছে। আমিও ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। যে সময় সে তার বিছানা থেকে নেমে এসে আমার সঙ্গে উচ্চতা মেপেছিল সেই সময় থেকে সহ¯্রাব্দের ক্যালেন্ডার দেখার জন্য ঘরে প্রবেশ করার সময় পর্যন্ত ও কী মনে করতে পারে, তা নিয়ে খুব একটা ভাবিনি। ও আদৌ এই ব্যাপারটি গায়ে মাখিয়েছে কি-না, তা নিয়েও ভাবিনি। ও যা ভাবে ভাবুক, আমি সত্যি সত্যিই ওকে খুন করার কথাই ভেবেছিাম। সারা রাত আমি অনুশোচনায় দগ্ধ হলাম। ওর শারীরিক সৌন্দর্য্য আমাকে টানছিল। ওর সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ করার আকাঙ্খা তীব্রভাবে বোধ করলাম।
নির্ঘুম রাত কাটানোর পর সকালে ঘর থেকে বের হলাম। অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছিলাম। বাসার একজন কাজের মহিলা, যে সবার আগে ঘুম থেকে ওঠে, জানালো যে আন্টির ভাই গত রাতে একটি খারাপ খবর নিয়ে এসেছিল। ওরা খুব ভোরে চলে গেছে। তখন আমার মাথায় শুধু একটাই ভাবনা- যদি তার কাছে মাফ চাইতে পারতাম তবে ভালো হতো।
আমি যখন বললাম, আমি আশ্রিত জীবনে হাপিয়ে উঠেছি, তখন আমার পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের কেউ আমার কথা বিশ্বাস করলো না। বললাম, আমি স্বনির্ভর হতে চাই। ওরা কেউ বিশ্বাস করলো না। ওরা যখন অনীহা দেখালো তখন ওদের সন্দেহ ও উদ্বিগ্নতার কোন উপশম করতে পারলাম না। তবে আমার চাহিদা পুরণে ওদের আমি বাধ্য করতে সফল হলাম। কারণ, ওরা তো আমাকে নিয়ে অনেক ভাবে।
আমার যাত্রার জন্য ওরা ব্যাপক আয়োজন করলো। বাড়িতে আদর-সম্মান দেখে আমি বরং বিরক্তই হলাম। আমার যাত্রার কয়েকদিন আগে ওরা আমাকে একটা ছোট্ট পাথরের মাদুলি আমার গলায় পড়িয়ে দিলো। ওখানে খোদাই করা কিছু পবিত্র নাম অংকিত ছিল। এটি অবশ্য আমার বংশানুক্রমিকভাবে পাওয়া জিনিস। এতে আমার উদ্বিগ্নতা আরও বেড়ে গেল। কাউকে না জানিয়ে গলা থেকে খুলে এটা একটা পুরাতন কাপড়- চোপড় রাখার বাক্সে রেখে দিলাম। ওখানেই এটা আগে সংরক্ষিত ছিল।
আমার জ্যেষ্ঠরা বেশ গুরুগম্ভীর স্বরে আদেশ-উপদেশ দিয়ে আমাকে বিদায় জানালো। তবে যে কণ্ঠগুলো আমি অনেক দূর পর্যন্ত শুনতে পেলাম সেগুলো হলো বাড়ির বুয়াদের কণ্ঠ। ওরা আমার নিরাপদে ফিরে আসার ব্যাপারে ওরা সবাই প্রার্থনা করলো।
নিজে যখন স্বনির্ভর হওয়ার জন্য সংগ্রাম করছিলাম তখন বেশ কষ্ট হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত পরিবারের জ্যেষ্ঠদের সুনাম আমাকে সাহায্য করলো। গতর না খাটিয়েই নিজেদের অজ্ঞাতেই ওরা আমাকে সাহায্য করলো আত্মনির্ভরশীল হতে।
আমার কাজ হলো বাড়িগুলো পরিদর্শন করা। প্রথম প্রথম মনে হতো, এ কাজ আমাকে দিয়ে হবে না। কারণ, শুধু আমার বাড়িটা ছাড়া অন্য সব বাড়ি মলমূত্রের ভাগাড় ছাড়া আমার কাছে আর কিছুই মনে হলো না। অর্ধমৃত আগাছার আকড় মনে হলো। মাঝে মাঝে অব্যক্ত রাগ হতো ওগুলোর উপর। কখনও কখনও ওগুলোকে আনন্দহীন, নিরস ফেলনা জিনিস মনে হতো। মাঝে মাঝে ওগুলোর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতাম। মনে হতো, কোন হাবাগোবা পোলাপানের দিকে তাকিয়ে আছি। ওরা যেন আমার কাছ থেকে মুখ লুকোচ্ছে, এমন মনে হতো। সম্ভবত এ কারণেই ওরা কখন যে ওরা ওদের প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করেছে, তা আমি একেবারেই টের পাইনি।
শুরতে বাড়িগুলোর বাসিন্দারা আমার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। শুধু বাড়ির দিকে তাকিয়েই আমি বুঝতে পারতাম, এটি কতটা পুরাতন; কিভাবে ও কখন এর সংস্কার করা হয়েছে, কত দ্রুত করা হয়েছে এবং কতটা দ্রুত এর উপর দিয়ে সময় বয়ে গেছে। আমি নিশ্চিত একটি বাড়ির ভেতর দিয়ে সময় যেভাবে বয়ে যায়, বাড়ির বাইরে সেভাবে বয়ে যায় না। আমি এ কথাও বিশ্বাস করি, বাড়ির এক পাশ দিয়ে সময় যেভাবে বয়ে যায়, অপর পাশ দিয়ে সেভাবে বয়ে যায় না। কাজেই, যখন আমি কোন বাড়ির ক্ষয়িষ্ণুতার ইতিহাসের হিসেব কষি এবং এর কাঠামোতে কত বছরের ছাপ পড়েছে তা নির্ণয় করি তখন বুঝতে পারি, এর বাহ্যিক চেহারার সঙ্গে সময় প্রবাহের কোন সম্পর্ক নেই। তারপরও এখন আমার কোন হিসেবই ভুলও প্রমাণিত হয়নি সঠিকও প্রমাণিত হয়নি। কারণ, এমন কি বছরের হিসেবের সবচেয়ে ছোট অংকটিও আমার ধারণার চাইতেই অনেক বেশি ছিল।
আমি যখন একদিন একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন এর বন্ধ দরজার কিছু একটা আমাকে সরাসরি এমন একটা ধারণা দিলো যে, এটি ভয়ে বা লজ্জায় কিছু একটা আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে। আমি বাড়িটার সঠিক মাপজোখ করতে পারলাম না। ভেতরে গিয়ে এর প্রতিটি কোণা, ফাঁকফোকড়, দেয়াল, মেঝে খুব সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করলাম। কোনরূপ উপসংহারে না পৌঁছেই সারাটা দিন আমি নষ্ট করলাম। বাড়ি ফিরে রাতের বেশিরভাগ সময় এই বাড়িটির কথাই শুধু ভাবলাম আর ভাবলাম। আমার মূল্যায়ন-কৌশল পুনঃবিবেচনা করলাম। সব খুঁটিনাটি বিষয় মনে করার চেষ্টা করলাম। মনে হলো, এই বাড়ির কোন একটি অংশ ভয়ের উদ্রেক করে। আরেকটা অংশ আছে যেখানে আমার মনে হয়েছিল, কোন এক অজানা আকাক্সক্ষা পুরণ করতে হবে।
পরের দিন আরেকটা বাড়ির সামনে গেলাম। এর সামনের দরজা বন্ধ। তবে মনে হলো, বাড়িটি বুক চেতিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পরে এর ভেতরে ঢুকে ঘুরতে লাগলাম। যখন এর একটি নির্দিষ্ট অংশে ঢুকে পড়লাম তখন আমার ভয় ভয় লাগতে শুরু করলো। আরও কেমন লাগে তা জানার জন্য অপেক্ষা করলাম। আমার মন হলো, নিশ্চয় বাড়ির অপর অংশে আমার অব্যক্ত ইচ্ছা পূরণ হবে।
তখন পর্যন্ত এই ব্যাপারটি এড়িযে যাওয়ার জন্য বিস্মিত হলাম। যে বাড়িগুলো আগে দেখেছিলাম সেগুলোতে ফিরে এলাম। প্রত্যেক বাড়ির যে অংশে গা ছমছম করে এবং যে অংশে আকাক্সক্ষা জাগে, তা চিহ্নিত করলাম। এই অঞ্চলগুলো খুঁজে বের করা আমার নেশা হয়ে দাঁড়ালো। অবশেষে এই মোহাচ্ছন্নতা আমার কাজের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। সামান্য কোন প্রমাণ ছাড়াই আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো, যে বাড়িগুলোতে ঢুকলে গা ছমছম করে আবার কাছেও টানে সেগুলোর বয়স বের করা অসম্ভব। অনেক ক্ষতির শিকার হওয়ার পর আমি বুঝতে পারলাম, আমি একটা নির্বোধ গর্দভে পরিণত হচ্ছি। পুরোপুরিভাবে মনোসংযোগ হারিয়ে ফেলছি। আমার পেশা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে বাড়ি পরিদর্শন করা আমার কাজ। সচেতনভাবে ভয় আর আকাঙ্খার অংশ দু’টো না খুঁজলেও আমি অস্পষ্টভাবে জানতাম, ওগুলো কোথায়। ওগুলোর প্রতি আমার আগ্রহ বাদ দিতে মনস্থির করলাম।
এরপর একদিন এমন একটি বাড়ির সন্ধান পেলাম যেখানে একই স্থানে গা ছমছমে ভাব ও আকর্ষণ মাখামাখি করে থাকে।
ওখানে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম। বুঝতে চেষ্টা করলাম, আমি আসলে ভয় নাকি আকর্ষণ বোধ করছি। কিন্তু এই দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারলাম না। এই বাড়িতে ভীতিই আকর্ষণ আর আকর্ষণই ভীতি। অনেকক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বাড়ির মালকিন অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন, আমি হতচকিত হয়ে যাইনি তো। উনি একজন যুবতী মহিলা। এ সময় বাড়িতে উনি আর আমি ছাড়া কেউ নেই। কাছাকাছি এলেন আমাকে ভালো করে দেখতে। মনে হলো, এই ভীতি আর আকর্ষণের জায়গাটা তাঁকে সমানভাবে পীড়িত করেছে। তারপর অদ্ভুত এক সাহসিকতায় আকস্মিকভাবে উনি আমার হাত দু’টো খামচে ধরলেন। কিছু সময়ের জন্য সামনের ঘরে বসতে বললেন। বললাম, আমি এখানেই বেশ ভালো আছি। তার সঙ্গে আর কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেলাম। সম্ভবত এদিনের পর থেকে এই বাড়ির বাসিন্দাদের ব্যাপারে আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
মূলতঃ আমি একটা ছাড়া অপরটার কথা কল্পনা করতে পারি না। আসলে মাঝে মাঝে এই দুই বিষয়কে আমার কাছে একই মনে হয়। কারণ, এই দু’টো আমাকে সমানভাবে উদ্দীপীত করে।
এই আগ্রহ অবশ্য আমার ব্যস্ততা বাড়িয়ে দেয়। এখন আমি দায়সারাভাবে বাড়ির দিকে তাকালেও সেখানকার গুপ্ত বা খোলা অংশ, তা সেটা পরিত্যক্ত হোক বা ব্যবহারের যোগ্য হোক, আমার চোখে পড়েই। আমি এখন বলতে পারি, বাড়ির এক পাশ থেকে ধ্বনিত স্বর অপর পাশে শোনা যাবে কি-না। আমি খুব সতর্কতার সঙ্গে প্রতিটি ঘর পরীক্ষা করি এবং দেখি, দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরের কোন অংশ দেখা যায়। জানালার ফাঁক দিয়ে অথবা উপর থেকে এবং কোন কোন অংশ দেখা যায় না। তাও আমি পরীক্ষা করি। প্রতিটি ঘরেরই একটা অংশ আছে যা দরজার ফাঁক দিয়ে বা জানালার ফাঁক দিয়ে বা উপর থেকেও দেখা যায় না। এই জায়গাটাকে আলাদা করার জন্য আমি ঘরের মাঝখানে দাঁড়াই এবং মনে মনে পুরো জায়গাটাতে কালো রং লেপ্টে দেই। এরপর শুধু দৃষ্টিশক্তি ব্যবহার করে যে জায়গাগুলো ফাঁক-ফোকড় বা জানালা দিয়ে দেখা যায় সেগুলোতে সাদা রং করে দেই। যার ফলে ঘরে যে জায়গাটা কালো রং করা সেটি আর দৃশ্যমান হয় না। শুধু বাচ্চাকাচ্চাদের ঘর ছাড়া কোন ঘরেই এমন কোন জায়গা নেই যেখানে কমপক্ষে একজন নারী বা একজন পুরুষ লুকিয়ে থাকতে পারে না।
এই সময়ের মধ্যেই এই অদৃশ্য অংশটি যে অবয়বগুলো ধারণ করতে পারে বলে মনে হয়, আমি সেগুলোর ব্যাপারে মনোযোগ দিতে শুরু করি। এরা বিভিন্ন কল্পচিত্রের রূপ দিতে পারে। এগুলোর বিশেষ কিছু জিনিসের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে। তবে আমি কখনও কোন কিছুর পূর্ণাঙ্গ ছবি পাইনি। সবকিছুকেই আমার কাছে অসম্পূর্ণ এবং খ-বিখ- মনে হয়েছে। এমনকি যখন আমি এমন অসংখ্য অদৃশ্য অংশের পরীক্ষা করেছি তখনও না। কিছু কিছু অবয়বের চেহারা পরিচিত। কোনটা দেখতে সিংহের মতো, কোনটা কাঁকড়ার মতো, কোনটা আবার দাঁড়িপাল্লার মতো। তবে ওগুলো সবসময় অসম্পূর্ণ। অন্য অবয়বগুলো অজানা জিনিসপত্রের মতো। অজানা হলেও দেখে বোঝা যায়, ওগুলো অসম্পূর্ণ। ওগুলো মনের উপর কী এক অদ্ভুত প্রভাব ফেলে যায়। কোনভাবেই এটিকে প্রকাশ করা যায় না।
একদিন নতুন বাড়ির বাইরের দিকে ঘরে ছিলাম। ঘরের অদৃশ্য অংশের একটি অবয়বের দিকে তাকিয়েছিলাম। অবয়বটা অপরিচিত। তখন পরীক্ষা করছিলাম তখন মনে হলো এই অবয়ব অনেক আগে একটি জরাজীর্ণ পুরাতন বাড়িতে দেখেছিলাম। আকাঙ্খার অঞ্চলেরও একই চেহারা।
ততোদিন পর্যন্ত আমি এই বাড়িগুলোতে ভয় আর আকর্ষণের প্রকৃত সীমারেখার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পেরেছিলাম। এই সীমারেখাগুলো যে কল্পচিত্র তৈরি করেছে, তার ব্যাপারে আমি এতদিন ভাবিনি। এবার আমি সব অবয়ব নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি। এখন মনে হচ্ছে, হয় আমি একটা গর্দভ, না হয় পুরোটাই পাগল। এবার বুঝতে পারলাম, আমি যেভাবে বাড়ির দিকে তাকাই সেভাবে কেউ তাকায় না। আমি ভেবে হতবিহ্বল হয়ে গেলাম যে, বাড়িতে বসবাসরত লোকজনের উপর আমার যে প্রভাব আছে, তা আর কারও নেই।
আমি এক স্থানে জমে যাইনি। অনেক শহর ঘুরেছি। অনেক বাড়ির ভেতর-বাহির দেখেছি। আমার মনে হয়, বাড়িতে বাড়িতে শহরগুলো গিজগিজ করছে, আর প্রতি বাড়িতে মহিলারা গিজ গিজ করছে। আবার প্রত্যেক মহিলাকে সহজেই নাগালের মধ্যে পাওয়া যায়। অনেক মহিলা আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। আমিও অনেক মহিলার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। অনেক বড় বড় পাপ করেছি।
উদাহরণ স্বরূপ, কিছু মহিলা যাদেরকে আমি মনে করেছিলাম যে ওদের কাছে এই ভাবনাটাই অজানা বা এই আকর্ষণের প্রতি ওদের ঘৃণা রয়েছে, পরে দেখেছি ওরাও ঐ আকর্ষণের পানে ছুটে যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আসলে কখনও কখনও ওরা এমন সব সাহসি প্রস্তাব আমাকে দিয়েছে যে, আমি ভয় পেয়ে গেছি। কিছু কিছু মহিলা যাদেরকে মনে হয়েছে যে, এই নেশায় বুদ হয়ে আছে এবং সামান্য একটু সংকেতের অপেক্ষায় আছে তাদের দিকে অগ্রসর হলে তারা এমন অর্বাচীন ভাব দেখাত যেন তারা আমার অভিসন্ধি একেবারেই বোঝেনি। কেউ কেউ হাতাশগ্রস্ত। কেউ আবার ভীত-সন্ত্রস্ত। আসলে একজন তো আবার এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল যে, শান্তপূর্ণ ঘরোয়া জীবন ত্যাগ করে পালিয়ে গিয়েছিল। ওর ঝলমলে কালো চুল গোছানোর অভ্যাস ছিল। ভেবেছিলাম, ও আমার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়। কিন্তু একদিন ও নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। ওকে খুঁজতে বের হলাম। ওকে শুধু বলতে চেয়েছিলাম, ওর কালো চুল আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে। কিন্তু ও আমার কাছ থেকে পালিয়ে গেল। সম্ভবত ভেবেছিল, কামুক কোন প্রাণীর মতো আমি ওর পিছু নিয়েছি। এরপর আর কখনই ওর দেখা পাইনি। আমার সন্দেহ হয়, ও আমার ভয়ে হয়তো মারাই গেছে। কিন্তু আমি নিজেকে এই বলে শান্তনা দেই যে, ওর নদীতে পড়ে যাওয়ার ঘটনা একটি দুর্ঘটনা মাত্র। যা’ক বাবা, ও ডুবে তো মরেনি। ওকে উদ্ধার করা হয়েছে। এরপর থেকে উপযাচক হয়ে মহিলাদের সঙ্গে প্রেম করাই বাদ দিয়েছি। তার পরিবর্তে ওদেরই তরফ থেকে প্রস্তাব আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। মাঝে মাঝে এই অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয়।
একবার এমন এক দীর্ঘ বিরতির সময় একটা নতুন শহরে গেলাম। ওখানকার কেউ আমাকে চিনত না। একদিন ঐ শহরের প্রধান বাজার ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। এক দোকানের সামনে দণ্ডায়মান এক মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলো। হাতের ইশারা করল। ভাবলাম, ও পেশাদার বারবণিতা। সাড়া না দিয়ে আমি হাটতে লাগলাম। কিন্তু এবার সে আমার নাম ধরে ডাকালো। থেমে ওর দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। ও দ্রুত আমার কাছে চলে এলো। “তুমি কি আমাকে চিনতে পারোনি?” হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল।
অবশেষে আমি ওকে চিনতে পেলাম। বেশ অনেক বছর পূর্বে আমরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ ছিলাম। ওর তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। শুধু একটু বুড়িয়ে গেছে বলে মনে হলো। আমি যে কেন ওকে চিনতে পারিনি, তা ভেবে অবাক হলাম। তবে অপরিচিত শহরে পরিচিত একজনকে পেয়ে আবার আমার আনন্দও হচ্ছিল।
“তুমি এখানে কী করছো?” আমি জানতে চাইলাম।
“আমি তো এখানেই থাকি,” ও উত্তর দেয়।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা খোলামেলা আলাপ-আলোচনা করতে শুরু করলাম। বার বার আমার মনে হচ্ছিল, ও বারবণিতা হয়ে গেছে। পেশাদার পতিতাদের সঙ্গলাভে আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই। সাধারণ মহিলাদের থেকে আমার এদেরকে আলাদা করারও সামর্থ্য নেই। তাহলে কেন আমি সন্দেহ করছি যে, ও একজন পেশাদার পতিতা? ওখানে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার সন্দেহ আরও ঘনীভূত হতে লাগল। ও বুঝতে পারলো, আমি ওকে পরীক্ষা করছি। ওর চোখে-মুখে প্রশান্তির ছাপ ছড়িয়ে পড়ল। এতে আমার সন্দেহ আরও জোরালো হলো। কিছুক্ষণের কথাবার্তায় ও আমার সঙ্গে ভাব জমাতে চেষ্টা করল। শরীরী ভাষা দিয়েও। অতীতে শুধু আমিই প্রথমে প্রণয় নিবেদন করতাম। কয়েক বছর আগে যখন ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, তখন ও টগগে তরুণী। আর এখন ও ছেনালিপনা করছে অঙ্গে প্রত্যঙ্গে কিশোরীসূলভ লাজুক লাজুক ভাব ফুটিয়ে তুলে। ব্যাপারটি আমাকে কষ্ট দিলো। আরেকবার ওকে খুব কাছ থেকে পরীক্ষা করলাম। ও এখনও আকর্ষণীয়। কিন্তু অনেকটা বদলে গেছে। ওর সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। সময় দ্রুত কেটে যাচ্ছিল।
“ কোথায় থাকো?” জিজ্ঞেস করলাম। ও দোকানগুলোর পেছনে কাছের একটি এলাকা নির্দেশ করলো।
“এসো, তোমাকে আমার বাড়ি দেখাই”, ও বলল। “তবে যদি তোমার সময় থাকে।”
আমাদের সম্পর্ক ঠিক একইভাবে শুরু হয়েছিল। ও যে বাড়িতে থাকে আমাকে সেই বাড়ি দেখালো। ব্যস্ত রাস্তা ধরে আমরা পাশাপাশি হাটতে লাগলাম। ও একটা দোকানের সামনে থামলো। বড় একটা তালা কিনলো। তালা আর এর সঙ্গে একটা চাবী ওর ব্যাগে রাখলো। একটা চাবী ওর বৃদ্ধাঙ্গুলে ও তর্জনীর মাঝখানে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে বিশেষ ধরণের তালার বিশেষ বিশেষ সুবিধার কথা বর্ণনা করতে লাগলো। তারপর অবচেতন মনে চাবীটা আমার হাতে দিলো। আমরা হাটতে লাগলাম।
সবকিছু যেভাবে আছে ও সেগুলো সেভাবেই চায়। নিজে নিজেই ভাবতে লাগলাম। আরেকবার মনে হলো, ঐ বাজারে সময় খুব দ্রুত ছুটে চলেছে।
“আর কত দূর?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“এই তো পৌঁছে গেছি প্রায়”, এ কথা বলে ও পাশের একটি বড় রাস্তায় নেমে গেল।
শীঘ্রই আমরা নিজেদের একটি পুরাতন কাঠের দরজার সামনে আবিষ্কার করলাম। দরজাটাতে সম্প্রতি রং করা হয়েছে। দরজায় ঝুলিয়ে থাকা তালাটা ও খুলে নিলো। ব্যাগে রাখল। তারপর ভেতরে ঢুকলো। আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। এরপর ও প্রধান দরজার সাথেই একটি ছোট দরজা খুলল। এই দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো। ওর হাতে এবার নতুন তালা।
“তুমি তো ভুলে যাওনি, গেছ কি?” ও জিজ্ঞেস করল। দৃঢ়তার সঙ্গে এক ঝটকা হাসি ছড়িয়ে দিলো আমার দিকে।
“আমার মনে আছে,” আমি বললাম।
আমি ওর হাত থেকে তালাটা নিলাম। ছোট দরজাটা দিয়ে ও আবার ভেতরে ঢুকলো। প্রধান দরজায় হুড়কো লাগালাম। আবার এতে তালা দিলাম। পাশের ছোট্ট দরজাটা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। এতেও হুড়কো লাগিয়ে দিলাম। এবার নিজেকে বড় একটি ঘরে আবিষ্কার করলাম। এতে অনেকগুলো চোরকুঠুরী আছে। তবে কোন আসবাবপত্র নেই। একটি দেয়ালের সঙ্গে লাগোয়া আঙ্গিনায় বেরিয়ে এলাম। দেখলাম, এই দেয়ালে বড় একটা জানালা। পাকানো কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এটি। জানালার দিকে যেতেই ডান দিক থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে শুনলাম।
“ওখানে নয়। এখানে।”
ঘুরলাম। দেখলাম, দেয়ালের এক কোণা সংলগ্ন স্থানে ছোট ছোট কয়েকটা গাছের ওপারে একটা বারান্দা। মহিলা ওখানে দাঁড়িয়েছিল। একটা আর্চের নীচে। ওখানে গিয়ে নরম দিভানে বসলাম। ওখানেই ওটি পাতা ছিল। আমার ঠিক পেছনেই একটা দরজা ছিল। ও দরজাটা খুলল। আমরা দু’জনে ঘরে ঢুকলাম। সুন্দর, ছিমছাম ও গোছানো ঘর। একটি বিছানা পাতা আছে এতে। প্রয়োজনীয় সাংসারিক জিনিসপত্রও আছে। ও ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। যেন খুব ক্লান্ত। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আমি বসে পড়লাম।
“তাহলে এখানে কি তুমি একাই থাকো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“একা ... বেশ, তুমি এটাকে ‘একা থাকা’ মনে করতে পার। আসলে এখানে আমি আমার একজন পরিচিত বৃদ্ধার সঙ্গে থাকি। বয়স্ক মহিলা।”
“এখন উনি কোথায়?”
“আসলে আমি জানি না, কয়েকদিন আগে হঠাৎ করে উনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। সারা রাত নীরবে কেঁদে চললেন। সকালে উঠে এক বুক হতাশা নিয়ে বললেন, উনি উনার গ্রামের বাড়িটাকে খুব মিস করছেন। হঠাৎ উনি বাড়ি যাবার জন্য মনস্থির করলেন। ওখানে উনি শৈশব কাটিয়েছেন। সাথে সাথে সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। উনি ফিরে এলে তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।
“আমি কেন একজন বিমর্ষ বৃদ্ধার সঙ্গে পরিচিত হব?” “আরে না, না। তুমি আসলে বুঝতে পারছ না। তুমি খুব মজা পাবে। এক নিঃশ্বাসে উনি তোমাকে বলে ফেলবেন, তাঁর স্বামী কেমন মজার মানুষ ছিলেন। ঠিক পর মুহূর্তেই উনি বলবেন, কিভাবে তাঁর স্বামী তাঁকে ধরে পেটাতেন। উনি আসলে মারাত্মক মজার মানুষ।”
“কোন বুড়ি ডাইনীর গল্প শুনে আমার খুন হওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই।” এ কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ও আমার পেছনে পেছনে এলো।
“কী হয়েছে?” ও জিজ্ঞেস করলো।
“আমি বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখতে চাই” এ কথা বলে আঙিনায় গেলাম।
“দেখার তেমন কিছু নেই,” ও বলল। “এই বারান্দা, এই ঘর আর ঐ যে বাইরের বৈঠকখানা, বাকিটা ধ্বসে পড়েছে।”
আমরা জানালাটা থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েছিলাম। জানালাটা উঠানের দেয়ালে। আমি সতর্কতার সঙ্গে দেয়ালটা পরীক্ষা করলাম। এটি স্পষ্ট যে, বাড়িটি আগে একটি বিশাল স্থাপনা ছিল আর এই দেয়ালটা নির্মাণ করা হয়েছে এই বাড়িটিকে দু’ভাগে ভাগ করার জন্য।
“ওপাশে কে থাকে?”
“জানিনা,” ও উত্তর দেয়। “সম্ভবত কেউ না।”
এবার আমরা দু’জনেই জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকি। জানালাটা কেমন জানি অমসৃণ কাঠ দিয়ে আনাড়িভাবে তৈরি করা হয়েছে। দুই পাল্লা সেঁটে একটি কাঠের তক্তা আঁড়াআড়িভাবে পেরেক দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে জানালাটাকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। আমি আস্তে আস্তে টোকা দিলাম কাঠের উপর। দেখলাম আমার পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। হাত দিয়ে মহিলার কোমড় পেচিয়ে নিয়ে আমার দিকে টেনে নিলাম। ওকে কিছুটা বিস্মিত দেখালো। আমি নিজেও কিছুটা অবাক হলাম। কয়েক ধাপ পেছনে সরে গিয়ে ওকে ছেড়ে দিলাম। অতএব, এখানেই কামনার অঞ্চল বিদ্যমান। স্বগোক্তি করলাম। জানালার কাছাকাছি গিয়ে আবার মহিলার দিকে ঘুরলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল।
“তুমি দেখছি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছো,” ও বলল। আমার পায়ের নীচের মাটি আবারও সরে গেল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম।
এটি ভীতিরও জায়গা। কোন কারণ ছাড়াই বিষণ্নতায় নিজে নিজে ভাবলাম।
মহিলা আমার সামনে দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছে। কোন না কোনভাবে আমার মধ্যে কামনার উদ্রেক ঘটাতে ও সক্ষম হয়েছে। জানালার পাশে আর কিছুক্ষণ থাকলাম। জানালার সঙ্গে লাগোয়া দুই ফুটের এক ফালি ভূমি। জায়গাটার বাকিটা জানালার অপর পাশে বিস্তৃত।
“ওপাশে কে থাকে?” “জিজ্ঞেস করলাম।”
“আমি তো তোমাকে বললাম মি. অধৈর্য। ও পাশে কেউ থাকে না।”
“চল, যাই,” ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম। আমরা দুজনে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলাম। এবার ওর মধ্যে ভাবাবেগের উদ্রেক হলো। দু’হাত দিয়ে ও আমার গলা জড়িয়ে ধরলো।
“খুব ঘনিষ্ট হওয়া অন্যায়,” ও ফিসফিস করে বলে। এবার যেখানে ছিলাম সেখানেই থেমে গেলাম। আমার ওর সঙ্গে অতীত ঘনিষ্টতার কথা মনে পড়ে গেল। তখন তো আবেগের ঝড়ে ওর পা দু’টো টালমাটাল হয়ে গিয়েছিল। আজও এ বাড়িতেও একই আবেগ ঝড় তুলেছে ওর ভেতর।
এই বাািড়তে, বিশেষ করে, এই বাড়ির এই স্থানে সময় বাজারের চাইতে অধিকতর দ্রুততার সঙ্গে বয়ে চলেছে। এই মহিলা, শুধু যাকে এই অপরিচিত শহরে আমি চিনি, তার জন্য এক ধরনের প্রেম আমার ভেতরটাতে আলোড়ন তুললো।
“তুমি একদম বদলাওনি,” ও মৃদুস্বরে বলল। “ বেশ, সময়ের সাথে সাথে ...” ও কথা বলতে শুরু করলে আমি চোখ তুলে জানালার দিকে তাকালাম। জানালার উপরের পাল্লা আর চৌকাঠের ফাটলের মধ্যে দিয়ে কিছু একটা চকচক করতে দেখলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে মহিলাটি আমার বাহুপাশ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে শুরু করলো। ও চোখ বন্ধ কওে রেখেছিল যেমনটা ও সচরাচর রাখে। আমি ওকে ধরে আবার জানালার দিকে তাকালাম। ফাঁক দিয়ে একজোড়া কালো চোখ ড্যবড্যাব করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। যখন ওকে বাহুপাশে আবদ্ধ করে হেলে আছি ঠিক তখনই লাল রংয়ের পোশাক পড়া একজনকে সরে যেতে দেখলাম ফাটলে মধ্য দিয়ে। আরেকবার সন্তর্পনে তাকালাম। কালো উজ্জ্বল চোখ দু’টো আমাদের উপর আটকে আছে। চোখে চোখে নয়। চোখ দু’টো আমাদের শরীরের উপর নিবন্ধ। ব্যাপারটা এমন যে, একজন মহিলা যার উপস্থিতির ব্যাপারে আমি আদৌ সচেতন নই, সে আমাদেরকে চেয়ে চেয়ে দেখছে আর তার উপস্থিতি আমাকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছে বলে তার দিক থেকে আমি দৃষ্টিটা ফিরিয়ে নিয়েছি।
এই মুহূর্তে আমরা জানালার খুব কাছে দাঁড়িয়েছিলাম। ধীরে ধীরে মাথাটা উঁচিয়ে জানালার তলা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে দেখতে চাইলাম যে, ওখানে কেউ আছে কি-না। শুধু অস্পষ্ট ধারণা পেলাম। এখানে একজন মহিলা আছে আমার সঙ্গে। আর আমি ওকে দু’হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছি। এবার জানালার নীচের ফাটলের দিকে নিজের দৃষ্টি নিবন্ধ করলাম। ফাঁক গলিয়ে একটা খালি পা চোখে পড়লো। এই পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল যদি বার বার স্পন্দিত না হতো তবে ভাবতাম, এটি সাদা মোমের তৈরি। পায়ের পেছনে কিছুটা দূরে, তবে কতদূরে তা বলতে পারব না, কালো কাঠের একটা পুরাতন খিলান করা দরজার একটা কলামের নীচের অংশ দেখতে পেলাম। লাল পোশাকের আভায় পা’টাও লালচে দেখাচ্ছে। আর ওর শরীর থেকে প্রাচীন এক সুগন্ধি নিঃসৃত হচ্ছে বলে অনুভব করলাম।
মাটি থেকে বৃদ্ধাঙ্গুলিটি উত্থিত হলো। দেখলাম এর চারপাশে একটি কালো সুতো বাঁধা। জানি না সুতাটা কোথায় চলে গেছে। চাইলে ওখানে গিয়ে ধরতাম। সম্ভবত সেটাও মাথায় এসেছিল। কিন্তু আমার সঙ্গের মহিলা আমার হাত ধরে রেখেছিল। তারপর সামান্য সময়ের জন্য চোখ খুলে সে আবারও বন্ধ করলো। ও সন্দেহ করতে পারে যে, আমি ওর ব্যাপারে মনোযোগ দিচ্ছি না। কাজেই, ওর ব্যাপারে মনোযোগী হলাম। একটু পর ও ওর চুলগুলো গুছিয়ে নিলো। তারপর বলল, “তুমি একদম বদলাওনি।”
আমি আবার জানালার দিকে তাকালাম। ওপারে আর কেউ নেই। ঠিক তখনই আমার ভেতরে একটা প্রশ্নের উদ্রেক হলো। এই মহিলা কি তার বান্ধবীকে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে চেয়েছে? আমি বেশ কয়েকবার জানালার দিকে তাকালাম। তারপর হঠাৎ মহিলাটির দিকে তাকালাম। খুব ঘনিষ্ঠভাবে ওর মুখমণ্ডল পরীক্ষা করলাম। ওর নিরাবেগ মুখমণ্ডলে একধরনের শূন্য তৃপ্তির ছাপ ছড়িয়ে আছে।
“তুমিও বদলাওনি,” আমি ওকে বললাম। এরপর বারান্দায় গেলাম।
প্রায় প্রত্যেক দিন এই মহিলার সঙ্গে দেখা করতে যাই। “বৃদ্ধা ফিরে আসার আগ পর্যন্ত,” ও তো আমাকে প্রথম দিনেই বলেছিল। “এই বাড়ি তোমার।” সত্যি কথা বলতে কী, এটাকে আমি আমার নিজের বাড়ি ভাবতে শুরু করেছি। যখনই মনে হয় আমি ওখানে চলে যাই। যদি দেখি প্রধান দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা, তাহলে কড়া নাড়ি। ও খুলে দেয়। ওর সঙ্গে বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করি। তারপর চলে যাই। যদি দেখি প্রধান ফটকে তালা তবে চাবীটা বের করে তালা খুলে বাড়িতে ঢুকে পড়ি। এরপর পাশের দরজা দিয়ে বের হয়ে এসে প্রধান দরজায় আবার তালা ঝুলাই। ও ভেতর থেকে পাশের দরজায় হুড়কো লাগায়। ও হয় বারান্দায় না হয় ঘরে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। ওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দিন শেষে বাড়ি ফিরতাম।
ইদানিং প্রায় প্রত্যেক দিন ওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ওর বাড়ি যাই। গিয়ে দেখি, প্রধান ফটকে ভেতর থেকে তালা ঝুলানো। ভেতরে ঢোকার জন্য আমাকে কড়া নাড়তে হয়। ও তালা খুলে দিলে ভেতরে যাই। হাসিঠাট্টা করি। তারপর চলে আসি।
একদিন অনেকক্ষণ দরজায় কড়া নাড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে বুঝলাম, দরজায় বাহির থেকে তালা দেওয়া রয়েছে। এতক্ষণে বোধদয় হলো যে, আমি কড়া নাড়াতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তালা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। পাশের দরজা খুলে বের হয়ে আবার প্রধান ফটকে তালা লাগালাম। এরপর আবার ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতর থেকে হুড়কো লাগিয়ে বারান্দায় গেলাম। ও বারান্দায় নেই। ওর ঘরের দরজাটাও বাহির থেকে লাগানো। আমার আসার কিছুক্ষণ আগেই ও এসে পড়েছে। ওর ঘরের দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে ওর বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ওখানে অনেকক্ষণ থাকতে পারতাম। ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝিতে। অবশেষে ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় গেলাম, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে। ওর জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করতে করতে নিজেই অবাক হলাম। যাই হোক, ওর জন্য আর একটু অপেক্ষা করলাম। তারপর পাশের দরজা দিয়ে বাইরে গেলাম। প্রধান ফটকের তালা খুলে আবার ভেতরে ঢুকলাম। ভেতর থেকে পাশের দরজায় হুড়কো লাগিয়ে দিলাম। প্রধান ফটক দিয়ে বের হয়ে যখন যাব যাব করছি ঠিক যখন তখনই আবার বারান্দায় গেলাম। এরপর ওর ঘরে ঢুকে বিছানার অবস্থান পরিবর্তন করলাম।
ভাবলাম, ও ফিরে এসে জানবে, আমি এসেছিলাম। এবার আবার আঙিনায় এলাম। প্রধান ফটকের দিকে যাচ্ছিলাম। কিছু একটা দেখে থেমে গেলাম। ধীরে ধীরে ঘুরলাম। দেয়ালের জানালার দিকে তাকালাম। এক জোড়া কালো চোখ জানালায় চৌকাঠ আর উপরের পাল্লার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি প্রধান ফটকের দিকে ফিরলাম।
আমার জানা উচিৎ ছিল, আমি ভিত্তিহীন বিষয় নিয়ে ভাবছি। ধীরে ধীরে বারান্দার দিকে গেলাম। আমি আবার ঘরে গিয়ে বিছানাটা যেমন ছিল তেমন করে রাখলাম। এবার আঙিনায় নেমে এলাম। চুপিচুপি হামাগুড়ি দিয়ে দেয়ালের কোণের কাছে এলাম। এটি বারান্দার কাছে মোচড় খেয়েছে। দেয়ালের কাছে গিয়ে এক ইঞ্চি দুই ইঞ্চি করে করে জানালার কাছে এগোলাম। যখন দেয়ালের একেবারে কাছে এলাম তখন মাথাটা এমনভাবে নীচু করলাম যেন মাথা আমার প্রায় মাটিতে ঠেকে যাবে। নীচের ফাটল দিয়ে মোমের মতো পা দেখলাম। বৃদ্ধাঙ্গুলে তখনও কালো সুতো লাগানো আছে। প্রথম দিকে সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু পরে মনে হলো, সুতাটি পেছনের দিকে যেতে শুরু করেছে। ফাঁটলের নীচ দিয়ে হঠাৎ হাত দিলাম। কালো সুতা ধরে ফেললাম। আমার হাতের দুই আঙ্গুলে কয়েকটা প্যাঁচ দিয়ে নিলাম। পা’টা পেছনের দিকে সরে যেতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু আমিও সমান শক্তিতে একে টানতে লাগলাম। সুতাটা আসলেই রেশমের তৈরি। এটি এত শক্ত যেন আমার আঙ্গুল দু’টো কেটে পড়ে যাবে। আমার আঙ্গুলে আরও কয়েকটা প্যাঁচ দিয়ে নিলাম। হঠাৎ আমার হাত বৃদ্ধাঙ্গুলটাকে স্পর্শ করে ফেলল।
টানাহেচড়াতে আমার মাথা ঠিক মতো কাজ করছিল না। বারান্দা থেকে যখন জানালার দিকে যাচ্ছিলাম তখনই মনস্থির করে ফেলেছিলাম যে, আজ ওকে ধরেই ফেলব। কিন্তু এখন ঠিক করতে পারছি না, আসলে কী করব। আমার আঙ্গুলগুলো কেটে পড়ে যাবার যোগাড় হয়েছে। সন্ধ্যার সব অন্ধকার আমার চোখে ভর করল ভারী কম্বলের মতো। আঙ্গুলগুলো কেটে যাওয়ার ব্যথা অনুভব করলাম। তবে এ সময় কিছু কিছু ভাবনা মাথায় এলো। প্রথম যে বিষয়টা আমার মাথায় এলো তা হলো- শুধু আমিই যে ব্যথা পাচ্ছি তা নয়। আমার শক্ত পুরুষোচিৎ হাতের বিপরীতে নাজুক মহিলার পা তো খুব নরম। যে সুতা আমার আঙ্গুলগুলো প্রায় কেটে ফেলছে সেটি তো ওর বৃদ্ধাঙ্গুলেও বাঁধা। আমি আলতোভাবে বৃদ্ধাঙ্গুলে চাপ দিয়ে দু’হাতে পা দু’টো জাপটে ধরার চেষ্টা করলাম। যতটা ভেবেছিলাম পা’টাকে তার চেয়েও বেশি নরম মনে হলো। তবে এটি বরফের মতো ঠান্ডা। তবুও নাজুক ত্বকের নীচে রক্তের প্রবাহ অনুভব করছিলাম।
ইতিমধ্যে রাতের আধার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ছোট ছোট গাছগুলোর ছায়া চোখে পড়ছিল না বললেই চলে। আমার মনে হলো, আমি ওকে আঘাত করছি। হঠাৎ মনে হলো, আমি সুতোটি ধরে একবার মাত্র আমার দিকে টেনেছি। আঙ্গুলের চারপাশে প্যাচানো সুতো কিছুটা আলগা করে আরেক হাত দিয়ে জানালার এখানে ওখানে হাতড়াতে শুরু করেছি। যে তক্তাটি আঁড়াআঁড়িভাবে লাগানো ছিল, ওটা খামচে ধরলাম। ওঠার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তক্তাটি খসে চলে এলো। ঠিক সেই মুহূর্তে সুতোটি আমার হাত থেকে ফসকে গেল। দুই হাত জানালায় রেখে চাপ দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে চেষ্টা করলাম। জানালাটা খুলে গেল যেহেতু একে বন্ধ করে রাখার আর কোন সাপোর্ট নেই। আমি জানালার অপর পাশে দেখতে পেলাম। অন্ধকারে ঝাপসা কাঠের খিলান করা দরজা চোখে পড়লো। আর ওদিকে একটি ছায়া চলে যাচ্ছিল।
আমি ঐ ছায়ার পেছনে পেছনে খিলান করা দরজার নীচে গাঢ় অন্ধকারে গেলাম। শীঘ্রই নিকষ অন্ধকারে নিজেকেই আর দেখতে পাচ্ছিলাম না।
নিঃছিদ্র অন্ধকারে এটি ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। দরজাটা পার হয়ে সামান্য কিছু দূরে এগিয়ে গেলাম। এরপর থামলাম। আমি উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম সব দিকেই চলতে চাইলাম। কিন্তু অন্ধকার আমার নড়াচড়াকে অসম্ভব করে তুলেছে। আমার দিগবিদিক জ্ঞানশুন্য অবস্থা। দরজার অবস্থানও আর ঠাহর করতে পারছি না। তখন যা কিছু আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, তা হলো- আমি একজন অপরিচিত মহিলার সঙ্গে একটি জনশুন্য প’ড়ো বাড়িতে অবস্থান করছি। আমি নিশ্চিত যে, আমরা এখানে একা। মহিলাদের এবং বাড়িঘরের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের যোগাযোগ আমার মধ্যে একটি তীক্ষ্ম সহজাত প্রবৃত্তির জন্ম দিয়েছে। এখন যখন আমি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছি তখন আমি তীক্ষ্ণভাবেই উঁকি দিয়ে পরিস্থিতি দেখতে পেলাম। গভীর শ্বাস নিলাম। আমি নিশ্চিত, প্রাচীন বাড়িঘর থেকে যে সোদা গন্ধ বের হয়, তা অবশ্যই আমার নাসারন্ধ্রে ধরা দেবে। দরজার বাইরে এই গন্ধ আমি পেয়েছিলাম। কিন্তু এখানে তা ঘটলো না। যদিও জানতাম যে, এতে তেমন কাজ হবে না, তবুও চোখ ট্যারা করে নিজের চেহারাটা দেখলাম। সত্যিই ভীতিকর। তা স্বত্ত্বেও অন্ধকার ভেদ করে নড়তে পারলাম না। যখন আমার আঙ্গুলে কালো সুতা জড়িয়েছি তখন থেকে আমি আর কোন কন্ঠস্বর শুনতে পাইনি। তবুও শোনার জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। মনে হলো, আমার অনুভূতিগুলোকে টান টান অবস্থায় রেখে আমি অনেকক্ষণ ধরে ওখানে অপেক্ষা করছি। এরপর মনে হলো, আমি খিলান করা দরজার নীচ দিয়ে এসেছি। শীঘ্রই দু’টি হাত আমাকে ছুঁয়ে গেল। হাত দু’টি শক্ত করে ধরে আমার দিকে সজোরে টেনে নিলাম। অনেকক্ষণ পরে হাত দু’টো ছেড়ে দিলাম। হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে থাকলাম ওর কনুই, বাহু, কাঁধ। হাতড়াতে হাতড়াতে হাত দু’টো মুখের দিকে নিয়ে গেলাম। এক এক করে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অনুভব করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু শুধু চোখের বড় বড় পাঁপড়ি ছাড়া আর কোন কিছুর অনুভব করতে পারলাম না। আমার হাত চলতে থাকলো ওর শরীরের বিভিন্ন অংশে। একেবারে পা পর্যন্ত, যতক্ষণ না আমার মাথা মাটি স্পর্শ করে। সুতো ধরে আলতোভাবে টানলাম। এরপর দাঁড়ালাম। এবার আবার মনে হলো, নরম হাতটা খপ করে আমার হাত ধরলো। ওর হাতের তালু আমার হাতের তালুতে মিশে গেল। এবারই প্রথম অন্ধকারে আমার হাতগুলো রংয়ের ব্যাপারে সংবেদনশীল হয়ে উঠলো। দু’টো সাদা হাতের তালু। তাতে মেহেদির রং মাখানো। আমার হাতের তালু থেকে কবজির দিকে সরে গেল। তারপর কনুইয়ে, তারপর কাঁধে, তারপর এসে আমার মুখ চেপে ধরলো। লাল আংটি পরা হাতের আঙুলগুলো আমার গালের উপর দিয়ে চলে গেল। গলায় এসে থিতু হলো। তিনবার গলায় চাপড় দিল। এবার ওর হাতের তালু কাঁধে এসে থামলো। অনেকক্ষণ আমার কাঁধে থাকলো। এরপর আমার জামায় হাত দিয়ে হাতড়াতে লাগল। হাতড়াতে হাতড়াতে পায়ের কাছে এসে নামলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল। এরপর আবার আমার কাঁধের ওপর এসে পড়লো। সেই পুরাতন গন্ধ যা এক সময় আমার নাকে এসে লেগেছিল, আমার মনে হলো, এক ধরনের মেয়েলি আবহের সঙ্গে মিশে গেল। এই গন্ধ মাটির গন্ধের মতোই প্রাচীন। গাছে ফুল ফোটার অনেক আগে মাটির যেমন গন্ধ হয়, তেমন। এই গন্ধে আমার অর্ধবিস্মৃত স্মৃতিগুলো ফিরে এলো। যাই হোক, এবার এটি আমাকে আর কিছু মনে করতে দিলো না। আসলে আমার যেটুকু মনে ছিল সেটুকুও আমি দ্রুত ভুলে গেলাম।
ও আমার কাঁধে হাতের তালু দিয়ে চাপ দিচ্ছিল, আবার শিথিল করছিল। এবার সঙ্গে সঙ্গে একটা মায়াময়, বোধগম্য নারীদেহের উপস্থিতি অনুভব করলাম। মনে হলো, আমি কোন মহিলার সঙ্গে আছি যে আমাকে আরেকজন মহিলার সঙ্গে আবিষ্কার করেছে, কমপক্ষে একবার প্রকাশ্য দিবালোকে। আমিও বুঝতে পারলাম, এ অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করা বৃথা। চোখ বন্ধ করলাম। অন্ধকারে চোখ খোলা রাখা আর বন্ধ করে রাখার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আসলেই কোন পার্থক্য ছিলও না, অন্ততপক্ষে কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু যখন আমি আমার শারীরিক সীমাবদ্ধতার কথা ভুলে যাচ্ছিলাম তখন মনে হলো, আমি কোন স্বচ্ছ জলের হ্রদে ডুবে যাচ্ছি। হ্রদের তলদেশে প্রাচীন মন্দিরসমূহের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেলাম। চোখ খুললাম। শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার দেখলাম। স্বস্তি পেলাম। মনে পড়ে গেল, এই অন্ধকারে আমার সঙ্গে একজন মহিলা আছে। আমার নিশ্বাস ওর শরীরের উষ্ণতা টের পাচ্ছিল। মনে হলো, একটা ঝড় ওকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। আবার আমার চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে এলো। যতই খোলা রাখতে চেষ্টা করি, কোন লাভ হলো না। আবার স্বচ্ছ জলের হ্রদ দেখলাম। প্রাচীন মন্দিরসমূহের ধ্বংসাবশেষ আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। অবশেষে ওগুলো আমার পায়ে এসে ধাক্কা মারলো। কিন্তু আমি অনুভব করতে পারলাম না। এরপর দেখতে দেখতে হ্রদের পানি কালো হয়ে গেল। মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমার মনে নেই, জেগে ওঠার আগ পর্যন্ত কতটা সময় কেটে গেছে। তখনও আমার চারপাশে নিকষ কালো অন্ধকার ছড়িয়ে আছে। কিন্তু আমার একপাশে খিলান করা দরজাটা দেখলাম। এর ওপারে প্রভাতের আলো ফুটছে। অন্ধকারে নিথর পড়ে থাকা শরীরটার দিকে ফিরলাম। সারা শরীর হাতড়ালাম। স্পর্শ করলাম। আমার হাতের তালু ওর হাতের তালুতে মিলালাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমার হাতের উষ্ণতায় ওর হাত উষ্ণ করার জন্য। কিন্তু ওগুলো শীতল ও শুষ্কই রয়ে গেল। যাই হোক, ওর একটা তালুতে উজ্জ্বল লাল রংয়ের একটি নকশা অনুভব করলাম। এই নকশা অজানা কিছু একটার ধারণা দিচ্ছিল। আমি এর দিকে দৃঢ়তার সঙ্গে তাকিয়ে থাকলাম। এবার আমার কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। এই একই নকশা কোন বাড়িতে ভীতির স্থান আবার কোন বাড়িতে কামনার স্থান নির্দেশ করে। আবার আরেকটা ঘরটির অদৃশ্য স্থানও নির্দেশ করে।
যেখানে যেখানে এই নকশা দেখেছি সেসব জায়গার কথা মনে করার চেষ্টা করলাম। মনে হলো, এই নকশা অপরিচিত হলেও সম্পূর্ণরূপে ঠিকঠাক আছে। এজন্য নিজেকে মানানোর জন্য জোর চেষ্টা করতে হলো যে, আমি আগে কখনও এই নকশা দেখিনি। আমি ওর হাত থেকে এই নকশাটা নেওয়ার জন্য বৃথা চেষ্টা করলাম। আমার কপাল ঠেকালাম এতে। এরপর কাঠের খিলাল করা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। জানালাটাকে একটা কালো দাগ মনে হলো। এর মধ্য দিয়ে ঢুকে আরেক পাশে বের হলাম।
যখন আঙিনা পার হয়ে প্রধান ফটকের দিকে যাচ্ছিলাম তখন বারান্দার ওপারের ছোট ছোট গাছগুলো থেকে পাখির কিচিরমিচিরের শব্দ আসছিল। এক বৃদ্ধ খকখক করে কাশতে কাশতে চলে গেল।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ থামলাম না। আসলে প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি যে, আমি কথা বলা বন্ধ করেছি। এর কারণ, আমি কখনই বাচাল ছিলাম না। আসল কথা হলো- আমি এখন চিন্তাভাবনায় মনোনিবেশ করছি। ওই বাড়ি থেকে আসার পর আমি ঠিক দুইদিন ঘুমালাম। ঘুমের মধ্যেও ভাবতে থাকলাম। এমনকি ঘুম থেকে ওঠার পরেও ভাবনার মধ্যে মজে থাকলাম। প্রথম যে বিষয়টি আমার মনে এলো, তা হলো- সে-রাতে আমি শুধু স্পর্শ ইন্দ্রীয় দ্বারা চালিত হয়েছিলাম। শুধু স্পর্শ করেই আমি সব উপলব্ধি করেছি। যাকিছু আমি অভিজ্ঞতাই ধরেছি, তার সবই আমার স্পর্শ ইন্দ্রীয়ের রূপান্তরিত প্রতিফলন। তারপরেও আমি কিছুই হারাইনি। প্রথম কয়েক মিনিট তো মনে হচ্ছিল আমার সবগুলো ইন্দ্রীয়ই পরিতৃপ্ত।
আমি কখনই ঐ মহিলার ব্যাপারে কৌতুহল বোধ করিনি। অথচ আমি যে তাকে নিয়ে ভাবতে নিজেকে চাপাচাপি করি, তাতে আমি নিজেই বিস্মিত হই। কিন্তু ওর যে অবয়বই কল্পনা করি না কেন, আমার মন তাতে সায় দেয় না। নিজের সঙ্গে অনেকদিন যুদ্ধ করি। অবশেষে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হই। মনের মধ্যে দীর্ঘ তর্কবিতর্কের শেষেও আমি ওকে চিনতে পারিনি। কিন্তু ও সঙ্গে সঙ্গে আমাকে চিনতে পেরেছে। যেখানেই দেখুক আর যখনই দেখুক। এই ভাবনা আমাকে খুব বেশি বিচলিত করেনি। তবে আমাকে স্বস্তিতেও থাকতে দেয়নি। আমি ব্যাপারটাকে আদি সত্যের নির্যাস হিসেবে গ্রহণ করেছি। এটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা ছেড়ে দিয়েছি। এখন তো আমার মনে হয়, এই ব্যাপারটি নিয়ে কথা বলাও ছেড়ে দিয়েছি।
আমি নিস্তব্ধতা নিয়ে পণ করছি না। আসল কথা হলো, আমার কথাবলার দরকার নেই। এই বাড়িতে যারা থাকেন, তারাই আমার জন্য এ কাজ সম্ভব করেছেন। ওরা আমাকে কোথাও দেখেছেন। আমাকে চিনেছেন এবং বলেছেন যে, অনেক প্রজন্ম ধরে আমাদের পরিবারগুলো মিলেমিশে বাস করে আসছিল। ওরাই আমাকে এই বিশাল বাািড়তে নিয়ে আসেন। আমাকে ঔদার্যের সঙ্গে যে ঘর খুঁশি সে ঘর বেছে নিতে বলেন। পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে আমি এই জায়গাটা পছন্দ করেছিলাম। দীর্ঘদিন এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। আমার এই বেছে নেওয়ার ব্যাপারটা ওদের হয়ত-খুশিই করেছিল। আমার বিছানাটা একেবারে ভীতির স্থানে পাতা। এই বাড়ির কামনার স্থান খুঁজে পাইনি। কিন্তু তা তো হতে পারে না। কাজেই, আমি এখন নিশ্চিত, ভয় ও কামনা একে অপরকে ভেদ করেছে ঠিক যে জায়গায় আমি সেখানেই প্রভুত্ব করছি।
একদিন মধ্যরাতে আমি আমার ঘরে হেটে বেড়াচ্ছিলাম। ঠিক তখনই এই স্থানটি আমার দৃষ্টিগোচর হলো। এটি একটি কালো অবয়ব ধারণ করলো। এই অবয়বটি অচেনা। এটি পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করলো। আমি অনেকক্ষণ এর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এরপর পুরো ঘর ভালোভাবে পরীক্ষা করলাম। প্রতিটি ফাঁক-ফোকর পরীক্ষা করলাম। প্রতিটি জানালা, এমনকি ছাদের ফুটোও পরীক্ষা করলাম। সাদা রঙে মুড়িয়ে দিলাম। কিন্তু ঐ কালো অবয়বটিতে সাদা রং স্পর্শ করতে পারলো না।
ঐ অবয়বের অদৃশ্য অংশ তখন মনে হলো ঠিক ডান দিকে। বাইরে পাখিরা কিচিরমিচির করছিল। আমি একেবারে নিশ্চিত, যদি একটু চেষ্টাও করি তবুও ঐ অবয়বকে আগে কোথায় দেখেছি, তা মনে করতে পারব না। কিন্তু এই চেষ্টা করব না বলে আগেই তো মনের সঙ্গে সন্ধি করে ফেলেছি। সেই তখন থেকেই আমি কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। আর ঐ সেই একই দিনে, যেদিন আমার নার্সের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো, সেদিন আমি আমার বিছানা আংশিকভাবে ভয় আর কামনার স্থানের বাইরে সরিয়ে নিলাম। সে আমার বিছানার এ পাশটায় বসে। আমি ওর দিকে তাকাই। আমার বিশ্বাস, আমি এভাবে ওকে রক্ষা করছি। নিজেকেও।
0 মন্তব্যসমূহ