বেগম জাহান আরা'র গল্প: কারিন শেংক-এর কথা




ওকে দেখলেই ক্লারা ফন ব্রাখেলের কথা মনে পড়ে যায়। সে ছিলো প্রায় ছ ফুটের মতো লম্বা। এ মেয়েও বেশ লম্বা। সে ছিলো বার্লিনের মেয়েদের হকি টিমের কাপ্তান। এ মেয়ে তা নয়। হাঁদা গোদা পুরুষকে বিপন্ন দেখলে সে উপকার করতো। সঙ্গে গালাগালিও প্রচুর।এর কথা বলতে পারিনা। ও তাই তো! সৈয়দ মুজতবা আলীর 'স্বয়ম্বরা' গল্প না পড়লে ফন ব্রাখেলকে তো জানা সম্ভব নয়। সে যাক। আমি বলবো ব্রেমেনের মেয়ে কারিন শেংকের কথা।
ওর সঙ্গে দেখা হলো আলটোনার এক ইয়োগো সেন্টারের কাছে। উলওয়ার্থ দোকান থেকে আমি বেরোচ্ছিলাম এক গাঁদা জিনিস নিয়ে। এক পাউন্ড উলের ফুটবল সাইজের গোলাটা পড়ে গেলো হঠাৎ। ঢ্যাঙা পায়ে ছুটে এসে ভুলে ধরলো, 'বিতে শোয়েন'। হয়তো পরনে শাড়ি দেখে ভেবেছে, ‘দাংকে’ বলতে জানিনা। বললাম, 'দাংকে'। ও আবার বললো, ‘বিতে শোয়েন'।
 
সামনেই দাঁড়িয় কারিন শেংক। সোজা লাঠিও ওকে দেখে লজ্জা পাবে। এতোই টান টান শরীর উন্নত গ্রিবা। দেখতে বেশ সুন্দর। হাসিটা একটু কাঠ কাঠ। বোধ হয় ডালিম দানার মতো দাঁত নয় বলেই। কথা বলে খুব সুন্দর করে। তবে মাথা ঝাঁকা়য় বিস্তর। পিঠের উপর পনি টেইল মার্কা চুলের গোছা তখন দোলে এদিক ওদিক। স্মার্ট পোশাক। খুব মিষ্টি পারফিউমের গন্ধ গায়ে ।
 
আলস্টার লেকের ধারে একটা হোস্টেলে থাকি। কারিনের সঙ্গে ভাব হয়ে গেলো। নিয়ে এলাম কফি খাওয়ানের জন্য। ও সন্ধেবেলা চলে যেতে চেয়েছিলো ব্রেমেনে। ঘণ্টা দেড়েকের পথ এদের জনা নস্যি। দেখি বৃষ্টি হচ্ছে

জোরে শোরে। এতো বৃষ্টিও হতে পারে হামবুর্গে! বললাম, থেকে যাও রাতটা । কাল সকালে যেও। রাজি হলো খুব স্বচ্ছন্দে।
 
একদিন দুদিন করে সাতদিন থাকলো কারিন। দিনের বেলায় দুজন দুদিকে যাই। আমি যাই সিটি সেন্টারে। ও যায় আলটোনায়। সকালে এক সঙ্গে চা নাশতা খাই। রাতের খাবারও এক সঙ্গে। গল্প হয় প্রচুর। আমি

যতোটা জানতে চাই, ও বলতে চায় তার চেয়ে অনেক বেশি। ওর কথা সবই ইয়োগা কেন্দ্রিক। একদিন আটলান্টিক হোটেল দেখাতে যাবো ভাবলাম। সময়ই হলো না। পাকিস্তানের একদার প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইযুব খান ঐ হোটেলে থাকতে পছন্দ করতেন। তাই দেখতে চাওয়া। যাক। তার চেয়ে গল্পই ভালো আমাদের। বলি, ইয়োগার প্রতি আকৃষ্ট হলে কি করো?
 
- আমার দুজন বন্ধকে দেখে। ওরা যে কি অসম্ভব দামাল ছিলো। এখন অনেক শান্ত হয়েছে।
 
- দামাল মানে
 
- দিশাহীন ছোটাছুটি করতো। কেনো যে করতো তাও বোধ হয় জানতো না। এক সপ্তার বেশি বন্ধু টেকেনা। মানে, ভালো লাগেনা । কোনো জায়গায় দুটো উইকেণ্ডও কাটায় না। মানে ভালো লাগেনা। উইকেণ্ডে পানীয় খেয়ে চুর হয়ে থাকে। সাইকেল রেস-এ যায়। কার রেস-এ যায়। সুইমিং, হর্স রাইডিং তো আছেই । যেনো কোনো দানব ওদের তাড়া করছে অনুক্ষণ।

তুমিও কি দামাল ছিলে? হাসি আমি।
 
কারিনও হাসে। বলে, ছিলাম বইকি! তবে ওদের যতো ওয়াইল্ড নয়। মানে... মানে ..
 
বুঝলাম একটু ইতস্তত করছে। বললাম, থাক তোমার কথা। ইয়োগা কেমন লাগছে, বলো।
 
- না না, তোমার কাছে বলবো আমার কথা। এক এক করে তিনজন বন্ধু আমাকে ছেড়ে যায়। তারপর আমি একটু সিক হয়ে পড়ি। ডাইভিং শিখতে গেলাম। ভালো লাগলো না। স্কিইং-এ গেলাম। হলো এ্যাক্সিডেন্ট।
 
- তোমার তো কোনো হাত নেই এসব ঘটনায় তাই নয় কি?
 
- নিশ্চয় আমারই ঘাটতি দিবা। এরপর হলো কি জানো? ছেলেদের দেখলেই আমার রাগ হতো। কিসের যেনো অস্থিরতা, বুঝতে পারতাম না। শুধু কাজের সময়টা ভালো কাটতো। কাজ ফুরোলেই মনে হতো, বন্ধু চাই

জীবনে। অথচ পুরুষ দেখলেই বিতৃষ্ণা। ছুটে গিয়ে দুটো ঘুষি মেরে আসতে ইচ্ছে হতো। বড়ো বাজে সময় সেগুলো।
 
- এখন তো ভালো আছো?
 
- খু-উ-ব ভালো। ইয়োগা আমাকে শান্ত করেছে। এখন খুব গুছিয়ে ভাবতে পারি। বই পড়তে পারি। ছেলেদের দেখলে রাগ হচ্ছে না। হ্যাঁ, তুমি ইয়োগার কথা জানতে চেয়েছিলে।
 
- হ্যাঁ বলো না কি কি করো? কোন কোন আসন শিখেছো?
 
চোখ বড়ো বড়ো করে কারিন বলে, মানে তুমি ইয়োগা সমন্ধে জানো?

আসন কি তাও?
 
- একটু একটু জানি।
 
-কেমন করে? বাংলাদেশে ইয়োগা আছে?
 
- নিশ্চয় আছে। ইয়োগা বাংলা-ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশের বহু প্রাচীন সাধনা । পাকিস্তানের কথা জানিনা। তবে বাংলাদেশে ইয়োগা সেন্টার আছে।
 
-কি যে ভালো লাগছে শুনে। আমি তো এখন হিলিং শিখছি ।
 
- পুনয়ে আমার এক বান্ধবি আছে। অপর্না। ইয়োগা করতো। সে আমাকে হিলিং সম্বন্ধে বলেছে।
 
-কি রকম হিলিং শিখতো সে?
 
- অপর্না নিজের স্বাস্থ্যের হিলিং শিখতো। এ্যাজমা ছিলো। কষ্ট পেতো প্রতি শীতে।
 
- ভালো হলো তোমার বন্ধু?
 
-ও বলতো, অনেক কমেছে। আমি দেখতাম, কিছুই কমেনি। যাক ওর কথা। তোমার কথা বলো কারিন। আসনের কথা বলো, মন্ত্রের কথা বলো।
 
- পদ্মাসনটা এখনও পারিনা। অন্য আসন তেমন কঠিন না। আর মন্ত্র শুনতে চাও? শুরু করি প্রায় পদ্মাসনের মতো বসে। হাত দুটো জোড়া করে বুকের সঙ্গে ঠেকাই। চোখ বন্ধ করি। বলি, সা...ত নাম। সাত-টা টেনে টেনে

স্বর উঁচু করে। নাম-টা উচ্চারণ করি গলা নামিয়ে। স্বর নামাতে চেষ্টা করি. নাভিমূলে।

আমার মনে হলো, সাধ-নাম-ই ওর মুখে সাতনাম হয়েছে। অথবা সৎনাম। যাই হোক, শুনি তো আগে । পাবনার 'সৎসঙ্গ' নামটা মনে গড়লো।
 
-কতোবার বলো মন্ত্রটা?
 
-তিন বার। তারপর শুরু করার মন্ত্র। গুরু বলেন 'আদি মন্ত্র'। আমাদের

ভাষায় 'আনফাংক্স মানত্রা?
 
- সেটা বলো না।
 
- অং নামো গুরু দেব নামো' । অনুবাদ হলো- Ich berufe mich and die komische Energie und than erhabenen weg aus dem Dunkel ins Licht.এটা শক্তি জাগানিয়া মন্ত্র।
 
আমার মনে হলো উচ্চারণটা হবে, ‘অং নমো গুরু দেব নমো'। আর জা্র্মান অনুবাদটা ঠিক পছন্দ হলো না। তবু একটা অনুবাদ আমি করলাম: হে আত্মা প্রণাম, গুরুদেব প্রণাম। অলৌকিকভাবে আঁধার কাটিয়ে আলোর

দিকে যাওয়ার শক্তি দাও। তবে আমার বিদ্যার দৌড়ও তো বেশি নয়। যাক গে, কারিন তো খুশি। কথায় বলে, বিশ্বাসে মিলায় সত্য, তর্কে বহুদূর । রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে, কৰি তব মনভুমি রামের জন্মস্হান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো'।
 
কারিন কিন্তু ভাবে ডুবে গেছে। সে বললো, কোনো ভালো কাজ বা কোনো যাত্রা শুরুর আগের মন্ত্র শোনো। এইবার শিখেছি।
 
‘আধ গুরে নামে
 
ইয়োগাত গুরে নামে
 
সাত ভরে নামে
 
সাত গুরে দেবে নামে'।

 এটা হলো 'শুট্ত্স মানত্রা'। নিরাপত্তা প্রার্থনার মন্ত্র।
 
কারিনের ভক্তি দেখে ভালো লাগে। উন্নত সত্যতার দেশে সময়ের তীব্র গতিতে জীবন ঘোরে। ও একট শান্ত হতে চায়। হোক না। বিশেষ করে স্কি-ইং-এ পা ভাঙার পর ও বদলে গেছে একটু।
 
সকালবেলা নাশতার সময় নিজের ট্রে সাজায় কারিন। আট দশটা ছোটো শিশি। ভেষজ চা। দুটো বড়ো কাপ। একটা ছোটো গ্লাস ভেষজ ওষুধের জন্য দুধ খায় না। দুধের তৈরি কোনো জিনিস খায় না। চিনি খায়না। তাই

মিষ্টি তো নয়ই, মিষ্টি জাতীয় কোনো ফলই খায় না। সাদা ময়দার রুটি খায় না। ব্রাউন রুটি টোস্ট করে মাখন আর মাংসের পুরুপেস্ট লাগায়। চা খেতে সময় লাগে অনেকক্ষণ। তারপর হোমিওপ্যাথির বড়ির মতো সাদা বড়ি গুনে গুনে বাইশটা ছোটো গ্লাসের পানির মধ্যে ফেলে। সেটা খায় ঢোকে ঢোকে।
 
আমি দেখি আর ভাবি। মন্ত্রের প্রভাব আর নিয়মের আচারে কারিনের এই বিশ্বাস সত্যি অবাক করার মতো। নি:সংকোচে নিষ্ঠার সঙ্গে গুরুর নির্দেশ পালন করে। মন্ত বড়ো গুণ। মানসিক জোরও বটে।
 
ইয়েগা শিখতে টাকা লাগে কিনা জানতে চাইলাম। বললো, অবশ্যই লাগে। সপ্তাহের ক্লাসে প্রতিদিন পঞ্চাশ ইউরো। আমাদের দল একদিনই ক্লাস করে।
 
- কতোজন আছে তোমাদের দলে? মনে মনে বলি, বেশ ভালো ব্যবসা তো। আসলে টাকা বানানো জানতে হয়।
 
-পনরো জন।
 
-কতোদিন শিখবে?
 
- আমি তো কেবল প্রথম স্টেপ-এ। মনে হয় বছরে একটা স্টেপ পার হওয়া যাবে।
 
- কয়টা স্টেপ?
 
- তিনটে। পরিক্ষা হয় উপরের স্টেপে ওঠার জন্য। প্রতি বছর তিন বার ইনটেনসিভ কোর্স আছে। সেই কোর্স তিন দিনের প্রথম দিন দিতে হয় বিশ ইউরো। তারপর দুদিন একশো একশো করে।
 
- বেশ এস্কপেনসিভ, কি বলো?
 
- হ্যাঁ। এর উপর আমাদেরকে মন্ত্রোচ্চারণের সিডি কিনতে হয়। আমরা শুনতেও পারি। দেখতেও পারি ডিভিডি প্লেয়ারে।
 
- মন্ত্রগুলো তুমি বুঝতে পারো কারিন?
 
- বুঝিনা। তবে মন্ত্র উচ্চারণের সময় সাড়া পাই শরীরে। ভালো লাগে। ইয়োগা আমাকে শক্তি দিচ্ছে। দারুণ জিনিস যাই বলো।
 
মনে পড়লো উমরা হজ্বের সময় কাবাঘর তাওয়াফ করার কথা। সমস্বরে আমরা বহু মানুষ আরবি উচ্চারণে দোয়া পড়ছিলাম। অনেক কণ্ঠ স্বরের গমগমে আওয়াজ চাঙ্গা করে তুলেছিলো শরীর এবং মনকে। পানি পড়ছিলো চোখ দিয়ে। ভক্তি আর ভালোবাসায় অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। দোয়ার শাব্দিক অর্থ বোঝার চেষ্টা করিনি। মাথায়ও আসেনি কথাটা। কারিন কি সেই রকম কিছু অনুভব করে? হতেই তো পারে! ভক্তির বোধ বিশ্বাসটা বোধ হয়, এরকমই। বুদ্ধির কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে হয় অনেক দূরে ।
 
কথা বলতে বলতে রোজই রাত বেড়ে যায়। ঘুমোতে যাওয়া হয়না বারোটার আগে। কারিনকে বললাম, আজ তাড়াতাড়ি ঘুমোবো। মাথাটা ভার ভার লাগছে।
 
মানে মাথাব্যথা করছে?
 
- একটু। ও কিছু না।
 
-এসো তোমার হিলিং করে দিই।
 
কি আগ্রহ মেয়েটার! টান টান হয়ে আরাম করে চোখ ঝুঁজে শুতে বললো। কাছে বসে ওর দুহাত রাখলো আমার ডান বাহুতে। ওর হাতের তালু গরম ছিলো কিনা জানিনা। হঠাৎ মনে হলো, জায়গাটা গরম হয়ে উঠলো।

একটু পরেই চলে গেলো উষ্ণতা ।
 
বেশ আরামই লাগছিলো। কেমন ঘুম ঘুম ভাব। একটু তন্দ্রাও এসেছিলো। মনে হলো জোয়ারের ফেনাযুক্ত পানিতে আমার গা ডুবে গেলো। তারপর আর পানি নেই। চোখ পিট পিট করে দেখলাম, কারিন দুলছে। প্রায় পনরো বিশ মিনিট পর বাহু থেকে হাত টেনে নিলো ও।
 
চুপ করে শুয়ে আছি। ও ভেবেছিলো, ঘুমিয়ে গেছি। কিন্তু না।.আমার অনুভবগুলো বুঝতে চেষ্টা করলাম যুক্তি দিয়ে। হলো না বোঝা। বার বার কারিনের স্পর্শের উষ্ণতা এবং ফেনা পানির খুব হালকা আরামের বোধটা জেগে ওঠে মনে। ব্যাপারটা কি!
 
এনার্জি ট্রান্সফারে আমি বিশ্বাস করি। হিলিং-এও করি। নইলে বেঘোর জ্বরের সময় প্রিয় মানুষ কপালে হাত দিলে এতো আরাম লাগে কেনো? নিজের অজান্তেই প্রিয় মানুষ হিল করে। দিতে চায় আরাম । আবার বাচ্চা পড়ে গেলে

মা বুকে নিয়ে চুমুর পর চুমু দেয়। কতো রকম আদরের কথা বলে। হাত বুলিয়ে দেয় গায়ে। চুপ করে যায় বাচ্চা। নিশ্চয় আরাম পায়। নিজের অজান্তেই হিল করে মা। কেউ এক সময় বলেছিলো, ওঝারা খুব শক্ত হিলার। মন্ত্রটন্ত্র

কিছু না। সাপের চৌদ্দ গুষ্টির শাপশাপান্ত করে গাল দিয়ে দিয়ে বিষগ্রস্ত ব্যক্তিকে বোঝানো হয় যে, সাপই মরবে। রোগির কিছু হবে না। এতে তার বাঁচার ইচ্ছাশক্তি বেড়ে যায় বহগুণ। ভাবতেই মাথা ঘোরে আমার।
 
কিছু প্রশিক্ষণের হিলিং ক্ষমতা সম্বন্ধে আমি জানি না। চোখ মেলে দেখি, কারিন আমারই দিকে তাকিয়ে। বললো, কেমন লাগছে?
 
কি বলবো? আধঘন্টা চোখ বুঁজে শোয়াটা এক রকম মানসিক বিশ্রাম। মাথা ব্যথা করলে কখনই করা হয়না কাজটা। সেজন্যই ভালো লাগছে কি? নাকি কারিনের হিলিং? ওর স্পর্শে এক রকম অনুভব তো হয়েছে? বললাম, ভালো লাগছে।
 
খুশিতে ঝলমল করে উঠলো কারিন। বললো, তোমার সোল খুব জাগ্রত দিবা। ওখানে যোগাযোগ করতে আমার বেশি সময় লাগেনি। প্রথমে কেটে কেটে যাচ্ছিলো। পরে মগ্ন হয়ে গেলাম।
 
- তুমি দুলছিলে, আমি দেখেছি।
 
- ওটা কাজের আনন্দ। তুমি কিছু অনুভব করোনি? সবটুকু খুলে বললাম। ওর দুচোখ দিয়ে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা পানি ঝরে পড়লো ।
 
- তুমি পারবে কারিন। সেনসিটিভ এবং প্রেমবোধ না থাকলে হিলিং হয় না। গুণ দুটো তোমার আছে পুরোমাত্রা।
 
- আমাদের গ্রুপে পারস্পরিক হিলিং করতে হয়। সাইপ্রাসের একজন আছে। লিওন। ব্যর্থ প্রেমিক। ওকে হিল করতে গিয়ে মরণ হলো আমার ।
 
-কেনো কেনো?
 
-এখন মারা যাচ্ছে আমার জন্য। মিষ্টি করে হাসে ও।
 
-কতোটা দখল করেছো লিওনের। আমিও হাসি দুষ্টু দুষ্টুভাব নিযে।
 
- মনে তো হয় অনেকটা। ও নাকি দিন রাতই স্বপ্নে দেখে আমাকে। গুরুও জানেন বিষয়টা
 
-আর তুমি?
 
তুমি বেশ দুষ্টু। উচ্ছ্বসিত হাসিতে ভেঙে পড়ে কারিন। মানে, মরেছে সেও। মুখে বলতে চাইছে না।
 
-আচ্ছা তোমাদের শেখান কে ইয়োগা?
 
- গুরু আছেন। তিনি মেক্সিকান। একবার আসেন বছরে। সেন্টাগুলো পরিচালনা করেন জার্মান গুরু।
 
মনে হলো, ধাক্কা লাগলো কিছুর সঙ্গে। খুব জোরে। মেক্সিকোর লোক ইয়োগা শিখেছে, শুনতেই খটকা লাগে। বললাম, উনি কতোদিন শিখেছেন?
 
-তা বলতে পারবো না। তবে ওঁর আসল গুরু ভারতীয়। তিনি মারা যাওয়ার আগে মেক্সিকান এই শিষ্যকে দিয়ে গেছেন পরবর্তী গুরুর আসন। তিনিই এখন হামবুর্গে।
 
কি জ্বালা। কোথাকার জিনিস কার মাধ্যমে কোথায় যায়? ম্যাপটা দেখি মনে মনে। কোথায় ভারত, আর কোথায় মেক্সিকো? কোথায় হামবুর্গ।
 
কারিন সকালেই চলে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু প্রচণ্ড পিঠের ব্যথা। গরম পানির ব্যাগ নিয়ে শুয়ে আছে।
 
ফোন করলো সাইপ্রাসের প্রেমিক লিওন। দুবার ‘সাতনাম' বললো কারিন। এটাই ওদের গ্রিটিংস। নমস্কারের মতো হাত জোড় করে সামান্য মাথা নুইয়ে পরস্পরকে এরা বলে ‘সাতনাম' । কথা শেষে বিদায়ের সময়ও এই

'সাতনাম'।
 
কারিনের শরীর খারাপ শুনে ওকে দেখার জন্য আসতে চাইলো লিওন। আমি বললাম, বলে

দাও আসতে। খুশিতে ঝকমক করে উঠলো ওর চোখ দুটো।
 
কারিনকে বললাম, সেল্ফ হিলিং করো না। ব্যথা কমে যাবে।
 
-নিজেরটা যে পারিনা। অসহায় কণ্ঠস্বর কারিনের।
 
- সেকি? মন্ত্রগুলোর তো মানে আছে। যেটা এখন তোমার দরকার, সেই

মন্ত্র পড়ো।
 
- মন্ত্রের মানে খুব কঠিন। উচ্চারণও। তবে গুরু বলেন, মানে নিয়ে মাথা ঘামিও না। মন্ত্র উচ্চারণ টাই আসল । আবার সেই কথা।
 
- মানতে পারিনা কারিন। একটা খটকা থেকে যায়।
 
- কিন্তু কথাটা খুব সত্যি দিবা। গভীর প্রত্যয় ওর কন্ঠে। উমরা হজের কথা মনে পড়ায় আমিও দুর্বল যাক। ওর বিশ্বাসে বাধা দেয়ার দরকার কি আমার! ওযে ফাঁকির ঘরে ঢুকে পড়েছে এটা বুঝলাম। গুরু ওকে অন্যের হিলিং

শেখায়। নিজের নয়। মনে হয় ভারতীয় যোগী হলে এমনটা হতোনা। তবে কি ভিনদেশি গুরুর মধ্যেই গলদ? সেও কি জানেনা মন্ত্রের অর্থ?
 
আধঘন্টার মধ্যে লিওন এলো। ঘনো কালো কোঁকড়ানো চুলের এক সুন্দর মেয়ে তার সঙ্গে। টপস্ স্কার্ট দুটোই লাল। মাথায় লাল ব্যাণ্ড। টকটকে লাল লিপস। যেনো জ্বলন্ত আগুন। আমি এবং কারিন ওকে দেখতে লাগলাম।

লিওন বললো, এ হলো মারিতা। ছেড়ে গিয়েছিলো আমাকে। ভুল বুঝতে পেরে ফিরে এসেছে কাল। বিয়ে করবো আমরা কালই। খুশিতে উপচে পড়ছে লিওন। হাসছে মারিতাও।
 
মুহূর্তে চেহারা বদলে গেলো কারিনের। একটু আগেও লিওনের কথায় স্বপ্নের প্রবাল দ্বীপ দেখেছি কারিনের চোখে। লিওনের মন জয় করেছে বলে রানীর মতো ভঙ্গি দেখলাম। আমি একটু দুষ্টুমি করতেই নায়াগ্রার উচ্ছ্বাস হাসিতে । এখন ধসে পড়া বস্তার মতো মনে হচ্ছে।
 
কেটে গেলো কয়েক সেকেন্ড। হট-ওয়াটার ব্যাগ সরিয়ে সোজা হয়ে বসলো কারিন। ইয়োগার ভঙ্গিতে বসে 'সাতনাম' উচ্চারণ করলো তিনবার। তারপর বললো, তোমার জন্য অফুরান শুভ-কামনা ‘লিওন'। এবার এসো। গুড বাই!
 
মুণ্ডুপাত করি লিওনের। ওদের জন্য কফি কেক চকোলেট আর চানাচুর সাজিয়ে দিয়েছিলাম টেবিলে। পড়ে রইলো সব। চলে গেলো ওরা। ভেবেছিলাম, লিওনের সঙ্গে জড়িয়ে কারিনকে নিয়ে গল্প লিখবো। গাধাটা মাটি করে দিলো সব।
 
আমারই কষ্ট হতে লাগলো কারিনের জন্য। স্মার্ট আর মনকাড়া পারফিউমের মধ্যে হঠাৎ এমন ছোটো ছোটো গভীর ক্ষত তৈরি হয় যা সহজে দেখাই যায়না। ক্ষরণ হয় ভেতরে। বুঝতে পারছি। ওর হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে।

রক্তে ভেসে যাচ্ছে ভেতরটা । কিন্তু ঘা খাওয়া শক্ত মেয়ে কারিন। বলবেনা কিছু। কি জ্বালা। আমার চোখে পানি উপচে ওঠে কেনো? সাধে কি বন্ধুরা বলে আমি একটা ইমোশনাল ফুল!
 
ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের বয়স মাত্র সাত দিনের। ভালো লাগলো মেয়েটাকে। কাছে টানলাম বন্ধুর মতো। অনেক কথা জানলাম। আমি তো মানুষের মনের বাক্স খুলতেই চেষ্টা করি। নইলে পাবো কোথায় জীবনের গল্প?
 
কারিন ব্যাগ গোছাচ্ছে আর শক্তি জাগানিয়া মন্ত্র গাইছে গুন গুন করে, অং নামো গুরু দেব নামো, অং নামো গুরু দেব নামো, অং নামো...।
-------------------------
১৪-০৯০৯
হামবুর্গ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ