মূল গল্প: ইন্তিজার হুসেইন
ভাষান্তর – উৎপল দাশগুপ্ত
বউ ওর দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, “হাসছ কেন?”
“কই হাসছি না তো, কোথায় হাসছি?” একটু আড়ষ্ট দেখাল ওকে।
“হাসছ না? তাহলে বত্রিশ পাটি বের করে রেখেছো কেন!” বউ একটু তলিয়ে দেখতে চাইল। “কারোর কথা মনে পড়েছে নাকি?”
“কার কথা আবার মনে পড়বে?” বিড়বিড় করে বলে চুপ মেরে গেল।
ছেলেটি চাইছে ওর বউ ওখান থেকে সরে যাক, যাতে ও প্রাণ খুলে হাসতে পারে। কিন্তু বউয়ের নড়বার কোনও লক্ষণই নেই।
ব্রেকফাস্টের প্লেটগুলো রান্নাঘরে নামিয়ে রেখেই তাড়াতাড়ি ফিরে এল। ছেলেটি বুঝে ফেলল বাড়িতে হাসবার সুযোগের আশা দুরস্ত।
কিন্তু যায় কোথায়?
বাড়িতে সুযোগ পাওয়ার আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে ছেলেটি বাকি সম্ভাবনাগুলো তোলপাড় করে খুঁজতে লাগল। কোথায় গেলে নিশ্চিন্ত মনে একটু হাসা যায়।
একটু হেসে নেবার জন্য মনটা ছটফট করছে। ঠিক করেছিল, বাড়িতে বসেই হাসবে।
কিন্তু বাড়িতে সুযোগ পাবে বলে মনে হয় না। অতএব বেরনোর জন্য উঠে দাঁড়ায়।
“অফিসে তোমার একটু দেরি করে যাওয়ার কথা ছিল না আজ?” বউ খোঁচা দেয়।
“তা ঠিক, কিন্তু খুবই জরুরি একটা কাজের কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে। সেটা করে ফেলা দরকার।”
“ভাল কথা। তা বেরোচ্ছই যখন ইলেক্ট্রিকের বিলটাও জমা করে দিও। পরশুই জমা করার শেষ তারিখ। বিল আর টাকা নিয়ে আসার জন্য মেয়েটি ওঠে।
ছেলেটি বেরোতে যাবে, আরও একটা কাজের কথা বউয়ের মনে পড়ে যায়। “আম্মা খালাকে মানি অর্ডার করে কিছু টাকা পাঠাতে হবে। বিলটা জমা দেওয়া হয়ে গেলে, কাছাকাছির কোনো ডাকঘর থেকে মানি অর্ডার করে দিও।” আবার ছুটে ভেতরে গেল। একশ টাকার একটা নোট নিয়ে ফিরে এসে ওর হাতে ধরিয়ে দিল।
বাড়ির বাইরে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।। যাক বাবা, এবার একটু হাসতে পারব, ভাবল মনে মনে। স্কুটারে স্টার্ট দিতে দিতে মুচকি মুচকি হাসল। পরমুহূর্তেই মনে হল, এই রে, স্কুটার চালাতে চালাতে হাসলে, লোকে বলবে কী? স্কুটারে বসে আপনমনে হাসলে, খুবই বেমানান লাগবে যে! অতএব হাসি চেপে নিজেকে স্বাভাবিক করতে হল।
ইলেক্ট্রিকের বিল জমা দিতে ব্যাঙ্কের কাউন্টারে পৌঁছল। লম্বা লাইন পড়েছে। কী আর করে লাইনের পেছনেই দাঁড়াল। অস্থির অস্থির লাগছে। অবশেষে ওর পালা এল। বিল জমা করেই ডাকঘরের জন্য বেরিয়ে গেল। মানি অর্ডার করার ফর্মটা ভরতে ভরতে লম্বা একটা লাইন পড়ে গেল এখানেও। লাইনের সবার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। শেষমেশ এই কাজটাও মিটল।
ব্যাঙ্ক আর ডাকঘরের পর্ব শেষ হওয়ার পর খুবই মনমরা লাগছিল। শান্ত আর নিরুপদ্রব একটা জায়গা পাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করে ওঠে। এক পেয়ালা চা খেয়ে একটু চাঙ্গা হতে পারলে বেশ হয়। একটা হোটেল দেখে ঢুকে পড়ল। ঠাণ্ডা জল খেল এক ঢোক । প্রাণটা জুড়লো। গলায় গরম চা পড়তেই আরও ভাল লাগল। হাসবার ইচ্ছের কথাটাও আবার মনে পড়ে গেল।
হাসাটা খুবই দরকার। কিন্তু আশেপাশের টেবিলের খদ্দেররা ওকে একলা একলা হাসতে দেখলে কী ভাববে? নিশ্চয়ই লোকটার মাথার স্ক্রুগুলো ঢিলে হয়ে গেছে। চারপাশে নজর ঘোরাল। প্রত্যেকটা টেবিলেই লোক। লাঞ্চের সময়। খাওয়াদাওয়ায় ব্যস্ত সবাই। এক চিলতে হাসিও কারো মুখে নেই। “হাসবার জন্য সময় তো বের করলাম, কিন্তু একা একা হাসি কী করে? একা একা বসে হাসলে সবাই নির্ঘাত ভাববে আমার মাথাটা গেছে! তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে যে হাসতে হলেও একজন সঙ্গী দরকার। কী আজগুবি সব ঝামেলা রে বাবা!”
এর চেয়ে বরং অফিসে চলে যাওয়াই ভাল। “এমন ভাল হাসবার জায়গা আর পাবই না। একবার হেসে ফেললেই হল, হাসিতে ভাগ নেবার জন্য অনেক লোক জুটে যাবে। এলোমেলো আড্ডাতেই কেটে যাবে অনেকটা সময় – রাজনীতি নিয়ে আড্ডা নয়তো রসালো গল্পের জমাটি আড্ডা। আর ফারুকির আছে রসালো গল্পের অফুরন্ত ভাণ্ডার; স্রেফ একটা ছুতোর দরকার, তারপর ওর রসালো গল্পের ফোয়ারা ছুটতে শুরু করবে।”
অফিসে পৌঁছল। মনে হল আবহাওয়াটা যেন একটু ভারি ভারি। ফারুকি নাকি প্রোমশন পায়নি, ওর জায়গায় শিকে ছিঁড়েছে আলি আহমেদের ভাগ্যে। গরমাগরম আলোচনা চলছে এটা নিয়েই। ফারুকির মেজাজ সংগত কারণেই ‘বিগড়ে’ আছে।
কী আর করে, বাড়ি ফেরার জন্য অফিস থেকে বেরিয়ে এল। ততক্ষণে সব কিছু ছাপিয়ে একটাই প্রশ্ন ওকে হয়রান করে তুলেছে – ঠিক কী কারণে ওর হাসবার ইচ্ছে হচ্ছিল?
“কেন আমি হাসতে চাইছিলাম?”
আর এই প্রশ্নেরই সুতো ধরে আরও একটা প্রশ্ন চাগিয়ে উঠছে –“হাসবার জন্য কি কোনও কারণ লাগে?”
মনে পড়ল বউ যখন সকালে ওকে জিগ্যেস করল, “তুমি হাসছ কেন?” ঘাবড়ে গেছিল ও।
“চলতে ফিরতে – কারণে অকারণে – কৈফিয়ত দেওয়া – আমি এটা করলাম কেন, সেটা করব কেন – কী জ্বালাতন! কারণ ছাড়াই, যুক্তি ছাড়াই, অনেক কিছুই আমরা করি না কি? – কিন্তু তা বলে নিজের কাছেই বা কেন জবাবদিহি করব? আমি হাসলাম কেন বা কেন আমাকে হাসতে হবে, তাই নিয়ে? হাসতে ইচ্ছে হয়েছে তাই হেসেছি – নাহয় এমনি এমনিই হেসেছি …”
যুক্তি আর পালটা যুক্তি সাজিয়ে নিজেকে বোঝাতে অসুবিধে হল না, কিন্তু অন্যদের বোঝায় কেমন করে? হাসছ কেন, কাঁদছ কেন, জেরায় জেরায় জেরায় অন্যরা তো জেরবার করতেই থাকবে! যুক্তিটাকে জোরদার করার জন্য আরও দু’চারটে কারণ খুঁজতে খুঁজতে চারপাশে নজর চালাল। মনে হল হাসার জন্য ছুতোর কী অভাব আছে নাকি? যেদিকে তাকাবে সেদিকেই ছুতো পাবে। অথচ হাসতে দেখলেই লোকের আর তর সইবে না, জিগ্যেস করবে, ‘কেন?’ কিন্তু ‘কেন’র জবাব দিতেই বা হবে কেন? এই জন্যই তো অজুহাত থাকলেও লোকে পারতপক্ষে হাসে না – তাজ্জব ব্যাপার … হুঁহ্ … তুমি কি নিজেই নিজের ছায়ার সঙ্গেই লড়াই জুড়লে নাকি …
বাড়ি পৌঁছয়; পরিবেশ মোটামুটি অনুকুল মনে হচ্ছে। সকালের চাইতে পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি আলাদা। রাতের খাবার দেরি করে উনুনে চড়েছে। ওর পাশে এসে বসার মত ফুরসৎ বউয়ের এখন নেই। নির্জনতার আস্বাদ পাচ্ছে – আহা! তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করারই জিনিস এই নির্জনতা – কেউ নেই তোমার ওপর নজরদারি চালানোর জন্য, কী করছ না করছ, কেউ দেখার নেই। খুব স্বাধীন মনে হয় নিজেকে, মুক্তির স্বাদ পাওয়া যায়।
হারা উদ্দেশ্যে রেডিও চালিয়ে দিল, আর উদ্দেশ্যহীনভাবেই রেডিওর নব ঘুরিয়ে চলল। একটা স্টেশনে রেডিও নাটক চলছে একটা। হাসির নাটক। কিছুক্ষণ শুনল, বেশ খুশি খুশি লাগল। তারপর আবার অন্য একটা স্টেশনে নব ঘোরাল। এখানে গান হচ্ছে। গানের হুল্লোড় …
আরও কিছুক্ষণ নব ঘুরিয়ে চলল। যে স্টেশনটাই লেগে যাচ্ছে, সেখানেই মন ভাল করার মত কিছু না কিছু হচ্ছে। “সবাইকেই তো কত খুশি মনে হচ্ছে!” নিজের মনেই বলল।
“সত্যি কথা, সবাইকেই কত খুশি খুশি লাগছে, তাই না?” বিড়বিড় করে কথাটা বলতে বলতে নিজেই বিষণ্ণ হয়ে উঠল। বিনা কারণেই!
----------
লেখক পরিচিতি:
ইন্তিজার হুসেইন – জন্ম ৭ ডিসেম্বর, ১৯২৩ – ব্রিটিশ ভারতের বুলন্দশহরে; মৃত্যু ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ – পাকিস্তানের লাহোরে। পাকিস্তানি সাহিত্যিক – উপন্যাস, ছোটগল্প এবং কবিতা সর্বক্ষেত্রেই তাঁর বিচরণ। উর্দু ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। ২০১৩-র ম্যান বুকার প্রাইজ়ের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন।
ভারতীয় উপমহাদেশে জন্ম এবং ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর পাকিস্তানে চলে যান। তাই তাঁর অনেক রচনাতেই দেশভাগের আগের জীবন নিয়ে স্মৃতিমেদুরতা ফুটে উঠেছে।
তাঁর অনেক লেখাই ইংরেজিতে অনুদিত হয়েছে, যেমন, The Seventh Door, Leaves, Basti. Basti উপন্যাসটি আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশংসিত হয়েছে।
উৎপল দাশগুপ্ত
অনুবাদক।
কলকাতায় থাকেন
0 মন্তব্যসমূহ