অনুবাদ : বিপ্লব বিশ্বাস
আমাদের উটের পিঠে চেপে, শ্বাস আটকে টানটান নীরবতায় পথ চলতে লাগলাম যতক্ষণ না আবু তাহির লাগাম টেনে ধরে শান্ত সন্তোষে ঘোষণা করল : ' আমরা পেরিয়ে এসেছি। '
' পেরিয়ে এসেছি? ', আমরা তিনজন বিস্ময় ও অবিশ্বাস নিয়ে আবু তাহিরের দিকে তাকালাম। ' বন্ধু, আমরা কি তোমার কথা বিশ্বাস করতে পারি? '
পূর্ণ আস্থায় আবু তাহির উত্তর দিল, ' আমার জীবনের ওপর যাঁর নিয়ন্ত্রণ তাঁর নামে দিব্যি কেটে বলছি। আমরা অবিশ্বাসীদের শহর থেকে বেরিয়ে এসেছি। '
তবুও আমরা ভাবতে থাকলাম। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আমরা চারপাশ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলাম। কুফা শহরের চেনা-জানা বাড়িঘর আর নজরে এল না। এ যেন নতুন কোনও ভূখণ্ডের ছবি। এবং তখনই মালুম হল, আমরা সত্যি সত্যিই বেরিয়ে এসেছি। সকলে উটের পিঠ থেকে নামলাম এবং অনিচ্ছাকৃতভাবে সটান শুয়ে পড়ে তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম যিনি আমাদের জীবন দান করেছেন। তারপর সেই পথপাশে বেড়ে ওঠা পাম গাছের ছায়ায় বসে খাবারের পুটলিটা খুললাম। সেখান থেকে মুঠো ভরে ঝলসানো ছোলার ডাল খেয়ে কিছুটা পানি খেলাম। তখন সেই পানি কতই না ঠান্ডা আর মিষ্টি মনে হচ্ছিল। মনে হল যেন কত যুগের তৃষ্ণা নিয়ে আমরা সেই পানি দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাচ্ছিলাম। আল্লাহ সাক্ষী, আমরা খাবারের স্বাদ - গন্ধ ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায় সেই অন্ধকার -নামা অচেনা শহরে এবং যেখানে ঠান্ডা, মিষ্টি পানির কুয়োগুলি ঈষৎ নোনা হয়ে গিয়েছিল। কিংবা হয়তো আমরা এতটাই নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছিলাম যে আল্লাহর দাক্ষিণ্য আমাদের কাছে স্বাদহীন হয়ে পড়েছিল।
এ সবই ঘটল সেই মানুষটা আসার পরপরই। এক উঁচু ঘোড়ায় চেপে কালো কাপড়ে সর্বাঙ্গ ঢেকে, এক টুকরো কাপড় মুখে চেপে, কোমরের খাপে তরবারি গুঁজে সে শহরে প্রবেশ করেছিল। সেই শহরের মানুষ ভেবেছিল, তাদের মাঝে হাজির হয়েছেন সময়ের নেতা, ইমাম জামান ( ইরানের শিয়া বিশ্বাসমতে ইনি আল্লাহর সুবিশাল আশীর্বাদের প্রতীক ও প্রকাশ)। শহরের অলিগলিতে দাবানলের মতো এই খবর ছড়িয়ে পড়ল। সকলে খুবই উল্লসিত। একজন উদ্ধারকর্তার ভাবনা তাদের বুঁদ করে রাখল। ' শাবাশ! শাবাশ! ' চিৎকার করে তারা তাঁকে ঘিরে দাঁড়াল। তারপর মিছিল করে বিউগল বাজিয়ে জাঁকালো রাজপ্রাসাদ কাজার- উল- আমারার দিকে এগোল। দেখে মনে হচ্ছিল, গোটা শহরটা বেরিয়ে এসে এখানে জড়ো হয়েছে।
রাজপ্রাসাদের উঁচু তোরণের সামনে পৌঁছে সে তার ঘোড়াকে লাগাম দিল এবং জনতার দিকে ফিরে তাকাল। সেই সময় তার মুখের ঢাকনাটা সরিয়ে নিল সে। ভয়ংকর, ক্রূর চেহারা, ঠোঁটের কোণজুড়ে জমানো থুতু নিয়ে, খাপ থেকে তরবারি বের করে জনতার উদ্দেশে বজ্রনির্ঘোষে বলল, ' হে জনতা, তোমরা যারা জানো, তারা তো জেনেই গেছ, কিন্তু যারা জানো না - জেনে নাও, আমি এসেছি। ' এ কথা শুনে জনতার মাঝে ভয়াল নীরবতা চেপে বসল। যারা জানত এবং তাদের মাঝে কে এসেছে তাকে দেখতে পেল আর যারা দেখল অথচ তার পরিচয় জানল না - উভয় দলের লোকই হতভম্ব হয়ে গেল।
ঘোষণা শেষ করে সে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করল। অবাক জনতা দীর্ঘক্ষণ নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ না শেষ অবধি আবু- আল- মানজার নীরবতা ভঙ্গ করল। তার গলায় বিষাদের সুর। ' আল্লাহ কুফা শহরের ওপর দয়া বর্ষণ করুন। বিশেষ কারও আবির্ভাবের আশায় এতদিন অপেক্ষা করেছি আর দেখো সবে, কে আবির্ভূত হয়েছেন! '
' কিন্তু এই আগন্তুক কে?'
' তোমাদের লজ্জা পাওয়া উচিত যে তোমরা চিনতে পারোনি, এঁ কার পুত্র? এক দাসীর গর্ভে এঁর জন্ম হয়েছিল এবং এঁর কোনও পিতা নেই। '
' জিয়াদ-এর পুত্র! 'কোনও এক ঠোঁট বেয়ে বিস্ময় ঝরে পড়ল আর তারপর আরও একবার জনতার মাঝে নীরবতা নেমে এল।
তাঁর আগমনের বার্তা দিকবিদিক ছড়িয়ে গেল। রাস্তাঘাট, আগান বাগান সব ফাঁকা হয়ে শান্ত হল। আমি, মনসুর বিন নোমান আল- হাদিদি কলরবমুখরিত রাস্তা, গলিঘুঁজি পেরিয়ে এই রাজপ্রাসাদে পৌঁছুলাম, কিন্তু এখন ফাঁকা পার্ক আর ধ্বনিত রাজপথ পার হয়ে আমার ঘরে পৌঁছুলাম। অস্থির রাত্রির অবসানে সকাল হলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে দেখলাম, শহরটি বদলে গেছে। আল্লাহ সাক্ষী, আমি এক সময় দেখেছিলাম, শহরটি যেন গনগনে আগুনের ওপর চাপানো ফুটন্ত কড়াইয়ের মতো, কিন্তু এখন দেখলাম এ তাদের হৃদয়ের মতো ঠান্ডা যারা অন্যের ওপর লালসা প্রদর্শন করে। হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে সেই জাঁকালো অনুষ্ঠান দেখে চিৎকার করে উঠেছিলাম যা শহরময় ছড়িয়ে পড়েছিল আর কত দ্রুতই না তা মিইয়ে গেল।
ভগ্নহৃদয়ে আমি আমার পুরনো বন্ধুর বাড়ি পৌঁছুলাম যার নাম মাসাব ইবন - এ - বশির। অশ্রুসজল চোখে আমি বললাম, ' ওহে মাসাব, লক্ষ করেছ কি চোখের পলক পড়তে না পড়তেই কুফা শহরটি কেমন বদলে গেছে? '
আমার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাসাব বলল, ' অবাক হোয়ো না, মনসুর, নরম সুরে কথা বলো।'
প্রশ্নাকুল চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ' তুমি কি সেই একই লোক নও যে এই গতকাল পর্যন্ত চেঁচিয়ে কথা বলেছ? '
সে বলল, ' গতকাল আবু আল - মানজার সর্বোচ্চ চড়া গলায় কথা বলেছিল আর আজ সে রাজপ্রাসাদের দেওয়ালের নিচে চাপা পড়ে মরে আছে। '
এমন বলে দ্রুত আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে রাজপ্রাসাদের দিকে চলে গেল। তখন বুঝলাম, কুফা শহরটি সত্যিই বদলে গেছে আর আমার নিচু স্বরেই কথা বলা উচিত ছিল। বরং একেবারে না বলাই ভালো ছিল।
আমি দেখেছি কীভাবে কায়েস- বিন মাসহার কথা বলেছিল আর চিরতরে নীরব হয়ে পড়ে গিয়েছিল। ইবন-এ - জিয়াদের লোকজন তাকে টেনেহিঁচড়ে রাজপ্রাসাদের ছাদে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, ' তোমার কী বলার আছে? '
উঁচু গলায় সে ঘোষণা করল যা সেই নিশ্চুপ শহরের প্রতিটি বাড়িতে শোনা গেল। পরক্ষণেই তাকে ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হল। কতক্ষণ সে রাজপ্রাসাদের দেওয়ালের নিচে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল! দীর্ঘক্ষণ পর তার বন্ধু আবদুল মোমিন বিন - আমির এই রাস্তা ধরে এল, ছোরা বের করল আর তার গলায় আড়াআড়ি বসিয়ে দিল। এক বৃদ্ধ তার কানে ফিসফিসিয়ে বলল, ' বন্ধুত্বের সম্মান রক্ষায় সুন্দর রাস্তা বেছে নিলে! ' উত্তরে সে বলল, ' আমার বন্ধুর এই ফুঁপিয়ে কান্না সহ্য করতে পারিনি। '
এই দৃশ্য দেখে আমি ঘুরে চললাম। বহু কষ্টে পার্ক ও বাগানের পথে ঘুরে বেড়ালাম। মনে হল, আমি যেন কুফায় নেই, ভয় ও সন্ত্রাসের কোনও পোড়ো জমিতে পড়ে আছি।'
আতঙ্কপীড়িত এই পরিত্যক্ত ভূখণ্ডে ঘুরে বেড়ানোর সময় আমার সঙ্গে আবু তাহিরের দেখা হল। সে জাফর রাবাই আর হারুন - বিন - সোহেলের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিল। দিনের পর দিন আমরা চারজন ভয়াল সেই শহরে ঘুরে বেড়ালাম যেন আমরা মূক ও বধির। শেষত ধৈর্যের আবরণ খুলে ফেলে এক জায়গায় বসে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে ঠিক করলাম, কোনও না কোনওভাবে এই স্থান ত্যাগ করে আমাদের চলে যেতে হবে। এই প্রস্তাব শুনে জাফর রাবাই চেঁচিয়ে উঠে বলল, ' আমি কুফার সন্তান। কীভাবে এ মাটি ছেড়ে যাব? '
হারুন- বিন - সোহেল বলল, ' আমার জন্ম যদিও মদিনার মাটিতে, যারা আমাকে লালনপালন করেছে তাদের দিব্যি দিয়ে বলছি, এ মাটি ছেড়ে গেলে আমিও কান্নায় ভেঙে পড়ব কেননা আমার যৌবনের শ্রেষ্ঠ বছরগুলো এখানকার পথেঘাটে কাটিয়েছি। '
তারপর আমাদের মধ্যে বয়োবৃদ্ধ আবু তাহির আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ' মনসুর, এ ব্যাপারে তোমার কী বলার আছে? '
আমি বললাম, ' বন্ধুরা, পয়গম্বরের হাদিসের কথা স্মরণ করো : ' তোমার শহর যখন তোমার কাছে সংকীর্ণ আর ছোটো ঠেকবে, তখনই তাকে ছেড়ে চলে যাবে। '
এই কথাসব শুনে আমার তিন বন্ধুই আশ্বস্ত হল আর আমরা শহর ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।
শহর ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টা কত সহজেই আমরা ভেবেছিলাম আর সে কাজ কতই না কঠিন হয়ে দাঁড়াল।
দ্বারে দ্বারে প্রহরী। যারা ভিতরে ঢুকতে চাইছিল আর যারা চলে গিয়েছিল তাদের বাধা দিয়ে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছিল। বারকয়েক দুটো দ্বারে পৌঁছে সেখানকার সতর্ক নজরদার সান্ত্রি দেখে শান্তভাবে ফিরে আসতে হয়েছিল। ক্রমবর্ধমানভাবে কুফা আমাদের কাছে সংকীর্ণ ও অসহ্য হয়ে পড়ছিল, তা এতটাই ছোটো মনে হচ্ছিল যে তাকে একটা ইঁদুরধরা কলের মতো লাগছিল। এবং সেই ফাঁদে পড়ে ছটফটে নেংটি ইঁদুরের মতো আমরা এদিক ওদিক করতে লাগলাম কিন্তু পালাতে পারলাম না।
পালানোর কোনও উপায় না পেয়ে আমরা দারুণ হতাশ হয়ে পড়লাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হারুন- বিন - সোহেল বলল, ' আমাদের আম্মিরা যদি বন্ধ্যা হত আর আব্বাদের শুক্র নিষ্ফল হত যাতে করে আমাদের জন্মই হত না, তাহলে এমন কালো দিনও দেখতে হত না। '
জাফর রাবাই চেঁচিয়ে বলল, ' আমাদের লজ্জা পাওয়া উচিত যে আমরা আমাদের নিজেদের শহরেই স্বেচ্ছায় বন্দিদশা সহ্য করছি আর সেই শহরেরও লজ্জা পাওয়া উচিত যে সে তার সন্তানদের কাছে ধাইমার মতো আচরণ করছে। '
হতাশার চরম সীমায় পৌঁছে আমাদের ভয়টয় দূর হয়ে গেল। সর্বোপরি আমাদের হারানোরই বা কী ছিল? কোনওভাবে আমরা প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হয়ে যাত্রা শুরু করলাম। কীভাবে ঘটল, জানি না। হয় সান্ত্রিরা সাময়িকভাবে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল নয় কোনও এক মুহূর্তে তাদের চোখ এঁটে এসেছিল। যাই হয়ে থাকুক, আমরা এখন শহরের বাইরে মুক্তির শ্বাস নিচ্ছি।
সন্ধ্যার ছায়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে আর গরম বাতাস ঠান্ডা হয়ে আসছে।
' বন্ধুগণ! রাত্রি অন্ধকারময় আর এই চলাও দীর্ঘ।'
' কুফায় যে দিন দেখেছি, এই রাত কি তার চেয়েও বেশি অন্ধকারময়?'
এভাবেই সকলের মধ্যে যুক্তিতর্ক চলতে থাকল। কালি- কালো রাত্রির ভিতরে আমরা যাত্রা শুরু করতে রাজি হলাম।
' কিন্তু আমরা যাব কোথায়? '
প্রশ্নটা যেন অজান্তেই প্রত্যেককে আঁকড়ে ধরল। আমরা এমনি এমনই বেরিয়ে পড়েছি। কোথায় যেতে হবে সে ব্যাপারে আদৌ ভাবিনি।
ক্ষণিকের জন্য কী একটা ভেবে আবু তাহির বলল, ' কোথায় আবার, মদিনায়? '
আমি আর জাফর রাবাই এই প্রস্তাবে সহমত হলাম কিন্তু হারুন - বিন - সোহেল গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। তারপর নিচু স্বরে বলল, ' মদিনাও যদি কুফার মতো হয়ে যায় তখন কী হবে? '
সবাই রেগে গিয়ে তার দিকে তাকালাম। ' ওহে বন্ধু ', জাফর রাবাই বলল, ' সেই জমকালো শহর সম্পর্কে তুমি কীভাবে এ কথা বলো, বিশেষ করে যখন তুমি নিজে সেই মাটির সন্তান? '
হারুন - বিন - সোহেল নিজেকে সংযত করে বলল, ' বন্ধুগণ, নিঃসন্দেহে এ এক পবিত্র শহর। এর মাটি সুরভিত, এর পানি পবিত্র, কিন্তু যারা এখান থেকে এসেছে তাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তাদের কপালে চিন্তার বলিরেখা আমি দেখেছি। '
এ কথায় আমরা চুপ মেরে গেলাম। কেউই কোনও উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু হারুন - বিন - সোহেলের কথা তখনও শেষ হয়নি। সে চিন্তান্বিত হয়ে বলল, ' বন্ধুসকল, আমি এ নিয়ে যতই ভাবি ততই অবাক হই। যে সব শহর এক সময় সত্যের আলোতে প্রজ্জ্বলিত থাকত তা কী করে এত দ্রুত উলটো দিকে গড়িয়ে গেল! কীভাবে তাদের দিন সান্ত্বনার অতীত আর রাতগুলি অস্থির হয়ে উঠল! '
ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আবু তাহির বলল, ' ওহে অবাধ্য, সোহেলের অবিশ্বস্ত, অসাধু পুত্র, তোমার আম্মা তোমার জন্য কপাল চাপড়াক! তুমি কি ইসলামের সত্যতার সারাৎসারকে খণ্ডন করতে পারো?'
হারুন - বিন - সোহেল বলল, ' শ্রদ্ধেয় অগ্রজ, যেদিন থেকে আমি অনিচ্ছাকৃতভাবে আমার অগ্রজদের প্রজ্ঞায় সংশয় প্রকাশ করতে লেগেছি আর ইসলাম যে ধ্রুব সত্য তাকে খণ্ডন করেছি সেদিন থেকে আমি আশ্রয়ের সন্ধান করে চলেছি, কিন্তু কুফা...!'
আবারও রেগে গিয়ে আবু তাহির তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ' কুফার ব্যাপারে কী? তুমি কী বলতে চাইছ? '
আমি তো এটাই বলতে চেষ্টা করছি : কুফার বিষয়টি কী এবং কেন? যতই কুফাকে নিয়ে ভাবনা দূরে ঠেলতে চাইছি ততই তা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ওই পবিত্র শহরের চিন্তার মাঝে কুফার কথা এসে পড়ছে কেন? আর কেনই বা এত তাড়াতাড়ি তা ভেসে উঠছে? পয়গম্বর মহম্মদের হিজরার ঘটনা ( ৬২২ এ ডি'তে মক্কা থেকে মহম্মদের মদিনায় যাওয়ার দিন) তো খুব বেশি আগের নয়! '
আবু তাহিরের রাগ যে ক্রমশ চড়ছে তা বেশ বুঝতে পারলাম। নাক গলাতে মনস্থির করলাম। ' আমার প্রস্তাব হল যে আমরা সেই শহরের দিকে এগিয়ে যাব যাকে উচ্চের উচ্চতমজন শান্তির শহর বলেছেন। অত্যাচারীরা যদি এ জগৎকে গুঁড়িয়েও দেয় আর এ পৃথিবী দাঙ্গায় ছেয়ে যায় তবুও পবিত্র মক্কা শহরের সেই শান্তি ও অবিক্ষুব্ধ অবস্থা বিঘ্নিত হবে না। '
উপস্থিত সবাই আমার প্রস্তাবে সহমত হল আর আমরা উটের পিঠে তৎক্ষনাৎ চেপে বসলাম। ঘনঘোর অন্ধকার, কেননা তা ছিল অমাবস্যার প্রথম দিকের রাত্রি। কিন্তু আমাদের শপথ অনিবার্যভাবে আমাদের চালিত করল। চরম শিশিরভেজা রাত আর বাতাসের কামড় আমাদের হৃদয় আনন্দে ভরিয়ে তুলল। শান্তির শহরের ভাবনায় মগ্ন হয়ে, স্বাধীনতার মত্ত সুরায় মাতাল হয়ে আমরা উটের পিঠে এগিয়ে চললাম। সেই অবস্থায় তন্দ্রাঘোরে আমি কী সুন্দর স্বপ্ন দেখলাম!
পবিত্র, সন্ত অগ্রজদের মাঝে শান্তির শহরে বসে তাদেরকে কুফার অবস্থা সম্পর্কে বিবরণ দিচ্ছি যখন হঠাৎ যেন কারও কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। ' কিন্তু আমরা ফের সেখানে পৌঁছে গেছি। ' চমকে চোখ মেললাম। ভোর হয়ে এসেছে, সামনে কুফার দেওয়াল নজরে এল।
' আমরা আবার এখানে ফিরে এসেছি ', জাফর রাবাই বলে উঠল।
আবু তাহির আর হারুন - বিন - সোহেল পরিচিত দেওয়ালগুলোর দিকে তাকাল, তাদের চোখে বিস্ময় ও ভয়।
' কিন্তু তা কী করে সম্ভব? ' আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল। আবু তাহির এক মিনিট ভাবল। তারপর বলল, ' রাত যেন অস্বাভাবিকভাবে অন্ধকারময়। কোন দিকে যাচ্ছি সেদিকে মনোযোগ দিলাম না। যে পথ দিয়ে পালাচ্ছিলাম সেই একই পথে ফিরে এসেছি। '
আমরা সব চুপ মেরে গেলাম।
' এখন আমরা কী করব? ' জাফর রাবাই জানতে চাইল।
পুনরায় একবার আবু তাহির সযত্নে তার কথাগুলো মেপে নিল, তারপর বলল, ' পিছনে ফেরা অসম্ভব, সান্ত্রিরা আমাদের চিনে ফেলেছে। হয়তো প্রকৃতি চাইছে না আমরা এই স্থান ছেড়ে যাই। '
দীর্ঘ কাঁপা কাঁপা শ্বাস টেনে হারুন - বিন - সোহেল বলল, ' তুমি ঠিক বলেছ। কুফা আমাদের নিয়তি। '
আর আমি, মনসুর বিন নোমান আল - হাদিদি দুঃখিতচিত্তে বললাম, ' ঠিকই বলেছ, মক্কা আমাদের স্বপ্ন ; কুফা নিয়তি। '
আমরা উটের পিঠে চেপে কুফায় ফিরে এলাম, ক্লান্ত ও পরাস্ত।
-----------
লেখক পরিচিতি:
প্রখ্যাত
পাকিস্তানি সাংবাদিক, ছোট গল্প লেখক এবং ঔপন্যাসিক ইন্তিজার হুসেইন উর্দু
সাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী গল্পকারদের একজন। জন্মে ছিলেন ব্রিটিশ-ভারতের
বুলান্দশহরের দিবাইতে। ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর পাকিস্তানের লাহোর-এ চলে যান।
লিখেছেন ‘বস্তি’, ‘নয়া ঘর’ এবং ‘আগে সমুন্দর হ্যায়’ নামের তিনটি উপন্যাস।
‘লীভ্স’, ‘দি সেভেন্থ ডোর’. ‘এ ক্রনিকল অফ দি পীককস’ এবং ‘অ্যান আনরিটন
এপিক’ তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গল্প সংকলন। তাঁর লেখায় দেশভাগ পূর্ব জীবনের
স্মৃতি যেমন ঘুরে ফিরে এসেছে তেমনি ধরা রয়েছে তাঁর জীবন-পাঠ যা একই সাথে
সমকালীন এবং কালোত্তীর্ণ।
নিজের
দেশে নানা সম্মানে ভূষিত ইন্তিজার হুসেইনকে ২০০৭ সালে ভারতীয় সাহিত্য
আকাদেমি প্রেমচাঁদ ফেলোশিপে সম্মানিত করে। ২০১৩-তে ‘বস্তি’ উপন্যাসটি
ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার পর তাঁর নাম ‘ম্যান বুকার’ পুরস্কারের মনোনয়নের জন্য
সর্বোচ্চ বিবেচিত নামের তালিকায় সংযুক্ত হয়। ২০১৪-তে পান ফরাসী সরকার-এর
‘অর্ডে ডেস আর্টস এট ডেস লেটার্স ‘-এর সম্মান।বিপ্লব বিশ্বাস
গল্পকার। প্রাবন্ধিক। অনুবাদক
কলকাতায় থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ