এলিস মুনরোর গল্প : কণ্ঠস্বর

অনুবাদ : আল মনসুর

আমার মায়ের উঠতি বয়সের সময় মা ও তাঁর পরিবারের সবাই মিলে নাচের অনুষ্ঠানে যেতেন। নাচের অনুষ্ঠানগুলো হতো স্কুলঘরে কিংবা সামনে বড় রুম আছে, এমন কোনো খামারবাড়িতে। ছেলে-বুড়ো সবাই অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। তাঁদের মধ্যে কেউ একজন পিয়ানো বাজাতেন। পিয়ানোটা কারো বাড়ি থেকে আনা হতো কিংবা স্কুলের পিয়ানোই বাজানো হতো। অন্য কেউ হয়তো বেহালা নিয়ে আসতেন। গোলাকার নৃত্যের প্যাটার্ন বা পদক্ষেপ ছিল বেশ জটিল। উপস্থিত লোকদের মধ্যে কেউ হয়তো বিশেষ কোনো গুণের কারণে সবার কাছে পরিচিত থাকতেন; তিনি গলা ফাটিয়ে নাচের আহ্বান জানাতেন।
সাধারণত কোনো পুরুষ মানুষ এ কাজটা করতেন। আর অদ্ভুত বেপরোয়া তাড়াহুড়ো পড়ে যেত অন্যদের মধ্যে। অবশ্য আগে থেকে নাচ না জেনে থাকলে তার জন্য তাড়াহুড়োর কিছু ছিল না। যারা অংশগ্রহণ করত, তাদের সবার বয়স ১০-১২ বছর হলেও নাচ তারা ইতিমধ্যে শিখে ফেলেছে। আমার মায়ের তখন আমরা তিনজন সন্তান। পল্লী গ্রামের দিকে বসবাস থাকলে এ নাচে অংশ নেওয়ার মতো বয়স ও মানসিকতা- দুটোই তাঁর থেকে থাকত। তাঁর বয়সীরা গ্রামের দিকে তখনো নাচ চালিয়ে যেত। জোড়া জোড়ায় অংশ নেওয়া গোলাকার নাচও তিনি উপভোগ করে থাকতে পারতেন। এ নাচটা তখন আগের পুরনো নাচের জায়গা কিছুটা দখল করা শুরু করেছে সবেমাত্র। কিন্তু আমার মায়ের অবস্থান কোনো দিকেই যেন মেলেনি। আমরা ছিলাম, মানে আমাদের পরিবার ছিল শহরের বাইরে। কিন্তু একেবারে গ্রামের ভেতরেও না।

অন্যদের কাছে আমার মায়ের চেয়ে বাবার গ্রহণযোগ্যতাই বেশি ছিল। যেকোনো বিষয়ে কেউ কিছু বললে বাবা সহজে বিশ্বাস করতেন। অন্যদিকে মা সে রকমটা করতেন না। খামারি মেয়ের জীবনের স্তর থেকে স্কুলশিক্ষক হওয়ার পর্যায়ে উঠে আসার জন্য চেষ্টা করেছেন মা। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়; যে পর্যায়ে উঠে আসতে চেয়েছিলেন, সে পর্যায় পর্যন্ত আসতে পারেননি। কিংবা শহরে যে পর্যায়ের বন্ধু পাবেন বলে আশা করেছিলেন, সে রকম পাননি। তাঁর বসবাস ছিল ভুল জায়গায় এবং নিজের পর্যাপ্ত টাকা-পয়সা ছিল না হাতে। তবে কোনো দিক থেকেই তাঁর কাঙ্ক্ষিত স্তরে পৌঁছানোর সহায়ক হাতিয়ারও ছিল না। মা ইওকার খেলতে পারতেন, কিন্তু ব্রিজ খেলতে পারতেন না। কোনো মহিলাকে ধূমপান করতে দেখলেই তাকে সরাসরি তিরস্কার করা শুরু করতেন মা। তিনি ছিলেন বাড়াবাড়ি রকমের প্রকাশ্যভাবে নিয়মনিষ্ঠ। তাঁর কথাবার্তায় কিছু মুদ্রাদোষও ছিল। যেমন- 'সাথে সাথে', 'আসলেই সে রকম' ইত্যাদি। তাঁর আচার-আচরণে মনে হতো তিনি এমন এক অদ্ভুত পরিবারে বড় হয়েছেন, যেখানে এ রকম নিয়ম কিংবা আচরণের বাস্তব ব্যবহার ছিল। আসলে তাঁর সে রকম কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না কিংবা তাঁদের পরিবারে সে রকম কোনো প্রচলনই ছিল না। বাড়ির বাইরে খামারে আমার খালা-মামারা কথা বলতেন তাঁদের সামাজিক স্তরের অন্য সবাই যেভাবে বলে সে রকম স্বাভাবিকভাবেই। তাঁরা আমার মাকে খুব বেশি পছন্দও করতেন না।

তার মানে আমি অবশ্য বলতে চাচ্ছি না, চারপাশের সব কিছুকে বদলে দেওয়ার জন্যই মা তাঁর সবটুকু সময় ব্যয় করতেন। অন্য মহিলাদের মতো তাঁরও রান্নাঘরের টবে সব কিছু ডুবিয়ে রাখার ব্যবস্থা ছিল; বহমান পানির ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি গ্রীষ্মের একটা বড় সময় শীতের খাবার তৈরি করে রাখতে ব্যয় হতো। এসবসহ তিনি ব্যস্ততার মধ্যেই সময় পার করতেন। ব্যস্ততার কারণে তিনি আমাকে নিয়ে ইচ্ছেমতো হতাশ হতেও পারতেন না। আমাকে নিয়ে হতাশ হওয়ার কারণ দু-একটা ছিল না। মা ভেবে কূল পেতেন না, শহরের স্কুল থেকে কী করে আমি উপযুক্ত পর্যায়ের বন্ধুবান্ধব বাড়িতে নিয়ে আসিনি কিংবা আদৌ কোনো বন্ধু আনতেই বা পারিনি কেন। কিংবা আমি কী কারণে রবিবারের আবৃত্তির ক্লাস এড়িয়ে চলছি- সেটাও মা ভেবে পেতেন না। আগে তো আমার কাছে এ ক্লাসগুলো ছিল খুব লোভনীয়। বাড়ি ফেরার সময় কেনই বা আমার চুলের কুঞ্চনগুলো খুলে ফেলেছি। মা এভাবে চুল বেঁধে দিতেন আর আমি স্কুলে পৌঁছানোর আগেই খুলে ফেলতাম। কাজটা অবশ্যই গর্হিত। খুলে ফেলার কারণ হচ্ছে, তখন স্কুলে ও রকম করে কেউই চুল বাঁধত না। কিংবা আমার উদার উর্বর স্মৃতিশক্তিকে একেবারে ফাঁকা করে ফেলা শিখলাম কী করে, সেটাও মা বুঝতে পারতেন না। কেননা এক সময় তো আমার কবিতা আবৃত্তির ক্ষমতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আমি অবশ্য এ রকম কোনো কিছু দিয়ে লোকদেখানো প্রচার পাওয়ার বিষয়টাকেই প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছি।

তবে আমি সব সময় মুখ গোমড়া করে থাকি তা নয়; সব সময় বিবাদে জড়িয়ে পড়ি, তা-ও নয়। এখন আর সে রকম নই মোটেও। আমার ১০ বছর বয়সে মায়ের ইচ্ছামতোই পোশাক-আশাক পরার জন্য ও মায়ের সঙ্গে নাচের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য যেন ব্যাকুল হয়ে থেকেছি।

নাচের অনুষ্ঠানগুলো হতো মোটামুটি ভদ্রগোছের চেহারাঅলা বাড়িগুলোর কোনোটায়। বাড়িগুলোর অবশ্য খুব যে চাকচিক্য আর জৌলুশ ছিল তা নয়। একটা কাঠের বাড়ির কথা মনে আছে। সেখানে যারা থাকত, তাদের কারো সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতাম না। শুধু জানতাম বাড়ির কর্তা লোকটা একটা ভাঙারির কারখানায় কাজ করত। তার বয়স অবশ্য আমার দাদা হওয়ার মতো। এত বয়স হয়ে যাওয়ার পরও লোকটা কারখানার কাজ ছাড়েনি। কারণ যখন আর টাকা-পয়সা রোজগার করা যাবে না, তখনকার জন্য কিছু জমা করে রাখতে চেয়েছে। মহামন্দার সেই মাঝামাঝি সময়ে বার্ধক্যের ভাতা নেওয়ার জন্য হাজিরা দেওয়া একটা কলঙ্কের ব্যাপার ছিল। মহামন্দা কথাটা অবশ্য কী জিনিস আমি পরে শিখেছি। বড় হয়ে যাওয়া সন্তানদের নিজেদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের কী গুণ আছে, না আছে- সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা ছিল, তাদের জন্য কলঙ্কের ব্যাপার ছিল পরিবারের কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বার্ধক্যের ভাতা নিলে।
কিছু প্রশ্ন এখন মনে ভেসে ওঠে। সেগুলো তখন বুঝতে পারিনি।

যে বাড়িতে নাচের আয়োজন করা হতো, সে বাড়ির লোকেরা কি শুধু উৎসব করার খাতিরে নাচের আয়োজন করত? তারা কি নিজেদের বাড়িতে নাচের আয়োজনের বিনিময়ে টাকা-পয়সা নিত? বাড়ির কর্তার চাকরি থাকলেও তাদের তো অনেক সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার কথা। আমি জানতাম, চিকিৎসকের খরচ খুব বেশি ছিল। কোনো পরিবারের ওপরে কী রকম ভয়াবহ চাপ ফেলত সেই খরচ। আমার ছোট বোন খুব হালকা-পলকা ছিল। আশপাশের লোকেরা এ রকমই বলত ওর শরীর-স্বাস্থ্য প্রসঙ্গে। তার টনসিল ইতিমধ্যে ফেলে দিতে হয়েছে। আমার ভাইয়ের আর আমার অনন্য ধরনের কাশি হতো প্রতি শীতেই। তার ফলে ডাক্তারের কাছে যেতেই হতো। আর ডাক্তারের কাছে যাওয়া মানেই তো টাকা।

আরেকটা প্রশ্ন হলো, আমার মায়ের সঙ্গে বাবার বদলে আমাকে কেন যেতে হতো। তবে এই প্রশ্নটা আমাকে তেমন বিমূঢ় করে না। আমার মা নাচ পছন্দ করতেন। বাবা হয়তো নাচ পছন্দ করতেন না। তা ছাড়া বাড়িতে আরো ছোট দুজন ছেলেমেয়ে ছিল। তাদেরও দেখাশোনার জন্য একজন দরকার ছিল। আর আমি ওদের দেখাশোনা করার মতো যথেষ্ট বড় ছিলাম না তখন। আমার মা-বাবা বাচ্চাদের দেখাশোনা করার মতো কোনো লোক রাখছেন, তেমনও তো মনে পড়ে না। আর সেসব দিনে বেবি সিটার কথাটা আদৌ প্রচলিত ছিল কি না, তাও তো জানি না। আমার কৈশোরবেলায় দেখেছি এ রকম কর্মসংস্থানের কথা। তবে দিন বদলে গেছে অনেক। সঙ্গে আরো কত কি বদলেছে!
আমরা যথারীতি নাচের পোশাক পরেই যেতাম। ওসব চনমনে গোলাকার নাচের জন্য আলাদা পোশাক পরে যেতে হতো। পরবর্তী সময়ে টেলিভিশনে তেমন কোনো পোশাক দেখা যেত না। নাচের জন্য সবাই যার যার সাধ্যমতো ভালো পোশাক পরে আসত। যদি কেউ তেমন পোশাক পরে না আসত, মানে যদি ঝালরঅলা কোনো পোশাক কিংবা ঘাড় ঢাকার জন্য বড় রুমাল জাতীয় কোনো পোশাক, গাঁয়ের লোকদের সচরাচর যেসব পোশাকে দেখা যায়, সেগুলো পরিধান করে আসত, তাহলে আয়োজনকারী ও উপস্থিত সবার জন্যই সেটা অপমানজনক হতো। শীতের সময়ের পশম থেকে আমার মা আমার জন্য একটা পোশাক তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেটা পরে আমি নাচের অনুষ্ঠানে যেতাম। স্কার্টটা ছিল গোলাপি আর ওপরের অংশ ছিল হলুদ। পরবর্তী সময়ে যেখানে আমার বাম স্তন উঠেছে সেখানে একটা হৃদয় বুনে দেওয়া হয়েছিল গোলাপি রঙের পশম দিয়ে। আমার চুল চিরুনি করে তেল দিয়ে আর্দ্র করে সসিজের মতো বড় বড় গোলাকার করে বেঁধে দেওয়া হতো। এ রকম করে বেঁধে দেওয়া হতো আমার স্কুলে যাওয়ার সময়ও। পথে বের হয়েই এই ঝামেলা খুলে ফেলতাম। নাচের অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় মাকে অনুযোগ করে বলতাম, এ রকম করে আর কেউ তো চুল বাঁধে না। আমাকে কেন বাঁধতে হবে? মা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়ে দিতেন, আমার মতো সৌভাগ্য নাকি আর কারো নেই। তবে আমি নালিশ খুব জোরালো করে তুলতাম না; কারণ আমি সৌভাগ্যের হাত ধরে অনেক দূর যেতে চাইতাম। কিংবা হতে পারে সম্ভবত আমার মনে হয়ে থাকতে পারে আমার স্কুলের কেউ ওই নাচের অনুষ্ঠানে আসবে না। সুতরাং আমার সংকোচের কিছু নেই। স্কুলের সহপাঠীদের ঠাট্টা-তামাশা আমার ভয়ের কারণ ছিল।

আমার মায়ের পোশাক বাড়িতে তৈরি ছিল না। সেটাই ছিল মায়ের সবচেয়ে চটকদার পোশাক এবং ভালো পোশাকও অবশ্যই। অতিমাত্রায় রুচিবাগীশ হওয়ার কারণে সে পোশাকটা পরে গির্জায় যাওয়া যেত না। পোশাকটার চেহারা অতিমাত্রায় উৎসব-উৎসব ভাব ফুটে ওঠার কারণে দাফন অনুষ্ঠানেও যাওয়া যেত না সেটা পরে। সে জন্য সে পোশাকটা খুব একটা পরা হতো না। কালো মখমলের তৈরি পোশাকটার হাতা ছিল কনুই পর্যন্ত লম্বা; ঘাড়ের ওপরে কলারের মতো একটা উঁচু লাইন খাড়া করা ছিল। সেটার সবচেয়ে মজার বৈশিষ্ট্য হলো, নানা বর্ণের ছোট ছোট গুটিদানা ছড়ানো ছিল সবখানে। সোনালি, রুপালি সব রঙের দানাগুলো ছড়িয়ে দেওয়া ছিল কাঁচুলির ওপরে। মা নড়াচড়া করলে কিংবা শুধু নিঃশ্বাস ফেললেও রঙের বদল খেলা চলত পোশাকটার ওপরে। তার বেশির ভাগ চুল তখন কালো ছিল। চুল বিনুনি করে ফুলের মালার সঙ্গে জড়িয়ে একেবারে মাথার ওপরে শক্ত করে বেঁধে রাখা হতো। তিনি আমার মা না হয়ে অন্য কেউ হলে তাকে রোমাঞ্চকর রকমের সুদর্শনা বলতে পারতাম। আমার তো এখনো সে রকমই মনে হয়। তবে অদ্ভুত সেই বাড়িতে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে দেখতাম যদিও অন্যরা তাদের সবচেয়ে ভালো পোশাকটাই পরে এসেছে, তবু আমার মায়ের পোশাকটা আর কারো পোশাকের মতো নয়।

অন্য যে মহিলাদের কথা বলছি, তারা থাকত রান্নাঘরে। সেখানে গিয়েই আমরা থামতাম এবং দেখতাম বড় একটা টেবিলে বিভিন্ন জিনিস সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সব ধরনের চাটনি, কুকিজ, পিঠা ইত্যাদি দেখা যেত। আমার মা সেখানে তাঁর নিজের তৈরি কোনো শখের জিনিস রেখে অন্যান্য জিনিস কিভাবে রাখলে আরো সুন্দর দেখাতে পারে, তা নিয়ে হৈচৈ শুরু করে দিতেন। সব কিছু কেমন জিভে জল আনার মতো চেহারা পেয়েছে বলে মন্তব্য করতেন।
মা কি সত্যি জিভে জল আনার কথাটাই বলতেন নাকি? আমি নিশ্চিত নই। যা-ই বলে থাকুন না কেন, শুনতে খুব ভালো লাগেনি, সেটা নিশ্চিত। আমার তখন ইচ্ছে করত সেখানে যেন বাবা এসে হাজির হন। সে রকম অনুষ্ঠানের কোনো মুহূর্তের জন্য বাবা সব সময়ই নিখুঁত কথাটাই বলতেন। এমনকি ব্যাকরণগতভাবে কথা বললেও বাবার কথা ঠিক মানিয়ে যেত যেকোনো মুহূর্তের সঙ্গেই। বাবা সেভাবে কথা বলতেন আমাদের বাড়িতে। তবে বাড়ির বাইরে ততটা তাৎক্ষণিকভাবে বলতেন না। অন্যদের আলোচনার মধ্যে অবলীলায় ঢুকে পড়তে পারতেন বাবা। তিনি ভালো করেই জানতেন, চলমান আলাপের মধ্যে বিশেষ কোনো মন্তব্য না করলেই হয়। আমার মা ছিলেন বাবার একেবারে বিপরীত। তাঁর মতে সব কিছু নির্দিষ্টভাবেই পরিষ্কার ও দৃষ্টি আকর্ষণ করছে নিজস্বতায়।



এ রকমই একটা মুহূর্ত চলছিল সেদিন এবং আমি মায়ের হাসি শুনতে পেলাম। হাসি শুনে মনে হওয়ার কোনো কারণ ছিল না তিনি অন্য কারো কথা বলার মধ্যে নিজে ঢুকে পড়েছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কোট কোথায় রাখব?

অবস্থা দেখে মনে হলো, আমরা যেখানে খুশি রাখতে পারি আমাদের কোট। তবু কেউ একজন জানাল, ইচ্ছে করলে আমরা দোতলায় শোবার ঘরের বিছানার ওপরে ফেলে রাখতে পারি। দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ি দেয়াল দিয়ে প্রায় বন্ধ করে দেওয়া এবং সেখানে কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই। শুধু একদম ওপরে আছে। মা আমাকে ওপরে যেতে বললেন; তিনি এক মিনিট পরে আসছেন। আমি মার কথামতো ওপরে উঠে গেলাম।

এখানে আরেকটা প্রশ্ন আসতে পারে; নাচের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য কি কোনো রকম টাকা-পয়সা প্রদানের ব্যাপার ছিল? ওসব অনুষ্ঠান আয়োজনের পেছনে আমার মায়ের হাতও থেকে থাকতে পারে। অন্যদিকে টাকা-পয়সা দানের পরও সবাইকে কি হালকা খানাপিনা আনার কথা বলা হতো? আমার এখন যে রকম স্মরণে আসে, খানাপিনা কি সে রকমই উদারভাবে আনত সবাই? সবাই তো খুব গরিব ছিল। অবশ্য এ রকমও হতে পারে, যুদ্ধের সময়ের কাজকর্ম ও টাকা-পয়সা যেগুলো সৈনিকরা বাড়িতে পাঠাত, সেগুলোর কারণে তারা আর নিজেদের অতটা গরিব মনে করেনি তখন। আমার তো মনে হয়, আমার বয়স ১০ বছরই ছিল তখন। যদি ঠিক ঠিক ১০ বছরই হয়ে থাকে, তাহলে তাদের অবস্থার ওসব পরিবর্তন ইতিমধ্যে ঘটে চলেছে প্রায় দুই বছর।

সিঁড়ি একটা এসেছে রান্নাঘর থেকে, আরেকটা এসেছে বাইরের রুম থেকে। দুদিক থেকে এসে মিশেছে একটা ধাপে, যেটা শেষ হয়েছে শোবার ঘরে। ফিটফাট করে সাজানো সামনের শোবার ঘরে আমার কোট আর জুতো থেকে মুক্তি লাভ করার পরও শুনতে পেলাম আমার মায়ের কণ্ঠ ঝনঝন করে বেজে চলেছে রান্নাঘরে। তবে সামনের রুম থেকে গানবাজনার সুরও শুনতে পেলাম আমি। সুতরাং নেমে সেদিকেই পা বাড়ালাম। পিয়ানো ছাড়া রুমের ভেতর থেকে সব কিছু বের করে দিয়ে পরিষ্কার পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে। ঘন সবুজ রঙের কাপড় টানিয়ে দেওয়া হয়েছে জানালার ওপরে। দেখে আমার বরং নিরানন্দই মনে হলো। তবে রুমের ভেতরে আসলে বিষণ্নতার ছোঁয়া পর্যন্ত নেই। অনেকেই সেখানে নাচছে। শোভন ভঙ্গিতে একজন আরেকজনকে ধরে আছে, পাশ বদল করছে কিংবা সুনির্দিষ্ট চক্রে এদিক-ওদিক দোল খাচ্ছে। এক জোড়া মেয়ে, মনে হয় এখনো স্কুলে পড়ে, তারা নাচছে। তাদের বিচিত্র ভঙ্গির নাচের দিকে সবার দৃষ্টি। তারা একজন আরেকজনের বিপরীত দিকে ঘুরছে। একবার হাত ধরছে; আরেকবার ছেড়ে দিচ্ছে। তারা আমাকে দেখে স্বাগত জানানোর মতো করে হাসল। খুশিতে আমি যেন গলে গেলাম। আমার চেয়ে বয়সে বড় বিশ্বস্ত কোনো মেয়ে আমার দিকে একটু বিশেষ নজর দিলে সব সময়ই আমি এ রকম গলে যেতাম।

রুমের মধ্যে একজন মহিলাকে দেখলাম। তাঁর দিকে দৃষ্টি না দিয়ে উপায় নেই এমন রূপ-চেহারা তার। তাঁর পোশাকের কাছে আমার মায়ের পোশাক যেন মলিন আর আবছা হয়ে যায়। মহিলার বয়স অবশ্যই আমার মায়ের চেয়ে বেশিই হবে। তাঁর চুল সাদা, অভিজাত ছোঁয়ায় মসৃণ পরিপাটি করে বাঁধা। এ রকম শৈলীকে তখনকার দিনে বলা হতো মারসেলড তরঙ্গ। মহিলার শরীরটা বেশ বড়সড়: উঁচু কাঁধ, চওড়া নিতম্ব। তাঁর পরনে সোনালি কমলা রঙের পাতলা রেয়নের কাপড়ের তৈরি পোশাক। পোশাকটার গলা গোলাকার এবং নিচু করে কাটা। তাঁর স্কার্ট শুধু হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে আছে। জামার ছোট হাতা তাঁর বাহুর ওপরে চেপে বসে আছে; বাহুর মাংস বেশ ভারী, মসৃণ আর শুয়োরের চর্বির মতো সাদা।

তাঁর চেহারা আসলেই চমকে দেওয়ার মতো ছিল। আমি কখনো ভাবিনি কারো চেহারায় একই সময়ে বার্ধক্য আর মসৃণতা থাকতে পারে; ভারী শরীরও সুন্দর হতে পারে, পিতলের মতো তীক্ষ্ন ও শক্তিমত্তার মিশেলে গম্ভীর হতে পারে। তাঁকে আসলেই পিতলের মতো তীক্ষ্ন বলা যেতে পারে। আমার মা পরবর্তী সময়ে তাঁর চেহারার কথা বলতে গেলে এ কথাটাই বলতেন। তাঁর কথাবার্তার ধরনই এ রকম ছিল। মহিলার চেহারার বর্ণনায় অন্য কোনো রুচিবান মানুষ হলে বলতেন দৃষ্টিনন্দন। তাঁর পোশাকের সার্বিক শৈলী ও রং ব্যতীত আর কোথাও কোনো রকমের লোকদেখানোর চেষ্টা ছিল না। মহিলা তাঁর সঙ্গের লোকটার সঙ্গে নাচছিলেন। তাঁদের নাচের ভঙ্গিতে সমীহ জাগানোর মতো ও আরেকটু বেশি মাত্রায় অন্যমনস্ক ভাব লক্ষ করার মতো ছিল। যে রকম সচরাচর দেখা যায় স্বামী-স্ত্রীর নাচে।

আমি মহিলার নাম জানতাম না। আগে কখনো তাঁকে দেখিনি। আমি তখনো জানতাম না আমাদের শহরজুড়ে তাঁর কুখ্যাতি আছে। হতে পারে আমাদের শহরের বাইরেও সেটা ছড়িয়ে পড়েছিল, পরে সে রকমই জেনেছি।

আমার মনে হয়, যদি স্মৃতি থেকে সত্যি ঘটনা না লিখে কল্পিত কাহিনী লিখতাম, তাহলে তাঁর পরনে এত চটকদার একটা পোশাক দিতাম না। এ ধরনের বিজ্ঞাপনের দরকার ছিল না তাঁর।

অবশ্য শুধু প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া-আসা ছাড়া আমি শহরে বাস করেছিও। আমি হয়তো জেনেছিলামও যে তিনি একজন বিশিষ্ট বেশ্যা। আমি তাঁকে নিশ্চয় দেখেও থাকতে পারি, তবে ওই গোলাপি পোশাকে নয়। তাঁকে দেখে থাকলেও তাঁর পরিচিতি হিসেবে বেশ্যা কথাটা ব্যবহার করিনি। সম্ভবত খারাপ মহিলা বলে উল্লেখ করে থাকতে পারি। আমি হয়তো জেনে থাকতে পারি যে তাঁর মধ্যে বিরক্তিকর, বিপজ্জনক, উত্তেজনাকর ও সাহসী কিছু বিষয় ছিল। আমি অবশ্য তখন জানতাম না, ওসব বৈশিষ্ট্য কী কী বোঝায়। তাঁর সম্পর্কে এ রকম কথা কেউ বলার চেষ্টা করে থাকলেও আমি মনে হয় বিশ্বাস করতাম না।

শহরে বেশ কিছু মানুষকে আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হতো। ওই মহিলাও হয়তো সে রকম কেউ হবেন ভেবেছিলাম। এ রকম আরেকজন লোক ছিল; পিঠ কুঁজো লোকটা প্রতিদিন টাউন হলের দরজা পরিষ্কার করত। আমি যত দূর জানতাম, এ ছাড়া আর কোনো কাজ ছিল না তার। আরেক মহিলাকে দেখতাম চেহারায় স্বাভাবিক। কিন্তু একা একা জোরে জোরে বিরামহীন কথা বলে যেত; চোখের সামনে নেই এ রকম কাউকে যেন বকাবকি করে যেত সমানে।

সময়ের আবর্তে আমি নাচের আসরের ওই মহিলার নাম জেনেছি এবং যেসব কাজ তিনি করতে পারেন না বলে বিশ্বাস ছিল আগে, সে বিশ্বাসও অবিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। নাচের আসরে তাঁর সঙ্গে যে লোকটাকে নাচতে দেখেছিলাম, সে ছিল একটা জুয়াখানার মালিক। তার নাম অবশ্য কোনো দিন জানা হয়নি আর। হাইস্কুলে থাকাকালে একদিন অন্য দুটো মেয়ের সঙ্গে আমি জুয়াখানার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। ওরা দুজন আমাকে সাহস দিয়ে ভেতরে পাঠিয়েছিল। ভেতরে গিয়ে বুঝতে পারলাম নাচের অনুষ্ঠানের সেই লোকটাই। তত দিনে তার মাথার টাকটা আরেকটু প্রশস্ত হয়েছে; শরীর আরেকটু ভারী হয়েছে। পরনের পোশাক সেদিনের পোশাকের চেয়ে বেশ মলিন। মনে পড়ে না লোকটা আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিল কি না। অবশ্য জিজ্ঞেস করার তেমন দরকারও ছিল না তার। আমি দৌড়ে বাইরে চলে এসেছিলাম। আমার সঙ্গের মেয়ে দুজনের সামনে ফিরে আসার পরে আমি কিছুই বলিনি ওদের। ওরা অবশ্য আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিল না।

লোকটাকে জুয়াখানায় দেখার পর নাচের অনুষ্ঠানের সব কিছু মনে পড়ে গেল: পিয়ানোর শব্দ, বাঁশির সুর আর হলুদ রঙের পোশাক। তত দিনে আমার কাছে ওই পোশাকটা হাস্যকর রূপে পতিত হয়ে গেছে।

সেদিন আমার মায়ের কোট পরা অবস্থায়ই হঠাৎ আবির্ভাব ঘটেছিল। মনে হয় গা থেকে কোটটা আদৌ খোলেননি মা।

বাজনা-বাদ্যের মধ্যেই মা আমার নাম ধরে জোরে জোরে ডাকছিলেন। মায়ের ওই রকম কণ্ঠটা আমার মোটেও পছন্দ ছিল না। তাঁর কণ্ঠেই বোঝা যাচ্ছিল, আমি এ জগতে আছি কি না মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দিতে হবে।

মা জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কোট কোথায়? যেন আমি কোনো ভুল জায়গায় রেখেছি!

আমি বললাম, ওপরের তলায়।

ঠিক আছে, যাও, নিয়ে এসো।

মা ওপরের তলায় গেলে নিশ্চয় আমার কোট দেখে থাকতেন। সম্ভবত আদৌ যাননি। মা মনে হয় রান্নাঘরের ওখান থেকে দোতলায় আদৌ ওঠেননি। কোটের বোতাম পর্যন্ত না খুলেই ওখানকার টেবিলের খাবার নিয়ে হৈচৈ মার্কা মন্তব্য করে যাচ্ছিলেন। তখন শেষে মা নাচের রুমের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন নাচ চলছে। তখনই তিনি কমলা রঙের পোশাক পরা মহিলাকে দেখতে পেয়েছিলেন।

মা বললেন, দেরি করো না।

আমিও দেরি করতে চাইনি। সিঁড়ির দিকে যাওয়ার দরজা খুলে দৌড়ে সিঁড়ির প্রথম ধাপ পর্যন্ত চলে গেলাম। দেখলাম যেখান থেকে সিঁড়ির ধাপগুলো ওপরের দিকে উঠে গেছে সেখানে কয়েকজন লোক বসে আসে। আমার ওপরে উঠার পথ আটকানো। তারা আমার আসা দেখতে পায়নি। মনে হলো, তারা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপে মগ্ন হয়ে আছে। কোনো রকম যুক্তিতর্ক নয়, তবে জরুরি কোনো বিষয়ে যেন মতামত লেনদেন হচ্ছে।

তাদের মধ্যে দুজন পুরুষ। বয়স অল্প। পরনে বিমানবাহিনীর পোশাক। একজন বসে আছে একটা সিঁড়ির ওপরে। আরেকজন সামনের নিচের সিঁড়ির ওপরে ঝুঁকে আছে। তার এক হাত হাঁটুর ওপরে। তাদের ওপরের সিঁড়িতে বসে আছে একটা মেয়ে। তার কাছের লোকটা মেয়েটার পায়ে হাত দিয়ে মৃদু চপেটাঘাত করে যাচ্ছে, যেন তাকে আরাম দেওয়া হচ্ছে। আমার মনে হলো, মেয়েটা চাপা সিঁড়ির ওপরে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে। কারণ সে কাঁদছে। পেগি, মেয়েটার নাম পেগি। লোক দুটো সনির্বন্ধ অথচ কোমল কণ্ঠে 'পেগি পেগি' বলে ডেকে যাচ্ছে।

মেয়েটা কী যেন বলল। আমি বুঝতে পারলাম না। বাচ্চাদের মতো আহ্লাদি কণ্ঠে কথা বলে যাচ্ছিল সে। বাচ্চারা যেমন কোনো বিষয়ে নালিশ জানানোর সময় বারবার বলে যায় অমুকতমুক কাজ ঠিক হয়নি। তারা বারবার এ রকম করে বলে বোঝাতে চায় অন্যায় কাজটাকে ন্যায় বলে চালোনো হচ্ছে। তাদের কণ্ঠে থাকে হতাশার সুর। এ রকম পরিস্থিতিতে ইতর কথাটা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কাজটা কত নীচ; লোকটা কত ইতর ইত্যাদি।

বাড়িতে ফেরার পরে বাবার সঙ্গে মায়ের কথা শুনে যা ঘটেছিল তার খানিকটা জানতে পারি। কিন্তু তখন সরাসরি অবগত হওয়ার মতো ক্ষমতা আমার ছিল না। মিসেস হাচিসন জুয়াখানার মালিক লোকটার তাড়া খেয়ে নাচের আসরে চলে এসেছিল। লোকটাকে তখন আমি জুয়াখানার মালিক পরিচয়ে চিনতাম না। আমার মা লোকটার কী নাম উল্লেখ করেছিলেন, তাও আর আজ মনে নেই। তবে অনুষ্ঠানের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং পোর্ট আলবেয়ার থেকে কয়েকজন ছেলে- মানে বিমানবাহিনীর ওই জওয়ানরা- সিদ্ধান্ত নেয়, তারা নাচের আসরে এসে হাজির হবে। অবশ্য তাদের সিদ্ধান্ত ঠিকই ছিল। নাচের আসরে তাদের উপস্থিতি কোনো ঝামেলা পাকায়নি। মিসেস হাচিসন ও ওই মেয়েটাই অনুষ্ঠানের লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

মিসেস হাচিসন তার অধীনস্থ মেয়েদের একজনকে নিয়ে এসেছিল। বাবা বললেন, হতে পারে শুধু বেড়ানোর উদ্দেশ্যেই বের হয়েছিল। কিংবা হতে পারে নাচ তাদের শখ ছিল।

আমার মা যেন বাবার কথা শুনতেই পেলেন না। তাদের উপস্থিতি নাচের অনুষ্ঠানের জন্য একটা লজ্জার বিষয়। সবাই আশা করেছিল একটা ভদ্র পরিবেশে নাচের অনুষ্ঠান হবে। নিজেদের প্রতিবেশে সুন্দর অনুষ্ঠান হবে। অথচ সব গোল্লায় গেল।

আমার চেয়ে আরেকটু বড় মেয়েদের দিকে তাকিয়ে তাদের চেহারা মেপে দেখার একটা অভ্যাস ছিল আমার। পেগি যে খুব নিখুঁত সুন্দর একটা মেয়ে ছিল, তা মনে হয়নি আমার। আবার হতে পারে কান্নার কারণে তার মুখের মেকআপ ধুয়েমুছে গেছে। গোল করে বাঁধা তার ইঁদুর-রঙা চুলের পিন খুলে চুল এলোমেলো হয়ে গেছে। পেগির আঙুলের নখগুলো ছিমছামই ছিল। কিন্তু দেখে মনে হলো, পেগি নখগুলো দাঁতে চিবিয়ে খানিকটা এবড়োথেবড়ো করে ফেলেছে। আমার পরিচিত কয়েকজন নাকি কাঁদা, সব সময় নালিশ জানানো, কুটনি ধরনের মেয়ে আছে; পেগিকে তাদের চেয়ে খুব একটা বাড়ন্ত শরীরের মনে হয়নি। তবু তার সঙ্গে যুবকরা এমনভাবে কথা বলছিল যেন সে জীবনে কোনো দিন শক্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। তাকে ঠিকমতো আদরের সান্ত্বনা দিতে হবে। তার সামনে অন্যদের সব সময় মাথা নত করে থাকতে হবে।

ওদের একজন পেগিকে একটা তৈরি সিগারেট সাধল। এটাকে আমার আনন্দদায়ক বিষয়ই মনে হলো। কারণ আমার বাবা ও আমার পরিচিত অন্য লোকেরা হাতের তালুতে তাদের সিগারেট গড়িয়ে গড়িয়ে ডলে গোলাকার করে নিতেন দেখেছি। কিন্তু পেগি মাথা ঝাঁকিয়ে নালিশের মতো করে নাকি সুরে আহত কণ্ঠে বলল সে ধূমপান করে না। তাদের অন্যজন গামের একটা খণ্ড এগিয়ে দিলে পেগি গ্রহণ করল।

তাদের মধ্যে তখন কী বিষয়ে আলাপ চলছিল আমার বোঝার উপায় ছিল না। যে ছেলেটা পেগিকে গাম দিল সে পকেটের মধ্যে কী যেন হাতড়াচ্ছিল। তখনই সে আমাকে দেখে ফেলে এবং বলে, পেগি? পেগি, একটা বাচ্চা মেয়ে ওপরের তলায় যেতে চাচ্ছে মনে হয়।

পেগি মাথাটা আরো নিচু করে ফেলল বলে তার মুখটা ভালো করে দেখতে পেলাম না। তাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পারফিউমের সুবাস পেলাম। সিগারেটের গন্ধ, তাদের পুরুষালি পশমি ইউনিফর্মের গন্ধ ও তাদের পালিশ করা বুট জুতোরও গন্ধ পেলাম।

কোট পরে আমি যখন নেমে আসছি, তখনো তারা ওখানেই। তবে এবারে তারা জানত আমি আসব। কাজেই আমি তাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তারা চুপচাপই রইল।

যেতে যেতে দেখলাম, পেগি শুধু একবার সশব্দে নাক টান দিল এবং তার পাশের যুবক পেগির ঊরুর ওপরে আদরের চাপড় দিতে থাকল। পেগির স্কার্ট ওপরের দিকে ওঠানো আছে বলে তার মোজার একেবারে ওপরের অংশে বন্ধনীও দেখতে পেলাম।

তাদের কণ্ঠ অনেক দিন পর্যন্ত আমার মনে ছিল। পেগির নয়, ওই যুবকদের। আমি এখন জানি যুদ্ধের শুরুতে পোর্ট আল-বেয়ারে নিয়োজিত যুবকদের কেউ কেউ এসেছিল ইংল্যান্ড থেকে। এখানে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল জার্মানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। আমার এখনো মনে হয়, তাদের যে কণ্ঠের আওয়াজ আমি শুনেছি সে রকম উচ্চারণ ব্রিটেনের কোনো কোনো অংশে ছিল- এ রকম কোমল, মৃদু আর আবেগাপ্লুত। তবে এ কথা সত্যি, আমি জীবনে আর কোনো দিন কোনো পুরুষ মানুষকে এ রকম সুরে কথা বলতে শুনিনি। একটা মেয়েকে তাদের দেখার ধরন থেকেই বোঝা যায় সে যেন এমন এক পূজনীয় ব্যক্তি, যার সামনে যা-ই আসুক না কেন, নির্দয় কোনো কিছু ঘটলেই যেন আইনের বিচ্যুতি হবে। পাপ হয়ে যাবে। পেগির কান্নার কারণ হিসেবে আমি কিসের কথা ভেবেছিলাম? সে সময় এ রকম কোমল প্রশ্ন আমাকে তাড়িত করেনি। আমার খুব সাহস ছিল, তা-ও নয়। আমার প্রথম স্কুল থেকে আসার পথে কেউ তাড়া করলে কিংবা ঢিল ছুড়ে মারলে আমি কেঁদে ফেলতাম। শহরের স্কুলের কোনো শিক্ষক আমার ডেস্কের অপরিষ্কার দশা সবাইকে দেখানোর জন্য ক্লাসে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিলেও কাঁদতাম। ওই একই অপরাধে তিনি আমার মাকে ফোন করলে মা ফোন ধরেই কাঁদতেন। কারণ আমি তাঁর কাছে গর্বের বদলে লজ্জার কারণ হয়ে গেছি। আমার মনে হয়, কিছু মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সাহসী হয়ে থাকে এবং অন্যরা সাহসী নয়। নিশ্চয় পেগিকে কেউ কিছু বলেছিল বলেই সে নাক টেনে টেনে কাঁদছিল। আমার মতো পেগিরও সহ্য করার ক্ষমতা খুব দুর্বল ছিল।

কোনো বিশেষ কারণ ছাড়াই আমার মনে হয়েছিল, কমলা রঙের পোশাক পরা মহিলাই হয়তো ইতরামির কোনো কাজ করেছিল। নিশ্চয়ই কোনো মহিলারই কাজ। কেননা কোনো পুরুষ মানুষ পেগিকে কাঁদিয়ে থাকলে বিমানবাহিনীর যুবকরা, যারা পেগিকে আরাম দেওয়ার চেষ্টা করছিল, তারা নিশ্চয়ই দোষীকে শাস্তি দিয়ে থাকত। হয়তো তাকে মুখ সামলে কথা বলতে বলত। কিংবা হতে পারে তাকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে যেত এবং প্রহার করে শাস্তি দিত।

সুতরাং আমার মনোযোগের কেন্দ্র পেগি ছিল না। তার অশ্রু নয়, তার বিচূর্ণ চেহারাও নয়। পেগির সব কিছু যেন আমারই মতো। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিল যারা, তাদের আচরণ দেখেই বিস্মিত হয়েছিলাম। তারা কিভাবে পেগির সামনে মাথা নত করে নিজেদের পেগির সেবায় নিয়োজিত করার ঘোষণা করছিল!

তারা কী বলছিল? বিশেষ কিছুই নয়। তারা বলছিল, ঠিক আছে, সব ঠিক আছে। ঠিক আছে, পেগি। এখন শান্ত হও পেগি। ঠিক আছে, সব ঠিক আছে।

তাদের এত দয়া! কেউ এত দয়া দেখাতে পারে!

খুব রূঢ় সত্যি হলো, বোমা মারা প্রশিক্ষণের জন্য ওই যুবকদের আমাদের দেশে আনা হয়েছিল; তাদের অনেকেই হয়তো মিশনে মারাও যাবে। কর্নওয়াল, কেন্ট, হাল কিংবা স্কটল্যান্ডের স্বাভাবিক উচ্চারণেই কথা বলছিল তারা। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, তাদের মুখ দিয়ে কোনো আশীর্বাদ না বের করে যেন মুখ খুলতেই পারেনি তারা, বিশেষ করে ওই মুহূর্তের জন্য কোনো আশীর্বাদ। আমার মনেই আসেনি তাদের ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, স্বাভাবিক জীবন জানালা দিয়ে পালিয়েছে এবং মাটির সঙ্গে মিশে গেছে নিষ্পেষিত হয়ে। আমার শুধু আশীর্বাদের কথা মনে আসছিল- আশীর্বাদ পাওয়া কি সৌভাগ্যের কথা! কী অদ্ভুত রকমের ভাগ্যবতী পেগি, আশীর্বাদ পাওয়ার যোগ্য না হয়েও সে পেয়ে গেছে।

আর আমি অবশ্য জানি না কতক্ষণ, কতক্ষণ তাদের কথা আমি ভেবেছি। আমার শোবার ঘরের ঠাণ্ডায় তারা আমাকে দোল দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। আমি তাদের জাগিয়ে দিতে পারতাম, তাদের মুখ আর কণ্ঠস্বর স্পষ্ট করে ফিরিয়ে আনতে পারতাম আমার স্মৃতিতে। আহা, কী বলব! তাদের কণ্ঠ তো আমার দিকে, অন্য কোনো অপ্রয়োজনীয় তৃতীয় পক্ষের দিকে নয়। তাদের হাত আমার শুকনো ঊরুর ওপরে আশীর্বাদ বুলিয়ে যেত; তাদের কণ্ঠ থেকে কোমল নিশ্চয়তা ঝরে পড়ত; আমিও ভালোবাসার যোগ্য।

আমার অপরিপক্ব কল্পিত কামনার ভেতর জীবন্ত অবস্থায় থাকতে থাকতেই তারা চলে গেছে- কেউ কেউ, অনেকেই। চিরতরে চলে গেছে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ