ভাষান্তর : মাসুদুজ্জামান
নির্জন পার্কের হলুদ পাতায় ছেয়ে থাকা কাঠের বেঞ্চিতে বসে রাজহাঁসগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি। গভীর মৃত্যুচিন্তায় মগ্ন। রুপোয় মোড়ানো ছড়ির হাতলের ওপর জোড়া করে তার হাত দুটো রাখা। জেনেভায় এসে তিনি দেখেছিলেন এই সরোবরটির পানি কত শান্ত আর স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ। গাংচিলের দল পোষা পাখির মতো তখন তাঁর হাত থেকে খাবার খেয়ে যেত।
সন্ধে ছ’টা বাজতে না বাজতেই হাতে ঝলমলে ছাতা নিয়ে, বড় কুঁচি দেওয়া অরগ্যান্ডি স্কার্টের খসখস শব্দ ছড়িয়ে ছায়ামূর্তির মতো এখানে ঘুরে বেড়াত কিছু মেয়ে, যাদেও ইচ্ছে করলেই ভাড়া করে নিয়ে রাত্রিযাপন করা যেত। ওই সব মেয়েদের মধ্যে এবার মাত্র একজনের দেখা পাওয়া গেল। জনমানবহীন সরোবরের বাঁধানো ঘাটে সে ফুল বিক্রি করে। তার জীবনের মতো সবকিছুই যে সময় এভাবে শেষ করে দিতে পারে, বিশ্বাস করাই তার পক্ষে খুবই কষ্টকর।
অনেক বিশিষ্ট লোকের মতো তিনিও এই শহরে আত্মগোপন করে আছেন। তার পরনে সাদা ডোরাকাটা গাঢ় নীল রঙের স্যুট আর ব্রোকেডের কাজ করা জ্যাকেট। মাথায় অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের টুপির মতো শক্ত টুপি। সশস্ত্র কোনো এক সৈনিকের মতো উদ্ধত তার গোঁফ। মাথায় বাহারি কায়দার ঢেউ-খেলানো একরাশ নীলাভ কালো চুল। বীণাবাদকের মতো তার দুটি হাত। বাঁ হাতের অনামিকায় বিপত্নীক চিহ্নবাহী অঙ্গুরীয়। চোখ জোড়া খুশিতে ঝলমলে, উজ্জ্বল। শুধু ত্বকের ওপর জমে থাকা ক্লান্তির ছাপ থেকে আন্দাজ করা যায় তার স্বাস্থ্যের হালচাল। এতকিছু সত্ত্বেও তিহাত্তর বছর বয়সে তার শরীরের কাঠামো রীতিমতো নজরকাড়া। এতটুকু নড়বড়ে হয়ে যায়নি। যদিও সেদিন সকালেই তিনি অনুভব করছিলেন, গর্ব করার মতো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। গৌরব আর প্রতিপত্তির দিনগুলি বিদায় নিয়েছে। এখন শুধু মৃত্যুর জন্যে প্রতীক্ষা।
দু’-দুটো বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে এবার তিনি জেনেভায় এলেন। কী একটা ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন, সেটা যদি এখানকার ডাক্তররা ধরতে পারেন, এরকম আশা নিয়েই তার আসা। মার্তিনিকের ডাক্তাররা বিষয়টা ধরতে পারেননি। ঠিক ছিল দু’ সপ্তাহের বেশি তিনি থাকবেন না, কিন্তু প্রায় ছ’ সপ্তাহ কেটে গেছে। যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া সত্ত্বেও কেউ কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত কী হবে তাও কেউ বলতে পারছেন না। ব্যথার কারণ খুঁজতে লিভার কিডনি থেকে শুরু করে প্যাংক্রিয়াস প্রস্টেট পর্যন্ত বাদ না দিয়ে সবকিছুই পরীক্ষা করা হল। অবশেষে এল সেই কঠিন দিনটি--বৃহস্পতিবার। সেদিন সকাল ন’টায় ইউরোপের জনৈক বিশেষজ্ঞ তাকে সময় দিলেন। আগে যারা দেখেছেন তাদের তুলনায় এই চিকিৎসকের নাম-যশ কম।
ডাক্তরের চেম্বারটি খুবই অনাড়ম্বর, সন্ন্যাসীদের আস্তানার মতো। ছোটখাটো চেহারার গম্ভীর প্রকৃতির ডাক্তারের ডান হাতের বুড়ো আঙুলে প্লাস্টার জড়ানো। ঘরের আলো নেভানোর পর বোঝা গেল এক্সরে পর্দায় একটা শিরদাঁড়ায় ছবি জ্বলজ্বল করছে। ডাক্তার দেখিয়ে দেওয়ার পর তিনি বুঝতে পারলেন ওটা তারই কোমরের নিচের মেরুদ-ের ছবি।
ডাক্তার বললেন, ‘আপনার ব্যথাটা এইখানে।’ কথাটা তার পক্ষে বোঝা এতটা সহজ নয়। দ্রুত স্থান পরিবর্তন করা সরে সরে যাওয়া ব্যথাটা কোথায় কখন যে চাগিয়ে ওঠে তা ঠাহর করা তার পক্ষে মুশকিল। কখনও মনে হয় ডান দিকের পাঁজরে, কখনও তলপেটে। কখনও আবার কুঁচকিতে আচমকা ছোরা বেঁধার মতো তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করেন তিনি। একমনে তার কথা শোনার পর ডাক্তার মন্তব্য করলেন, ‘সেই জন্যেই তো এতদিন ধরে ব্যাপারটা ধরা পড়েনি।’
‘কিন্তু এখন আমরা জানি ব্যথটার কেন্দ্রবিন্দু কোথায়।’ কপালের একপাশে তর্জনী ঠেকিয়ে ডাক্তার আরও বললেন, ‘মাননীয় রাষ্ট্রপতি, সব ব্যথার সূত্রপাত আসলে এইখানে।’ দেখিয়ে দেওয়ার এই ভঙ্গিটি এতই নাটকীয় যে রাষ্ট্রপতি রীতিমতো ভীত হয়ে পড়লেন। তবে ডাক্তারের শেষ কথাটা তাকে যথেষ্ট আশ্বস্ত করল। অনিবার্য এবং কিছুটা বিপজ্জনক একটা অস্ত্রোপচার এখুনি দরকার। বিষয়টা কতখানি বিপজ্জনক জিজ্ঞাসা করায় ডাক্তার অস্পষ্ট জবাব দিলেন, ‘ঠিক ঠিক বলা মুশকিল।’ তারপরে একটু থেমে, বিশদভাবে তিনি বোঝালেন যে, অস্ত্রোপচার না করলে মারাত্মক কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আবার অস্ত্রোপচারের ফলে বিভিন্ন মাত্রার পক্ষাঘাতের সম্ভাবানাও আছে বলে ডাক্তার মন্তব্য করলেন। ‘তবে এটাও ঠিক যে দুটো বিশ্বযুদ্ধের পর চিকিৎসাশাস্ত্রের অনেক উন্নতি হয়েছে। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায়, এই আশঙ্কা প্রায় অমূলক।’ সবশেষে ডাক্তার বললেন, ‘চিন্তার কিছু নেই। আপনার কাজকর্ম সেরে নিন। তারপর যোগাযোগ করবেন। তবে ভুলে যাবেন না, যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই মঙ্গল।’
এরকম একটা দুঃসংবাদ আত্মস্থ করা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। বিশেষ করে বাইরের আবহাওয়ার হালহকিকত মোটেও সুবিধাজনক নয়। খুব সকালে হোটেল থেকে বেরোনোর সময় জানালা দিয়ে ঝলমলে রোদ দেখা যাচ্ছিল বলে তিনি ওভারকোট না পরেই বেরিয়ে পড়েন। চেমিন দু বিউ-সোলেইল হাসপাতাল থেকে ধীরে ধীরে প্রেমিক-প্রেমিকাদের গোপন আস্তানা জার্দিন আঙ্গলাইস পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন। মৃতুচিন্তা করতে করতে ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় এখানেই কাটিয়ে দিলেন। তখনই খেয়াল হল, হেমন্তকাল এসে গেছে। সরোবরের পানি ঝঞ্ঝামুখর সমুদ্রের মতো উত্তাল। গাংচিলদের সন্ত্রস্ত করে তোলার মতো এলোমেলো হাওয়ায় গাছের অবশিষ্ট পাতাগুলোও ঝরে পড়ছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি উঠে দাঁড়ালেন। ফুলের পসরা সাজিয়ে বসা মেয়েটির কাছ থেকে ফুল না কিনে সরকারি বাগান থেকে একটা ফুল তুলে নিয়ে জ্যাকেটে লাগিয়ে নিলেন। ফুলওয়ালি ব্যাপারটা দেখে বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করলো, ‘এইসব ফুল ঈশ্বরের দান নয়, এগুলো শহরের সম্পত্তি।’
কথাটায় কান না দিয়ে ছড়ির মাঝখানটা ধরে ঘোরাতে ঘোরাতে মাননীয় রাষ্ট্রপতি লম্বা লম্বা পা ফেলে কিছুটা বেপরোয়া ভঙ্গিতে বেরিয়ে এলেন। ম-ব্লাঁ সেতুর ওপর থেকে সুইজারল্যান্ডের সহযোগী দেশগুলোর পতাকা চটজলদি নামিয়ে নেওয়ার বিষয়টা তার নজরে এল। আকস্মিক ঝোড়ো হাওয়ায় পতাকাগুলো পতপত করে পাগলামি শুরু করে দিল। ফোয়ারার চূড়ায় জমা হওয়া মনোহর ফেনাপুঞ্জ আজ দেখা যাচ্ছে না। সরোবরের লাগোয়া যে কাফেটেরিয়ার তিনি নিয়মিত কাস্টোমার, সেটাকেও আজ আর চেনা যাচ্ছে না। কাফেটেরিয়ার সামনের সবুজ ক্যানভাসের ছাউনিটাও গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। গ্রীষ্মের ফুল দিয়ে সাজানো সুন্দর ছাদটাও বন্ধ। এই দুপুরেও কাফেটেরিয়ার ভেতরে জ্বলছে ঝাঁঝালো বৈদ্যুতিক বাতি। এরই মাঝে দুর্ভাবনা জাগিয়ে তোলা সুরে কোনও একটা যন্ত্রে বেজে চলেছে মোৎসার্টের সুরমূর্ছনা।
খরিদ্দারদের জন্যে কাউন্টারে সাজিয়ে রাখা খবরের কাগজ থেকে মাননীয় রাষ্ট্রপতি একটি কাগজ তুলে নিলেন। টুপি ও ছড়ি রাখলেন নির্দিষ্ট জায়গায়। সংবাদপত্র পড়বেন বলে সোনার ফ্রেমের চশমাটি পরে একটু দূরের একটা টেবিল বেছে নিয়ে বসবার সময় তার খেয়াল হল, হেমন্তকাল এসে গেছে। আন্তর্জাতিক থবর দিয়ে সংবাদ পড়া শুরু করলেন। কারণ, এই পৃষ্ঠাতেই থাকে দুই আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশের যাবতীয় খবরাখবর। তারপর পেছনের পাতা থেকে সামনের দিকে এগোতে শুরু করলেন তিনি। ততক্ষণে ওয়েট্রেস তাঁর প্রতিদিনকার পানীয় এভিয়ান ওয়াটার নিয়ে উপস্থিত। ডাক্তারের নির্দেশে তিরিশ বছরেরও বেশি আগে তিনি কফির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলেন। তবে এখন তার মনে হল, ‘মৃত্যু আসন্ন জানতে পারলে কবেই কফি খাওয়া শুরু করা যেত।’ বিশুদ্ধ ফরাসি ভাষায় তিনি উচ্চারণ করলেন, ‘আমাকে কফিও দেবেন, ইতালীয় কফি। এমন কড়া হওয়া চাই যেন তা খেয়ে মড়া মানুষও বেঁচে ওঠে।’ কথাটার যে অন্য একটা মানে হতে পারে, তা তিনি খেয়াল করলেন না।
ধীরে সুস্থে, আস্তে আস্তে খেয়ে ফেললেন চিনি-ছাড়া কফি। তারপর পেয়ালাটা পিরিচের ওপর উপুড় করে রেখে যেন দেখতে চাইলেন তলানি হওয়া কফির দানাগুলো তার কী ভবিষ্যৎ এঁকে দেয়। ফিরে পাওয়া কফির স্বাদ মুহূর্তের মধ্যে তার মন থেকে সমস্ত বিষণœতা মুছে দিল। কফির যাদুতেই যেন আন্দাজ করতে পারলেন, কেউ এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। অন্যমনস্কতার ভান করে খবরের কাগজের পাতা ওলটাতে ওলটাতে তিনি চশমার ওপর দিয়ে লোকটার দিকে তাকালেন। শুকনো লিকলিকে চেহারার একটা মানুষ। দাড়ি কামায়নি। মাথায় খেলোয়াড়ের টুপি। গায়ে ভেড়ার চামড়ার কারুকাজ করা একটা জ্যাকেট। চোখাচোখি এড়াতে লোকটি নিজেই তার চোখ সরিয়ে নিল।
পরিচিত মুখ। হাসপাতালের লবিতে বেশ কয়েকবার তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেছেন। প্রোমেনাদে দু লাকে একবার লোকটিকে একটা মোটর সাইকেল চালিয়ে যেতে দেখেছেন। তিনি তখন রাজহাঁসগুলোর দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিলেন। কিন্তু কখনও অব্দি মনে হয়নি, সে তার পরিচয় জানে। তবুও লোকটি ওখান থেকে চলে না যাওয়ায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি নির্বাসিত বন্দির মতো নানারকম নির্যাতনের সম্ভাবনায় ভীত বোধ করছিলেন।
ব্রাহমাসের সুমধুর চেলোর সুরে তিনি নিজেকে ভাসিয়ে দিলেন। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে খবরের কাগজ পড়া শেষ করলেন। এরই মাঝে ব্যথাটা আবার তীব্রভাবে চাগিয়ে উঠেছে। ব্যথা উপশমের অন্যতম উপাদান সুরমূর্ছনাও কোনো কাজে এল না। ওয়েস্টকোটের পকেট থেকে চেন বাঁধা সোনার ঘড়িটা বের করে সময় দেখলেন তিনি। এরপর দুপুরর জন্যে বরাদ্দ করা ওষুধের দুটো বড়ি গলায় চালান করে দিয়ে এভিয়ান ওয়াটারের তলানিটুকুতে চুমুক দিলেন। পিরিচের ওপর পড়ে থাকা কফির দানাগুলো তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী পুর্বাভাস দিচ্ছে তা বোঝার চেষ্টায় চশমা খোলার আগে তিনি একবার ওদিকে তাকালেন। শুকনো কফিদানার নকশায় নজর রাখতেই তাঁর শরীরে যেন এক অজানা শৈত্যপ্রবাহ দেখা দিল। তার ভয়ে কেঁপে ওঠার কারণ হলো, পিরিচের ওপর ফুটে উঠেছে অনিশ্চয়তায় ভরা এক সংকেত।
বিল মিটিয়ে, সামান্য কিছু বকশিশ দিয়ে, আস্তে আস্তে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ছড়ি আর টুপিটা তুলে নিলেন। তার দিকে তাকিয়ে থাকা লোকটিকে কোনও রকম পাত্তা না দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে ঝড়ে বিধ্বস্ত রাশি রাশি ফুলকে পাশ কাটিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লেন। তার মনে হলো, মিথ্যে ভয়ের ঘোরটা বোধ হয় কেটে গেছে। কিন্তু হঠাৎই পেছন দিক থেকে ধেয়ে আসা একজোড়া পায়ের শব্দ তাকে থামিয়ে দিল। বাগানের কোনায় ঘুরে যাওয়ার মুখে কিছুটা পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে পড়তেই পিছু নেওয়া লোকটির সঙ্গে তার ধাক্কা লাগে আর কি! নেহাত লোকটি নিজেকে সামলে নিয়েছিল। লোকটির বিস্ময়ভরা দৃষ্টি তখন মাত্র দু’ আঙুল দূরে। আর সেই অবস্থাতেই লোকটি অস্ফুট স্বরে বললো, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি’।
মুখের হাসি এবং কণ্ঠস্বরের মাধুর্য বজায় রেখেই তিনি বললেন, ‘যারা তোমাকে এই কাজে লাগিয়েছে, তাদের বলে দিতে পারো আমার শরীর-স্বাস্থ্য বেশ ভালোই আছে।’
‘সেকথা আমার থেকে ভালো আর কে জানে?’ লোকটি বলল। ‘আমি তো হাসপাতালেই কাজ করি।’ তার কথা বলার ভঙ্গি, কথার ওঠানামা, এমনকি নিরীহ ভাবটিও একেবারে ষোলো আনা বিশুদ্ধ ক্যারিবীয় ধরনের।
‘তুমি তাহলে ডাক্তার?’
‘হলে তো ভালোই হত’, লোকটি জবাব দেয়। ‘আমি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালাই।’
রাষ্ট্রপতি দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, ‘তবে তো তোমার কাজটা বেশ কঠিন।’
‘আপনার কাজের মতো কঠিন নয় নিশ্চয়ই।’
ছড়ির ওপর ভর দিয়ে হাত দুটোকে রাখার পর তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার দেশ কোথায়?’
‘আমি ক্যারিবিয়ার মানুষ।’
‘সে তো বুঝতেই পারছি।’ রাষ্ট্রপতি বেশ জোর দিয়ে বলবার পর আবার প্রশ্ন করলেন, ‘জায়গাটার নাম কী?’
‘আপনি আর আমি একই এলাকার লোক’ বলেই সে করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল। ‘আমার নাম হোমেরো রে।’
‘বাঃ, চমৎকার নাম।’ মাঝপথে হোমেরোকে থামিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রপতি তার হাতটা চেপে ধরলেন। হোমেরো কিছুটা স্বস্তি পেলেন।
রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘আরও ভালো শোনাত যদি বলা হতো হোমেরো রে দে লা কাসা অর্থাৎ তাঁর প্রাসাদের রাজা আমি--হোমার।’
মহামান্য প্রেসিডেন্ট আর সেই লেকটি যখন রাস্তার একেবারে মাঝখানে, ঠিক তখনই কনকনে ঠা-া শীতের বাতাস ছুরির ফলার মতো আক্রমণ করে বসলো। দুজনের কেউই এমন অবস্থার জন্যে প্রস্তুত নয়। হাওয়াটা যেন রাষ্ট্রপতির হাড়ের মধ্যেই সেঁধিয়ে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন, গায়ে ওভারকোট নেই। তিনি আরও বুঝলেন, এই পরিস্থিতিতে সামনের দুটো চত্বর পেরিয়ে তার পছন্দেও সেই সস্তা রেস্তোরাঁয় পৌঁছোনো অসম্ভব। হোমোরোকে প্রশ্ন করলেন, ‘খেয়েছ?’
‘দুপুরে আমি খাই না। একেবারে বাড়ি ফিরে রাত্রে খাই’, হোমেরো জবাব দেয়।
‘আজকের জন্যে নিয়মটা না হয় একটু বদলে নাও’, মন ভোলানো ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটিয়ে রাষ্ট্রপতি বললেন। ‘চল, আমার সঙ্গে আজ তুমি মধ্যাহ্ণভোজ করবে।’
সদ্য পরিচয় হওয়া মানুষটির হাত ধরে তিনি আস্তে আস্তে রেস্তোরাঁর দিকে এগোতে থাকেন। সোনালি অক্ষরে ক্যানভাসের ছাউনির ওপর সোনালি অক্ষরে লেখা রয়েছে দোকানের নাম--লে বোয়েউফ কৌরোন্নে। রেস্তোরাঁটা একেবারেই ছোট। ভিতরে এক চিলতে বসার জায়গা, কোনও টেবিলই এইসময় খালি নেই। পরিবেশটা রীতিমতো উষ্ণ। রাষ্ট্রপতিকে কেউ চিনতে পারল না দেখে হোমেরো বিস্মিত। রাষ্ট্রপতির বসার একটা বন্দোবস্ত করার জন্যে সে রেস্তোরাঁর মালিকের সঙ্গে কথা বলতে গেল। রেস্তোরাঁর মালিক জানতে চাইলে, ‘ইনি কি বর্তমান রাষ্ট্রপতি?’
‘না’, হোমেরোর উত্তর। ‘উনি পদচ্যুত হয়েছেন।’
রেস্তেরাঁর মালিকের মুখে ফুটে উঠলো রহস্যময় হেঁয়ালির হাসি। ‘ওঁদের জন্যে সবসময়ই আলাদা ব্যবস্থা থাকে।’ নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে সুবিধে হয়, রেস্তোরাঁর শেষপ্রান্তের এরকম একটা আলাদা টেবিলে তাদের বসানো হল। রাষ্ট্রপতি লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ‘নির্বাসিতরাও যে সম্মান পেতে পারে, তা অনেকেরই খেয়াল থাকে না।’
কাঠকয়লার আগুনে ঝলসানো গোরুর পাঁজর এই রেস্তোরাঁর বিশেষ খাবার বলে পরিচিতি পেয়েছে। রাষ্ট্রপতি এবং তার অতিথি নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে অন্য টেবিলগুলোর দিকে চোখ ফেরালেন। ঝলসানো মাংসের বড় বড় টুকরোগুলোর ওপর তাদের নজর গেল। রাষ্ট্রপতি বিড়বিড় করে বললেন, ‘অসাধারণ! কিন্তু আমার খাওয়া নিষেধ।’ হোমেরোর দিকে একঝলক তির্যক দৃষ্টি হেনে তিনি আরও মন্তব্য করলেন, ‘আসলে আমার জন্যে তো সবকিছুই নিষিদ্ধ।’
‘আপনার তো কফি খাওয়াও বারণ, কিন্তু খেলেন দেখলাম।’
‘তুমি দেখে ফেলেছ নাকি?’ রাষ্ট্রপতির বিস্ময়ভরা প্রশ্ন। তারপরই পরিস্থিতিটা সামলে নেওয়ার জন্যে বললেন, ‘তা নয়; আজকের দিনটা তো একটু অন্যরকম, তাই ব্যতিক্রম ঘটালাম।’
শুধু কফিই নয়, আরও অনেক কিছু ওলোট-পালট হয়ে গেল। কাঠকয়লার আগুনে ঝলসানো গোরুর পাঁজরের সঙ্গে অলিভ অয়েল ছেটানো টাটকা সবজির সালাদ আনতে বললেন। সঙ্গে রেড ওয়াইন।
টেবিলে খাবার এসে পৌঁছোনোর আগে হোমেরো জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা পেটমোটা মানিব্যাগ বের করলেন। নোট বা খুচরো পয়সা নয়, বেরিয়ে এল কতগুলো বিবর্ণ কাগজ। তার মধ্যে থেকে খুঁজে পেতে একটা বিবর্ণ ছবি সে দেখাল রাষ্ট্রপতিকে। ছবিটা দেখে নিজেকে চিনতে পারলেন রাষ্ট্রপতি। পরনে ফুলশার্ট, কালো চুল, দশাসই গোঁফ। ছবিতে একদল যুবক তাকে ঘিরে রয়েছে। ছবির ফ্রেম থেকে ওই যুবকেরা যাতে বাদ না পড়ে সেই জন্যে তারা পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে মাথাটা উঁচুতে তুলে ধরায় ব্যস্ত। রাষ্ট্রপতি এক নজরেই চিনতে পারলেন কী ছিল তার নির্বাচনের প্রতীকগুলি। অপ্রীতিকর সেই ঘটনাটি কত তারিখে ঘটেছিল, তাও মনে পড়ে গেল। ‘দেখলে কষ্ট হয়। একটা কথা আমি সবসময়ই বলি, একমাত্র ছবি দেখলেই বোঝা যায় যে কতটা বুড়িয়ে গেছে মানুষটা।’ অস্পষ্ট স্বরে কোনওরকমে কথাটা বলেই তিনি ছবিটা এমনভাবে ফিরিয়ে দিলেন যেন এ প্রসঙ্গে তার শেষ কথা বলা হয়ে গেছে। অবশ্য এরপরে আবার বললেন, ‘বেশ মনে পড়ছে, সেই যে কত হাজার বছর আগেকার কথা। সান ক্রিস্তোবাল দে লা কাসাসের মোরগের লড়াই।’
‘আমিও তো ওই শহরেরই ’, খবরটা জানিয়ে হোমেরো ছবিতে অন্যদের মধ্যে নিজেকে দেখিয়ে দিয়ে বললো, ‘এই যে দেখুন--আমি।’ রাষ্ট্রপতি তাকে চিনতে পেরে বললেন, ‘তখন তো তুমি একটা ছেলেমানুষ ছিলে।’
‘প্রায় সেরকমই’, হোমেরো বলেই চলে। ‘বিশ্ববিদ্যালয় বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে দক্ষিণের সমস্ত প্রচার অভিযানেই আপনার সঙ্গে আমি ছিলাম।’
রাষ্ট্রপতি বুঝলেন হোমেরোর মনে অভিযোগ জমে আছে। ‘আমি আসলে খেয়াল করতে পারিনি’, তিনি মন্তব্য করলেন।
‘না না, তা নয়। আপনি আর তেমন কী করেছেন! এতজনের মধ্যে থেকে একজনকে কী আর আলাদা করে মনে রাখা যায়!’
‘তারপর কী হলো?’ প্রশ্ন করেন রাষ্ট্রপতি।
‘সে সব ব্যাপার আপনিই সবচেয়ে ভালো জানেন। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো’, হোমেরো বলেই চলে, ‘সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে আমরা দুজনেই এখানে। এখন আমরা দুজনে মিলে অর্ধেকটা গোরু খেয়ে ফেলতে পারি। এমন সুযোগ আর ক’জন পেয়েছে?’
বলতে বলতেই টেবিলে খাবার পরিবেশন করা হলো। খাওয়ানোর আগে বাচ্চাদের গলায় যেমনভাবে বিব্ বেঁধে দেওয়া হয়, সেইভাবে ন্যাপকিনটি জামার মধ্যে গুঁজে নিলেন রাষ্ট্রপতি। তার অতিথি যে অবাক বিস্ময়ে ব্যাপারটা দেখছে, সেটাও খেয়াল করতে ভুললেন না তিনি।
‘এভাবে বেঁধে না নিলে প্রতিবারেই একটা করে টাইয়ের বারোটা বাজবে’, ন্যাপকিনের ব্যাপারটাকে তিনি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেন।
খাওয়া শুরুর আগে মাংসটা একবার চেখে নিতেই তাঁর চোখে-মুখে তৃপ্তি ছড়িয়ে পড়ল। আবার তিনি কথা শুরু করলেন, ‘একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, কেন যে সরাসরি আমার সঙ্গে আলাপ করার বদলে তুমি আমাকে অনুসরণ করছিলে।’
হোমেরো জানালো, ভিআইপি রোগিদের জন্যে সংরক্ষিত দরজা দিয়ে হাসপাতালে ঢোকার সময়ই সে তাকে চিনতে পেরেছিল। প্রচ- গরমের সেই দিনে তার পরনে ছিল আন্তিলেসের থ্রি-পিস স্যুট। পায়ে সাদা-কালো জুতো। কোটের কলারে গোঁজা ছিল একটা ডেইজি ফুল। হাওয়ায় এলোমেলোভাবে উড়ছিল তার মাথার সুন্দর লম্বা চুল। হোমেরো জেনেছে, কারো সহায়তা ছাড়াই তিনি জেনেভায় এসেছেন। ছাত্রাবস্থায় এখানেই আইন পড়েছিলেন বলে শহরটা তার অনেকটাই চেনা। তার পরিচয় গোপন রাখার জন্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিঃশব্দে সবরকমের সাবধানতা অবলম্বন করেছিল। হয়তো এমনটা করা হয়েছিল তারই অনুরোধে। ওই রাতেই হোমেরো আর তার স্ত্রী ঠিক করে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তারা যোগাযোগ করবে। কিন্তু তার পরও অনুকূল পরিস্থিতির জন্যে পাঁচ সপ্তাহ ধরে হোমেরো তাকে অনুসরণ করেছে। হয়তো এভাবে তাদের মধ্যে এভাবে কথা বলা সম্ভব হতো না যদি কিনা রাষ্ট্রপতি নিজেরই তার দিকে সরাসরি ঘুরে দাঁড়াতেন। ‘মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম বলে আমি মোটেও অখুশি নই। তবে সত্যি বলতে কী, একলা থাকতে আমার কোনও কষ্ট হয় না।’
‘এটা ঠিক নয়।’
রাষ্টপতি জানতে চাইলেন, ‘কেন ঠিক নয়?’ তারপরেই মন্তব্য করলেন, ‘সকলে যে আমায় ভুলে গেছে সেটাই সবচেয়ে বড় লাভ।’
‘আপনি জানেন না কীভাবে আপনাকে মনে রেখেছি।’ হোমেরোর কথায় আবেগ গোপন থাকল না। ‘এখনও তরতাজা যুবকের মতো স্বাস্থ্যবান চেহারায় আপনাকে দেখতে পাওয়া যে কী আনন্দেও, আপনার সেটা জানা নেই।’
‘তবু’, তার কথায় কোনও নাটকীয়তা নেই; ‘তবুও সমস্ত লক্ষণই বলে দিচ্ছে শিয়রে মৃত্যু উপস্থিত।’
‘আপনি সেরে উঠবেন’, হোমেরো জানান দেয়। ‘সে সম্ভাবনাই বেশি।’
রাষ্ট্রপতি রীতিমতো চমকে উঠলেও রসিকতা করতে ছাড়লেন না। ‘তা না হয় বোঝা গেল। তবে এত সুন্দর এই সুইজারল্যান্ডে চিকিৎসা সংক্রান্ত গোপনীয়তা কি আজকাল বজায় রাখা যায় না?’
‘পৃথিবীর কোনও অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারের কাছেই হাসপাতালের খবর গোপন থাকে না।’ হোমেরোর সুস্পষ্ট উত্তর।
‘কিন্তু আমিই তো জেনেছি মাত্র ঘণ্টা দুয়েক আগে। জানিয়েছেন সেই মানুষটি, যার পক্ষে আমার অবস্থা জানা সম্ভব।’
‘সে যাই হোক, উদ্দেশ্য সফল না করে কীভাবে মারা যাবেন আপনি? সে হতেই পারে না’, হোমেরো জোর দিয়ে বলে। ‘আপনার আসনে আবার প্রতিষ্ঠিত হবেন, সেটা আমাদের দায়িত্ব।
রাষ্ট্রপতি এবার বিস্ময়ের ভান করলেন। ‘সাবধান করে দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ।’ ধীরেসুস্থে, আস্তে আস্তে, তারিয়ে তারিয়ে খেলেন। সরাসরি তাকালেন হোমেরোর চোখে চোখ রাখলেন। অল্পবয়সি মানুষটির মনে হল বয়স্ক ভদ্রলোকটি কী ভাবছেন তা সে বুঝতে পেরেছে। অনেকক্ষন ধরে তারা কথা বললেন; স্মৃতিচারণও হলো। শেষে একটু দুষ্টুমির ছোঁয়া মিশিয়ে হাসতে হাসতে রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘মৃতদেহের কী পরিনাম হবে, সেটা আমি ভাবতে চাইছিলাম না। কিন্তু এখন দেখছি সেটাকে গোপন রাখার জন্যে রহস্যোপন্যাসের মতো সাবধান হতে হবে।’
‘তাতে অবশ্য কোনও লাভই হবে না’, ঠাট্টার ছলে হোমেরো উত্তর দিল। ‘হাসপাতালে কোনও রহস্যেরই মেয়াদ এক ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয় না। শুধু একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল।
কফি খাওয়ার পর শেষ হলো মধ্যাহ্নভোজ। রাষ্ট্রপতি আবার তার অভ্যেসবশত কাপের তলানিতে চোখ বোলালেন এবং তার মনের ভেতর কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল। এবার ওই একই উত্তর পেলেন। তার মুখে অবশ্য কোনো অভিব্যক্তিই জাগলো না। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে বিল মেটালেন। সঙ্গে যথারীতি কিছু বকশিশ। বকশিশের অঙ্কটা দেখে পরিবেশনকারীর গলা থেকে কোনো কথা নয় শুধু একটা আওয়াজ বেরিয়ে এলো।
হোমেরোকে বিদায় জানাবার সময় রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘তোমার সঙ্গে আলাপ করে বেশ ভালো লাগল।’ ‘এখনও অপারেশনের দিনক্ষণ স্থির হয়নি। সবকিছু ঠিকঠাক চললে নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে।’
‘তার আগে নয় কেন?’ হোমেরো জানতে চাইলো। ‘আমার বউ কয়েকটা বাড়িতে রান্নার কাজ করে। চিংড়ি মাছের পোলাও রান্নায় ওর খুব নামডাক। আমাদের অনেক দিনের ইচ্ছে আপনাকে বাড়িতে নৈশভোজে নেমন্তন্ন করে খাওয়াবো।’
‘আমার আবার চিংড়ি মাছ, কাঁকড়া জাতীয় খাবার খাওয়া বারণ। তবে তোমাদের ওখানে যাব। আর প্রাণভরে খাব। বলো, কবে যাব?’
‘আমার তো বৃহস্পতিবার ছুটি’, হোমেরো জানায়।
‘বেশ তো, দারুণ প্রস্তাব’, রাষ্ট্রপতি নেমতন্নটা নিশ্চিন্ত করলেন। ‘আগামী বৃহস্পতিবারই যাচ্ছি তোমাদের ওখানে। ধরো, এই সন্ধে সাতটা নাগাদ।’
হোমেরো বলল, ‘আমি গিয়ে নিয়ে আসবো। ঠিকানাটা হলো--হোতেলেরিয়ে দামেস্ ১৪ নম্বর রুয়ে দে লইন্দ্রাস্ত্রিয়ে। স্টেশনের ঠিক পেছন দিকে, তাইতো?
বাহ্, তুমি দেখছি সব মনে রেখেছো। আমার জুতোর মাপও বলে দেবে নাকি! রাষ্ট্রপতি উঠে দাঁড়ালেন। তাকে তখন আরও শান্ত ও সৌম দেখাচ্ছিল।
‘জানি, সেটাও জানি’, হোমেরো যেন মজা পেয়েছে। ‘একচল্লিশ নম্বর।’
হোমেরোকে এতটা নিরীহ মনে হলেও তার আসল উদ্দেশ্য কিন্তু তেমন নিঃস্বার্থ নয়। কথাটা অবশ্য সে রাষ্ট্রপতিকে বলেনি। অথচ পরে যাকে পেয়েছে অথবা যে শুনতে চেয়েছে, তাকেই ও বলে দিয়েছে। তার আসল মতলবটা কী। অন্যান্য অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারের মতো হোমেরোও আঞ্জুমানে মফিদুল আর জীবনবীমা কোম্পানির সঙ্গে সবকিছুই ঠিকঠাক করে রেখেছিল। মৃতদেহ সৎকার থেকে শুরু করে যাবতীয় আনুষঙ্গিক কাজের দায়িত্ব যেন তার ওপরই বর্তায়। বিশেষ করে বিদেশী রোগীদের ওপর ওদের নজর বেশি। কারণ তাদের সামর্থ্য আছে। এতে অবশ্য হোমেরোর যে অনেক লাভ হবে তা নয়। অন্যদেরও ভাগ দিতে হবে তাকে। বিশেষ করে যারা দুরারোগ্য রোগীদের গোপন তথ্যের সন্ধান দেয়, তাদেরকে তো ভাগ না দিলে চলবে না। এই মতলববাজির অজুহাতও হোমেরোর কাছে খুবই পরিষ্কার। প্রথমত, সে স্বদেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে আছে, ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এর ওপর তাকে বিচ্ছিরি রকমের কম বেতনে স্ত্রী ও দুটি সন্তানের ভরণপোষণ করতে হচ্ছে।
হোমেরোর স্ত্রী লাজারা ডেভিসের বাস্তববুদ্ধি অনেক টনটনে। সান হুয়ান পুয়ের্তোরিকোর মেয়ে লাজারা এমনিতে ছোটখাটো আর রোগাপাতলা হলে কী হবে, শারীরিকভাবে বেশ শক্তপোক্ত। চায়ের হালকা লিকারের মতো তার গায়ের রং। শেয়ালের মতো ধূর্ত চোখের চাহনি স্বভাবের সঙ্গে যথেষ্ট বেশ মানিয়ে গেছে। লাজারা ও তার স্বামীর প্রথম সাক্ষাৎ হয় হাসপাতালের দাতব্য বিভাগে। জেনেভায় সে এসেছিল স্বদেশের অর্থাৎ পুয়ের্তোরিকের কোনো এক ধনী ব্যবসায়ীর বুয়া হিসেবে। ব্যবসায়ীটি লাজারা ডেভিসকে জেনেভায় ফেলে রেখে চলে যায়। সহায়সম্বলহীন অবস্থায় ভেসে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ করে সে হাসপাতালের পরিচারিকার চাকরি পেয়ে যায়। তখনই হোমেরোর সঙ্গে বিয়েটা সেরে ফেলে। ইয়োরুবান রাজকন্যা হওয়া সত্ত্বেও হোমেরোর সঙ্গে লাজারার বিয়েটা হয়েছিল ক্যাথলিক প্রথায়। একটা বহুতল বাড়ির নয় তলায় দুই কামরার একটা ফ্ল্যাটে তাদের বসবাস। বহুতল হলেও বাড়িটায় লিফ্ট নেই। প্রায় পুরো বাড়িটাই আফ্রিকা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের আশ্রয়স্থল। লাজারা এবং হোমেরোর মেয়ে বারবারার বয়স নয় বছর আর ছেলে লাজারোর সাত। প্রতিবন্ধী হয়ে ওঠার সমস্ত লক্ষণ ছেলেটির শরীরে এরই মধ্যে ফুটে উঠেছে।
লাজারা বুদ্ধিমতী হলে কী হবে যথেষ্ট বদমেজাজি। কিন্তু তার হৃদয়টি কোমল। খাঁটি বৃষরাশিতে জন্ম বলে তার ধারণা মানুষের জীবনে গ্রহনক্ষত্রের প্রভাব অপরিসীম। এ বিষয়ে তার নিজের গণনার যথার্থতা সম্পর্কে সে যথেষ্ট আস্থাশীল। তার স্বপ্ন ছিল কোটিপতিদের ভাগ্য গণনা করে জীবনযাপন করবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। পারিবারিক প্রয়োজনে মাঝে মধ্যেই তাকে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়। ধনী গৃহিনীদের ফরমায়েশ অনুযায়ী রান্না করেই তার যত উপার্জন। অতিথিদের কাছ থেকে নিজেদের রান্নার প্রশংসা আদায় করা ধনী মহিলাদের ভীষণ পছন্দ বলেই তার এই উপার্জনের পথটি খুলে গেছে।
হোমেরো এতই নিরীহ প্রকৃতির যে মাঝে মাঝে তাকে সহ্য করা লাজারার কঠিন হয়ে পড়ে। বেচারির উপার্জনও সামান্য আর কোনও উচ্চাকাক্সক্ষাও নেই। তবুও লাজারা হোমেরোকে বাদ দিয়ে কিছুই ভাবতে পারে না। কারণ, হোমেরো খুবই সরল মনের মানুষ আর তার কিছু সঙ্গীসাথী আছে যারা বেশ ক্ষমতাধর মানুষ।
মোটামুটি স্বচ্ছলভাবে তাদের দিনগুলো কেটে গেলেও অবস্থা ক্রমশই সঙ্গিন হয়ে উঠছে। ছেলেময়েরা বড় হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি যখন এদেশে এলেন সেই সময়ে পাঁচ বছর ধরে গড়ে তোলা সঞ্চয়ে তাদের হাত পড়েছে। পরিচয় লুকিয়ে গোপন রোগী হিসেবে রাষ্টপতিকে হাসপাতালে দেখার পর হোমেরোরা যেন আশার আলো দেখতে পেল।
তবে ঠিক কী চাইবে বা কোন অধিকারে চাইবে সে বিষয়ে তারা তেমনভাবে মনস্থির করতে পারেনি। প্রথমে ভেবেছিল রাষ্ট্রপতির দাফন-কাফনের ব্যাপারটা নিজেরাই সামলে নেবে। মৃতদেহে সুগন্ধি লেপন করা থেকে শুরু করে স্বদেশে কফিনবন্দি দেহ পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সবকিছু তারাই করবে। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারে রাষ্ট্রপতির মৃত্যু যত তাড়াতাড়ি হবে বলে মনে হচ্ছিল, তত তাড়াতাড়ি ঠিক হবার নয়। নেমন্তন্নর দিনে সন্দেহটা আরও ঘনীভূত হলো।
আসলে হোমেরো কখনও বিশ্ববিদ্যালয় ব্রিগেড বা অন্য কোনও গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেয়নি। নির্বাচনী প্রচারের সময় যখন ফোটো তোলা হতো তখন শুধু সে নিয়ম করে ঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়তো যাতে ছবিতে তাকে দেখা যায়। বাড়ির বাজে কাগজের স্তূপ ঘাটাঘাটি করার সময় এরকম একটা পুরোনো ছবি আচমকা তাদের হাতে চলে আসে। তবে তার আগ্রহে কোনও ঘাটতি ছিল না; এবং এটাও সত্যি যে সে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। কেননা, সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নামা অসংখ্য মানুষের সেও ছিল একজন। তবে দেশত্যাগের বহুদিন পরেও সে জেনেভাতেই রয়ে গেছে। মনের জোর কম বলেই সে জেনেভা ছেড়ে যায়নি। অতএব দু’একটা মিথ্যা কথা বলে যদি রাষ্ট্রপতির নজর কাড়া যায় তো ক্ষতি কী! লা গ্রোত্তেসের মতো একটা নির্জীব আনন্দহীন এলাকা - যেখানে এশিয়া মহাদেশ থেকে আসা শরণার্থী আর দেহপসারিনীরা থাকে, সেখানে দেশান্তরিত এমন একজন বিশিষ্ট মানুষকে দেখে তারা দুজনেই রীতিমতো বিস্মিত। তার ওপর তিনি একলাই থাকছেন একটা চতুর্থ শ্রেণির হোটেলে আর খাওয়াদাওয়া সারছেন সস্তা রেস্তোরাঁয়। অথচ ব্যর্থ রাজনীতিকদের জন্যে যোগ্য বাসস্থানের অভাব নেই জেনেভায়। দিনের পর দিন এইভাবে তাঁর বেঁচে থাকার প্রক্রিয়া হোমেরো সন্তর্পণে খেয়াল করেছে। রাষ্ট্রপতিকে সে চোখে চোখে রেখেছে এবং যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে খুব কাছ থেকে তাকে অনুসরণ করেছে। এমনকী শহরের ভাঙাচোরা পুরোনো দেওয়াল ঘেঁষে ফুটে থাকা জুঁইফুলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে তিনি যখন নৈশ ভ্রমণ সারেন, তখনও হোমেরো পিছু ছাড়ে না। কালভিনের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি যখন চিন্তামগ্ন, তখনও তার দিকে সজাগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হোমেরো। গ্রীষ্মের স্বচ্ছ আকাশে ধীরে ধীরে মিলিয়ে আসা গোধূলির সৌন্দর্য গভীরভাবে দেখার জন্যে তিনি যখন বুর্গ-দে-ফুরের চূড়ায় উঠেছেন ,তখন জুঁইফুলের তীব্র সুবাসে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা সত্ত্বেও সে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে পায়ে পায়ে তাকে অনুসরণ করেছে। একদিন রাতে হোমেরো দেখল রুবিনস্তেইন কনসার্ট শোনার জন্যে ছাত্রদের সঙ্গে একই সারিতে দাড়িয়ে তিনি বছরের প্রথম বৃষ্টিতে ভিজছেন। গায়ে ওভারকোট নেই, হাতে নেই ছাতা। বাড়িতে ফিরে হোমেরো স্ত্রীকে বলল, ‘জানি না, কীভাবে নিউমোনিয়া থেকে রেহাই পেলেন তিনি।’ ঋতু পরিবর্তনের আগের শনিবার তাকে নকল সিল্কের কলার লাগানো একটা কোট কিনতে দেখা গেল। পলাতক আমিরেরা যেখানে কেনাকাটা করে, সেই রুয়ে দু রোনের তেমন কোনও চোখ ধাঁধানো দোকান থেকে নয়, আসন্ন হেমন্তকালের এই কোটটি কেনার জন্যে তিনি ফুটপাতের সস্তা দোকানগুলো বেছে নিয়েছিলেন।
‘আমাদের তাহলে কী হবে, হোমেরোর মুখ থেকে সব শুনে আর্তনাদ করে উঠল লাজারা। ‘আসলে ব্যাটা মহা হাড়কেপ্পন। দাতব্য প্রতিষ্ঠান মারফত অন্ত্যেঃষ্টির কথা মাথায় রেখে উনি বোধ হয় ভাবছেন বেওয়ারিশদের জন্যে সংরক্ষিত কোনও একটা কবরে হয়তো ওঁর জায়গা হয়ে যাবে। ওঁর কাছ থেকে কোনো কিছু পাওয়ার আশা করা উচিত নয়।’
‘হয়তো উনি খুবই গরিব’, হোমেরো বলে। ‘অনেকদিন ধরেই তো উনি একেবারে বেকার।’
‘আ-হা-হা! মীন রাশির দোসর আরেক মীন রাশি। অথবা তুমি একটা আকাট মুর্খ।’ লাজারা বিরক্তি প্রকাশ করে। ‘সকলেই জানে দেশের সব সোনা নিয়ে উনি পালিয়ে এসেছেন। আর মার্তিনিক থেকে নির্বাসিতদের মধ্যে উনিই সবচেয়ে ধনী।’ স্ত্রীর চাইতে হোমেরোর বয়স দশ বছর বেশি। খবরের কাগজের যে সব লেখা ছেলেবেলা থেকে হোমেরোকে প্রভাবিত করছিল সেগুলো থেকে সে জানে রাজমিস্ত্রির জোগালি হিসেবে কাজ করে রাষ্ট্রপতি জেনেভায় পড়াশোনার খরচ চালাতেন। অন্যদিকে তার সম্পর্কে বিরোধীদের গালমন্দ শুনতে শুনতে লাজারার বড় হয়ে ওঠা। অল্প বয়স থেকে বিরোধী মতের বিভিন্ন পরিবারে বুয়ার কাজ করে আসার সুবাদে সেই সব ধারণা তার আরও দৃঢ় হয়েছে। তাই বাড়ি ফিরে খুশিতে ডগমগ হয়ে দামি রেস্তোরাঁয় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের কাহিনি যেদিন হোমেরো শোনাল, লাজারা সেকথা বিশ্বাস করতে পারেনি। রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে অনেক কিছু চেয়ে পাওয়ার স্বপ্ন তাদের চোখে। ভেবেছিল, বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্যে আর্থিক সাহায্যের কথা বলবে অথবা হোমেরোর চাকরিতে উন্নতির জন্যে অনুরোধ জানাবে। অথচ হোমেরো কিছুই চায়নি শুনে লাজারা রীতিমতো স্তম্ভিত। তার ধারণা রাষ্ট্রপতি নিজের মৃতদেহ শকুন দিয়ে খাওয়াবেন। যথাযথভাবে মৃতদেহ সমাধিস্থ করার জন্যে কোনও খরচাপাতি করার ইচ্ছেই তার নেই। আবার স্বদেশে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত হওয়াও তার কাম্য নয়। এসব শুনে লাজারার সন্দেহ আরও ঘনীভূত হলো। সবশেষে হোমেরো বৃহস্পতিবার রাতে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে বাগদা চিংড়ির পোলাও খাওয়ার নেমন্তন্ন পাওয়ার সংবাদটি বলার পর থেকেই লাজারা প্রায় মূর্চ্ছা যাচ্ছিল। ‘হ্যাঁ, এটাই আমাদের দরকার’, লাজারা চিৎকার করে ওঠে। ‘ক্যানের চিংড়ি খেয়ে ব্যাটা এখানেই মরবে। আর বাচ্চাদের জন্যে গড়ে তোলা সঞ্চয় দিয়ে আমরাই ওকে কবর দেব।’
লাজারা এতকিছুর পরও দাম্পত্য আনুগত্যের কারণে হোমেরোর হঠকারিতাকে মেনে নিল। এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে খাবার পরিবেশন করার জন্যে ধার করে আনা হলো তিনটে রূপার বাসন আর একটা সালাদ রাখার কাচের পাত্র। অন্য একজনের কাছ থেকে কফি বানাবার ইলেকট্রিক কেটলি এবং তৃতীয় এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে এমব্রয়ডারি করা টেবিলক্লথ এবং কফি খাওয়ার কাপ ধার করা হলো। পুরোনো পর্দা খুলে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে কেটে গেল একটা পুরো দিন। ধুলো ঝাড়া হলো, বাড়ির যাবতীয় জিনিসপত্র টানাটানি করে তাদের জায়গা বদল করে ফেলা হলো। সম্মানিত অতিথিকে মুগ্ধ করার জন্যে যা যা প্রয়োজন, তাই করা হলো। তাকে যেন বোঝাতে হবে, দরিদ্র হলেও তারা আসলে অভিজাত শ্রেণির মানুষ। অর্থাৎ লাজারা যা করতে চেয়েছিল, বাস্তবে ঘটলো তার বিপরীত।
বৃহস্পতিবার রাতে সিঁড়ি বেয়ে ন’তলা পর্যন্ত উঠতে রাষ্ট্রপতির প্রায় দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। পরনে পুরোনো জিনিসের সস্তা মার্কেট থেকে কেনা একটা নতুন কোট। মাথায় সাবেকি কেতায় বানানো তরমুজের আকারের ঢাউস হ্যাট। লাজারার জন্যে একটা গোলাপ হাতে নিয়ে এভাবেই তিনি হোমেরোদের দরজায় এসে উপস্থিত হলেন। রাষ্ট্রপতির পুরুষোচিত চেহারা এবং যুবরাজের মতো আচরণে লাজারা তো রীতিমতো অভিভূত। এ সবের মধ্য তিয়েই লাজারা মিলিয়ে নিয়েছে--মানুষটি কপট ও লোভী। হয়তো কিছুটা শিষ্টাচারবর্জিত মানুষ। বাড়িটাকে চিংড়ির গন্ধমুক্ত রাখার জন্যে লাজারা জানালা খুলেই রান্না করেছিল। কিন্তু ঘরে ঢুকেই রাষ্ট্রপতি একটা গভীর নিঃশ্বাস টেনে, চোখ বন্ধ করে, দু’হাত ছড়িয়ে দিয়ে আবেগ মেশানো তৃপ্তির সুরে উচ্চারণ করলেন, ‘আঃ! একেবারে আমাদের সমুদ্রের গন্ধ।’ লাজারার ধারণার চাইতে মানুষটি অনেক বেশি কৃপণ না হলে একটামাত্র গোলাপ হাতে কেউ আসে? নিশ্চয়ই সরকারি বাগান থেকে চুরি করে এনেছে। দেওয়ালের কাগজগুলোর দিকে তাচ্ছিল্যভরা চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনে হলো মানুষটি যথেষ্ট উদ্ধত। অথচ ওইসব পুরোনো খবরের কাগজের টুকরোগুলোতে ছাপা ছিল রাষ্ট্রপতির নানা কীর্তিকাহিনির খবরাখবর। তখনকার নির্বাচনী প্রচারের প্রতীক ও পতাকাও ছাপা ছিল ওখানে। দেওয়ালের কাগজগুলো আটকাবার সময় হোমেরো তো আনন্দে ডগমগ। আর এখন, এই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিটিকে মনে হচ্ছে খুবই নিষ্ঠুুর প্রকৃতির একজন মানুষ। বারবারা বা লাজারাকে সম্ভাষণ পর্যন্ত করলেন না। অথচ তার জন্যে উপহারও রাখা ছিল। এর ওপর আবার খেতে বসে বললেন, দুটি জিনিস তার একেবারে অসহ্য। প্রথমত, কুকুর আর ছেলেপুলে। কথাটা শোনামাত্রই ঘেন্নায় লাজারার গা ঘিনঘিন করে উঠল। শুধুমাত্র ক্যারিবীয় আতিথেয়তার সৌজন্যে পরিস্থিতিটাকে সামাল দিল সে। লাজারার পরনে বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্যে তুলে রাখা আফ্রিকান গাউন। গলায় সান্তেরিয়া দানার মালা আর হাতে ব্রেসলেট। এতটুকু আতিশয্য না দেখিয়ে বা একটিও অবান্তর কথা না বলে সে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত। বিরক্তি প্রকাশ পায় বা ত্রুটি ধরা পরে, এমন কিছুই লাজারা করছেনা। লাজারার আপ্যায়নকে নিখুঁত বলা হলেও বোধ হয় কম বলা হবে।
চিংড়ির পোলাও মোটেও উপাদেয় খাবার নয়। তবুও যতটা সম্ভব যতœ নিয়ে রান্না করা হয়েছে। রান্নাটা যথেষ্ট সুস্বাদু হয়েছে। রাষ্ট্রপতিও দু’বার চেয়ে নিলেন। প্রশংসা করলেন। তৃপ্তির সঙ্গেই খেলেন পাকা কলার ভাজা টুকরোগুলো। আয়োকাদো সালাদও খেলেন। তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়ার সময় তিনি অবশ্য স্মৃতির সরণি বেয়ে দেশের কথায় ফিরে যাননি। লাজারা কেবল চুপ করে তাদের কথাবার্তা শুনছিল। সব শেষে মিষ্টি পরিবেশন করার সময় কোনও কারণ ছাড়াই হোমেরো ঈশ্বরের অস্তিত্ব সংক্রান্ত আলোচনার কানাগলিতে হাজির হলো।
‘আমি বিশ্বাস করি ঈশ্বর আছেন’, রাষ্ট্রপতি বললেন। ‘তবে মানুষের জীবনে তার কোনও হাত নেই।’
‘আমার অবশ্য গ্রহনক্ষেত্রে অগাধ বিশ্বাস’, বলেই লাজারা তীক্ষè দৃষ্টিতে রাষ্ট্রপতির প্রতিক্রিয়া কী হয় লক্ষ করতে চেষ্টা করলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার জন্মতারিখটা কি জানতে পারি?’
‘এগারোই মার্চ।’
যেন বিরাট একটা জয় হয়েছে এমন উল্লাস দেখিয়ে লাজারা চঞ্চল হয়ে বলে উঠলো, ‘জানতাম।’
তারপর গলায় খুশির ভাব ফুটিয়ে প্রশ্ন করল, ‘এক টেবিলে দুই মীনরাশির জাতককে দেখতে অস্বস্তি লাগছে না আপনার?’
তারা কিন্তু তখনও ঈশ্বর সংক্রান্ত আলোচনা করে চলেছেন। কফি বানাতে উঠে গেল লাজারা। এক ফাঁকে টেবিলটাও পরিস্কার করলো। সে মনে মনে চাইল, সন্ধেটা যেন ভালোভাবে কেটে যায়। কফি নিয়ে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে আসার সময় রাষ্ট্রপতির একটা মন্তব্য কানে আসায় স্তম্ভিত হয়ে গেল লাজারা। রাষ্ট্রপতি বলছেন, ‘বিশ্বাস করো, আমাকে যদি আবার দেশের রাষ্ট্রপতি করা হয় তাহলে আমাদের মতো গরিব দেশের পক্ষে সেটা ভয়ংকর খারাপ কাজ হবে।’
হোমেরো দেখলো ধার করে জোগাড় করা চিনামাটির কাপ আর রুপোর কফি-পাত্র নিয়ে দরজায় লাজারা উপস্থিত। দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি যেন মূর্ছা যাবে। রাষ্ট্রপতিও ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। তিনি বিনীতভাবে বললেন, ‘আমার দিকে অমন করে তাকাবেন না। আমি সত্যি কথাটাই বলেছি। নিজের বোকামির জন্যে আজ আমায় এত বড় মূল্য দিতে হচ্ছে।’
লাজারা কফি পরিবেশন করে টেবিলের আলোটা নিভিয়ে দিল। অত উজ্জ্বল আলো কথা বলার উপযোগী নয়। ঘরের মধ্যে একটা অন্তরঙ্গ ছায়াঘন পরিবেশ তৈরি হওয়ায় লাজারা এই প্রথম অতিথি সম্পর্কে আগ্রহ বোধ করলো। অতিথিটি নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমান। তবে তিনি তার বিষাদ ঢেকে রাখতে পারেননি। লাজারার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল, যখন রাষ্ট্রপতি কফি খাওয়া শেষ করে এমনভাবে পেয়ালাটা উপুড় করে পিরিচের ওপর রেখে দিলেন যাতে কফির গুঁড়ো সেখানে জমতে পারে।
রাষ্টপতি বললেন, নির্বাসনের জন্যে তিনি মার্তিনিক দ্বীপটিই বেছে নিয়েছিলেন। কারণ সেখানকার কবি আইমে সেজার তার বন্ধু। সেজারের লেখা ঘরে ফেরার খেড়ো খাতা নামের কবিতার বইটি তখন কেবল বেরিয়েছে। এই বন্ধুটিই তাকে নতুন করে জীবন শুরু করতে সাহায্য করেছিল। স্ত্রীর সম্পত্তির যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাই দিয়ে তিনি ফোর্ত-দে-ফ্রঁসেজের পাহাড়ে কাঠের তৈরি একটি দামি বাড়ি কিনেছিলেন। বাড়িটার জানালায় পর্দা ছিল, আর ছিল প্রাচীন জাতের ফুলগাছে ভরা একটা বারান্দা, যেখান থেকে সরাসরি সমুদ্র দেখা যেত। চিনির কল থেকে ভেসে আসা গুড় আর মদের গন্ধ মাতোয়ারা হাওয়ায় শরীর জুড়োতে জুড়োতে আর ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শুনতে শুনতে পরম আরামে ঘুমানো যেত তৃপ্তির ঘুম। রাষ্ট্রপতির থেকে চোদ্দো বছরের বড় ছিলেন তার স্ত্রী। তাদের প্রথম সন্তানের জন্মের পর থেকেই ভদ্রমহিলা পঙ্গু। লাতিন ভাষায় নতুন করে চিরায়ত সাহিত্য পড়া শুরু করেছিলেন বলেই তিনি ভাগ্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার শক্তি পেয়েছিলেন। এ সম্পর্কে তার বিশ্বাস এতটাই দৃঢ় ছিল যে তিনি ধরেই নিয়েছিলেন বারবার ওই সাহিত্য পড়াই তার একমাত্র কাজ। নির্বাচনে তার দল হেরে যাওয়ার পর দলের নেতৃত্ব বহুদিন পর্যন্ত তার কাছে নতুন নতুন আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তাব পাঠাত। কিন্তু তিনি সেই প্রলোভন জয় করেছিলেন। বললেন, ‘যখন বুঝতে পারলাম ওদের প্রস্তাবগুলো একেবারেই অসার। আজ যেটাকে ভীষণ জরুরি বলে মনে করছে সপ্তাহখানেক পরেই সেই পরিকল্পনার কিছুই মনে রাখছে না, এমনকি যে চিঠি লিখেছিল তাও ভুলে গেছে, তখন ঠিক করলাম, আর কোনও চিঠিই খুলব না। খুলিওনি।’
আবছা আলোয় তিনি লাজারার দিকে তাকালেন। সে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। লাজারার হাত থেকে রাষ্ট্রপতি জ্বলন্ত সিগারেটটা নিয়ে নিলেন। লম্বা একটা সুখটান দিয়ে ধোঁয়াটা গলায় চালান করে দিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় লাজারা বিমূঢ়। সে আরেকটা সিগারেট ধরাবার জন্যে দেশলাইয়ের বাক্স আর প্যাকেট হাতে তুলে নিল। লাজারা যখন এরকম আয়োজনে ব্যস্ত ঠিক তখনি তিনি জ্বলন্ত সিগারেটটা লাজারাকে ফিরিয়ে দিলেন।
তিনি বললেন, ‘চোখের সামনে অমন আয়েস করে কাউকে সিগারেট খেতে দেখলে লোভ দমন করা সত্যি কঠিন।’ এবার সিগারেটটা ফিরিয়ে দেওয়ার আগে গলার মধ্যে জমিয়ে রাখা ধোঁয়াটা আলতে করে শূন্যে ভাসিয়ে দিলেন। কাশির গমক এসে গেল তার। ‘অনেক দিন আগেই সিগারেটের নেশা ছেড়ে দিয়েছি’, বললেন তিনি। ‘ কোনো কেনো সময় অভ্যেসের কাছে আমি একেবারে হেরে যাই। যেমন এই এখন হারলাম।’
কাশির গমক তার পুরো শরীরটাকে হঠাৎ করে আরও বার দুয়েক ঝাঁকিয়ে দিল। শুরু হলো ব্যথাটা। ছোট পকেটঘড়িটি দেখে নিলেন রাষ্ট্রপতি। সন্ধের সময় যেসব ওষুধ খাওয়ার কথা সেগুলো খেয়ে নিলেন। এবার ঝুঁকে পরে কাপের তলানিটা দেখলেন। কিছুই পালটায়নি। তবে এবার আর তিনি কেঁপে উঠলেন না।
‘আমার সমর্থকদের মধ্যে কেউ কেউ পরে রাষ্ট্রপতি হয়েছিল’, বললেন তিনি।
হোমেরো ধরিয়ে দেয়, ‘সায়াগো।’
‘শুধু সায়াগো কেন, অন্যেরাও’, তিনি বললেন। ‘সকলেই জোর করে আমাদের সমর্থন আদায় করেছে। আমাদের এটা প্রাপ্য ছিল না। এই দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্যতাও আমাদের ছিল না। ছিল কেবল ক্ষমতার লোভ। বেশিরভাগের প্রত্যাশা অবশ্য এর থেকেও কম ছিল। তাই চাইতো শুধু একটা চাকরি।’
লাজারা রীতিমতো ক্রুদ্ধ। তার জিজ্ঞাসা, ‘আপনি জানেন, ওরা আপনার সম্পেের্ক কী বলে?’
হোমেরো আতঙ্কিত হয়ে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেয়। ‘না, না, ওরা মিথ্যে কথা বলে।’
‘মিথ্যে আবার মিথ্যে নয়ও।’ রাষ্ট্রপতির কণ্ঠস্বর স্বর্গীয় প্রশান্তিতে ভরা। ‘রাষ্ট্রপতি যখন বিষয় হয়, তখন সবচেয়ে কলঙ্কিত কাহিনিও সত্যি বা মিথ্যে দুই-ই হতে পারে।”
নির্বাসনের পুরো মেয়াদটাই প্রেসিডেন্ট কাটিয়েছেন মার্তিনিক দ্বীপে। সরকারি কাগজপত্র মারফত যে সামান্য খবরটুকু পৌঁছাতো, সেইটুকুই ছিল বাইরের জগতের সঙ্গে তার একমাত্র যোগসূত্র। সরকারি বিদ্যালয়ে হিস্পানি ও লাতিন পড়িয়ে চলতো তার ভরণপোষণ। আর আইমে সেজার বিভিন্ন সময়ে তাকে যেসব অনুবাদের কাজ দিতেন, তা দিয়েই তার পেট চলত। আগস্ট মাসে যখন গরম অসহনীয় হয়ে উঠতো তখন তিনি দোলখাটানো চৌকিতে দুপুর পর্যন্ত শুয়ে থাকতেন। কানে আসত শোয়ার ঘরের পাখার ভোঁ ভোঁ শব্দ।
দিনের বেলার অসহনীয় গরমে তার স্ত্রী পোষা পাখিদের খাওয়ানোর জন্য বেরোতেন। তার মাথায় থাকতো একটা সাধারণ শনের টুপি। টুপিটার চওড়া কিনারটি নকল ফল আর অরগ্যান্ডি ফুল দিয়ে সাজানো ছিল। পাখিগুলো ঘরের বাইরে খোলা জায়গায় স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতো। দুপুরের তাপ কমে যাওয়ার পর ঠা- বাতাসে বসে থাকাটা ছিল বেশ আরামদায়ক। অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি সমুদ্রের দিকে নির্নিমেষভাবে তাকিয়ে বসে থাকতেন । আর তার স্ত্রী, যার মাথায় থাকতো ছেঁড়া টুপি, হাতের প্রতিটি আঙুলে শোভা পেত ঝলমলে পাথরের আংটি। তিনি দোলায়িত চেয়ারে বসে একদৃষ্টিতে দেখতেন জাহাজের আসা-যাওয়া। দেখতেন এই পৃথিবীরই সব জাহাজ।
‘ওই জাহাজটা পুয়েন্তো সান্তোর’, এভাবে তিনি বলে ফেরতেন। ‘কী পরিমানে কলা বোঝাই করেছে দেখ! নড়তেই পারছে না’, বলতেন তিনি। তার পক্ষে ভাবা সহজ ছিল না, তাঁর দেশের নয় এমন জাহাজ ওই পথ দিয়ে যেতে পারে। স্ত্রীর এইসব কথাবার্তা না শোনার ভান করতেন রাষ্ট্রপতি। যদিও শেষ পর্যন্ত তার স্বামী যা ভুলতে পেরেছিলেন, তিনি তার তুলনায় আরও অনেক কিছু ভুলে যেতে পেরেছিলেন। কেননা ভদ্রমহিলার স্মৃতিভ্রংশ হয়। এভাবে তারা সমুদ্রের ধারে বসে সময় কাটাতেন। গোধূলির কোলাহল থেমে গেলে মশার উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য ঘরে ফিরে যেতেন।
এমনি এক আগস্টের দিনে বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়তে পড়তে চমকে উঠলেন রাষ্ট্রপতি।
তিনি বললেন, ‘কী আশ্চর্য, আমি নাকি এস্তোরিলেই মরে গেছি।’ তার স্ত্রী ঝিমুচ্ছিলেন। খবরটা শুনে ভয়ে চমকে উঠলেন। পত্রিকার পঞ্চম পৃষ্ঠার এক কোনায় ছ’ লাইনের একটা খবর। অথচ এই সংবাদপত্রেই তার অনুবাদকর্ম মাঝে মাঝে প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার ম্যানেজার মাঝে মাঝে এসে তার সঙ্গে দেখাও কওে গেছেন। আর সেই পত্রিকাতেই কিনা এখন লেখা হচ্ছে তিনি মারা গেছেন এস্তোরিল দি লিসবোঁতে। এই এলাকাতেই ইয়োরোপ পতনের পর যারা আশ্রয় নিয়েছিল, সেইসব মানুষদের আশ্রয় ও বসবাসস্থল। অথচ কী কা-, ওই এলাকাতে তিনি কখনও যাননি। সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র স্থান যেখানে তিনি মারা যেতে চান না।
শেষ পর্যন্ত যেটুকু স্মৃতি তার অবশিষ্ট ছিল, বিশেষ করে একমাত্র সন্তানের স্মৃতির যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে এর বছরখানেক বাদে তাণ্ডার স্ত্রী মারা যান। পিতাকে পদচ্যুত করার ব্যাপারে এই ছেলেও অংশ নিয়েছিল। পরে অবশ্য নিজের দলের লোকের হাতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে সে মারা যায়।
রাষ্ট্রপতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ‘এই তো আমাদের অবস্থা। কোনকিছুই রক্ষা করতে পারবে না আমাদের’, বললেন তিনি। ‘পৃথিবীর আবর্জনা থেকে জন্ম নিয়েছে একটা মহাদেশ। সেখানে মুহূর্তের জন্যেও কোনো ভালোবাসা অবশিষ্ট ছিল না। নারীহরণ, ধর্ষণ, অত্যাচার, যাবতীয় নিন্দনীয় কাজ, প্রতারণা আর শত্রুর সঙ্গে শত্রুর সংযোগে জন্ম নেয় সেখানকার এক-একটি সন্তান।’ তিনি খেয়াল করলেন, লাজারার আফ্রিকান চোখ দুটি তীব্র দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। সুনিপুন বাগ্মিত দিয়ে অন্যকে প্রভাবিত করার বহুকালের পুরোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করে তিনি লাজারাকে জয় করবার চেষ্টা করলেন। বললেন, ‘বর্ণসংকরের অর্থ হলো চোখের পানির সঙ্গে ছলকে পড়া রক্তের মিলন। এমন বিষক্রিয়া থেকে কীই-বা পাওয়া যেতে পারে?’
মৃত্যুর মতো নীরবতা সেখানে নেমে এলো। সকলেই স্তব্ধ, নির্বাক। লাজারাই যেন স্তব্ধ করে রেখেছে সকলকে। অনেকক্ষণ। মধ্যরাত্রির খানিক আগে লাজারা সংবিৎ ফিরে পেল। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে চুমু দিয়ে সে রাষ্ট্রপতিকে বিদায় জানালো। হোমেরো তাকে হোটেলে এগিয়ে দিতে চাইলো। রাষ্ট্রপতি রাজি হলেন না। ট্যাক্সি করে দেবে বলে কোনো বাধা না মেনে হোমেরা তার সঙ্গে গেল।
বাড়ি ফিরে এলে হোমেরোর স্ত্রী রাগে ফেটে পড়লো, ‘তিনিই পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্রপতি যাকে গদি থেকে হটিয়ে দিয়ে ঠিক কাজটাই করা হয়েছে। কুত্তার বাচ্চা একটা।’
হোমেরো তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেও বাকি রাতটা তারা না ঘুমিয়ে সাংঘাতিকভাবে কাটিয়ে দিল। লাজারা স্বীকার করলো, এ পর্যন্ত সে যত মানুষ দেখেছে তার মধ্যে এই মানুষটিই সবচেয়ে সুদর্শন। এমনই তার সম্মোহিনী শক্তি যে তোমাকে সে একেবারে শেষ করে দেবে। ষাঁড়ের মতো পৌরুষ তার। ‘এই এখন তার যা অবস্থা--বুড়োহাবড়া এবং নিঃশেষ হতে চলেছেন--তবু এখনও বিছানায় মানুষটি বাঘের শক্তি ধরে’, লাজারা জানায়। কিন্তু হোমেরার ধারণা, এইসব ঈশ্বরপ্রদত্ত গুণাবলি তিনি ভণ্ডামি করে নষ্ট করেছেন। সাধু থাকার ভান হোমেরার তাই অসহ্য লাগছিল। কেননা লাজারা তো নিশ্চিতভাবেই জানে মার্তিনিকের অর্ধেক আখের খেতের মালিক ছিলেন তিনি। আর ক্ষমতার প্রতি তার অনাগ্রহ? এও এক ভ-ামি। একথা তো স্পষ্ট যে, রাষ্টপতি হওয়ার জন্যে সর্বস্ব দিতে প্রস্তুত তিনি। আর একবার রাষ্ট্রপতি হতে পারলে দীর্ঘকালের জন্যে তিনি ওই পদ আঁকড়ে থাকবেন যাতে তার শত্রুদের কবর দেয়া যায়।
‘আর যেসব কথা তিনি বলে গেলেন’, লাজারা বললো, ‘তা শুধু এই জন্যে যাতে পায়ের কাছে বসে আমরা তার বন্দনা করি।’
‘তাতে তার কী লাভ?’ হোমেরো প্রশ্ন করে।
‘কিছুই নয়’, লাজারা জবাব দেয়। ‘মানুষকে সম্মোহিত করাটা একটা নেশা। এটা কাটানো মুশকিল।’
লাজারা এমন রেগে রয়েছে যে হোমেরোর পক্ষে তাকে বিছানায় সহ্য করা কষ্টকর হয়ে উঠলো। ফলে বাকি রাতটা বসবার ঘরের সোফায় একটা কম্বল জড়িয়ে শুয়ে থাকল সে। মাঝরাতে লাজারাও জেগে গেল, আপাদমস্তক নগ্ন; এইভাবেই সে ঘুমোতে অভ্যস্ত। অথবা বাড়িতে যখন যে একা থাকে, এভাবেই থাকে। আপন মনে বেচারি গজগজ করতে থাকে, সেই একই বিষয়ে। লাজারার ইচ্ছে করছে এক ধাক্কায় সেই ঘৃণ্য নৈশভোজের সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেলতে। সকাল হতে না হতেই ফিরিয়ে দিল ধার করে আনা যাবতীয় জিনিসপত্র। নতুন পর্দাগুলো খুলে ফেলে টাঙিয়ে দিল পুরোনো পর্দা। বাড়িঘরের চেহারায় ফিরে এলো আগেকার দারিদ্র্যখচিত সুরুচির ছাপ। একটানে খুলে ফেলে চিরকালের মতো আবর্জনার ঝুঁড়িতে ছুঁড়ে ফেলে দিল দেওয়ালে আটকানো সংবাদপত্রের সেইসব টুকরোগুলো, যাতে ছাপা আছে অতীদের সেই জঘন্য নির্বাচনী প্রচারের খবর-ছবি-প্রতীক-পতাকা। এরপরই সে চিৎকার কওে বলে উঠলো, ‘গোল্লায় যাক সব।’
নৈশভোজের সপ্তাহখানেক বাদে হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় হোমেরোর চোখে পড়ল রাষ্ট্রপতি তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হোমেরোকে সঙ্গে করে তিনি হোটেলে নিয়ে গেলেন। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে চারতলার ওপর চিলেকোঠায় পৌঁছুলেন। ঘুলঘুলির মতো একচিলতে জানালা দিয়ে ঘোলাটে আকাশ দেখা যাচ্ছে। ঘরের ভেতর টাঙানো দড়িতে শুকোচ্ছে কাপড়চোপড়। ঘরের অর্ধেকটা জুড়ে রয়েছে একটা বিশাল খাট। রয়েছে একটা কাঠের চেয়ার, বিবর্ণ আয়না লাগানো সাদামাটা একটা আলমারি এবং হাত-মুখ ধোয়ার বেসিন। রাষ্ট্রপতি লক্ষ করলেন হোমেরোর প্রতিক্রিয়া।
‘ছাত্রাবস্থায় এই খুপরিতেই আমি থাকতাম।’ ক্ষমা চাইবার ভঙ্গিতে অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে তিনি বললেন, ‘ফোর্ত-দে-ফ্রঁসেজ থেকে আগেই এটা ভাড়া করে রেখেছিলাম।’
এবার ভেলভেটের একটা থলি তিনি বিছানার ওপর উপুড় করে দিতেই ছড়িয়ে পড়লো বেশকিছু গয়নাগাটি। তার সম্পদের সামান্য অবশেষ। নানা রকমের দামি মণিমুক্তা বসানো কয়েকটা সোনার ব্রেসলেট, একটা তিন লহরির মুক্তোর নেকলেস, দামি পাথর বসানো দুটো সোনার নেকলেস, সাধুসন্তের ছবি লাগানো লকেটসহ তিনটে সোনার হার এবং তিন জোড়া সোনার দুল। এগুলোর মধ্যে একজোড়ায় পান্না, আরেক জোড়ায় হিরে এবং বাকি জোড়ায় চুনি বসানো। আরো আছে, উপাসনায় ব্যবহৃত হয় এরকম জিনিসপত্র রাখার দুটো বাক্স এবং একটা লকেট। নানা ধরনের দামি মণিমানিক্যখচিত এগারোটা আংটি। রানিদের উপযুক্ত একটা হিরের টায়রা। একটা বাক্স থেকে বেরলো তিন জোড়া রুপোর আর দু’জোড়া সোনার কাফলিঙ্ক। সেই সঙ্গে মানানসই টাইপিন আর সোনার পাতে মোড়া একটা সোনার ঘড়ি। তারপর একটা জুতোর বাক্স থেকে বের করলেন ছটা পদক। পদকগুলোর মধ্যে দুটো সোনার, একটা রুপোর আর তিনটে একটু সস্তা ধরনের। ‘এই হল আমার শেষ সম্বল,’ জানালেন তিনি।
এইসব গয়নাগাটি বিক্রি করে চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে হবে তাকে। এছাড়া তার সামনে আর অন্য কোনও পথ খোলা নেই। হোমেরাকে তিনি অনুরোধ করলেন সে যেন বুঝেশুনে এগুলো ঠিকঠাক দামে বিক্রি করে দেয়। হোমেরো অবশ্য তখন ভাবছে আসল রশিদ ছাড়া এগুলো কী করে বিক্রি করবে। রাষ্ট্রপতি জানালেন, পিতামহীর কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে তার স্ত্রী এইসব গয়নাগাটি পেয়েছিলেন। সময়টা ছিল উপনিবেশের যুগ। কলোম্বিয়ার সোনার খনির একাংশের মালিকানা ছিল তার স্ত্রীর পিতামহীর। তিনি আবার উত্তরাধিকার সূত্রে এগুলো পেয়েছিলেন। তবে ঘড়িটা, কাফলিঙ্ক আর টাইপিনগুলো তার নিজের। পদকগুলোও অবশ্য উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া নয়।
‘কারও কাছে কি এইসব জিনিসের রসিদ থাকে?’ হোমেরো কিন্তু রাজি হলো না। ‘তাহলে’, রাষ্ট্রপতির গলায় অসন্তোষের সুর স্পষ্ট। ‘আমি নিজেই তবে চেষ্টা করে দেখি।’ সুবিবেচনার পরিচয় দিয়ে কোনোরকম উত্তেজনা ছাড়াই একে একে অলংকারগুলো তিনি গুছিয়ে তুলতে লাগলেন। বললেন, ‘তুমি কিন্তু কিছু মনে করো না, হোমেরা। তুমি আমার প্রিয় মানুষ। তোমায় বলি, গরিব হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রপতির মতো দরিদ্র আর কেউ নয়। এমনকি এখন বেঁচে থাকতেও ঘৃণা হয়।’ এবার তিনি হোমেরোর হৃদয় স্পর্শ করলেন। হোমেরো রাষ্ট্রপতির প্রতি তাক করা তার অস্ত্র নামিয়ে নিল।
লাজারার বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। বিছানার ওপর ঝকঝক করতে থাকা গয়নাগুলি দরজা থেকেই তার নজরে এসেছে। তার মনে হলো বিছানার ওপর একটা কাঁকড়া অথবা বিচ্ছু যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে।
‘এতটুকু বুদ্ধি নেই তোমার? এগুলো এখানে এনেছ কেন?’ লাজারার কষ্ঠস্ব রীতিমতো ভয়ার্ত।
হোমেরোর ব্যাখ্যা শুনে সে আরও ভয় পেয়ে গেল। বিছানায় বসে জহুরির চোখে একটি একটি করে প্রতিটি গয়না খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। তারপর একসময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘এ যে বিরাট সম্পত্তি।’ এবার সে তাকায় হোমেরোর দিকে। কিন্তু উভয় সংকট থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পায় না।
‘দুত্তোরি’ মন্তব্য করে লাজারা বলে, ‘লোকটা সব সত্যি বলেছেন কিনা কী করে বুঝবো?’
‘কেন নয়’, জবাবে হোমেরো প্রশ্ন করে। ‘এইতো দেখে এলাম নিজের জামাকাপড় উনি নিজেই কাচেন। আমাদের মতোই ঘরের মধ্যে দড়ি টানিয়ে শুকোতে দিয়েছেন।’
‘কারণ ওঁর দৃষ্টিটা নিচের দিকে’, লাজারার স্পষ্ট কথা।
‘অথবা উনি খুবই গরিব’, হোমেরো প্রেসিডেন্টের পক্ষে সাফাই গায়।
লাজারা গয়নাগুলো আবার পরীক্ষা করে দেখলো। রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে সে একটু দুর্বল হয়ে পড়েছে। পরদিন সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটি পরার পর বেছে বেছে সেই গয়নাগুলো দিয়েই নিজেকে সাজাল যেগুলো দেখে বেশি দামি মনে হয়। সবকটা আঙুলে, এমনকি বুড়ো আঙুলেও গলিয়ে দিল আংটি। দু’হাতে পরে নিল সবগুলো ব্রেসলেট। এবার শুরু হলো বিক্রয় অভিযান। ‘দেখা যাক, লাজারা ডেভিসের কাছে কে রসিদ চায়।’
ঠিক দোকানটিই বেছে নিয়েছে লাজারা। তেমন দামি নয়, তবে জাঁকজমকে ত্রুটি নেই। সে জানে এইসব দোকানে গয়নাগাটি কেনাবেচার সময় কেউ বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করে না। দোকানের ভেতরে সে ঢুকল ভয়ে ভয়ে কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে।
সান্ধ্যা পোশাক পরিহিত রোগাটে চেহারার একজন ফ্যাকাশে-মতো কর্মচারী নাটকীয় ভঙ্গিতে নিচু হয়ে লাজারাকে অভিবাদন জানালো। তার হাতে চুমু খেয়ে কর্মচারীটি জিজ্ঞাসা করলো, কীভাবে লাজারাকে সে সাহায্য করতে পারে। আলোয় ঝলমলে দোকানটার চারদিকই আয়না দিয়ে মোড়ানো। দোকানের ভিতরটা তাই দিনের চেয়েও উজ্জ্বল। মনে হচ্ছে পুরো দোকানটাই হিরে দিয়ে গড়া। লাজারা কর্মচারীটির দিকে না তাকিয়ে তাকে অনুসরণ করে চলে গেল দোকানের পিছন দিকে। পাছে ফাঁকিটা ধরা পড়ে যায় ভেবে লাজারা ভীষণ ভীত।
দোকানের কাউন্টার হিসেবে লুই পঞ্চদশ আমলের প্রচলিত নকশার তিনটি টেবিল সাজানো আছে। সেখানেই লাজারাকে বসতে বললো। কর্মচারীটি টেবিলের ওপর পরিষ্কার একটা কাপড় পেতে দিল। তারপরে লাজারার মুখোমুখি বসে সে প্রতীক্ষা করতে লাগলো।
‘কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি’, কর্মচারীটি আবার বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করলো।
আংটি, ব্রেসলেট, দুল অর্থাৎ যে সমস্ত গয়না গায়ে পরা ছিল, সেগুলো খুলে ফেলে টেবিলের ওপর সাজিয়ে দিয়ে লাজারা জানতে চাইল, ‘এগুলোর আসল দাম কত?’ জহুরি একটা কাচ বাঁ চোখের সামনে রেখে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগারের নীরবতা নিয়ে অলংকাগুলি খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলো। অনেকক্ষণ ধরে দেখার পর পরীক্ষা করতে করতেই সে প্রশ্ন করে, ‘আপনি কোত্থেকে আসছেন?’ এরকম কোনো প্রশ্নের জন্যে লাজারা আদৌ প্রস্তুত ছিল না।
‘অ্যাঁ! অনেক দূর থেকে।’
‘সে আমি বুঝতে পেরেছি’, মন্তব্য করেই জহুরি আবার নীরব হয়ে গেল। ওদিকে লাজারার সোনালি দুটি চোখ তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। জহুরি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে হিরের টায়রাটা দেখে নিয়ে অন্য গয়নাগুলো থেকে সেটাকে আলাদা করে রাখলে লাজারা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো।
‘আপনার যে কন্যা রাশি সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই’, লাজারা মন্তব্য করে। হাতের কাজ গুটিয়ে না রেখে জহুরি পালটা প্রশ্ন করে, ‘কী করে বুঝলেন?’
‘আপনার ধরন দেখে’, লাজারার পরিষ্কার জবাব।
কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত জহুরি কোনও মন্তব্য করলো না। তারপর একেবারে সূচনাপর্বের মতো শিষ্টাচার বজায় রেখে অত্যন্ত সন্তর্পণে লাজারাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এগুলো কোথায় পেলেন?’
‘আমার দিদিমার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া’, লাজারার সতর্ক উত্তর। তার কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় টানটান। ‘গত বছর পারামাইবোয় সাতানব্বই বছর বয়সে তিনি মারা গেছেন।’
কথাটা শোনার পর লাজারার চোখে চোখ রেখে জহুরি মন্তব্য করলো, ‘আমি খুবই দুঃখিত।’
টায়রাটা আঙুল দিয়ে তুলে ধরে জহুরি জানালো, ‘এটার শুধু সোনাটুকুর দাম পাওয়া যাবে।’ উজ্জ্বল আলোয় টায়রাটা চকচক করছে। মনে হচ্ছে এটা খুবই প্রাচীন মিশরীয় গয়না। হিরেগুলোর অবস্থা ভালো হলে এটা একটা মহামূল্যবান গয়না হতে পারতো। তবে এর একটা ঐতিহাসিক মূল্য আছে। অন্যান্য গয়নার সমস্ত পাথর নকল। আসলগুলো নিশ্চয়ই ভালো ছিল।’
জহুরি গয়নাগুলো গুছাতে গুছাতে বলেন, ‘আসলে পুরুষানুক্রমে এগুলো এতবার হাতবদল হয়েছে যে আসল পাথরগুলো হারিয়ে গেছে আর তার বদলে সস্তা কাচ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
কথাগুলো শুনে লাজারার কেমন যেন বিবমিষা হয়। মনের ভিতর জেগে ওঠা আতঙ্ককে সে কোনোরকমে চাপা দেয়। জহুরি তাকে সন্ত¡না দিয়ে বললো, ‘অনেক সময়ই এরকম হয়।’
আশ্বস্ত হয়ে লাজারা বললো, ‘আমি জানি, সেইজন্যেই তো এগুলোর হাত থেকে মুক্তি পেতে চাই।’
নিজের কঠিন অবস্থার কথা অনুভব করার পর আবার নিজের আসল চেহারায় ফিরে যায় লাজারা। একটুও দেরি না করে হাতব্যাগ থেকে কাফলিঙ্ক, পকেটঘড়ি, টাইপিন, রুপো ও সোনার পদক এবং রাষ্ট্রপতির অন্যান্য ব্যক্তিগত ছোটখাটো গয়নাগুলো বের করে টেবিলের ওপর রাখে।
‘এগুলোও?’ জহুরি প্রশ্ন করে।
লাজারা জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ, সব।’
দাম হিসেবে লাজারা সুইস ফ্রাঁর যে নোটগুলো পেল সেগুলো এতই নতুন যে মনে হচ্ছে এর ছাপগুলো এখন সজীব আছে, আঙুলে লেগে না যায়! বিলগুলো সে গুণেও নিল না। একইরকম সম্ভ্রম আর ভদ্রতার সঙ্গে জহুরি লাজারাকে দরোজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। কাচের দরজাটা খুলে ধরে লাজারাকে একটু দাঁড় করিয়ে সে বললো, ‘আমার কিন্তু কুম্ভরাশি।’
সন্ধ্যা গড়িয়ে যাওয়ার আগেই লাজারা আর হোমেরো সদ্য পাওয়া নোটগুলো নিয়ে হোটেলে গেল। হিসেবনিকেশ করে দেখা গেল এখনও কিছু কম পড়ছে। রাষ্ট্রপতি এবার বিয়ের আংটি, চেন লাগানো পকেটঘড়ি, কাফলিঙ্ক, টাইপিন এক কথায় তার গায়ে দামি যা কিছু ছিল, সব খুলে বিছানার ওপর রাখতে লাগলেন।
লাজারার বিছানার ওপর থেকে বিয়ের আংটিটা তার হাতে তুলে দিয়ে বললো, ‘এটা নয়। এমন স্মৃতিচিহ্ন বেচা ঠিক নয়।’
প্রস্তাবটা মেনে নিলেন রাষ্ট্রপতি। সেটা আবার আঙুলে পরে নিলেন। চেন লাগানো পকেটঘড়িটাও লাজারা ফিরিয়ে দিয়ে বললো, ‘এটাও নয়।’
এবার রাষ্ট্রপতি আপত্তি করলেন। কিন্তু লাজারা তাকে সেটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো, ‘সুইজারল্যান্ডে পুরোনো ঘড়ি কে কিনবে?’
‘কেন আমরাই তো বেচেছি’, হোমেরো বলবার চেষ্টা করে।
লাজারা হোমেরোকে সংশোধন করে দিয়ে জানাল, ‘হ্যাঁ, কথাটা ঠিক। তবে ঘড়ি নয়, আমরা বেচেছিলাম ঘড়ির সোনাটুকু।’
‘এটাও সোনার’, রাষ্ট্রপতি বললেন।
‘সোনার? তাহলে আর কী!’ লাজারা জোর দিয়ে বললো, ‘অপারেশন না করালেও আপনার চলতে পারে, কিন্তু কখন ক’টা বাজল, না জানলে চলবে না।’
তার সোনার ফ্রেমের চশমাটাও লাজারা নিল না। অথচ আরেক জোড়া কচ্ছপের খোলের চশমা প্রেসিডেন্টের আছে। জিনিসগুলো হাতে তুলে লাজারা আন্দাজ করার চেষ্টা করলো। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে বললো, ‘এতেই হয়ে যাবে মনে হয়।’
বেরিয়ে আসার আগে ঘরের দড়িতে টাঙানো ভেজা জামা-কাপড়গুলো রাষ্ট্রপতির অনুমতি না নিয়েই গুছিয়ে ণিল লাজারা। বাড়িতে গিয়ে ওগুলোকে ইস্তিরি করে আবার ফিরিয়ে দেবে। মোটর সাইকেলে চেপে লাজারাদম্পতি বাড়ির পথে পা বাড়ালো। হোমেরো চালাচ্ছে আর লাজারা দু’ হাতে হোমেরোর কোমর জড়িয়ে বসে আছে পিছনের সিটে। রক্তিম বেগুনি গোধুলিতে একটা দুটো করে রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। গাছের শেষ পাতাটাও হাওয়ায় উড়ে গেছে। ন্যাড়া গাছগুলোকে দেখাচ্ছে জীবাশ্মের মতো। রাস্তায় সংগীতের সুরলহরি ছড়িয়ে দিতে দিতে একটা ট্রাক চলে গেল। আসলে ট্রাকের ভিতরে রেডিওতে পুরোদমে বাজছে জর্জ বাসেনসের এটা পরিচিত গান, হে আমার প্রিয়তমা, শক্ত রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলাম / ওখান দিয়ে সময় যাবে বলে / হায়, আটিলার মতো বর্বর সময়! / তার ঘোড়া যায় সেই পথ দিয়ে / প্রেম যেখানে যায় শুকিয়ে।
ওরা দুজনেই নির্বাক। গানের কথা আর সুরে পুরোপুরি সম্মোহিত। তাদের স্মৃতিতে ভেসে উঠলো শাপলা ফুলের গন্ধ। খানিক বাদে লাজারার মনে হলো দীর্ঘ নিদ্রা থেকে সে বুঝি জেগে উঠছে।
‘যেতে দাও।’
হোমেরো প্রশ্ন করে, ‘কী?’
‘বেচারা বুড়ো মানুষ’, লাজারা উত্তর দেয়। কী জঘন্য জীবন বেচারার।’
পরের শুক্রবার সাতই অক্টোবর একটানা সাত ঘণ্টা ধরে রাষ্ট্রপতির অপারেশন হলো। তখনকার মতো মনে হলো, আগেকার মতোই সবকিছু বোধ হয় অন্ধকারেই থেকে যাবে। সত্যি কথা হলো, তার বেঁচে থাকার খবরটা জানতে পারাই ছিল একমাত্র সান্ত¡না। অন্য রোগীদের যেখানে রাখা হয়, দশ দিন বাদে সেখানে আনা হলো তাকে। দেখা করার অনুমতি পেল হোমেরো আর লাজারা। তিনি আর আগের মানুষটি নেই। সাজ-সজ্জাহীন শীর্ণ দেহ। এলোমেলো কয়েকটা পাতলা চুল বালিশের ছোঁয়াতেই খসে পড়ছে। আগেকার অস্তিত্বের মধ্যে রয়েছে শুধু তার দুই হাতের কোমল মাধুর্য। অস্থি বিশেষজ্ঞর পরামর্শ অনুসারে দুটো লাঠিতে ভর দিয়ে তিনি যখন হাঁটার চেষ্টা করছিলেন, তখন এক হৃদয়বিদারক দৃশের অবতারণা হলো। হাসপাতালেই থেকে গেল লাজারা। আয়ার খরচ বাঁচানোর জন্যে তার বিছানার পাশেই রাত কাটালো সে। ঘরের অন্য রোগীদের মধ্যে একজন মৃত্যুভয়ে কেঁদে কেঁদে সারা রাত পার করে দিল। শেষ না-হওয়া রাত্রিগুলো থেকে রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে লাজারার যত অভিযোগ ছিল, সব ভেসে গেল।
জেনেভায় আসার চার মাস পূর্ণ হওয়ার পর তিনি হাসপাতাল থেকে মুক্তি পেলেন। রাষ্ট্রপতির যেটুকু সঙ্গতি ছিল তাই দিয়ে যতœবান তত্ত্বাবধায়কের মতো হোমেরো শোধ করলো হাসপাতালের সমস্ত বিল। নিজের অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে নিয়ে এলো নিজের বাড়িতে। হোমোরোর সহকর্মীরা রাষ্ট্রপতিকে ন’ তলায় তুলে দিতে সাহায্য করলো। ছেলেমেয়েদের ঘরে তার থাকার বন্দোবস্ত হলো। অথচ এই ছেলেমেয়েদের দিকে আগে কখনও তাকিয়ে দেখার অবকাশ হয়নি তার। ধীরে ধীরে প্রেসিডেন্ট বাস্তবে ফিরে এলেন। আগের মতো সুস্থ হয়ে ওঠার জন্যে নিয়মিত যে সমস্ত ব্যায়াম করা দরকার বলে তিনি শুনেছিলেন, সামরিক নিয়মনিষ্ঠার মতো সেগুলো মেনে অনুশীলন করে যেতে লাগলেন। তারপর একসময় ছড়ির সাহায্য নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। কিন্তু আগেকার সবচেয়ে ভালো পোশাকটি পরার পরও কী চেহারায়, কী আচার-আচরণে, আগের রূপে ফিরতে পারলেন না। শীত আসছে এই ভয়ে তিনি ঠিক করলেন দশই ডিসেম্বর মার্সেলেস থেকে যে জাহাজটি ছাড়বে, তাতে চড়েই তিনি বাড়ি ফিরে যাবেন। আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস হচ্ছে এবার ভয়ংকর তীব্র শীত নামবে। সত্যি সত্যিই সেবার শতাব্দীর সবচেয়ে দুঃসহ শীত পড়লো। চিকিৎসকেরা আরও কিছুদিন তাকে তাদের তত্ত্বাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
শেষ মুহূর্তে দেখা গেল, টিকিটের দাম জুটছে না। স্বামীকে না জানিয়ে লাজারা বাচ্চাদের সঞ্চয় থেকে আরও একবার কিছু তুলে নিল। দেখা গেল, সেখানেও যা থাকবার কথা তার চেয়ে কম রয়েছে। হোমেরো এবার কী ঘটেছিল সেই সত্যটা প্রকাশ করলো। লাজারাকে না জানিয়ে সেখান থেকেই হোমেরো হাসপাতালের বিল শোধ করেছিল।
হাল ছেড়ে দিয়ে লাজারা বললো, ‘ঠিক আছে, ওঁকে না হয় আমাদের বড় ছেলে বলে মেনে নিচ্ছি।’
এগারোই ডিসেম্বর শুরু হলো প্রচ- তুষারঝড়। এই ঝড়ের মধ্যেই লাজারা আর হেমেরো মার্সেলেসের ট্রেনে রাষ্ট্রপতিকে তুলে দিল। বাড়ি ফেরার আগ পর্যন্ত তারা জানতে পারেনি ছেলেমেয়েদের ঘরের টেবিলে একটি চিঠি লিখে রেখে বিদায় জানিয়ে গেছেন তিনি। বারবারার জন্যে রেখে গেছেন তার সেই বিয়ের আংটি। লাজারার জন্যে তার প্রয়াত স্ত্রীর বিয়ের ব্যান্ড, যেটা বিক্রি করার কথা কখনও ভাবেননি তিনি, আর চেন লাগানো পকেটঘড়িটা রেখে গেছেন হোমেরোর জন্যে।
দিনটা রবিবার। ভেরাক্রুজ থেকে গোপন সংবাদ পেয়ে কয়েকজন ক্যারিবীয় প্রবাসী ব্যান্ড বাজাতে বাজাতে পৌঁছে গেছে কর্নাভিন স্টেশনে। দাগি দুর্বৃত্তদের গায়ে মানায় এমন একটা ওভারকোট তার গায়ে। তিনি তখন হাঁপাচ্ছেন। গলায় জড়ানো একটা বহুবর্ণিল পুরানো স্কার্ফ। ওটা লাজারার। কশাঘাতের মতো তীক্ষè তীব্র হাওয়া গায়ে এসে বিঁধছে। ট্রেনের প্রান্তিক কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে সেই প্রবল বাতাসে তিনি টুপি নাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছেন। ট্রেন চলতে শুরু করার পর হোমেরোর খেয়াল হলো রাষ্ট্রপতির ছড়িটা তার হাতেই রয়ে গেছে। দৌড়াতে দৌড়াতে প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে এসে ছড়িটা সে এমনভাবে সজোরে ট্রেনের দিকে ছুঁড়ে দিল যাতে রাষ্ট্রপতি ওটা ধরে ফেলতে পারেন। ছড়িটা অবশ্য তিনি ধরতে পারলেন না, তলিয়ে গেল ট্রেনের চাকার নিচে। সে এক ভয়ংকর মুহূর্ত। কাঁপা কাঁপা হাতটা এগিয়ে দিয়ে তিনি ছড়িটা ধরার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তাঁর হাত পৌঁছচ্ছে না। বাতাসের ধাক্কায় তিনি প্রায় দরজার বাইরে বেরিয়ে পড়লেন। ট্রেনের কন্ডাকটর সেই বরফ আচ্ছাদিত স্কার্ফ ধরে ভিতরে টেনে নিয়ে গিয়ে তাকে বাঁচালেন। লাজারার দেখা এটাই শেষ দৃশ্য। তারপরই মারাত্মক রকমের ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে লাজারা ছুটতে লাগল স্বামীর দিকে। সে হাসতে চেষ্টা করছে, আসলে সে তখন কাঁদছে। লাজারা চিৎকার করে উঠলো, ‘হে ঈশ্বর ,কে মারবে এমন মানুষকে!’
নিরাপদে ও সুস্থ শরীরে রাষ্ট্রপতি ফিরে এসেছেন নিজের বাড়িতে। ধন্যবাদ জ্ঞাপনকারী দীর্ঘ টেলিগ্রামটার বয়ান সেইরকমই ছিল। তারপর এক বছর তার আর খোঁজখবর নেই। অবশেষে লাজারা আর হেমোরোর কাছে পৌঁছালো ছ’ পৃষ্ঠার একটা হাতেলেখা চিঠি। চিঠিতে তাকে একেবারে অপরিচিত মনে হচ্ছে। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ব্যথাটা আবার ফিরে এসেছে। আগের মতোই তীব্র এবং নিয়মিত। তবে ওটাকে তিনি আর গ্রাহ্য করবেন না বলে স্থির করেছেন। জীবন তাকে যে অবস্থায় রেখেছে, তা-ই তিনি মেনে নেবেন। এভাবেই তিনি বেঁচে থাকবেন বলে মনস্থ করেছেন। কবি আইমে সেজার তাকে মাদার অফ্ পার্ল খচিত একটি ছড়ি দিয়েছেন। তবে তিনি ঠিক করেছেন, ছড়িটা তুলে রাখবেন। মাস দুয়েক হলো তিনি মাংস খাওয়া শুরু করেছেন। খাচ্ছেন সবরকমের চিংড়িমাছ। দিনে উনিশ-কুড়ি কাপ কড়া কফি। তবে কাপের তলানিতে ভাগ্যলিপি পড়ার চেষ্টা আর করছেন না। কেননা কোনও ভবিষ্যদ্বাণীই তার বেলায় ফলেনি। নিজের পঁচাত্তর বছর পূর্তির দিনে কয়েক গেলাস মার্তিনিকের রামও খেয়েছেন রাষ্ট্রপতি। এই পানীয় সহ্যও হয়েছে তার। আবার তিনি ধূমপানও শুরু করেছেন। খুব একটা যে সুস্থ আছেন তা নয়, তবে অসুস্থও নন।
যাই হোক, হোমেরো ও লাজারাকে চিঠি লেখার আসল উদ্দেশ্য হলো, তিনি তাঁর পরিকল্পনার কথা তাদের জানাতে চান। জাতির পূর্বগৌরব পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে নতুন এক আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিতে চান। সে কারণেই তার দেশে প্রত্যাগমন। এর ফলে আর দশজনের মতো বার্ধক্যের শেষ শয্যায় শুয়ে তার মৃত্যু না হলেও ক্ষতি নেই। শেষ বয়সে দেশকে নেতৃত্ব দেবার সুযোগ পাচ্ছেন, শুধু এইটুকু গৌরব জুটছে, এতেই তিনি খুশি। চিঠির শেষে জানিয়েছেন, জেনেভায় যাওয়াটা তার জন্য মঙ্গলজনকই হয়েছিল।
[রচনাকাল : জুন ১৯৭৯]
অনুবাদক পরিচিতি
মাসুদুজ্জামান
নির্জন পার্কের হলুদ পাতায় ছেয়ে থাকা কাঠের বেঞ্চিতে বসে রাজহাঁসগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি। গভীর মৃত্যুচিন্তায় মগ্ন। রুপোয় মোড়ানো ছড়ির হাতলের ওপর জোড়া করে তার হাত দুটো রাখা। জেনেভায় এসে তিনি দেখেছিলেন এই সরোবরটির পানি কত শান্ত আর স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ। গাংচিলের দল পোষা পাখির মতো তখন তাঁর হাত থেকে খাবার খেয়ে যেত।
সন্ধে ছ’টা বাজতে না বাজতেই হাতে ঝলমলে ছাতা নিয়ে, বড় কুঁচি দেওয়া অরগ্যান্ডি স্কার্টের খসখস শব্দ ছড়িয়ে ছায়ামূর্তির মতো এখানে ঘুরে বেড়াত কিছু মেয়ে, যাদেও ইচ্ছে করলেই ভাড়া করে নিয়ে রাত্রিযাপন করা যেত। ওই সব মেয়েদের মধ্যে এবার মাত্র একজনের দেখা পাওয়া গেল। জনমানবহীন সরোবরের বাঁধানো ঘাটে সে ফুল বিক্রি করে। তার জীবনের মতো সবকিছুই যে সময় এভাবে শেষ করে দিতে পারে, বিশ্বাস করাই তার পক্ষে খুবই কষ্টকর।
অনেক বিশিষ্ট লোকের মতো তিনিও এই শহরে আত্মগোপন করে আছেন। তার পরনে সাদা ডোরাকাটা গাঢ় নীল রঙের স্যুট আর ব্রোকেডের কাজ করা জ্যাকেট। মাথায় অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের টুপির মতো শক্ত টুপি। সশস্ত্র কোনো এক সৈনিকের মতো উদ্ধত তার গোঁফ। মাথায় বাহারি কায়দার ঢেউ-খেলানো একরাশ নীলাভ কালো চুল। বীণাবাদকের মতো তার দুটি হাত। বাঁ হাতের অনামিকায় বিপত্নীক চিহ্নবাহী অঙ্গুরীয়। চোখ জোড়া খুশিতে ঝলমলে, উজ্জ্বল। শুধু ত্বকের ওপর জমে থাকা ক্লান্তির ছাপ থেকে আন্দাজ করা যায় তার স্বাস্থ্যের হালচাল। এতকিছু সত্ত্বেও তিহাত্তর বছর বয়সে তার শরীরের কাঠামো রীতিমতো নজরকাড়া। এতটুকু নড়বড়ে হয়ে যায়নি। যদিও সেদিন সকালেই তিনি অনুভব করছিলেন, গর্ব করার মতো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। গৌরব আর প্রতিপত্তির দিনগুলি বিদায় নিয়েছে। এখন শুধু মৃত্যুর জন্যে প্রতীক্ষা।
দু’-দুটো বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে এবার তিনি জেনেভায় এলেন। কী একটা ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন, সেটা যদি এখানকার ডাক্তররা ধরতে পারেন, এরকম আশা নিয়েই তার আসা। মার্তিনিকের ডাক্তাররা বিষয়টা ধরতে পারেননি। ঠিক ছিল দু’ সপ্তাহের বেশি তিনি থাকবেন না, কিন্তু প্রায় ছ’ সপ্তাহ কেটে গেছে। যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া সত্ত্বেও কেউ কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত কী হবে তাও কেউ বলতে পারছেন না। ব্যথার কারণ খুঁজতে লিভার কিডনি থেকে শুরু করে প্যাংক্রিয়াস প্রস্টেট পর্যন্ত বাদ না দিয়ে সবকিছুই পরীক্ষা করা হল। অবশেষে এল সেই কঠিন দিনটি--বৃহস্পতিবার। সেদিন সকাল ন’টায় ইউরোপের জনৈক বিশেষজ্ঞ তাকে সময় দিলেন। আগে যারা দেখেছেন তাদের তুলনায় এই চিকিৎসকের নাম-যশ কম।
ডাক্তরের চেম্বারটি খুবই অনাড়ম্বর, সন্ন্যাসীদের আস্তানার মতো। ছোটখাটো চেহারার গম্ভীর প্রকৃতির ডাক্তারের ডান হাতের বুড়ো আঙুলে প্লাস্টার জড়ানো। ঘরের আলো নেভানোর পর বোঝা গেল এক্সরে পর্দায় একটা শিরদাঁড়ায় ছবি জ্বলজ্বল করছে। ডাক্তার দেখিয়ে দেওয়ার পর তিনি বুঝতে পারলেন ওটা তারই কোমরের নিচের মেরুদ-ের ছবি।
ডাক্তার বললেন, ‘আপনার ব্যথাটা এইখানে।’ কথাটা তার পক্ষে বোঝা এতটা সহজ নয়। দ্রুত স্থান পরিবর্তন করা সরে সরে যাওয়া ব্যথাটা কোথায় কখন যে চাগিয়ে ওঠে তা ঠাহর করা তার পক্ষে মুশকিল। কখনও মনে হয় ডান দিকের পাঁজরে, কখনও তলপেটে। কখনও আবার কুঁচকিতে আচমকা ছোরা বেঁধার মতো তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করেন তিনি। একমনে তার কথা শোনার পর ডাক্তার মন্তব্য করলেন, ‘সেই জন্যেই তো এতদিন ধরে ব্যাপারটা ধরা পড়েনি।’
‘কিন্তু এখন আমরা জানি ব্যথটার কেন্দ্রবিন্দু কোথায়।’ কপালের একপাশে তর্জনী ঠেকিয়ে ডাক্তার আরও বললেন, ‘মাননীয় রাষ্ট্রপতি, সব ব্যথার সূত্রপাত আসলে এইখানে।’ দেখিয়ে দেওয়ার এই ভঙ্গিটি এতই নাটকীয় যে রাষ্ট্রপতি রীতিমতো ভীত হয়ে পড়লেন। তবে ডাক্তারের শেষ কথাটা তাকে যথেষ্ট আশ্বস্ত করল। অনিবার্য এবং কিছুটা বিপজ্জনক একটা অস্ত্রোপচার এখুনি দরকার। বিষয়টা কতখানি বিপজ্জনক জিজ্ঞাসা করায় ডাক্তার অস্পষ্ট জবাব দিলেন, ‘ঠিক ঠিক বলা মুশকিল।’ তারপরে একটু থেমে, বিশদভাবে তিনি বোঝালেন যে, অস্ত্রোপচার না করলে মারাত্মক কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আবার অস্ত্রোপচারের ফলে বিভিন্ন মাত্রার পক্ষাঘাতের সম্ভাবানাও আছে বলে ডাক্তার মন্তব্য করলেন। ‘তবে এটাও ঠিক যে দুটো বিশ্বযুদ্ধের পর চিকিৎসাশাস্ত্রের অনেক উন্নতি হয়েছে। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায়, এই আশঙ্কা প্রায় অমূলক।’ সবশেষে ডাক্তার বললেন, ‘চিন্তার কিছু নেই। আপনার কাজকর্ম সেরে নিন। তারপর যোগাযোগ করবেন। তবে ভুলে যাবেন না, যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই মঙ্গল।’
এরকম একটা দুঃসংবাদ আত্মস্থ করা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। বিশেষ করে বাইরের আবহাওয়ার হালহকিকত মোটেও সুবিধাজনক নয়। খুব সকালে হোটেল থেকে বেরোনোর সময় জানালা দিয়ে ঝলমলে রোদ দেখা যাচ্ছিল বলে তিনি ওভারকোট না পরেই বেরিয়ে পড়েন। চেমিন দু বিউ-সোলেইল হাসপাতাল থেকে ধীরে ধীরে প্রেমিক-প্রেমিকাদের গোপন আস্তানা জার্দিন আঙ্গলাইস পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন। মৃতুচিন্তা করতে করতে ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় এখানেই কাটিয়ে দিলেন। তখনই খেয়াল হল, হেমন্তকাল এসে গেছে। সরোবরের পানি ঝঞ্ঝামুখর সমুদ্রের মতো উত্তাল। গাংচিলদের সন্ত্রস্ত করে তোলার মতো এলোমেলো হাওয়ায় গাছের অবশিষ্ট পাতাগুলোও ঝরে পড়ছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি উঠে দাঁড়ালেন। ফুলের পসরা সাজিয়ে বসা মেয়েটির কাছ থেকে ফুল না কিনে সরকারি বাগান থেকে একটা ফুল তুলে নিয়ে জ্যাকেটে লাগিয়ে নিলেন। ফুলওয়ালি ব্যাপারটা দেখে বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করলো, ‘এইসব ফুল ঈশ্বরের দান নয়, এগুলো শহরের সম্পত্তি।’
কথাটায় কান না দিয়ে ছড়ির মাঝখানটা ধরে ঘোরাতে ঘোরাতে মাননীয় রাষ্ট্রপতি লম্বা লম্বা পা ফেলে কিছুটা বেপরোয়া ভঙ্গিতে বেরিয়ে এলেন। ম-ব্লাঁ সেতুর ওপর থেকে সুইজারল্যান্ডের সহযোগী দেশগুলোর পতাকা চটজলদি নামিয়ে নেওয়ার বিষয়টা তার নজরে এল। আকস্মিক ঝোড়ো হাওয়ায় পতাকাগুলো পতপত করে পাগলামি শুরু করে দিল। ফোয়ারার চূড়ায় জমা হওয়া মনোহর ফেনাপুঞ্জ আজ দেখা যাচ্ছে না। সরোবরের লাগোয়া যে কাফেটেরিয়ার তিনি নিয়মিত কাস্টোমার, সেটাকেও আজ আর চেনা যাচ্ছে না। কাফেটেরিয়ার সামনের সবুজ ক্যানভাসের ছাউনিটাও গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। গ্রীষ্মের ফুল দিয়ে সাজানো সুন্দর ছাদটাও বন্ধ। এই দুপুরেও কাফেটেরিয়ার ভেতরে জ্বলছে ঝাঁঝালো বৈদ্যুতিক বাতি। এরই মাঝে দুর্ভাবনা জাগিয়ে তোলা সুরে কোনও একটা যন্ত্রে বেজে চলেছে মোৎসার্টের সুরমূর্ছনা।
খরিদ্দারদের জন্যে কাউন্টারে সাজিয়ে রাখা খবরের কাগজ থেকে মাননীয় রাষ্ট্রপতি একটি কাগজ তুলে নিলেন। টুপি ও ছড়ি রাখলেন নির্দিষ্ট জায়গায়। সংবাদপত্র পড়বেন বলে সোনার ফ্রেমের চশমাটি পরে একটু দূরের একটা টেবিল বেছে নিয়ে বসবার সময় তার খেয়াল হল, হেমন্তকাল এসে গেছে। আন্তর্জাতিক থবর দিয়ে সংবাদ পড়া শুরু করলেন। কারণ, এই পৃষ্ঠাতেই থাকে দুই আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশের যাবতীয় খবরাখবর। তারপর পেছনের পাতা থেকে সামনের দিকে এগোতে শুরু করলেন তিনি। ততক্ষণে ওয়েট্রেস তাঁর প্রতিদিনকার পানীয় এভিয়ান ওয়াটার নিয়ে উপস্থিত। ডাক্তারের নির্দেশে তিরিশ বছরেরও বেশি আগে তিনি কফির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলেন। তবে এখন তার মনে হল, ‘মৃত্যু আসন্ন জানতে পারলে কবেই কফি খাওয়া শুরু করা যেত।’ বিশুদ্ধ ফরাসি ভাষায় তিনি উচ্চারণ করলেন, ‘আমাকে কফিও দেবেন, ইতালীয় কফি। এমন কড়া হওয়া চাই যেন তা খেয়ে মড়া মানুষও বেঁচে ওঠে।’ কথাটার যে অন্য একটা মানে হতে পারে, তা তিনি খেয়াল করলেন না।
ধীরে সুস্থে, আস্তে আস্তে খেয়ে ফেললেন চিনি-ছাড়া কফি। তারপর পেয়ালাটা পিরিচের ওপর উপুড় করে রেখে যেন দেখতে চাইলেন তলানি হওয়া কফির দানাগুলো তার কী ভবিষ্যৎ এঁকে দেয়। ফিরে পাওয়া কফির স্বাদ মুহূর্তের মধ্যে তার মন থেকে সমস্ত বিষণœতা মুছে দিল। কফির যাদুতেই যেন আন্দাজ করতে পারলেন, কেউ এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। অন্যমনস্কতার ভান করে খবরের কাগজের পাতা ওলটাতে ওলটাতে তিনি চশমার ওপর দিয়ে লোকটার দিকে তাকালেন। শুকনো লিকলিকে চেহারার একটা মানুষ। দাড়ি কামায়নি। মাথায় খেলোয়াড়ের টুপি। গায়ে ভেড়ার চামড়ার কারুকাজ করা একটা জ্যাকেট। চোখাচোখি এড়াতে লোকটি নিজেই তার চোখ সরিয়ে নিল।
পরিচিত মুখ। হাসপাতালের লবিতে বেশ কয়েকবার তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেছেন। প্রোমেনাদে দু লাকে একবার লোকটিকে একটা মোটর সাইকেল চালিয়ে যেতে দেখেছেন। তিনি তখন রাজহাঁসগুলোর দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিলেন। কিন্তু কখনও অব্দি মনে হয়নি, সে তার পরিচয় জানে। তবুও লোকটি ওখান থেকে চলে না যাওয়ায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি নির্বাসিত বন্দির মতো নানারকম নির্যাতনের সম্ভাবনায় ভীত বোধ করছিলেন।
ব্রাহমাসের সুমধুর চেলোর সুরে তিনি নিজেকে ভাসিয়ে দিলেন। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে খবরের কাগজ পড়া শেষ করলেন। এরই মাঝে ব্যথাটা আবার তীব্রভাবে চাগিয়ে উঠেছে। ব্যথা উপশমের অন্যতম উপাদান সুরমূর্ছনাও কোনো কাজে এল না। ওয়েস্টকোটের পকেট থেকে চেন বাঁধা সোনার ঘড়িটা বের করে সময় দেখলেন তিনি। এরপর দুপুরর জন্যে বরাদ্দ করা ওষুধের দুটো বড়ি গলায় চালান করে দিয়ে এভিয়ান ওয়াটারের তলানিটুকুতে চুমুক দিলেন। পিরিচের ওপর পড়ে থাকা কফির দানাগুলো তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী পুর্বাভাস দিচ্ছে তা বোঝার চেষ্টায় চশমা খোলার আগে তিনি একবার ওদিকে তাকালেন। শুকনো কফিদানার নকশায় নজর রাখতেই তাঁর শরীরে যেন এক অজানা শৈত্যপ্রবাহ দেখা দিল। তার ভয়ে কেঁপে ওঠার কারণ হলো, পিরিচের ওপর ফুটে উঠেছে অনিশ্চয়তায় ভরা এক সংকেত।
বিল মিটিয়ে, সামান্য কিছু বকশিশ দিয়ে, আস্তে আস্তে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ছড়ি আর টুপিটা তুলে নিলেন। তার দিকে তাকিয়ে থাকা লোকটিকে কোনও রকম পাত্তা না দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে ঝড়ে বিধ্বস্ত রাশি রাশি ফুলকে পাশ কাটিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লেন। তার মনে হলো, মিথ্যে ভয়ের ঘোরটা বোধ হয় কেটে গেছে। কিন্তু হঠাৎই পেছন দিক থেকে ধেয়ে আসা একজোড়া পায়ের শব্দ তাকে থামিয়ে দিল। বাগানের কোনায় ঘুরে যাওয়ার মুখে কিছুটা পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে পড়তেই পিছু নেওয়া লোকটির সঙ্গে তার ধাক্কা লাগে আর কি! নেহাত লোকটি নিজেকে সামলে নিয়েছিল। লোকটির বিস্ময়ভরা দৃষ্টি তখন মাত্র দু’ আঙুল দূরে। আর সেই অবস্থাতেই লোকটি অস্ফুট স্বরে বললো, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি’।
মুখের হাসি এবং কণ্ঠস্বরের মাধুর্য বজায় রেখেই তিনি বললেন, ‘যারা তোমাকে এই কাজে লাগিয়েছে, তাদের বলে দিতে পারো আমার শরীর-স্বাস্থ্য বেশ ভালোই আছে।’
‘সেকথা আমার থেকে ভালো আর কে জানে?’ লোকটি বলল। ‘আমি তো হাসপাতালেই কাজ করি।’ তার কথা বলার ভঙ্গি, কথার ওঠানামা, এমনকি নিরীহ ভাবটিও একেবারে ষোলো আনা বিশুদ্ধ ক্যারিবীয় ধরনের।
‘তুমি তাহলে ডাক্তার?’
‘হলে তো ভালোই হত’, লোকটি জবাব দেয়। ‘আমি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালাই।’
রাষ্ট্রপতি দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, ‘তবে তো তোমার কাজটা বেশ কঠিন।’
‘আপনার কাজের মতো কঠিন নয় নিশ্চয়ই।’
ছড়ির ওপর ভর দিয়ে হাত দুটোকে রাখার পর তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার দেশ কোথায়?’
‘আমি ক্যারিবিয়ার মানুষ।’
‘সে তো বুঝতেই পারছি।’ রাষ্ট্রপতি বেশ জোর দিয়ে বলবার পর আবার প্রশ্ন করলেন, ‘জায়গাটার নাম কী?’
‘আপনি আর আমি একই এলাকার লোক’ বলেই সে করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল। ‘আমার নাম হোমেরো রে।’
‘বাঃ, চমৎকার নাম।’ মাঝপথে হোমেরোকে থামিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রপতি তার হাতটা চেপে ধরলেন। হোমেরো কিছুটা স্বস্তি পেলেন।
রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘আরও ভালো শোনাত যদি বলা হতো হোমেরো রে দে লা কাসা অর্থাৎ তাঁর প্রাসাদের রাজা আমি--হোমার।’
মহামান্য প্রেসিডেন্ট আর সেই লেকটি যখন রাস্তার একেবারে মাঝখানে, ঠিক তখনই কনকনে ঠা-া শীতের বাতাস ছুরির ফলার মতো আক্রমণ করে বসলো। দুজনের কেউই এমন অবস্থার জন্যে প্রস্তুত নয়। হাওয়াটা যেন রাষ্ট্রপতির হাড়ের মধ্যেই সেঁধিয়ে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন, গায়ে ওভারকোট নেই। তিনি আরও বুঝলেন, এই পরিস্থিতিতে সামনের দুটো চত্বর পেরিয়ে তার পছন্দেও সেই সস্তা রেস্তোরাঁয় পৌঁছোনো অসম্ভব। হোমোরোকে প্রশ্ন করলেন, ‘খেয়েছ?’
‘দুপুরে আমি খাই না। একেবারে বাড়ি ফিরে রাত্রে খাই’, হোমেরো জবাব দেয়।
‘আজকের জন্যে নিয়মটা না হয় একটু বদলে নাও’, মন ভোলানো ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটিয়ে রাষ্ট্রপতি বললেন। ‘চল, আমার সঙ্গে আজ তুমি মধ্যাহ্ণভোজ করবে।’
সদ্য পরিচয় হওয়া মানুষটির হাত ধরে তিনি আস্তে আস্তে রেস্তোরাঁর দিকে এগোতে থাকেন। সোনালি অক্ষরে ক্যানভাসের ছাউনির ওপর সোনালি অক্ষরে লেখা রয়েছে দোকানের নাম--লে বোয়েউফ কৌরোন্নে। রেস্তোরাঁটা একেবারেই ছোট। ভিতরে এক চিলতে বসার জায়গা, কোনও টেবিলই এইসময় খালি নেই। পরিবেশটা রীতিমতো উষ্ণ। রাষ্ট্রপতিকে কেউ চিনতে পারল না দেখে হোমেরো বিস্মিত। রাষ্ট্রপতির বসার একটা বন্দোবস্ত করার জন্যে সে রেস্তোরাঁর মালিকের সঙ্গে কথা বলতে গেল। রেস্তোরাঁর মালিক জানতে চাইলে, ‘ইনি কি বর্তমান রাষ্ট্রপতি?’
‘না’, হোমেরোর উত্তর। ‘উনি পদচ্যুত হয়েছেন।’
রেস্তেরাঁর মালিকের মুখে ফুটে উঠলো রহস্যময় হেঁয়ালির হাসি। ‘ওঁদের জন্যে সবসময়ই আলাদা ব্যবস্থা থাকে।’ নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে সুবিধে হয়, রেস্তোরাঁর শেষপ্রান্তের এরকম একটা আলাদা টেবিলে তাদের বসানো হল। রাষ্ট্রপতি লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ‘নির্বাসিতরাও যে সম্মান পেতে পারে, তা অনেকেরই খেয়াল থাকে না।’
কাঠকয়লার আগুনে ঝলসানো গোরুর পাঁজর এই রেস্তোরাঁর বিশেষ খাবার বলে পরিচিতি পেয়েছে। রাষ্ট্রপতি এবং তার অতিথি নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে অন্য টেবিলগুলোর দিকে চোখ ফেরালেন। ঝলসানো মাংসের বড় বড় টুকরোগুলোর ওপর তাদের নজর গেল। রাষ্ট্রপতি বিড়বিড় করে বললেন, ‘অসাধারণ! কিন্তু আমার খাওয়া নিষেধ।’ হোমেরোর দিকে একঝলক তির্যক দৃষ্টি হেনে তিনি আরও মন্তব্য করলেন, ‘আসলে আমার জন্যে তো সবকিছুই নিষিদ্ধ।’
‘আপনার তো কফি খাওয়াও বারণ, কিন্তু খেলেন দেখলাম।’
‘তুমি দেখে ফেলেছ নাকি?’ রাষ্ট্রপতির বিস্ময়ভরা প্রশ্ন। তারপরই পরিস্থিতিটা সামলে নেওয়ার জন্যে বললেন, ‘তা নয়; আজকের দিনটা তো একটু অন্যরকম, তাই ব্যতিক্রম ঘটালাম।’
শুধু কফিই নয়, আরও অনেক কিছু ওলোট-পালট হয়ে গেল। কাঠকয়লার আগুনে ঝলসানো গোরুর পাঁজরের সঙ্গে অলিভ অয়েল ছেটানো টাটকা সবজির সালাদ আনতে বললেন। সঙ্গে রেড ওয়াইন।
টেবিলে খাবার এসে পৌঁছোনোর আগে হোমেরো জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা পেটমোটা মানিব্যাগ বের করলেন। নোট বা খুচরো পয়সা নয়, বেরিয়ে এল কতগুলো বিবর্ণ কাগজ। তার মধ্যে থেকে খুঁজে পেতে একটা বিবর্ণ ছবি সে দেখাল রাষ্ট্রপতিকে। ছবিটা দেখে নিজেকে চিনতে পারলেন রাষ্ট্রপতি। পরনে ফুলশার্ট, কালো চুল, দশাসই গোঁফ। ছবিতে একদল যুবক তাকে ঘিরে রয়েছে। ছবির ফ্রেম থেকে ওই যুবকেরা যাতে বাদ না পড়ে সেই জন্যে তারা পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে মাথাটা উঁচুতে তুলে ধরায় ব্যস্ত। রাষ্ট্রপতি এক নজরেই চিনতে পারলেন কী ছিল তার নির্বাচনের প্রতীকগুলি। অপ্রীতিকর সেই ঘটনাটি কত তারিখে ঘটেছিল, তাও মনে পড়ে গেল। ‘দেখলে কষ্ট হয়। একটা কথা আমি সবসময়ই বলি, একমাত্র ছবি দেখলেই বোঝা যায় যে কতটা বুড়িয়ে গেছে মানুষটা।’ অস্পষ্ট স্বরে কোনওরকমে কথাটা বলেই তিনি ছবিটা এমনভাবে ফিরিয়ে দিলেন যেন এ প্রসঙ্গে তার শেষ কথা বলা হয়ে গেছে। অবশ্য এরপরে আবার বললেন, ‘বেশ মনে পড়ছে, সেই যে কত হাজার বছর আগেকার কথা। সান ক্রিস্তোবাল দে লা কাসাসের মোরগের লড়াই।’
‘আমিও তো ওই শহরেরই ’, খবরটা জানিয়ে হোমেরো ছবিতে অন্যদের মধ্যে নিজেকে দেখিয়ে দিয়ে বললো, ‘এই যে দেখুন--আমি।’ রাষ্ট্রপতি তাকে চিনতে পেরে বললেন, ‘তখন তো তুমি একটা ছেলেমানুষ ছিলে।’
‘প্রায় সেরকমই’, হোমেরো বলেই চলে। ‘বিশ্ববিদ্যালয় বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে দক্ষিণের সমস্ত প্রচার অভিযানেই আপনার সঙ্গে আমি ছিলাম।’
রাষ্ট্রপতি বুঝলেন হোমেরোর মনে অভিযোগ জমে আছে। ‘আমি আসলে খেয়াল করতে পারিনি’, তিনি মন্তব্য করলেন।
‘না না, তা নয়। আপনি আর তেমন কী করেছেন! এতজনের মধ্যে থেকে একজনকে কী আর আলাদা করে মনে রাখা যায়!’
‘তারপর কী হলো?’ প্রশ্ন করেন রাষ্ট্রপতি।
‘সে সব ব্যাপার আপনিই সবচেয়ে ভালো জানেন। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো’, হোমেরো বলেই চলে, ‘সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে আমরা দুজনেই এখানে। এখন আমরা দুজনে মিলে অর্ধেকটা গোরু খেয়ে ফেলতে পারি। এমন সুযোগ আর ক’জন পেয়েছে?’
বলতে বলতেই টেবিলে খাবার পরিবেশন করা হলো। খাওয়ানোর আগে বাচ্চাদের গলায় যেমনভাবে বিব্ বেঁধে দেওয়া হয়, সেইভাবে ন্যাপকিনটি জামার মধ্যে গুঁজে নিলেন রাষ্ট্রপতি। তার অতিথি যে অবাক বিস্ময়ে ব্যাপারটা দেখছে, সেটাও খেয়াল করতে ভুললেন না তিনি।
‘এভাবে বেঁধে না নিলে প্রতিবারেই একটা করে টাইয়ের বারোটা বাজবে’, ন্যাপকিনের ব্যাপারটাকে তিনি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেন।
খাওয়া শুরুর আগে মাংসটা একবার চেখে নিতেই তাঁর চোখে-মুখে তৃপ্তি ছড়িয়ে পড়ল। আবার তিনি কথা শুরু করলেন, ‘একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, কেন যে সরাসরি আমার সঙ্গে আলাপ করার বদলে তুমি আমাকে অনুসরণ করছিলে।’
হোমেরো জানালো, ভিআইপি রোগিদের জন্যে সংরক্ষিত দরজা দিয়ে হাসপাতালে ঢোকার সময়ই সে তাকে চিনতে পেরেছিল। প্রচ- গরমের সেই দিনে তার পরনে ছিল আন্তিলেসের থ্রি-পিস স্যুট। পায়ে সাদা-কালো জুতো। কোটের কলারে গোঁজা ছিল একটা ডেইজি ফুল। হাওয়ায় এলোমেলোভাবে উড়ছিল তার মাথার সুন্দর লম্বা চুল। হোমেরো জেনেছে, কারো সহায়তা ছাড়াই তিনি জেনেভায় এসেছেন। ছাত্রাবস্থায় এখানেই আইন পড়েছিলেন বলে শহরটা তার অনেকটাই চেনা। তার পরিচয় গোপন রাখার জন্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিঃশব্দে সবরকমের সাবধানতা অবলম্বন করেছিল। হয়তো এমনটা করা হয়েছিল তারই অনুরোধে। ওই রাতেই হোমেরো আর তার স্ত্রী ঠিক করে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তারা যোগাযোগ করবে। কিন্তু তার পরও অনুকূল পরিস্থিতির জন্যে পাঁচ সপ্তাহ ধরে হোমেরো তাকে অনুসরণ করেছে। হয়তো এভাবে তাদের মধ্যে এভাবে কথা বলা সম্ভব হতো না যদি কিনা রাষ্ট্রপতি নিজেরই তার দিকে সরাসরি ঘুরে দাঁড়াতেন। ‘মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম বলে আমি মোটেও অখুশি নই। তবে সত্যি বলতে কী, একলা থাকতে আমার কোনও কষ্ট হয় না।’
‘এটা ঠিক নয়।’
রাষ্টপতি জানতে চাইলেন, ‘কেন ঠিক নয়?’ তারপরেই মন্তব্য করলেন, ‘সকলে যে আমায় ভুলে গেছে সেটাই সবচেয়ে বড় লাভ।’
‘আপনি জানেন না কীভাবে আপনাকে মনে রেখেছি।’ হোমেরোর কথায় আবেগ গোপন থাকল না। ‘এখনও তরতাজা যুবকের মতো স্বাস্থ্যবান চেহারায় আপনাকে দেখতে পাওয়া যে কী আনন্দেও, আপনার সেটা জানা নেই।’
‘তবু’, তার কথায় কোনও নাটকীয়তা নেই; ‘তবুও সমস্ত লক্ষণই বলে দিচ্ছে শিয়রে মৃত্যু উপস্থিত।’
‘আপনি সেরে উঠবেন’, হোমেরো জানান দেয়। ‘সে সম্ভাবনাই বেশি।’
রাষ্ট্রপতি রীতিমতো চমকে উঠলেও রসিকতা করতে ছাড়লেন না। ‘তা না হয় বোঝা গেল। তবে এত সুন্দর এই সুইজারল্যান্ডে চিকিৎসা সংক্রান্ত গোপনীয়তা কি আজকাল বজায় রাখা যায় না?’
‘পৃথিবীর কোনও অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারের কাছেই হাসপাতালের খবর গোপন থাকে না।’ হোমেরোর সুস্পষ্ট উত্তর।
‘কিন্তু আমিই তো জেনেছি মাত্র ঘণ্টা দুয়েক আগে। জানিয়েছেন সেই মানুষটি, যার পক্ষে আমার অবস্থা জানা সম্ভব।’
‘সে যাই হোক, উদ্দেশ্য সফল না করে কীভাবে মারা যাবেন আপনি? সে হতেই পারে না’, হোমেরো জোর দিয়ে বলে। ‘আপনার আসনে আবার প্রতিষ্ঠিত হবেন, সেটা আমাদের দায়িত্ব।
রাষ্ট্রপতি এবার বিস্ময়ের ভান করলেন। ‘সাবধান করে দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ।’ ধীরেসুস্থে, আস্তে আস্তে, তারিয়ে তারিয়ে খেলেন। সরাসরি তাকালেন হোমেরোর চোখে চোখ রাখলেন। অল্পবয়সি মানুষটির মনে হল বয়স্ক ভদ্রলোকটি কী ভাবছেন তা সে বুঝতে পেরেছে। অনেকক্ষন ধরে তারা কথা বললেন; স্মৃতিচারণও হলো। শেষে একটু দুষ্টুমির ছোঁয়া মিশিয়ে হাসতে হাসতে রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘মৃতদেহের কী পরিনাম হবে, সেটা আমি ভাবতে চাইছিলাম না। কিন্তু এখন দেখছি সেটাকে গোপন রাখার জন্যে রহস্যোপন্যাসের মতো সাবধান হতে হবে।’
‘তাতে অবশ্য কোনও লাভই হবে না’, ঠাট্টার ছলে হোমেরো উত্তর দিল। ‘হাসপাতালে কোনও রহস্যেরই মেয়াদ এক ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয় না। শুধু একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল।
কফি খাওয়ার পর শেষ হলো মধ্যাহ্নভোজ। রাষ্ট্রপতি আবার তার অভ্যেসবশত কাপের তলানিতে চোখ বোলালেন এবং তার মনের ভেতর কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল। এবার ওই একই উত্তর পেলেন। তার মুখে অবশ্য কোনো অভিব্যক্তিই জাগলো না। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে বিল মেটালেন। সঙ্গে যথারীতি কিছু বকশিশ। বকশিশের অঙ্কটা দেখে পরিবেশনকারীর গলা থেকে কোনো কথা নয় শুধু একটা আওয়াজ বেরিয়ে এলো।
হোমেরোকে বিদায় জানাবার সময় রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘তোমার সঙ্গে আলাপ করে বেশ ভালো লাগল।’ ‘এখনও অপারেশনের দিনক্ষণ স্থির হয়নি। সবকিছু ঠিকঠাক চললে নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে।’
‘তার আগে নয় কেন?’ হোমেরো জানতে চাইলো। ‘আমার বউ কয়েকটা বাড়িতে রান্নার কাজ করে। চিংড়ি মাছের পোলাও রান্নায় ওর খুব নামডাক। আমাদের অনেক দিনের ইচ্ছে আপনাকে বাড়িতে নৈশভোজে নেমন্তন্ন করে খাওয়াবো।’
‘আমার আবার চিংড়ি মাছ, কাঁকড়া জাতীয় খাবার খাওয়া বারণ। তবে তোমাদের ওখানে যাব। আর প্রাণভরে খাব। বলো, কবে যাব?’
‘আমার তো বৃহস্পতিবার ছুটি’, হোমেরো জানায়।
‘বেশ তো, দারুণ প্রস্তাব’, রাষ্ট্রপতি নেমতন্নটা নিশ্চিন্ত করলেন। ‘আগামী বৃহস্পতিবারই যাচ্ছি তোমাদের ওখানে। ধরো, এই সন্ধে সাতটা নাগাদ।’
হোমেরো বলল, ‘আমি গিয়ে নিয়ে আসবো। ঠিকানাটা হলো--হোতেলেরিয়ে দামেস্ ১৪ নম্বর রুয়ে দে লইন্দ্রাস্ত্রিয়ে। স্টেশনের ঠিক পেছন দিকে, তাইতো?
বাহ্, তুমি দেখছি সব মনে রেখেছো। আমার জুতোর মাপও বলে দেবে নাকি! রাষ্ট্রপতি উঠে দাঁড়ালেন। তাকে তখন আরও শান্ত ও সৌম দেখাচ্ছিল।
‘জানি, সেটাও জানি’, হোমেরো যেন মজা পেয়েছে। ‘একচল্লিশ নম্বর।’
হোমেরোকে এতটা নিরীহ মনে হলেও তার আসল উদ্দেশ্য কিন্তু তেমন নিঃস্বার্থ নয়। কথাটা অবশ্য সে রাষ্ট্রপতিকে বলেনি। অথচ পরে যাকে পেয়েছে অথবা যে শুনতে চেয়েছে, তাকেই ও বলে দিয়েছে। তার আসল মতলবটা কী। অন্যান্য অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারের মতো হোমেরোও আঞ্জুমানে মফিদুল আর জীবনবীমা কোম্পানির সঙ্গে সবকিছুই ঠিকঠাক করে রেখেছিল। মৃতদেহ সৎকার থেকে শুরু করে যাবতীয় আনুষঙ্গিক কাজের দায়িত্ব যেন তার ওপরই বর্তায়। বিশেষ করে বিদেশী রোগীদের ওপর ওদের নজর বেশি। কারণ তাদের সামর্থ্য আছে। এতে অবশ্য হোমেরোর যে অনেক লাভ হবে তা নয়। অন্যদেরও ভাগ দিতে হবে তাকে। বিশেষ করে যারা দুরারোগ্য রোগীদের গোপন তথ্যের সন্ধান দেয়, তাদেরকে তো ভাগ না দিলে চলবে না। এই মতলববাজির অজুহাতও হোমেরোর কাছে খুবই পরিষ্কার। প্রথমত, সে স্বদেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে আছে, ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এর ওপর তাকে বিচ্ছিরি রকমের কম বেতনে স্ত্রী ও দুটি সন্তানের ভরণপোষণ করতে হচ্ছে।
হোমেরোর স্ত্রী লাজারা ডেভিসের বাস্তববুদ্ধি অনেক টনটনে। সান হুয়ান পুয়ের্তোরিকোর মেয়ে লাজারা এমনিতে ছোটখাটো আর রোগাপাতলা হলে কী হবে, শারীরিকভাবে বেশ শক্তপোক্ত। চায়ের হালকা লিকারের মতো তার গায়ের রং। শেয়ালের মতো ধূর্ত চোখের চাহনি স্বভাবের সঙ্গে যথেষ্ট বেশ মানিয়ে গেছে। লাজারা ও তার স্বামীর প্রথম সাক্ষাৎ হয় হাসপাতালের দাতব্য বিভাগে। জেনেভায় সে এসেছিল স্বদেশের অর্থাৎ পুয়ের্তোরিকের কোনো এক ধনী ব্যবসায়ীর বুয়া হিসেবে। ব্যবসায়ীটি লাজারা ডেভিসকে জেনেভায় ফেলে রেখে চলে যায়। সহায়সম্বলহীন অবস্থায় ভেসে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ করে সে হাসপাতালের পরিচারিকার চাকরি পেয়ে যায়। তখনই হোমেরোর সঙ্গে বিয়েটা সেরে ফেলে। ইয়োরুবান রাজকন্যা হওয়া সত্ত্বেও হোমেরোর সঙ্গে লাজারার বিয়েটা হয়েছিল ক্যাথলিক প্রথায়। একটা বহুতল বাড়ির নয় তলায় দুই কামরার একটা ফ্ল্যাটে তাদের বসবাস। বহুতল হলেও বাড়িটায় লিফ্ট নেই। প্রায় পুরো বাড়িটাই আফ্রিকা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের আশ্রয়স্থল। লাজারা এবং হোমেরোর মেয়ে বারবারার বয়স নয় বছর আর ছেলে লাজারোর সাত। প্রতিবন্ধী হয়ে ওঠার সমস্ত লক্ষণ ছেলেটির শরীরে এরই মধ্যে ফুটে উঠেছে।
লাজারা বুদ্ধিমতী হলে কী হবে যথেষ্ট বদমেজাজি। কিন্তু তার হৃদয়টি কোমল। খাঁটি বৃষরাশিতে জন্ম বলে তার ধারণা মানুষের জীবনে গ্রহনক্ষত্রের প্রভাব অপরিসীম। এ বিষয়ে তার নিজের গণনার যথার্থতা সম্পর্কে সে যথেষ্ট আস্থাশীল। তার স্বপ্ন ছিল কোটিপতিদের ভাগ্য গণনা করে জীবনযাপন করবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। পারিবারিক প্রয়োজনে মাঝে মধ্যেই তাকে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়। ধনী গৃহিনীদের ফরমায়েশ অনুযায়ী রান্না করেই তার যত উপার্জন। অতিথিদের কাছ থেকে নিজেদের রান্নার প্রশংসা আদায় করা ধনী মহিলাদের ভীষণ পছন্দ বলেই তার এই উপার্জনের পথটি খুলে গেছে।
হোমেরো এতই নিরীহ প্রকৃতির যে মাঝে মাঝে তাকে সহ্য করা লাজারার কঠিন হয়ে পড়ে। বেচারির উপার্জনও সামান্য আর কোনও উচ্চাকাক্সক্ষাও নেই। তবুও লাজারা হোমেরোকে বাদ দিয়ে কিছুই ভাবতে পারে না। কারণ, হোমেরো খুবই সরল মনের মানুষ আর তার কিছু সঙ্গীসাথী আছে যারা বেশ ক্ষমতাধর মানুষ।
মোটামুটি স্বচ্ছলভাবে তাদের দিনগুলো কেটে গেলেও অবস্থা ক্রমশই সঙ্গিন হয়ে উঠছে। ছেলেময়েরা বড় হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি যখন এদেশে এলেন সেই সময়ে পাঁচ বছর ধরে গড়ে তোলা সঞ্চয়ে তাদের হাত পড়েছে। পরিচয় লুকিয়ে গোপন রোগী হিসেবে রাষ্টপতিকে হাসপাতালে দেখার পর হোমেরোরা যেন আশার আলো দেখতে পেল।
তবে ঠিক কী চাইবে বা কোন অধিকারে চাইবে সে বিষয়ে তারা তেমনভাবে মনস্থির করতে পারেনি। প্রথমে ভেবেছিল রাষ্ট্রপতির দাফন-কাফনের ব্যাপারটা নিজেরাই সামলে নেবে। মৃতদেহে সুগন্ধি লেপন করা থেকে শুরু করে স্বদেশে কফিনবন্দি দেহ পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সবকিছু তারাই করবে। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারে রাষ্ট্রপতির মৃত্যু যত তাড়াতাড়ি হবে বলে মনে হচ্ছিল, তত তাড়াতাড়ি ঠিক হবার নয়। নেমন্তন্নর দিনে সন্দেহটা আরও ঘনীভূত হলো।
আসলে হোমেরো কখনও বিশ্ববিদ্যালয় ব্রিগেড বা অন্য কোনও গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেয়নি। নির্বাচনী প্রচারের সময় যখন ফোটো তোলা হতো তখন শুধু সে নিয়ম করে ঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়তো যাতে ছবিতে তাকে দেখা যায়। বাড়ির বাজে কাগজের স্তূপ ঘাটাঘাটি করার সময় এরকম একটা পুরোনো ছবি আচমকা তাদের হাতে চলে আসে। তবে তার আগ্রহে কোনও ঘাটতি ছিল না; এবং এটাও সত্যি যে সে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। কেননা, সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নামা অসংখ্য মানুষের সেও ছিল একজন। তবে দেশত্যাগের বহুদিন পরেও সে জেনেভাতেই রয়ে গেছে। মনের জোর কম বলেই সে জেনেভা ছেড়ে যায়নি। অতএব দু’একটা মিথ্যা কথা বলে যদি রাষ্ট্রপতির নজর কাড়া যায় তো ক্ষতি কী! লা গ্রোত্তেসের মতো একটা নির্জীব আনন্দহীন এলাকা - যেখানে এশিয়া মহাদেশ থেকে আসা শরণার্থী আর দেহপসারিনীরা থাকে, সেখানে দেশান্তরিত এমন একজন বিশিষ্ট মানুষকে দেখে তারা দুজনেই রীতিমতো বিস্মিত। তার ওপর তিনি একলাই থাকছেন একটা চতুর্থ শ্রেণির হোটেলে আর খাওয়াদাওয়া সারছেন সস্তা রেস্তোরাঁয়। অথচ ব্যর্থ রাজনীতিকদের জন্যে যোগ্য বাসস্থানের অভাব নেই জেনেভায়। দিনের পর দিন এইভাবে তাঁর বেঁচে থাকার প্রক্রিয়া হোমেরো সন্তর্পণে খেয়াল করেছে। রাষ্ট্রপতিকে সে চোখে চোখে রেখেছে এবং যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে খুব কাছ থেকে তাকে অনুসরণ করেছে। এমনকী শহরের ভাঙাচোরা পুরোনো দেওয়াল ঘেঁষে ফুটে থাকা জুঁইফুলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে তিনি যখন নৈশ ভ্রমণ সারেন, তখনও হোমেরো পিছু ছাড়ে না। কালভিনের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি যখন চিন্তামগ্ন, তখনও তার দিকে সজাগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হোমেরো। গ্রীষ্মের স্বচ্ছ আকাশে ধীরে ধীরে মিলিয়ে আসা গোধূলির সৌন্দর্য গভীরভাবে দেখার জন্যে তিনি যখন বুর্গ-দে-ফুরের চূড়ায় উঠেছেন ,তখন জুঁইফুলের তীব্র সুবাসে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা সত্ত্বেও সে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে পায়ে পায়ে তাকে অনুসরণ করেছে। একদিন রাতে হোমেরো দেখল রুবিনস্তেইন কনসার্ট শোনার জন্যে ছাত্রদের সঙ্গে একই সারিতে দাড়িয়ে তিনি বছরের প্রথম বৃষ্টিতে ভিজছেন। গায়ে ওভারকোট নেই, হাতে নেই ছাতা। বাড়িতে ফিরে হোমেরো স্ত্রীকে বলল, ‘জানি না, কীভাবে নিউমোনিয়া থেকে রেহাই পেলেন তিনি।’ ঋতু পরিবর্তনের আগের শনিবার তাকে নকল সিল্কের কলার লাগানো একটা কোট কিনতে দেখা গেল। পলাতক আমিরেরা যেখানে কেনাকাটা করে, সেই রুয়ে দু রোনের তেমন কোনও চোখ ধাঁধানো দোকান থেকে নয়, আসন্ন হেমন্তকালের এই কোটটি কেনার জন্যে তিনি ফুটপাতের সস্তা দোকানগুলো বেছে নিয়েছিলেন।
‘আমাদের তাহলে কী হবে, হোমেরোর মুখ থেকে সব শুনে আর্তনাদ করে উঠল লাজারা। ‘আসলে ব্যাটা মহা হাড়কেপ্পন। দাতব্য প্রতিষ্ঠান মারফত অন্ত্যেঃষ্টির কথা মাথায় রেখে উনি বোধ হয় ভাবছেন বেওয়ারিশদের জন্যে সংরক্ষিত কোনও একটা কবরে হয়তো ওঁর জায়গা হয়ে যাবে। ওঁর কাছ থেকে কোনো কিছু পাওয়ার আশা করা উচিত নয়।’
‘হয়তো উনি খুবই গরিব’, হোমেরো বলে। ‘অনেকদিন ধরেই তো উনি একেবারে বেকার।’
‘আ-হা-হা! মীন রাশির দোসর আরেক মীন রাশি। অথবা তুমি একটা আকাট মুর্খ।’ লাজারা বিরক্তি প্রকাশ করে। ‘সকলেই জানে দেশের সব সোনা নিয়ে উনি পালিয়ে এসেছেন। আর মার্তিনিক থেকে নির্বাসিতদের মধ্যে উনিই সবচেয়ে ধনী।’ স্ত্রীর চাইতে হোমেরোর বয়স দশ বছর বেশি। খবরের কাগজের যে সব লেখা ছেলেবেলা থেকে হোমেরোকে প্রভাবিত করছিল সেগুলো থেকে সে জানে রাজমিস্ত্রির জোগালি হিসেবে কাজ করে রাষ্ট্রপতি জেনেভায় পড়াশোনার খরচ চালাতেন। অন্যদিকে তার সম্পর্কে বিরোধীদের গালমন্দ শুনতে শুনতে লাজারার বড় হয়ে ওঠা। অল্প বয়স থেকে বিরোধী মতের বিভিন্ন পরিবারে বুয়ার কাজ করে আসার সুবাদে সেই সব ধারণা তার আরও দৃঢ় হয়েছে। তাই বাড়ি ফিরে খুশিতে ডগমগ হয়ে দামি রেস্তোরাঁয় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের কাহিনি যেদিন হোমেরো শোনাল, লাজারা সেকথা বিশ্বাস করতে পারেনি। রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে অনেক কিছু চেয়ে পাওয়ার স্বপ্ন তাদের চোখে। ভেবেছিল, বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্যে আর্থিক সাহায্যের কথা বলবে অথবা হোমেরোর চাকরিতে উন্নতির জন্যে অনুরোধ জানাবে। অথচ হোমেরো কিছুই চায়নি শুনে লাজারা রীতিমতো স্তম্ভিত। তার ধারণা রাষ্ট্রপতি নিজের মৃতদেহ শকুন দিয়ে খাওয়াবেন। যথাযথভাবে মৃতদেহ সমাধিস্থ করার জন্যে কোনও খরচাপাতি করার ইচ্ছেই তার নেই। আবার স্বদেশে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত হওয়াও তার কাম্য নয়। এসব শুনে লাজারার সন্দেহ আরও ঘনীভূত হলো। সবশেষে হোমেরো বৃহস্পতিবার রাতে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে বাগদা চিংড়ির পোলাও খাওয়ার নেমন্তন্ন পাওয়ার সংবাদটি বলার পর থেকেই লাজারা প্রায় মূর্চ্ছা যাচ্ছিল। ‘হ্যাঁ, এটাই আমাদের দরকার’, লাজারা চিৎকার করে ওঠে। ‘ক্যানের চিংড়ি খেয়ে ব্যাটা এখানেই মরবে। আর বাচ্চাদের জন্যে গড়ে তোলা সঞ্চয় দিয়ে আমরাই ওকে কবর দেব।’
লাজারা এতকিছুর পরও দাম্পত্য আনুগত্যের কারণে হোমেরোর হঠকারিতাকে মেনে নিল। এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে খাবার পরিবেশন করার জন্যে ধার করে আনা হলো তিনটে রূপার বাসন আর একটা সালাদ রাখার কাচের পাত্র। অন্য একজনের কাছ থেকে কফি বানাবার ইলেকট্রিক কেটলি এবং তৃতীয় এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে এমব্রয়ডারি করা টেবিলক্লথ এবং কফি খাওয়ার কাপ ধার করা হলো। পুরোনো পর্দা খুলে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে কেটে গেল একটা পুরো দিন। ধুলো ঝাড়া হলো, বাড়ির যাবতীয় জিনিসপত্র টানাটানি করে তাদের জায়গা বদল করে ফেলা হলো। সম্মানিত অতিথিকে মুগ্ধ করার জন্যে যা যা প্রয়োজন, তাই করা হলো। তাকে যেন বোঝাতে হবে, দরিদ্র হলেও তারা আসলে অভিজাত শ্রেণির মানুষ। অর্থাৎ লাজারা যা করতে চেয়েছিল, বাস্তবে ঘটলো তার বিপরীত।
বৃহস্পতিবার রাতে সিঁড়ি বেয়ে ন’তলা পর্যন্ত উঠতে রাষ্ট্রপতির প্রায় দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। পরনে পুরোনো জিনিসের সস্তা মার্কেট থেকে কেনা একটা নতুন কোট। মাথায় সাবেকি কেতায় বানানো তরমুজের আকারের ঢাউস হ্যাট। লাজারার জন্যে একটা গোলাপ হাতে নিয়ে এভাবেই তিনি হোমেরোদের দরজায় এসে উপস্থিত হলেন। রাষ্ট্রপতির পুরুষোচিত চেহারা এবং যুবরাজের মতো আচরণে লাজারা তো রীতিমতো অভিভূত। এ সবের মধ্য তিয়েই লাজারা মিলিয়ে নিয়েছে--মানুষটি কপট ও লোভী। হয়তো কিছুটা শিষ্টাচারবর্জিত মানুষ। বাড়িটাকে চিংড়ির গন্ধমুক্ত রাখার জন্যে লাজারা জানালা খুলেই রান্না করেছিল। কিন্তু ঘরে ঢুকেই রাষ্ট্রপতি একটা গভীর নিঃশ্বাস টেনে, চোখ বন্ধ করে, দু’হাত ছড়িয়ে দিয়ে আবেগ মেশানো তৃপ্তির সুরে উচ্চারণ করলেন, ‘আঃ! একেবারে আমাদের সমুদ্রের গন্ধ।’ লাজারার ধারণার চাইতে মানুষটি অনেক বেশি কৃপণ না হলে একটামাত্র গোলাপ হাতে কেউ আসে? নিশ্চয়ই সরকারি বাগান থেকে চুরি করে এনেছে। দেওয়ালের কাগজগুলোর দিকে তাচ্ছিল্যভরা চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনে হলো মানুষটি যথেষ্ট উদ্ধত। অথচ ওইসব পুরোনো খবরের কাগজের টুকরোগুলোতে ছাপা ছিল রাষ্ট্রপতির নানা কীর্তিকাহিনির খবরাখবর। তখনকার নির্বাচনী প্রচারের প্রতীক ও পতাকাও ছাপা ছিল ওখানে। দেওয়ালের কাগজগুলো আটকাবার সময় হোমেরো তো আনন্দে ডগমগ। আর এখন, এই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিটিকে মনে হচ্ছে খুবই নিষ্ঠুুর প্রকৃতির একজন মানুষ। বারবারা বা লাজারাকে সম্ভাষণ পর্যন্ত করলেন না। অথচ তার জন্যে উপহারও রাখা ছিল। এর ওপর আবার খেতে বসে বললেন, দুটি জিনিস তার একেবারে অসহ্য। প্রথমত, কুকুর আর ছেলেপুলে। কথাটা শোনামাত্রই ঘেন্নায় লাজারার গা ঘিনঘিন করে উঠল। শুধুমাত্র ক্যারিবীয় আতিথেয়তার সৌজন্যে পরিস্থিতিটাকে সামাল দিল সে। লাজারার পরনে বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্যে তুলে রাখা আফ্রিকান গাউন। গলায় সান্তেরিয়া দানার মালা আর হাতে ব্রেসলেট। এতটুকু আতিশয্য না দেখিয়ে বা একটিও অবান্তর কথা না বলে সে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত। বিরক্তি প্রকাশ পায় বা ত্রুটি ধরা পরে, এমন কিছুই লাজারা করছেনা। লাজারার আপ্যায়নকে নিখুঁত বলা হলেও বোধ হয় কম বলা হবে।
চিংড়ির পোলাও মোটেও উপাদেয় খাবার নয়। তবুও যতটা সম্ভব যতœ নিয়ে রান্না করা হয়েছে। রান্নাটা যথেষ্ট সুস্বাদু হয়েছে। রাষ্ট্রপতিও দু’বার চেয়ে নিলেন। প্রশংসা করলেন। তৃপ্তির সঙ্গেই খেলেন পাকা কলার ভাজা টুকরোগুলো। আয়োকাদো সালাদও খেলেন। তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়ার সময় তিনি অবশ্য স্মৃতির সরণি বেয়ে দেশের কথায় ফিরে যাননি। লাজারা কেবল চুপ করে তাদের কথাবার্তা শুনছিল। সব শেষে মিষ্টি পরিবেশন করার সময় কোনও কারণ ছাড়াই হোমেরো ঈশ্বরের অস্তিত্ব সংক্রান্ত আলোচনার কানাগলিতে হাজির হলো।
‘আমি বিশ্বাস করি ঈশ্বর আছেন’, রাষ্ট্রপতি বললেন। ‘তবে মানুষের জীবনে তার কোনও হাত নেই।’
‘আমার অবশ্য গ্রহনক্ষেত্রে অগাধ বিশ্বাস’, বলেই লাজারা তীক্ষè দৃষ্টিতে রাষ্ট্রপতির প্রতিক্রিয়া কী হয় লক্ষ করতে চেষ্টা করলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার জন্মতারিখটা কি জানতে পারি?’
‘এগারোই মার্চ।’
যেন বিরাট একটা জয় হয়েছে এমন উল্লাস দেখিয়ে লাজারা চঞ্চল হয়ে বলে উঠলো, ‘জানতাম।’
তারপর গলায় খুশির ভাব ফুটিয়ে প্রশ্ন করল, ‘এক টেবিলে দুই মীনরাশির জাতককে দেখতে অস্বস্তি লাগছে না আপনার?’
তারা কিন্তু তখনও ঈশ্বর সংক্রান্ত আলোচনা করে চলেছেন। কফি বানাতে উঠে গেল লাজারা। এক ফাঁকে টেবিলটাও পরিস্কার করলো। সে মনে মনে চাইল, সন্ধেটা যেন ভালোভাবে কেটে যায়। কফি নিয়ে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে আসার সময় রাষ্ট্রপতির একটা মন্তব্য কানে আসায় স্তম্ভিত হয়ে গেল লাজারা। রাষ্ট্রপতি বলছেন, ‘বিশ্বাস করো, আমাকে যদি আবার দেশের রাষ্ট্রপতি করা হয় তাহলে আমাদের মতো গরিব দেশের পক্ষে সেটা ভয়ংকর খারাপ কাজ হবে।’
হোমেরো দেখলো ধার করে জোগাড় করা চিনামাটির কাপ আর রুপোর কফি-পাত্র নিয়ে দরজায় লাজারা উপস্থিত। দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি যেন মূর্ছা যাবে। রাষ্ট্রপতিও ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। তিনি বিনীতভাবে বললেন, ‘আমার দিকে অমন করে তাকাবেন না। আমি সত্যি কথাটাই বলেছি। নিজের বোকামির জন্যে আজ আমায় এত বড় মূল্য দিতে হচ্ছে।’
লাজারা কফি পরিবেশন করে টেবিলের আলোটা নিভিয়ে দিল। অত উজ্জ্বল আলো কথা বলার উপযোগী নয়। ঘরের মধ্যে একটা অন্তরঙ্গ ছায়াঘন পরিবেশ তৈরি হওয়ায় লাজারা এই প্রথম অতিথি সম্পর্কে আগ্রহ বোধ করলো। অতিথিটি নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমান। তবে তিনি তার বিষাদ ঢেকে রাখতে পারেননি। লাজারার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল, যখন রাষ্ট্রপতি কফি খাওয়া শেষ করে এমনভাবে পেয়ালাটা উপুড় করে পিরিচের ওপর রেখে দিলেন যাতে কফির গুঁড়ো সেখানে জমতে পারে।
রাষ্টপতি বললেন, নির্বাসনের জন্যে তিনি মার্তিনিক দ্বীপটিই বেছে নিয়েছিলেন। কারণ সেখানকার কবি আইমে সেজার তার বন্ধু। সেজারের লেখা ঘরে ফেরার খেড়ো খাতা নামের কবিতার বইটি তখন কেবল বেরিয়েছে। এই বন্ধুটিই তাকে নতুন করে জীবন শুরু করতে সাহায্য করেছিল। স্ত্রীর সম্পত্তির যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাই দিয়ে তিনি ফোর্ত-দে-ফ্রঁসেজের পাহাড়ে কাঠের তৈরি একটি দামি বাড়ি কিনেছিলেন। বাড়িটার জানালায় পর্দা ছিল, আর ছিল প্রাচীন জাতের ফুলগাছে ভরা একটা বারান্দা, যেখান থেকে সরাসরি সমুদ্র দেখা যেত। চিনির কল থেকে ভেসে আসা গুড় আর মদের গন্ধ মাতোয়ারা হাওয়ায় শরীর জুড়োতে জুড়োতে আর ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শুনতে শুনতে পরম আরামে ঘুমানো যেত তৃপ্তির ঘুম। রাষ্ট্রপতির থেকে চোদ্দো বছরের বড় ছিলেন তার স্ত্রী। তাদের প্রথম সন্তানের জন্মের পর থেকেই ভদ্রমহিলা পঙ্গু। লাতিন ভাষায় নতুন করে চিরায়ত সাহিত্য পড়া শুরু করেছিলেন বলেই তিনি ভাগ্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার শক্তি পেয়েছিলেন। এ সম্পর্কে তার বিশ্বাস এতটাই দৃঢ় ছিল যে তিনি ধরেই নিয়েছিলেন বারবার ওই সাহিত্য পড়াই তার একমাত্র কাজ। নির্বাচনে তার দল হেরে যাওয়ার পর দলের নেতৃত্ব বহুদিন পর্যন্ত তার কাছে নতুন নতুন আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তাব পাঠাত। কিন্তু তিনি সেই প্রলোভন জয় করেছিলেন। বললেন, ‘যখন বুঝতে পারলাম ওদের প্রস্তাবগুলো একেবারেই অসার। আজ যেটাকে ভীষণ জরুরি বলে মনে করছে সপ্তাহখানেক পরেই সেই পরিকল্পনার কিছুই মনে রাখছে না, এমনকি যে চিঠি লিখেছিল তাও ভুলে গেছে, তখন ঠিক করলাম, আর কোনও চিঠিই খুলব না। খুলিওনি।’
আবছা আলোয় তিনি লাজারার দিকে তাকালেন। সে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। লাজারার হাত থেকে রাষ্ট্রপতি জ্বলন্ত সিগারেটটা নিয়ে নিলেন। লম্বা একটা সুখটান দিয়ে ধোঁয়াটা গলায় চালান করে দিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় লাজারা বিমূঢ়। সে আরেকটা সিগারেট ধরাবার জন্যে দেশলাইয়ের বাক্স আর প্যাকেট হাতে তুলে নিল। লাজারা যখন এরকম আয়োজনে ব্যস্ত ঠিক তখনি তিনি জ্বলন্ত সিগারেটটা লাজারাকে ফিরিয়ে দিলেন।
তিনি বললেন, ‘চোখের সামনে অমন আয়েস করে কাউকে সিগারেট খেতে দেখলে লোভ দমন করা সত্যি কঠিন।’ এবার সিগারেটটা ফিরিয়ে দেওয়ার আগে গলার মধ্যে জমিয়ে রাখা ধোঁয়াটা আলতে করে শূন্যে ভাসিয়ে দিলেন। কাশির গমক এসে গেল তার। ‘অনেক দিন আগেই সিগারেটের নেশা ছেড়ে দিয়েছি’, বললেন তিনি। ‘ কোনো কেনো সময় অভ্যেসের কাছে আমি একেবারে হেরে যাই। যেমন এই এখন হারলাম।’
কাশির গমক তার পুরো শরীরটাকে হঠাৎ করে আরও বার দুয়েক ঝাঁকিয়ে দিল। শুরু হলো ব্যথাটা। ছোট পকেটঘড়িটি দেখে নিলেন রাষ্ট্রপতি। সন্ধের সময় যেসব ওষুধ খাওয়ার কথা সেগুলো খেয়ে নিলেন। এবার ঝুঁকে পরে কাপের তলানিটা দেখলেন। কিছুই পালটায়নি। তবে এবার আর তিনি কেঁপে উঠলেন না।
‘আমার সমর্থকদের মধ্যে কেউ কেউ পরে রাষ্ট্রপতি হয়েছিল’, বললেন তিনি।
হোমেরো ধরিয়ে দেয়, ‘সায়াগো।’
‘শুধু সায়াগো কেন, অন্যেরাও’, তিনি বললেন। ‘সকলেই জোর করে আমাদের সমর্থন আদায় করেছে। আমাদের এটা প্রাপ্য ছিল না। এই দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্যতাও আমাদের ছিল না। ছিল কেবল ক্ষমতার লোভ। বেশিরভাগের প্রত্যাশা অবশ্য এর থেকেও কম ছিল। তাই চাইতো শুধু একটা চাকরি।’
লাজারা রীতিমতো ক্রুদ্ধ। তার জিজ্ঞাসা, ‘আপনি জানেন, ওরা আপনার সম্পেের্ক কী বলে?’
হোমেরো আতঙ্কিত হয়ে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেয়। ‘না, না, ওরা মিথ্যে কথা বলে।’
‘মিথ্যে আবার মিথ্যে নয়ও।’ রাষ্ট্রপতির কণ্ঠস্বর স্বর্গীয় প্রশান্তিতে ভরা। ‘রাষ্ট্রপতি যখন বিষয় হয়, তখন সবচেয়ে কলঙ্কিত কাহিনিও সত্যি বা মিথ্যে দুই-ই হতে পারে।”
নির্বাসনের পুরো মেয়াদটাই প্রেসিডেন্ট কাটিয়েছেন মার্তিনিক দ্বীপে। সরকারি কাগজপত্র মারফত যে সামান্য খবরটুকু পৌঁছাতো, সেইটুকুই ছিল বাইরের জগতের সঙ্গে তার একমাত্র যোগসূত্র। সরকারি বিদ্যালয়ে হিস্পানি ও লাতিন পড়িয়ে চলতো তার ভরণপোষণ। আর আইমে সেজার বিভিন্ন সময়ে তাকে যেসব অনুবাদের কাজ দিতেন, তা দিয়েই তার পেট চলত। আগস্ট মাসে যখন গরম অসহনীয় হয়ে উঠতো তখন তিনি দোলখাটানো চৌকিতে দুপুর পর্যন্ত শুয়ে থাকতেন। কানে আসত শোয়ার ঘরের পাখার ভোঁ ভোঁ শব্দ।
দিনের বেলার অসহনীয় গরমে তার স্ত্রী পোষা পাখিদের খাওয়ানোর জন্য বেরোতেন। তার মাথায় থাকতো একটা সাধারণ শনের টুপি। টুপিটার চওড়া কিনারটি নকল ফল আর অরগ্যান্ডি ফুল দিয়ে সাজানো ছিল। পাখিগুলো ঘরের বাইরে খোলা জায়গায় স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতো। দুপুরের তাপ কমে যাওয়ার পর ঠা- বাতাসে বসে থাকাটা ছিল বেশ আরামদায়ক। অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি সমুদ্রের দিকে নির্নিমেষভাবে তাকিয়ে বসে থাকতেন । আর তার স্ত্রী, যার মাথায় থাকতো ছেঁড়া টুপি, হাতের প্রতিটি আঙুলে শোভা পেত ঝলমলে পাথরের আংটি। তিনি দোলায়িত চেয়ারে বসে একদৃষ্টিতে দেখতেন জাহাজের আসা-যাওয়া। দেখতেন এই পৃথিবীরই সব জাহাজ।
‘ওই জাহাজটা পুয়েন্তো সান্তোর’, এভাবে তিনি বলে ফেরতেন। ‘কী পরিমানে কলা বোঝাই করেছে দেখ! নড়তেই পারছে না’, বলতেন তিনি। তার পক্ষে ভাবা সহজ ছিল না, তাঁর দেশের নয় এমন জাহাজ ওই পথ দিয়ে যেতে পারে। স্ত্রীর এইসব কথাবার্তা না শোনার ভান করতেন রাষ্ট্রপতি। যদিও শেষ পর্যন্ত তার স্বামী যা ভুলতে পেরেছিলেন, তিনি তার তুলনায় আরও অনেক কিছু ভুলে যেতে পেরেছিলেন। কেননা ভদ্রমহিলার স্মৃতিভ্রংশ হয়। এভাবে তারা সমুদ্রের ধারে বসে সময় কাটাতেন। গোধূলির কোলাহল থেমে গেলে মশার উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য ঘরে ফিরে যেতেন।
এমনি এক আগস্টের দিনে বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়তে পড়তে চমকে উঠলেন রাষ্ট্রপতি।
তিনি বললেন, ‘কী আশ্চর্য, আমি নাকি এস্তোরিলেই মরে গেছি।’ তার স্ত্রী ঝিমুচ্ছিলেন। খবরটা শুনে ভয়ে চমকে উঠলেন। পত্রিকার পঞ্চম পৃষ্ঠার এক কোনায় ছ’ লাইনের একটা খবর। অথচ এই সংবাদপত্রেই তার অনুবাদকর্ম মাঝে মাঝে প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার ম্যানেজার মাঝে মাঝে এসে তার সঙ্গে দেখাও কওে গেছেন। আর সেই পত্রিকাতেই কিনা এখন লেখা হচ্ছে তিনি মারা গেছেন এস্তোরিল দি লিসবোঁতে। এই এলাকাতেই ইয়োরোপ পতনের পর যারা আশ্রয় নিয়েছিল, সেইসব মানুষদের আশ্রয় ও বসবাসস্থল। অথচ কী কা-, ওই এলাকাতে তিনি কখনও যাননি। সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র স্থান যেখানে তিনি মারা যেতে চান না।
শেষ পর্যন্ত যেটুকু স্মৃতি তার অবশিষ্ট ছিল, বিশেষ করে একমাত্র সন্তানের স্মৃতির যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে এর বছরখানেক বাদে তাণ্ডার স্ত্রী মারা যান। পিতাকে পদচ্যুত করার ব্যাপারে এই ছেলেও অংশ নিয়েছিল। পরে অবশ্য নিজের দলের লোকের হাতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে সে মারা যায়।
রাষ্ট্রপতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ‘এই তো আমাদের অবস্থা। কোনকিছুই রক্ষা করতে পারবে না আমাদের’, বললেন তিনি। ‘পৃথিবীর আবর্জনা থেকে জন্ম নিয়েছে একটা মহাদেশ। সেখানে মুহূর্তের জন্যেও কোনো ভালোবাসা অবশিষ্ট ছিল না। নারীহরণ, ধর্ষণ, অত্যাচার, যাবতীয় নিন্দনীয় কাজ, প্রতারণা আর শত্রুর সঙ্গে শত্রুর সংযোগে জন্ম নেয় সেখানকার এক-একটি সন্তান।’ তিনি খেয়াল করলেন, লাজারার আফ্রিকান চোখ দুটি তীব্র দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। সুনিপুন বাগ্মিত দিয়ে অন্যকে প্রভাবিত করার বহুকালের পুরোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করে তিনি লাজারাকে জয় করবার চেষ্টা করলেন। বললেন, ‘বর্ণসংকরের অর্থ হলো চোখের পানির সঙ্গে ছলকে পড়া রক্তের মিলন। এমন বিষক্রিয়া থেকে কীই-বা পাওয়া যেতে পারে?’
মৃত্যুর মতো নীরবতা সেখানে নেমে এলো। সকলেই স্তব্ধ, নির্বাক। লাজারাই যেন স্তব্ধ করে রেখেছে সকলকে। অনেকক্ষণ। মধ্যরাত্রির খানিক আগে লাজারা সংবিৎ ফিরে পেল। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে চুমু দিয়ে সে রাষ্ট্রপতিকে বিদায় জানালো। হোমেরো তাকে হোটেলে এগিয়ে দিতে চাইলো। রাষ্ট্রপতি রাজি হলেন না। ট্যাক্সি করে দেবে বলে কোনো বাধা না মেনে হোমেরা তার সঙ্গে গেল।
বাড়ি ফিরে এলে হোমেরোর স্ত্রী রাগে ফেটে পড়লো, ‘তিনিই পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্রপতি যাকে গদি থেকে হটিয়ে দিয়ে ঠিক কাজটাই করা হয়েছে। কুত্তার বাচ্চা একটা।’
হোমেরো তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেও বাকি রাতটা তারা না ঘুমিয়ে সাংঘাতিকভাবে কাটিয়ে দিল। লাজারা স্বীকার করলো, এ পর্যন্ত সে যত মানুষ দেখেছে তার মধ্যে এই মানুষটিই সবচেয়ে সুদর্শন। এমনই তার সম্মোহিনী শক্তি যে তোমাকে সে একেবারে শেষ করে দেবে। ষাঁড়ের মতো পৌরুষ তার। ‘এই এখন তার যা অবস্থা--বুড়োহাবড়া এবং নিঃশেষ হতে চলেছেন--তবু এখনও বিছানায় মানুষটি বাঘের শক্তি ধরে’, লাজারা জানায়। কিন্তু হোমেরার ধারণা, এইসব ঈশ্বরপ্রদত্ত গুণাবলি তিনি ভণ্ডামি করে নষ্ট করেছেন। সাধু থাকার ভান হোমেরার তাই অসহ্য লাগছিল। কেননা লাজারা তো নিশ্চিতভাবেই জানে মার্তিনিকের অর্ধেক আখের খেতের মালিক ছিলেন তিনি। আর ক্ষমতার প্রতি তার অনাগ্রহ? এও এক ভ-ামি। একথা তো স্পষ্ট যে, রাষ্টপতি হওয়ার জন্যে সর্বস্ব দিতে প্রস্তুত তিনি। আর একবার রাষ্ট্রপতি হতে পারলে দীর্ঘকালের জন্যে তিনি ওই পদ আঁকড়ে থাকবেন যাতে তার শত্রুদের কবর দেয়া যায়।
‘আর যেসব কথা তিনি বলে গেলেন’, লাজারা বললো, ‘তা শুধু এই জন্যে যাতে পায়ের কাছে বসে আমরা তার বন্দনা করি।’
‘তাতে তার কী লাভ?’ হোমেরো প্রশ্ন করে।
‘কিছুই নয়’, লাজারা জবাব দেয়। ‘মানুষকে সম্মোহিত করাটা একটা নেশা। এটা কাটানো মুশকিল।’
লাজারা এমন রেগে রয়েছে যে হোমেরোর পক্ষে তাকে বিছানায় সহ্য করা কষ্টকর হয়ে উঠলো। ফলে বাকি রাতটা বসবার ঘরের সোফায় একটা কম্বল জড়িয়ে শুয়ে থাকল সে। মাঝরাতে লাজারাও জেগে গেল, আপাদমস্তক নগ্ন; এইভাবেই সে ঘুমোতে অভ্যস্ত। অথবা বাড়িতে যখন যে একা থাকে, এভাবেই থাকে। আপন মনে বেচারি গজগজ করতে থাকে, সেই একই বিষয়ে। লাজারার ইচ্ছে করছে এক ধাক্কায় সেই ঘৃণ্য নৈশভোজের সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেলতে। সকাল হতে না হতেই ফিরিয়ে দিল ধার করে আনা যাবতীয় জিনিসপত্র। নতুন পর্দাগুলো খুলে ফেলে টাঙিয়ে দিল পুরোনো পর্দা। বাড়িঘরের চেহারায় ফিরে এলো আগেকার দারিদ্র্যখচিত সুরুচির ছাপ। একটানে খুলে ফেলে চিরকালের মতো আবর্জনার ঝুঁড়িতে ছুঁড়ে ফেলে দিল দেওয়ালে আটকানো সংবাদপত্রের সেইসব টুকরোগুলো, যাতে ছাপা আছে অতীদের সেই জঘন্য নির্বাচনী প্রচারের খবর-ছবি-প্রতীক-পতাকা। এরপরই সে চিৎকার কওে বলে উঠলো, ‘গোল্লায় যাক সব।’
নৈশভোজের সপ্তাহখানেক বাদে হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় হোমেরোর চোখে পড়ল রাষ্ট্রপতি তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হোমেরোকে সঙ্গে করে তিনি হোটেলে নিয়ে গেলেন। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে চারতলার ওপর চিলেকোঠায় পৌঁছুলেন। ঘুলঘুলির মতো একচিলতে জানালা দিয়ে ঘোলাটে আকাশ দেখা যাচ্ছে। ঘরের ভেতর টাঙানো দড়িতে শুকোচ্ছে কাপড়চোপড়। ঘরের অর্ধেকটা জুড়ে রয়েছে একটা বিশাল খাট। রয়েছে একটা কাঠের চেয়ার, বিবর্ণ আয়না লাগানো সাদামাটা একটা আলমারি এবং হাত-মুখ ধোয়ার বেসিন। রাষ্ট্রপতি লক্ষ করলেন হোমেরোর প্রতিক্রিয়া।
‘ছাত্রাবস্থায় এই খুপরিতেই আমি থাকতাম।’ ক্ষমা চাইবার ভঙ্গিতে অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে তিনি বললেন, ‘ফোর্ত-দে-ফ্রঁসেজ থেকে আগেই এটা ভাড়া করে রেখেছিলাম।’
এবার ভেলভেটের একটা থলি তিনি বিছানার ওপর উপুড় করে দিতেই ছড়িয়ে পড়লো বেশকিছু গয়নাগাটি। তার সম্পদের সামান্য অবশেষ। নানা রকমের দামি মণিমুক্তা বসানো কয়েকটা সোনার ব্রেসলেট, একটা তিন লহরির মুক্তোর নেকলেস, দামি পাথর বসানো দুটো সোনার নেকলেস, সাধুসন্তের ছবি লাগানো লকেটসহ তিনটে সোনার হার এবং তিন জোড়া সোনার দুল। এগুলোর মধ্যে একজোড়ায় পান্না, আরেক জোড়ায় হিরে এবং বাকি জোড়ায় চুনি বসানো। আরো আছে, উপাসনায় ব্যবহৃত হয় এরকম জিনিসপত্র রাখার দুটো বাক্স এবং একটা লকেট। নানা ধরনের দামি মণিমানিক্যখচিত এগারোটা আংটি। রানিদের উপযুক্ত একটা হিরের টায়রা। একটা বাক্স থেকে বেরলো তিন জোড়া রুপোর আর দু’জোড়া সোনার কাফলিঙ্ক। সেই সঙ্গে মানানসই টাইপিন আর সোনার পাতে মোড়া একটা সোনার ঘড়ি। তারপর একটা জুতোর বাক্স থেকে বের করলেন ছটা পদক। পদকগুলোর মধ্যে দুটো সোনার, একটা রুপোর আর তিনটে একটু সস্তা ধরনের। ‘এই হল আমার শেষ সম্বল,’ জানালেন তিনি।
এইসব গয়নাগাটি বিক্রি করে চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে হবে তাকে। এছাড়া তার সামনে আর অন্য কোনও পথ খোলা নেই। হোমেরাকে তিনি অনুরোধ করলেন সে যেন বুঝেশুনে এগুলো ঠিকঠাক দামে বিক্রি করে দেয়। হোমেরো অবশ্য তখন ভাবছে আসল রশিদ ছাড়া এগুলো কী করে বিক্রি করবে। রাষ্ট্রপতি জানালেন, পিতামহীর কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে তার স্ত্রী এইসব গয়নাগাটি পেয়েছিলেন। সময়টা ছিল উপনিবেশের যুগ। কলোম্বিয়ার সোনার খনির একাংশের মালিকানা ছিল তার স্ত্রীর পিতামহীর। তিনি আবার উত্তরাধিকার সূত্রে এগুলো পেয়েছিলেন। তবে ঘড়িটা, কাফলিঙ্ক আর টাইপিনগুলো তার নিজের। পদকগুলোও অবশ্য উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া নয়।
‘কারও কাছে কি এইসব জিনিসের রসিদ থাকে?’ হোমেরো কিন্তু রাজি হলো না। ‘তাহলে’, রাষ্ট্রপতির গলায় অসন্তোষের সুর স্পষ্ট। ‘আমি নিজেই তবে চেষ্টা করে দেখি।’ সুবিবেচনার পরিচয় দিয়ে কোনোরকম উত্তেজনা ছাড়াই একে একে অলংকারগুলো তিনি গুছিয়ে তুলতে লাগলেন। বললেন, ‘তুমি কিন্তু কিছু মনে করো না, হোমেরা। তুমি আমার প্রিয় মানুষ। তোমায় বলি, গরিব হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রপতির মতো দরিদ্র আর কেউ নয়। এমনকি এখন বেঁচে থাকতেও ঘৃণা হয়।’ এবার তিনি হোমেরোর হৃদয় স্পর্শ করলেন। হোমেরো রাষ্ট্রপতির প্রতি তাক করা তার অস্ত্র নামিয়ে নিল।
লাজারার বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। বিছানার ওপর ঝকঝক করতে থাকা গয়নাগুলি দরজা থেকেই তার নজরে এসেছে। তার মনে হলো বিছানার ওপর একটা কাঁকড়া অথবা বিচ্ছু যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে।
‘এতটুকু বুদ্ধি নেই তোমার? এগুলো এখানে এনেছ কেন?’ লাজারার কষ্ঠস্ব রীতিমতো ভয়ার্ত।
হোমেরোর ব্যাখ্যা শুনে সে আরও ভয় পেয়ে গেল। বিছানায় বসে জহুরির চোখে একটি একটি করে প্রতিটি গয়না খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। তারপর একসময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘এ যে বিরাট সম্পত্তি।’ এবার সে তাকায় হোমেরোর দিকে। কিন্তু উভয় সংকট থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পায় না।
‘দুত্তোরি’ মন্তব্য করে লাজারা বলে, ‘লোকটা সব সত্যি বলেছেন কিনা কী করে বুঝবো?’
‘কেন নয়’, জবাবে হোমেরো প্রশ্ন করে। ‘এইতো দেখে এলাম নিজের জামাকাপড় উনি নিজেই কাচেন। আমাদের মতোই ঘরের মধ্যে দড়ি টানিয়ে শুকোতে দিয়েছেন।’
‘কারণ ওঁর দৃষ্টিটা নিচের দিকে’, লাজারার স্পষ্ট কথা।
‘অথবা উনি খুবই গরিব’, হোমেরো প্রেসিডেন্টের পক্ষে সাফাই গায়।
লাজারা গয়নাগুলো আবার পরীক্ষা করে দেখলো। রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে সে একটু দুর্বল হয়ে পড়েছে। পরদিন সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটি পরার পর বেছে বেছে সেই গয়নাগুলো দিয়েই নিজেকে সাজাল যেগুলো দেখে বেশি দামি মনে হয়। সবকটা আঙুলে, এমনকি বুড়ো আঙুলেও গলিয়ে দিল আংটি। দু’হাতে পরে নিল সবগুলো ব্রেসলেট। এবার শুরু হলো বিক্রয় অভিযান। ‘দেখা যাক, লাজারা ডেভিসের কাছে কে রসিদ চায়।’
ঠিক দোকানটিই বেছে নিয়েছে লাজারা। তেমন দামি নয়, তবে জাঁকজমকে ত্রুটি নেই। সে জানে এইসব দোকানে গয়নাগাটি কেনাবেচার সময় কেউ বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করে না। দোকানের ভেতরে সে ঢুকল ভয়ে ভয়ে কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে।
সান্ধ্যা পোশাক পরিহিত রোগাটে চেহারার একজন ফ্যাকাশে-মতো কর্মচারী নাটকীয় ভঙ্গিতে নিচু হয়ে লাজারাকে অভিবাদন জানালো। তার হাতে চুমু খেয়ে কর্মচারীটি জিজ্ঞাসা করলো, কীভাবে লাজারাকে সে সাহায্য করতে পারে। আলোয় ঝলমলে দোকানটার চারদিকই আয়না দিয়ে মোড়ানো। দোকানের ভিতরটা তাই দিনের চেয়েও উজ্জ্বল। মনে হচ্ছে পুরো দোকানটাই হিরে দিয়ে গড়া। লাজারা কর্মচারীটির দিকে না তাকিয়ে তাকে অনুসরণ করে চলে গেল দোকানের পিছন দিকে। পাছে ফাঁকিটা ধরা পড়ে যায় ভেবে লাজারা ভীষণ ভীত।
দোকানের কাউন্টার হিসেবে লুই পঞ্চদশ আমলের প্রচলিত নকশার তিনটি টেবিল সাজানো আছে। সেখানেই লাজারাকে বসতে বললো। কর্মচারীটি টেবিলের ওপর পরিষ্কার একটা কাপড় পেতে দিল। তারপরে লাজারার মুখোমুখি বসে সে প্রতীক্ষা করতে লাগলো।
‘কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি’, কর্মচারীটি আবার বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করলো।
আংটি, ব্রেসলেট, দুল অর্থাৎ যে সমস্ত গয়না গায়ে পরা ছিল, সেগুলো খুলে ফেলে টেবিলের ওপর সাজিয়ে দিয়ে লাজারা জানতে চাইল, ‘এগুলোর আসল দাম কত?’ জহুরি একটা কাচ বাঁ চোখের সামনে রেখে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগারের নীরবতা নিয়ে অলংকাগুলি খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলো। অনেকক্ষণ ধরে দেখার পর পরীক্ষা করতে করতেই সে প্রশ্ন করে, ‘আপনি কোত্থেকে আসছেন?’ এরকম কোনো প্রশ্নের জন্যে লাজারা আদৌ প্রস্তুত ছিল না।
‘অ্যাঁ! অনেক দূর থেকে।’
‘সে আমি বুঝতে পেরেছি’, মন্তব্য করেই জহুরি আবার নীরব হয়ে গেল। ওদিকে লাজারার সোনালি দুটি চোখ তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। জহুরি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে হিরের টায়রাটা দেখে নিয়ে অন্য গয়নাগুলো থেকে সেটাকে আলাদা করে রাখলে লাজারা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো।
‘আপনার যে কন্যা রাশি সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই’, লাজারা মন্তব্য করে। হাতের কাজ গুটিয়ে না রেখে জহুরি পালটা প্রশ্ন করে, ‘কী করে বুঝলেন?’
‘আপনার ধরন দেখে’, লাজারার পরিষ্কার জবাব।
কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত জহুরি কোনও মন্তব্য করলো না। তারপর একেবারে সূচনাপর্বের মতো শিষ্টাচার বজায় রেখে অত্যন্ত সন্তর্পণে লাজারাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এগুলো কোথায় পেলেন?’
‘আমার দিদিমার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া’, লাজারার সতর্ক উত্তর। তার কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় টানটান। ‘গত বছর পারামাইবোয় সাতানব্বই বছর বয়সে তিনি মারা গেছেন।’
কথাটা শোনার পর লাজারার চোখে চোখ রেখে জহুরি মন্তব্য করলো, ‘আমি খুবই দুঃখিত।’
টায়রাটা আঙুল দিয়ে তুলে ধরে জহুরি জানালো, ‘এটার শুধু সোনাটুকুর দাম পাওয়া যাবে।’ উজ্জ্বল আলোয় টায়রাটা চকচক করছে। মনে হচ্ছে এটা খুবই প্রাচীন মিশরীয় গয়না। হিরেগুলোর অবস্থা ভালো হলে এটা একটা মহামূল্যবান গয়না হতে পারতো। তবে এর একটা ঐতিহাসিক মূল্য আছে। অন্যান্য গয়নার সমস্ত পাথর নকল। আসলগুলো নিশ্চয়ই ভালো ছিল।’
জহুরি গয়নাগুলো গুছাতে গুছাতে বলেন, ‘আসলে পুরুষানুক্রমে এগুলো এতবার হাতবদল হয়েছে যে আসল পাথরগুলো হারিয়ে গেছে আর তার বদলে সস্তা কাচ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
কথাগুলো শুনে লাজারার কেমন যেন বিবমিষা হয়। মনের ভিতর জেগে ওঠা আতঙ্ককে সে কোনোরকমে চাপা দেয়। জহুরি তাকে সন্ত¡না দিয়ে বললো, ‘অনেক সময়ই এরকম হয়।’
আশ্বস্ত হয়ে লাজারা বললো, ‘আমি জানি, সেইজন্যেই তো এগুলোর হাত থেকে মুক্তি পেতে চাই।’
নিজের কঠিন অবস্থার কথা অনুভব করার পর আবার নিজের আসল চেহারায় ফিরে যায় লাজারা। একটুও দেরি না করে হাতব্যাগ থেকে কাফলিঙ্ক, পকেটঘড়ি, টাইপিন, রুপো ও সোনার পদক এবং রাষ্ট্রপতির অন্যান্য ব্যক্তিগত ছোটখাটো গয়নাগুলো বের করে টেবিলের ওপর রাখে।
‘এগুলোও?’ জহুরি প্রশ্ন করে।
লাজারা জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ, সব।’
দাম হিসেবে লাজারা সুইস ফ্রাঁর যে নোটগুলো পেল সেগুলো এতই নতুন যে মনে হচ্ছে এর ছাপগুলো এখন সজীব আছে, আঙুলে লেগে না যায়! বিলগুলো সে গুণেও নিল না। একইরকম সম্ভ্রম আর ভদ্রতার সঙ্গে জহুরি লাজারাকে দরোজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। কাচের দরজাটা খুলে ধরে লাজারাকে একটু দাঁড় করিয়ে সে বললো, ‘আমার কিন্তু কুম্ভরাশি।’
সন্ধ্যা গড়িয়ে যাওয়ার আগেই লাজারা আর হোমেরো সদ্য পাওয়া নোটগুলো নিয়ে হোটেলে গেল। হিসেবনিকেশ করে দেখা গেল এখনও কিছু কম পড়ছে। রাষ্ট্রপতি এবার বিয়ের আংটি, চেন লাগানো পকেটঘড়ি, কাফলিঙ্ক, টাইপিন এক কথায় তার গায়ে দামি যা কিছু ছিল, সব খুলে বিছানার ওপর রাখতে লাগলেন।
লাজারার বিছানার ওপর থেকে বিয়ের আংটিটা তার হাতে তুলে দিয়ে বললো, ‘এটা নয়। এমন স্মৃতিচিহ্ন বেচা ঠিক নয়।’
প্রস্তাবটা মেনে নিলেন রাষ্ট্রপতি। সেটা আবার আঙুলে পরে নিলেন। চেন লাগানো পকেটঘড়িটাও লাজারা ফিরিয়ে দিয়ে বললো, ‘এটাও নয়।’
এবার রাষ্ট্রপতি আপত্তি করলেন। কিন্তু লাজারা তাকে সেটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো, ‘সুইজারল্যান্ডে পুরোনো ঘড়ি কে কিনবে?’
‘কেন আমরাই তো বেচেছি’, হোমেরো বলবার চেষ্টা করে।
লাজারা হোমেরোকে সংশোধন করে দিয়ে জানাল, ‘হ্যাঁ, কথাটা ঠিক। তবে ঘড়ি নয়, আমরা বেচেছিলাম ঘড়ির সোনাটুকু।’
‘এটাও সোনার’, রাষ্ট্রপতি বললেন।
‘সোনার? তাহলে আর কী!’ লাজারা জোর দিয়ে বললো, ‘অপারেশন না করালেও আপনার চলতে পারে, কিন্তু কখন ক’টা বাজল, না জানলে চলবে না।’
তার সোনার ফ্রেমের চশমাটাও লাজারা নিল না। অথচ আরেক জোড়া কচ্ছপের খোলের চশমা প্রেসিডেন্টের আছে। জিনিসগুলো হাতে তুলে লাজারা আন্দাজ করার চেষ্টা করলো। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে বললো, ‘এতেই হয়ে যাবে মনে হয়।’
বেরিয়ে আসার আগে ঘরের দড়িতে টাঙানো ভেজা জামা-কাপড়গুলো রাষ্ট্রপতির অনুমতি না নিয়েই গুছিয়ে ণিল লাজারা। বাড়িতে গিয়ে ওগুলোকে ইস্তিরি করে আবার ফিরিয়ে দেবে। মোটর সাইকেলে চেপে লাজারাদম্পতি বাড়ির পথে পা বাড়ালো। হোমেরো চালাচ্ছে আর লাজারা দু’ হাতে হোমেরোর কোমর জড়িয়ে বসে আছে পিছনের সিটে। রক্তিম বেগুনি গোধুলিতে একটা দুটো করে রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। গাছের শেষ পাতাটাও হাওয়ায় উড়ে গেছে। ন্যাড়া গাছগুলোকে দেখাচ্ছে জীবাশ্মের মতো। রাস্তায় সংগীতের সুরলহরি ছড়িয়ে দিতে দিতে একটা ট্রাক চলে গেল। আসলে ট্রাকের ভিতরে রেডিওতে পুরোদমে বাজছে জর্জ বাসেনসের এটা পরিচিত গান, হে আমার প্রিয়তমা, শক্ত রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলাম / ওখান দিয়ে সময় যাবে বলে / হায়, আটিলার মতো বর্বর সময়! / তার ঘোড়া যায় সেই পথ দিয়ে / প্রেম যেখানে যায় শুকিয়ে।
ওরা দুজনেই নির্বাক। গানের কথা আর সুরে পুরোপুরি সম্মোহিত। তাদের স্মৃতিতে ভেসে উঠলো শাপলা ফুলের গন্ধ। খানিক বাদে লাজারার মনে হলো দীর্ঘ নিদ্রা থেকে সে বুঝি জেগে উঠছে।
‘যেতে দাও।’
হোমেরো প্রশ্ন করে, ‘কী?’
‘বেচারা বুড়ো মানুষ’, লাজারা উত্তর দেয়। কী জঘন্য জীবন বেচারার।’
পরের শুক্রবার সাতই অক্টোবর একটানা সাত ঘণ্টা ধরে রাষ্ট্রপতির অপারেশন হলো। তখনকার মতো মনে হলো, আগেকার মতোই সবকিছু বোধ হয় অন্ধকারেই থেকে যাবে। সত্যি কথা হলো, তার বেঁচে থাকার খবরটা জানতে পারাই ছিল একমাত্র সান্ত¡না। অন্য রোগীদের যেখানে রাখা হয়, দশ দিন বাদে সেখানে আনা হলো তাকে। দেখা করার অনুমতি পেল হোমেরো আর লাজারা। তিনি আর আগের মানুষটি নেই। সাজ-সজ্জাহীন শীর্ণ দেহ। এলোমেলো কয়েকটা পাতলা চুল বালিশের ছোঁয়াতেই খসে পড়ছে। আগেকার অস্তিত্বের মধ্যে রয়েছে শুধু তার দুই হাতের কোমল মাধুর্য। অস্থি বিশেষজ্ঞর পরামর্শ অনুসারে দুটো লাঠিতে ভর দিয়ে তিনি যখন হাঁটার চেষ্টা করছিলেন, তখন এক হৃদয়বিদারক দৃশের অবতারণা হলো। হাসপাতালেই থেকে গেল লাজারা। আয়ার খরচ বাঁচানোর জন্যে তার বিছানার পাশেই রাত কাটালো সে। ঘরের অন্য রোগীদের মধ্যে একজন মৃত্যুভয়ে কেঁদে কেঁদে সারা রাত পার করে দিল। শেষ না-হওয়া রাত্রিগুলো থেকে রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে লাজারার যত অভিযোগ ছিল, সব ভেসে গেল।
জেনেভায় আসার চার মাস পূর্ণ হওয়ার পর তিনি হাসপাতাল থেকে মুক্তি পেলেন। রাষ্ট্রপতির যেটুকু সঙ্গতি ছিল তাই দিয়ে যতœবান তত্ত্বাবধায়কের মতো হোমেরো শোধ করলো হাসপাতালের সমস্ত বিল। নিজের অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে নিয়ে এলো নিজের বাড়িতে। হোমোরোর সহকর্মীরা রাষ্ট্রপতিকে ন’ তলায় তুলে দিতে সাহায্য করলো। ছেলেমেয়েদের ঘরে তার থাকার বন্দোবস্ত হলো। অথচ এই ছেলেমেয়েদের দিকে আগে কখনও তাকিয়ে দেখার অবকাশ হয়নি তার। ধীরে ধীরে প্রেসিডেন্ট বাস্তবে ফিরে এলেন। আগের মতো সুস্থ হয়ে ওঠার জন্যে নিয়মিত যে সমস্ত ব্যায়াম করা দরকার বলে তিনি শুনেছিলেন, সামরিক নিয়মনিষ্ঠার মতো সেগুলো মেনে অনুশীলন করে যেতে লাগলেন। তারপর একসময় ছড়ির সাহায্য নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। কিন্তু আগেকার সবচেয়ে ভালো পোশাকটি পরার পরও কী চেহারায়, কী আচার-আচরণে, আগের রূপে ফিরতে পারলেন না। শীত আসছে এই ভয়ে তিনি ঠিক করলেন দশই ডিসেম্বর মার্সেলেস থেকে যে জাহাজটি ছাড়বে, তাতে চড়েই তিনি বাড়ি ফিরে যাবেন। আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস হচ্ছে এবার ভয়ংকর তীব্র শীত নামবে। সত্যি সত্যিই সেবার শতাব্দীর সবচেয়ে দুঃসহ শীত পড়লো। চিকিৎসকেরা আরও কিছুদিন তাকে তাদের তত্ত্বাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
শেষ মুহূর্তে দেখা গেল, টিকিটের দাম জুটছে না। স্বামীকে না জানিয়ে লাজারা বাচ্চাদের সঞ্চয় থেকে আরও একবার কিছু তুলে নিল। দেখা গেল, সেখানেও যা থাকবার কথা তার চেয়ে কম রয়েছে। হোমেরো এবার কী ঘটেছিল সেই সত্যটা প্রকাশ করলো। লাজারাকে না জানিয়ে সেখান থেকেই হোমেরো হাসপাতালের বিল শোধ করেছিল।
হাল ছেড়ে দিয়ে লাজারা বললো, ‘ঠিক আছে, ওঁকে না হয় আমাদের বড় ছেলে বলে মেনে নিচ্ছি।’
এগারোই ডিসেম্বর শুরু হলো প্রচ- তুষারঝড়। এই ঝড়ের মধ্যেই লাজারা আর হেমেরো মার্সেলেসের ট্রেনে রাষ্ট্রপতিকে তুলে দিল। বাড়ি ফেরার আগ পর্যন্ত তারা জানতে পারেনি ছেলেমেয়েদের ঘরের টেবিলে একটি চিঠি লিখে রেখে বিদায় জানিয়ে গেছেন তিনি। বারবারার জন্যে রেখে গেছেন তার সেই বিয়ের আংটি। লাজারার জন্যে তার প্রয়াত স্ত্রীর বিয়ের ব্যান্ড, যেটা বিক্রি করার কথা কখনও ভাবেননি তিনি, আর চেন লাগানো পকেটঘড়িটা রেখে গেছেন হোমেরোর জন্যে।
দিনটা রবিবার। ভেরাক্রুজ থেকে গোপন সংবাদ পেয়ে কয়েকজন ক্যারিবীয় প্রবাসী ব্যান্ড বাজাতে বাজাতে পৌঁছে গেছে কর্নাভিন স্টেশনে। দাগি দুর্বৃত্তদের গায়ে মানায় এমন একটা ওভারকোট তার গায়ে। তিনি তখন হাঁপাচ্ছেন। গলায় জড়ানো একটা বহুবর্ণিল পুরানো স্কার্ফ। ওটা লাজারার। কশাঘাতের মতো তীক্ষè তীব্র হাওয়া গায়ে এসে বিঁধছে। ট্রেনের প্রান্তিক কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে সেই প্রবল বাতাসে তিনি টুপি নাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছেন। ট্রেন চলতে শুরু করার পর হোমেরোর খেয়াল হলো রাষ্ট্রপতির ছড়িটা তার হাতেই রয়ে গেছে। দৌড়াতে দৌড়াতে প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে এসে ছড়িটা সে এমনভাবে সজোরে ট্রেনের দিকে ছুঁড়ে দিল যাতে রাষ্ট্রপতি ওটা ধরে ফেলতে পারেন। ছড়িটা অবশ্য তিনি ধরতে পারলেন না, তলিয়ে গেল ট্রেনের চাকার নিচে। সে এক ভয়ংকর মুহূর্ত। কাঁপা কাঁপা হাতটা এগিয়ে দিয়ে তিনি ছড়িটা ধরার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তাঁর হাত পৌঁছচ্ছে না। বাতাসের ধাক্কায় তিনি প্রায় দরজার বাইরে বেরিয়ে পড়লেন। ট্রেনের কন্ডাকটর সেই বরফ আচ্ছাদিত স্কার্ফ ধরে ভিতরে টেনে নিয়ে গিয়ে তাকে বাঁচালেন। লাজারার দেখা এটাই শেষ দৃশ্য। তারপরই মারাত্মক রকমের ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে লাজারা ছুটতে লাগল স্বামীর দিকে। সে হাসতে চেষ্টা করছে, আসলে সে তখন কাঁদছে। লাজারা চিৎকার করে উঠলো, ‘হে ঈশ্বর ,কে মারবে এমন মানুষকে!’
নিরাপদে ও সুস্থ শরীরে রাষ্ট্রপতি ফিরে এসেছেন নিজের বাড়িতে। ধন্যবাদ জ্ঞাপনকারী দীর্ঘ টেলিগ্রামটার বয়ান সেইরকমই ছিল। তারপর এক বছর তার আর খোঁজখবর নেই। অবশেষে লাজারা আর হেমোরোর কাছে পৌঁছালো ছ’ পৃষ্ঠার একটা হাতেলেখা চিঠি। চিঠিতে তাকে একেবারে অপরিচিত মনে হচ্ছে। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ব্যথাটা আবার ফিরে এসেছে। আগের মতোই তীব্র এবং নিয়মিত। তবে ওটাকে তিনি আর গ্রাহ্য করবেন না বলে স্থির করেছেন। জীবন তাকে যে অবস্থায় রেখেছে, তা-ই তিনি মেনে নেবেন। এভাবেই তিনি বেঁচে থাকবেন বলে মনস্থ করেছেন। কবি আইমে সেজার তাকে মাদার অফ্ পার্ল খচিত একটি ছড়ি দিয়েছেন। তবে তিনি ঠিক করেছেন, ছড়িটা তুলে রাখবেন। মাস দুয়েক হলো তিনি মাংস খাওয়া শুরু করেছেন। খাচ্ছেন সবরকমের চিংড়িমাছ। দিনে উনিশ-কুড়ি কাপ কড়া কফি। তবে কাপের তলানিতে ভাগ্যলিপি পড়ার চেষ্টা আর করছেন না। কেননা কোনও ভবিষ্যদ্বাণীই তার বেলায় ফলেনি। নিজের পঁচাত্তর বছর পূর্তির দিনে কয়েক গেলাস মার্তিনিকের রামও খেয়েছেন রাষ্ট্রপতি। এই পানীয় সহ্যও হয়েছে তার। আবার তিনি ধূমপানও শুরু করেছেন। খুব একটা যে সুস্থ আছেন তা নয়, তবে অসুস্থও নন।
যাই হোক, হোমেরো ও লাজারাকে চিঠি লেখার আসল উদ্দেশ্য হলো, তিনি তাঁর পরিকল্পনার কথা তাদের জানাতে চান। জাতির পূর্বগৌরব পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে নতুন এক আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিতে চান। সে কারণেই তার দেশে প্রত্যাগমন। এর ফলে আর দশজনের মতো বার্ধক্যের শেষ শয্যায় শুয়ে তার মৃত্যু না হলেও ক্ষতি নেই। শেষ বয়সে দেশকে নেতৃত্ব দেবার সুযোগ পাচ্ছেন, শুধু এইটুকু গৌরব জুটছে, এতেই তিনি খুশি। চিঠির শেষে জানিয়েছেন, জেনেভায় যাওয়াটা তার জন্য মঙ্গলজনকই হয়েছিল।
[রচনাকাল : জুন ১৯৭৯]
মাসুদুজ্জামান
পিএইচডি
অধ্যাপক
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
সর্বশেষ প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ :
প্রবন্ধ--
কাফকার প্রেম [অবসর প্রকশনী],
অনুবাদ--
অধ্যাপক
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
সর্বশেষ প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ :
প্রবন্ধ--
কাফকার প্রেম [অবসর প্রকশনী],
নারী যৌনতা রাজনীতি [বেঙ্গল পাবলিকেসন্স]
দেবদূত পুরুষ ও যৌনরাজনীতি [শুদ্ধস্বর প্রকাশনী],
অনুবাদ--
টমাস ট্রান্সট্রোমারের কবিতা
আত্মস্মৃতি সাক্ষাৎকার [অঙ্কুর প্রকাশনী]
2 মন্তব্যসমূহ
এমন ঝরঝরে অনুবাদ বহুদিন পড়িনি। অনেক ভালবাসা রইল।
উত্তরমুছুনমার্কেজের অদ্ভুত আশ্চর্য লেখা অনুবাদে প্রকাশ করা খুব শক্ত ।
উত্তরমুছুনতবু,এখানে কিছুটা হয়েছে ।
আসলে অন্তর্লীন সত্যটুকু অনুবাদে ধরা, অধরাই থেকে যায় অনেক সময়।