'লেখালেখি ছেড়ে দিলেও জীবন আগের মতোই গতিময়'
মুখচোরা স্বভাবের এ মানুষটি শুধুই বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে আড্ডা দিতে সহজ বোধ করেন। সাক্ষাৎকারবিমুখ এই লেখক বহু বহু দিন পর ২০০৬ সালে বার্সেলোনার দৈনিক লা বান্গুয়ার্দিয়া পত্রিকার রবিবাসরীয় সংখ্যার সাংবাদিক শাবি আয়েন'র সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় লেখালেখি ও তার ব্যক্তিগত জীবন প্রসঙ্গে অনেক কথাই বলেছেন। মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটির পেদ্রেগাল দে সান আনহেল নামক আবাসিক এলাকায় (সিনেমার নায়ক-নায়িকা, সাবেক প্রেসিডেন্ট ও ধনাঢ্য ব্যাংকারদের বসতি যে এলাকায়) নিজ বাড়িতে বসে গার্সিয়া মার্কেস এই সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। শাবি আয়েনের বয়ানে এখানে সেটা অনুবাদ করা হলো।
১৯৭৫ সালে স্পেন থেকে ফিরে আসার পর থেকে এই বাড়িতেই থেকে আসছেন গার্সিয়া মার্কেস ও তার স্ত্রী মের্সেদেস বার্চা। কাঠের বিমের বাড়িটাতে জানালার ছড়াছড়ি। নেটের পর্দা ও ফাঁকা জায়গা থাকার কারণে বাড়িটাতে প্রচুর আলোর আসা-যাওয়া। ৭ থেকে ১৮ বছর বয়সী লেখকের পাঁচ নাতি-নাতনির ছবিগুলোতে আলো এসে ঠিকরে পড়ছে। আমরা যে ঘরটায় প্রথমে বসেছিলাম সেখানটার চারদিকে নোবেল পুরস্কারের ছবিসংবলিত কিছু বই রাখা আর বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক রিচার্ড অ্যাভেডনের তোলা লেখকের কিছু ছবি।
এরপর বাহারি অর্কিডের বাগানসংলগ্ন পথ ধরে আমরা যে ঘরটায় গিয়ে ঢুকলাম সেটা তার স্টাডি রুম, নীরবে-নিভৃতে কাজ করার জন্য এ রুমটাকে বেছে নিয়েছেন। আমরা চমকে গেলাম গার্সিয়া মার্কেসকে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা অবস্থায় দেখে। কিছু লিখছেন না, বরং ইন্টারনেটে আন্তর্জাতিক খবরাখবর পড়ছেন। আন্তরিক ভঙ্গিতে আমাদের বসতে বললেন এবং জানালেন যে এই সাক্ষাৎকারটা দিতে যে তিনি রাজি হয়েছেন সেটা নেহায়েতই একটা ব্যতিক্রম। স্বভাবসুলভ ঠাট্টাচ্ছলে আমাদের কাছে ডেকে কানে কানে জিজ্ঞাসা করলেন, 'তো বলেন তো, এই সাক্ষাৎকারের জন্য আমার স্ত্রী-কে কত টাকা দিয়েছেন?'
একেবারে হাল আমলের মাল্টিমিডিয়া কম্পিউটার ব্যবহার করেন গাবো (স্প্যানিশ ভাষী বিশ্বে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস 'গাবো' নামেই সমধিক পরিচিতি)। যে ইলেকট্রিক টাইপরাইটারে লিখে আসছেন প্রায় সারা জীবন সেটা আর ব্যবহার করেন না বছর কয়েক হয়। 'ইলেকট্রিক টাইপরাইটারে যখন লিখতাম তখন প্রতি সাত বছরে একটা বই বের করার পরিকল্পনা ছিল, পরবর্তীতে কম্পিউটারে কাজ শুরু করার পর থেকে প্রতি তিন বছরে একটা বই বের করার কথা ভাবি, কম্পিউটার অনেকাংশেই অনেক কাজ কমিয়ে দেয়। হুবহু একই রকমের কম্পিউটার মেশিন আমার আছে বেশ কয়েকটা, একটা এখানে আমার এই বাড়িতে, একটা আছে বোগোতায় আর একটা বার্সেলোনায়। শুধু ব্যাগে কয়েকটা ডিস্ক নিয়ে চলাফেরা করলেই হলো।'
আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই গাবো একটা কোলা পানীয় পান করছিলেন। থেকে থেকে টেলিফোন, ইন্টারনেট, ফ্যাঙ্ ও ডাক মারফত আসা খবরাখবরে চোখ বোলাচ্ছিলেন, বিশ্বে কোথায় কী ঘটছে, বিশেষ করে তার স্বদেশ কলম্বিয়ায়। নিজের কথা বলতে গিয়ে জানালেন, 'গেল বছর ২০০৫-এ নিজেকে নিজে ছুটি দিলাম। কম্পিউটারের সামনে বসি নাই। গোটা বছরে একটা লাইনও লিখি নাই। আপাতত লেখালেখিকে ঘিরে আমার কোনো পরিকল্পনা কিংবা ভবিষ্যৎ কোনো প্রোজেক্ট নাই। আমার জীবনে এরকমটা আগে কখনোই হয় নাই। লেখালেখিটাকে কখনোই ছাড়ি নাই। এই প্রথম একটা বছর কাটল আমার জীবনে কোনো কিছু না লিখে। এতটা কাল প্রতিদিনই আমি লিখেছি, সকাল ৯টা থেকে শুরু করে বেলা ৩টা পর্যন্ত হাতকে সচল, উষ্ণ রাখার জন্য হলেও লিখেছি। আদতে দিনের বেলা এছাড়া আর কি করার ছিল আমার জানা ছিল না।'
-তাহলে এখন লেখালেখি ব্যতিরেকে অন্য ভালো কিছু খুঁজে পেয়েছেন করার?
-হ্যাঁ, মজার একটা ব্যাপার আবিষ্কার করেছি; শুয়ে শুয়ে বই পড়া। যেসব বই পড়ার সময় হয়নি এতটা কাল সেগুলো এখন পড়ছি। মনে পড়ে আগে তুমুল লেখালেখির দিনগুলোতে কেমন একটা অস্থিরতা পেয়ে বসত আমায়। বেলা ৩টা পর্যন্ত লেখালেখি করে কিছু একটা করার পাঁয়তারা করতে হতো যাতে করে সময়টা কাটে। যাতে করে এই বোধ কাজ করে যে বেঁচে আছি, ভেতরের অস্থিরতা, অতৃপ্তিটাকে দমানোর জন্য। কিন্তু এখন ওই অস্থির ভাবটা আর নেই সেভাবে, বেশ ভালো লাগছে।
-আর আত্মস্মৃতি কথার দ্বিতীয় খ-টা?
-আমার মনে হয় না ওটা আমি শেষ পর্যন্ত লিখব। কিছু কিছু নোট টোকা আছে, কিন্তু আমি চাই না ওগুলো ছাপা হউক। আত্মস্মৃতির এই দ্বিতীয় খ-টি বের হলে বইটিতে এমন কিছু কথাবার্তা আসবে যেগুলো আমি ঠিক বলতে চাই না, এমনটা বাবার পিছনে কিছু ব্যক্তিগত কারণ জড়িয়ে আছে, ওটা লিখতে গেলে এমন কিছু সম্পর্ক বা মানুষের নাম এসে যায় যাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ভালো না। প্রথম খ-টাই (বিবির পারা কোনতার লা, বাংলায় 'গল্প বলার জন্য বেঁচে থাকা') শুধু লিখতে চেয়েছিলাম আমি। দ্বিতীয় খ-টার কথা ভাবতে গিয়ে দেখছি এমনসব মানুষের প্রসঙ্গ এসে যাচ্ছে অথচ যাদের কথা আমি বলতে চাই না আমার স্মৃতিকথায়। আবার তাদের কথা বাদ-ও দেয়া যায় না, কারণ আমার জীবনে তারাও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, যদিও তাদের বন্ধু বলা যায় না।
যদিও গাবো কারও নাম উল্লেখ করলেন না, স্বাভাবিকভাবেই আমরা মারিও বার্গাস ইয়োসার প্রসঙ্গ না টেনে পারলাম না, পেরুর এই বিখ্যাত লেখকের সঙ্গে গার্সিয়া মার্কেসের বন্ধুত্বের অবসান ঘটেছিল এই মেঙ্েিকাতে, ১৯৭৬ সালে দুজনের মধ্যে একটা ব্যক্তিগত কোন্দলের ফলশ্রুতিতে। ঠিক কী হয়েছিল সেটা স্পষ্ট না হলেও জানা যায় যে, সবার সম্মুখেই গার্সিয়া মার্কেস বার্গাস ইয়োসাকে ঘুষি মেরেছিলেন। আমরা গাবোকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'কোনো একদিন আপনাদের মধ্যে মিটমাট হবে-এমনটি কি আশা করা যায়?' ঠিক সেই মুহূর্তে তার স্ত্রী মের্সেদেস বার্চা, যিনি এই কয়েক মিনিট হয় রুমটিতে ঢুকেছেন, জোর গলায় উত্তর দিলেন, 'আমি যতদিন বেঁচে আছি সেটা হচ্ছে না। ত্রিশ বছর তো কেটেই গেল।'
'কি বল? এতগুলো বছর?' অবাক বিস্ময়ে গাবো জিজ্ঞাসা করলেন। মের্সেদেস পুনর্ব্যক্ত করলেন 'উনি তো এই ব্যাপারে নিজে কিছু বলবেন না, চাইছেন, আমি বলি... এই ত্রিশটা বছর বার্গাস ইয়োসাকে ছাড়া আমাদের এত ভালো কেটেছে যে, তার সঙ্গের তো আর প্রয়োজন দেখি না। তাকে বাদ দিয়েই বাকিটা জীবন কেটে যেতে পারে।'
এরপর লেখালেখির প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে গাবো জানালেন যে, 'গেল এক বছর তো কিছুই না লিখে পার করে দিলাম এবং এই বছরটাও কোনো এক অজুহাতে এভাবে কাটিয়ে দেব বলে ভাবছি। এখন তো পড়েই মজা পাচ্ছি, কিছু লিখতে হচ্ছে না, দেখি এরকম কতদিন যায়। মনে হয় না সেটা খারাপ কিছু হবে, কি বলেন? যদি আবার আগামীকালই একটা উপন্যাস মাথায় ভর কতে তাহলে তো অন্য কথা!
সত্যি কথা বলতে ঠিক, আমি যেভাবে লিখি, তাতে করে একটা উপন্যাস লেখা এমন কোনো কঠিন ব্যাপার না, কম্পিউটারের সামনে বসলেই হলো... কিন্তু লোকজন ঠিকই ধরতে পারবে ফাঁকিটা, যদি তাদের মনে ধরার মতো কোনো লেখা সেটা না হয়ে দাঁড়ায়। এই রুমেই, ওই তো ওখানে, আমার ঠিক পিছনে অনেক তথ্যাদি, নোট, টুকিটাকি সব লেখা আছে। যেদিন লিখব সেদিন ওগুলো নিয়ে বসা যাবে। লেখার কোনো বিষয় মাথায় এলে খুবই ভালো লাগবে, কিন্তু আপাতত বসে ওরকম কোনো বিষয় নিয়ে ভাবনা-চিন্তার তাগিদ অনুভব করছি না। লোকজনের জানা উচিত যে, যদি নতুন কোনো কিছু লিখি তবে সেটা লেখার তাগিদ আর তাড়না থেকেই লেখা হবে।
আদতে বলা যায়,' আগের মতো ভয়ে-শঙ্কায় আমার ঘুম আর ভাঙে না, স্বপ্নে সেসব মৃত ব্যক্তিরা আর হানা দেয় না যাদের কথা শুনেছিলোম নানীর কাছ থেকে ছোটবেলায়, সেই আরাকাতাকায়। হয়তো এভাবে বলা যায় যে, বলার মতো কোনো বিষয় আর অবশিষ্ট নেই আমার কাছে।'
এখন পর্যন্ত গার্সিয়া মার্কেসের সর্বশেষ বইটি হলো মেমোরিয়া দে মিস পুতাস ত্রিস্তেস ('আমার দুঃখভারাতুর বেশ্যাদের স্মৃতিকথা') নামের ছোট উপন্যাস, যেটি ২০০৪ সালে বাজারে এসেছিল। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কোটি কোটি ভক্ত-পাঠকরা আশা করবেন যে, এটাই যেন লেখকের শেষ বই না হয়। 'এ বইটাও ঠিক লেখার কথা ছিল না', গাবো বললেন। 'মূলত অন্য একটি বইয়ের পরিকল্পনা থেকেই উদ্ভূত এই বইয়ের ধারণা, বেশ্যালয়কেন্দ্রিক একগুচ্ছ গল্প নিয়ে মূল বইটি হওয়ার কথা ছিল। সে মাফিক লিখলামও পাঁচ-ছয়টা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা মাত্র গল্পই ভালো লাগল আর সেটা নিয়েই বইটা লিখলাম। আমার মনে হয়েছিল যে, বিষয় হিসেবে মন্দ না, মনে মনে ওরকম একটা বিষয়ই খুঁজছিলাম লেখার জন্য। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথম গল্পগুলো বাদ দিয়ে ওই শেষের গল্পটা নিয়েই বইটা করি। আরও একটা বইয়ের পরিকল্পনা ছিল, কাজও কিছু করেছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর লেখা হলো না। গল্পটা ছিল এক লোককে নিয়ে যে মারা যাওয়ার আগে শেষ বাক্যটা লিখবে এরকম- 'দেখি তোমার বেলায়ও এটা ঘটে কি না...।'
আপাতত লেখালেখি ছেড়ে দিয়ে মনে হয় না গাবোর জীবন কষ্ট বা দুঃখের মধ্যে কাটছে, বরং খেয়াল করা যায় এরকম ক্যারিবীয় স্বভাবসুলভ ঔদাসীন্য-'লেখালেখি ছেড়ে দিলেও আমার জীবন এতটুকু বদলায়নি, এটাই সবচেয়ে সুখের কথা। আগে লেখালেখির জন্য যে সময়টা ভালোই কাটছে, বিরক্তিকর কিছু একটা করতে হচ্ছে না।'
এরপর আমাদের কথাবার্তায় ক্ষমতা ও রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ চলে আসে। বিশ্বের বড় বড় অনেক বাঘা-বাঘা রাজনৈতিক নেতারা ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে গার্সিয়া মার্কেস ওঠা-বসা করেছেন, সাক্ষাৎ ঘটেছে তাদের মধ্যে, একই মঞ্চে উপবিষ্ট হয়েছেন। 'আমি যেহেতু লেখক, ক্ষমতা ব্যাপারটা আমাকে টানে, কারণ ব্যক্তি মানুষের সব সাহায্য ও অসহায়ত্বের সংক্ষিপ্তসার হলো ক্ষমতা।'
ক্ষমতাধর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের কথা বলতে গিয়ে গাবো জানান যে, 'ও চমৎকার একজন মানুষ। তার সঙ্গে যতটুকুই সময় কেটেছে আমার বেশ ভালো কেটেছে। এইডস রোগটা নিয়ে যারপরনাই চিন্তিত তিনি, বিশেষ করে ক্যারিবীয় অঞ্চলসহ পৃথিবীর নানা কোণে নতুন করে এইডসের ছড়াছড়িতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলতে গেলে একেবারে উদাসীন এ ব্যাপারে। এইডস বিষয়ে তার যথেষ্ট জ্ঞান।'
নিজ বাড়িতে আয়েশে সিনেমা দেখার জন্য আলাদা একটি রুম সাজিয়েছেন। আমাদের রুমটি দেখালেন। 'বাইরে গিয়ে সিনেমা দেখাটা আমার জন্য যথেষ্ট মুশকিল, দেখা যাবে সিনেমা হলের প্রবেশদ্বারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেবল অটোগ্রাফই দিচ্ছি। তাই পরিচালক-প্রযোজকরা সিনেমার কপি পাঠিয়ে দেন আমাকে, নিজ বাড়িতে নিজের এই সিনেমা হলেই বসে ওগুলো দেখি নয় তো খুবই বিশেষ কোনো প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকলে বিশেষ বিবেচনায় সেগুলো গিয়ে দেখি।'
সিনেমার প্রতি গার্সিয়া মার্কেসের অদম্য ভালোবাসার কথা নতুন করে বলার কিছু নাই। ছোটবেলা থেকেই চলচ্চিত্র পরিচালক হওয়ার স্বপ্ন দেখে আসছেন। নিজে সেটা হতে পারেননি কিন্তু ছেলে রোদ্রিগো একজন চলচ্চিত্র পরিচালক। কান, লোকার্নো, সান সেবাস্তিয়ান-এর বড় বড় চলচ্চিত্র উৎসবে হরদম সে নিমন্ত্রিত হয়। তার পরিচালিত সিনেমার মধ্যে 'দিয়েস্ পেকেনিয়োস্ ইস্তোরিয়াস্ দে আমোর' এবং 'নুয়েবে বিদাস্্' উল্লেখযোগ্য।
'ভাগ্য ভালো যে ওর তৈরি সিনেমাগুলো ভালো'- ছেলের সিনেমা নিয়ে বাবা গার্সিয়া মার্কেসের মন্তব্য। 'আমার ভালো না লাগলে কি যে বিশ্রী অবস্থা হতো।' গার্সিয়া মার্কেসের দুই ছেলে-রোদ্রিগো থাকে হলিউডে আর ছোট ছেলে গোন্সালো হল গ্রাফিক ডিজাইনার ও চিত্রকর, থাকে প্যারিসে। এ মুহূর্তে দুজনই বাবা-মা'র সঙ্গে ছুটি কাটাচ্ছেন এখানে মেক্সিকো এই বাড়িতে। বাবা গাবো সম্পর্কে পুত্র গোনসালো'র মন্তব্য-বাবা হিসেবে গার্সিয়া মার্কেস ছিলেন অন্য রকম, আমাদের সঙ্গে খেলতেন না, বরং গল্প করতেন, কথা বলতেন, যেন আমরা ছোট না, বড়, প্রাপ্তবয়স্ক। যেগুলো বড়দের বিষয় সেগুলো নিয়েও আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন। ছোট থাকতে তার সঙ্গে আমাদের সময় কেটেছে কেবল কথা বলে ও গান শুনে।'
যতই দিন গেছে এবং খ্যাতি বেড়েছে গার্সিয়া মার্কেস্্ ততই নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে একেবারে আড়ালে নিয়ে গেছেন, সব সময় খেয়ালে রেখেছেন তার খ্যাতির কোনো নেতিবাচক প্রভাব যেন না পড়ে তার ব্যক্তিগত জীবনে বিশেষ করে নিজ পরিবার, ছেলে, নাতি-নাতনি এবং বন্ধুদের জন্য যেন নিজের মতো করে দেয়ার সময় থাকে।
বললেন, 'খ্যাতি এক সময় আমার জীবনের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছিল, এমনটাই যে বাস্তবতার ধারণাটাই লোপ পেতে যাচ্ছিল আমার জীবন থেকে। যেমনটা করে ক্ষমতা। এক ধরনের একাকী, নিঃসঙ্গ জগতে নিক্ষেপ করে, কারও সঙ্গেই যেখানে আর সংযোগ স্থাপন করা যায় না, এক ধরনের নির্জনতার শিকার হবেন আপনি।'
লোকচক্ষুর আড়ালেই সব সময় থাকতে চেয়েছেন গাবো। এমনকি রাজনৈতিক পরিম-লে নিজেকে জড়ালেও সময় সময় সরে এসেছেন প্রত্যক্ষ কোনো রাজনৈতিক অবস্থান থেকে। ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সঙ্গে তার বন্ধুত্বের কথা কে না জানে; কিন্তু বিভিন্ন সময়ে গাবোর ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও চেষ্টায় কুবার সরকার যে বহু রাজবন্দিদের বেলায় তাদের আদেশ মওকুফ করেছে কিংবা কঠোর নিয়ম শিথিল করেছে সেটা কয়জন জানি। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বা সামাজিক সঙ্কটে দেখা গেছে ত্রাণকর্তার ভূমিকায়। এল সালভাদোরে তারই হস্তক্ষেপে এরকম একবার একদল ব্যাংক কর্মচারী রেহাই পায় হরণকারীদের কবল থেকে। ১৯৯৫ সালে স্বদেশ কলম্বিয়ায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুয়ান কার্লোস গাবিরিয়াকে হরণকারী বিদ্রোহী গ্রুপ গাবোকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুপারিশ করলে তিনি বলেন, 'কেউ নিশ্চয়ই আশা করবেন না যে, প্রজাতন্ত্রের বাজে একজন প্রেসিডেন্ট হওয়ার অ-দায়িত্বটা আমি নিই।' পরে তারই হস্তক্ষেপে প্রেসিডেন্ট গাবিরিয়াকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং দেশের সাংবিধানিক কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়।
'বরাবর আমি ঘোঁট পাকিয়ে আসছি, অনুমোদনের সুপারিশ করেছি, কিন্তু কোনো চুক্তি, স্বাক্ষরপত্রে সইটই করি নাই। প্রতিবাদে প্রতিরোধের ইশতেহারে স্বাক্ষর দেয়ার চেয়ে বরং আড়ালে থেকে ঘটনা ঘটানোর কাজেই নিয়োজিত হয়েছি বরাবর... মতানৈক্য, বিরোধ, সংঘর্ষ থেকে ঐক্যের মঞ্চে সবাইকে বসানোর, একটা পারস্পরিক আস্থা তৈরি পরিবেশ সৃষ্টি করা, এতটা সমঝোতায় পেঁৗছাটা জরুরি মনে করি।'
বর্তমানে কলম্বিয়ার জাতীয় রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে প্রেসিডেন্ট উরিবের সরকার ও জাতীয় মুক্তি ফোর্সের মধ্যে একটা সমঝোতা স্থাপনে উদগ্রীব গাবো। 'রাজনৈতিক ভায়োলেন্স সব সময়ই ছিল কলম্বিয়া'য় বহু বহু বছর ধরে একটানা হয়ে আসছে। এর পেছনে মূল সমস্যাটা অর্থনৈতিক বৈষম্যের। একদিকে প্রচন্ড ধনী অন্যদিকে প্রচন্ড গরিব জনগোষ্ঠী। কোকেন ব্যবসায় প্রচুর পয়সা, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। ড্রাগ ব্যবসার নিরসন হবে যেদিন সেদিন থেকে সবকিছু বদলে যাবে, দেশের অবস্থা ভালো হবে বলে আমার বিশ্বাস। ড্রাগ কারবারিদের বিশাল অবস্থা, ওরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, এমনকি রাজনীতিও ওদের কব্জায়। বিশ্বের বড় বড় সব ড্রাগ কারবারিই শুধু এর সঙ্গে জড়িত না, ছত্রছায়ায় পুরোপুরি আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও।'
মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ করেছেন:
রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী
0 মন্তব্যসমূহ