মূল : গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ অনুবাদ : মোবারক হোসেন খান 
হঠাৎ শীত শুরু হয়ে গেল। রোববারের প্রার্থনা শেষ হতে না হতেই বলা নেই কওয়া নেই ঝট করে শীত এসে গেল। অথচ শনিবার রাতে কী অসহ্য গরমই না ছিল। রোববার সকালেও কেউ বৃষ্টি হতে পারে বলে ভাবেনি। প্রার্থনা শেষ করে বাইরে বেরিয়ে মেয়েরা হাতের ছাতা খোলার আগেই ঝড়ো হাওয়া বইতে লাগল। বাতাসের তোড়ে বালু ও খড়কুটো মে মাসের আকাশে চক্রাকারে ঘুরতে লাগল। আমার পাশের এক মহিলা বলে উঠল, 'বৃষ্টি আসবে'। আমিও বুঝতে পেরেছিলাম। বারান্দায় পা দিতেই আমার পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। পুরুষের দল ধারেকাছে কোনো বাড়িতে ঠাঁই নেয়ার জন্য দৌড়াতে লাগল। এক হাতে মাথার টুপি চেপে ধরেছিল, অন্য হাতে রুমাল দিয়ে ধুলোবালি থেকে মুখটা বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। একটু পরই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আকাশ অন্ধকার হয়ে গেল। আমাদের মাথার ঠিক কয়েক ইঞ্চি ওপরে যেন সেই অন্ধকার নেমে এলো।
সারাটা সকাল আমার সৎমা আর আমি ব্যালকনির রেলিং ধরে বসে রইলাম। বৃষ্টির জলে রোজমেরিগুলো তাজা হয়ে উঠবে ভাবতে খুব মজা লাগছিল। সাত মাস ধরে ফুলের টবে ফুলগুলো প্রচ- গ্রীষ্মের উত্তাপে তৃষ্ণার্ত দিন কাটাচ্ছিল। রৌদ্রতপ্ত ধুলায় ওদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিল। বৃষ্টির ছোঁয়ায় ওদের দীর্ঘদিনের তৃষ্ণা মিটবে। দুপুর নাগাদ মাটির সোঁদা গন্ধে চারদিক ভরে উঠল। দুপুরে খাওয়ার সময় বাবা বললেন, 'মে মাসে বৃষ্টি হওয়া ভালো লক্ষণ। পরে এর ফল পাওয়া যায়'। আমার সৎমা আমাকে বলল, 'ধর্মোপদেশ গ্রন্থেও এ কথা আছে'। বাবা মার কথা শুনে শুধু হাসলেন। ধীরে-সুস্থে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বারান্দায় বসে চোখ বুজে একটু আয়েশও করলেন। খাবার হজম হবে। কিন্তু ঘুমালেন না। চুপচাপ চোখ বুজে রইলেন। ভাবটা যেন দিবাস্বপ্ন দেখছেন।
সারা বিকাল প্রবল বৃষ্টি হলো। সমস্ত বিকালটা ট্রেনে সফর করলে যেমন গাড়ির একটানা আওয়াজ শোনা যায়, তেমনি যেন আমাদের অনুভূতির গভীরে নাড়া দিতে শুরু করে দিয়েছিল। সোমবার সকালে যখন হিমশীতল কনকনে বাতাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দরজাটা বন্ধ করে দিলাম, তখন বৃষ্টির ঢলে আমাদের অনুভূতি কানায় কানায় পূর্ণ। যেন উপচে পড়তে চাইছিল। আমার সৎমা আর আমি বাগানের দিকে আরেকবার তাকালাম। মে মাসের অসমতল ধূসর মাটির রঙ রাতের মধ্যেই কাদামাটির তালে পরিণত হয়ে গেল। অনেকটা যেন সস্তা সাবানের মতো। জল লাগলেই যেমন গলে কাদার মতো হয়ে যায় ঠিক তেমনি। ফুলের টবগুলোর ফাঁকে ফাঁকে জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। আমার সৎমা বলল, 'এক রাতেই ফুলগুলো প্রচুর জল পেয়ে গেল দেখছি'। কিন্তু তার মুখে হাসি ছিল না। আগের দিনের খুশির ভাবটা কেমন যেন শিথিল আর ক্লান্তিজনক গাম্ভীর্যে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। আমি জবাব দিলাম, 'তুমি ঠিকই বলেছ, তবে ফুলের টবগুলো এখন বারান্দায় তুলে আনা দরকার। বৃষ্টি শেষ না হওয়া পর্যন্ত বারান্দায় রেখে দেয়াই ভালো'। আমার কথায় কাজ হলো। সবাই ধরাধরি করে ফুলের টবগুলো বারান্দায় তুলে রাখল। বৃষ্টির তোড় আরো প্রচ- হলো। প্রবল বেগে বৃষ্টি ঝরা অব্যাহত রাইল। রোববারের স্থানটিতে আজও বাবা বসেছিলেন, কিন্তু মুখে বৃষ্টির কোনো কথা ছিল না। শুধু বললেন, 'গত রাতে ভালো ঘুম হয়নি। ঘুম থেকে ওঠার পর পিঠ ব্যথা করছে'। আর কিছু বললেন না।
ব্যালকনির রেলিংয়ের কাছে চেয়ারে পা তুলে বসে শূন্য বাগানের দিকে তাকিয়ে রইলেন চুপচাপ, নির্বাক। সন্ধ্যাবেলা খেতেও গেলেন না। মুখ তুলে শুধু বললেন, 'বৃষ্টি থামবে বলে তো মনে হচ্ছে না'। আমার হঠাৎ গরমকালের কথা মনে পড়ে গেল। আগস্টের প্রচ- গরমের দিনগুলো যেন ফুরাতে চাইত না। সারা শরীর ভিজে জবজবে হয়ে যেত। গায়ের কাপড় ভিজে সেঁটে লেগে যেত। সময় যেন কাটত না। উহ, কী ভয়ঙ্কর। সেই দীর্ঘ প্রহরগুলোর কথা মনে হতেই আমি শিউরে উঠলাম। বাইরে দেয়ালের দিকে চেয়ে দেখলাম, স্যাঁতসেঁতে সবুজ আগাছাগুলো বৃষ্টির জলে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে। ছোট বাগানটার দিকে তাকালাম। খালি, শূন্য। দেয়ালের পাশে আমার মায়ের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে যে জেসমিন গাছটি দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাকে দেখলাম। বাবা একটা দোলানো চেয়ারে বসে আছেন। পিঠের নিচে একটা বালিশ। পিঠের ব্যথা উপশমের জন্য এ ব্যবস্থা। তার চোখের দৃষ্টি বিষণ্ন। বৃষ্টির গোলকধাঁধায় যেন আনন্দ হারিয়ে গেছে। আগস্টের রাতগুলোর কথা আমার মনে পড়ল। এগুলোর মোহনীয় নীরবতার কথা আমার মনের কোণে জেগে উঠল। কোনো শব্দ নেই। শুধু তেলবিহীন মরচেধরা অক্ষে পৃথিবীর পরিভ্রমণের শতাব্দীপুরান শব্দ ছাড়া আর কিছুই যেন নেই। আমার মনটা হঠাৎ গুমট বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠল।
রোববারের মতো সোমবারও সারা দিন বৃষ্টি হলো, কিন্তু বৃষ্টির রূপ যেন বদলে গেছে বলে আমার মনে হলো। কোথায় যেন কিছু একটা ঘটে গেছে। তাই অবিরাম বৃষ্টি ঝরার রূপও বদলে গেছে। কেমন যেন একটা তিক্ততার ছোঁয়া রয়েছে এই বৃষ্টিতে। আমার হৃদয়ে যেন বৃষ্টির রূপ বদলানোর তফাতটা আমি গভীরভাবে অনুভব করছিলাম।
সন্ধ্যার পর কে যেন আমার পাশ থেকে বলে উঠল, 'উহ, কী বিরক্তিকর, সারা দিন বৃষ্টি আর বৃষ্টি'। আমি মাথা ঘুরিয়ে বুঝতে পারলাম মার্টিন কথা বলছে। আমার পাশের চেয়ারে বসেই যে সে কথা বলছে তাও বুঝতে পারলাম। তার গলার স্বরে পরিবর্তন নেই। ডিসেম্বরের এক সকালে তার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল। সেদিন থেকে আজ অবধি তার কণ্ঠস্বর বা অসাড় ভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। পাঁচ মাস তো এর মধ্যে পার হয়ে গেল। আমি মা হতে চলেছি, আমার পেটে তার সন্তান। সেই ভাবলেশহীন মার্টিন আমার পাশের চেয়ারে বসে আজ কি না বলছে, বৃষ্টি তার কাছে বিরক্তিকর লাগছে। কিন্তু আমি বললাম, 'মোটেই বিরক্তকর নয়। তবে শূন্য বাগানটা দেখে আমার দুঃখ লাগছে। আর বেচারা গাছগুলোকে উপড়ে বাগান থেকে তুলে আনা যাবে না বলে মনে সহানুভূতি জাগছে'। কথা শেষ করে মুখ ঘুরিয়ে মার্টিনের দিকে তাকালাম। কিন্তু মার্টিন নেই। শুধু তার কণ্ঠস্বর যেন আমাকে বলে গেল, 'বৃষ্টি থামবার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না'। আমি কণ্ঠস্বরের দিকে তাকাতেই দেখলাম, চেয়ারটা খালি।
মঙ্গলবার সকালে বাগানে একটা গরু দেখতে পেলাম। ওটাকে যেন একটা জেদি, অবাধ্য আর নিশ্চল কাদামাটির পাথর বলে মনে হচ্ছিল। ওর পায়ের ক্ষুরগুলো পাঁকে ডুবে গেছে আর মাথাটা মাটির দিকে নুয়ে রয়েছে। সকালের দিকে ইট-পাটকেল ছুড়ে বাগান থেকে তাড়াতে চেষ্টা করল সবাই। কিন্তু গরুটার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। শান্তভাবে দাঁড়িয়ে রইল, নিশ্চল পাহাড়ের মতো। ক্ষুর পাঁকে আটকানো। বৃষ্টির দাপটে ওর প্রকা- মাথাটা অবনত। তখনো গরুটাকে তাড়াবার জন্য সবাই বিরক্ত করে মারছিল। অবশেষে বারবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। অথচ তিনি এমনিতে খুবই সহিষ্ণু। তিনি গরুটাকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে গেলেন। বললেন, 'আহা, গরুটাকে আর উত্ত্যক্ত করো না। ওকে একা থাকতে দাও। যে পথ দিয়ে এসেছে সে পথ দিয়েই চলে যাবে ও'।
মঙ্গলবার রাত নাগাদ বৃষ্টি যেন আমাদের হৃৎপিণ্ডের চারপাশে ভীষণ চাপ আর ব্যথার সৃষ্টি করল। প্রথম দিনের বৃষ্টির সেই সজীবতা আর নেই। তার বদলে একটা ভ্যাপসা আর স্যাঁতসেঁতে ভাব দেখা দিল। উষ্ণতার মাত্রা শীতলও নয়, আবার গরমও নয়। যেন একসঙ্গে দুটোই। ঠিক জ্বরের মতো। জুতোর ভেতরে আমাদের পা ঘামতে লাগল। আমাদের গায়ে খালি চামড়া, নাকি গায়ের সঙ্গে কাপড় ছোঁয়া, কোনটা বিরক্তকর ঠিক যেন ঠাহর করতে পারছিলাম না। বাড়ির সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা বারান্দায় বসে আছি। বৃষ্টির দিকে প্রথম দিনের মতো তেমন আর মনোযোগ নেই। বৃষ্টি পড়ার শব্দও যেন আমাদের কানে যাচ্ছিল না। আমরা শুধু বৃষ্টির কুয়াশার ভেতর দিয়ে গাছগুলোকে ছায়ার মতো দেখতে পাচ্ছিলাম। স্বপ্নে অপরিচিত ব্যক্তি দেখলে যেমন জিহ্বা শুকিয়ে যায়, নিঃসঙ্গ অন্ধকারেও যেন আমাদের মনে তেমনি একটা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। আমাদের মন বিষণ্ন হয়ে উঠল। আজ যে মঙ্গলবার আমার ঠিক মনে আছে। কেননা, সান জেরোমিনো গ্রামের দুটো যমজ অন্ধ বোন প্রতি মঙ্গলবারে আমাদের গান শোনাতে আসে। তাদের বিষাদমাখা কণ্ঠে গানের সুর আরো করুণ হয়ে উঠত। বৃষ্টির সুর ছাপিয়ে যেন আমি যমজ অন্ধ বোনের গান শুনতে পেলাম। আমি কল্পনা নেত্রে দেখতে পেলাম যেন তারা বাসায় বসে গান গাইছে আর বৃষ্টি ঝরছে, এ মঙ্গলবার যমজ বোন দুটো ঘর থেকে বেরোতেই পারবে না। প্রতি মঙ্গলবার যে ভিখারিণীটা আসে সেও আজ আসতে পারবে না। দুপুরের ঘুম থেকে উঠে আজ তার ডাক শুনতে পাব না।
সেদিন আমাদের খাওয়ার হিসাব আর ঠিক রইল না। আমার সৎমা মধ্যাহ্নকালীন নিদ্রার পর এক পেয়ালা স্যুপ আর এক টুকরো রুটি খেতে দিল। আমরা কিন্তু সোমবার রাতের পর থেকেই আর ভালো খাবার পাচ্ছিলাম না। বলতে কী, তখন থেকে আমাদের চিন্তাশক্তিও যেন থেমে গিয়েছিল। বৃষ্টি যেন আমাদের বোধশক্তিও অসাড় করে দিয়েছিল। শান্তি আর আত্মসমর্পণের ভাব নিয়ে যেন আমরা প্রকৃতির কাছে নতিস্বীকার করেছিলাম। বিকালের দিকে গরুটা নড়েচড়ে উঠল। হঠাৎ একটা গম্ভীর গুড়গুড় শব্দ যেন তার ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলল। যেন মরে গিয়েছিল। কেবল বেঁচে থাকার অভ্যাসের দরুনই যেন সে পড়ে যাচ্ছিল না। বৃষ্টির মধ্যে এভাবে দাঁড়িয়ে ভেজার পুরনো অভ্যাসের বশেই যেন দাঁড়িয়ে ছিল। হয়তো ওর এ অভ্যাসটুকু দেহের ভার থেকে দুর্বল হয়ে পড়লেই আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত ওকে হার মানতেই হলো। সামনের পা দুটো কাত করে সে মরিয়া হয়ে ওর কালো চকচকে পেছন দিকটা তুলবার শেষ প্রচেষ্টা করে লালা নিঃসরণরত নাক পাঁকে গুঁজে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। নিজের দেহের ভার বইতে পারল না। 'ব্যস, শক্তি ফুরিয়ে গেছে। এর বেশি আর শক্তি ছিল না'। কে যেন আমার পেছন থেকে বলে উঠল। আমি ঘুরিয়ে তাকালাম। দরজায় ভিখারিণীকে দেখতে পেলাম, প্রতি মঙ্গলবারের মতো এই ঝড়ের মধ্যে আজও ঠিক ভিক্ষা চাইতে এসেছে।
বুধবার নাগাদ এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি হয়তো গা-সওয়া হয়ে যেত, কিন্তু বুধবার সকালে ড্রইংরুমে ঢুকেই দেখলাম টেবিলটা ঠেলে দেয়ালের সঙ্গে ঠেকিয়ে তার ওপর সব জিনিসপত্র স্তূপাকারে রাখা হয়েছে। রাতের বেলা একটা কৃত্রিম পাঁচিলের মতো তৈরি করে তার ওপর তুলে দেয়া হয়েছে। এ দৃশ্য দেখে আমার মনে রিক্ততার একটা গভীর অনুভূতি যেন বোধ করলাম। রাত্রিবেলা কী যেন একটা ঘটে গিয়েছিল। সারা বাড়িটা বিশৃঙ্খল হয়ে আছে। একদল মজুর খালি গায়ে আর খালি পায়ে পাতলুন হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে ডাইনিংরুমের ভেতর আসবাবপত্র সরাচ্ছিল। তাদের হাবেভাবে ও কাজকর্মে যেন একটা ব্যর্থ বিদ্রোহের কঠোরতা। বৃষ্টির কাছে অসম্মানজনক পরাজয়ের জন্যই তাদের মনে এই ভাবের সৃষ্টি হয়েছে। আমি উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে লাগলাম। আমার ইচ্ছাশক্তি যেন লোপ পেয়ে গেছে। মনে হলো, আমি যেন আর মাটিতে নেই। একটা জনশূন্য সমতল ভূমিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছি। স্যাঁতসেঁতে শেওলা আর আঠালো ব্যাঙের ছাতায় চারদিক ভরে গেছে। আমি ড্রইংরুমে দাঁড়িয়ে যখন আসবাবপত্রের রূপ দেখছিলাম, বেডরুম থেকে আমার সৎমার সাবধানবাণী শুনতে পেলাম। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে যে প্রচ- ঠা-ার হাত থেকে রক্ষা নেই বারবার সে কথা স্মরণ করিয়ে দিতে লাগল। আর তখনই কেবল সৃষ্টির জলে যে আমার গোড়ালি পর্যন্ত ডুবে গেছে বুঝতে পারলাম। বাড়িতে বৃষ্টির জল জমে গেছে। ঘরের মেঝে চটচটে জলে ডুবে গেছে।
বুধবার দুপুরে দিনের আলো দেখা যাচ্ছিল না। তিনটা বাজতে না বাজতেই রাতের ধ্বনি যেন শোনা যেতে লাগল। বাইরের বৃষ্টির মতো মৃদু অথচ একঘেয়ে ছন্দে অসময়েই রাত ঘনিয়ে আসতে লাগল। সন্ধ্যার অন্ধকার অনেক আগেই নেমে এলো। কেমন যেন কোমল আর বিষাদময়। কর্মক্লান্ত মজুরের দল দেয়ালের সঙ্গে লাগানো চেয়ারে গোল গোল হয়ে বসেছিল। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তারা পরাজিত।
এমন সময় বাইরে থেকে খবর আসতে শুরু করল। না, কেউ সে খবর বয়ে আনেনি। তবু খবর এলো। সংক্ষিপ্ত আর বাছাই করা খবর। রাস্তার ওপর দিয়ে যে নরম কাদার স্রোত বাড়িঘরের জিনিসপত্র, মৃত জন্তুর লাশ, জঞ্জাল আর আবর্জনা বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সেখানেই যেন এ খবরের জন্ম। রোববার যখন বৃষ্টি শুরু হয়েছিল তখন সে বৃষ্টি নতুন মৌসুমের আগমনবার্তা বয়ে এনেছে বলে মনে হয়েছিল। সেই রোববারের ঘটনাই বাড়িতে পেঁৗছাতে দুই দিন লেগে গেল। বুধবার খবর পেঁৗছাল, যেন ঝড়ের অন্তর্নিহিত গতিময়তার তাড়না এই বিলম্বের কারণ। বন্যাকবলিত হয়ে যে গির্জাটি ধসে পড়তে পারে এ কথা সবার জানা ছিল। কে যেন সেদিন রাতে বলল, 'সোমবার থেকে ট্রেন আটকে আছে। পুল পেরোতে পারেনি। নদীর ওপরের সেতুটা জলের স্রোতে ভেসে গেছে'। আরো জানা গেল, একজন অসুস্থ মহিলা বিছানা থেকে উধাও হয়ে গেছেন। সেদিন বিকালে তাকে মৃত অবস্থায় উঠোনে ভাসতে দেখা গেছে। বন্যা আর ভীষণ ভয় আমাকে দারুণভাবে আতঙ্কত করে তুলল। আমি দোলনা চেয়ারে পা দুটো ভাঁজ করে বসে পড়লাম। আমার দৃষ্টি অন্ধকারের দিকে নিবদ্ধ। অন্ধকারের ভেতর দিয়ে যেন একটা অমঙ্গলের পদধ্বনি শুনতে পেলাম। আমার সৎমা দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। তার হাতে একটা বাতি। উঁচু করে ধরে আছে। মাথার ওপরের দিকে সোজা করে রেখেছে। তাকে যেন পরিচিত কোনো ভূত বলে মনে হলো। তাকে দেখে আমি ভয় পাচ্ছিলাম। কারণ আমি যে 'অতিপ্রাকৃত দশা' বিশ্বাস করি। সৎমা আমার দিকে এগিয়ে এলো। তার মাথাটা তখনো উঁচু আর বাতিটা মাথার ওপরে তুলে ধরে রেখেছিল। বারান্দায় জমা জলের ওপর দিয়ে হেঁটে আমার কাছে এসে বলল, 'আমাদের প্রার্থনা করা ছাড়া উপায় নেই'। আমি তার শুকনো আর চিড় খাওয়া মুখের দিকে তাকালাম। মনে হলো, সে যেন এই মাত্র কবর থেকে উঠে এসেছে। তার মধ্যে যেন মানুষের কোনো উপাদানই নেই। সে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তার হাতে জপমালা। একটু থেমে আবার বলল, 'আমাদের প্রার্থনা করতে হবে। বৃষ্টির তোড়ে কবরগুলো ভেঙে গেছে। গোরস্তানের চারদিকে মৃতদেহ ভাসছে'।
সে রাতে আমি বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারিনি। পচা লাশের গন্ধে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আমি মার্টিনকে ধাক্কা দিতে লাগলাম। মার্টিন আমার পাশে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিল। মার্টিন জেগে উঠতেই জিজ্ঞেস করলাম, 'কোনো গন্ধ পাচ্ছ?' সে বলল, 'কীসের গন্ধ?' আমি বললাম, 'সেই গন্ধটা পাচ্ছি, নিশ্চয়ই লাশগুলো রাস্তায় ভাসছে'। মরা লাশের কথা ভাবতেই আমি আতঙ্কে শিউরে উঠলাম। কিন্তু মার্টিন ওপাশ ফিরে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুলো আর ঘুম জড়ানো ফ্যাসফ্যাস স্বরে বলল, 'তুমিও যেমন, উহ, গর্ভবতী মেয়েদের মগজে যত্তসব আজেবাজে চিন্তা'।
বৃহস্পতিবার ভোরে গন্ধটা চলে গেল। সময়ের হিসাবেও যেন সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে গেল। বৃহস্পতিবার বলে যেন কিছু নেই। বৃহস্পতিবারটা যেন একটা কৃষ্ণ পদার্থ। কেউ ইচ্ছা করলেই তাকে ঠেলে পাশে সরিয়ে শুক্রবারে পেঁৗছে যেতে পারে। নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য বোঝা যাচ্ছিল না। আমার সৎমা, আমার বাবা আর মজুরের দল যেন চর্বি আর অর্থহীন সব পদার্থ। শীতের জলাভূমিতে হাঁটাচলা করছে। বাবা আমাকে বললেন, 'কী ঘটেছে তোমাকে না বলা পর্যন্ত তুমি এখান থেকে নড়বে না'। তার গলার স্বর এখন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে বলে মনে হলো। কথার ভঙ্গিটা যেন পরোক্ষ, আর তার কথাগুলো যেন কান নয় স্পর্শ দিয়ে উপলব্ধি করতে হচ্ছিল। কেননা, এই একটামাত্র বোধশক্তিই যেন তখনো অবশিষ্ট ছিল।
কিন্তু বাবা ফিরে এলেন না। তিনি যেন সময়ের ওপারে হারিয়ে গেছেন। সন্ধ্যার পর তাই আমার সৎমাকে ডেকে আমার সঙ্গে শোবার ঘরে শুতে বললাম। সে রাতে আমার ঘুমে কোনো বিঘ্ন ঘটল না। শান্তিতে সারা রাত ঘুমালাম। পর দিনও একই ব্যবস্থা। কোনো পরিবর্তন নেই। বর্ণহীন, গন্ধহীন আর উত্তাপহীন। ঘুম থেকে উঠেই আমি একটা চেয়ারে বসে পড়লাম এবং নিশ্চল বসে রইলাম। আমার চেতনার কোনো একটা অঙ্গের ঘুম যেন তখনো ভাঙেনি। এমন সময় আমি গাড়ির হুইসেল শুনতে পেলাম। গাড়ির একটানা হুইসেল যেন ঝড়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ছুটে পালাচ্ছিল। 'নিশ্চয়ই কোথাও পথ খুলে গেছে', আমি মনে মনে ভাবলাম। পেছন থেকে যেন কার কণ্ঠস্বর আমার মনের কথার জবাব দিল, 'কোথায়?' আমি ঘুরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কে ওখানে?' আমার সৎমাকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, সে বলল, 'আমি!' আমি তখন বললাম, 'শুনতে পাচ্ছ?' সে শুনতে পাচ্ছে বলে জানাল। ধারেকাছে কোথা হয়তো পথ পরিষ্কার হয়ে গেছে। রেললাইন মেরামত হয়ে গেছে। একটু পরে আমার হাতে সকালের নাশতার ট্রে এনে দিল। তখনো ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। রসুনের চাটনি আর সিদ্ধ চর্বির গন্ধ পেলাম। ট্রের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এক পেয়ালা স্যুপ। হঠাৎ যেন অপ্রতিভ হয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি তার কাছে এখন সময় কত জানতে চাইলাম। বেশ শান্ত, কিন্তু অবসন্ন কণ্ঠে সৎমা বলল, 'আড়াইটা হবে। ট্রেনটা ঠিক সয়মমতোই গেল দেখছি'। আমি বিস্মিত কণ্ঠে বললাম, 'আড়াইটা! আমি এতক্ষণ ধরে ঘুমালাম কেমন করে?' সৎমা বলল, 'তুমি বেশিক্ষণ ঘুমাওনি'। আমার সারা শরীর কাঁপতে শুরু করল। হাত থেকে ট্রেটা পড়ে যাবে মনে হচ্ছিল। আমি কম্পিতস্বরে বললাম, 'শুক্রবার আড়াইটা...'। আমার সৎমা হিমশীতল কণ্ঠে বলল 'না, না, বিষুদবার আড়াইটা। বিষুদবার আড়াইটা এখনো পেরোয়নি'।
কতক্ষণ এমন ঘোরের ঘোরে ছিলাম জানি না। আমার সব বোধশক্তি যেন লোপ পেয়ে গিয়েছিল। শুধু মনে হলো, অনেক যুগ পরে যেন পাশের ঘরে কারো কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। কে যেন বলছে, 'এখন বিছানাটা সরাতে পার'। যে কথা বলছিল তাকে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। তবে কোনো রুগ্ন মানুষের কণ্ঠস্বর নয়। অসুখের পর বিশ্রামরত মানুষের গলার স্বর মনে হলো। এমন সময় আমি জলে ইট ছুড়ে ফেলার শব্দ শুনতে পেলাম। আমি যেন জমাট বেঁধে গেছি, কিন্তু একটু পরেই বুঝলাম আমি শুয়ে আছি। আমার ভেতর দারুণ একটা শূন্যতা যেন অনুভব করলাম। সারা বাড়িতে যেন প্রচ- নির্জনতার স্পন্দন বিরাজ করছে, আবিশ্বাস্য নিশ্চলতার ছোঁয়া যেন সর্বত্র। হঠাৎ আমার হৃৎপি-টা জমাটবাঁধা পাথরে পরিণত হয়ে গেল। আমার মনে হলো, 'আমি মরে গেছি। হায় ঈশ্বর! আমি মরে গেছি'। হঠাৎ বিছানায় লাফিয়ে উঠলাম। চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম, 'অ্যাদা! অ্যাদা!' মার্টিন ওপাশ থেকে নীরস কণ্ঠে উত্তর দিল, 'সবাই বাইরে গেছে। তোমার ডাক কেউ শুনতে পাবে না'। তখনই কেবল আমি বুঝতে পারলাম, সব পরিষ্কার হয়ে গেছে, একটা নিস্তব্ধতা, একটা প্রশান্তি, একটা রহস্যময় ও প্রগাঢ় শান্ত পরিবেশ আমাদের চারদিকে বিরাজ করছে, ঠিক যেন মৃত্যুর মতো। এমন সময় বারান্দায় পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। একটা সজীব ও সুস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। একটা বাতাসের ঝাপটা লেগে দরজার কপাট ক্যাঁচক্যাঁচ করে উঠল। পাকা ফলের মতো একটা নিরেট বস্তু যেন উঠোনের ডোবাতে ঝপ করে পড়ল। বাতাসে কী যেন একটা লুকিয়ে ছিল, আর সেই লুকানো বস্তুটা অন্ধারের ভেতর হাস্যরত কোনো একজন অদৃশ্য মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছিল। 'হে ঈশ্বর!' আমি সময়ের কথা ভুলে গিয়ে বলে উঠলাম, 'এক্ষুনি কেউ এসে আমাকে রোববারের উপাসনায় যেতে বললে আমি মোটেই বিস্মিত হব না!'
লেখক পরিচিতি : গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ল্যাটিন আমেরিকার কলম্বিয়া প্রদেশের একটি ছোট শহরে ১৯২৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বোগাটার ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। অধ্যয়ন শেষে সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেন। অচিরেই তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন এবং সাহিত্যিক হিসেবে সাহিত্য ভুবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি একজন ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক। তার রচিত ছোটগল্প গ্রন্থের মধ্যে 'লিফ স্টর্ম', 'নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল' ও 'ইনোসেন্ট এরেনডিরা' এবং উপন্যাসের মধ্যে 'ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচুভ' (শতবর্ষের নির্জনতা) ও 'দি অটাম অব দ্য প্যাট্রিয়ার্ক' উল্লেখযোগ্য। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮২ সালে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১৪ সালের এপ্রিলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 'ইসাবেলার স্বগতোক্তি' মার্কেজ রচিত 'ইসাবেলা'স সলিলোকুই' গল্পের অনুবাদ।]

হঠাৎ শীত শুরু হয়ে গেল। রোববারের প্রার্থনা শেষ হতে না হতেই বলা নেই কওয়া নেই ঝট করে শীত এসে গেল। অথচ শনিবার রাতে কী অসহ্য গরমই না ছিল। রোববার সকালেও কেউ বৃষ্টি হতে পারে বলে ভাবেনি। প্রার্থনা শেষ করে বাইরে বেরিয়ে মেয়েরা হাতের ছাতা খোলার আগেই ঝড়ো হাওয়া বইতে লাগল। বাতাসের তোড়ে বালু ও খড়কুটো মে মাসের আকাশে চক্রাকারে ঘুরতে লাগল। আমার পাশের এক মহিলা বলে উঠল, 'বৃষ্টি আসবে'। আমিও বুঝতে পেরেছিলাম। বারান্দায় পা দিতেই আমার পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। পুরুষের দল ধারেকাছে কোনো বাড়িতে ঠাঁই নেয়ার জন্য দৌড়াতে লাগল। এক হাতে মাথার টুপি চেপে ধরেছিল, অন্য হাতে রুমাল দিয়ে ধুলোবালি থেকে মুখটা বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। একটু পরই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আকাশ অন্ধকার হয়ে গেল। আমাদের মাথার ঠিক কয়েক ইঞ্চি ওপরে যেন সেই অন্ধকার নেমে এলো।
সারাটা সকাল আমার সৎমা আর আমি ব্যালকনির রেলিং ধরে বসে রইলাম। বৃষ্টির জলে রোজমেরিগুলো তাজা হয়ে উঠবে ভাবতে খুব মজা লাগছিল। সাত মাস ধরে ফুলের টবে ফুলগুলো প্রচ- গ্রীষ্মের উত্তাপে তৃষ্ণার্ত দিন কাটাচ্ছিল। রৌদ্রতপ্ত ধুলায় ওদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিল। বৃষ্টির ছোঁয়ায় ওদের দীর্ঘদিনের তৃষ্ণা মিটবে। দুপুর নাগাদ মাটির সোঁদা গন্ধে চারদিক ভরে উঠল। দুপুরে খাওয়ার সময় বাবা বললেন, 'মে মাসে বৃষ্টি হওয়া ভালো লক্ষণ। পরে এর ফল পাওয়া যায়'। আমার সৎমা আমাকে বলল, 'ধর্মোপদেশ গ্রন্থেও এ কথা আছে'। বাবা মার কথা শুনে শুধু হাসলেন। ধীরে-সুস্থে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বারান্দায় বসে চোখ বুজে একটু আয়েশও করলেন। খাবার হজম হবে। কিন্তু ঘুমালেন না। চুপচাপ চোখ বুজে রইলেন। ভাবটা যেন দিবাস্বপ্ন দেখছেন।
সারা বিকাল প্রবল বৃষ্টি হলো। সমস্ত বিকালটা ট্রেনে সফর করলে যেমন গাড়ির একটানা আওয়াজ শোনা যায়, তেমনি যেন আমাদের অনুভূতির গভীরে নাড়া দিতে শুরু করে দিয়েছিল। সোমবার সকালে যখন হিমশীতল কনকনে বাতাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দরজাটা বন্ধ করে দিলাম, তখন বৃষ্টির ঢলে আমাদের অনুভূতি কানায় কানায় পূর্ণ। যেন উপচে পড়তে চাইছিল। আমার সৎমা আর আমি বাগানের দিকে আরেকবার তাকালাম। মে মাসের অসমতল ধূসর মাটির রঙ রাতের মধ্যেই কাদামাটির তালে পরিণত হয়ে গেল। অনেকটা যেন সস্তা সাবানের মতো। জল লাগলেই যেমন গলে কাদার মতো হয়ে যায় ঠিক তেমনি। ফুলের টবগুলোর ফাঁকে ফাঁকে জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। আমার সৎমা বলল, 'এক রাতেই ফুলগুলো প্রচুর জল পেয়ে গেল দেখছি'। কিন্তু তার মুখে হাসি ছিল না। আগের দিনের খুশির ভাবটা কেমন যেন শিথিল আর ক্লান্তিজনক গাম্ভীর্যে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। আমি জবাব দিলাম, 'তুমি ঠিকই বলেছ, তবে ফুলের টবগুলো এখন বারান্দায় তুলে আনা দরকার। বৃষ্টি শেষ না হওয়া পর্যন্ত বারান্দায় রেখে দেয়াই ভালো'। আমার কথায় কাজ হলো। সবাই ধরাধরি করে ফুলের টবগুলো বারান্দায় তুলে রাখল। বৃষ্টির তোড় আরো প্রচ- হলো। প্রবল বেগে বৃষ্টি ঝরা অব্যাহত রাইল। রোববারের স্থানটিতে আজও বাবা বসেছিলেন, কিন্তু মুখে বৃষ্টির কোনো কথা ছিল না। শুধু বললেন, 'গত রাতে ভালো ঘুম হয়নি। ঘুম থেকে ওঠার পর পিঠ ব্যথা করছে'। আর কিছু বললেন না।
ব্যালকনির রেলিংয়ের কাছে চেয়ারে পা তুলে বসে শূন্য বাগানের দিকে তাকিয়ে রইলেন চুপচাপ, নির্বাক। সন্ধ্যাবেলা খেতেও গেলেন না। মুখ তুলে শুধু বললেন, 'বৃষ্টি থামবে বলে তো মনে হচ্ছে না'। আমার হঠাৎ গরমকালের কথা মনে পড়ে গেল। আগস্টের প্রচ- গরমের দিনগুলো যেন ফুরাতে চাইত না। সারা শরীর ভিজে জবজবে হয়ে যেত। গায়ের কাপড় ভিজে সেঁটে লেগে যেত। সময় যেন কাটত না। উহ, কী ভয়ঙ্কর। সেই দীর্ঘ প্রহরগুলোর কথা মনে হতেই আমি শিউরে উঠলাম। বাইরে দেয়ালের দিকে চেয়ে দেখলাম, স্যাঁতসেঁতে সবুজ আগাছাগুলো বৃষ্টির জলে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে। ছোট বাগানটার দিকে তাকালাম। খালি, শূন্য। দেয়ালের পাশে আমার মায়ের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে যে জেসমিন গাছটি দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাকে দেখলাম। বাবা একটা দোলানো চেয়ারে বসে আছেন। পিঠের নিচে একটা বালিশ। পিঠের ব্যথা উপশমের জন্য এ ব্যবস্থা। তার চোখের দৃষ্টি বিষণ্ন। বৃষ্টির গোলকধাঁধায় যেন আনন্দ হারিয়ে গেছে। আগস্টের রাতগুলোর কথা আমার মনে পড়ল। এগুলোর মোহনীয় নীরবতার কথা আমার মনের কোণে জেগে উঠল। কোনো শব্দ নেই। শুধু তেলবিহীন মরচেধরা অক্ষে পৃথিবীর পরিভ্রমণের শতাব্দীপুরান শব্দ ছাড়া আর কিছুই যেন নেই। আমার মনটা হঠাৎ গুমট বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠল।
রোববারের মতো সোমবারও সারা দিন বৃষ্টি হলো, কিন্তু বৃষ্টির রূপ যেন বদলে গেছে বলে আমার মনে হলো। কোথায় যেন কিছু একটা ঘটে গেছে। তাই অবিরাম বৃষ্টি ঝরার রূপও বদলে গেছে। কেমন যেন একটা তিক্ততার ছোঁয়া রয়েছে এই বৃষ্টিতে। আমার হৃদয়ে যেন বৃষ্টির রূপ বদলানোর তফাতটা আমি গভীরভাবে অনুভব করছিলাম।
সন্ধ্যার পর কে যেন আমার পাশ থেকে বলে উঠল, 'উহ, কী বিরক্তিকর, সারা দিন বৃষ্টি আর বৃষ্টি'। আমি মাথা ঘুরিয়ে বুঝতে পারলাম মার্টিন কথা বলছে। আমার পাশের চেয়ারে বসেই যে সে কথা বলছে তাও বুঝতে পারলাম। তার গলার স্বরে পরিবর্তন নেই। ডিসেম্বরের এক সকালে তার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল। সেদিন থেকে আজ অবধি তার কণ্ঠস্বর বা অসাড় ভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। পাঁচ মাস তো এর মধ্যে পার হয়ে গেল। আমি মা হতে চলেছি, আমার পেটে তার সন্তান। সেই ভাবলেশহীন মার্টিন আমার পাশের চেয়ারে বসে আজ কি না বলছে, বৃষ্টি তার কাছে বিরক্তিকর লাগছে। কিন্তু আমি বললাম, 'মোটেই বিরক্তকর নয়। তবে শূন্য বাগানটা দেখে আমার দুঃখ লাগছে। আর বেচারা গাছগুলোকে উপড়ে বাগান থেকে তুলে আনা যাবে না বলে মনে সহানুভূতি জাগছে'। কথা শেষ করে মুখ ঘুরিয়ে মার্টিনের দিকে তাকালাম। কিন্তু মার্টিন নেই। শুধু তার কণ্ঠস্বর যেন আমাকে বলে গেল, 'বৃষ্টি থামবার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না'। আমি কণ্ঠস্বরের দিকে তাকাতেই দেখলাম, চেয়ারটা খালি।
মঙ্গলবার সকালে বাগানে একটা গরু দেখতে পেলাম। ওটাকে যেন একটা জেদি, অবাধ্য আর নিশ্চল কাদামাটির পাথর বলে মনে হচ্ছিল। ওর পায়ের ক্ষুরগুলো পাঁকে ডুবে গেছে আর মাথাটা মাটির দিকে নুয়ে রয়েছে। সকালের দিকে ইট-পাটকেল ছুড়ে বাগান থেকে তাড়াতে চেষ্টা করল সবাই। কিন্তু গরুটার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। শান্তভাবে দাঁড়িয়ে রইল, নিশ্চল পাহাড়ের মতো। ক্ষুর পাঁকে আটকানো। বৃষ্টির দাপটে ওর প্রকা- মাথাটা অবনত। তখনো গরুটাকে তাড়াবার জন্য সবাই বিরক্ত করে মারছিল। অবশেষে বারবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। অথচ তিনি এমনিতে খুবই সহিষ্ণু। তিনি গরুটাকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে গেলেন। বললেন, 'আহা, গরুটাকে আর উত্ত্যক্ত করো না। ওকে একা থাকতে দাও। যে পথ দিয়ে এসেছে সে পথ দিয়েই চলে যাবে ও'।
মঙ্গলবার রাত নাগাদ বৃষ্টি যেন আমাদের হৃৎপিণ্ডের চারপাশে ভীষণ চাপ আর ব্যথার সৃষ্টি করল। প্রথম দিনের বৃষ্টির সেই সজীবতা আর নেই। তার বদলে একটা ভ্যাপসা আর স্যাঁতসেঁতে ভাব দেখা দিল। উষ্ণতার মাত্রা শীতলও নয়, আবার গরমও নয়। যেন একসঙ্গে দুটোই। ঠিক জ্বরের মতো। জুতোর ভেতরে আমাদের পা ঘামতে লাগল। আমাদের গায়ে খালি চামড়া, নাকি গায়ের সঙ্গে কাপড় ছোঁয়া, কোনটা বিরক্তকর ঠিক যেন ঠাহর করতে পারছিলাম না। বাড়ির সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা বারান্দায় বসে আছি। বৃষ্টির দিকে প্রথম দিনের মতো তেমন আর মনোযোগ নেই। বৃষ্টি পড়ার শব্দও যেন আমাদের কানে যাচ্ছিল না। আমরা শুধু বৃষ্টির কুয়াশার ভেতর দিয়ে গাছগুলোকে ছায়ার মতো দেখতে পাচ্ছিলাম। স্বপ্নে অপরিচিত ব্যক্তি দেখলে যেমন জিহ্বা শুকিয়ে যায়, নিঃসঙ্গ অন্ধকারেও যেন আমাদের মনে তেমনি একটা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। আমাদের মন বিষণ্ন হয়ে উঠল। আজ যে মঙ্গলবার আমার ঠিক মনে আছে। কেননা, সান জেরোমিনো গ্রামের দুটো যমজ অন্ধ বোন প্রতি মঙ্গলবারে আমাদের গান শোনাতে আসে। তাদের বিষাদমাখা কণ্ঠে গানের সুর আরো করুণ হয়ে উঠত। বৃষ্টির সুর ছাপিয়ে যেন আমি যমজ অন্ধ বোনের গান শুনতে পেলাম। আমি কল্পনা নেত্রে দেখতে পেলাম যেন তারা বাসায় বসে গান গাইছে আর বৃষ্টি ঝরছে, এ মঙ্গলবার যমজ বোন দুটো ঘর থেকে বেরোতেই পারবে না। প্রতি মঙ্গলবার যে ভিখারিণীটা আসে সেও আজ আসতে পারবে না। দুপুরের ঘুম থেকে উঠে আজ তার ডাক শুনতে পাব না।
সেদিন আমাদের খাওয়ার হিসাব আর ঠিক রইল না। আমার সৎমা মধ্যাহ্নকালীন নিদ্রার পর এক পেয়ালা স্যুপ আর এক টুকরো রুটি খেতে দিল। আমরা কিন্তু সোমবার রাতের পর থেকেই আর ভালো খাবার পাচ্ছিলাম না। বলতে কী, তখন থেকে আমাদের চিন্তাশক্তিও যেন থেমে গিয়েছিল। বৃষ্টি যেন আমাদের বোধশক্তিও অসাড় করে দিয়েছিল। শান্তি আর আত্মসমর্পণের ভাব নিয়ে যেন আমরা প্রকৃতির কাছে নতিস্বীকার করেছিলাম। বিকালের দিকে গরুটা নড়েচড়ে উঠল। হঠাৎ একটা গম্ভীর গুড়গুড় শব্দ যেন তার ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলল। যেন মরে গিয়েছিল। কেবল বেঁচে থাকার অভ্যাসের দরুনই যেন সে পড়ে যাচ্ছিল না। বৃষ্টির মধ্যে এভাবে দাঁড়িয়ে ভেজার পুরনো অভ্যাসের বশেই যেন দাঁড়িয়ে ছিল। হয়তো ওর এ অভ্যাসটুকু দেহের ভার থেকে দুর্বল হয়ে পড়লেই আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত ওকে হার মানতেই হলো। সামনের পা দুটো কাত করে সে মরিয়া হয়ে ওর কালো চকচকে পেছন দিকটা তুলবার শেষ প্রচেষ্টা করে লালা নিঃসরণরত নাক পাঁকে গুঁজে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। নিজের দেহের ভার বইতে পারল না। 'ব্যস, শক্তি ফুরিয়ে গেছে। এর বেশি আর শক্তি ছিল না'। কে যেন আমার পেছন থেকে বলে উঠল। আমি ঘুরিয়ে তাকালাম। দরজায় ভিখারিণীকে দেখতে পেলাম, প্রতি মঙ্গলবারের মতো এই ঝড়ের মধ্যে আজও ঠিক ভিক্ষা চাইতে এসেছে।
বুধবার নাগাদ এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি হয়তো গা-সওয়া হয়ে যেত, কিন্তু বুধবার সকালে ড্রইংরুমে ঢুকেই দেখলাম টেবিলটা ঠেলে দেয়ালের সঙ্গে ঠেকিয়ে তার ওপর সব জিনিসপত্র স্তূপাকারে রাখা হয়েছে। রাতের বেলা একটা কৃত্রিম পাঁচিলের মতো তৈরি করে তার ওপর তুলে দেয়া হয়েছে। এ দৃশ্য দেখে আমার মনে রিক্ততার একটা গভীর অনুভূতি যেন বোধ করলাম। রাত্রিবেলা কী যেন একটা ঘটে গিয়েছিল। সারা বাড়িটা বিশৃঙ্খল হয়ে আছে। একদল মজুর খালি গায়ে আর খালি পায়ে পাতলুন হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে ডাইনিংরুমের ভেতর আসবাবপত্র সরাচ্ছিল। তাদের হাবেভাবে ও কাজকর্মে যেন একটা ব্যর্থ বিদ্রোহের কঠোরতা। বৃষ্টির কাছে অসম্মানজনক পরাজয়ের জন্যই তাদের মনে এই ভাবের সৃষ্টি হয়েছে। আমি উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে লাগলাম। আমার ইচ্ছাশক্তি যেন লোপ পেয়ে গেছে। মনে হলো, আমি যেন আর মাটিতে নেই। একটা জনশূন্য সমতল ভূমিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছি। স্যাঁতসেঁতে শেওলা আর আঠালো ব্যাঙের ছাতায় চারদিক ভরে গেছে। আমি ড্রইংরুমে দাঁড়িয়ে যখন আসবাবপত্রের রূপ দেখছিলাম, বেডরুম থেকে আমার সৎমার সাবধানবাণী শুনতে পেলাম। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে যে প্রচ- ঠা-ার হাত থেকে রক্ষা নেই বারবার সে কথা স্মরণ করিয়ে দিতে লাগল। আর তখনই কেবল সৃষ্টির জলে যে আমার গোড়ালি পর্যন্ত ডুবে গেছে বুঝতে পারলাম। বাড়িতে বৃষ্টির জল জমে গেছে। ঘরের মেঝে চটচটে জলে ডুবে গেছে।
বুধবার দুপুরে দিনের আলো দেখা যাচ্ছিল না। তিনটা বাজতে না বাজতেই রাতের ধ্বনি যেন শোনা যেতে লাগল। বাইরের বৃষ্টির মতো মৃদু অথচ একঘেয়ে ছন্দে অসময়েই রাত ঘনিয়ে আসতে লাগল। সন্ধ্যার অন্ধকার অনেক আগেই নেমে এলো। কেমন যেন কোমল আর বিষাদময়। কর্মক্লান্ত মজুরের দল দেয়ালের সঙ্গে লাগানো চেয়ারে গোল গোল হয়ে বসেছিল। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তারা পরাজিত।
এমন সময় বাইরে থেকে খবর আসতে শুরু করল। না, কেউ সে খবর বয়ে আনেনি। তবু খবর এলো। সংক্ষিপ্ত আর বাছাই করা খবর। রাস্তার ওপর দিয়ে যে নরম কাদার স্রোত বাড়িঘরের জিনিসপত্র, মৃত জন্তুর লাশ, জঞ্জাল আর আবর্জনা বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সেখানেই যেন এ খবরের জন্ম। রোববার যখন বৃষ্টি শুরু হয়েছিল তখন সে বৃষ্টি নতুন মৌসুমের আগমনবার্তা বয়ে এনেছে বলে মনে হয়েছিল। সেই রোববারের ঘটনাই বাড়িতে পেঁৗছাতে দুই দিন লেগে গেল। বুধবার খবর পেঁৗছাল, যেন ঝড়ের অন্তর্নিহিত গতিময়তার তাড়না এই বিলম্বের কারণ। বন্যাকবলিত হয়ে যে গির্জাটি ধসে পড়তে পারে এ কথা সবার জানা ছিল। কে যেন সেদিন রাতে বলল, 'সোমবার থেকে ট্রেন আটকে আছে। পুল পেরোতে পারেনি। নদীর ওপরের সেতুটা জলের স্রোতে ভেসে গেছে'। আরো জানা গেল, একজন অসুস্থ মহিলা বিছানা থেকে উধাও হয়ে গেছেন। সেদিন বিকালে তাকে মৃত অবস্থায় উঠোনে ভাসতে দেখা গেছে। বন্যা আর ভীষণ ভয় আমাকে দারুণভাবে আতঙ্কত করে তুলল। আমি দোলনা চেয়ারে পা দুটো ভাঁজ করে বসে পড়লাম। আমার দৃষ্টি অন্ধকারের দিকে নিবদ্ধ। অন্ধকারের ভেতর দিয়ে যেন একটা অমঙ্গলের পদধ্বনি শুনতে পেলাম। আমার সৎমা দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। তার হাতে একটা বাতি। উঁচু করে ধরে আছে। মাথার ওপরের দিকে সোজা করে রেখেছে। তাকে যেন পরিচিত কোনো ভূত বলে মনে হলো। তাকে দেখে আমি ভয় পাচ্ছিলাম। কারণ আমি যে 'অতিপ্রাকৃত দশা' বিশ্বাস করি। সৎমা আমার দিকে এগিয়ে এলো। তার মাথাটা তখনো উঁচু আর বাতিটা মাথার ওপরে তুলে ধরে রেখেছিল। বারান্দায় জমা জলের ওপর দিয়ে হেঁটে আমার কাছে এসে বলল, 'আমাদের প্রার্থনা করা ছাড়া উপায় নেই'। আমি তার শুকনো আর চিড় খাওয়া মুখের দিকে তাকালাম। মনে হলো, সে যেন এই মাত্র কবর থেকে উঠে এসেছে। তার মধ্যে যেন মানুষের কোনো উপাদানই নেই। সে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তার হাতে জপমালা। একটু থেমে আবার বলল, 'আমাদের প্রার্থনা করতে হবে। বৃষ্টির তোড়ে কবরগুলো ভেঙে গেছে। গোরস্তানের চারদিকে মৃতদেহ ভাসছে'।
সে রাতে আমি বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারিনি। পচা লাশের গন্ধে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আমি মার্টিনকে ধাক্কা দিতে লাগলাম। মার্টিন আমার পাশে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিল। মার্টিন জেগে উঠতেই জিজ্ঞেস করলাম, 'কোনো গন্ধ পাচ্ছ?' সে বলল, 'কীসের গন্ধ?' আমি বললাম, 'সেই গন্ধটা পাচ্ছি, নিশ্চয়ই লাশগুলো রাস্তায় ভাসছে'। মরা লাশের কথা ভাবতেই আমি আতঙ্কে শিউরে উঠলাম। কিন্তু মার্টিন ওপাশ ফিরে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুলো আর ঘুম জড়ানো ফ্যাসফ্যাস স্বরে বলল, 'তুমিও যেমন, উহ, গর্ভবতী মেয়েদের মগজে যত্তসব আজেবাজে চিন্তা'।
বৃহস্পতিবার ভোরে গন্ধটা চলে গেল। সময়ের হিসাবেও যেন সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে গেল। বৃহস্পতিবার বলে যেন কিছু নেই। বৃহস্পতিবারটা যেন একটা কৃষ্ণ পদার্থ। কেউ ইচ্ছা করলেই তাকে ঠেলে পাশে সরিয়ে শুক্রবারে পেঁৗছে যেতে পারে। নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য বোঝা যাচ্ছিল না। আমার সৎমা, আমার বাবা আর মজুরের দল যেন চর্বি আর অর্থহীন সব পদার্থ। শীতের জলাভূমিতে হাঁটাচলা করছে। বাবা আমাকে বললেন, 'কী ঘটেছে তোমাকে না বলা পর্যন্ত তুমি এখান থেকে নড়বে না'। তার গলার স্বর এখন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে বলে মনে হলো। কথার ভঙ্গিটা যেন পরোক্ষ, আর তার কথাগুলো যেন কান নয় স্পর্শ দিয়ে উপলব্ধি করতে হচ্ছিল। কেননা, এই একটামাত্র বোধশক্তিই যেন তখনো অবশিষ্ট ছিল।
কিন্তু বাবা ফিরে এলেন না। তিনি যেন সময়ের ওপারে হারিয়ে গেছেন। সন্ধ্যার পর তাই আমার সৎমাকে ডেকে আমার সঙ্গে শোবার ঘরে শুতে বললাম। সে রাতে আমার ঘুমে কোনো বিঘ্ন ঘটল না। শান্তিতে সারা রাত ঘুমালাম। পর দিনও একই ব্যবস্থা। কোনো পরিবর্তন নেই। বর্ণহীন, গন্ধহীন আর উত্তাপহীন। ঘুম থেকে উঠেই আমি একটা চেয়ারে বসে পড়লাম এবং নিশ্চল বসে রইলাম। আমার চেতনার কোনো একটা অঙ্গের ঘুম যেন তখনো ভাঙেনি। এমন সময় আমি গাড়ির হুইসেল শুনতে পেলাম। গাড়ির একটানা হুইসেল যেন ঝড়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ছুটে পালাচ্ছিল। 'নিশ্চয়ই কোথাও পথ খুলে গেছে', আমি মনে মনে ভাবলাম। পেছন থেকে যেন কার কণ্ঠস্বর আমার মনের কথার জবাব দিল, 'কোথায়?' আমি ঘুরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কে ওখানে?' আমার সৎমাকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, সে বলল, 'আমি!' আমি তখন বললাম, 'শুনতে পাচ্ছ?' সে শুনতে পাচ্ছে বলে জানাল। ধারেকাছে কোথা হয়তো পথ পরিষ্কার হয়ে গেছে। রেললাইন মেরামত হয়ে গেছে। একটু পরে আমার হাতে সকালের নাশতার ট্রে এনে দিল। তখনো ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। রসুনের চাটনি আর সিদ্ধ চর্বির গন্ধ পেলাম। ট্রের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এক পেয়ালা স্যুপ। হঠাৎ যেন অপ্রতিভ হয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি তার কাছে এখন সময় কত জানতে চাইলাম। বেশ শান্ত, কিন্তু অবসন্ন কণ্ঠে সৎমা বলল, 'আড়াইটা হবে। ট্রেনটা ঠিক সয়মমতোই গেল দেখছি'। আমি বিস্মিত কণ্ঠে বললাম, 'আড়াইটা! আমি এতক্ষণ ধরে ঘুমালাম কেমন করে?' সৎমা বলল, 'তুমি বেশিক্ষণ ঘুমাওনি'। আমার সারা শরীর কাঁপতে শুরু করল। হাত থেকে ট্রেটা পড়ে যাবে মনে হচ্ছিল। আমি কম্পিতস্বরে বললাম, 'শুক্রবার আড়াইটা...'। আমার সৎমা হিমশীতল কণ্ঠে বলল 'না, না, বিষুদবার আড়াইটা। বিষুদবার আড়াইটা এখনো পেরোয়নি'।
কতক্ষণ এমন ঘোরের ঘোরে ছিলাম জানি না। আমার সব বোধশক্তি যেন লোপ পেয়ে গিয়েছিল। শুধু মনে হলো, অনেক যুগ পরে যেন পাশের ঘরে কারো কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। কে যেন বলছে, 'এখন বিছানাটা সরাতে পার'। যে কথা বলছিল তাকে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। তবে কোনো রুগ্ন মানুষের কণ্ঠস্বর নয়। অসুখের পর বিশ্রামরত মানুষের গলার স্বর মনে হলো। এমন সময় আমি জলে ইট ছুড়ে ফেলার শব্দ শুনতে পেলাম। আমি যেন জমাট বেঁধে গেছি, কিন্তু একটু পরেই বুঝলাম আমি শুয়ে আছি। আমার ভেতর দারুণ একটা শূন্যতা যেন অনুভব করলাম। সারা বাড়িতে যেন প্রচ- নির্জনতার স্পন্দন বিরাজ করছে, আবিশ্বাস্য নিশ্চলতার ছোঁয়া যেন সর্বত্র। হঠাৎ আমার হৃৎপি-টা জমাটবাঁধা পাথরে পরিণত হয়ে গেল। আমার মনে হলো, 'আমি মরে গেছি। হায় ঈশ্বর! আমি মরে গেছি'। হঠাৎ বিছানায় লাফিয়ে উঠলাম। চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম, 'অ্যাদা! অ্যাদা!' মার্টিন ওপাশ থেকে নীরস কণ্ঠে উত্তর দিল, 'সবাই বাইরে গেছে। তোমার ডাক কেউ শুনতে পাবে না'। তখনই কেবল আমি বুঝতে পারলাম, সব পরিষ্কার হয়ে গেছে, একটা নিস্তব্ধতা, একটা প্রশান্তি, একটা রহস্যময় ও প্রগাঢ় শান্ত পরিবেশ আমাদের চারদিকে বিরাজ করছে, ঠিক যেন মৃত্যুর মতো। এমন সময় বারান্দায় পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। একটা সজীব ও সুস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। একটা বাতাসের ঝাপটা লেগে দরজার কপাট ক্যাঁচক্যাঁচ করে উঠল। পাকা ফলের মতো একটা নিরেট বস্তু যেন উঠোনের ডোবাতে ঝপ করে পড়ল। বাতাসে কী যেন একটা লুকিয়ে ছিল, আর সেই লুকানো বস্তুটা অন্ধারের ভেতর হাস্যরত কোনো একজন অদৃশ্য মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছিল। 'হে ঈশ্বর!' আমি সময়ের কথা ভুলে গিয়ে বলে উঠলাম, 'এক্ষুনি কেউ এসে আমাকে রোববারের উপাসনায় যেতে বললে আমি মোটেই বিস্মিত হব না!'
লেখক পরিচিতি : গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ল্যাটিন আমেরিকার কলম্বিয়া প্রদেশের একটি ছোট শহরে ১৯২৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বোগাটার ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। অধ্যয়ন শেষে সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেন। অচিরেই তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন এবং সাহিত্যিক হিসেবে সাহিত্য ভুবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি একজন ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক। তার রচিত ছোটগল্প গ্রন্থের মধ্যে 'লিফ স্টর্ম', 'নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল' ও 'ইনোসেন্ট এরেনডিরা' এবং উপন্যাসের মধ্যে 'ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচুভ' (শতবর্ষের নির্জনতা) ও 'দি অটাম অব দ্য প্যাট্রিয়ার্ক' উল্লেখযোগ্য। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮২ সালে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১৪ সালের এপ্রিলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 'ইসাবেলার স্বগতোক্তি' মার্কেজ রচিত 'ইসাবেলা'স সলিলোকুই' গল্পের অনুবাদ।]
1 মন্তব্যসমূহ
valo anubad
উত্তরমুছুন