হোর্হে লুইস বোর্হেসের সঙ্গে আলাপ

রিচার্ড বার্জিন


অনুবাদ- এমদাদ রহমান

[তাঁর সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল—‘বোর্হেসের সঙ্গে আলাপ করার মানে হল তাঁকে পড়তে থাকা, বোর্হেসের সঙ্গে দেখা হবার মানে হল তাঁকে পড়তে শুরু করা।’ তিনি সব সময় সাহিত্য নিয়েই কথা বলেন, কিংবা বলেন শুধু জীবন নিয়ে। তখনও পুরপুরি অন্ধ হয়ে যান নি, অন্ধত্বের ঠিক আগের অবস্থায় আছেন, এখন কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলতে এলে, তিনি বলছেন— দেখতে পাচ্ছি যে জানালাগুলি এখানে আছে কিন্তু আপনার মুখ আমি দেখছি না!

রিচার্ড বার্জিন নিজেও লেখক, তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই, একজন লেখক যখন আরেকজন লেখকের মুখোমুখি হবেন, তখন, কথায় কথায় তারা খুঁজে চলবেন জীবন-রহস্য, ভাঙচুর হবে বিশ্বাসে, আস্থায়। পাঠকও আগ্রহী হবেন পড়ে, নিজেকে নতুন করে গড়ে নিতে।

১৯৬৭ সালে রিচার্ড বার্জিন বোর্হেসের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। ৭টি দীর্ঘ বৈঠক হয় তাদের, আমেরিকায়। পরে, বার্জিন একটি বই প্রকাশ করেন এই নামে—দ্য কনভারসেশন্স উইদ হোর্হে লুইস বোর্হেস। বইটি আমেরিকায় বের হয় ১৯৬৮ সালে, ১৯৭৩ সালে এর ব্রিটিশ সংস্করণ হয় প্রকাশ পায়। জীবন, জগৎ আর লেখালেখি নিয়ে এই সাক্ষাৎকারটি এই বইয়ের ৩য় বৈঠক। ৭৩ সালের ব্রিটিশ সংস্করণ থেকে, কিছুটা সংক্ষেপিত আকারে এখানে বাংলায় প্রকাশ করা হল।]



রিচার্ড বার্জিনঃ আমরা জানি যে আপনি আপনার লেখার ব্যাপারে নিজেই বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করেন আবার সমালোচনায়ও মুখর, তারপরও বলুন কোন লেখাগুলো আপনার কাছে প্রিয়?

হোর্হে লুইস বোর্হেসঃ ‘দ্য সাউথ’ এবং সেই গল্পটি যার কথা আমি আপনাকে বলেছি, সেই ‘অবাঞ্ছিত প্রবেশকারী’। আমি মনে করি এটা হল আমার লেখা সেরা গল্প। তবে, পরে এর সঙ্গে যুক্ত করে দিব ‘ফিউন্স দ্য মেমরিয়াস’কে, এটা খুব একটা খারাপ না, হ্যাঁ, আমি মনে করি যে এটাও ভাল একটা গল্প, আর সম্ভবত ‘মৃত্যু এবং পোতাশ্রয়ের কম্পাস’ গল্পটিও বেশ ভাল।


রিচার্ড বার্জিনঃ ‘আলেফ’ কি আপনার একটি প্রিয় গল্প নয়?

হোর্হে লুইস বোর্হেসঃ দ্য আলেফ, হ্যাঁ, এবং ‘দ্য যহির’। যহির হল এই সম্পর্কে ... একটি ভুলতে না পারা কয়েক’কে নিয়ে। আমি অবাক হব যদি এই গল্পটির কথা আপনার মনে থাকে।


রিচার্ড বার্জিনঃ অবশ্যই আমি মনে করতে পারছি।

হোর্হে লুইস বোর্হেসঃ আমি ‘অবিস্মরণীয়’ শব্দটি থেকে বের হবার জন্য গল্পটি লিখেছিলাম। তার কারণ, শব্দটি আমি কোথাও পড়েছিলাম। আপনি দেখে থাকবেন কোনও একজনের অভিনয় কিংবা কারোর গাইতে থাকা গান শুনবেন, তাদের দুজনেই অবিস্মরণীয়। এবং আমি ভাবলাম ভাল তো, এখানে কী এমন আছে যে তাকে সত্যিকার অর্থেই ভুলা যায় না? এরূপ ভাবনার কারণ হল আমি শব্দগুলোর ব্যাপারে খুব আগ্রহী। যা হয়ত আপনিও কিছুটা মেনে নিবেন। আমি বলব, আসেন, সত্যিকার অর্থেই কিছু ভুলতে-না-পারা বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকি। এমনকি যাকে আপনি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে যেতে পারেন না, এমন কিছু ভেবে নেবার পর, অবশেষে, আমি পুরো গল্পটাকে আবিষ্কার করলাম, তবে আবারও বলি, পুরো গল্পটিই এই ‘আনফরগেটেবল’ শব্দটি থেকে বের হয়ে এসেছে। 
 

রিচার্ড বার্জিনঃ এই সেন্সে কি বলা যায় যে, ‘ফিউন্স দ্য মেমরিয়াস’ এবং, এমনকি ‘দ্য ইম্মরটার’ গল্পদুটিতেও একি রকমের ভেরিয়েশন আছে?

হোর্হে লুইস বোর্হেসঃ হ্যাঁ, তা তো আছেই, তবে এখানে আরেকটি ব্যাপারও আছে, আর সেটা হল এমন—অবশ্যই ব্যাপারটার মধ্যে তেমন একটা রহস্যময়তাও নেই, সাঙ্কেতিকতাও নেই, আটপৌরে ব্যাপার, তার কারণ যদি আমি একটি বিস্মরণহীন স্পিংসের কথা বলি, কিংবা বলি এক ভুলতে-না-পারা সূর্যাস্তের কথা, আমি ধরে নিচ্ছি টাকশাল থেকে সব একই রকম দেখতে মিলিয়ন মিলিয়ন কয়েন নিয়ে আসা হল, ধরে নিন, সেই মিলিয়ন কয়েন থেকে একটি কয়েনকে লুকিয়ে ফেলা হল, অবিস্মরণীয় ভুলে, আর সেই লোকটি কয়েনটাকে দেখতে পেল, লোকটির পক্ষে কয়েকটাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় এবং তাতে সে উন্মাদ হয়ে গেল। এই ঘটনা আমাদেরকে এই ইম্প্রেশনটি দেয় যে লোকটা আগে থেকেই উন্মাদ ছিল এবং এ কারণেই সে ভাবছে যে কয়েকটি আনফরগেটেবল, তাই নয়? তবে এই গল্পটি পড়তে হবে এক ভিন্ন উপায়ে। আমি এখানে বলব যে আমরা পাঠককে গল্পটি বিশ্বাস করবার জন্য তইরি করে নিব, কিংবা অন্তত অবিশ্বাস যাতে না করে, তার ব্যাবস্থা করব, যেমনটা কোলরিজ বলেছেন—যদি এমন কিছু তার ক্ষেত্রে ঘটে যায় কয়েনটিকে দেখে ফেলবার আগে, উদাহরণস্বরূপ, যদি সেই নারী যাকে সে ভালবাসত, সে যদি মারা যায়, তাহলে এটা খুবই সহজ হয়ে যায় পাঠকের জন্য আর আমার নিজের জন্য, কারণ, আমি কখনোই এই গল্পের কথক হব না। আমি পাঠককে কিছু পরিস্থিতির বর্ণনা করব তার প্রতি কী ঘটেছিল তা পরীক্ষা করে দেখবার জন্য। 


রিচার্ড বার্জিনঃ ‘ফিউন্স দ্য মেমরিয়াস’ গল্পে অন্য বিষয়গুলোর সঙ্গে ইনসমনিয়ার প্রসঙ্গ এসেছে, বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে।

হোর্হে লুইস বোর্হেসঃ গল্পটা অবশ্যই ইনসমনিয়া প্রসঙ্গেই, এক ধরণের মেটাফর।


রিচার্ড বার্জিনঃ এই মেটাফরটাকে যদি আমি গ্রহণ করি, তবে আমাদের ইনসমনিয়ার অবস্থা তইরি হবে।

হোর্হে লুইস বোর্হেসঃ হ্যাঁ। 


রিচার্ড বার্জিনঃ আমিও তাতে ভুগেছি।

হোর্হে লুইস বোর্হেসঃ আপনিও!

রিচার্ড বার্জিনঃ এখন অবশ্য তাতে আর ভুগছি না, তবে এক সময় তো ভয়ানক ভুগেছি। ব্যাপারটা আসলেই ভয়ানক।

হোর্হে লুইস বোর্হেসঃ হ্যাঁ, নিদ্রাহীনতা ব্যাপারটা ভয়ানক।


রিচার্ড বার্জিনঃ তার কারণ আপনি ভাবছেন যে এই অবস্থার কোনও শেষ নেই?

হোর্হে লুইস বোর্হেসঃ হ্যাঁ, তবে কেউ একজন এই ব্যাপারে চিন্তা করতে পারে কিংবা চিন্তা করছে কিংবা কেউ একজন হয়ত এটা অনুভব করতে পারছে যে এই নিদ্রাহীনতার ব্যাপারটা আসলে কারো একার নিদ্রাহীনতা নয়, সে ভাবছে যে কেউ একজন তার নিজের নিয়ন্ত্রক হয়ে তার ভিতরে একটা নিদ্রাহীন জগৎ তইরি করছে। 


রিচার্ড বার্জিনঃ একটা মহাজাগতিক ভ্রম?

হোর্হে লুইস বোর্হেসঃ মহাজাগতিক কিংবা কিছু বর্বর শত্রু, তাই না? এটা যে একটা দুর্ঘটনা আপনি বুঝতেই পারবেন না। আপনি শুধু এটাই অনুভব করবেন যে কোনও একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে কেউ আপনাকে হত্যা করবার চেষ্টা করছে, এভাবেও ধরে নেয়া যায়, এক অর্থে, কিংবা আপনাকে কেউ আঘাত করতে চাইছে। তাই না? 
 

রিচার্ড বার্জিনঃ ‘দ্য সাউথ’ গল্পটি নিয়ে কথা বলা যাক। এ সম্পর্কে বলুন। আপনি আগে বলেছেন যে এই গল্পটি আপনার বিশেষ পছন্দের। আপনি কি এখনও সেই কথাই বলবেন?

হোর্হে লুইস বোর্হেসঃ কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যে আমি এর চেয়েও ভাল একটি গল্প লিখেছি, ‘লা ইনট্রুসা’ নামে এটি প্রকাশিতও হয়েছে। আপনি এটাকে ‘এল আলেফ’ বা এ পার্সোনাল অ্যান্থলজিতেও খুঁজে পাবেন। আমার মতে, অন্যগুলোর চেয়ে এটি অনেক ভাল। আমার মনে হয় যতগুলো গল্প আমি লিখেছি, তাদের মধ্যে ‘লা ইনট্রুসা’ই সর্বশেষ। এখানে ব্যক্তিগত কোনও ব্যাপারই যোগ হয় নি। দ্য সাউথ দুই জন মাস্তানের গল্প। দুই ভাই, যারা ভয়ানক মাস্তান, তাদের জীবনের মাঝখানে অবাঞ্ছিতভাবে কেউ একজন ঢুকে পড়ে, সেই কেউ একজন এক নারী। এটা কোনওভাবেই চালাকি-করা গল্প নয়। কোনও গোলকধাঁধার ব্যাপার এখানে নেই। আপনি যদি পড়েন, তো মনে হতে পারে যে গল্পটিতে একটা ধাঁধা আছে, ট্রিক আছে। পরে, অবশ্যই আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে যে পৃষ্ঠার শেষে আসলে ঘটনাটা কী ঘটতে চলেছে, আপনি হন্যে হয়ে তাই খুঁজে মরছেন কিংবা আপনার নিজের মতই তেমন কিছু একটা যুক্তি দাড় করাচ্ছেন, তার মানে কিন্তু এটা নয় যে এটা একটা ফাঁদে ফেলবার গল্প হতে চলেছে। সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মীতা। ধাঁধাই হয়ত। আমি যা করতে চাইছিলাম, একটি একক গল্প বলার জন্য, যাতে করে শেষটায় কোনও আকস্মিকতা না থাকে। 
 

রিচার্ড বার্জিনঃ কখন লিখেছিলেন?

হোর্হে লুইস বোর্হেসঃ বছরখানেক তো হবেই, কিংবা হয়ত তারচেয়েও বেশি আগে, গল্পটি আমি আমার মাকে উৎসর্গ করেছিলাম। তিনি ভেবেছিলেন যে এটা হচ্ছে আমার লেখা সবচেয়ে বাজে গল্প আবার তিনি এটাও মনে করেছিলেন যে গল্পটি ভয়ানক। হ্যাঁ, তবে যখনই গল্পের শেষে আসা যায়, শেষের দিকে, সেখানে এমন একটি মুহূর্ত মূর্ত হয়ে উঠে, যখন একটি চরিত্র কিছু বলতে থাকে, তখন আমার মা খুঁজে পান সেইসব শব্দকে। যদি আপনি গল্পটি পড়েন, একটা ব্যাপার এখানে আছে, আমি আপনাকে পড়তে বলব, এখানে তিনটি চরিত্র আছে, এদের মধ্যে মাত্র একটি চরিত্র আছে যে কিছু বলছে, অন্যরা, মনে করেন, অন্যরা যেন বিষয় হয়ে যাচ্ছে এবং আমরা তাদের সম্পর্কে বলছি। তবে শুধুমাত্র একটি চরিত্রই সরাসরি আমাদের সঙ্গে কথা বলছে, এবং; গল্পের সকল ঘটনার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, সে-ই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে আর সেখানে যে বিধিবদ্ধ নিয়মে এই ব্যাপারটা তইরি হচ্ছে, সে-ই একমাত্র চরিত্র যার কণ্ঠস্বর আমরা শুনতে পাচ্ছি, পুরো গল্পটায়। 


রিচার্ড বার্জিনঃ এটা কি খুবই ছোট একটা গল্প?

হোর্হে লুইস বোর্হেসঃ হ্যাঁ, মাত্র পাঁচ পৃষ্ঠার গল্প। আমার মতে এটাই সবচেয়ে সেরা কাজ যা আমার দ্বারা লিখিত হয়েছে। তার কারন, উদাহরণ দিয়ে বলি-- ‘হমব্রে দে লা এসকুইনা রোসাদা’, বলতে চাইছি যে আমি এখানকার স্থানীয় শব্দগুলোর তাৎপর্যকে অতিরঞ্জিত করে ফেলেছি এবং আমি তাদের নষ্ট করেছি। তবে আমি এখানে ভাবছি যে আপনি সকল কিছুরই তাৎপর্য খুঁজে পাবেন, আমি কখনোই বলব না যে এটা স্থানীয় কিছু, তবে আপনি অনুভব করবেন বুয়েনস আইরেসের চারপাশের ঘিঞ্জি বস্তিগুলোয় গল্পের সমস্ত ব্যাপারগুলি আছে আর এ সমস্ত ঘটনা পঞ্চাশ বা ষাট বছর আগেই ঘটে গেছে আর এখন এখানে কোনও নৈমিত্তিক বা মৌলিক কিছুই নেই। এখানে অল্পকিছু আর্জেন্টাইন শব্দ আছে কিন্তু শব্দগুলো এখন আর ব্যবহৃত হয় না। তারা যেন চিত্রবৎ স্থির কারণ তারা ছিল নির্ভুল শব্দ, তাই নয় কি? আমি বোঝাতে চাইছি যদি আমি তাদের কোনও কোনটি ব্যবহারও করে থাকি তাহলে পুরো ব্যাপারটিকেই আমি নকল কিংবা মিথ্যায় পরিণত করব। 


রিচার্ড বার্জিনঃ ‘ডেথ অ্যান্ড দ্য কম্পাস’ সম্পর্কে কী বলবেন? এই গল্পেও আপনি বুয়েনস আইরেসের স্থানীয় ব্যাপারগুলিকে ব্যবহার করেছেন।

হোর্হে লুইস বোর্হেসঃ হ্যাঁ, করেছি, তবে, ডেথ অ্যান্ড দ্য কম্পাস গল্পে, এই গল্পটি আসলে এক ধরণের দুঃস্বপ্ন কিংবা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার স্মৃতি। তাই না? এটা সত্য গল্প নয়। যেখানে ‘লা ইনট্রুসা’র বিষয়বস্তু ভীতিজাগানিয়া, তবে আমার ধারণা কোনও না কোনওভাবে এটা সত্য আর দুঃখজনকও বটে। 
 

রিচার্ড বার্জিনঃ দেখা যাচ্ছে যে ঠিক একই অনুভূতি আপনার ‘দ্য সার্কুলার রুইনস’ গল্পটি থেকেও যে কেউই পেতে পারে। আপনি কি এই গল্পটি লেখার পেছনের কারণটি বলতে পারবেন?

হোর্হে লুইস বোর্হেসঃ না। আমি এই কল্পনা সম্পর্কে তেমন কিছুই বলতে পারব না। তবে এটা বলতে পারি যে ঠিক কখন আমি এই গল্পটি লিখেছিলাম। গল্পটি আমার কাছ থেকে এক সপ্তা সময় নিয়েছে। আমি আমার কাজ নিয়মিত করে গেছি। আমি নিয়মিত সেখানে গিয়েছি— খুব ছোট আর অবশ্যই জরাজীর্ণ এক পাব্লিক লাইব্রেরিতে আমি কাজ করতাম, জায়গাটা বুয়েনস আইরেসে আর একেবারেই বৈচিত্রহীন এক স্ট্রিটে। আমি প্রতিদিন সেখানে যেতাম, প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা কাজ করতাম আর মাঝে মাঝে কাজ শেষে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতাম, তারপর আমরা কোথাও যেতে চাইতাম, সিনেমা দেখতাম অথবা কারও সঙ্গে রাতের খাবার খেতাম, তবে, এইসবকিছুর মাঝেও, সব সময় আমার মনে হত যে এই জীবন সত্য নয়, জীবন অবাস্তব। এই ধারণাটাই, এই মনে হওয়াটাই আমাকে দিয়ে এই গল্পটি লিখিয়ে নিয়েছে। আমার নিজের কাছে গল্পটি আসলে একটা বিশেষ কিছুকেই বোঝাচ্ছে। 


রিচার্ড বার্জিনঃ আপনার রচনাকর্মের একটি এডিশনে যদি ইলাস্ট্রেশন থাকে, আপনি কি তা পছন্দ করবেন?

হোর্হে লুইস বোর্হেসঃ না। করব না। আমার বইয়ের ভিতরে আমি মনে করি না যে ভিজ্যুয়াল কিছু থাকাটা খুব জরুরি। তবে আমি ইলাস্ট্রেশন পছন্দ করব কারণ আমি যখন ভাবতে পারব যে তা মূল টেক্সট-এর কোনও ক্ষতি করছে না আর অবশ্যই ইলাস্ট্রেশন টেক্সটকে সমৃদ্ধ করবে। এখানে একটা বিষয়ের উল্লেখ করি, সম্ভবত হেনরি জেমসের সুনির্দিষ্ট আইডিয়া ছিল যে তার ক্যারেকটারগুলো ঠিক কিসের মত। যদিও অন্য কেউ এই আইডিয়াটাকে গ্রহণ করবে না। কেউ যখন তার বইগুলি পড়ছে, সেই পাঠক হয়ত এটা অনুভব করবে না যে সে ক্যারেকটারগুলোকে ভাল করে জানে, যদিও তাদের সঙ্গে তার রাস্তায় দেখাও হয়ে যায়। হেনরি জেমস সম্পর্কে সম্ভবত আমি এই ধারণাটি করছি যে তিনি প্রথমত একজন উচ্চমানের গল্পকথক, দ্বিতীয়ত একজন উপন্যাসিক। আর আমার অভিজ্ঞতা বলে যে তার উপন্যাসগুলি পাঠের পক্ষে খুব ক্লান্তিকর। তাই নয়? আপনার কি এরকম মনে হয় না? আমার ধারণা হেনরি জেমস হলেন পরিস্থিতি বর্ণনার সুদক্ষ কারিগর। মাস্টার অভ সিকুয়েন্সেস। তার রচনার প্লট বিবেচনায় রেখেই এমন বলছি, তবে, তার ক্যারেকটারগুলি যেন গল্পের বাইরে বেরিয়ে আসে না, সাক্ষাৎ দেয় না। গল্পের বাইরে তারা যেন বের হয়ে আসতেই পারে না। তাই আমি মনে করি যে তার ক্যারেকটারগুলোর এক আনরিয়াল অস্তিত্ব রয়েছে। তারা যেন বাস্তব পৃথিবীর কেউ নয়। আমি তো বলব যে ক্যারেকটারগুলো সবই তার বানানো। হ্যাঁ, এমন হতেই পারে যেমন ডিটেকটিভ গল্পে, উদাহরণ হিসাবেই বলছি, এখানে প্লটের জন্যই ক্যারেকটারদের তইরি করে নিতে হয়, প্লটের খাতিরেই তা করতে হয়। হেনরি জেমসের দীর্ঘ বিশ্লেষণকে মনে হয় এক ধরণের মেকি বিশ্লেষণ কিংবা হতে পারে যে তিনি এভাবে আসলে নিজেকে প্রতারিত করেছেন। 
 

রিচার্ড বার্জিনঃ কোন কোন উপন্যাসিককে মনে হয় যে তারা চরিত্র সৃষ্টি করতে পেরেছেন?

হোর্হে লুইস বোর্হেসঃ কনরাড ডিকেন্স, তবে অবশ্যই কনরাড। তার কথা বিশেষভাবে বলছি এ জন্যে যে আপনি অনুভব করবেন তার জগতের সবকিছুই বাস্তব, আর একই সঙ্গে চরম কাব্যিক। তাই মনে হয় না আপনার কাছে? আমি তো কনরাডকে হেনরি জেমসের উচ্চতার চেয়েও অনেক বেশি উচ্চতায় বসাব। আমি যখন তরুণ ছিলাম, ভাবতাম যে দস্তয়েভস্কি হলেন মহান উপন্যাসিক। তারপর, মানে দশ বছর বা আরও কিছু বেশি হবে, আমি তাকে পুনর্বার পাঠ করি আর ভয়ানকরকম মর্মাহত হই। আমি বুঝতে পারি যে তার চরিত্রগুলি অবাস্তব, আর এমনও মনে হতে থাকে যে তার চরিত্ররা প্লটের এক-একটি অংশমাত্র। কারণ, বাস্তবজীবনে, এমনকি যেকোনো ডিফিকাল্ট সিচুয়েশনে, এমনকি আপনি হয়ত কোনও এক পরিস্থিতির কারণে দুশ্চিন্তায় পরে গেছেন, হয়ত আপনি ভয়ানক মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছেন, কিংবা হৃদয়ে আঘাত লাগার মত ব্যাপার ঘটেছে—হ্যাঁ, আমি অবশ্য আঘাতপ্রাপ্ত হই নি—অথবা, আপনার ভাললাগার অনুভূতি হচ্ছে, অথবা হয়ত, আপনি ক্রোধে উন্মত্ত, আপনি তখন নিজেকে একটি লেখার অন্যান্য লাইনগুলোয় নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন, তাই হয় না? আমি বোঝাচ্ছি, মনে করুন একজন মানুষ প্রেমে পড়েছে ঠিক একই সময়ে সে সিনেমার প্রতিও প্রচণ্ড আগ্রহ তইরি হয়েছে তার কিংবা সে হয়ত গণিত বা কবিতা বা রাজনীতি নিয়ে ভাবনা করছে, সেখানে উপন্যাসগুলোয়, বেশিরভাগ উপন্যাসেই, চরিত্রগুলি, খুবই সরলভাবে বলা যায় যে, তাদের প্রতি কী ঘটছে তার ভিতরেই তারা পড়ে থাকছে, নড়তে পারছে না। খুব সরল, সাদামাটা ব্যক্তির ক্ষেত্রে হয়ত এমনটা ঘটতে পারে, তবে আমি এমন ব্যক্তি দেখিনি। আমি ভাবতেও পারি না যে এমন সাদামাটা কিছু মানুষের জীবনে ঘটতে পারে।


রিচার্ড বার্জিনঃ আপনি হেনরি জেমস আর কাফকাকে একটি মিলনসূত্রে একীভূত করেছিলেন। হয়ত আপনার মনের কোনও অভিপ্রায়ে এমন যোগ সম্ভব হয়েছিল।

হোর্হে লুইস বোর্হেসঃ আমি মনে করি যে তাদের দুজনের ভিতরে সাদৃশ্য আছে। আমি মনে করি যখনই আমাদের ভাবনা, অস্তিত্ব, সত্তা কিংবা পারিপার্শ্বিকতা দ্ব্যর্থক হয়ে উঠে, অর্থহীন হয়ে পড়ে, এক অর্থহীন বিশ্বে বাস করতে থাকে কিন্তু যখনই তা বহুধাবিভক্ত হয়ে পড়ে এবং অবশেষে যার কোনও ব্যাখ্যা দেয়া যায় না, হ্যাঁ, হেনরি জেমস তার ভাইকে লিখেছিলেন যে তার কাছে এই বিশ্বকে হীরার এক মিউজিয়াম মনে হয়, মনে হয়ে এই বিশ্ব দানবদের মিউজিয়াম ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি ভেবে নিয়েছি যে তিনি অবশ্যই আমাদের জীবনকেও এমনভাবে অনুভব করেছেন।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ