ইবলিসের গির্জা

খোয়াকিম মারিয়া মাচাদো দি আসিস

অনুবাদ : রওশন জামিল


প্রথম অধ্যায়
একটি চমৎকার ভাবনা


এক প্রাচীন বেনেডিক্টীয় পাণ্ডুলিপিতে কথিত আছেএকদিন ইবলিসের মাথায় একটি গির্জা পত্তনের বুদ্ধি চাপল। যদিও তার মুনাফা অব্যাহত ছিল এবং পরিমাণও কমতি ছিল না, তবু যুগ যুগ ধরে পালন-করে-আসা নিজের ভূমিকায় সে অপমানিত বোধ করছিল। তার না আছে সংগঠন, না নিয়ম, না বিধান, না আচার। সে, বলতে কী, ঈশ্বরের উচ্ছিষ্ট, আর মানুষের অনুগ্রহ আর অসতর্কতার ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। কোনকিছুই নির্দিষ্ট নয়, কোনকিছুই নিয়মিত না। তার নিজের একটা গির্জা হবে না কেন? অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে লড়াই এবং সেগুলোকে চিরদিনের মতো নির্মূল করার জন্য ইবলিসের গির্জা হবে একটি কার্যকর পন্থা।


‘বেশ, তাহলে গির্জাই সই,’ সিদ্ধান্তে পৌঁছল সে। ‘ধর্মগ্রন্থের বিপরীতে পাল্টা ধর্মগ্রন্থ, প্রার্থনাপুস্তকেরবিপরীতে পাল্টাপ্রার্থনাপুস্তক। আমার নিজের উপাসনা-উৎসব, অঢেল সুরা আর রুটিসহ, ধর্মোপদেশ, অনুশাসন, প্রার্থনা, এবং অন্যান্য ধর্মীয় জাঁকজমক সব থাকবে। আমার কৃষ্টি হবে শাশ্বত চৈতন্যের সারাৎসার, আমার গির্জা ইব্রাহিমের অন্যতম তাঁবু। এবং তারপর যখন কলহে বিদীর্ণ হবেঅন্যান্য ধর্ম, তখন আমার গির্জাইহবে অদ্বিতীয়। মোহাম্মদ বা লুথার কেউই আমাকে অতিক্রম করতে পারবে না। বিশ্বাসের পথ বহু, সবকিছু অস্বীকারের পথ একটাই।’

একথা বলতে বলতে, মাথা ঝাঁকায় ইবলিস, রাজকীয় পৌরুষোচিত ভঙ্গিতে নিজের বাহু প্রসারিত করে। তক্ষুনি নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয় সে ঈশ্বরের কাছে যেতে হবে, স্বীয় ভাবনা দিয়ে তাঁকে মোকাবেলা করতে হবে, এবং তাঁকে শক্তিপরীক্ষায় আহ্বান জানাতে হবে। ইবলিস এবার চোখ তুলল, বিদ্বেষে রক্তিম, প্রতিহিংসায় কঠোর; নিজেকে বলল সে: ‘যাওয়া যাক, এটাই সময়।’ পরক্ষণে পাতালের প্রতিটি কন্দর আন্দোলিত করে সজোরে ডানা ঝাপটে, চকিতে ছায়া থেকে অনন্ত নীলিমায় সে উড়ল।



দ্বিতীয় অধ্যায়
ঈশ্বর এবং ইবলিসের কথোপকথন


ঈশ্বর একজন বৃদ্ধকে বরণ করছিলেন যখন বেহেশতে উপস্থিত হলইবলিস। নতুন অতিথিকে ফুলমাল্য দিয়ে বরণরত দেবদূতেরা অবিলম্বে বন্ধ করল নিজেদের কাজ, আর ইবলিস দাঁড়িয়ে রইল দরজায়, চোখ ঈশ্বরের ওপর।

‘আমার কাছেকী চাই তোমার?’ প্রশ্ন করলেন প্রভু।

‘আমি আপনার কাছে আপনার গোলাম ফাউস্টের পক্ষ হয়ে আসিনি,’চাপা হেসে জবাব দিল ইবলিস, ‘আমি এসেছি সকল সময়ের সকল ফাউস্টের হয়ে।’

‘ব্যাখ্যা কর।’

‘প্রভু, এর ব্যাখ্যা সহজ, তবে তার আগে আপনার উদ্দেশে আমাকে একটা কথা বলতে দিন: আপন করে নিন এই সদাশিব বৃদ্ধ ভদ্রলোককে, তাঁকে স্বর্গের শ্রেষ্ঠ স্থানটি বরাদ্দ করুন,তাঁকে সর্বানুপম সুরে-বাঁধা বীণা আর সুরম-লের ঐকতানে বরণ করে নেয়ার জন্য আদেশ দিন...’

‘তুমি জান ও কী করেছে?’ প্রশ্ন করলেন প্রভু, দৃষ্টিতে অপার দয়া।

‘না, তবেউনিই সম্ভবত শেষ ব্যক্তিদের একজন হতে যাচ্ছেন যাঁরা আপনার কাছে আসবেন। সেই অবস্থা হতে বেশিদিন লাগবে না যখন স্বর্গ বেশি ভাড়ার হোটেলের মতো ফাঁকা পড়ে থাকবে। আমি সস্তা বোর্ডিংহাউস তৈরি করতে যাচ্ছি, অর্থাৎ কিনা, আমি আমার নিজের গির্জা প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি। আমি আমার বিশৃঙ্খলা, এবং আমার অপরিকল্পিত ও অস্থানিক রাজত্বে ক্লান্ত। এখন আমার চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গ বিজয়লাভ করার সময় হয়েছে। আমি আনুগত্যের খাতিরে আপনাকে জানাতে এসেছি একথা, যাতে আপনি আমার বিরুদ্ধে চাতুরীর অভিযোগ না আনেন। চমৎকার চিন্তা, না?’

‘তুমি আমাকে জানাতে এসেছ, অনুমোদন নেয়ার জন্য না,’উল্লেখ করলেন প্রভু।

‘আপনি ঠিক ধরেছেন,’ জবাব দিল ইবলিস, ‘তবে মনিবের প্রশংসা শুনলে আত্মগরিমায় তৃপ্তি হয়। অবশ্যি এটাও ঠিক, এক্ষেত্রে এটি হবে পরাজিত মনিবের প্রশংসা, আর... প্রভু, আমি পৃথিবীতে নেমে গিয়ে আমার ভিত্তি স্থাপন করতে যাচ্ছি।’

‘তথাস্তু।’

‘আপনি কি চান আমি ফিরে এসে আপনাকে অবহিত করি সবকিছু কীভাবে ঘটল?’

‘তার প্রয়োজন হবে না। আমাকে শুধু বল কেন, এতকাল নিজের বিশৃঙ্খলায় অসন্তুষ্ট থাকার পর, আজ তোমার মনে নিজস্ব গির্জা স্থাপনের সাধ জেগেছে?’

বিদ্রুপ আর বিজয়োল্লাসের সুরে হাসল ইবলিস। একটি নিষ্ঠুর উৎক্রোশ ছিল ওর অন্তরে, স্মৃতির থলেতে জমান একটা বিষাক্ত মন্তব্য, এমন একটা-কিছু যা তাকে বিশ্বাস করাল যে সে মহাকালের ওই ক্ষণিক মুহূর্তে ইশ্বরের চেয়ে শক্তিমান। তবে হাসি সংবরণ করল সে এবংবলল:

‘মাত্র এখুনি একটি পর্যবেক্ষণ শেষ করেছি আমি যা শুরু করেছিলাম কয়েক শতক আগে--আমি দেখেছি যে সব সুনীতি, যারা স্বর্গের কন্যা,অনেকাংশে সেসব রানির সঙ্গে তুলনীয় যাদের রেশমি আলখাল্লায় সুতির ঝালরথাকে। এখন আমি ইচ্ছা করছি ওই ঝালর ধরে আকর্ষণ করব ওদের এবং সবাইকে আমার গির্জায় নিয়ে যাব। ওদের পেছনে আসবে বিশুদ্ধ সিল্কের ঝালর...’

‘বস্তাপচা বাগাড়ম্বর!’ বিড়বিড় করলেন প্রভু।

‘কিন্তু দেখুন। এরকম অনেক তনু, যারা মর্ত্যরে মন্দিরগুলোয় আপনার পায়ের কাছে নতজানু হয়, তারা বৈঠকখানা আর রাস্তা থেকে ঘাঘরা ফুলিয়ে আসে, একই পাউডারে রঞ্জিত তাদের মুখম-ল, তাদের রুমালগুলোয় একই সৌরভ, আর তাদের চোখপবিত্র গ্রন্থ আর পাপ-গুম্ফের প্রতি ঔৎসুক্য আর অনুরক্তি জ্বলজ্বল করে। দেখুন কী ব্যগ্রতা--বা কমপক্ষে ঔদাসীন্য--নিয়ে ওইসুশীল জাহির করে বেড়ায় সে মুক্তহাতে কী কী সুবিধা খয়রাত করেথাকে--কাপড় জুতো, টাকাপয়সা, বা জীবনের জন্য প্রয়োজন অন্য কোন জিনিস...। তবে আমি চাই না,এটা মনে হোক যে আমি তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। যেমন, আমি বলছি না কেমন আত্মতুষ্টির সঙ্গে ওই ধর্মযাজক কাফেলায় ভক্তিভরে আপনার ভালবাসা আর ধর্মীয় অলঙ্কার ধারণ করেন...। আমি আরো গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের কথা বলছি...।’

একথায় ডানা ঝাপটাল দেবদূতেরা, বেদম ক্লান্তি আর অবসাদভরে। মিকায়েল আর জিবরায়েল সকাতরে তাকাল প্রভুর দিকে। ইবলিসকে বাধা দিলেন ঈশ্বর:

‘তুমি একটা অকিঞ্চিৎকর, তোমার মত প্রেতাত্মার জন্য এটাই হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা যা ঘটতে পারে। তুমি যা-কিছু বলছ বা বলতে পার তার সবই এর আগে মর্ত্যের নীতিবাগিশদের মুখে কথিত এবং পুনর্কথিত হয়েছে। এটি একটি জীর্ণ বিষয়। তোমার যদি বিষয়টাকে নতুন দৃষ্টিতে আবার বলার মতো যথেষ্ট রসদ বা মৌলিকতা না থাকে, তাহলে তোমার জন্য সবচেয়ে ভাল হচ্ছে চুপ করা এবং ব্যাপারটা ভুলে যাওয়া। দেখ, আমার অগুনতি সেনার চেহারায় তোমার কথায় কীরকম নিদারুণ একঘেয়েমির ছাপ পড়েছে। ওই বৃদ্ধকে বিতৃষ্ণ দেখাচ্ছে, তুমি জান ও কী করেছে?’

‘আমি আগেই বলেছি আমি জানি না।’

‘সৎ জীবনযাপনের পর, সে এক মহীয়ান মৃত্যুবরণ করেছে। জাহাজডুবিতে পড়ে, একটা ভাঙা তক্তা ধরে নিজেকে বাঁচাতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু দেখল দুই নবদম্পত্তি, তারুণ্যে প্রস্ফুটিত, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। জীবনদায়ী তক্তাটা ওদেরকে দান করে, সে অনন্ত-মাঝে ঝাঁপ দিয়েছে। কেউ এই কীর্তি চাক্ষুষ করেনি, কারণ তার চারপাশে ছিল শুধু পানি আর ওপরে আকাশ। এর মাঝে কোথায় তুমি সুতির ঝালর দেখছ?’

‘প্রভু, আপনি জানেন, আমি হচ্ছি সেই সত্তা যে অস্বীকার করে।’

‘তুমি কি এই মৃত্যুর নিঃস্বার্থপরতা অস্বীকার কর?’

‘আমি সবকিছুই অস্বীকার করি। পরহিতের ছদ্মবেশে নরবিদ্বেষ হাজির হতে পারে--কারণ একজন নরবিদ্বেষীর জন্য অন্যদের জীবনদান তাদেরকে ঘৃণা করার সমান...’

‘ফন্দিবাজ, বাগাড়াম্বর!’ চেঁচিয়ে উঠলেন প্রভু। ‘যাও, যাও তোমার গির্জা স্থাপন কর গিয়ে। সব সুনীতিকে ডাক, সব ঝালর জড় কর, সব মানুষকে আহ্বান কর...। কিন্তু ভাগ এখান থেকে!’

আরো হাঁকডাকের ব্যর্থচেষ্টা করল ইবলিস। ঈশ্বর মূক করে দিয়েছেন ওকে। ঈশ্বরের ইশারায় দেবদূতেরা তাদের প্রার্থনাগীতের ঐকতানে স্বর্গ ভরিয়ে তুলল। অকস্মাৎ ইবলিসের মনে হলো সে শূন্যে ভাসছে--ডানাদুটো ভাঁজ করল সে, বিজলিপাতের মতো মর্ত্যে ভূপাতিত হলো।



তৃতীয় অধ্যায়
মানবজাতির জন্য সুখবর


মর্ত্যে এসে, একমুহূর্ত অপচয় করল না ইবলিস। যেহেতু সুনামের পরিধেয়, দ্রুত একটি বেনেডিক্টীয় আলখাল্লা গায়ে চাপাল সে, তারপর এক অভূতপূর্ব ও অসাধারণ মতবাদ প্রচার করতে শুরু করল এমন এক কণ্ঠে যা শতাব্দী-গভীরে প্রতিধ্বনিত হল। তার শিষ্য ও অনুগতদের মর্ত্যরে সমস্ত আনন্দ, যশ আর ভোগসুখের প্রতিশ্রুতি দিল সে। কবুল করল সে হচ্ছে ইবলিস, তবে সে এটা স্বীকার করল তার সম্পর্কে মানুষের ধারণা পরিবর্তন এবং ধর্মভীরু বুড়িদের বয়ান অস্বীকার করার জন্য।

‘হ্যাঁ, আমি হচ্ছি ইবলিস,’ পুনরাবৃত্তি করল সে, ‘তবেনরকাগ্নিময় রাত আর ঘুমপাড়ানিয়া কাহিনি, বা শিশুদের ভয়-দেখান ইবলিস নয়, বরং একমেবাদ্বিতীয়ম ইবলিস, প্রকৃতির সেই নিয়ন্তা যাকে মানুষের হৃদয় থেকে অপসারণ করার জন্য এই নাম দেয়া হয়েছে। দেখ, আমি কত সুশিক্ষিত আর সুসভ্য। আমিই হচ্ছি তোমাদের প্রকৃত পিতা। এসো, আমাকে অনুসরণ করো এবং সেই নাম গ্রহণ করো যা আমাকে অসম্মান করার জন্য আবিষ্কার করা হয়েছে, এ থেকে প্রতীক এবং আদর্শমান তৈরি করো, আমি তোমাদের সব দেবো, সব...।’

উৎসাহ উসকাতে আর উদাসীনকে জাগ্রত করতে, অন্য কথায়, নিজের চারপাশে বিপুল সমাবেশ ঘটাতে এভাবে কথা বলল সে। এবং ওরা এল। আর ওরা আসামাত্রই নিজের মতবাদ ব্যাখ্যা করতে অগ্রসর হল ইবলিস। সারমর্মের বিচারে, অবিশ্বাসী কোন আত্মা থেকে এমনটাই প্রত্যাশা করতে পারে একজন--আর রূপকল্পের বিচারে এটা কখনো অত্যন্ত পরিশীলিত, আবার কখনো ধৃষ্ট আর নির্লজ্জ শোনাল।

সে ঘোষণা করল, স্বীকৃত সুনীতিগুণগুলো অবশ্যই অন্যকিছু দিয়ে বদল করতে হবে, এমনকিছু যেগুলো প্রাকৃতিক এবং বৈধ। অহঙ্কার, লালসা, আলস্য এসব আবার পুনর্বহাল করা হল। সেই সঙ্গে ধনলিপ্সাও, যাকে সে অর্থনীতির জননী বলে ঘোষণা করল, উভয়ের মধ্যে পার্থক্য কেবলজননী হলেন স্বাস্থ্যবতী আর কন্যা অস্থিচর্মসার। হোমরের সময়ে রোষনিজের শ্রেষ্ঠ ন্যায়সঙ্গত মর্যাদা লাভ করেছিল--আকিলিসের ক্রোধ ছাড়া ইলিয়াড হত না: ‘কাব্যলক্ষ্মী, পেলাস পুত্র আকিলিসের ক্রোধের গান কর...।’ অতিভোজনের ব্যাপারেও একই কথা বলল সে, রাবেলেইসের শ্রেষ্ঠ পাতা আর ক্রাজ ডি সিলভার হিসোপোর বহু সুন্দর কবিতার জন্ম দিয়েছে। এটা এতই শ্রেয়তর গুণ যে কেউ লুকলাসের যুদ্ধের কথা স্মরণ করে না, শুধু তার ভোজসভার কথা স্মরণ করে: বস্তুত অতিভোজই তাকে অবিস্মরণীয় করেছে। আর কেউ যদি এসব সাহিত্যিক এবং ঐতিহাসিক যুক্তি অগ্রাহ্য করে শুধু অতিভোজের অন্তর্নিহিত অর্থ বিবেচনা করতে চায়, তারপরেও কে অস্বীকার করতে পারে যে মুখে আর পেটে সুখাদ্যের প্রাচুর্য একগ্রাস খাবার বা অনাহারের লালার চেয়ে ভাল বোধ হয়?ঈশ্বরের আঙুরবাগানের পরিবর্তে, একটি রূপকী অভিব্যক্তি, ইবলিসের আঙুরবাগান প্রতিষ্ঠার ওয়াদা করল ইবলিস, একটি সোজাসাপটা এবং নির্ভেজাল কথার কথা, যেহেতু সে কখনই তার অনুগামীদের বিশ্বের সুন্দরতমদ্রাক্ষা জোগানয় ব্যর্থ হবে না। আর ঈর্ষার ব্যাপারে শীতলকণ্ঠে সে প্রচার করল, এটাই হচ্ছে প্রধান গুণ, অনন্ত সমৃদ্ধির উৎস, একটি আনন্দদায়ক ভাব যা অন্যান্য গুণ ও প্রতিভার ঘাটতি পূরণ করে।

জনতা উৎসাহভরে ছুটল তার পেছনে। বাগ্মিতার প্রাবল্যে ইবলিস তার অনুগামীদের মধ্যে দুনিয়া সম্পর্কে ধারণা বদলে দিয়ে, বিকৃতির প্রতি ভালবাসা আর শুভের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগ্রত করে, নয়া শৃঙ্খলা সঞ্চারিত করল।

যেমন, তার অসততার সংজ্ঞার চেয়ে আজগুবি আর কিছুই হতে পরে না।একে মানুষের বাম হাত বলল সে, যেহেতু ডান হাত হচ্ছে শক্তি, এবং রায় দিলো যে বেশিরভাগ মানুষই হচ্ছে বামহাতি। তবে সব মানুষকে বামহাতি হতে হবেএমন আবশ্যক করল না--সে নতুন সদস্য গ্রহণে অনাগ্রহী নয়। যারা বামহাতি কিংবা ডানহাতি তাদেরকে গ্রহণ করল সে, কিন্তু যারা কোনটাই নয় তাদেরকে জায়গা দিল না।অর্থলালসার ওপর সে সবচেয়ে প্রগাঢ় এবং প্রচ- ব্যাখ্যা দিল: তৎকালীন একজন কূটতার্কিক এমনকি এও স্বীকার করলেন যে এটা হচ্ছে যুক্তির এক মিনার। অর্থলালসা, ইবলিস বলল, অন্য সব অধিকারের চেয়ে শ্রেয়তর এক অধিকারের প্রয়োগ। তুমি যদি তোমার বাড়ি বিক্রি করতে পার, তোমার ষাঁড়, জুতো, কিংবা টুপি বিক্রি করতে পার--তুমি যেগুলোর বৈধ ও আইনসঙ্গত মালিক সেসব জিনিস--তাহলে তোমার মতামত, ব্রত, কথা, কিংবা বিশ্বাস--যেগুলো তুচ্ছ বিষয়আশয়ের চেয়ে বেশি মূল্যবান কারণ সেগুলো তোমার বিবেকের, অর্থাৎ, তোমার আত্মার উপকরণ--বিক্রি করা যাবে না কেন? এটা অস্বীকারের অর্থ হচ্ছে অযৌক্তিকতা আর অসঙ্গতিতে পতিত হওয়া। কোন কোন মেয়ে কি তাদের চুল বিক্রি করে না? একজন মানুষ কি আরেকজন রক্তাল্পতাগ্রস্ত মানুষকে দেয়ার জন্য নিজের কিছু রক্ত বিক্রি করতে পারে না? রক্ত, চুল--দেহের নানা অংশ--এগুলো কি চরিত্র--মানুষের নৈতিক অংশের চেয়ে চেয়ে বেশি মর্যাদাবান? এভাবে অর্থলালসার নীতিগুলো প্রদর্শন করে, ইবলিস এর দুনিয়াবি এবং আর্থিক সুবিধা ব্যাখ্যা করতে দেরি করল না। তারপর, সে দেখাল যে সামাজিক কুসংস্কারের প্রেক্ষাপটে এধরনের বৈধ অধিকারগুলো আড়াল করা যথাযথ হবে। আর এটা করার মাধ্যমে, অর্থলালসা ও ভণ্ডামি একইসঙ্গে প্রয়োগ করতে সমর্থ হবে একজন এবং এভাবে দ্বিগুণ যোগ্য হয়ে উঠবে।

সবকিছু পরীক্ষা আর শোধরানর জন্য একই সময়ে সব জায়গায় সমুপস্থিত রইল সে। স্বাভাবিকভাবেই ভুলের জন্য ক্ষমা, এবং দয়া ও আন্তরিকতা পরিচায়ক এমন নীতিগুলোর বিরোধিতা করল। যদিও সে বিনামাশুলে অপবাদ সুনির্দিষ্টভাবে নিষিদ্ধ করল না, তবে সবসময় আর্থিক বা অন্য কোন ধরনের দক্ষিণার কথা মাথায় রেখে এর চর্চা সুপারিশ করল। তবে, অপবাদ যখন সম্পূর্ণতই কল্পনার সীমাহীন বিস্তার, সে পারিশ্রমিকগ্রহণ নিষিদ্ধ করল, কেননা সেটা হবে নিশ্বাসগ্রহণের জন্য মজুরি পাওয়ার সমতুল। সামাজিক ও ব্যক্তিগত শিষ্টাচারের সম্ভাব্য উপকরণ হিশেবে উল্লেখ করে, সব ধরনের আদবকায়দার নিন্দা করল সে, কেবল এর ব্যতিক্রম হল যখন ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিলের জন্য মোসাহেবি আবশ্যক হয়। তবে এই ব্যতিক্রমকে শেষে খারিজ করা হল এই সত্য দিয়ে যে ব্যক্তিগত লাভের আকাক্সক্ষা আদবকে নিছক চাটুকারিতায় পরিণত করে--সুতরাং এধরনের ক্ষেত্রে আদব নয়, চাটুকারিতাই হচ্ছে প্রযোজ্য যথার্থ মনোভাব।

সতীর্থদের প্রতি ভালবাসার ধারণা ওর নতুন প্রতিষ্ঠানের জন্য মারাত্মক বাধা এটা লক্ষ করে,নিজেরকাজ সম্পন্ন করার জন্য ইবলিস উপলব্ধি করল মানুষের সমস্ত সংহতি ধ্বংস করাই যথাযথ হবে। সে দেখাল যে এই ধারণা মূলত পরগাছা এবং দেউলে ব্যবসায়ীদের আবিষ্কার, বস্তুত সতীর্থদের প্রতি উদাসীনতা--এবং কোন কোন ক্ষেত্রে, ঘৃণা বা অবজ্ঞা--ছাড়া কিছুই প্রদর্শন করা উচিত নয়। সংস্কৃতবান ও পরিশীলিত নেয়াপোলিতীয় পাদ্রি, ফার্নান্দো গালিয়ানি, যিনি সাবেক শাসনামলেএকজন সম্ভ্রান্ত মহিলাকে লিখেছিলেন: ‘জাহান্নামে যাক সতীর্থজন। সতীর্থ বলে কিছু নেই!’ এই কথাগুলো উদ্ধৃত করে ‘সতীর্থ’ ধারণাটা ভুল প্রমাণিত করতে চেষ্টা করল সে। মাত্র একটি পরিস্থিতিতেই মানুষকে আর কাউকে ভালবাসার অনুমতি দিলো ইবলিস, আর সেটা হচ্ছে পরস্ত্রীকে ভালবাসা। কেননা এধরনের ভালবাসায় আসলে ব্যক্তির নিজেকে ভালবাসার অতিরিক্ত কিছুুই নেই। আর যখন কয়েকজন শিষ্য আবিষ্কার করল যে এধরনের মারিফতি ব্যাখ্যা সাধারণ মানুষের বোধের অগম্য, ইবলিস একটি রূপকের আশ্রয় নিলো: একশ লোক ব্যাংকের শেয়ার কেনে অভিন্ন কর্মসম্পাদনার জন্য, কিন্তু প্রত্যেক শেয়ারমালিক শুধু নিজের লাভের ব্যাপারে আগ্রহী থাকে। ব্যভিচারীদের বেলায়ও তা-ই ঘটে। এই হিতোপদেশটি সে তার জ্ঞান পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করল।



চতুর্থ অধ্যায়
সুবিধা, আরো সুবিধা


ইবলিসের ভবিষ্যদ্বাণীই সত্য হল। সব সুনীতি, যাদের রেশমি আলখাল্লা সুতির ঝালরে শেষ হয়েছে, নিজেদের আলখাল্লাগুলো পরিত্যাগ করল বিছুটি ঝোপে, ঝালরে টান পড়ার পর নতুন গির্জায় যোগ দেয়ার জন্য দৌড়ে এল। অন্যরা অনুসরণ করল ওদের, এবং প্রতিষ্ঠানটি সময়ের আশীর্বাদ লাভ করল। গির্জা স্থাপিত হল; মতাদর্শ ছড়িয়ে পড়ল; দুনিয়ার এমন কোন অঞ্চল রইল না যা এর সঙ্গে পরিচিত হল না, এমন কোন ভাষা বাদ রইল না যে-ভাষায় এটি অনূদিত হল না, অথবা এমন কোন জাতি রইল না যে একে ভালবাসল না। ইবলিস সাফল্যের তুমুল আওয়াজ তুলল।

কিন্তু, একদিন, অনেক বছর বাদে, ইবলিস লক্ষ করল অনেক বিশ্বাসী গোপনে সনাতন সুনীতিগুলোর চর্চা করছে। তার সব চর্চা করছে না, বা পুরোপুরিও করছে না, কিন্তু কোন কোনটা অংশত করছে এবং যেমনটি বলা হয়েছে আগেই, গোপনে করছে। কোন কোন পেটুক বছরে তিন-চারবার পিছু হটেছে মিতাহার করার জন্য, ঠিক যেসব দিনে ক্যাথলিক অনুশাসনে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। অনেক কৃপণ রাতে অথবা জনবিরল রাস্তায় দান-খয়রাত করেছে। রাজকোষ ফাঁকি দিয়েছে এমন অনেকে মাঝে মাঝে কিছুটা ফেরত দিয়েছে। কখনো-সখনো, অসৎ লোকেরা নির্ভেজাল সত্যকথা বলেছে, কিন্তু নিজেদের চেহারায় প্রতারকের অভিব্যক্তি ধরে রেখেছে ধাপ্পাবাজির ধারণা দেয়ার জন্য।

এই আবিষ্কার শঙ্কিত করে তুলল ইবলিসকে। দুষ্টকে আরো কাছে থেকে লক্ষ করতে লাগল সে এবং দেখল যে এটা প্রভূত বৃদ্ধি পেয়েছে। কোন কোন ঘটনা ধারণার বাইরে, লেভিন্থিয়ান ওই ওষুধ বিক্রেতার ঘটনাটি যেমন। বহুকাল ধরে একটি বিশেষ পরিবারের পুরো একটি প্রজন্মকে বিষপ্রয়োগ করে আসছিল সে, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তের ছেলেমেয়েদেরকে ওষধটির উপজাত পদার্থের সাহায্যে উদ্ধার করেছে। কায়রোয় এক অনুশোচনাহীন উট চোরের দেখা পেল ইবলিস যে তার মুখ ঢেকে রেখেছিল যাতে মসজিদে ঢুকতে পারে। এক মসজিদের প্রবেশপথে ইবলিস পাকড়াও করল লোকটাকে এবং তার আচরণের জন্য ভর্ৎসনা করল। কিন্তু অভিযোগ অস্বীকার করল চোর, বলল সে মসজিদে যাচ্ছিল এক পথপ্রদর্শকের উট চুরি করার জন্য। তবে, ইবলিসের উপস্থিতিতে চুরি করার পর, ওটা সে দান করল মুয়াজ্জিনকে যিনি আল্লাহর কাছে তার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। বেনেডিক্টিীয় পাণ্ডুলিপিতে আরো অনেক অসাধারণ আবিষ্কারের উল্লেখ ছিল, যেগুলোর মধ্যে এটি ইবলিসের মাথা সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি করে দিয়েছিল। ক্যালাব্রিয়ান ওর সেরা শিষ্যদের একজন, বয়স পঞ্চাশ, একজন খ্যাতনামা দলিল জোচ্চর যার রোমের গ্রামাঞ্চলে চিত্রকলা, মূর্তি ও পাঠাগারশোভিত চমৎকার একটি বাড়ি ছিল। চোখেমুখে জোচ্চর লোকটা--সুস্থ আছে একথা যেন স্বীকার করতে না হয় সেজন্য বিছানাগত হলো। কিন্তু ইবলিস আবিষ্কার করল, লোকটা জুয়াতেও যেমন চুরি করে না তেমনি তার ভৃত্যদেরও বখশিস দেয়। একজন পাদ্রির সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর প্রত্যেক সপ্তাহে নির্জন উপসনাকক্ষে যায় সে নিজের অপরাধ স্বীকার করার জন্য এবং যদিও বন্ধুর কাছে নিজের গোপন কর্মকাণ্ডের কথা প্রকাশ করে না সে, কিন্তু সবসময়ে দুবার ক্রুশআঁকে, একবার যখন নতজানু হয় এবং আরেকবার যখন উঠে দাঁড়ায়। এরকম ছলনা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় ইবলিসের, কিন্তু এব্যাপারে কোন সন্দেহ ছিল--ঘটনাটা সত্যি।

একমুহূর্ত নষ্ট করল না সে। ধাক্কাটা তাকে বর্তমান অবস্থার সঙ্গে অতীতের কোন মিল খুঁজে পাওয়ার জন্য চিন্তাভাবনা করা, তুলনা করা বা সিদ্ধান্তে পৌঁছানর সময় দিলো না। আবার স্বর্গে উড়ে গেল সে, ক্রোধে উন্মত্ত, এরকম একটি বিরল ঘটনার গুপ্তরহস্য জানবার জন্য ব্যাকুল। সীমাহীন সন্তোষের সঙ্গে ওর কথা শুনলেন ঈশ্বর কিন্তু বাধা দিলেন না বা জবাব দিলেন না এবং এমনকি ইবলিসের যন্ত্রণা নিয়ে উল্লসিতও হলেন না। তিনি সোজা তাকালেন ইবলিসের চোখের দিকে, বললেন:

‘তুমি কী প্রত্যাশা করেছিলে, হে আমার বেচারা ইবলিস?সুতির আলখাল্লাগুলোয় এখন রেশমি ঝালর রয়েছে, ঠিক যেমন ওই রেশমিগুলোর সুতির ঝালর ছিল। তুমি কী প্রত্যাশা করেছিলে? এটাই হলোমানুষের অনন্ত স্ববিরোধিতা।’



(‘আ ইগরেহা দু দিয়াবো” নামে এই গল্পটি ১৮৮৪ সালে মাচাদো দি আসিসের ছোটগল্প সংগ্রহে প্রকাশিত হয়। এই বাংলা অনুবাদের ভিত্তি টেক্সাস প্যান অ্যামেরিকান সিরিজভুক্ত জ্যাক শ্মিট ও লোরি ইশিমাৎসু অনূদিত ও সম্পাদিত ইংরেজি দি ডেভিলস্ চার্চ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ-ভুক্ত ‘দি ডেভিলস চার্চ।’)


লেখক পরিচিত
রওশন জামিল
জন্মসাল: ১৯৫৮
জন্মস্থান: ঢাকা
শিক্ষা: বিএ অনার্স, এমএ (বাংলা) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আন্ডারগ্র্যাজুয়েট (জার্নালিজম ও ফোটোগ্রাফি) : সিটি ইউনিভার্সিটি অভ ন্যু ইয়র্ক।
বর্তমান পেশা: লিঙ্গুইস্ট, নিউ ইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অভ এডুকেশন
উল্লেখযোগ্য অনুবাদ গ্রন্থ: দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি এবং দি অ্যাডভেঞ্চার অভ হাকলবেরি ফিন; এছাড়া ওয়েস্টার্ন ধারার ওসমান পরিবার সিরিজ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ