বৃটিশ কথাসাহিত্যিক এবং ফেমিনিস্ট ভার্জিনিয়া উলফের জন্ম ১৮৮২ সালে। তাঁকে বিবেচনা করা হয় বিশ শতকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আধুনিকতাবাদী সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে লন্ডনের সাহিত্য সমাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে পরিগণিত হন তিনি। তৎকালীন ব্লুমস্বারি গোষ্ঠীরও একজন সম্মানিত সদস্য ছিলেন তিনি। উলফ-রচিত সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ। মিসেস ডলওয়ে, টু দ্য লাইটহাউস, জেকবস্ রুম, ওরলানডো, দ্য ওয়েভস্ তাঁর প্রখ্যাত উপন্যাস।
চরিত্রের অবিরাম বিবৃতি আর উন্মোচনে উপন্যাসগুলো পেয়ে যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রা। উল্ফকে বলা হয় অক্লান্ত পরীক্ষক, পর্যবেক্ষক এবং বহুদর্শী এক রচয়িতা। স্ট্রিম অব কনসাসনেস বা চেতনাপ্রবাহ রীতিতে তিনি রচনা করেন 'নিজের একটি ঘর' নামক প্রখ্যাত গ্রন্থটি। এই রীতির শ্রেষ্ঠ ফসল জেমস জয়েসের ইউলিসিস। এই রীতিটিকে বলা হয় কোনো ব্যক্তির চেতনাপ্রসূত অভিজ্ঞতার বিরামহীন বর্ণনা। দীর্ঘদিন বিষণ্নতায় ভোগার ফলে বেঁচে থাকবার তীব্রতা কমে যায় তাঁর। নিজের হাতে তুলে নেন নিজেকে ধ্বংসের দায়িত্ব! ৫৯ বছর বয়সে কোটের পকেটে পাথর ভরে বৃটেনের ওউশি নদীতে ডুবে যান তিনি। জীবনে আর ফেরা হয় না তাঁর। জলের সঙ্গে মিশে যায় বিষণ্ন লেখিকার আত্মা। দিনটি ছিল ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ। সোম কিংবা মঙ্গলবার গল্পের মূল নাম Monday or Tuesday, ভূতুড়ে বাড়ি গল্পটির মূল শিরোনাম A Hounted House, রচনাকাল ১৯২১। অনুবাদ- এমদাদ রহমান।
সোম কিংবা মঙ্গলবার
অলস আর নিঃস্পৃহ ভঙ্গিতে, ডানাগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত কম্পনে, স্থান ও কালকে কাঁপিয়ে, নিজের গতিপথ সম্পর্কে নির্ভার থেকে, সারস পাখিটি আকাশ আর গির্জার চূড়ার মাঝখান দিয়ে উড়ে চলেছে। আদিগন্ত ফ্যাকাশে শুভ্রতার কারণে তেমন কিছু চোখে পড়ে না তার। তাই ফ্যাকাসে শুভ্রতাটুকু নিজের ভেতরে শুষে নিয়ে, অবিরাম অবিশ্রান্ত দক্ষতায়।
আকাশকে আত্মা দিয়ে ঢেকে পরক্ষণে অনাবৃত করে সারসটি বারবার তার ডানাজোড়া আন্দোলিত করে, আবার স্থির স্ত্মব্ধতার ভেতর নিজেকে লুকিয়ে ফেলে এগিয়ে যায়। নিচে এটা কী দেখা যায়? কোনো লেক? জলাশয়টার তটরেখা কোথায় বিলুপ্ত হয়েছে! নাকি এটা কোনো পর্বতের শৃঙ্গ? আহ্! তার চড়াই-উৎরাই ভরে আছে সূর্যের সোনালি আভা। নিচে বয়ে চলেছে এক উষ্ণ প্রস্রবন। অজস্র ফার্ন, অথবা খসে-পড়া পাখির পালক, অবিরাম খসে-পড়া পালক...
আকাঙ্ক্ষিত সত্য, এবং সত্যের জন্যে তার অধীর অপেক্ষা; জোর করে উচ্চারিত কিছু শব্দ, চিরকালীন কিছু আকাঙ্ক্ষা (বাঁ পাশে কেউ একজন হঠাৎ কেঁদে উঠল, তারপর ডানপাশেও, চাকাগুলো ঘুরতে শুরু করল অনিয়ন্ত্রিত গতিতে আর পুরোনো মোটর-বাসগুলো হলো সংঘর্ষে বিধ্বস্ত, চিরকালের কিছু আকাঙ্ক্ষা (ঘড়িটি দৃঢ়তার সঙ্গে বারোটি পৃথক শব্দে ঘোষণা করল এখন মধ্য-দুপুর, আলো আর ছায়ায় স্বর্ণ-আভা, শিশুরা ঝাঁক বেঁধে দৌড়াচ্ছে), চিরকালীন প্রতীক্ষিত এইসব-ই কি তাহলে সত্য? অট্টালিকাগুলো রক্তলাল; গাছে গাছে ঝুলে আছে পয়সাগুলো; চিমনির কালো ধোঁয়া লেজ গুটিয়ে উড়ছে; ঘেউঘেউ, চিৎকার, ফেরিওলার বাজখাই হাঁক-লোহা কিনবেন, লোহা... এটাই কি তাহলে সত্য?
কালো কিংবা সোনালি আবরণে নারী-পুরুষের পা-গুলোকে উদ্ভাসিত করে দিয়ে (এই কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া কি মধুর? না, ধন্যবাদ; এই কুয়াশা আগামী দিনের ঔপনিবেশিক অন্ধকারের কমনওয়েলথ!), চুল্লির আগুন ছড়িয়ে পড়ে ঘরগুলোকে করে ফেলে লাল, কালো কালো মানব-মূর্তি আর তাদের উজ্জ্বল চোখগুলোকে রক্ষা করার জন্য; হয়ত বাইরে কোথাও তখন ভ্যান থেকে খালাস হচ্ছে মাল। কুমারী থিংগুমি তার চেয়ারে বসে একা একা পান করছে চা, ভাঙা কাচের টুকরোগুলো সে ভরে রাখছে চামড়ার কোটের পকেটে...
জাঁক-জমক, পাতার উজ্জ্বলাভা; সমুদ্রস্রোতে ডুবতে ডুবতে আর ভাসতে ভাসতে এককোণে জড়ো হওয়া, গতির বিপরীতে উড়ে-চলা, রূপালি আলোর হঠাৎ বিচ্ছুরণ, ঘর কিংবা নিরাশ্রয়; সমষ্টি, বিচ্ছিন্নতা, বিভিন্ন মাত্রার অপব্যয়; উপরকে মুছে ফেলা আর নিচকে দলা পাকিয়ে ছিন্নভিন্ন করা; অতঃপর ডুবিয়ে দেয়া-তাহলে এইসবই সম্মিলিতভাবে সত্য?
শ্বেতপাথরের উন্মুক্ত চত্বরে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের পাশে সবকিছুকে জড়ো করা হোক গজদন্তের মতো গভীর তাৎপর্যময় শব্দগুলোর দ্বারা তাদের কালোত্বটুকুকে ঢেলে ফেলা হোক। তাদেরকে আলোয় ফুটিয়ে তোলা হোক। তাদেরকে গাঢ় অন্ত্মর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা হোক। যুদ্ধে নিহত মানুষের ইতিহাস এখানে অগ্নিশিখায় জ্বলজ্বল, প্রতিমুহূর্তেই জীবনের চিহ্ন জ্বেলে সবাই এখন দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায়, নগরীর উন্মুক্ত চত্বরে গলার অলঙ্কারের মতো সবকিছুই দীপ্তিমান, গির্জার চূড়া আর মিনারগুলো এখন অন্তরালে আর নিচে তরঙ্গায়িত ভারত সাগরের জলরাশি, আকাশের শূন্যতা আদিগন্ত নীলে ছেয়ে যায় আর তারকামণ্ডল প্রখর দীপ্তিতে জ্বলতে থাকে; সত্য কি তাই? অথবা, এ সবকিছুই সত্যের নিকটবর্তী?
অলস আর নিঃস্পৃহ সারস পাখিটি তার পরিক্রমা শেষ করে ফিরছে। আকাশ তারাদের মুখোশে লুকিয়ে ফেলেছে তার মুখ, তারপর লুকিয়ে ফেলেছে তারাগুলোকেই।
ভূতুড়ে বাড়ি
যখনই, তুমি ঘুম থেকে জেগে ওঠো, দেখবে যে ঘরের দরোজা খুলে গেছে, তারপর এক ঘর থেকে আরেক ঘরে তারা যাবে; হাতের ভেতর হাত, শূন্যে উড়ছে, মুঠো খুলে যাচ্ছে, নিশ্চিত হচ্ছে যে এরাই ছায়াচ্ছন্ন ভূতুড়ে দম্পতি।
'এটাকে এখানেই ফেলে দেওয়া উচিত', বলল ভূতুড়ে নারীটি এবং সঙ্গে আরো যোগ করল, 'উফ্, কিন্তু এখানে আরো কিছু রয়ে গেছে', 'ওপরের তলায়', সে ফিসফিস করে। পুরুষকণ্ঠ বলে 'এমনকি বাগানের মধ্যেও' এবং সেও ফিসফিস করে, 'চুপিসারে', তারা একসঙ্গে বলে, 'অথবা আমরা তাদের ঘুম ভাঙিয়ে দেব'।
'কিন্তু তুমি আমাদের জাগিয়ে দেয়াটা ঠিক হবে না। উফ্, না', 'তারা এখানেই তাকে খুঁজছে'; 'তারা পর্দার অন্ত্মরাল থেকে দেখছে', কেউ একজন কথাটা অবশ্যই বলবে এবং তাই তারা পাঠ করবে পৃষ্ঠাগুলির একটি বা দুটি। 'এখনই তারা তাকে খুঁজে পাবে', কেউ একজন ব্যাপারটায় নিঃসংশয় হবে। মার্জিনের ওপর চেপে ধরবে পেন্সিল; আর তারপর, পাঠ করতে করতে ক্লান্ত কেউ একজন উঠে দাঁড়াবে এবং দেখবে যে তার জন্য পুরো বাড়িটিই খালি, সবগুলি দরোজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে, কাঠপায়রাগুলি ডাকছে তৃপ্তি সহকারে, খামার থেকে আসছে মাড়াইকলের গুমগুম ডাক। আমি কী করতে এখানে এসেছি? কী খুঁজে পেতে চাই আমি? আমার হাতদুটি খালি। সম্ভবত এটা ওপরতলারও ওপরে, আপেলগুলি ঘাস রাখবার ঘরে এবং আবারো নিচে আরো নিচে, বাগানটি আগের মতোই আছে।
কিন্তু তারা এটাকে খুঁজে পেয়েছে ড্রইংরুমেই। ব্যাপারটা এমন নয় যে কেউ একজন এটাকে দেখতে পেয়েছিল, আর আপেলগুলিও প্রতিবিম্বিত হচ্ছিল জানালার কাচে। প্রতিবিম্বিত হচ্ছিল গোলাপগুলি, জানালার কাচে পাতাগুলি কী অদ্ভুত সবুজ, যদি তারা ড্রইংরুম থেকে চলেই যায়, তাহলে আপেলগুলি ঘুরতে শুরু করবে আর দেখাবে তাদের হলুদিয়া অংশগুলি, এমনও হতে পারে, যদি মুহূর্তকয়েক পর দরোজাটা খুলে দেয়াও হয়, তারা ছড়িয়ে পড়বে মেঝের ওপর, ঝুলে পড়বে দেয়ালে দেয়ালে আর ছাদে,-ঠিক এরকমটাই হবে না? আমার হাত দুটি খালি, একেবারেই খালি। একটা থ্রাস পাখির ছায়া কার্পেট পেরিয়ে গেল। নীরবতার একেবারে গভীর কূপ থেকে বনঘুঘুরা শব্দের বুদ্বুদ তুলছে-'সাবধান, সতর্ক হও, সাবধান... 'নিরাপদ, নিরাপদ', বাড়িটির হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হচ্ছে মৃদুতালে। গুপ্তধন কক্ষটিতেই রাখা। হৃৎস্পন্দন মুহূর্তের জন্য থামে। উফ্, এটাই কি সেই ঘর, গুপ্তধন যেখানে রাখা?
মুহূর্তের ব্যবধানে আলো কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বাগান থেকে দূরে কোথাও? কিন্তু গাছগুলো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ডালপালায় অস্থির ঘূর্ণন তুলেছে, অফুরন্ত সূর্যরশ্মির অপেক্ষা। এত সূক্ষ্ণ আর হালকা যে অলক্ষ্যেই পৃষ্ঠতল ভেদ করে রশ্মিগুলি হারিয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে সবকিছু পুড়ে যাচ্ছে গ্লাসের আড়ালে। এই গ্লাসেই মৃত্যু ছিল, মৃত্যু ছিল আমাদের ভেতরে; সেই প্রথম যেদিন নারী এল, শতশত বৎসর আগে, বাস করেছিল ঘরটিতে, বন্ধ করে দিয়েছিল কপাটগুলি, কক্ষগুলি ঢেকে গিয়েছিল অন্ধকারে, তারপর মৃত্যু নারীটিকে পৃথিবী থেকে পরিত্যক্ত করেছে, পরিত্যক্ত করেছে নিজেকেও, তারপর, চলে গেছে উত্তরে, চলে গেছে পূর্বে, তারাদের অবিরাম আবর্তন সে দেখেছে দক্ষিণাঞ্চলের আকাশে, ঘরটিকে ফের খুঁজতে শুরু করেছে, ভূগোলকের একেবারে নিচের দিকে তাকে খুঁজেও পেয়েছে, 'নিরাপদ, নিরাপদ, নিরাপদ', ঘরটির হৃদয় স্পন্দিত হচ্ছে আনন্দের সঙ্গে, এই সেই গুপ্তধন, যা কেবলমাত্র তোমার।
শো শো বাতাস বইছে এভিনিউ জুড়ে আর বৃক্ষগুলি বারবার বন্ধ করে দিচ্ছে বাতাসের গতিপথ। বৃষ্টিতে চাঁদের আলো বাঁধভাঙা জলের মতো গলে যাচ্ছে, কিন্তু বাতির আলোকরশ্মির ফালি প্রতিফলিত হচ্ছে সোজা জানালা বরাবর। নিঃশেষ হওয়ার প্রচণ্ড জেদ নিয়ে ঝড়ের ভেতর একটানা জ্বলেই যাচ্ছে মোমবাতিটা। বিক্ষিপ্ত এলোমেলো ঘরটির জানালা খুলে দিয়ে ফিসফিস করে আমাদের ঘুম না ভাঙিয়ে, অশরীরী-যুগল তাদের আনন্দকে উপভোগের সুযোগ খুঁজে পায়। নারীটি বলে-এখানেই ঘুমিয়ে পড়ব আমরা; পুরুষটি যোগ করে-চুমু খাবো অগুন্তি আর ভোরে ঘুম ভাঙবে আমাদের...বৃক্ষগুলির মাঝখানে রূপালি ঝিলিক...যখন গ্রীষ্ম আসবে...প্রচণ্ড শৈত্যে তুষারপাতের মধ্যেও...দরোজাগুলি বন্ধ হচ্ছে একে একে, সময়ের দূরত্বের ভেতর ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, মৃদু করাঘাত করছে ঠিক যেন হৃদযন্ত্রের স্পন্দন।
নিকটবর্তী হয়, দরোজার কাছে এসে থামে, বিরতি দেয়, প্রবেশ করে-বাতাস পড়ে এসেছে, বৃষ্টির ফোঁটাগুলি রূপার বিন্দু হয়ে কাচের ওপর আর আমাদের চোখগুলি অন্ধকার, শুনতে পাচ্ছি না আমাদের পাশে কারো পদশব্দ, এমনকি কোনো ভদ্রমহিলাকেও দেখছি না যিনি তার ভূতুড়ে আলখাল্লাটিকে মেলে ধরেছেন। তার হাতগুলি রক্ষা করবে জ্বলন্ত হারিকেন। 'তাকাও' পুরুষটির ফিসফিস। মথিত করে দাও পরস্পরের ঠোঁটগুলি, আমাদের ওপর রূপালি বাতিটি তুলে ধরে, দীর্ঘসময় ধরে নিজেদের তারা দেখে নেয় এবং গভীরে যাত্রা শুরু করে, বাতাস সোজাসুজি বয়ে চলে, শিখাগুলি নিভে যায় ধীরে ধীরে, চাঁদের বুনো রশ্মি মেঝে আর দেয়ালকে ভেদ করে চলে যায় আর একসঙ্গে মিশে যেতে থাকে, রঙের ছোপলাগা মুখ রক্তিম, মুখগুলি মন্থর, পৃথুল, মুখগুলি খুঁজে বেড়াচ্ছে ঘরের ভেতর রক্ষিত গোপন শয্যা এবং নিংড়ে নিতে চাইছে আত্মগোপন করে থাকা আনন্দ।
বাড়িটির হৃদয় আনন্দে স্পন্দিত হয়- নিরাপদ, নিরাপদ, নিরাপদ, সুদীর্ঘ কাল ধরে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আবার আমাকে তুমি খুঁজে পাবে- ফিসফিস করে বলে -এইখানে। এখানেই ঘুমিয়ে থাকবে, এই উদ্যানেই পড়তে থাকবে, হাসতে থাকবে, আপেলগুলি গড়াতে গড়াতে ঘাস রাখবার ঘরে...এখানেই আমরা নিজেদের নিঃশেষ করে সম্পদ ফেলে চলে গেছি। স্থির, নিশ্চল আলো চোখের ঢাকনা সরিয়ে দেয়। 'নিরাপদ, নিরাপদ, নিরাপদ', বাড়িটার হৃৎস্পন্দন বুনো হাওয়ার মতো স্পন্দিত হয়। জেগে ওঠো, আমি আর্তচিৎকার করছি, ওঠো, উফ্, এই কি তোমার চাপা দেয়া সম্পদ? এই তোমার হৃদয়ের জ্যোতির্ময় আলো?
চরিত্রের অবিরাম বিবৃতি আর উন্মোচনে উপন্যাসগুলো পেয়ে যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রা। উল্ফকে বলা হয় অক্লান্ত পরীক্ষক, পর্যবেক্ষক এবং বহুদর্শী এক রচয়িতা। স্ট্রিম অব কনসাসনেস বা চেতনাপ্রবাহ রীতিতে তিনি রচনা করেন 'নিজের একটি ঘর' নামক প্রখ্যাত গ্রন্থটি। এই রীতির শ্রেষ্ঠ ফসল জেমস জয়েসের ইউলিসিস। এই রীতিটিকে বলা হয় কোনো ব্যক্তির চেতনাপ্রসূত অভিজ্ঞতার বিরামহীন বর্ণনা। দীর্ঘদিন বিষণ্নতায় ভোগার ফলে বেঁচে থাকবার তীব্রতা কমে যায় তাঁর। নিজের হাতে তুলে নেন নিজেকে ধ্বংসের দায়িত্ব! ৫৯ বছর বয়সে কোটের পকেটে পাথর ভরে বৃটেনের ওউশি নদীতে ডুবে যান তিনি। জীবনে আর ফেরা হয় না তাঁর। জলের সঙ্গে মিশে যায় বিষণ্ন লেখিকার আত্মা। দিনটি ছিল ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ। সোম কিংবা মঙ্গলবার গল্পের মূল নাম Monday or Tuesday, ভূতুড়ে বাড়ি গল্পটির মূল শিরোনাম A Hounted House, রচনাকাল ১৯২১। অনুবাদ- এমদাদ রহমান।
সোম কিংবা মঙ্গলবার
অলস আর নিঃস্পৃহ ভঙ্গিতে, ডানাগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত কম্পনে, স্থান ও কালকে কাঁপিয়ে, নিজের গতিপথ সম্পর্কে নির্ভার থেকে, সারস পাখিটি আকাশ আর গির্জার চূড়ার মাঝখান দিয়ে উড়ে চলেছে। আদিগন্ত ফ্যাকাশে শুভ্রতার কারণে তেমন কিছু চোখে পড়ে না তার। তাই ফ্যাকাসে শুভ্রতাটুকু নিজের ভেতরে শুষে নিয়ে, অবিরাম অবিশ্রান্ত দক্ষতায়।
আকাশকে আত্মা দিয়ে ঢেকে পরক্ষণে অনাবৃত করে সারসটি বারবার তার ডানাজোড়া আন্দোলিত করে, আবার স্থির স্ত্মব্ধতার ভেতর নিজেকে লুকিয়ে ফেলে এগিয়ে যায়। নিচে এটা কী দেখা যায়? কোনো লেক? জলাশয়টার তটরেখা কোথায় বিলুপ্ত হয়েছে! নাকি এটা কোনো পর্বতের শৃঙ্গ? আহ্! তার চড়াই-উৎরাই ভরে আছে সূর্যের সোনালি আভা। নিচে বয়ে চলেছে এক উষ্ণ প্রস্রবন। অজস্র ফার্ন, অথবা খসে-পড়া পাখির পালক, অবিরাম খসে-পড়া পালক...
আকাঙ্ক্ষিত সত্য, এবং সত্যের জন্যে তার অধীর অপেক্ষা; জোর করে উচ্চারিত কিছু শব্দ, চিরকালীন কিছু আকাঙ্ক্ষা (বাঁ পাশে কেউ একজন হঠাৎ কেঁদে উঠল, তারপর ডানপাশেও, চাকাগুলো ঘুরতে শুরু করল অনিয়ন্ত্রিত গতিতে আর পুরোনো মোটর-বাসগুলো হলো সংঘর্ষে বিধ্বস্ত, চিরকালের কিছু আকাঙ্ক্ষা (ঘড়িটি দৃঢ়তার সঙ্গে বারোটি পৃথক শব্দে ঘোষণা করল এখন মধ্য-দুপুর, আলো আর ছায়ায় স্বর্ণ-আভা, শিশুরা ঝাঁক বেঁধে দৌড়াচ্ছে), চিরকালীন প্রতীক্ষিত এইসব-ই কি তাহলে সত্য? অট্টালিকাগুলো রক্তলাল; গাছে গাছে ঝুলে আছে পয়সাগুলো; চিমনির কালো ধোঁয়া লেজ গুটিয়ে উড়ছে; ঘেউঘেউ, চিৎকার, ফেরিওলার বাজখাই হাঁক-লোহা কিনবেন, লোহা... এটাই কি তাহলে সত্য?
কালো কিংবা সোনালি আবরণে নারী-পুরুষের পা-গুলোকে উদ্ভাসিত করে দিয়ে (এই কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া কি মধুর? না, ধন্যবাদ; এই কুয়াশা আগামী দিনের ঔপনিবেশিক অন্ধকারের কমনওয়েলথ!), চুল্লির আগুন ছড়িয়ে পড়ে ঘরগুলোকে করে ফেলে লাল, কালো কালো মানব-মূর্তি আর তাদের উজ্জ্বল চোখগুলোকে রক্ষা করার জন্য; হয়ত বাইরে কোথাও তখন ভ্যান থেকে খালাস হচ্ছে মাল। কুমারী থিংগুমি তার চেয়ারে বসে একা একা পান করছে চা, ভাঙা কাচের টুকরোগুলো সে ভরে রাখছে চামড়ার কোটের পকেটে...
জাঁক-জমক, পাতার উজ্জ্বলাভা; সমুদ্রস্রোতে ডুবতে ডুবতে আর ভাসতে ভাসতে এককোণে জড়ো হওয়া, গতির বিপরীতে উড়ে-চলা, রূপালি আলোর হঠাৎ বিচ্ছুরণ, ঘর কিংবা নিরাশ্রয়; সমষ্টি, বিচ্ছিন্নতা, বিভিন্ন মাত্রার অপব্যয়; উপরকে মুছে ফেলা আর নিচকে দলা পাকিয়ে ছিন্নভিন্ন করা; অতঃপর ডুবিয়ে দেয়া-তাহলে এইসবই সম্মিলিতভাবে সত্য?
শ্বেতপাথরের উন্মুক্ত চত্বরে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের পাশে সবকিছুকে জড়ো করা হোক গজদন্তের মতো গভীর তাৎপর্যময় শব্দগুলোর দ্বারা তাদের কালোত্বটুকুকে ঢেলে ফেলা হোক। তাদেরকে আলোয় ফুটিয়ে তোলা হোক। তাদেরকে গাঢ় অন্ত্মর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা হোক। যুদ্ধে নিহত মানুষের ইতিহাস এখানে অগ্নিশিখায় জ্বলজ্বল, প্রতিমুহূর্তেই জীবনের চিহ্ন জ্বেলে সবাই এখন দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায়, নগরীর উন্মুক্ত চত্বরে গলার অলঙ্কারের মতো সবকিছুই দীপ্তিমান, গির্জার চূড়া আর মিনারগুলো এখন অন্তরালে আর নিচে তরঙ্গায়িত ভারত সাগরের জলরাশি, আকাশের শূন্যতা আদিগন্ত নীলে ছেয়ে যায় আর তারকামণ্ডল প্রখর দীপ্তিতে জ্বলতে থাকে; সত্য কি তাই? অথবা, এ সবকিছুই সত্যের নিকটবর্তী?
অলস আর নিঃস্পৃহ সারস পাখিটি তার পরিক্রমা শেষ করে ফিরছে। আকাশ তারাদের মুখোশে লুকিয়ে ফেলেছে তার মুখ, তারপর লুকিয়ে ফেলেছে তারাগুলোকেই।
ভূতুড়ে বাড়ি
যখনই, তুমি ঘুম থেকে জেগে ওঠো, দেখবে যে ঘরের দরোজা খুলে গেছে, তারপর এক ঘর থেকে আরেক ঘরে তারা যাবে; হাতের ভেতর হাত, শূন্যে উড়ছে, মুঠো খুলে যাচ্ছে, নিশ্চিত হচ্ছে যে এরাই ছায়াচ্ছন্ন ভূতুড়ে দম্পতি।
'এটাকে এখানেই ফেলে দেওয়া উচিত', বলল ভূতুড়ে নারীটি এবং সঙ্গে আরো যোগ করল, 'উফ্, কিন্তু এখানে আরো কিছু রয়ে গেছে', 'ওপরের তলায়', সে ফিসফিস করে। পুরুষকণ্ঠ বলে 'এমনকি বাগানের মধ্যেও' এবং সেও ফিসফিস করে, 'চুপিসারে', তারা একসঙ্গে বলে, 'অথবা আমরা তাদের ঘুম ভাঙিয়ে দেব'।
'কিন্তু তুমি আমাদের জাগিয়ে দেয়াটা ঠিক হবে না। উফ্, না', 'তারা এখানেই তাকে খুঁজছে'; 'তারা পর্দার অন্ত্মরাল থেকে দেখছে', কেউ একজন কথাটা অবশ্যই বলবে এবং তাই তারা পাঠ করবে পৃষ্ঠাগুলির একটি বা দুটি। 'এখনই তারা তাকে খুঁজে পাবে', কেউ একজন ব্যাপারটায় নিঃসংশয় হবে। মার্জিনের ওপর চেপে ধরবে পেন্সিল; আর তারপর, পাঠ করতে করতে ক্লান্ত কেউ একজন উঠে দাঁড়াবে এবং দেখবে যে তার জন্য পুরো বাড়িটিই খালি, সবগুলি দরোজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে, কাঠপায়রাগুলি ডাকছে তৃপ্তি সহকারে, খামার থেকে আসছে মাড়াইকলের গুমগুম ডাক। আমি কী করতে এখানে এসেছি? কী খুঁজে পেতে চাই আমি? আমার হাতদুটি খালি। সম্ভবত এটা ওপরতলারও ওপরে, আপেলগুলি ঘাস রাখবার ঘরে এবং আবারো নিচে আরো নিচে, বাগানটি আগের মতোই আছে।
কিন্তু তারা এটাকে খুঁজে পেয়েছে ড্রইংরুমেই। ব্যাপারটা এমন নয় যে কেউ একজন এটাকে দেখতে পেয়েছিল, আর আপেলগুলিও প্রতিবিম্বিত হচ্ছিল জানালার কাচে। প্রতিবিম্বিত হচ্ছিল গোলাপগুলি, জানালার কাচে পাতাগুলি কী অদ্ভুত সবুজ, যদি তারা ড্রইংরুম থেকে চলেই যায়, তাহলে আপেলগুলি ঘুরতে শুরু করবে আর দেখাবে তাদের হলুদিয়া অংশগুলি, এমনও হতে পারে, যদি মুহূর্তকয়েক পর দরোজাটা খুলে দেয়াও হয়, তারা ছড়িয়ে পড়বে মেঝের ওপর, ঝুলে পড়বে দেয়ালে দেয়ালে আর ছাদে,-ঠিক এরকমটাই হবে না? আমার হাত দুটি খালি, একেবারেই খালি। একটা থ্রাস পাখির ছায়া কার্পেট পেরিয়ে গেল। নীরবতার একেবারে গভীর কূপ থেকে বনঘুঘুরা শব্দের বুদ্বুদ তুলছে-'সাবধান, সতর্ক হও, সাবধান... 'নিরাপদ, নিরাপদ', বাড়িটির হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হচ্ছে মৃদুতালে। গুপ্তধন কক্ষটিতেই রাখা। হৃৎস্পন্দন মুহূর্তের জন্য থামে। উফ্, এটাই কি সেই ঘর, গুপ্তধন যেখানে রাখা?
মুহূর্তের ব্যবধানে আলো কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বাগান থেকে দূরে কোথাও? কিন্তু গাছগুলো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ডালপালায় অস্থির ঘূর্ণন তুলেছে, অফুরন্ত সূর্যরশ্মির অপেক্ষা। এত সূক্ষ্ণ আর হালকা যে অলক্ষ্যেই পৃষ্ঠতল ভেদ করে রশ্মিগুলি হারিয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে সবকিছু পুড়ে যাচ্ছে গ্লাসের আড়ালে। এই গ্লাসেই মৃত্যু ছিল, মৃত্যু ছিল আমাদের ভেতরে; সেই প্রথম যেদিন নারী এল, শতশত বৎসর আগে, বাস করেছিল ঘরটিতে, বন্ধ করে দিয়েছিল কপাটগুলি, কক্ষগুলি ঢেকে গিয়েছিল অন্ধকারে, তারপর মৃত্যু নারীটিকে পৃথিবী থেকে পরিত্যক্ত করেছে, পরিত্যক্ত করেছে নিজেকেও, তারপর, চলে গেছে উত্তরে, চলে গেছে পূর্বে, তারাদের অবিরাম আবর্তন সে দেখেছে দক্ষিণাঞ্চলের আকাশে, ঘরটিকে ফের খুঁজতে শুরু করেছে, ভূগোলকের একেবারে নিচের দিকে তাকে খুঁজেও পেয়েছে, 'নিরাপদ, নিরাপদ, নিরাপদ', ঘরটির হৃদয় স্পন্দিত হচ্ছে আনন্দের সঙ্গে, এই সেই গুপ্তধন, যা কেবলমাত্র তোমার।
শো শো বাতাস বইছে এভিনিউ জুড়ে আর বৃক্ষগুলি বারবার বন্ধ করে দিচ্ছে বাতাসের গতিপথ। বৃষ্টিতে চাঁদের আলো বাঁধভাঙা জলের মতো গলে যাচ্ছে, কিন্তু বাতির আলোকরশ্মির ফালি প্রতিফলিত হচ্ছে সোজা জানালা বরাবর। নিঃশেষ হওয়ার প্রচণ্ড জেদ নিয়ে ঝড়ের ভেতর একটানা জ্বলেই যাচ্ছে মোমবাতিটা। বিক্ষিপ্ত এলোমেলো ঘরটির জানালা খুলে দিয়ে ফিসফিস করে আমাদের ঘুম না ভাঙিয়ে, অশরীরী-যুগল তাদের আনন্দকে উপভোগের সুযোগ খুঁজে পায়। নারীটি বলে-এখানেই ঘুমিয়ে পড়ব আমরা; পুরুষটি যোগ করে-চুমু খাবো অগুন্তি আর ভোরে ঘুম ভাঙবে আমাদের...বৃক্ষগুলির মাঝখানে রূপালি ঝিলিক...যখন গ্রীষ্ম আসবে...প্রচণ্ড শৈত্যে তুষারপাতের মধ্যেও...দরোজাগুলি বন্ধ হচ্ছে একে একে, সময়ের দূরত্বের ভেতর ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, মৃদু করাঘাত করছে ঠিক যেন হৃদযন্ত্রের স্পন্দন।
নিকটবর্তী হয়, দরোজার কাছে এসে থামে, বিরতি দেয়, প্রবেশ করে-বাতাস পড়ে এসেছে, বৃষ্টির ফোঁটাগুলি রূপার বিন্দু হয়ে কাচের ওপর আর আমাদের চোখগুলি অন্ধকার, শুনতে পাচ্ছি না আমাদের পাশে কারো পদশব্দ, এমনকি কোনো ভদ্রমহিলাকেও দেখছি না যিনি তার ভূতুড়ে আলখাল্লাটিকে মেলে ধরেছেন। তার হাতগুলি রক্ষা করবে জ্বলন্ত হারিকেন। 'তাকাও' পুরুষটির ফিসফিস। মথিত করে দাও পরস্পরের ঠোঁটগুলি, আমাদের ওপর রূপালি বাতিটি তুলে ধরে, দীর্ঘসময় ধরে নিজেদের তারা দেখে নেয় এবং গভীরে যাত্রা শুরু করে, বাতাস সোজাসুজি বয়ে চলে, শিখাগুলি নিভে যায় ধীরে ধীরে, চাঁদের বুনো রশ্মি মেঝে আর দেয়ালকে ভেদ করে চলে যায় আর একসঙ্গে মিশে যেতে থাকে, রঙের ছোপলাগা মুখ রক্তিম, মুখগুলি মন্থর, পৃথুল, মুখগুলি খুঁজে বেড়াচ্ছে ঘরের ভেতর রক্ষিত গোপন শয্যা এবং নিংড়ে নিতে চাইছে আত্মগোপন করে থাকা আনন্দ।
বাড়িটির হৃদয় আনন্দে স্পন্দিত হয়- নিরাপদ, নিরাপদ, নিরাপদ, সুদীর্ঘ কাল ধরে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আবার আমাকে তুমি খুঁজে পাবে- ফিসফিস করে বলে -এইখানে। এখানেই ঘুমিয়ে থাকবে, এই উদ্যানেই পড়তে থাকবে, হাসতে থাকবে, আপেলগুলি গড়াতে গড়াতে ঘাস রাখবার ঘরে...এখানেই আমরা নিজেদের নিঃশেষ করে সম্পদ ফেলে চলে গেছি। স্থির, নিশ্চল আলো চোখের ঢাকনা সরিয়ে দেয়। 'নিরাপদ, নিরাপদ, নিরাপদ', বাড়িটার হৃৎস্পন্দন বুনো হাওয়ার মতো স্পন্দিত হয়। জেগে ওঠো, আমি আর্তচিৎকার করছি, ওঠো, উফ্, এই কি তোমার চাপা দেয়া সম্পদ? এই তোমার হৃদয়ের জ্যোতির্ময় আলো?
0 মন্তব্যসমূহ