মাসুদুজ্জামান
"আমার প্রেমিকা সে, গভীর প্রেম আমাদের, কিন্তু হঠাৎ করে কোনো এক উঠতি কবির পাল্লায় পড়ে অনূদিত একটা বই তাকে উপহার দেওয়ার পরপরই সে বদলে যেতে থাকল। আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে মজে গেল ওই কবির কপট প্রেমে। বইটা কার, খোঁজ করতেই দেখি, সেটা আপনারই অনূদিত বই- 'কাফকার প্রেম'।" কথাগুলো এই লেখককে জানিয়েছিলেন বোদ্ধা এক পাঠক। এই লেখকের অনূদিত 'কাফকার প্রেম' বইটা ২০১৪ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন পর। আমি আরো জেনেছিলাম, ওদের ত্রিভুজ প্রেমের সম্পর্ক বেশি দিন টেকেনি। না, আমি এতে বিস্মিত হইনি। কাফকার আপাত অনির্দেশ্য জীবনযাপন আর লক্ষ্যহীন প্রেমের প্রভাবেই হয়তো ওদের সম্পর্কে ছেদ পড়ে, যার কিছুটা ছায়া পড়েছে প্রেমিকাদের কাছে লেখা কাফকার অজস্র চিঠিপত্রে।
কাফকা, গত শতাব্দীর এই মহান চেক লেখক, যাঁর পুরো নাম ফ্রানৎস কাফকা, মানবিক সম্পর্ককে ছিঁড়েখুঁড়ে দেখিয়েছেন তাঁর গল্পে। সম্পর্কহীনতার সম্পর্ক তাঁকে কিভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, শুধু তাঁর সৃষ্টিশীল রচনা নয়, ডায়েরি এবং তিন-তিনজন প্রেমিকার কাছে লেখা অজস্র চিঠি থেকে তার হদিস পাওয়া যায় : 'ঘুমাতে পারছি না, মানুষের সঙ্গে সামান্যতম সম্পর্ক নেই, শুধু তারা উদ্বেগের সঙ্গে যা সৃষ্টি করছে সেটুকু ছাড়া, যা সেই মুহূর্তের জন্য আমাকে তাড়া করে, যেমনটি তাদের সব কৃতকর্মই করে থাকে।' মানবিক সম্পর্কের শূন্য, নিষ্করুণ, অসার অভিজ্ঞানই ছিল কাফকার অন্বিষ্ট। থাকার মধ্যেই না থাকাকেই প্রবলভাবে ছুঁতে চেয়েছেন তিনি।
মানুষ কি পতঙ্গতুল্য, এই পৃথিবী কি কারাগার? পতঙ্গই হই বা পৃথিবীটা বিচারহীন কারাগার হয়ে উঠুক, শরীরকে ঘিরেই অমানবিকতার শৃঙ্খলে আটকে যায় মানুষ। মনে পড়ছে, ফুকোই বলেছিলেন এ রকম একটা কথা। জোসেফ কে-র নামে নিশ্চয়ই কেউ অপবাদ ছড়িয়েছে, তাই কোনো দোষ না থাকা সত্ত্বেও এক সকালবেলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। সে অভিযুক্ত। কিন্তু সে কারণ জানে না। আত্মরক্ষা করতে চায়, কিন্তু জানে না কেন। উকিলরা তার মামলাটা কঠিন মনে করে। তার ভালোবাসা, খাওয়াদাওয়া, কাগজ পড়া- কোনো কিছুই বন্ধ থাকে না। তারপর তার বিচার হয়। কিন্তু আদালতে অন্ধকার, সে বিশেষ কিছুই বোঝে না। শুধু ধরে নেয় সে অভিযুক্ত। ব্যাপারটা বিরক্তিকর, হাস্যকর। কিন্তু আইনি জটে আটকে যায় সে। যতই আইনের ভেতরে ঢুকতে থাকে ততই যুক্তির নিরিখে মুক্তি পাওয়ার ব্যাপারটা সহজ হলেও ক্রমেই তা কঠিন হয়ে পড়ে। দুজন লোক এসে একটা পাথরের ওপর তার মাথাটা রেখে গলা কেটে দেয়। মৃত্যুর আগে অভিযুক্ত মানুষটি শুধু বলে কুকুরের মতো।
কোর্টের এই যে অর্থহীন দণ্ডাদেশ, ভীতি ও বিদ্রূপ, অলীকতা আর বাস্তবতা, সম্ভব-অসম্ভবের এক জগৎ, একান্তভাবেই যা কাফকীয়, বধ্যভূমির মতো নিরেট, কঠিন। আধুনিক মানুষ আসলে এ রকমই নামহীন পীড়িত সত্তার মতো, অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও অনস্তিত্বের শঙ্কাই তাকে মানবিক করে তোলে। জোসেফ কে-র সম্পূর্ণ নামটি কি আমাদের জানাননি কাফকা। শুধু কে নামটির মধ্যে এমন একজন মানুষকে তিনি আভাসিত করে দিয়েছেন, যার অস্তিত্ব অনেকটাই বিমূর্ত, অনির্দেশ্য। উনামুনো এ জন্যই জোসেফ কে সম্পর্কে বলেছেন, সে রক্ত-মাংসের মানুষ নয়, বাস্তব মানুষের বিমূর্ত রূপ। আশ্চর্য রকমের বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করে। বিচ্ছিন্নতার আবার দ্বিমুখী রূপ আছে : গোপন ও প্রকাশ্য, ব্যক্তিগত ও সর্বজনীন। আসলে মানুষ এভাবেই দুই পৃথিবীতে বাস করে।
কিন্তু বিচারব্যবস্থার করুণ পরিণতি আর অসারতা যখন জোসেফ কে-র কাছে স্পষ্ট হতে থাকে তখনই তাঁর মনে পড়ে, 'তার মুক্তির সপক্ষে কোনো যুক্তি কি চোখ এড়িয়ে গেছে? নিশ্চয়ই তা-ই হবে।' 'বিচার' উপন্যাসটিতে এই যে তলিয়ে যাওয়া একটা মানুষ, বেঁচে থাকার খড়কুটো খুঁজে পায়। ফলে কাফকা এটাই দেখাতে চেয়েছেন যে একদিকে নিস্তরঙ্গ জীবন এবং অন্যদিকে অনির্দেশ্য পৃথিবী- এই দুইয়ের মধ্যেই মানুষ আবর্তিত হয়। কাফকার লেখায় কামু নিজের অস্তিত্ববাদী অ্যাবসার্ড দর্শনের শিকড় এভাবেই খুঁজে পেয়েছিলেন। কাফকাও কি ঢুকে পড়েননি তাঁর চরিত্রের মধ্যে? কামুই তো বলছেন, 'বিচার উপন্যাসের নায়কের নাম হতে পারত স্কিমিড বা ফ্রানৎস কাফকা। কিন্তু তার নাম দেওয়া হয়েছে জোসেফ কে। সে কাফকা না হয়েও কাফকা। সে একজন গড়পড়তা ইউরোপীয়।'
কাফকার চিঠিতে একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, সময় সম্পর্কে সহজ সমীকরণের মধ্য দিয়ে আধুনিক মানুষকে তিনি তার আখ্যানে তুলে আনেননি। তাঁর গল্পে যে মানুষদের পাই তারা জটিল বিপন্ন একটা সময়কে অতিক্রম করছে, আসন্ন নাৎসি হলোকাস্ট কিংবা বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতা যাদের অচিরেই আক্রান্ত করবে।
ব্যক্তিজীবনেও পরম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দুরারোগ্য ব্যাধির কবলে পড়ে জীবনান্তিকে পৌঁছে যাবেন তিনি। ফেলিস বাউয়ার, যাঁর প্রেমে নিমজ্জিত ছিলেন প্রায় পাঁচ বছর, দুবার যাঁর সঙ্গে বাগদান হয়েছিল, তাঁকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। ফেলিসের পর প্রেমে জড়িয়েছিলেন আরো দুই রমণীর সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে দীর্ঘ পত্রালাপ হয়েছে; কিন্তু বিয়ে করেননি কাউকেই। সংসারী হওয়ার জন্য যে স্থৈর্যের প্রয়োজন হয়, সে রকম শান্ত সমাহিত মনের অধিকারী ছিলেন না কাফকা। কিন্তু জীবনের শেষে, সেকালে যক্ষ্মার মতো দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত হলে তাঁকে পরম মমতায় আশ্রয় দিয়েছিলেন এক করুণাময়ী নারী- ডোরা ডায়মন্ট। ডোরা আর কাফকার স্বপ্ন ছিল যৌথ জীবনযাপনের; কিন্তু কাফকার মৃত্যু যবনিকাপাত ঘটায় এক মহান লেখকের।
সরল নয়, বিসর্পিল পথে মানবিক বোধ আর উৎক্রান্তির কথাই বলে গেছেন কাফকা। উইল করে বলে রেখেছিলেন, মৃত্যুর পর তাঁর সব লেখা যেন পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু বন্ধু ম্যাক্স ব্রড কিংবা প্রেমিকা ফেলিস তাঁর কাছে লেখা চিঠিগুলো সযত্নে রক্ষা করেছেন। বার্লিনে থাকতেন ফেলিস, পরে বার্লিন থেকে সুইজারল্যান্ড এবং সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত তাঁকে লেখা কাফকার সব চিঠি বয়ে নিয়ে গেছেন। মৃত্যুর অল্প আগে প্রকাশের জন্য তুলে দিয়েছেন প্রকাশকের হাতে। ফেলিসের কারণেই কাফকার অনেক কথাই আজ আর অজানা নেই আমাদের। কাফকাও জানতেন, অসুস্থতার কারণে তাঁর জীবন খুব দীর্ঘায়িত হবে না, একটা গল্পে কোনো একটা চরিত্রের কথা বলতে গিয়ে লিখেছিলেন নিজেরই কথা : 'ডানে বাঁয়ে কোনো দিকে আমার নিস্তার নেই- সোজা সামনে শুধু, ক্ষুধার্ত পশু, ওখানেই আছে আহার্যের দিককার রাস্তা, যা তোমাকে টিকিয়ে রাখবে; বাতাস, যাতে তুমি নিঃশ্বাস নিতে পারো, মুক্ত এক জীবন, এমনকি তা যদি তোমাকে জীবনের সীমান্ত পার করে নিয়ে যায় খুঁজে পাবে তাও।'
মাত্র ৪০ বছর বেঁচে ছিলেন কাফকা; কিন্তু মৃত্যু-পরবর্তী প্রায় ৯০ বছর ধরে দেশে দেশে আজও বিশ্বনন্দিত মহান এক আধুনিক লেখক হিসেবে সমাদৃত হয়ে আসছেন তিনি।
"আমার প্রেমিকা সে, গভীর প্রেম আমাদের, কিন্তু হঠাৎ করে কোনো এক উঠতি কবির পাল্লায় পড়ে অনূদিত একটা বই তাকে উপহার দেওয়ার পরপরই সে বদলে যেতে থাকল। আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে মজে গেল ওই কবির কপট প্রেমে। বইটা কার, খোঁজ করতেই দেখি, সেটা আপনারই অনূদিত বই- 'কাফকার প্রেম'।" কথাগুলো এই লেখককে জানিয়েছিলেন বোদ্ধা এক পাঠক। এই লেখকের অনূদিত 'কাফকার প্রেম' বইটা ২০১৪ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন পর। আমি আরো জেনেছিলাম, ওদের ত্রিভুজ প্রেমের সম্পর্ক বেশি দিন টেকেনি। না, আমি এতে বিস্মিত হইনি। কাফকার আপাত অনির্দেশ্য জীবনযাপন আর লক্ষ্যহীন প্রেমের প্রভাবেই হয়তো ওদের সম্পর্কে ছেদ পড়ে, যার কিছুটা ছায়া পড়েছে প্রেমিকাদের কাছে লেখা কাফকার অজস্র চিঠিপত্রে।
কাফকা, গত শতাব্দীর এই মহান চেক লেখক, যাঁর পুরো নাম ফ্রানৎস কাফকা, মানবিক সম্পর্ককে ছিঁড়েখুঁড়ে দেখিয়েছেন তাঁর গল্পে। সম্পর্কহীনতার সম্পর্ক তাঁকে কিভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, শুধু তাঁর সৃষ্টিশীল রচনা নয়, ডায়েরি এবং তিন-তিনজন প্রেমিকার কাছে লেখা অজস্র চিঠি থেকে তার হদিস পাওয়া যায় : 'ঘুমাতে পারছি না, মানুষের সঙ্গে সামান্যতম সম্পর্ক নেই, শুধু তারা উদ্বেগের সঙ্গে যা সৃষ্টি করছে সেটুকু ছাড়া, যা সেই মুহূর্তের জন্য আমাকে তাড়া করে, যেমনটি তাদের সব কৃতকর্মই করে থাকে।' মানবিক সম্পর্কের শূন্য, নিষ্করুণ, অসার অভিজ্ঞানই ছিল কাফকার অন্বিষ্ট। থাকার মধ্যেই না থাকাকেই প্রবলভাবে ছুঁতে চেয়েছেন তিনি।
মানুষ কি পতঙ্গতুল্য, এই পৃথিবী কি কারাগার? পতঙ্গই হই বা পৃথিবীটা বিচারহীন কারাগার হয়ে উঠুক, শরীরকে ঘিরেই অমানবিকতার শৃঙ্খলে আটকে যায় মানুষ। মনে পড়ছে, ফুকোই বলেছিলেন এ রকম একটা কথা। জোসেফ কে-র নামে নিশ্চয়ই কেউ অপবাদ ছড়িয়েছে, তাই কোনো দোষ না থাকা সত্ত্বেও এক সকালবেলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। সে অভিযুক্ত। কিন্তু সে কারণ জানে না। আত্মরক্ষা করতে চায়, কিন্তু জানে না কেন। উকিলরা তার মামলাটা কঠিন মনে করে। তার ভালোবাসা, খাওয়াদাওয়া, কাগজ পড়া- কোনো কিছুই বন্ধ থাকে না। তারপর তার বিচার হয়। কিন্তু আদালতে অন্ধকার, সে বিশেষ কিছুই বোঝে না। শুধু ধরে নেয় সে অভিযুক্ত। ব্যাপারটা বিরক্তিকর, হাস্যকর। কিন্তু আইনি জটে আটকে যায় সে। যতই আইনের ভেতরে ঢুকতে থাকে ততই যুক্তির নিরিখে মুক্তি পাওয়ার ব্যাপারটা সহজ হলেও ক্রমেই তা কঠিন হয়ে পড়ে। দুজন লোক এসে একটা পাথরের ওপর তার মাথাটা রেখে গলা কেটে দেয়। মৃত্যুর আগে অভিযুক্ত মানুষটি শুধু বলে কুকুরের মতো।
কোর্টের এই যে অর্থহীন দণ্ডাদেশ, ভীতি ও বিদ্রূপ, অলীকতা আর বাস্তবতা, সম্ভব-অসম্ভবের এক জগৎ, একান্তভাবেই যা কাফকীয়, বধ্যভূমির মতো নিরেট, কঠিন। আধুনিক মানুষ আসলে এ রকমই নামহীন পীড়িত সত্তার মতো, অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও অনস্তিত্বের শঙ্কাই তাকে মানবিক করে তোলে। জোসেফ কে-র সম্পূর্ণ নামটি কি আমাদের জানাননি কাফকা। শুধু কে নামটির মধ্যে এমন একজন মানুষকে তিনি আভাসিত করে দিয়েছেন, যার অস্তিত্ব অনেকটাই বিমূর্ত, অনির্দেশ্য। উনামুনো এ জন্যই জোসেফ কে সম্পর্কে বলেছেন, সে রক্ত-মাংসের মানুষ নয়, বাস্তব মানুষের বিমূর্ত রূপ। আশ্চর্য রকমের বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করে। বিচ্ছিন্নতার আবার দ্বিমুখী রূপ আছে : গোপন ও প্রকাশ্য, ব্যক্তিগত ও সর্বজনীন। আসলে মানুষ এভাবেই দুই পৃথিবীতে বাস করে।
কিন্তু বিচারব্যবস্থার করুণ পরিণতি আর অসারতা যখন জোসেফ কে-র কাছে স্পষ্ট হতে থাকে তখনই তাঁর মনে পড়ে, 'তার মুক্তির সপক্ষে কোনো যুক্তি কি চোখ এড়িয়ে গেছে? নিশ্চয়ই তা-ই হবে।' 'বিচার' উপন্যাসটিতে এই যে তলিয়ে যাওয়া একটা মানুষ, বেঁচে থাকার খড়কুটো খুঁজে পায়। ফলে কাফকা এটাই দেখাতে চেয়েছেন যে একদিকে নিস্তরঙ্গ জীবন এবং অন্যদিকে অনির্দেশ্য পৃথিবী- এই দুইয়ের মধ্যেই মানুষ আবর্তিত হয়। কাফকার লেখায় কামু নিজের অস্তিত্ববাদী অ্যাবসার্ড দর্শনের শিকড় এভাবেই খুঁজে পেয়েছিলেন। কাফকাও কি ঢুকে পড়েননি তাঁর চরিত্রের মধ্যে? কামুই তো বলছেন, 'বিচার উপন্যাসের নায়কের নাম হতে পারত স্কিমিড বা ফ্রানৎস কাফকা। কিন্তু তার নাম দেওয়া হয়েছে জোসেফ কে। সে কাফকা না হয়েও কাফকা। সে একজন গড়পড়তা ইউরোপীয়।'
কাফকার চিঠিতে একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, সময় সম্পর্কে সহজ সমীকরণের মধ্য দিয়ে আধুনিক মানুষকে তিনি তার আখ্যানে তুলে আনেননি। তাঁর গল্পে যে মানুষদের পাই তারা জটিল বিপন্ন একটা সময়কে অতিক্রম করছে, আসন্ন নাৎসি হলোকাস্ট কিংবা বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতা যাদের অচিরেই আক্রান্ত করবে।
ব্যক্তিজীবনেও পরম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দুরারোগ্য ব্যাধির কবলে পড়ে জীবনান্তিকে পৌঁছে যাবেন তিনি। ফেলিস বাউয়ার, যাঁর প্রেমে নিমজ্জিত ছিলেন প্রায় পাঁচ বছর, দুবার যাঁর সঙ্গে বাগদান হয়েছিল, তাঁকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। ফেলিসের পর প্রেমে জড়িয়েছিলেন আরো দুই রমণীর সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে দীর্ঘ পত্রালাপ হয়েছে; কিন্তু বিয়ে করেননি কাউকেই। সংসারী হওয়ার জন্য যে স্থৈর্যের প্রয়োজন হয়, সে রকম শান্ত সমাহিত মনের অধিকারী ছিলেন না কাফকা। কিন্তু জীবনের শেষে, সেকালে যক্ষ্মার মতো দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত হলে তাঁকে পরম মমতায় আশ্রয় দিয়েছিলেন এক করুণাময়ী নারী- ডোরা ডায়মন্ট। ডোরা আর কাফকার স্বপ্ন ছিল যৌথ জীবনযাপনের; কিন্তু কাফকার মৃত্যু যবনিকাপাত ঘটায় এক মহান লেখকের।
সরল নয়, বিসর্পিল পথে মানবিক বোধ আর উৎক্রান্তির কথাই বলে গেছেন কাফকা। উইল করে বলে রেখেছিলেন, মৃত্যুর পর তাঁর সব লেখা যেন পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু বন্ধু ম্যাক্স ব্রড কিংবা প্রেমিকা ফেলিস তাঁর কাছে লেখা চিঠিগুলো সযত্নে রক্ষা করেছেন। বার্লিনে থাকতেন ফেলিস, পরে বার্লিন থেকে সুইজারল্যান্ড এবং সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত তাঁকে লেখা কাফকার সব চিঠি বয়ে নিয়ে গেছেন। মৃত্যুর অল্প আগে প্রকাশের জন্য তুলে দিয়েছেন প্রকাশকের হাতে। ফেলিসের কারণেই কাফকার অনেক কথাই আজ আর অজানা নেই আমাদের। কাফকাও জানতেন, অসুস্থতার কারণে তাঁর জীবন খুব দীর্ঘায়িত হবে না, একটা গল্পে কোনো একটা চরিত্রের কথা বলতে গিয়ে লিখেছিলেন নিজেরই কথা : 'ডানে বাঁয়ে কোনো দিকে আমার নিস্তার নেই- সোজা সামনে শুধু, ক্ষুধার্ত পশু, ওখানেই আছে আহার্যের দিককার রাস্তা, যা তোমাকে টিকিয়ে রাখবে; বাতাস, যাতে তুমি নিঃশ্বাস নিতে পারো, মুক্ত এক জীবন, এমনকি তা যদি তোমাকে জীবনের সীমান্ত পার করে নিয়ে যায় খুঁজে পাবে তাও।'
মাত্র ৪০ বছর বেঁচে ছিলেন কাফকা; কিন্তু মৃত্যু-পরবর্তী প্রায় ৯০ বছর ধরে দেশে দেশে আজও বিশ্বনন্দিত মহান এক আধুনিক লেখক হিসেবে সমাদৃত হয়ে আসছেন তিনি।
0 মন্তব্যসমূহ