আমার মা

অনুবাদ গল্প

"আমার মা”!

জুদা ওয়াটেন (১৯১১-১৯৮৫, অস্ট্রেলিয়া)
অনুবাদ : সুদর্শনা রহমান


সেই ছোট্ট বেলা থেকেই লক্ষ্য করে আসছি আমার সব কিছুর প্রতিই মায়ের নজর বড় তীক্ষ্ণ। মায়ের চাওনি যেন আমার অন্তর আত্মাকে করে বিদ্ধ করে দিত। একটি শব্দও উচ্চারণ না করে মা এমন করে অপলক চেয়ে থাকতেন যে, ভিতরে ভিতরে রীতিমত আমি শিউরে উঠতাম। মাটিতে নজর গেথে অপরাধীর মতো মনে মনে তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফিরতাম আজ আমার দৈনন্দিন কাজের তালিকায় কিছু কি গাফিলতি হয়েছে?


কিন্তু, খানিকটা বুদ্ধি হবার পর থেকে বুঝে গেছিলাম নূতন দেশে এসে মা, আমার বোন আর আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে এত বেশী চিন্তিত থাকতেন যে, অন্য কোনো দিকে নজর দেবার তাঁর আর ফুরসৎই ছিল না। প্রতিনিয়ত জীবন সংগ্রাম ঘিরে তাঁর যে সংঘর্ষ তা তাঁকে মোটেও সুস্থির থাকতে দিতো না এই পরাভূমে। এদেশে নিজেকে সব সময় একজন অতিথি বলেই মনে করতন। নূতন দেশের বৈচিত্র্যময় জীবন আমাকে এতটা অভিভূত করে ফেলেছিল আমি যেন তাতে মায়ের কাছ থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। আসলে সত্যিই কি আমি দূরে সরে গিয়েছিলাম? নাকি শুধু মায়েরই তা মনে হতো আর, তাই ভেবে মা যেন বেশ দুঃখও অনুভব করতেন।

মায়ের কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল না, যার সাথে মা তাঁর মনের সুখ, দুঃখ, চিন্তা,ভাবনা গুলো ভাগাভাগি করে নিতে পারতেন। কিংবা মার যেন তেমন কাউকে প্রয়োজনও ছিল না, যদিও মা আমাকে প্রচণ্ড ভালবাসতেন তবুও আমাদের মা পুত্রের মাঝেও এমন সম্পর্ক কক্ষনো গড়ে ওঠেনি। নিজের জীবন যাত্রা এবং জীবন দর্শন সম্পর্কে মা এমন আত্মপ্রত্যয় ছিলেন যে সেখান থেকে তাঁকে নড়ায় এমন সাধ্যি কার? তাঁর ছিল একটাই কথা, ‘নিজের মনোবলকে দৃঢ় রাখ অন্যের সামনে, এক ঈশ্বর ছাড়া আর কারো কাছে মাথা নোয়াবে না!’ এমন কি আমার বাবার সামনেও তিনি এই মতবাদে অটল থাকতেন সব সময়। মায়ের এই অদ্ভুত আর একগুঁয়েমি মনোভাবের জন্যই শহরের এই কোণটিতে আর যে সব পরিবার ছিল যারা মায়ের মতো একই দেশ থেকে এসেছিল তাঁদের সাথেও মায়ের কোনো সখ্যতা ছিল না। যদিও অন্যদের সাথে মায়ের আচরণ ছিল খুবই বিনম্র, এতো মৃদু স্বরে মা লোকেদের সাথে কথা বলতেন যেন মনে হতো তাঁর মন এখানে নয় দূরে অন্য কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে। মা যেন এখানে থেকেও নেই, তাঁর শরীর যেন যান্ত্রিক ভাবে কাজ করছে। মায়ের চেহারায় সব সময় ফুটে উঠতো ইস্পাত কঠিন ধাতব ভাব। তাঁর ছিপ,ছিপে কিন্তু মজবুত দেহ, বিষণ্ণ মুখ, ঘন বাদামী কালো চোখের তারায় আর কুঁচকুঁচে কালো চুল ঘিরে থাকতো কবরস্থানের মতো মৃত শীতল স্নিগ্ধতা!

আমার বাবা আর মায়ের স্বভাব চরিত্রের মাঝে যে বিস্তর ফরাক তা ছোট্ট কালেই আমি বুঝে গেছিলাম। বাবা ছিলেন ভারী হাসিখুশী আর প্রানবন্ত মানুষ, বুড়ো কিবা কাঁচাকুঁচো সবার সাথেই সহজে মিশে যেতেন, গল্পে আনন্দে সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। আমার মা ছিলেন বাবার চাইতে বয়সে অনেক বড়, প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি ছিল তাঁর বয়স যদিও, দেখাতো তার চাইতে আরও ঢের বেশী। সময়ের সাথে একটু খানি বদলালেও মার বয়স যেন একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল অনেক বসর, তারপর আবার হঠাৎ করেই একেবারে বুড়িয়ে গিয়ে জুবুথুবু অবস্থা শেষের দিকে। মায়ের আসল বয়স নিয়ে আমার কৌতূহলের সীমা ছিল না। আমাদের পরিবারের কারো জন্মদিন পালন করবার রেওয়াজ ছিল না, তাই আমাদের বাড়িতে কক্ষনো মোম জ্বালিয়ে কেক কাটা বা উপহার দেয়া হতো না কাউকে। পাড়ার বন্ধু বা প্রতিবেশীরা যখন তাদের জন্ম উৎসব নিয়ে অহংকার ভরে গর্ব করতো, আমি আমার মায়ের কাছ থেকে শেখা প্রবচন ঝাড়তাম, ‘এ ধরণের আদিখ্যেতা শুধু গাধাদেরই সাজে!’ মা বলতেন, ‘এও এক ধরণের আত্মপ্রবঞ্চনা, বসরের প্রতিটা মাসই তো গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে, কেনরে বাপু বসরের একটা মাত্র দিন নিয়ে এতো হ্যাংলামি। কতো বয়স হলো তাই নিয়ে এমন বাড়াবাড়ি করবারই বা কি আছে?’ মায়ের একথা গুলোও আমি তোতা পাখির মতো আউরে যেতাম তাই বলে, মায়ের আসল বয়স জানবার ইচ্ছে কিন্তু মোটেই কমে যায়নি কক্ষনো। জিজ্ঞেস করতেই মা তীক্ষ্ণস্বরে জবাব দিয়েছিলেন, ‘ দিব্যি জলজ্যান্ত তোমাদের চোখের সামনে রয়েছি তাতেই কি প্রমান হয় না যে, একদিন আমি জন্মে ছিলাম।’ ব্যাস, তারপর আর কোনো দিন তাঁকে জিজ্ঞেস করবার মতো সাহস আমার হয়নি।

সবদিক দিয়ে মা ছিলেন আমার পরিচিত অন্য মহিলাদের থেকে এক্কেবারে আলাদা। পাড়ার মহিলাদের পরিচ্ছন্ন ঘরদোর, সুন্দর করে সাজানো আসবাব রীতিমত একে অন্যের মনে ঈর্ষা সৃষ্টি করতো। কিন্তু, আমার মায়ের কাছে এসবের একেবারে তুচ্ছাতুচ্ছিত বিষয় ছিল। আমাদের বাড়ি দেখলে যে কারোই মনে হতে পারে, এই মাত্র কিছুদিন হলে আমরা বোধহয় এখানে এসেছি। অথবা, খুব শীঘ্রই এ বাড়ি বদলে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছি। বাবা ঠাট্টা করে বলতেন, ‘ঠিক যেন এক ঠেঙ্গে পাখীর দশা, এই উড়াল দিল বলে!’

যে বাড়িতেই আমরা বসবাস করিনা কেন সব গুলোর দশা হত প্রায় একই রকম, প্যাকিং বক্স গুলোর অর্ধেক খোলাই হত না। ঘরের এক কোনে ঠেশ দেয়া এক রোল মেঝেতে বেছানোর শতরঞ্জি যেমন রাখা ছিল তেমনি রইতো বিছানোর প্রয়োজন মনে হত না মায়ের। মাত্র কয়েকটি জানালা ভাগ্যে পর্দা জুটতো বাকি সব উদোম। সব বাড়িতেই কাপড় রাখবার আলমিরা মায়ের মনে হত প্রয়োজনের তুলানয় অপ্রতুল তাই, দরজার আড়ালে হুকের মাথায় ঝুলে থাকতো গুচ্ছের কাপড়। নোংরা, শত ছিন্ন জঞ্জালও মা কক্ষনো ফেলে দিতেন না ফলে, জমে জমে তা বিশাল স্তূপে পরিণত হত। উত্তারিধকারসূত্রে আমার নানীর কাছ থেকে মা একটা পুরানো সবজেটে রঙের কোট পেয়েছিলেন ওটা সব সময় মায়ের শোবার ঘরের দেয়ালে ঝুলতে দেখা যেত। আদ্যিকালের পুরানো খবরের কাগজ, বিবর্ণ পত্রপত্রিকা, ছেঁড়াখোঁড়া বই অগোছালো ভাবে বাড়ির কোনে জমানো। ওতে শ্যাওলা পড়ে গিয়েছিল, ক্যামন যেন একটা পুঁতি গন্ধ ছড়াতো ওখান থেকে। সে দিকে মায়ের কোনো ভ্রুক্ষেপই ছিল না। খাটের নীচে কয়েকটা পুরানো টিনের তোরঙে রাখা থাকতো মায়ের সব চেয়ে প্রিয় জিনিস গুলো। ওগুলোকে মা যক্ষের ধনের মত আগলে রাখতেন। ওতে ছিল বান্ডিল, বান্ডিল পুরানো চিঠি। নার্সিঙের উপর দুটো বই এমন ভাবে তার প্রতিটা লাইন কলমের কালি দিয়ে এমন ভাবে দাগানো যে তা পাঠোদ্ধার করে সাধ্যি কার। ছিল হলদেটে হয়ে যাওয়া মায়ের ডিপ্লোমা ডিগ্রীর সার্টিফিকেট, একখানা বহু পুরানো হিব্রু ভাষায় লেখা বাইবেল। মায়ের যে খালার বাড়িতে ছোট বেলায় মা আশ্রিত ছিলেন তাঁর দেয়া তিনটে রুপার চামুচ। আরও ছিল মায়ের পছন্দের কিছু বই!

যে কোনো একটা তোরঙ থেকে একটা বই বেছে নিয়ে আমাদের দু’ভাই বোনকে প্রায়ই মা পড়ে শোনাতেন। মোজেজ যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান যুগের ইহুদীদের বীরগাথা, ১৯০৫ সনের বিপ্লব, মাক্সিম গোকীর্, টলষ্টয় আর সোলম অ্যালিচেমের গল্প, কবিতা মা হৃষ্টচিত্তে পড়ে যেতেন। আমরা ক্ষুদে দুটি ভাইবোনে তা আদৌ কিছু বুঝতাম কিনা ও নিয়ে মায়ের কোনো হেলদোল ছিল না। তিনি বলতেন, ‘এখন না বুঝলেও পরে বুঝতে পারবে।’ মায়ের পড়াবার ঢঙ্গটা আমারও খুব ভাল লাগতো কিন্তু, প্রতি দিনই এমন সময় তিনি বেছে নিতেন যখন হয় আমি অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত বা পাড়ার ছেলেদের সাথে হল্লাগুল্লা করছি। হয়তো আমারা ছেলেদের দল ফুটবল পেটাচ্ছি, নয়তো বা লাটিমের প্যাঁচ কষছি, কিবা ঘুড়ি উড়াচ্ছি ঠিক এমন সময় গুলোতেই মা ধুমকেতুর মতো উদয় হতেন। আশেপাশের কারো তোয়াক্কা না করেই মা হুকুমজারী করতেন, ‘ভেতরে এস তোমরা ভাই বোনে, ঢের হয়েছে দূরান্তপনা। এখন লক্ষ্মী ছেলে মেয়ের মতো বই পড়া শোনো।’ আমি ঠ্যাঁটার মতো দাঁড়িয়ে থাকতাম কিন্তু, তাতে মায়ের ভারী বয়েই যেতো। একনাগাড়ে মা ডেকেই যেতেন, যতক্ষণ না আমি খেলা ফেলে ঘরে ঢুকতাম। পাড়ার ছেলে মেয়েদের টিটকারীতে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যেত, আগুনে লাল হয়ে উঠতো আমার গাল দুটো। কিন্তু, মা যেমন আমার একরোখা মনোভাব নিয়ে কক্ষনো বকাঝকা করেননি তেমন, পাড়ার ছেলে মেয়েরা যে আমায় এমন হেনস্থা করতো তা নিয়েও উচ্চবাচ্য করেননি।

বহু বসর পরে আমি বুঝতে পেড়েছিলাম কেন আমার মা এমন ছিলেন। এমন কি মায়ের শিশুকালটা সম্পর্কে ধরনা করাও আমার জন্য তেমন কঠিন ছিল না। অত্যন্ত ধর্ম্যভীরু আচারনিষ্ঠ ইহুদী পিতা আর বসর বসর সন্তান প্রসবে ক্লান্ত সূতিকা রোগাগ্রস্থ মায়ের কনিষ্ঠা কন্যা সন্তান ছিলেন আমার মা। রাশিয়ার একটা প্রত্যন্ত গ্রামে সামান্য এক গরীব দিনমজুর ছিলেন মায়ের বাবা। এক দংগল মেয়ের বাবা হওয়াতে আমার নানা তাঁর কন্যাদের প্রতি এমন বিমুখ ছিলেন যে আমার মাও যে তাঁর আর একটি সন্তান তা যেন মনেও থাকতো না। বড় বোনদের কাছে অত্যন্ত হেলাফেলায় পালিত হয়েছিলেন মা শিশু কালে। ঘরের বাইরে যাবার সুযোগ বলতে গেলে মায়ের ভাগ্যে জোটেইনি। ভাবতেও অবাক লাগে আমার মা ছোট বেলায় কক্ষনো গাছ, ফুল, লতাপাতা বা পশু, পাখী দেখেনি। মাটির তলায় যে অন্ধ কূপের মতো বাড়িতে মা থাকতেন ওটার লোহার গ্রিলে ঘেরা জানালা দিয়ে শুধু পথচারীদের চলন্ত পা আর জুতো গুলোই শুধু দেখা যেত।

আমার নানা নানীর মৃত্যু হয় তখন মায়ের বয়স প্রায় পনের বসর। মায়ের আশ্রয় জুটলো বিধবা খালার বিরাট পরিবারে, অনেক দূরে অন্য এক গ্রামে। মায়ের খালা ছিলেন সরাইখানার মালিক। খদ্দের কুনজর থেকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য মাকে রাখা হতো তাঁর খালাতো বোনদের সাথে বিশাল বাড়ির আরেক কোনে। দিনান্তে ক্বচিৎকদাচিৎ মায়ের সাথে মায়ের খালার দেখা হতো ফলে, তাঁর সাথেও মায়ের কোনো হৃদ্যতা গড়ে ওঠেনি। বরং খালা মায়ের প্রতি বিরক্তই থাকতেন সব সময় এবং তা লুকাবার চেষ্টাও তিনি করতেন না। প্রায়ই তিনি তিক্ত গলায় বলতেন, ‘তোকে নিয়ে আমার হয়েছে এক মহা জ্বালা, আমার নিজেরই ভেড়ার পালের মতো গাদা খানেক মেয়ে। ওগুলোর বিয়ের যৌতুক জোটাতেই আমার ফতুর হতে হবে। তোর মাবাপ তো ক্ষুদকুঁড়োটিও সাথে দেয়নি তোর, কি দিয়ে তোকে পার করি বলতো?’

সে সময়ে মায়ের অক্ষর পরিচয় ছিল না, এমন কি ছিল না কোনো খেলারসাথী বা বন্ধু, বান্ধব। তাই মা এও জানতো না যে, কি করে সমবয়সী খালাতো ভাই বোনদের গল্প করতে হয় অথবা কি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়। দিনের বেশীর ভাগ সময়ই মায়ের কাটতো রান্না ঘরের হাঁড়িকুঁড়ি নাড়াচাড়া করে অথবা অন্ধকার ঘরের কোনে চুপচাপ বসে। মায়ের দূর সম্পর্কীয় এক আত্মীয় ব্যাপারটা লক্ষ্য করেন একদিন। তিনি দয়াপরবেশ হয়ে একাকী এই মেয়েটিকে লেখা পড়া শেখাতে লাগলেন। অল্প কিছু দিনের ভেতরেই মা ইদ্দিস আর রাশিয়ান দুটো ভাষা পড়তে শিখে যান, সেই সাথে খানিকটা গণিতও শেখেন তবে, রাশিয়ান আর ইহুদী গল্প বইয়ের পোকা হয়ে ওঠেন।

লেখা পড়া শিখবার সুযোগ পেয়ে যেন মায়ের চোখের সামনে নূতন দুয়ার খুলে যায়। একনিষ্ঠ ভাবে মা পড়ালেখায় মন দেন আর, খুব তাড়াতাড়িই প্রাথমিক পাঠ্যবই, ব্যকরণ, পাটিগণিত আর গল্পের বইয়ের ভক্ত হয়ে ওঠেন। মায়ের মন বলে ওঠে এই লেখা পড়াই একমাত্র পথ যা মাকে মুক্তি দিতে পারে এই বিভীষিকাময় জগত থেকে। এই পৃথিবীর বাইরেও আরেকটা উষ্ণ আলোঝলমলে দুনিয়া আছে, যে করেই হোক সেখানে পৌঁছাতে হবে তাঁকে। মায়ের ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠলো যে করেই হোক এই অন্ধকূপ থেকে তাঁকে বের হয়ে তাঁর স্বপ্নের জগতে পৌঁছাতে হবে।

কার কাছে যেন মা একদিন শুনতে পায় যে, অনেক দূরের কোনো এক শহরে ইহুদীদের জন্য নূতন হাসপাতাল খোলা হয়েছে। সে শহরে মায়ের এক আত্মীয় থাকতেন, তাঁরা চাইলে মাকে হয়তো সে হাসপাতালে একটা যেন তেন হলেও চাকরী খুঁজে দিতে পারেন। মায়ের খালার কাছে যাবার অনুমতি চাইতেই তিনি ভয়ানক রকমের খেপে উঠলেন, ‘তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে যে বাড়ি ছেড়ে অত দূরে যাবার কথা ভাবছিস? আর আঠারো বসরের মেয়ে একা,একা অত দূরের পথ পাড়ি দেয়, এমন সৃষ্টিছাড়া কথা কে কবে শুনেছে? এসব অদ্ভুতুড়ে পরামর্শ কে তোকে দেয় শুনি?’ তখন থেকেই মায়ের আসল বয়স নিয়ে যেন একটা লুকোচুরি চলতে থাকে, সুবিধামত তা কমানো বাড়ানো হয়। মা জোর দিয়ে বলেন তাঁর বয়স বাইশ আঠারো নয় মোটেই আর খালার অনুগ্রহে বাস করাটাও মায়ের কাছে আর ভাল লাগছে না। মায়ের মুখে এমন জবাব শুনে তাজ্জব বনে যান মায়ের খালা। কোনো রকমে তিনি বিড় বিড় করে বলেন, ‘ সে কিরে তোর বয়স বাইশ হোলো কবে?’ তারপর, তিনি মায়ের বয়সের হিশাব কষতে শুরু করেন। ইহুদী দিনপঞ্জী অনুযায়ী মায়ের জন্ম হয় তামুজ মাসে, যা কিনা আবার রাশিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী জুন মাস কিন্তু কোন সালে? কিছুতেই সালের হিশাব আর মেলে না। খালার পেল্লায় গুষ্ঠির মধ্যে অগুন্তি ভাগ্না/ভাগ্নি কতক মরে হেজে গেছে, আর বাকীরা কে কোথায় দূরদূরান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের সবার জন্ম সালের আর দিনের হিসাব রাখা যমেরও অসাধ্য! তা সে যাই হোক বাপু, এ মেয়ের বয়স যদি সত্যি বাইশ হয়ে থাকে তবে, তার বিয়ের বেলা কবে গড়িয়ে গেছে। আর এই অজ পাড়া গায়ে বিনা যৌতুকে এমন আইবুড়ো মেয়ের বরটাই বা জুটবে কোত্থেকে? বাইশ- ওরে বাপরে সে যে বড্ড বেশী বয়স বিয়ের জন্য! এ মেয়ের বিয়ের যৌতুকই বা যোগাড় হবে কোথা থেকে, তার চাইতে যদি শহরে গিয়ে নিজে চড়ে খেতে শেখে মন্দ কি বরং একটা হিল্লে হয়। ঘাড় থেকে তো বোঝা নামলো সুতরাং, মায়ের খালা এসব পাঁচসাত ভেবে খুশী মনেই রাজী হলেন।

কিন্তু বসন্তকাল শুরু হবার আগে যাবার অনুমতি মিলল না মায়ের। গ্রাম থেকে রেল রাস্তা বহু দূরের হাঁটা পথ, মায়ের খালা আর খালাতো ভাই দুজনে গিয়ে মাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে এলেন। আমার নানা নানীর ছবি, শতছিন্ন রাশিয়ান পাঠ্যবই গুলো আর বাকী সব ছোটখাট জঞ্জাল একটা ঢাউশ পোঁটলায় বেঁধে নিয়ে মা অজানা জগতের উদ্দেশ্য রওনা হলেন।

হাসপাতালটা ছিল বহুদূরের একটা শহরে। এখানে পৌঁছে মায়ের আশা আকাঙ্ক্ষা কিছুই পূর্ণ হয়নি। যে জগতের মা স্বপ্ন দেখেছিলেন সবই রয়ে যায় অধরা। মা ভেবেছিলেন তাঁর বইয়ে পড়া জগতের মতো এখানকার লোকজনরা সবাই হবে সৎ, ভদ্রনম্র, দুয়ালু আর পরোপকারী। সূর্যদোয় থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হাসপাতালের মেঝে ঘষে ঝকঝকে, তকতকে করা আর গাদাগুচ্ছে কাচাকুচি করা এই ছিল মায়ের প্রতিদিনের রুটিন। কেউ মায়ের সাথে হাসি মুখে দুটো কথা বলা তো দূরে থাক তাঁর দিকে ফিরেও তাকাতো না। শুধু হুকুমের পর হুকুম জারী করে যেত, মা মুখবুজে খেটে যেতেন যন্ত্রের মতো যতক্ষণ না অবসাদে তাঁর শরীর ভেঙ্গে পড়তো। অনেক রাতে কোনো রকমে ছাদের চিলে কোঠায় গিয়ে মড়া লাশের মতো বিছানায় লুটিয়ে পরতেন। মায়ের যে আত্মীয় সে শহরে বাস করতেন তিনি মাকে প্রায় অব্যবহার যোগ্য কিছু পুরানো জুতা কাপড় আর নার্সিং শেখবার একখানা বই দিয়েছিলেন। মায়ের কাছে তখন এসব জিনিসই ছিল অতি অমূল্য। বিশেষ করে নার্সিঙের বইটা। তাঁদের বাড়িতেই মা তাঁর সাপ্তাহিক ছুটির দিনটা কাটাতেন। দিন রাতের যে টুকু সময় মা পেতেন বুভুক্ষের মতো নার্সিঙের বইটা থেকে পাঠ নিতেন। এই-ই যে ছিল তাঁর জীবনে পরিবর্তন আনার একমাত্র উপায় তা মা খুব ভাল ভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।

নার্সিঙের সব গুলো পরীক্ষাই মা খুব ভাল ভাবে পাস করেছিলেন। আর মহা মূল্যবান সার্টিফিকেট খানা হাতে পাবার সাথে সাথেই মা একটা মেডিক্যাল মিশনের সাথে কাজ করবার জন্য দরখাস্ত করেন। সে সময়ে কলেরার প্রায়শঃই খুব মহামারী আকারে দেখা দিত। এমনই একটা মিশনের সাথে বেশ অনেকগুলো বসর মা দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে, ঘুরে সেবা করে কাটিয়ে দেন। এখনও মা যখন পিছনে ফিরে তাকান সেই বসরগুলোই মায়ের মনে জ্বল জ্বল করে। এমন লোকদের সাথে মা কাজ করেছিলেন যারা ছিল নিঃস্বার্থভাবে সেবায়, দয়ায় নিবেদিত প্রাণ, তাঁদের একজন হতে পেরে মা ছিলেন ভীষণ ভাবে সুখী আর গর্বিতা। সে সময়গুলোই ছিল আমার মায়ের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাল। ১৯০৫ সনের যুদ্ধে বেশ ক’জন মেডিক্যাল কর্মী প্রাণ হারায় তাই ওই সেবা সদনটাও বন্ধ হয়ে যায়। মায়ের কাছে তা ছিল যেন এক মর্মান্তিক ঘটনা। দুঃখভরাক্রান্ত মনে মা বাধ্য হয়েই অন্য আর একটা শহরের অন্য একটা ব্যক্তিগত মালিকাধীন সেবা সদনে কাজ খুঁজে নেন। যেখানে বয়স্ক মহিলাদের দেখাশোনার ভার ছিল মায়ের হাতে।

এই সেবা সদনেরই চিকিৎসাধীন একজন মহিলা রোগী বাবার সাথে মায়ের পরিচয় ঘটিয়ে দেন। এমন অদ্ভুত রকমের বেজোড় যোটক কি করে প্রেমে পরলেন সেটা ভেবে আমার বিস্ময়ের কূল থাকে না। আমার মা ছিলেন স্বল্পভাষিণী, কথা বলতেন খুব মেপে মেপে, যাও বা বলতেন তা ছিল তাঁর একান্ত নিজস্ব ধ্যানধারণা। আর নিজের সম্পর্কে পারতপক্ষে তিনি মুখ খুলতেন না। আর ওদিকে আমার বাবা ছিলেন ধূর্ত স্বভাবের যদিও নিজের ব্যপারে বাবার কোনো রাখঢাক ছিল না। গোপনীয়তা বলতে কোনো জিনিশ ছিল না তাঁর চরিত্রে। এমন কি মায়ের প্রতি বাবার যে অনুভূতি ছিল তাও বাবা অপকটে বলে ফেলতেন। আমার দাদার সাথে যে বাবার সম্পর্ক ভাল ছিল না, প্রায়শঃ বাপ বেটা দুজনের মাঝে ঠোকাঠুকি লেগে থাকতো সে কথাও বাবা গোপন করবার চেষ্টা করতেন না।

নিজের সম্পর্কে বাবা বলতেন, ‘আমার চরিত্র হচ্ছে বইয়ের খোলা পাতার মতো, আর তাই সব মানুষের সাথেই আমার সম্পর্ক সহজ সরল, খোলা মেলা।’ কোনো জমায়েতে গল্প করবার সময় নিজের পরিবারের কথাও নির্দ্বিধায় বলে যেতেন। এমনকি নিজের মা বাবাকে নিয়ে কৌতুক করতেও তাঁর বাঁধতো না। তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাকেও বাবা চমৎকার গল্পে পরিণত করতে পারতেন। আর গল্পের রসদের জন্য গানের জলসা, সার্কাসের তাঁবু, অভিনেতা অভিনেত্রী, কৌতুকাভিনেতা এমন কি রাস্তার ধারে গান গেয়ে যে সব ভিখারী ভিক্ষা চাইতো তাদেরকেও খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন তিনি। সেই দিন গুলোতে আমার মায়ের জীবনে বাবা বয়ে এনেছিলেন লঘু চপল সুবাতাস। তাই, ক্ষণিকের জন্য হলেও মা ভুলে গিয়েছিলেন নিজের কঠোর নৈতিক আদর্শগুলো। বাবার পোশাক ছিল বড় রংচঙয়ে, চটকদার এবং স্মার্ট। তাঁর গায়ে ঝলমলে সিল্কের সার্ট, মাথায় ঝকমকে খড়ের টুপী, গাঢ় রঙের মোজার সাথে একসার বোতাম লাগানো হাই বুট। আমার মা মনে করতেন, পোশাক আশাকের অতিরিক্ত চাকচিক্য প্রমান করে মানুষটার স্বভাব হচ্ছে অন্তঃসারশূন্য আর বড় অগভীর। কিন্তু, আশ্চর্য হলেও সত্যি সেই তিনিও বাবার ফ্যাশানেবল চালচলনে গর্বিত বোধ করতেন!

বিয়ের পরের দিন গুলোতে বাবা আমার মাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন তাঁর প্রিয় জায়গাগুলোতে। কখনো নামকরা কোনো রিসোর্টে, কখনো গানের আসরে বা চায়ের আড্ডায়। যেখানে বাবা তাঁর অন্য নিষ্কর্মা বন্ধুবান্ধবদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুলতানি মেরে, জুয়া খেলে কাটিয়ে দিতেন । তাঁদের আলোচনার মুখ্যবিষয় ছিল নিজেরদের নিয়ে অকারণ ফাঁকা অহংকার আর কি করে ব্যবসায়ে একটা বড় দাও মারা যায় সেই গালগল্প। সারারাত ধরে চলতো নাচ গান আর হল্লাগুল্লা, খানা পিনা। উজ্জ্বল ঝলমলে আলো, ব্যান্ডের উঁচু আওয়াজ, নাচিয়েদের রুচিহীন পোশাক তাদের ববছাঁটা চুল, উৎকট সাজ মায়ের কাছে প্রচণ্ড রকমের রুচিহীন মনে হোতো।

কিছুদিন না যেতেই মায়ের মন ভবিষ্যৎ চিন্তায় শঙ্কিত হয়ে উঠলো। বাবার ব্যবসা জগত ছিল ধোঁকাদারী, সর্বক্ষণ লাভ লোকসান হিশাব আর বিকিকিনির নানা ফন্দিফিকরে ভরা। বাবা বলতেন, ‘আমি চাইলে হাওয়াও বিক্রি করতে পারি।’ এমন জালিয়াতি কাণ্ড কারখানা মা আগে কক্ষনো দেখেননি কিবা এমন একটা জগতও যে থাকতে পারে তাই ছিল মায়ের কাছে অজানা। ভয়ে, ভাবনায় মা যেন কেমন দিশেহারা হয়ে গেলেন। যতদিন যেতে লাগলো বাবার দুনম্বরী জীবন যাত্রা মায়ের কাছে একটু, একটু করে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগলো। আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠলো মায়ের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। বাবার জীবনের মন্ত্র ছিল শুধু এই মুহূর্তের জন্য প্রাণ ভরে বাঁচো, খামখাই পরের দিনের কথা ভেবে অযথা কালক্ষেপ করা কেন হে বাপু! যদি একটা বড় দাও মারতে পারলেন তাহলে এক সপ্তাহ বড়জোর এক মাস হোতো তাঁর ব্যবসার স্থায়িত্ব। যা কিছু আয় হোতো তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে নিয়ে সব উড়িয়ে পুড়িয়ে দিতেন মৌজমাস্তি করে। যতক্ষণ হাতে কড়ি আছে ততক্ষণ ‘নো চিন্তা ডু ফুর্তি’ এই ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র।

সব সময় বাবার মাথায় ঘুরতো কি করে রাতারাতি আমীর হওয়া যায়। দুনম্বরী ধান্দার চমৎকার সব কলাকৌশল তাঁর মাথায় খেলতো। কিন্তু, স্বভাব দোষে নিজে সে সব কাজে লাগানোর আগেই অন্যের কাছে বারফাট্টাই করে বেড়াতেন। ফলে, দেখা যেতো তাঁর নেমকহারাম বন্ধুর দল তাঁরই প্ল্যান কাজে লাগিয়ে দিব্যি একটা ব্যবসা বাগিয়ে বসেছে। কিন্তু তাতেও বাবার কোনোই হেলদোল ছিল না। সেই বন্ধুদের সাথেই এক চায়ের টেবিলে বসে আড্ডাবাজী করছেন। এতো বড় বেঈমানীতেও তাঁর যেন কিছুই যেতো আসতো না। এটাকেও তিনি নিছক মস্কারা ভেবে করে হেসে উড়িয়ে দিতেন। আর তিনি ভাবতেন তাঁর মতো আর সকলেই সব কিছু সহজে ভুলে যায়। কিন্তু, যখন দেখতেন যে তাঁর এ ধরণের কথা বার্তায় অন্যেরা উল্টো ক্ষেপে উঠতো আর তাঁর সাথে শত্রুর মতো আচরণ করতো তখন তাঁর আর বিষয়ের সীমা থাকতো না। নিষ্পাপ শিশুর মতো মুখ করে মাকে বলতেন, ‘আমি কি করে জানবো যে মানুষ এত দীর্ঘ সময় ধরে মনের মধ্যে ঘৃণা পুষে রাখে? আমার স্মৃতিশক্তি তো বেড়ালের স্মৃতির মতো ক্ষণস্থায়ী!’ মা কঠিন ভাবে বলতেন, ‘উপর দিকে থুতু ছিটালে যে তা নিজের মুখেই পরে একটা ছোট্ট শিশুও জানে।’

ক্রমশঃ, আমার মায়ের মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মে গেল যে একমাত্র অন্য কোনো দেশে যদি প্রবাসী হওয়া যায় তবেই সব কূল রক্ষা হয়। বাবার পিছনে মা একেবারে আদাজল খেয়ে লাগলেন, যাতে তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ বিষয়ে জরুরী সিধান্ত নেন। মায়ের পছন্দের দেশের তালিকায় ছিল অ্যামেরিকা, ফ্রান্স আর প্যালেস্টাইন, কিন্তু শেষমেশ ঠিক হোলো অস্ট্রেলিয়ায় আসা। এর একমাত্র কারন ছিল মায়ের কিছু দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় স্বজন এ দেশে বাস করতো। মা সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত ছিলেন এই ভেবে যে, তাঁর আত্মীয়রা নিশ্চয়ই এই নূতন দেশে বসতি গাড়তে প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগীতা করবে। আসলে, মায়ের মনে একটা সুপ্ত আশা ছিল অস্ট্রেলিয়া নিশ্চয় অন্য দেশ গুলো থেকে একেবারে আলাদা, এখানে এলে বাবা অবশ্যই সৎ পথে আয় রোজগার করবেন আর আদর্শ জীবন যাপন করবেন।

দীর্ঘদিন বাবা মায়ের কাকুতি মিনতিতে একে বারেই পাত্তা দেননি। বাবা বিদ্রুপ করে বলতেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় কেন তারচেয়ে চল না একেবারে তিব্বতে

চলে যাই। দুটো দেশের মধ্যে তফাৎটাই বা কি? দুটোই তো দুনিয়ার সেই আরেক মাথায়।’ নিজের দেশ ছাড়বার আইডিয়াটাই এত অবান্তর মনে হোতো তাঁর কাছে যে তিনি যখনই মা এবিষয়ে কথা বলতেন তিনি উপহাস করে তা উড়িয়ে দিতেন। তিনি ভেবেছিলেন এতে করে মায়ের স্বপ্ন সাধ রঙ্গিন বেলুনের মতো একসময় চুপসে যাবে। অলস, অকর্মণ্য আমার বাবার আসলেই অন্য কোনো দেশে যাবার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে ছিল না। নিজের শহরের হাতে গোনা তিন/ চারটি রাস্তাই ছিল তাঁর চৌহদ্দি, এর বাইরে আর বেশী তাঁর জানা ছিল না। আর কেনই বা তাঁর স্ত্রীর তাঁর আয়ের উৎস নিয়ে এতো আদিখ্যেতা, কেন নূতন আয়ের পথ খুঁজতে হবে তাও তিনি ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারেন না। জীবনের কোনো কাজই তিনি ভেবে করেনি আর গভীরভাবে কোনো কিছু তলিয়ে দেখাও তাঁর ধাতে নেই। তারচাইতে ঝকমকে পোশাক, আশাক আর হইহুল্লোড় ভরা জীবন অনেক স্বাচ্ছন্দ্যের, কেন অহেতুক নূতন যন্ত্রণা মাথায় নেয়া?

শেষ পর্যন্ত মায়ের দৃঢ়চেতা মনোভাবের কাছে বাবাকে রণ ভঙ্গ দিতে হোলো। রাশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া দীর্ঘ সারাটা পথ তাঁর মন বড় তিতিবিরক্ত হয়ে রইলো মায়ের উপর, কেন মা এমন একটা আজব সিধান্ত নিলেন? কিন্তু, অস্ট্রেলিয়ায় পা দেবার যেন একেবারে সাথে, সাথেই এটাই তাঁর প্রিয় বাসভূমি উঠলো,নিজের দেশকে ভুলে যেতে শুধু মুহূর্ত বিলম্ব মাত্র। তিনি ভেবেছিলেন অস্ট্রেলিয়া একেবারেই অন্য রকম একটা দেশ কিন্তু দেখলেন আসলে মোটেও তা নয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সাঙ্গোপাঙ্গ জুটিয়ে ফেল্লেন, আর শুরু হোলো ক্যাফেতে বসে নব্য সাথীদের সাথে নূতন ব্যবসার পাঁয়তারা কষা। মুহূর্তেই বাবার হিশাব নিকাশ হয়ে গেল, এদেশে টাকা রোজগার করার অজস্র উপায়, টাকা এখানে হাওয়ায় উড়ছে, শুধু ধরে বস্তা বন্দি করবার অপেক্ষা! তবে, নূতন দেশের নূতন ভাষা একটা বিরাট বাঁধা বইকি। কিন্তু ব্যবসা করতে গেলে কি অতসব ভাবলে চলে? সে সমস্যাও বাবা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন, ‘যদি জানো কি করে বিকিকিনি করতে হয় তাহলেই যথেষ্ট, এ হচ্ছে সোনার দেশ।’

কিন্তু, মায়ের জন্য ছিল সম্পূর্ণ অন্য আর এক চিত্র। জাহাজে করে এদেশে এসে পৌঁছাবার পর দিনই তিনি ফিরে যাবার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠলেন। অজানা, অচেনা নূতন দেশে এসে প্রথম যে অনুভূতি মায়ের মনে জেগেছিল তা তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অটুট ছিল। নিজের দেশের তুলনায় প্রতিটি জিনিশ, নিজ এলাকার মানুষজন, কাস্টমসের অফিসাররা, ট্যাক্সি ড্রাইভার এমনকি বাড়ির দালাল সব কিছুই এত উন্নত আর অন্য রকমের ছিল যে, মায়ের মনে চরম ক্রোধের জন্ম হয়েছিল। মায়ের মনে হয়েছিল, প্রতিবেশীদের নজর তাঁদের প্রতি যতটা প্রসন্ন ও বন্ধুত্বসুলভ যেন ঠিক ততটাই ব্যঙ্গ আর সহানুভূতিমাখা। তিনি কল্পনা করতেন পাড়ার প্রতিটা মানুষই তাঁদের একই নজরে দেখে। তাই কক্ষনো তিনি তাঁদের সহ্য করতে পারতেন না। তাই বলে তাঁর যেসব ইহুদী আত্মীয় ছিল এদেশে অথবা জাহাজে যে সব ইহুদীদের সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছিল তাঁদের সাথেও তাঁর কোনো রকম সখ্যতা গড়ে উঠেছিল তা ভাবাও খুবই ভুল হবে। কাউকেই মা একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। মায়ের আত্মীয় যারা অনেক আগে থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন স্বভাবতই তাঁরা এদেশ সম্পর্কে অনেক বেশী জানতেন। তাঁরা চাইতেন নূতন দেশ আর এর বিভিন্ন নিয়ম কানুনের বিষয়ে জ্ঞান দিয়ে মাকে চমৎকৃত করতে। এ ব্যপারে রীতিমত তাঁদের মধ্যে প্রতিযোগীতা লেগে থাকতো কে কতো বেশী আমার মাকে বিস্মিত করতে পারে নয়া, নয়া তথ্য সরবরাহ করে। তাঁদের কথা বলবার ভঙ্গী ছিল কেমন যেন আক্রমণাত্মক, কথায় কথায় বলতো, ‘এটা একটা স্বাধীন সংস্কারপূর্ণ দেশ, সবারই বাক স্বাধীনতা রয়েছে, খাবার সময় সবাই ভদ্র লোকের মতো ছুরিকাঁটা ব্যবহার করে কেউই হাত দিয়ে খায় না। সবাই লেখা পড়া জানা, চিৎকার করে কথা বলে না। এখানে কেউই কারো সাথে অন্যায় আচরণ করে না, যেমনটি হোতো পুরানো দেশে।’

মার ছিল অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, খুব সহজে আর কম সময়ে তিনি তাঁর পারিপার্শ্বিক জগত সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। অন্য দিকে বাবা ছিলেন ধূর্ত, অন্যেরা কথা বলবার সময় এমন হাসি হাসি মুখ করে থাকতেন যেন তিনি কতই না তাঁদের কথা প্রাণ ভরে উপভোগ করছেন। কিন্তু মা অন্যদের কথা বলার মাঝখানেই থামিয়ে দিতেন, মৃদু কিন্তু কঠিন হিমশীতল স্বরে বলতেন, ‘ধরে নিলাম তোমাদের কথাই সত্যি তাহলে তোমরা এমন পোষা কুকুরের মতো নেচেকুঁদে বেড়াও কেন? কাকে খুশী করবার চেষ্টা কর শুনি?’

নূতন দেশের প্রতি মায়ের এই কঠিন আর শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবের কোনোদিনও পরিবর্তন হয়নি। এ দেশে যেন কিছুই ছিল না তাঁর কাছে এমনকি, সেজন্য এদেশের ভাষা শেখবার আগ্রহও দেখাননি তিনি। আমি আর বোন যখন স্কুলে যাবার মতো যথেষ্ট বড় হলাম তখন যেন মা খানিকটা হলেও তাঁর মনে আশেপাশের জগত সম্পর্কে কৌতূহল জেগে উঠলো। মায়ের মনে বই পড়া আর শিখবার যে অদম্য ইচ্ছে সুপ্ত ছিল তা যেন নূতন করে বিকশিত হলো। আমাদের বই পুস্তক গুলো মা এমন ভাবে নাড়াচাড়া করতেন যেন ওগুলো কোনো পবিত্র ধর্ম্যগ্রন্থ! আমাদের ভবিষ্যতের লক্ষ্যমাত্রা আগে ভাগেই মা ঠিক করে রাখলেন। মা আমাদের জগত এমন ভাবে নির্ধারণ করে দিলেন যে, আমাদের দু’ ভাইবোনকে চিকিৎসা বিদ্যা, সংগীত আর সাহিত্য প্রতিটা বিষয়ে হতে হবে তুখোড়। মায়ের ধারণা ছিল কেবল এভাবেই আমরা মানবতার সেবায় নিজের উৎসর্গ করতে পারবো। গোকীর্ আর টলস্টয় থেকে পড়ে শোনাতেন মা। আর তাঁর মেডিক্যাল টিমের সাথে কাজ করবার দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতেন সবসময়। মায়ের ধারণা ছিল শুধুমাত্র স্কুলের শিক্ষাই আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়। একমাত্র তাঁর মেডিক্যাল মিশন তাঁকে যেমন ভাবে পথ দেখিয়েছিল মানবতার সেবায় সেটাই ছিল সব চেয়ে আদর্শ উদাহরণ। এই বন্ধ্যা দেশে একমাত্র ওই আদর্শই আমাদের বাঁচাতে পারে অন্তঃসারশূন্যতার হাত থেকে।

খেলা থেকে অসময়ে ডেকে এনে বই পড়ে শোনাতেন বলে আমি মাঝে মাঝে তীব্র প্রতিবাদ জানাতাম মায়ের বিরুদ্ধে। বাবাও ভেবে আশ্চর্য হতেন মা কেন অযথা এত সময় নষ্ট করেন আমাদের বই পড়ে শোনাতে গিয়ে। আর কেনই বা তাঁর মেডিক্যাল মিশনের একঘেয়ে গল্প বার, বার বলেন। মাঝে সাঝে বাবা তাই আমার পক্ষ নিতেন, ‘ওরা এখনও অনেক ছোট, এসব বুঝবার মতো অত বড় হয়নি, কেন জোর করে ওদের এসব গিলাতে চাও শুনি। কচি মাথাগুলো কি না বিগড়ালেই নয়? ঈশ্বরই জানেন শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে!’ তারপর, আমাদের দিকে ইশারা করে বলতেন ‘আমার ছেলে যদি ভাল একজন ছুতোর মিস্ত্রী হয় আর মেয়ে পোশাক কারখানায় কাজ পায় তাহলেই আমি যথেষ্ট খুশী হবো।’ ‘যাক, তোমার মতো ব্যবসায়ী হবার পরামর্শ যে দাওনি সেটাই ভাগ্যের। অন্তত জীবন থেকে খানিকটা হলেও কিছু শিখেছ শেষ পর্যন্ত।’ বাবা রেগে চিড়বিড়িয়ে উঠতেন, ব্যাঙ্গ করে বলতেন, ‘কি আর করা যাবে আমার বাপ যখন আমাকে প্রফেসার হবার মতো শিক্ষা দেননি। তাই ব্যবসায়ী না হয়ে বা আমার উপায় বা কি?’ তবে, মায়ের শীতল দৃষ্টি আর কুঞ্চিত মুখোভঙ্গীর সামনে খুব বেশীক্ষণ তাঁর এই যুদ্ধাংদেহী মূর্তি টিকতো না, বাবার চেহারা দেখাতো চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো।

এত সহজেই বাবা রণেভঙ্গ দিতেন দেখে আমারা দু’ ভাই বোন রেগে আগুন হয়ে যেতাম, ‘বাবাটা যেন কি, তাঁর উপর নির্ভর করাটাই মুর্খামি, কক্ষনো আমাদের পক্ষ নিয়ে দুটো কথা মাকে বলার সাহস নেই।’ আসলে মুখে,মুখে মায়ের সাথে তর্ক করলেও মনে, মনে বাবা মাকেই সমর্থন করতেন। ঘরের বাইরে মাকে নিয়ে বাবার যে কি গর্ব ছিল, এক অদ্ভুত ধরণের অহংকার প্রকাশ পেতো বাবার কথায় মায়ের শিক্ষা সহবত নিয়ে। যেমন ভাবে আমরা দু’ভাই বোন মায়ের শেখানো বুলি তোতা পাখীর মতো করে আওড়ে যেতাম, বাবাও ঠিক তাই করতেন।

মায়ের ভারী দুঃশ্চিন্তা ছিল কি করে আমাদের দু’ভাইবোনকে, উপযুক্ত গানের তালিম দেয়া যায়। কিন্তু, তাঁর পক্ষে স্বপ্নেও কল্পনা করা কঠিন ছিল যে আমাদের জন্য কোনো বাদ্যযন্ত্র কিনবেন বা শিক্ষক রাখবেন। একেই বাবার ব্যবসার সব সময়ই টলোমলো অবস্থা, কোথা থেকে টাকা যোগাড় হবে কে জানে, ঠিক মতো বাড়ি ভাড়াই দেয়া হয় না। তাই মা আমাদের পরিচিত মানুষদের বাড়িতে নিয়ে যেতেন গ্রামোফোনের গান শোনাবার জন্য। এডিসন কোম্পানির তৈরি সরু চোংগা ওয়ালা আদ্যিকালের গ্রামোফোন থেকে এমন কিনকিনে সুর উঠতো মনে হতো যেন সেই অসীম সুদূর থেকে ভেসে, ভেসে আসছে। আমার দু’ভাইবোন তাতেই মন্ত্রমুগ্ধ ছিলাম, বুঁদ হয়ে শুনতে চাইতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মায়ের আবার তাতেও মহা আপত্তি, তাঁর ধারণা বেশিক্ষণ এমন তীক্ষ্ণ বাজনা শুনলে আমাদের কানের ক্ষতি হতে পারে।

এরপর থেকে আমরা গানের দোকানে দোকানে ঘোরাঘুরি শুরু করলাম। স্কুল ছুটির পর কিবা ছুটির দিন গুলোতে আমরা এ দোকান সে দোকান করে কাটিয়ে দিতাম। আর বাড়িতে বাবা কখনো দুপুরের খাবার আবার কখনো বা সন্ধ্যার খাবারের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে রইতেন। কিন্তু তা নিয়ে তিনি কক্ষনো কোনো রকম হই চই করেননি, বরং উল্টে মানুষের কাছে গর্ব করে মায়ের প্রশংসা করতেন। মা যে আমাদের গান শেখাবার জন্য কতো কঠোর তপস্যা করছেন তা নিয়ে বাবার অহংকারের সীমা ছিল না।

মা তো নিজে পড়তে পারতেন না তাই, প্রথম প্রথম আমরা দোকানে গিয়ে দু’ভাই বোন মিলে তাকে সাজানো গানের বইগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহ করতাম। গানের কথা কে লিখেছেন, সুর কে করেছেন, কোন রেকর্ড কোম্পানি এটা বাজারে ছেড়েছে আর দেয়ালে ঝোলানো বড় বড় ছবি গুলো গায়কের জীবনবৃত্যান্ত মুখস্ত করে ফেলেছিলাম। ও এলাকার এমন একটা দোকানও বাদ ছিল না যেখানে, আমাদের নিত্য আসা যাওয়া ছিল না। এরপর, আমরা আবার প্রথম দোকান থেকে শুরু করতাম, এবারে গান শোনার পালা। মা তো ইংরেজি জানতেন না তাই, মায়ের হয়ে আমি দোকানদারদের তাঁর পছন্দের গান বাজিয়ে শোনাবার অনুরোধ করতাম। এরপর আরেকটা পিস বাজাবার অনুরোধ করতাম, কখনো তাচিকভাস্কির বেহালা, বা বিটোভেন, কারসু বা চ্যাপলিনের সময় কালে গাওয়া কোনো গান। যতক্ষণ পর্যন্ত না দোকানীর সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যেত, আমরা সেই দোকানে গেড়ে বসে থাকতাম।

ধীরে ধীরে মায়ের সাহস বেড়ে গেল, দোকানে গিয়ে দোকানীকে পুরা একটা কন্সার্ট অথবা সম্পূর্ণ সিম্ফনি বাজিয়ে শোনাবার অনুরোধ করতেন। গান শোনাবার ছোট্ট ঘরটিতে আমরা ঘণ্টা খানেকেরও বেশী সময় এমন করেই কাটিয়ে দিতাম। দোকানীর অস্থির পদচারনা, বার বার হাই তোলা বিরক্তিমাখা মুখ কোনো কিছুতেই মায়ের ভ্রুক্ষেপ ছিল না। উল্টে মা চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসে ঘূর্ণায়মান রেকর্ডের দিকে এক দৃষ্টিতে এমন ভাবে চেয়ে থাকতেন যেন সেখানে দোকানী বলতে কোনো জনপ্রাণীর অস্তিত্ব ছিল না। প্রতিটা দোকানের সব গুলো মানুষ আমাদের খুব ভাল ভাবেই চিনে গিয়েছিল। যে দোকানেই আমরা ঢুকতাম সবাই আমাদের দিকে এমন নজরে চাইতো যেন আমরা চিড়িয়াখানার কোনো আজব জীব। লজ্জায় আমার কান মাথা গরম হয়ে যেতো, মানুষগুলোর উপহাস ভরা বক্রদৃষ্টি আমরা যেদিকে যেতাম সেদিকই অনুসরণ করতো। কখনো, কখনো আমি মায়ের হাত দুটি ধরে অনুনয় করে বলতাম, ‘চল না মা, আজ নাহয় চলে যাই।’ কিন্তু এসব তুচ্ছ বিষয়ে নজর দেবেন এমন পাত্রী তিনি ছিলেন না।

খুব তাড়াতাড়ি আমরা মানুষের উপহাসের বস্তু হয়ে দাঁড়ালাম। দোকানদাররা আমাদের আর মোটেই পাত্তা দিতেন না। এক দোকানী তো দরজার সামনে আমাদের দাড় করিয়ে রেখে কি যেন খানিকটা বিড়বিড় করে বকলেন। তারপর সেখানেই দাড় করিয়ে রেখে ভেতরে চলে গেলেন। তাই বলে এতো সহজে দমবার বান্দাও মা নন। মা ঠিক করলেন দোকানের ম্যানেজারের কাছে গিয়ে নালিশ দেবেন। দুঃখে অপমানে আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন মাটিতে মিশে যাচ্ছি। ফিরে যাবার জন্য যেই পা বাড়িয়েছি অমনি মা খপ করে আমার আহত চেপে ধরলেন। ‘কিসের এতো ভয় শুনি, আমার উপর বিশ্বাস রাখ। দেখো, আমি তোমাকে কোনো রকম অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলবো না’ অভয় আশ্বাস দিলেন মা। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘ঠিক করে ভেবে বলো, কে ঠিক আমরা নাকি ওই দোকানী? কেন আমাদের বাজিয়ে শোনাবে না, এতে তো আর ওর নিজের গাঁটের কড়ি খরচ হচ্ছে না। আমার গরীব আমাদের কিনবার ক্ষমতা নেই তাই বলে, ভাল কিছু শোনার সুযোগ থেকেও আমরা বঞ্চিত হবো?’ মায়ের অকাট্য যুক্তি, যতক্ষণ পর্যন্ত না মায়ের সাথে ভেতরে যেতে রাজী হলাম মা একই কথা বলে, বলে আমার জান ঝলাপালা করে দিলন।

আমরা তিনজন গিয়ে ম্যানেজারের ঘরে ঢুকলাম, মায়ের দোভাষী হয়ে তাঁর বক্তব্য ম্যানেজারকে জানালাম। আমি বুঝতে পারছিলাম ম্যানেজার সুলভ গাম্ভীর্য বজায় রাখতে তাঁর খুব কসরত করতে হচ্ছিল। বহু কষ্টে হাসি চেপে তিনি জানতে চাইলেন, ‘কিন্তু আদৌ কি রেকর্ড কিনবার কোনো ইচ্ছা আছে তোমাদের?’ মায়ের হয়ে আমি জবাব দিলাম, ‘আমি যদি বড়লোক হতাম তাহলেও কি আপনি এই একই প্রশ্ন আমাকে জিজ্ঞেস করতেন?’ আমি চুপ করে থাকলেই মা আমাকে খোঁচাতেন, ‘হুবহু বলো ওনাকে যেভাবে আমি তোমাকে বলছি ঠিক তেমন করে।’ আমার শিরা উপশিরায় গরম রক্তের ছোটাছুটির কারনে আমার কান মাথা সব ঝাঁঝাঁ করতে থাকতো। ত্যাঁদড় ম্যানেজার আবার তাঁর প্রথম প্রশ্নটাই করলেন মাকে। এবার মায়ের ধৈর্যের বাধ্ টুটে গেল। ম্যানেজার তাঁর কথা আদৌ কিছু বুঝলেন কিনা তার তোয়াক্কা না করেই, নিজের ভাষায় শিল্প সংস্কৃতি, সংগীতে সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে তিনি লম্বা চওড়া জ্বালাময়ী এক ভাষণ দিয়ে বসলেন।

এরপর প্রতিটা দোকান থেকেই আমাদের এমন করে ধুলোপায়ে বিদায় করে দেয়া হতে লাগলো। দোকানীদের এক কথা যদি রেকর্ড কিনতে পার তাহলে এসো নইলে নয়। তবে মাও সহজে ছেড়ে কথা কইবার লোক নয়, আচ্ছা মতো তাঁদের দুচার কথা শুনিয়ে দিতেন।

আমার মায়ের কল্যাণে এমন প্রত্যাখ্যান আমাদের কপালে প্রায়ই জুটতো। একবার তো মা আমাদের নিয়ে সোজা ইউনির সাইন্সল্যাবে হাজির। সারি সারি টেবিলের সামনে সাদা এপ্রন পরা ছেলে মেয়েরা উঁচু টুলে বসে আছে। তাদের সামনে সাজানো থরে থরে অসংখ্য টেস্ট টিউব, বিকন, জার ভর্তি রাসায়নিক তরল । একজন অধ্যাপক কি একটা বিষয় নিয়ে যেন লেকচার দিচ্ছিলেন, মা আর মায়ের পিছনে দুটি পুঁচকে ছেলে মেয়েকে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন।

মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল পুরো ঘরটা ভাল করে ঘুরে ঘুরে দেখবার। কিন্তু, একটু পরে একজন কালো পোশাক পরা ভদ্রলোক এসে মাকে জিজ্ঞেস

করলেন আমরা কি ভুল করে এখানে ঢুকে পরেছি কিবা কাউকে খুঁজছি কিনা? লোকটির চাল চলন দেখেই বোঝা যায় তিনি কোনো বিশেষ ব্যক্তি, চমৎকার ঝকঝকে চেহারা আর মথায় সিংহের কেশরের মতো সাদায় কালো মেশানো লম্বা ঝামুর ঝুমুর চুল।

মায়ের বক্তব্য আমি পুনারাবৃতি করলাম, ‘না, আমরা কাউকে খুঁজছি না, আমরা শুধু আপনাদের কাজ আর জ্ঞানকে উপভোগ করতে চাই।’

তিনি তাঁর কুঞ্চিত মুখে খানিকটা প্রসন্নতা টেনে এনে মৃদু হেসে বললেন, ‘এখানে তো বাইরের কারো ঢুকবার অনুমতি নেই, এটা শুধুমাত্র ছাত্র/ ছাত্রীদের জন্য।’ মাকে লোকটির কথা অনুবাদ করে বলার সাথে সাথে মায়ের চেহারা বদলে গেল, রাগে টকটকে লাল হয়ে গেল তাঁর মুখ। ঝাড়া দশটি সেকেন্ড তিনি লোকটির চোখের দিকে অপলক চেয়ে রইলেন। তারপর আমাকে বললেন, ‘ওনাকে জিজ্ঞেস করো কেন, তিনি এমন হাসি হাসি মুখ করে আমাদের সাথে কথা বলছেন?’ আমি বললাম, ‘ মা জানতে চাইছেন কেন আপনি আমাদের সাথে এমন সৌজন্যের সাথে কথা বলছেন?’ আমার কথা শুনে ভদ্রলোক এমন থতমত খেলেন যে কিছুক্ষণের জন্য রীতিমত তাঁর বাক্য হরে গেল। একটু পরেই তাঁর মুখ কঠিন হয়ে গেল, তিনি প্রথমে গলা খ্যাঁকরালেন, অস্থির ভাবে এক পা পিছিয়ে গেলেন। তারপর, ঘড়ির দিকে একনজর চেয়ে আর কোনো দিকে না তাকিয়ে দৃপ্ত পায়ে হেটে অন্যদিকে চলে গেলেন।

আমরা রাস্তায় বেরিয়ে এসে দেখি আজ বসন্তের দিনটা যে কি অপরূপ সাজে সেজেছে। মা কিছুক্ষণ থম ধরে রইলেন তারপর বললেন, ‘এ ধরণের ভদ্রলোকরা নিজেদের খুব উদারচিত্তের মনে করে আসলে, ভেতরে ভেতরে এরা আমাদের মতো মানুষদের শুধু করুণাই করে আর কিছু নয়। তোমাদেরও আমার মতো কপালে অনেক ভোগান্তি রয়েছে এদেশে। শুধু কি আর মিষ্টি কথায় চিঁড়ে ভেজে? আমার দেশে তো যাওবা কিছু হলেও হৃদয়বান মানুষের দেখা মিলতো, কিন্তু এখানে সে আশা করাটাও বাহুল্য দেখছি!’ এই একই কথা মা হরহামেশাই বলতেন। এমনকি আমি এখন আর সেই ছোট্ট বালকটি আর নই আমি এখন তের বসরের কিশোর। এদেশে সম্পর্কে অনেক কিছু আমার জানা হয়ে গেছে, আর এটাই আমার একমাত্র দেশ একথাও আমি জানি। কিন্তু, মায়ের সাথে তর্কে এঁটে ওঠা অত সহজ নয়। সারা জীবন মা একই রকম রয়ে গেলেন, মায়ের এই ধ্যান ধারণা আর একগুঁয়ে স্বভাবের পরিবর্তন করা অসম্ভব ছিল। পুরানো দিনের সুখ স্বপ্নে মা এতোই বিভোর ছিলেন যে এদেশের বর্তমান আর ভবিষ্যতের কোনো কিছুই তাঁর কাছে আশাব্যঞ্জক মনে হতো না। মা হতাশ হয়ে বলতেন, ‘হয়তো তোমার মতো যারা তাদের জন্য বিষয়টা ভিন্ন, কিন্তু এ জীবনে আর কিছুতেই আমি পথ খুঁজে পাব না এদেশের মাটিতে!’



অনুবাদিকা ঃ সুদর্শনা রহমান ( ১৪ই বৈশাখ ১৪২২, ইউমাণ্ডী, কুইন্সল্যান্ড)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ