ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা ১৯৬৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। ‘স্নো কান্ট্রি’, ‘থাউজ্যান্ড ক্রেনস’, ‘দ্যা সাউন্ড অফ দ্যা মাউন্টেন’ উপন্যাসগুলোর জন্য বিখ্যাত হ’লেও কাওয়াবাতা নিজে বলতেন তাঁর শিল্পকে সত্যিকারভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে হাতের পাতায় এঁটে যাওয়া এই সব ছোট,ছোট গল্পে। ১৯২৩ থেকে শুরু করে ১৯৭২-এ আত্মহত্যা করবার কিছু আগে পর্যন্ত তিনি লিখে গেছেন হীরের কুচির মত এমন অনেক গল্প। এই গল্পগুলো স্বপ্নের মত, কুয়াশার মত। সময়ের মত, মৃত্যুর মত।...একাকীত্ব,ভালোবাসা আর অনুভূতির সূক্ষ্ণতায় কবিতার মত।
মূলঃ ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা [১৯৪৪]
অনুবাদঃ কল্যাণী রমা
মেয়েটি মানুষটিকে বিয়ে করবার জন্য জন্মভূমি ছেড়ে আসামাত্র, তাকে মাঞ্চুরিয়ায় চিং-এ্যান পর্বতশ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ দপ্তরে বদলি করে দেওয়া হ’ল। মেয়েটিকে সবচেয়ে যা অবাক করে দিল তা হ’ল এখানে এক তেলের বোতল ভর্তি করে জল নিতে দাম দিতে হচ্ছে সাত সেন – ঘোলা, নোংরা সেই জল।এই জল দিয়ে মুখ ধুতে হবে কিংবা চাল ধুতে হবে মনে করলেই মেয়েটির পেটের ভিতর গুলিয়ে বমি পেত। ছয় মাসের ভিতর বিছানার চাদর, সব অন্তর্বাস হলদে হয়ে গেল। আর সবকিছুকে ছাপিয়ে ডিসেম্বরে কুয়াটা একদম নীচ পর্যন্ত জমে শক্ত বরফ হয়ে গেল। একজন কুলি কোথাও একটা থেকে বরফের একটা চাঙর নিয়ে এল। মেয়েটি মাঝে মাঝে তা স্নানের জন্য ব্যবহার করত। প্রাচুর্যের কথা বলবার মত কোন জায়গা এটা নয়। তবু অবশ হয়ে যাওয়া হাড্ডি একটু গরম করতে পারলে তা কী আশীর্বাদই যে হত! দূরের স্বপ্নের মত মনে পড়ল নিজের গ্রামে ফেলে আসা স্নানাগারের কথাঃ কাঁধ পর্যন্ত গরম জলে নিজেকে নামিয়ে যখন সাদা তোয়ালেটা মেলে ধরত, তার হাত পাগুলোকে কী সুন্দরই না লাগত।
“যদি কিছু মনে না করেন, আপনার একটু জল বেচে থাকলে, আমি অল্প নিতে পারি কি?” এক প্রতিবেশী মহিলা একটা মাটির বোতল নিয়ে এসে বলল। অনেক দিন পর প্রথমবারের মত পাত্রগুলো পালিশ করতে গিয়ে সব জল শেষ করে ফেলেছি।”
কোন জল অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু সে প্রতিবেশীকে একটু বেচে যাওয়া চা দিল।
“আমি বসন্ত আসা পর্যন্ত আর অপেক্ষা করতে পারছি না। কাপড়চোপড়গুলো গলতে থাকা বরফের মধ্যে যত খুশি ধুতে পারব। কি ভালোই যে লাগবে যদি কিছু জল ছিটাতে পারতাম,” প্রতিবেশী মেয়েটি বলল। এ সেই মেয়ের স্বপ্ন যে কিনা এসেছে জাপান থেকে, ওখানে পরিষ্কার জল পর্যাপ্ত। সে আর অপেক্ষা করতে পারছে না, কবে বরফ গলে গলে আবার জল হবে। যখন সে গামলা থেকে জল ঢেলে দিতেই মাটি কিভাবে তা শুষে নিচ্ছে দেখবে, কী ভালোই যে লাগবে। ড্যান্ডিলাইনই প্রথম মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে।
মেয়েটি নিজের স্নানের জলে স্নান করবার জন্য প্রতিবেশী মহিলাটিকে আমন্ত্রণ জানাল। তখন হঠাত্ উত্তরের সীমানার দিকে ধেয়ে যাওয়া ট্রেনটি উপত্যকার মাঝ দিয়ে এসে হাজির হল। দক্ষিণের যুদ্ধক্ষেত্রের খবর জানবার এটাই সময়।
“কি বিশাল বিস্তার এর,” বাথটাবের গরম জলের ভিতর থেকে প্রতিবেশী মেয়েটি বলে উঠল। সত্যিই। বহুদূর উত্তরে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ দপ্তরে যেখানে মেয়েটির স্বামী কাজ করত সেখান থেকে বহুনীচে দক্ষিণের আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃতি তার। এই হচ্ছে আজকের জাপান।
মেয়েটি যখন তার বাড়ির সামনে বের হয়ে এল, লার্চ গাছের ছোট ছোট ডালে জমে ওঠা তুষারের ফুল চেরী ফুলের পাপড়ির মত চারপাশে ঝরে পড়তে থাকল। মেয়েটি চোখ মেলে তাকাতেই, নিখুঁত নীল আকাশ মেয়েটিকে মনে করিয়ে দিল নিজ জন্মভূমির সমুদ্রের কথা।
মৃত মুখের ঘটনাটুকু
মূলঃ ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা [১৯২৫]
অনুবাদঃ কল্যাণী রমা
“হ্যাঁ, এসে দেখে যাও, এই অবস্থা হয়েছে ওর। ওহ্, কী ভীষণই যে ও তোমাকে আর একবার দেখতে চেয়েছিল।” লোকটির শাশুড়ি তাকে তাড়াহুড়ো ক’রে ঘরের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল। তার স্ত্রীর বিছানার পাশের সব মানুষ একইসাথে তার দিকে তাকাল।
“একবারটি ওকে দেখ।” তার শাশুড়ি স্ত্রীর মুখ ঢেকে রাখা কাপড়টা সরাতে সরাতে আবার বলে উঠল।
হঠাত্ লোকটি বলে উঠল। “আমি কি ওকে একটু একা দেখতে পারি? তোমরা সবাই এই ঘরে ওর সাথে আমাকে একটু একা থাকতে দেবে?”
লোকটির কথায় স্ত্রীর পরিবারে সহানুভূতি জেগে উঠল। ওরা ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। স্লাইডিং দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে।
সে সাদা কাপড় সরিয়ে দিল।
তার স্ত্রীর মুখ মৃত্যুতে, বেদনায় শক্ত হ’য়ে গেছে। গালগুলো ভিতরে ঢুকে গেছে, বিবর্ণ দাঁতগুলো ঠোঁটদু’টোর মাঝ থেকে ঝুলে আছে। চোখের পাতার মাংস শুকিয়ে চোখের মণিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। কপালে এক স্পষ্টত প্রতীয়মান টান টান উত্তেজনা সেই ব্যথাকে জমাট ক’রে রেখেছে।
সে কিছুক্ষণের জন্য স্থির হ’য়ে বসে থাকল। মৃতের বিশ্রী মুখটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে।
তারপর, কাঁপা কাঁপা হাতদু’টো সে স্ত্রীর ঠোঁটের উপর রাখল। মুখটা বন্ধ করবার চেষ্টা করল। কিন্তু জোর ক’রে ঠোঁটদু’টো বন্ধ রাখতে চেষ্টা করতে গিয়ে দেখে হাত সরিয়ে নিলেই ঠোঁটদু’টো আবার নিস্তেজ হ’য়ে খুলে যাচ্ছে। আবার মুখটা বন্ধ করল সে। আবার খুলে গেল মুখ। বারবার এমন ক’রেও সফল হওয়া গেল না। কিন্তু দেখা গেল স্ত্রীর মুখের চারপাশ ঘিরে যে কঠিন রেখাগুলো ছিল তা যেন নরম হ’তে শুরু করেছে।
তখন সে আঙ্গুলের ডগায় যেন এক ক্রমশ বেড়ে ওঠা কামনা অনুভব করতে থাকল। সে স্ত্রীর কপালে আঙ্গুল ঘষে ঘষে সব উদ্বেগ, সব দুশ্চিন্তা দূর ক’রে দেওয়ার চেষ্টা করল। তার হাতের তালু গরম হ’য়ে উঠল।
আর একবার চুপ ক’রে বসে থেকে সে এই নতুন মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকল।
স্ত্রীর মা এবং ছোটবোন ভিতরে আসল। “তুমি নিশ্চয়ই ট্রেনজার্নি ক’রে ক্লান্ত। দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নাও...ওহ্!”
মার দু’চোখ বেয়ে হঠাত্ জল গড়িয়ে পড়ল। “মানুষের আত্মা এক ভয়ংকর জিনিষ। তুমি ফিরে না এলে ও পুরোপুরি মারা যেতে পারছিল না। কী আশ্চর্য। তুমি ওর দিকে শুধু একবার তাকিয়েছ আর ওর মুখ কী অদ্ভুত শিথিল, নরম হ’য়ে গেছে...ঠিক আছে। এখন সব ঠিক আছে।”
স্ত্রীর ছোটবোনের চোখগুলোতে এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য ভাসছে। সে তার দিকে তাকাল। রাগ ঝরে পড়ছে সে চোখে। তারপর মেয়েটিও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
0 মন্তব্যসমূহ