অনুবাদ : সুব্রত বড়ুয়া
অবশেষে এল সেই মুহূর্তটি। সে ট্রিগার টেনে ধরল আর স্যাম ফাদার্স সেই উষ্ণ রক্ত মাখিয়ে দিল তার মুখে এবং সে আর বালক রইল না, রূপান্তরিত হলো একজন শিকারি এবং একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষে। এটিই ছিল সর্বশেষ দিন। সেদিন বিকেলেই ক্যামন গুটিয়ে নিল তারা বেং বেরিয়ে গড়ল সেখানে থেকে। ম্যাককাসলিন, মেজর দ্য স্পেন, জেনারেল কম্পসন ও বুন অশ্বপৃষ্ঠে, ওয়াল্টার ইউয়েল এবং নিগ্রোরা তার সাথে ওয়াগনে এবং সেই সঙ্গে স্যাম, তার চামড়া ও হরিণের শিংগুলো সহ। ওয়াগনে অন্যান্য ট্রফিও থাকতে পারত এবং তা ছিলও।
কিন্তু ওর কাছে সেগুলোর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কেবল বাস্তব কারণেই সে এবং স্যাম ফাদার্স ছিল অনেকটা একসাথে যেমনটি ছিল তারা সকাল থেকেই। ওয়াগন চলছিল উঁচু নিচু এবড়ো-থেবড়ো পথ ধরে-দুপাশে ঘন বৃক্ষরাজির দেয়াল, মাথার উপরেও ডালপালার বিস্তার- অরণ্য যেন হাত ধরে চলছিল তাদের সাথে সাথে। ওর মনে পড়ছিল সেই গুলীর কথা, সেই হরিণটির কথা, স্যাম এবং তার নিজের কথা, স্যাম যা তার মুখে মেখে দিয়েছিল সেই রক্তের কথা আর স্যাম যখন বলেছিল সে ঠিকভাবে সবকিছু করেছে তখন যে বন্যতা তাকে গ্রাস করেছিল তার কথা। স্যাম যখন হঠাৎ করে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল এবং ওয়াগনটি দাঁড়িয়ে গেল তখন সবাই নির্ভুলভাবে শুনল কখনো ভুলতে না পারার মতো হরিণের দ্রুত ছুটে যাওয়ার শব্দ।
ওরা যখন ওয়াগনের ভেতর অনড় বসেছিল তখন ট্রেইলের বাঁকের পেছন থেকে চিৎকার করে উঠেছিল বুন, ওয়াল্টার এবং ছেলেটির হাত এর মধ্যেই চলে গিয়েছিল তাদের বন্দুকে, খচ্চরটাকে তার টুপি দিয়ে মারতে মারতে বুন এগিয়ে এল তার মুখ বন্য এবং আনন্দোজ্জ্বল হয়ে উঠল চিৎকার করার সময়। তখন অন্য অশ্বারোহীরাও ঘোড়া ছুটিয়ে চলে এল বাঁকটিতে।
‘কুকুরগুলো নামাও,’ বুন চিৎকার করে বলল, ‘কুকুরগুলো নিয়ে আসো। যদি ওর মাথায় কোনো গুল লেগে থাকে তাহলে কোথাও ও আছে। সম্ভবত ওটি আছে রাস্তার পাশে বেনাপটির পেছনে। আমার পকেট-ছুরি দিয়ে ওর গলাটা কেটে ফেলতে পারব আমি।’
‘হয়ত সেজন্যই সেটি দৌড়ে যাচ্ছে, ওয়াল্টার বলল। ‘ওটি দেখেছে যে তোমার হাতে কখনো কোনো বন্দুক ছিল না। এর মধ্যেই রাইফেল হাতে সে নেমে এসেছে ওয়াগন থেকে। এবার ছেলেটিও নেমে এল তার বন্দুক হাতে এবং অন্য অশ্বারোহীরাও এগিয়ে এল কাছে। বুন কোনোভাবে নেমে এল তার খচ্চরের পিঠ থেকে। ওয়াগনের ভেতর জিনিসপত্তর ওলট-পালট করতে করতে সে তখনো চিৎকার করছিল; কুকুরগুলো নিয়ে আসো। ‘কুকুরগুলো নিয়ে আসো। ছেলেটির মনে হচ্ছিল বুড়ো লোকগুলির অনন্তকাল লাগবে কি করবে তা ঠিক করতে। ওদের রক্ত ঠান্ডা এবং ধীরগতি হয়ে গেছে, ওর আর অই লোকগুলোর মধ্যে সময়ের যে ব্যবধান সেই ব্যবধানে বদলে গেছে ওদের রক্ত, ঠান্ডা হয়ে গেছে রক্তের উপাদানগুলো- এবং এমনকি বুন আর ওয়াল্টারেরও তা ঘটেছে।
‘কি হয়েছে, স্যাম?’ মেজর দ্য স্পেন বলল। ‘কুকুরগুলো কি ওটাকে নিয়ে আসতে পারবে?’
‘কুকুরগুলোর কোনো প্রয়োজন হবে না,’ স্যাম বলল। ‘যদি সে তার পেছনে কুকুরগুলোর ডাক না শোনে, তাহলে বৃত্তের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে সূর্যাস্তের সময় সে এখানে এসে লুটিয়ে পড়বে।’
‘ঠিক আছে,’ মেজর দ্য স্পেন বলল। ‘তোমরা ঘোড়াগুলো নিয়ে যাও। আমরা ওয়াগনে চেপে রাস্তায় গিয়ে উঠব। সেখানেই অপেক্ষা করব আমরা।’সে, জেনারেল কম্পসন এবং ম্যাককাসলিন ওয়াগনে উঠে বসল এবং বুন, ওয়াল্টার, স্যাম ও ছেলেটি ঘোড়ায় চাপল, তারপর ট্রেইল ধরে পেছন দিকে এগিয়ে গেল। এক ঘণ্টা ধরে, অপরাহ্নের সেই ধূসর ও অচিহ্নিত আলোর মধ্যে দিয়ে স্যাম ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। তারপর স্যাম ওদের থামতে বলল।
‘অনেকদূর এসেছি আমরা,’ সে বলল। ‘ওটি আসবে বাতাসের উল্টোদিকে আর খচ্চরের গন্ধ ওটি পছন্দ করে না।’ঘোড়াগুলোকে ওরা একটি ঝোপের সাথে বাঁধল। এবার স্যাম হাঁটতে হাঁটতে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল ওদের। বিশেষত্বহীন এক অপরাহ্ন। আর ওরা কোনো পথ ধরেও এগোচ্ছিল না। ছেলেটি হাঁটছিল স্যামের একেবারে পেছন পেছন আর বাকি দুজন চলছিল একেবারে ওর গায়ের ওপর হুমড়ি খাওয়ার মতো করে; অন্তত ছেলেটির তাই মনে হচ্ছিলো। কিন্তু আসলে তারা সেভাবে হাঁটছিল না। দু বার স্যাম আলতো করে পেছন ফিরে হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে বলেছিল : তোমার হাতে সময় আছে। ওর আগেই আমরা পৌছে যাব সেখানে।
অতত্রব সে চেষ্টা করছিল আরো ধীরে চলতে। সে ইচ্ছে করেই চেষ্টা করছিল সময়ের অলস ছুটে চলাকে ধীরতর করে দিতে- যে সময়ের মধ্যে এমনকি তার তখনো পর্যন্ত অদেখা হরিণটি ছুটে চলছিল। যেন তার মনে হচ্ছিল ওই সময় হরিণটিকে তাদের কাছ থেকে দূরে, আরো দূরে, সরিয়ে নিয়ে যাছিল- যদিও ওকে তাড়া করার কুকুরগুলো ওর পেছনে ছুটে আসছিল না, তবুও, স্যাম- এর মতে, হরিণটি অবশ্যই এখন তার বৃত্তটি সম্পূর্ণ করেছে এবং এখন ফিরে আসছে তাদের দিকেই। ওরা সবাই এগিয়ে যাচ্ছিল; সম্ভবত আরো এক কি দুই ঘণ্টা ধরে কিংবা ধরা যাক আধ ঘণ্টা কম। ছেলেটি তা ঠিক বলতে পারবে না। তারা এসে পৌঁছাল ঢালু পর্বতশীর্ষের একটি উঁচু সরু স্থানে। এর আগে সে কখনো আর এখানে আসে নি এবং সেটি দুদিকে ঢালু একটি উচু স্থলভাগ এটি তার চোখেই পড়ে নি। সে কেবল জানত যে, এটি সামান্য উঁচু একটি জায়গা, কারণ নিচের ঝোপগুলো কিছুটা হালকা হয়ে নেমে গেছে আর নিচের ভূমি ঢালু হয়ে প্রায় অদৃশ্যভাবে গিয়ে শেষ হয়েছে দেয়ালের মতো বেতঝোপের সালে। স্যাম থাএল। ‘এটিই সে জায়গা,’ সে বলল। ওয়াল্টার এবং বুনকে সে বলল, ‘এই সরু উঁচু পক্ষটা ধরে এগিয়ে যাও। দুটি ক্রসিং তোমরা পাবে। তোমরা ট্র্যাকগুলিও দেখতে পাবে। যদি সে এখান দিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে এই তিন জায়গার একটিতে তোমরা তার ট্র্যাক পেয়ে যাবে।
ওয়াল্টার এক মুহূর্ত চারদিকে তাকালো। ‘আমি জানি’, সে বলল। ‘আমি তোমার হরিণটিও দেখেছি। গত সোমবার আমি এখানে এসেছিলাম। ওটি একটি ইয়ালির্ং ছাড়া আর কিছু নয়।
‘ইয়ালিং হ’বুন বলল। এতখানি পক্ষ হেঁটে আসার কারণে সে হাঁপাচ্ছিল। তার মুখে তখনো চাপা একটা রাগের চিহ্ন লেগেছিল। ‘আমি যেটি দেখেছি সেটি যদি ইয়ার্লিং হয়, তাহলে আমি এখানো শিশুই রয়ে গেছি।’
‘তাহলে আমি একটা খরগোশই দেখেছি নিশ্চয়ই।’ ওয়াল্টার বলল, ‘আমি শুনেছি- ফার্স্ট গ্রেড-এর দুবছর আগেই তুমি স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলে।’
বুন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ওয়াল্টারের দিকে তাকান। ‘তুমি যদি ওটাকে গুলী করতে না তাও তাহলে কেটে পড়ো। কোথাও বসে যাও। ঈশ্বরের দোহাই, আমি-’
‘এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তোমরা কেউই ওটাকে গুলী করতে পারবে না,’ শান্ত কন্ঠে বলল স্যাম।
‘স্যাম ঠিকই বলেছে,’ ওয়াল্টার বলল। তার পুরোনো রুপালি ব্যারেলের রাইফেলটা নিচের দিকে ধরে সে হাঁটত শুরু করল আবার। ‘আর একটু যেতে হবে আর চুপ করেও থাকতে হবে। হগ্যানব্যাক রেঞ্জ এখনো পাঁচ মাইল দূর।’ ওরা আবার হাঁটতে শুরু করল। ছেলেটি তখনো বুন-এর কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলো, যদিও তা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। তখন আবার সে আর স্যাম ছোটো এক ঝোপঝাড়ের মধ্যে একটি বিশাল ওক গাছের নিচে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে পড়ল একে অপরের গা ঘেঁষে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। ম্লান আলোয় কেবল উঁচু একটি জায়গায় শান্ত নির্জনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল ওরা। ওদের চারপাশে কেবল সারাদিন ধরে চলতে থাকা হালকা ঠান্ডা বৃষ্টির ক্ষীণ ফিসফিস শব্দ রইল জেগে। যেন সেই অস্পষ্ট ফিসফিসানি অপেক্ষা করছিল ওদের এই দাঁড়ানোর জন্য- যেন অরণ্য নিশ্বাস ফেলছিল আবার। মনে হচ্ছিল ওর- সেই মৃদু নিঃশব্দপ্রায় ধ্বনি ঝুলে পড়ছিল তার নিজের এবং স্যাম, ওয়াল্টার ও বুন এর ওপর- ওদের চারজনের অবস্থানের ওপর- আর সেই হরিণটি নড়াচড়া করছিল কোথাও, দৌড়াচ্ছিল না- কেননা তাড়া করছিল না ওকে কেউ ভয়ও পায় নি সেটি, কিন্তু সতর্ক হয়ে আছে সারাক্ষণ ওদেরই মতো। সম্ভবত বৃত্তটিকে বড়ো করতে করতে পিছিয়ে যাচ্ছিল সেটি, সম্ভবত খুব কাছে, সম্ভবত প্রাচীন সেই অমর পরিচালকের দৃষ্টিতে সচেতন থেকেই। ওর বয়স যেহেতু বারো বছর, এবং সেই সকালেই ওর জীবনে কিছু একটা ঘটে গেছে- অতএব সে আর গতকালের বালকটি ছিল না তখন। অথবা সম্ভবত ওতে তার তেমন কোনো পরিবর্তনও ঘটে নি, সম্ভবত শহুরে একজন মানুষের, একজন বালক হওয়া সত্ত্বেও, সে বুঝতে পারছিল না কিছুই। সম্ভবত প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ে ওঠা যে কারো মতো সে-ও তার জীবনযাপনকে ভালোবেসে ফেলেছিল। আবার কাঁপতে শুরু করেছিল সে।
‘ওটা শুরু হয়েছে বলে আমার আনন্দ হচ্ছে,’ ফিসফিস করে সে বলল নিজেকে। সে নড়ল না একটুও; কেবল তাঁর ঠোঁটগুলো ফাঁক করে বিড়বিড় করছিল সে : বন্দুক তুললেই এটা চলে যাবে।’
স্যামও কথা বলছিল না। ‘চুপ’, সে বলল।
‘ওটি কি কাছে?’ ছেলেটি ফিসফিস করে বলল, ‘তোমার কি মনে হয়--
‘চুপ’, স্যাম বলল। সে চুপ করলো। কিন্তু কাঁপুনি বন্ধ হলো না তার। বন্ধ করার চেষ্টাও করল না সে। সে জানে যখন তার স্থির অচঞ্চল থাকার প্রয়োজন হবে তখন আপনাআপনিই সেটি চলে যাবে। স্যাম ফাদার্স কী তাকে দুর্বলতা ও দুঃখবোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করে এনে আত্মোৎসর্গ করতে শেখায় নি? এবং তা কেবল আড়ম্বর ও গতিময়তার মধ্যে তার জীবনের যে ভালোবাসা ও দয়া নিয়ে বেঁচে থাকার ব্যাপারই নয়, বরং দুর্বলতা ও দুঃখবোধের মধ্যে থেকে এক মুহূর্তের জন্য বেরিয়ে আসার ব্যাপারও। তারা অনড় দাঁড়িয়ে রইল। গভীর নিশ্বাস পড়ছিল ওদের , কিন্তু তারা ছিল শান্ত ও অচঞ্চল। যদি সেখানে কোনো সূর্য থেকেও ছিল, তাহলে তা এখন অস্তাচলের পথে। ঘনায়মান অন্ধকারকে সে মনে করেছিল ধূসর ও অপরিবর্তনীয় আলো বলে এবং হঠাৎ সে উপলব্ধি করলো যে- এ হচ্ছে তার নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস, তার হৃদয়, তার রক্ত- এমন একটা কিছু কিংবা সবকিছু এবং আসলে স্যাম ফাদার্স তাকে কেবল শিকারি হিসেবে নয়, বরং তার হারিয়ে যাওয়া বিস্মৃত স্বজনদের কিছু একটা প্রতিফলনের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছিল।
নিশ্বাস ফেলতে ভুলে গেল সে। রইল কেবল তার হৃদয় এবং রক্ত, এবং পেছন পেছন আসতে-থাকা নীরবতার মধ্যে সেই জন্য উদ্দামতাও যেন হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। যেন সেটি ঠেস দিয়ে, উপুড় হয়ে, মাথার ওপর ঝুলে থেকে অসম্ভব কঠিন এক চেষ্টায় নিজের নিশ্বাসটুর চেপে দাঁড়িয়ে ছিল। ততক্ষণে কাঁপুনিও থেকে গিয়েছিল তার, যেমনটি সে ভেবেছিল আগেই। সে তার বন্দুকের ভারি হ্যামার দুটি পেছনদিকে টেনে নিল।
তারপর সেটি বেরিয়ে গেল। সাঙ্গ হলো সব। উৎকঠন্ঠার পুনরাবির্ভাব ঘটল-না আর। ওদের দিকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে ওর এবং এখন অন্যদিকে তাকাচ্ছে, এমনকি হয়ত ওদের দিকে পেছন ফিরে তাকিয়ে আছে পর্বতশীর্ষের মরু উচ্চভূমির ওপর দিয়ে অন্য কোনো দিকে। আর ছেলেটি জানে, যেন সে নিজের চোখেই দেখেছে, হরিণটি বেতঝোপের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল এবং হয় ওদের দেখেছিল কিংবা ওদের গায়ের গন্ধ পেয়েছিল। কিন্তু সেই উৎকণ্ঠা আর জড়িয়ে ধরল না ওদের। এটি আবার ওদের ঘিরে ধরা উচিত ছিল। কিন্তু না, তেমনটি আর ঘটল না। এটি তখনো ওদের দিকে তাকিয়ে ওদের দেখছে এবং এটি ওখানে নেই, যেখানে স্যাম আর ও নিজে দাঁড়িয়ে। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে, যেন নিশ্বাস ফেলতেও ভুলে গেছে। সে বলে উঠল, না না! সে-তো জেনেই গেছে যে- অনেক বিলম্ব ঘটে গেছে। দু বছর বা তিন আগের সেই পুরোনো হতাশা ঘিরে ধরল তাকে; আমি কখনো ঠিকভাবে গুলী ছুঁড়তে পারব না। আর তখনই শব্দটি শুনল সে- ওয়াল্টার ইওয়েল এর রাইফেলের মোটা একক শব্দ। ওর রাইফেলের গুলী কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। এর পরপরই পাহাড়ের খাড়াইয়ের নিচে থেকে শিঙার মাতাল শব্দ এল ভেসে। কিছু একটা যেন বেরিয়ে চলে গেলো ওর কাছ থেকে এবং সে জেনে গেল- আসলে ঠিকভাবে গুলী করার আশাও সে কখনো করে নি।
‘আমার মনে হচ্ছে এটিই সেটি; সে বলল। ‘ওয়াল্টার ওকে পেয়েছো।’নিজের অজান্তেই বন্দুকটা সামান্য একটু উঁচু করল সে। তারপর আবার নামিয়ে নিল। একটি হ্যামারও নামিয়ে নিল সে এবং ঝোপের বাইরে আসতে যেতেই স্যাম বলল।
‘দাঁড়াও’ ‘দাঁড়াও।’ চেঁচিয়ে উঠল ছেলেটি। সারাজীবন তার মনে থাকবে- কেমন করে সে মুহূর্তে সুযোগ নষ্ট হওয়ার গাভীর দুঃখে স্যাম-এর ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল সে। ‘কেন? দাঁড়াব কেন? শিঙার শব্দ কি তুমি শোনো নি?’
তার মনে পড়ছিল স্যাম কিভাবে দাঁড়িয়েছিল। স্যাম একটুও নড়ে নি। সে তেমন লম্বা ছিল না, বরং ছিল কিছুটা খাটো ও মোটা এবং স্থূলকায়, আর গত এক বছর ধরে ছেলেটা খুব তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে উঠছিল অথবা তেমন একটা কিছু এবং দৈর্ঘ্যরে দিক থেকে ওদের মধ্যে পার্থক্য তেমন একটা ছিল না যদিও, তবু স্যাম ছেলেটির মাথার ওপর দিয়ে ও দুই ঢালু উচ্চভূমির শীর্ষ রেখা পেরিয়ে শিঙার শব্দ যেদিক থেকে আসছিল সেদিকে তাকাল আর ছেলেটি জানত যে স্যাম এমনকি তাকে দেখতেও পায় নি; স্যাম জানত যে ছেলেটি তার পাশেই আছে, কিন্তু সে ছেলেটিকে দেখতে পায় নি। তখন ছেলেটি দেখতে পেয়েছিল হরিণটিকে। সেটি উচ্চভূমির খাড়া পাড় থেকে নেমে আসছে, যেন সেটি বেরিয়ে আসছিল তার মৃত্যুধ্বনি সেই শিঙার শব্দের আওতা থেকে। সেটি তখন দৌড়াচ্ছে না, হাঁটছে, প্রবলভাবে, কিন্তু কোনো তাড়াহুড়ো নেই, ঢালু তির্যক ভঙ্গিতে ও নিদের মাথা দোলাতে দোলাতে- ছোটো ছোটো ঝোপঝাড়, গাছ, গুল্প ইত্যাদির ভেতর দিয়ে নিজের শিংগুলোকে পার করে নিয়ে যাওয়ার সময় আর ছেলেটি এখন দাঁড়িয়ে ছিল স্যাম-এর পাশে, বরাবরের যেমন দাঁড়াত তেমন ভাবে পেছনে নয়, এবং বন্দুকটা তখনো আংশিকভাবে তাক করা, আর হ্যামারগুলির মধ্যে একটি গুঁলি ছোঁড়ার অবস্থানে।
তখনই হরিণটি ওদের দেখতে পেল। কিন্তু তবুও দৌড়াতে শুরু করল না সেটি। এক মুহূর্তের জন্য মাত্র দাঁড়িয়ে পড়ল সেটি, যে-কোনো মানুষের চেয়ে লম্বা, তাকিয়ে রইল ওদের দিকে; এর পরই ওর মাংসপেশি শিথিল হয়ে উঠল একটু, তারপর সংহত। কিন্তু ওর চলার দিক পরিবর্তন করল না, ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে চাইল না, দৌড়াতেও নয়, ওদের বিশ ফুটের মধ্যে, যেমন করে হরিণেরা এগিয়ে যায় তেমনি যেন ডানায় ভর করে অনায়াস গতিতে ওদের অতিক্রম করছিল। মাথাটা উঁচু, চোখে গর্ব কিংবা ঔদ্ধত্য কিছুই নেই, কিন্তু আছে পুরো চোখে একটা বন্য ভয়ডরহীন ভাব, এবং এখন ছেলেটার পাশে স্যাম তার ডান হাত পুরোপুরি তুলল, প্রসারিত করল হাতের তালু, কথা বলল সেই ভঙ্গিতে ছেলেটি যা শিখেছিল কামারশালায় জো বেকার এবং তার কাছ থেকে। এদিকে উপত্যকার খাড়া শীর্ষের ওপরে ওয়াল্টার ইউয়েল-এর শিঙা তখনো বেজে চলছিল একটা মরা হরিণের কথা তাদের জানিয়ে দিতে দিতে।
‘ওলে, চীফ,’ স্যাম বলেছিল, গ্রান্ডফাদার।’ ওরা যখন ওয়াল্টারের কাছে গিয়ে পৌঁছল তখন সে দাঁড়িয়ে ছিল ওদের দিকে পেছন ফিরে, তখনো শান্ত, যেন হতবুদ্ধি, তাকিয়ে আছে তার পায়ের দিকে। মোটেই সে চোখ তুলে তাকাল না।
‘এদিকে আসো, স্যাম’, শান্তভাবে বলল সে। ওরা যখন ওর কাছে গিয়ে পৌঁছাল তখনো সে মুখ তুলে তাকায় নি। সে দাঁড়িয়ে ছিল ছোটো একটা সরু মুখের হরিণের ওপর, যে কিনা গত বসন্তেও ছিল একটি শাবক মাত্র। ‘ওটি এত ছোটো যে আমি ওকে প্রায় ছেড়েই দিচ্ছিলাম’, ওয়াল্টার বলল। ‘কিন্তু, দেখ ওর পায়ের ছাপগুলো। যেন প্রায় একটা বড়ো গরুর মতো। ওর পায়ের ছাপের কাছে যদি আরো কোনো পায়ের ছাপ থাকত, তাহলে, দোহাই বলছি, আমি নিশ্চয়ই ভাবতাম যে ওখানে আরো একটি হরিণ ছিল, যাকে আমি এমন কি একবারও দেখতে পাই নি।’
রাস্তায় দু-আসনের ঘোড়ায় টানা চার চাকার গাড়িটি যেখানে ছিল সেখানে ওরা যখন পৌঁছল তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। ঠান্ডা লাগছিল ওদের, বৃষ্টি থেমে গেছে, আর আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। ওর কাজিন এবং মেজর দ্য স্পেন ও জেনারেল কম্পসন আগুন জ্বালিয়ে বসেছিল। ‘ওটা পেয়েছ তুমি?’
মেজর দ্য স্পেন জিজ্ঞেস করেছিল।
‘ছুঁচোলো-শিঙের একটা বড়ো আকারের জলাভূমির খরগোশ পেয়েছি’, ওয়াল্টার বলল। ওর গাধার পিঠ থেকে ছোটো হরিণটাকে গড়িয়ে নিচে ফেলল সে, ছেলেটির কাজিন ম্যাককাসলিন ওটার দিকে দেখল একবার।
‘বড়োটাকে কেউ দেখে নি?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘আমি এমনকি বিশ্বাসও করি না যে বুন ওটা দেখেছিল’, ওয়াল্টার বলল। সে মনে হয় সম্ভবত কারো খড়ের তৈরি গরুর ওপর লাফ দিয়ে পড়েছিল বুন অভিশাপ দিতে শুরু করল, কুকুরগুলোকে প্রথম জায়গাটিতেও হরিণটির কাছে না নেওয়ার জন্য গালাগাল দিয়ে চলল ওয়াল্টার এবং স্যামকে।
‘কিছু মনে কোরো না’, মেজর দ্য স্পেন বলল। ‘আগামী হেমন্তেই ও আমাদের জন্যে এখানে চলে আসবে। চলো এবার বাড়ি ফিরে যাই।’
জেফারসন থেকে দু মাইল দূরের বাড়ির ফটকে ওয়াল্টারকে যখন ওরা নামিয়ে দিল তখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। জেনারেল কম্পসনকে তার বাড়িতে পৌঁছাতে আরো দেরি হলো, তারপর ওরা ফিরে গেল মেজর দ্য স্পেন-এর বাড়িতে এবং ঠিক করল সেখানেই বাকি রাতটা কাটাবে ওরা, যেহেতু ওদের বাড়ি আরো সতেরো মাইল দূরে। খুব ঠান্ডা পড়ছিল তখন আকাশ পরিষ্কার; ভোরে সূর্য যখন উঠবে তখন ভারী কুয়াশা পড়বে এখনই ঘোড়াগুলোর পা গাড়ির চাকা এবং তাদের পায়ের নিচে মাটি ভিজে গেছে কুয়াশায়- মেজর দ্য স্পেন-এর বাড়ির সামনে আঙ্গিনা পেরিয়ে বাড়িতে ঢোকার সময়ই টের পেল তারা। অন্ধকার ঢাকা উষ্ণ বাড়িটা, অন্ধকারের ভেতর দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠার সময় তারা টের পেল সে উচ্চতা; সেই আঁধারের মধ্যে মেজর দ্য স্পেন মোমবাতিটা খুঁজে বের করে বাতিটা না জ্বালানো পর্যন্ত। তারপর তারা ঢুকে পড়ল সেই আশ্চর্য কক্ষটিতে, বড়ো ও গভীর বিছানাটিতে উঠে তখনো পর্যন্ত ঠান্ডা চাদরের নিচে ঢুকে পড়ে নিজেদের শরীর গরম করতে শুরু করল ওরা। এবং শেষ পর্যন্ত গায়ের কাঁপুনি থামলে হঠাৎ ছেলেটি ম্যাককাসলিনকে বলতে শুরু করল সে ঘটনাটির কথা। ম্যাককাসলিন শান্তভাবে ওর কথাগুলো শুনল।’‘তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো নি’, ছেলেটি বলল। ‘আমি জানি তুমি করো নি-’।
‘কেন করব না?’ ম্যাককাসলিন বলল। ভেবে দেখো এখানে কি কি ঘটেছিল। বাঁচার জন্যে, সুখের জন্যে সে উষ্ণ ও সতেজ রক্ত প্রয়োজন তা আবার শুষে নিয়েছিল মাটি। অবশ্য শোক প্রকাশ আর কষ্টভোগের জন্যেও, তবে এখনো এর থেকে কিছু পেয়ে যাচ্ছে, কারণ শেষ পর্যন্ত তোমাকে যা সহ্য করে যেতে হবে না বলে তুমি যা বিশ্বাস করো তা হলো কষ্ট; তুমি সবসময় তা বন্ধ করতে, শেষ করতে চাইতে পারো। আর এমন কি কোনো কিছু না থাকার চেয়ে বরং কষ্ট পাওয়া ও শোক প্রকাশ করাও অনেক ভালো; বেঁচে না থাকার চেয়ে খারাপ মাত্র একটি জিনিসই আছে, সেটি হচ্ছে লজ্জা। কিন্তু তুমি চিরকাল বেঁচে থাকতে পারবে না, এবং বেঁচে থাকার সম্ভাবনাগুলো ফুরিয়ে যাওয়ার অনেক আগেই তুমি সবসময় তোমার জীবনটাকে নিঃশেষ করে ফেলবে। আর সে-সব কিছুই নিশ্চয়ই কোথাও থেকে যাবে; শুধু ছুঁড়ে ফেলে দেবার জন্যই যা কিছু উদ্ভাবন ও সৃষ্টি করা যেতে পারত। আর পৃথিবীটা হচ্ছে সামান্য একটা কিছু; এই পাথুরে পাহাড়ে আসার আগে তার অনেক কিছুই তুমি দেখনি। এই পৃথিবী কোনো কিছুই রেখে দিতে বা জমিয়ে রাখতে চায় না; সেগুলোকে আবার ব্যবহার করতে চায়। বীজ, ওকফল- এগুলোর দিকে চেয়ে দেখ, এমনকি নোংরা আবর্জনাও যখন পুঁতে ফেলতে চেষ্টা করো- তখন কী ঘটে সে ব্যাপারটার কথা মনে করে দেখ: সেখানে তা থাকতে চায় না, নড়ে-চড়ে ওঠে, আলো আর বাতাসের কাছে না-পৌঁছা পর্যন্ত লড়াই করতে থাকে এবং এর পরও সূর্যের আলো খুঁজে বেড়ায়। এবং ওরা-’ছেলেটি জানালার বিপরীতে ছায়ারেখার মতো তার হাতটাকে দেখল, যার পেছনে, এখন অন্ধকার সয়ে আসার ফলে সে দেখতে পারছিল আকাশটাকে সেখানে ঘষে পরিষ্কারকরা নিরুত্তাপ তারাগুলি জ্বলজ্বল করছিল ‘-ওরা তা চায় না, ওদের এসবের প্রয়োজন নেই। তাছাড়া, সে নিজে কী চাইতে পারে, ওখানে ঘুরে ঘুরে আঘাত করতে করতে, যখন মাটি যেভাবে রয়েছে সে-ব্যাপারে মোটেই যথেষ্ট সময় নেই ওদের, যখন মাটির ওপরে এখনো অনেক জায়গা রয়ে গেছে, অনেক জায়গা যা এখনো একেবারে আগের মতো, পরিবর্তনহীন, যখন রক্ত ঝরেছিল সেখানে এবং ওর মধ্যে সুখের অনুভূতি খুঁজে পেয়েছিল যখন তা তখনো রক্তই ছিল?
‘কিন্তু আমরা ওদের চাই,’ ছেলেটি বলল। ‘আমরা ওদেরও চাই। এখানে ওদের এবং আমাদের জন্যও অনেক জায়গা আছে।’‘সে-কথা ঠিক,’ ম্যাককাসসিন বলল। ‘ধরো ওদের মধ্যে কোনো বস্তু নেই, ওরা কোনো ছায়া ফেলতে পারে না-’
কিন্তু আমি ওটা দেখেছি!’ ছেলেটি চিৎকার করে বলল। ‘আমি দেখেছি ওকে!’
‘শান্ত হও,’ ম্যাককাসসিন বলল। এক মুহূর্তের জন্য ওর হাতটা চাদরের নিচে ছেলেটির পাঁজরা ও নিতম্বের মধ্যবর্তী মাংসল পার্শ্বদেশ ছুঁয়ে গেল। ‘শান্ত হও আমি জানি- তুমি দেখেছ। তোমার মতো আমিও দেখেছি। আমার জীবনে প্রথম হরিণটি মারার পর স্যাম একবার আমাকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল।’
অবশেষে এল সেই মুহূর্তটি। সে ট্রিগার টেনে ধরল আর স্যাম ফাদার্স সেই উষ্ণ রক্ত মাখিয়ে দিল তার মুখে এবং সে আর বালক রইল না, রূপান্তরিত হলো একজন শিকারি এবং একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষে। এটিই ছিল সর্বশেষ দিন। সেদিন বিকেলেই ক্যামন গুটিয়ে নিল তারা বেং বেরিয়ে গড়ল সেখানে থেকে। ম্যাককাসলিন, মেজর দ্য স্পেন, জেনারেল কম্পসন ও বুন অশ্বপৃষ্ঠে, ওয়াল্টার ইউয়েল এবং নিগ্রোরা তার সাথে ওয়াগনে এবং সেই সঙ্গে স্যাম, তার চামড়া ও হরিণের শিংগুলো সহ। ওয়াগনে অন্যান্য ট্রফিও থাকতে পারত এবং তা ছিলও।
কিন্তু ওর কাছে সেগুলোর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কেবল বাস্তব কারণেই সে এবং স্যাম ফাদার্স ছিল অনেকটা একসাথে যেমনটি ছিল তারা সকাল থেকেই। ওয়াগন চলছিল উঁচু নিচু এবড়ো-থেবড়ো পথ ধরে-দুপাশে ঘন বৃক্ষরাজির দেয়াল, মাথার উপরেও ডালপালার বিস্তার- অরণ্য যেন হাত ধরে চলছিল তাদের সাথে সাথে। ওর মনে পড়ছিল সেই গুলীর কথা, সেই হরিণটির কথা, স্যাম এবং তার নিজের কথা, স্যাম যা তার মুখে মেখে দিয়েছিল সেই রক্তের কথা আর স্যাম যখন বলেছিল সে ঠিকভাবে সবকিছু করেছে তখন যে বন্যতা তাকে গ্রাস করেছিল তার কথা। স্যাম যখন হঠাৎ করে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল এবং ওয়াগনটি দাঁড়িয়ে গেল তখন সবাই নির্ভুলভাবে শুনল কখনো ভুলতে না পারার মতো হরিণের দ্রুত ছুটে যাওয়ার শব্দ।
ওরা যখন ওয়াগনের ভেতর অনড় বসেছিল তখন ট্রেইলের বাঁকের পেছন থেকে চিৎকার করে উঠেছিল বুন, ওয়াল্টার এবং ছেলেটির হাত এর মধ্যেই চলে গিয়েছিল তাদের বন্দুকে, খচ্চরটাকে তার টুপি দিয়ে মারতে মারতে বুন এগিয়ে এল তার মুখ বন্য এবং আনন্দোজ্জ্বল হয়ে উঠল চিৎকার করার সময়। তখন অন্য অশ্বারোহীরাও ঘোড়া ছুটিয়ে চলে এল বাঁকটিতে।
‘কুকুরগুলো নামাও,’ বুন চিৎকার করে বলল, ‘কুকুরগুলো নিয়ে আসো। যদি ওর মাথায় কোনো গুল লেগে থাকে তাহলে কোথাও ও আছে। সম্ভবত ওটি আছে রাস্তার পাশে বেনাপটির পেছনে। আমার পকেট-ছুরি দিয়ে ওর গলাটা কেটে ফেলতে পারব আমি।’
‘হয়ত সেজন্যই সেটি দৌড়ে যাচ্ছে, ওয়াল্টার বলল। ‘ওটি দেখেছে যে তোমার হাতে কখনো কোনো বন্দুক ছিল না। এর মধ্যেই রাইফেল হাতে সে নেমে এসেছে ওয়াগন থেকে। এবার ছেলেটিও নেমে এল তার বন্দুক হাতে এবং অন্য অশ্বারোহীরাও এগিয়ে এল কাছে। বুন কোনোভাবে নেমে এল তার খচ্চরের পিঠ থেকে। ওয়াগনের ভেতর জিনিসপত্তর ওলট-পালট করতে করতে সে তখনো চিৎকার করছিল; কুকুরগুলো নিয়ে আসো। ‘কুকুরগুলো নিয়ে আসো। ছেলেটির মনে হচ্ছিল বুড়ো লোকগুলির অনন্তকাল লাগবে কি করবে তা ঠিক করতে। ওদের রক্ত ঠান্ডা এবং ধীরগতি হয়ে গেছে, ওর আর অই লোকগুলোর মধ্যে সময়ের যে ব্যবধান সেই ব্যবধানে বদলে গেছে ওদের রক্ত, ঠান্ডা হয়ে গেছে রক্তের উপাদানগুলো- এবং এমনকি বুন আর ওয়াল্টারেরও তা ঘটেছে।
‘কি হয়েছে, স্যাম?’ মেজর দ্য স্পেন বলল। ‘কুকুরগুলো কি ওটাকে নিয়ে আসতে পারবে?’
‘কুকুরগুলোর কোনো প্রয়োজন হবে না,’ স্যাম বলল। ‘যদি সে তার পেছনে কুকুরগুলোর ডাক না শোনে, তাহলে বৃত্তের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে সূর্যাস্তের সময় সে এখানে এসে লুটিয়ে পড়বে।’
‘ঠিক আছে,’ মেজর দ্য স্পেন বলল। ‘তোমরা ঘোড়াগুলো নিয়ে যাও। আমরা ওয়াগনে চেপে রাস্তায় গিয়ে উঠব। সেখানেই অপেক্ষা করব আমরা।’সে, জেনারেল কম্পসন এবং ম্যাককাসলিন ওয়াগনে উঠে বসল এবং বুন, ওয়াল্টার, স্যাম ও ছেলেটি ঘোড়ায় চাপল, তারপর ট্রেইল ধরে পেছন দিকে এগিয়ে গেল। এক ঘণ্টা ধরে, অপরাহ্নের সেই ধূসর ও অচিহ্নিত আলোর মধ্যে দিয়ে স্যাম ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। তারপর স্যাম ওদের থামতে বলল।
‘অনেকদূর এসেছি আমরা,’ সে বলল। ‘ওটি আসবে বাতাসের উল্টোদিকে আর খচ্চরের গন্ধ ওটি পছন্দ করে না।’ঘোড়াগুলোকে ওরা একটি ঝোপের সাথে বাঁধল। এবার স্যাম হাঁটতে হাঁটতে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল ওদের। বিশেষত্বহীন এক অপরাহ্ন। আর ওরা কোনো পথ ধরেও এগোচ্ছিল না। ছেলেটি হাঁটছিল স্যামের একেবারে পেছন পেছন আর বাকি দুজন চলছিল একেবারে ওর গায়ের ওপর হুমড়ি খাওয়ার মতো করে; অন্তত ছেলেটির তাই মনে হচ্ছিলো। কিন্তু আসলে তারা সেভাবে হাঁটছিল না। দু বার স্যাম আলতো করে পেছন ফিরে হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে বলেছিল : তোমার হাতে সময় আছে। ওর আগেই আমরা পৌছে যাব সেখানে।
অতত্রব সে চেষ্টা করছিল আরো ধীরে চলতে। সে ইচ্ছে করেই চেষ্টা করছিল সময়ের অলস ছুটে চলাকে ধীরতর করে দিতে- যে সময়ের মধ্যে এমনকি তার তখনো পর্যন্ত অদেখা হরিণটি ছুটে চলছিল। যেন তার মনে হচ্ছিল ওই সময় হরিণটিকে তাদের কাছ থেকে দূরে, আরো দূরে, সরিয়ে নিয়ে যাছিল- যদিও ওকে তাড়া করার কুকুরগুলো ওর পেছনে ছুটে আসছিল না, তবুও, স্যাম- এর মতে, হরিণটি অবশ্যই এখন তার বৃত্তটি সম্পূর্ণ করেছে এবং এখন ফিরে আসছে তাদের দিকেই। ওরা সবাই এগিয়ে যাচ্ছিল; সম্ভবত আরো এক কি দুই ঘণ্টা ধরে কিংবা ধরা যাক আধ ঘণ্টা কম। ছেলেটি তা ঠিক বলতে পারবে না। তারা এসে পৌঁছাল ঢালু পর্বতশীর্ষের একটি উঁচু সরু স্থানে। এর আগে সে কখনো আর এখানে আসে নি এবং সেটি দুদিকে ঢালু একটি উচু স্থলভাগ এটি তার চোখেই পড়ে নি। সে কেবল জানত যে, এটি সামান্য উঁচু একটি জায়গা, কারণ নিচের ঝোপগুলো কিছুটা হালকা হয়ে নেমে গেছে আর নিচের ভূমি ঢালু হয়ে প্রায় অদৃশ্যভাবে গিয়ে শেষ হয়েছে দেয়ালের মতো বেতঝোপের সালে। স্যাম থাএল। ‘এটিই সে জায়গা,’ সে বলল। ওয়াল্টার এবং বুনকে সে বলল, ‘এই সরু উঁচু পক্ষটা ধরে এগিয়ে যাও। দুটি ক্রসিং তোমরা পাবে। তোমরা ট্র্যাকগুলিও দেখতে পাবে। যদি সে এখান দিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে এই তিন জায়গার একটিতে তোমরা তার ট্র্যাক পেয়ে যাবে।
ওয়াল্টার এক মুহূর্ত চারদিকে তাকালো। ‘আমি জানি’, সে বলল। ‘আমি তোমার হরিণটিও দেখেছি। গত সোমবার আমি এখানে এসেছিলাম। ওটি একটি ইয়ালির্ং ছাড়া আর কিছু নয়।
‘ইয়ালিং হ’বুন বলল। এতখানি পক্ষ হেঁটে আসার কারণে সে হাঁপাচ্ছিল। তার মুখে তখনো চাপা একটা রাগের চিহ্ন লেগেছিল। ‘আমি যেটি দেখেছি সেটি যদি ইয়ার্লিং হয়, তাহলে আমি এখানো শিশুই রয়ে গেছি।’
‘তাহলে আমি একটা খরগোশই দেখেছি নিশ্চয়ই।’ ওয়াল্টার বলল, ‘আমি শুনেছি- ফার্স্ট গ্রেড-এর দুবছর আগেই তুমি স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলে।’
বুন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ওয়াল্টারের দিকে তাকান। ‘তুমি যদি ওটাকে গুলী করতে না তাও তাহলে কেটে পড়ো। কোথাও বসে যাও। ঈশ্বরের দোহাই, আমি-’
‘এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তোমরা কেউই ওটাকে গুলী করতে পারবে না,’ শান্ত কন্ঠে বলল স্যাম।
‘স্যাম ঠিকই বলেছে,’ ওয়াল্টার বলল। তার পুরোনো রুপালি ব্যারেলের রাইফেলটা নিচের দিকে ধরে সে হাঁটত শুরু করল আবার। ‘আর একটু যেতে হবে আর চুপ করেও থাকতে হবে। হগ্যানব্যাক রেঞ্জ এখনো পাঁচ মাইল দূর।’ ওরা আবার হাঁটতে শুরু করল। ছেলেটি তখনো বুন-এর কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলো, যদিও তা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। তখন আবার সে আর স্যাম ছোটো এক ঝোপঝাড়ের মধ্যে একটি বিশাল ওক গাছের নিচে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে পড়ল একে অপরের গা ঘেঁষে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। ম্লান আলোয় কেবল উঁচু একটি জায়গায় শান্ত নির্জনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল ওরা। ওদের চারপাশে কেবল সারাদিন ধরে চলতে থাকা হালকা ঠান্ডা বৃষ্টির ক্ষীণ ফিসফিস শব্দ রইল জেগে। যেন সেই অস্পষ্ট ফিসফিসানি অপেক্ষা করছিল ওদের এই দাঁড়ানোর জন্য- যেন অরণ্য নিশ্বাস ফেলছিল আবার। মনে হচ্ছিল ওর- সেই মৃদু নিঃশব্দপ্রায় ধ্বনি ঝুলে পড়ছিল তার নিজের এবং স্যাম, ওয়াল্টার ও বুন এর ওপর- ওদের চারজনের অবস্থানের ওপর- আর সেই হরিণটি নড়াচড়া করছিল কোথাও, দৌড়াচ্ছিল না- কেননা তাড়া করছিল না ওকে কেউ ভয়ও পায় নি সেটি, কিন্তু সতর্ক হয়ে আছে সারাক্ষণ ওদেরই মতো। সম্ভবত বৃত্তটিকে বড়ো করতে করতে পিছিয়ে যাচ্ছিল সেটি, সম্ভবত খুব কাছে, সম্ভবত প্রাচীন সেই অমর পরিচালকের দৃষ্টিতে সচেতন থেকেই। ওর বয়স যেহেতু বারো বছর, এবং সেই সকালেই ওর জীবনে কিছু একটা ঘটে গেছে- অতএব সে আর গতকালের বালকটি ছিল না তখন। অথবা সম্ভবত ওতে তার তেমন কোনো পরিবর্তনও ঘটে নি, সম্ভবত শহুরে একজন মানুষের, একজন বালক হওয়া সত্ত্বেও, সে বুঝতে পারছিল না কিছুই। সম্ভবত প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ে ওঠা যে কারো মতো সে-ও তার জীবনযাপনকে ভালোবেসে ফেলেছিল। আবার কাঁপতে শুরু করেছিল সে।
‘ওটা শুরু হয়েছে বলে আমার আনন্দ হচ্ছে,’ ফিসফিস করে সে বলল নিজেকে। সে নড়ল না একটুও; কেবল তাঁর ঠোঁটগুলো ফাঁক করে বিড়বিড় করছিল সে : বন্দুক তুললেই এটা চলে যাবে।’
স্যামও কথা বলছিল না। ‘চুপ’, সে বলল।
‘ওটি কি কাছে?’ ছেলেটি ফিসফিস করে বলল, ‘তোমার কি মনে হয়--
‘চুপ’, স্যাম বলল। সে চুপ করলো। কিন্তু কাঁপুনি বন্ধ হলো না তার। বন্ধ করার চেষ্টাও করল না সে। সে জানে যখন তার স্থির অচঞ্চল থাকার প্রয়োজন হবে তখন আপনাআপনিই সেটি চলে যাবে। স্যাম ফাদার্স কী তাকে দুর্বলতা ও দুঃখবোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করে এনে আত্মোৎসর্গ করতে শেখায় নি? এবং তা কেবল আড়ম্বর ও গতিময়তার মধ্যে তার জীবনের যে ভালোবাসা ও দয়া নিয়ে বেঁচে থাকার ব্যাপারই নয়, বরং দুর্বলতা ও দুঃখবোধের মধ্যে থেকে এক মুহূর্তের জন্য বেরিয়ে আসার ব্যাপারও। তারা অনড় দাঁড়িয়ে রইল। গভীর নিশ্বাস পড়ছিল ওদের , কিন্তু তারা ছিল শান্ত ও অচঞ্চল। যদি সেখানে কোনো সূর্য থেকেও ছিল, তাহলে তা এখন অস্তাচলের পথে। ঘনায়মান অন্ধকারকে সে মনে করেছিল ধূসর ও অপরিবর্তনীয় আলো বলে এবং হঠাৎ সে উপলব্ধি করলো যে- এ হচ্ছে তার নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস, তার হৃদয়, তার রক্ত- এমন একটা কিছু কিংবা সবকিছু এবং আসলে স্যাম ফাদার্স তাকে কেবল শিকারি হিসেবে নয়, বরং তার হারিয়ে যাওয়া বিস্মৃত স্বজনদের কিছু একটা প্রতিফলনের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছিল।
নিশ্বাস ফেলতে ভুলে গেল সে। রইল কেবল তার হৃদয় এবং রক্ত, এবং পেছন পেছন আসতে-থাকা নীরবতার মধ্যে সেই জন্য উদ্দামতাও যেন হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। যেন সেটি ঠেস দিয়ে, উপুড় হয়ে, মাথার ওপর ঝুলে থেকে অসম্ভব কঠিন এক চেষ্টায় নিজের নিশ্বাসটুর চেপে দাঁড়িয়ে ছিল। ততক্ষণে কাঁপুনিও থেকে গিয়েছিল তার, যেমনটি সে ভেবেছিল আগেই। সে তার বন্দুকের ভারি হ্যামার দুটি পেছনদিকে টেনে নিল।
তারপর সেটি বেরিয়ে গেল। সাঙ্গ হলো সব। উৎকঠন্ঠার পুনরাবির্ভাব ঘটল-না আর। ওদের দিকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে ওর এবং এখন অন্যদিকে তাকাচ্ছে, এমনকি হয়ত ওদের দিকে পেছন ফিরে তাকিয়ে আছে পর্বতশীর্ষের মরু উচ্চভূমির ওপর দিয়ে অন্য কোনো দিকে। আর ছেলেটি জানে, যেন সে নিজের চোখেই দেখেছে, হরিণটি বেতঝোপের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল এবং হয় ওদের দেখেছিল কিংবা ওদের গায়ের গন্ধ পেয়েছিল। কিন্তু সেই উৎকণ্ঠা আর জড়িয়ে ধরল না ওদের। এটি আবার ওদের ঘিরে ধরা উচিত ছিল। কিন্তু না, তেমনটি আর ঘটল না। এটি তখনো ওদের দিকে তাকিয়ে ওদের দেখছে এবং এটি ওখানে নেই, যেখানে স্যাম আর ও নিজে দাঁড়িয়ে। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে, যেন নিশ্বাস ফেলতেও ভুলে গেছে। সে বলে উঠল, না না! সে-তো জেনেই গেছে যে- অনেক বিলম্ব ঘটে গেছে। দু বছর বা তিন আগের সেই পুরোনো হতাশা ঘিরে ধরল তাকে; আমি কখনো ঠিকভাবে গুলী ছুঁড়তে পারব না। আর তখনই শব্দটি শুনল সে- ওয়াল্টার ইওয়েল এর রাইফেলের মোটা একক শব্দ। ওর রাইফেলের গুলী কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। এর পরপরই পাহাড়ের খাড়াইয়ের নিচে থেকে শিঙার মাতাল শব্দ এল ভেসে। কিছু একটা যেন বেরিয়ে চলে গেলো ওর কাছ থেকে এবং সে জেনে গেল- আসলে ঠিকভাবে গুলী করার আশাও সে কখনো করে নি।
‘আমার মনে হচ্ছে এটিই সেটি; সে বলল। ‘ওয়াল্টার ওকে পেয়েছো।’নিজের অজান্তেই বন্দুকটা সামান্য একটু উঁচু করল সে। তারপর আবার নামিয়ে নিল। একটি হ্যামারও নামিয়ে নিল সে এবং ঝোপের বাইরে আসতে যেতেই স্যাম বলল।
‘দাঁড়াও’ ‘দাঁড়াও।’ চেঁচিয়ে উঠল ছেলেটি। সারাজীবন তার মনে থাকবে- কেমন করে সে মুহূর্তে সুযোগ নষ্ট হওয়ার গাভীর দুঃখে স্যাম-এর ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল সে। ‘কেন? দাঁড়াব কেন? শিঙার শব্দ কি তুমি শোনো নি?’
তার মনে পড়ছিল স্যাম কিভাবে দাঁড়িয়েছিল। স্যাম একটুও নড়ে নি। সে তেমন লম্বা ছিল না, বরং ছিল কিছুটা খাটো ও মোটা এবং স্থূলকায়, আর গত এক বছর ধরে ছেলেটা খুব তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে উঠছিল অথবা তেমন একটা কিছু এবং দৈর্ঘ্যরে দিক থেকে ওদের মধ্যে পার্থক্য তেমন একটা ছিল না যদিও, তবু স্যাম ছেলেটির মাথার ওপর দিয়ে ও দুই ঢালু উচ্চভূমির শীর্ষ রেখা পেরিয়ে শিঙার শব্দ যেদিক থেকে আসছিল সেদিকে তাকাল আর ছেলেটি জানত যে স্যাম এমনকি তাকে দেখতেও পায় নি; স্যাম জানত যে ছেলেটি তার পাশেই আছে, কিন্তু সে ছেলেটিকে দেখতে পায় নি। তখন ছেলেটি দেখতে পেয়েছিল হরিণটিকে। সেটি উচ্চভূমির খাড়া পাড় থেকে নেমে আসছে, যেন সেটি বেরিয়ে আসছিল তার মৃত্যুধ্বনি সেই শিঙার শব্দের আওতা থেকে। সেটি তখন দৌড়াচ্ছে না, হাঁটছে, প্রবলভাবে, কিন্তু কোনো তাড়াহুড়ো নেই, ঢালু তির্যক ভঙ্গিতে ও নিদের মাথা দোলাতে দোলাতে- ছোটো ছোটো ঝোপঝাড়, গাছ, গুল্প ইত্যাদির ভেতর দিয়ে নিজের শিংগুলোকে পার করে নিয়ে যাওয়ার সময় আর ছেলেটি এখন দাঁড়িয়ে ছিল স্যাম-এর পাশে, বরাবরের যেমন দাঁড়াত তেমন ভাবে পেছনে নয়, এবং বন্দুকটা তখনো আংশিকভাবে তাক করা, আর হ্যামারগুলির মধ্যে একটি গুঁলি ছোঁড়ার অবস্থানে।
তখনই হরিণটি ওদের দেখতে পেল। কিন্তু তবুও দৌড়াতে শুরু করল না সেটি। এক মুহূর্তের জন্য মাত্র দাঁড়িয়ে পড়ল সেটি, যে-কোনো মানুষের চেয়ে লম্বা, তাকিয়ে রইল ওদের দিকে; এর পরই ওর মাংসপেশি শিথিল হয়ে উঠল একটু, তারপর সংহত। কিন্তু ওর চলার দিক পরিবর্তন করল না, ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে চাইল না, দৌড়াতেও নয়, ওদের বিশ ফুটের মধ্যে, যেমন করে হরিণেরা এগিয়ে যায় তেমনি যেন ডানায় ভর করে অনায়াস গতিতে ওদের অতিক্রম করছিল। মাথাটা উঁচু, চোখে গর্ব কিংবা ঔদ্ধত্য কিছুই নেই, কিন্তু আছে পুরো চোখে একটা বন্য ভয়ডরহীন ভাব, এবং এখন ছেলেটার পাশে স্যাম তার ডান হাত পুরোপুরি তুলল, প্রসারিত করল হাতের তালু, কথা বলল সেই ভঙ্গিতে ছেলেটি যা শিখেছিল কামারশালায় জো বেকার এবং তার কাছ থেকে। এদিকে উপত্যকার খাড়া শীর্ষের ওপরে ওয়াল্টার ইউয়েল-এর শিঙা তখনো বেজে চলছিল একটা মরা হরিণের কথা তাদের জানিয়ে দিতে দিতে।
‘ওলে, চীফ,’ স্যাম বলেছিল, গ্রান্ডফাদার।’ ওরা যখন ওয়াল্টারের কাছে গিয়ে পৌঁছল তখন সে দাঁড়িয়ে ছিল ওদের দিকে পেছন ফিরে, তখনো শান্ত, যেন হতবুদ্ধি, তাকিয়ে আছে তার পায়ের দিকে। মোটেই সে চোখ তুলে তাকাল না।
‘এদিকে আসো, স্যাম’, শান্তভাবে বলল সে। ওরা যখন ওর কাছে গিয়ে পৌঁছাল তখনো সে মুখ তুলে তাকায় নি। সে দাঁড়িয়ে ছিল ছোটো একটা সরু মুখের হরিণের ওপর, যে কিনা গত বসন্তেও ছিল একটি শাবক মাত্র। ‘ওটি এত ছোটো যে আমি ওকে প্রায় ছেড়েই দিচ্ছিলাম’, ওয়াল্টার বলল। ‘কিন্তু, দেখ ওর পায়ের ছাপগুলো। যেন প্রায় একটা বড়ো গরুর মতো। ওর পায়ের ছাপের কাছে যদি আরো কোনো পায়ের ছাপ থাকত, তাহলে, দোহাই বলছি, আমি নিশ্চয়ই ভাবতাম যে ওখানে আরো একটি হরিণ ছিল, যাকে আমি এমন কি একবারও দেখতে পাই নি।’
রাস্তায় দু-আসনের ঘোড়ায় টানা চার চাকার গাড়িটি যেখানে ছিল সেখানে ওরা যখন পৌঁছল তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। ঠান্ডা লাগছিল ওদের, বৃষ্টি থেমে গেছে, আর আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। ওর কাজিন এবং মেজর দ্য স্পেন ও জেনারেল কম্পসন আগুন জ্বালিয়ে বসেছিল। ‘ওটা পেয়েছ তুমি?’
মেজর দ্য স্পেন জিজ্ঞেস করেছিল।
‘ছুঁচোলো-শিঙের একটা বড়ো আকারের জলাভূমির খরগোশ পেয়েছি’, ওয়াল্টার বলল। ওর গাধার পিঠ থেকে ছোটো হরিণটাকে গড়িয়ে নিচে ফেলল সে, ছেলেটির কাজিন ম্যাককাসলিন ওটার দিকে দেখল একবার।
‘বড়োটাকে কেউ দেখে নি?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘আমি এমনকি বিশ্বাসও করি না যে বুন ওটা দেখেছিল’, ওয়াল্টার বলল। সে মনে হয় সম্ভবত কারো খড়ের তৈরি গরুর ওপর লাফ দিয়ে পড়েছিল বুন অভিশাপ দিতে শুরু করল, কুকুরগুলোকে প্রথম জায়গাটিতেও হরিণটির কাছে না নেওয়ার জন্য গালাগাল দিয়ে চলল ওয়াল্টার এবং স্যামকে।
‘কিছু মনে কোরো না’, মেজর দ্য স্পেন বলল। ‘আগামী হেমন্তেই ও আমাদের জন্যে এখানে চলে আসবে। চলো এবার বাড়ি ফিরে যাই।’
জেফারসন থেকে দু মাইল দূরের বাড়ির ফটকে ওয়াল্টারকে যখন ওরা নামিয়ে দিল তখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। জেনারেল কম্পসনকে তার বাড়িতে পৌঁছাতে আরো দেরি হলো, তারপর ওরা ফিরে গেল মেজর দ্য স্পেন-এর বাড়িতে এবং ঠিক করল সেখানেই বাকি রাতটা কাটাবে ওরা, যেহেতু ওদের বাড়ি আরো সতেরো মাইল দূরে। খুব ঠান্ডা পড়ছিল তখন আকাশ পরিষ্কার; ভোরে সূর্য যখন উঠবে তখন ভারী কুয়াশা পড়বে এখনই ঘোড়াগুলোর পা গাড়ির চাকা এবং তাদের পায়ের নিচে মাটি ভিজে গেছে কুয়াশায়- মেজর দ্য স্পেন-এর বাড়ির সামনে আঙ্গিনা পেরিয়ে বাড়িতে ঢোকার সময়ই টের পেল তারা। অন্ধকার ঢাকা উষ্ণ বাড়িটা, অন্ধকারের ভেতর দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠার সময় তারা টের পেল সে উচ্চতা; সেই আঁধারের মধ্যে মেজর দ্য স্পেন মোমবাতিটা খুঁজে বের করে বাতিটা না জ্বালানো পর্যন্ত। তারপর তারা ঢুকে পড়ল সেই আশ্চর্য কক্ষটিতে, বড়ো ও গভীর বিছানাটিতে উঠে তখনো পর্যন্ত ঠান্ডা চাদরের নিচে ঢুকে পড়ে নিজেদের শরীর গরম করতে শুরু করল ওরা। এবং শেষ পর্যন্ত গায়ের কাঁপুনি থামলে হঠাৎ ছেলেটি ম্যাককাসলিনকে বলতে শুরু করল সে ঘটনাটির কথা। ম্যাককাসলিন শান্তভাবে ওর কথাগুলো শুনল।’‘তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো নি’, ছেলেটি বলল। ‘আমি জানি তুমি করো নি-’।
‘কেন করব না?’ ম্যাককাসলিন বলল। ভেবে দেখো এখানে কি কি ঘটেছিল। বাঁচার জন্যে, সুখের জন্যে সে উষ্ণ ও সতেজ রক্ত প্রয়োজন তা আবার শুষে নিয়েছিল মাটি। অবশ্য শোক প্রকাশ আর কষ্টভোগের জন্যেও, তবে এখনো এর থেকে কিছু পেয়ে যাচ্ছে, কারণ শেষ পর্যন্ত তোমাকে যা সহ্য করে যেতে হবে না বলে তুমি যা বিশ্বাস করো তা হলো কষ্ট; তুমি সবসময় তা বন্ধ করতে, শেষ করতে চাইতে পারো। আর এমন কি কোনো কিছু না থাকার চেয়ে বরং কষ্ট পাওয়া ও শোক প্রকাশ করাও অনেক ভালো; বেঁচে না থাকার চেয়ে খারাপ মাত্র একটি জিনিসই আছে, সেটি হচ্ছে লজ্জা। কিন্তু তুমি চিরকাল বেঁচে থাকতে পারবে না, এবং বেঁচে থাকার সম্ভাবনাগুলো ফুরিয়ে যাওয়ার অনেক আগেই তুমি সবসময় তোমার জীবনটাকে নিঃশেষ করে ফেলবে। আর সে-সব কিছুই নিশ্চয়ই কোথাও থেকে যাবে; শুধু ছুঁড়ে ফেলে দেবার জন্যই যা কিছু উদ্ভাবন ও সৃষ্টি করা যেতে পারত। আর পৃথিবীটা হচ্ছে সামান্য একটা কিছু; এই পাথুরে পাহাড়ে আসার আগে তার অনেক কিছুই তুমি দেখনি। এই পৃথিবী কোনো কিছুই রেখে দিতে বা জমিয়ে রাখতে চায় না; সেগুলোকে আবার ব্যবহার করতে চায়। বীজ, ওকফল- এগুলোর দিকে চেয়ে দেখ, এমনকি নোংরা আবর্জনাও যখন পুঁতে ফেলতে চেষ্টা করো- তখন কী ঘটে সে ব্যাপারটার কথা মনে করে দেখ: সেখানে তা থাকতে চায় না, নড়ে-চড়ে ওঠে, আলো আর বাতাসের কাছে না-পৌঁছা পর্যন্ত লড়াই করতে থাকে এবং এর পরও সূর্যের আলো খুঁজে বেড়ায়। এবং ওরা-’ছেলেটি জানালার বিপরীতে ছায়ারেখার মতো তার হাতটাকে দেখল, যার পেছনে, এখন অন্ধকার সয়ে আসার ফলে সে দেখতে পারছিল আকাশটাকে সেখানে ঘষে পরিষ্কারকরা নিরুত্তাপ তারাগুলি জ্বলজ্বল করছিল ‘-ওরা তা চায় না, ওদের এসবের প্রয়োজন নেই। তাছাড়া, সে নিজে কী চাইতে পারে, ওখানে ঘুরে ঘুরে আঘাত করতে করতে, যখন মাটি যেভাবে রয়েছে সে-ব্যাপারে মোটেই যথেষ্ট সময় নেই ওদের, যখন মাটির ওপরে এখনো অনেক জায়গা রয়ে গেছে, অনেক জায়গা যা এখনো একেবারে আগের মতো, পরিবর্তনহীন, যখন রক্ত ঝরেছিল সেখানে এবং ওর মধ্যে সুখের অনুভূতি খুঁজে পেয়েছিল যখন তা তখনো রক্তই ছিল?
‘কিন্তু আমরা ওদের চাই,’ ছেলেটি বলল। ‘আমরা ওদেরও চাই। এখানে ওদের এবং আমাদের জন্যও অনেক জায়গা আছে।’‘সে-কথা ঠিক,’ ম্যাককাসসিন বলল। ‘ধরো ওদের মধ্যে কোনো বস্তু নেই, ওরা কোনো ছায়া ফেলতে পারে না-’
কিন্তু আমি ওটা দেখেছি!’ ছেলেটি চিৎকার করে বলল। ‘আমি দেখেছি ওকে!’
‘শান্ত হও,’ ম্যাককাসসিন বলল। এক মুহূর্তের জন্য ওর হাতটা চাদরের নিচে ছেলেটির পাঁজরা ও নিতম্বের মধ্যবর্তী মাংসল পার্শ্বদেশ ছুঁয়ে গেল। ‘শান্ত হও আমি জানি- তুমি দেখেছ। তোমার মতো আমিও দেখেছি। আমার জীবনে প্রথম হরিণটি মারার পর স্যাম একবার আমাকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল।’
1 মন্তব্যসমূহ
অনুবাদটা আরামদায়ক হয়নি৷ বানানেও অনেক ভুল আছে।
উত্তরমুছুন