কুলদা রায় /১
‘যতটুকু আমি বুঝতে পারি’ গল্পটিতে সেভাবে প্রচলিত ধরনের গল্প নেই। চরিত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা সংঘাত নেই। নেই কাহিনীর মধ্যে সাসপেনশন, টেনশন, থ্রিলং বা ক্লাইমেক্স। এমন কি কোনো চমকও আপনি সে অর্থে সৃষ্টি করেননি। কিন্তু গল্পের চমৎকার আকর্ষণ আছে। পড়তে শুরু করলে শেষ না করে পারা যায় না। এই ধরনের গল্পকে আপনি কী বলবেন?
হামীম কামরুল হক /১
‘যতটুকু আমি বুঝতে পারি’-র কথক চরিত্রেটির মধ্যে কিন্তু একটা টেনশান কাজ করেছে। সে এমন কিছু করছে যেটা তার প্রেমিকা জানে না। সে জানাতেও চায় না। এমন একটা কাজ যার জন্য তার বিপদ হতে পারে, এমন কি তাকে মেরেও ফেলা হতে পারে। ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে পড়ছে। আফ্রিন নামের একটা মেয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে। দুজনেই নিবিড়ভাবে মেলামেশা করে। কিন্তু ছেলেটা আফ্রিনের কাছ থেকে একটা বিষয় গোপন করতে চায়। এই গোপন করার ব্যাপারটা আমি হয়তো এই লেখায় এমনভাবে এনেছি, যাতে কেউ চট করে সেটা ধরতে নাও পারে। কিন্তু টেনশানটা কাজ করেছে। এক ধরনের মৃত্যুভীতি। ছেলেটা এমন কিছু করছে যাতে যেকোনো সময় তার খুন হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। এখন, এটা তো একটা টেনশানই, নাকি?-- যা খুব শীতলভাবে এ গল্পে আছে। উচ্চকিতভাবে নয়।
কোনো গল্পের শেষে চমক থাকবে-- এই ধারায় এই সময়ে ছোটগল্প প্রায় লেখাই হয় না। সচেতন পাঠকও এখন এধরনের গল্প পড়তে তেমন আগ্রহী নন বলেই বোধ করি। হয়তো একারণে আমরা এর চর্চাও করি না। কিন্তু আমি গল্পের শেষে চমক থাকাকে কোনো গল্পের দুর্বলতা মনে করি না। আর গল্পটা তো আমি লিখেছি। এটা বলা খুবই মুশকিল যে পাঠক আমার গল্পকে কী রকম ভাবতে পারেন। এখন এ গল্পটি পড়তে শুরু করলে শেষ করা যায় না-- এটা আমার কৃতিত্ব, না পাঠকের কৃতিত্ব-- তাও বলা মুশকিল। তবে আমি আমার দিক থেকে বলতে পারি যে, আমি সব সময় চেষ্টা করি গল্পের ভাষা যাতে খুব জটিল না হয়, দুর্বোধ্য না হয়। গল্পের বিষয়টা জটিল হতে পারে, কিন্তু ভাষাটা যাতে সহজ হয়। সহজ কিন্তু সবল গদ্যে গল্প লেখার চেষ্টাটা থাকা চাই।-- এমনটা মনে হয় আর কী।
প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশ-- এ ধরনের গল্পকে আমি কী বলব? আমি একজন ব্যক্তির এক ধরনের সংকটের কথা এখানে কথা বলতে চেয়েছি যে-সংকটের কারণে প্রেমিকার সঙ্গে একান্ত মুহূর্তেও সে আনন্দ পাচ্ছিল না। পরে সে ঠিক করে, সে যা করছে, তা থেকে বেরিয়ে এসে, নিজের কেরিয়ার তৈরি করবে, আর প্রেমিকাকে নিয়েই আনন্দময় ভোগেসুখে জীবন কাটাবে।-- এই সিদ্ধান্তই সে গ্রহণ করে। ছেলেটা যে একটা গোপন লড়াই চালাচ্ছিল, সেখান থেকে সে সরে আসতে চাইল শেষ পর্যন্ত। এটা মূলত একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পর্বে পাঠরত এক ব্লগারের গল্প। যে কোনোধরনের সংস্কার মানে না, কোনো ট্যাবু মানে না। কিন্তু তার মনে হয় সে ঠিক পথেও চলছে না। সে একটু দ্বিধায়ও পড়ে। ফলে সে তার পথ থেকে সরে আসতে চায়। পুরো গল্পে কোথাও ‘ব্লগার’ শব্দটা বলা হয়নি। এটা এই সময়ের একটা বিশেষ সংকটের গল্প।-- এছাড়া আমি কী আর বলতে পারি।
কোনো গল্পের শেষে চমক থাকবে-- এই ধারায় এই সময়ে ছোটগল্প প্রায় লেখাই হয় না। সচেতন পাঠকও এখন এধরনের গল্প পড়তে তেমন আগ্রহী নন বলেই বোধ করি। হয়তো একারণে আমরা এর চর্চাও করি না। কিন্তু আমি গল্পের শেষে চমক থাকাকে কোনো গল্পের দুর্বলতা মনে করি না। আর গল্পটা তো আমি লিখেছি। এটা বলা খুবই মুশকিল যে পাঠক আমার গল্পকে কী রকম ভাবতে পারেন। এখন এ গল্পটি পড়তে শুরু করলে শেষ করা যায় না-- এটা আমার কৃতিত্ব, না পাঠকের কৃতিত্ব-- তাও বলা মুশকিল। তবে আমি আমার দিক থেকে বলতে পারি যে, আমি সব সময় চেষ্টা করি গল্পের ভাষা যাতে খুব জটিল না হয়, দুর্বোধ্য না হয়। গল্পের বিষয়টা জটিল হতে পারে, কিন্তু ভাষাটা যাতে সহজ হয়। সহজ কিন্তু সবল গদ্যে গল্প লেখার চেষ্টাটা থাকা চাই।-- এমনটা মনে হয় আর কী।
প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশ-- এ ধরনের গল্পকে আমি কী বলব? আমি একজন ব্যক্তির এক ধরনের সংকটের কথা এখানে কথা বলতে চেয়েছি যে-সংকটের কারণে প্রেমিকার সঙ্গে একান্ত মুহূর্তেও সে আনন্দ পাচ্ছিল না। পরে সে ঠিক করে, সে যা করছে, তা থেকে বেরিয়ে এসে, নিজের কেরিয়ার তৈরি করবে, আর প্রেমিকাকে নিয়েই আনন্দময় ভোগেসুখে জীবন কাটাবে।-- এই সিদ্ধান্তই সে গ্রহণ করে। ছেলেটা যে একটা গোপন লড়াই চালাচ্ছিল, সেখান থেকে সে সরে আসতে চাইল শেষ পর্যন্ত। এটা মূলত একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পর্বে পাঠরত এক ব্লগারের গল্প। যে কোনোধরনের সংস্কার মানে না, কোনো ট্যাবু মানে না। কিন্তু তার মনে হয় সে ঠিক পথেও চলছে না। সে একটু দ্বিধায়ও পড়ে। ফলে সে তার পথ থেকে সরে আসতে চায়। পুরো গল্পে কোথাও ‘ব্লগার’ শব্দটা বলা হয়নি। এটা এই সময়ের একটা বিশেষ সংকটের গল্প।-- এছাড়া আমি কী আর বলতে পারি।
কুলদা রায় /২
গল্পটির শুরুতেই একটি বাক্য লিখলেন –‘গ্রামে গেলেই খালি পায়ের লোক খুঁজি’। দুটি গ্রাম নয়—মফস্বল শহরের কিছুটা উল্লেখ থাকলেও কিন্তু গল্পের পটভূমি গ্রাম নয়। ঢাকা শহর বলেই মনে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী বা ঢাকার প্রতিবেশ। ছাত্রী হল, ছেলেমেয়েদের ঘনিষ্ট প্রেম, ট্যুর, বান্ধবীদের বাসায় থাকা, কয়েকজন লোকের খুন হয়ে যাওয়া--ইত্যাদি বিষয়গুলো ঘটছে ঢাকা শহরেই। তাহলে শুরুতেই একটি গ্রামের জুতোহীন খালি মানুষের পায়ের কথা দিয়ে শুরু করলেন কেন?
হামীম কামরুল হক /২
আসলে গল্পের শুরুতে ওটা একটা সংলাপ ছিল। ‘গ্রামে গেলেই খালি পায়ের লোক খুঁজি।’ থেকে ‘ঝরঝরে শরীর স্বাস্থ্য।’ এ পর্যন্ত কথাগুলি রীতি নামের একটি মেয়ে বলছে। মেয়েটা বিশ্বাবিদ্যালয়ে অনার্স পর্যন্ত কথকের সঙ্গে পড়েছিল। পরে তার বিয়ে হলে মেয়েটি স্বামীর সঙ্গে কানাডা চলে যায়। অনেক দিন পর দেশে বেড়াতে এসে কথকের সঙ্গে কোনো একটা আড্ডা আলাপে মেয়েটি ওই সব কথা বলছে। তার কাছে বাংলাদেশের বেশ উন্নতি হয়েছে। লোকজনও আগের চেয়ে বেশি তাজা আর ঝলমলে। --এমনটাই ভাবছে সে, কিন্তু এই তলে তলে কয়েকটি বিষয়ে যে প্রবল সংঘাত তৈরি হয়েছে দুটো প্রধান পক্ষের মধ্যে এটা তো ওই মেয়ে তেমন করে হয়তো জানে না। গল্পের এক জায়গায় যেখানে কালীচরণের মৃত্যু দৃশ্য আছে-- সেই অংশ থেকে বোঝা যায়, যে, বিপুল পরিমাণ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এদেশ ত্যাগ করলেও, বেশ কিছু সংখ্যক এখানো আছেন যারা অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে এদেশে বাস করছেন। সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে তাঁরা উঠতে পারছেন।--এদিকটা একটু এসেছে। আর গল্পের পটভূমি অবশ্যই একটা বিশ্ববিদ্যালয়, কিন্তু সেটা ঠিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়। আমি নাম বলিনি। কিন্তু আভাস দিয়েছি যে এটা ঢাকা শহরের একটু বাইরে থাকা একটা বিশ্ববিদ্যালয়-- যার বিরাট একটা ক্যাম্পাস আছে।
কুলদা রায় /৩
গল্পে রীতি নামে কানাডাপ্রবাসী একটি মেয়ের কথা আছে গল্পটির দ্বিতীয় প্যারাতে। আর তার রয়েছে অনতি দীর্ঘ সংলাপ। অথচ রীতিকে এই গল্পে আর কোথাও দেখা যায় না। তার কথাও শোনা যায় না। অথচ মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল সম্ভবত রীতি এই গল্পের নায়িকা হবেন। কিন্তু নায়িকা হলেন আরেকটি মেয়ে আফরিন। মেয়েটি গল্পকারের চেয়ে কয়েক বছরের ছোট। তাহলে হুট করে রীতিকে গল্পের শুরুতেই ঘটা করে আনার উদ্দেশ্য কী ছিল?
হামীম কামরুল হক /৩
এটা তো ওই কথক ছেলেটি আর ওই আফ্রিন নামের মেয়েটিরই গল্প। যারা গভীর প্রেমেকামে একে অন্যের ভিতরে বার বার ডুবছে ভাসছে। নিয়মিত একজন আরেকজনের শরীর উপভোগ করছে। রীতি নামের মেয়েটির কাছ থেকে কথক কেবল ওই মন্তব্যটা শুনেছিল। কথক জানে, রীতি যাদের এমন তরতাজা দেখছে, এমনকি রীতি কথকেও বলছে যে, তাকেও দুর্দান্ত তাজা লাগছে, বয়সের চেয়ে অল্প বয়স লাগছে, সেই কথক জানে এদেশে একটা সংকটও চলছে। সেটা হল প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রগতিশীল মানসিকতার মানুষের দ্বন্দ্ব। আমি সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা সুবিধা ভোগ করছে তাদের একটা আভাস এখানে দিয়েছি। বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন একবার লিখেছিলেন, তিনি নিজেকে মোটেও সংখ্যালঘু মনে করেন না। আমরাও জানি তিনি যে সম্মানের ও মর্যাদাময় জীবন কাটান সেটা সংখ্যালঘুর জীবন নয়। সংখ্যালঘুর একটা সাবঅলটার্ন দিক আছে। নিম্নবর্গ বা সাবঅলটার্ন কারা? গৌতম ভদ্রের মতে, সাবঅলটার্ন একটা আপেক্ষিক অবস্থান। একই ব্যক্তি অবস্থাভেদে কোথাও সাবঅলটার্ন, কোথাও তার তুলনায় অন্যজন সাবঅলটার্ন। ধরা যাক, মহাজনের কাছে একজন কৃষক সাবঅলটার্ন, আবার সেই কৃষক একজন পুরুষ, বাড়িতে তার প্রবল কর্র্তৃত্ব, তার তুলনায় তার স্ত্রী সাবঅলটার্ন। মোট কথা যেখানে যার স্বর নিচু হয়ে যায়, বা যার স্বর শোনাই যায় না-- সেই আসলে সাবঅলটার্নে পরিণত হয়। ‘ভয়েসলেস’ হওয়া মানেই সাবঅলটার্ন হয়ে যাওয়া। আমার এই গল্পের কথক ইন্টারনেটে এমন সব কথা লেখে, ছদ্ম নামেই লেখে, কিন্তু সেটা সে তার প্রেমিকাকে পর্যন্ত জানতে দেয়নি। কিন্তু এমন করে যারা লেখে তাদের প্রতিপক্ষ তাদের ঠিকই চিনে নেয়। এই যে ব্লগার হিসেবে কোনো একটি ব্লগে বা ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে কথক ছেলেটি ছদ্মনামে সরব, কিন্তু এটা সে প্রকাশ্যে কাউকে সাধারণত বলে না। সে একটা নীরবতা পালন করে। এটাও আসলে একটা সাবঅলটার্ন পজিশান। আসলে প্রত্যেকটি দেশেই সংস্কারমুক্ত প্রকৃত প্রগতিশীল মানুষরাই মূলত প্রকৃত সংখ্যালঘু এবং সাবঅলটার্ন।-- এটা গল্পে তুলে আনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ছেলেটি শেষ পর্যন্ত নিজের অবস্থান পাল্টায়। সে বিসিএস দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পথ খুঁজে বের করতে চায়। একটি চাকরি, মনের মতো বৌ, নিবিড়ভাবে সুখী ও উদ্দাম যৌনজীবন এবং সংসার-- এই তার জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে।
কুলদা রায় /৪
গল্পটির কথক একজন যুবক। উচ্চ শিক্ষিত। প্রগতিশীল রাজনীতিও করেন। চিন্তার স্বাধীনতাকামী বলেই মনে হয়। যুবকটি যে কোন সময়ে খুন হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে ভুগছে সারা গল্প জুড়ে। অথচ গল্পের কোনো চরিত্রকে খুন হতে দেখা যায় না। খুন হতে শোনা যায় মাত্র। খুনের পরিকল্পনাও করতে বোঝা যায় না। এই খুনের জন্য অন্য কোনো লোকের, পরিবারের, সমাজের বা রাষ্ট্রের কোনো উদ্বেগ বা প্রতিক্রিয়া দেখা নেই। তাহলে কি জনবিচ্ছিন্ন কোনো মানুষের গল্প লিখেছেন?
হামীম কামরুল হক /৪
একটু তো জনবিচ্ছিন্নই। এর কথক সংস্কারমুক্ত মানুষ। অন্যরা খুন তো হয়েছে। তবে তারা এই গল্পের মূল চরিত্রদের কেউ নয়। কিন্তু তাতে তো তলে তলে ভয়ও পাচ্ছে কথক। আর কথা মূলত বুঝতে পারে, তার এইসব প্রগতিশীলতা হয়তো ছদ্মই। সে একজন শিশ্নোদরপরায়ণ মানুষ। প্রতিষ্ঠা ও ভোগই তার জীবনের প্রধান দুই সত্য। এছাড়া এসব করে শুধু শুধু মৃত্যুর ঝুঁকির ভেতরে কেন সে পড়ে থাকবে। সে একজন সুবিধাবাদী মানুষই তো বটে। আর সুবিধাবাদী মানুষ স্বার্থপর, এবং জনবিচ্ছিন্নতা তো তার দেখা দেয়ই।
কুলদা রায় /৫
গল্পের অন্যতম চরিত্র আফ্রিন একটি মৌলবাদী পরিবার থেকে এসেছেন। তার মা হিজাব পরে সেই বিশ্বাসের রাজনীতির কাজ করে। আফরিন নিজেও অবিশ্বাসী নয়। কিন্তু একজন মৌলবাদ বিরোধী যুবকের সঙ্গে প্রেম করে। তার সঙ্গে বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কও করেছে। যুবকটির আগে একাধিক অন্য যুবকের সঙ্গেও শারীরিক প্রেম ছিল। সেটা গল্প করে শোনাতেও পছন্দ করে বর্তমান প্রেমিকের কাছে। যুবকের বিপরীত। এ রকম বিপরীত চরিত্রের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব সংঘাতই কোনো গল্পের আখ্যানে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আপনার গল্পে এরকম কোনো ব্যাপার নেই। বিষয়টি নিয়ে আপনার ব্যাখ্যা কি।
হামীম কামরুল হক /৫
এঁদের জীবনে ভোগই সত্য। আর কিছু নয়। ওই সব আদর্শটাদর্শ ফাঁকাবুলি। গল্পের ওই আফ্রিন অত্যন্ত ভোগকাতর ও রতিপ্রিয় একটি মেয়ে। ছেলেটি তাকে জিজ্ঞাসাও করেছিল, এদিকে সে ধর্ম করে, অন্যদিকে সে যৌনতাকে কোনো রকমের দ্বিধা ছাড়া উপভোগ করে-- এটা কেমন করে সে পারে? মেয়েটি তাকে উত্তর দিয়েছিল। সেটা গল্পেই আছে। আসলে ছেলেমেয়ে দুজনেই সুবিধাভোগী চরিত্র। আফ্রিন এত সাহিত্য পড়তে পছন্দ করে, সে কমলকুমারের মতো জটিল লেখকের লেখা উপভোগ করে। কিন্তু সেটা তার সাহিত্যরুচি। তার যৌনরুচির সঙ্গে এর কোনো সংঘাত নেই। আফ্রিন ভালো-মন্দ-- এমন শ্রেণিবিভাগে পড়ে না। ছেলেটিও বোঝে, আসলে সুবিধাই শেষ কথা। প্রতিভা বসুর বিখ্যাত বই ‘মহাভারতের মহারণ্যে’ পড়ে আমাদের তো মনে না হয়ে পারে না, এ জগতের সৎ-অসৎ, সত্য-মিথ্যা-- ন্যায়-অন্যায় আরো যা যা নিয়ে দ্বন্দ্বসংকট আছে, তা মূলত ফাঁকা, জগতের সত্য একটাই-- সুবিধাভোগীর সুবিধাভোগ। আদর্শটাদর্শ এসবই একসময় ফাঁকা বুলি হয়ে যায়। বিশ্বাস বদলে যায়। কিন্তু জীবনের এক বিশেষ প্রবাহ চলতেই থাকে। কোনো যুদ্ধ, মৃত্যু, হত্যাকাণ্ড কোনো কিছুতেই তা রোধ হয় না। সেখানে সুবিধাজনক অবস্থা তৈরির জন্যই মানুষ চেষ্টা করে চলে। যৌনতা ও ভোগ, সন্তান জন্মদেওয়া, জীবিকার জন্য চেষ্টা করা, প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টা, সফল হওয়ার চেষ্টাই বা নিদেনপক্ষে টিকে থাকা, বা বেঁচে থাকার চেষ্টাটাই এর মূল কথা।
কুলদা রায় /৬
কালীচরণ নামে একজন প্রবীণ গণিত শিক্ষকের উপাখ্যান পাওয়া যাচ্ছে। দেশভাগের সময় আগে পরে কালীচরণবাবুদের আত্মীয়স্বজনরা দেশত্যাগ করে ইন্ডিয়া চলে গেছেন। এলাকার লোকজন তাদের জন্য এক ধরনের হাহাকার করেন। মুসলামানদের মধ্যে কেউ কেউ কেবল দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন, ‘হিন্দুরা দেশটা ছাইড়া গেল আর স্কুলে বাংলা, অঙ্ক আর ইংরেজি-- এই তিনটার মান দুম করে পড়ে গেল। এই তিন বিদ্যাই হল আসল।’
কালীচরণ স্যার ১৯৪৭ সালে, ১৯৫০ সালে, ১৯৫৪ সালে, ১৯৬৪ সালে, ১৯৭১ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, শত্রু সম্পত্তি আইন, গণহত্যার প্রথম ভিক্টিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হওয়া সত্বেও দেশ ছেড়ে যাননি। তার ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষা লাভ করেছেন। উচ্চ চাকরি করছেন। কালীচরণ স্যার মারা যাওয়ার আগে তার বন্ধু নিজামুল হকের গান শুনতে শুনতে তার ধরে চোখ বোজেন। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এটা একটা সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত। ইতিবাচক ঘটনা। আপনার এই গল্পে একজন নেতির আতঙ্কে পড়া শিক্ষিত যুবককে নানাভাবে দেখাচ্ছেন। নানাভাবে এই কালীচরণ বাবুরা নিপীড়ণের শিকার হচ্ছেন। তাদের দেশত্যাগের কারণগুলো মোটেই কমেনি। ক্ষেত্র বিশেষে বেড়েছে। তাদের পক্ষে কথা বলাটাও এক ধরণের রোষের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি একটু অদ্ভুত লাগে। এই সম্প্রীতির বিষয়টিকে কি আপনি অদ্ভুত করে ভেবেই লিখেছেন? না, ফান করে লিখেছেন?
কালীচরণ স্যার ১৯৪৭ সালে, ১৯৫০ সালে, ১৯৫৪ সালে, ১৯৬৪ সালে, ১৯৭১ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, শত্রু সম্পত্তি আইন, গণহত্যার প্রথম ভিক্টিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হওয়া সত্বেও দেশ ছেড়ে যাননি। তার ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষা লাভ করেছেন। উচ্চ চাকরি করছেন। কালীচরণ স্যার মারা যাওয়ার আগে তার বন্ধু নিজামুল হকের গান শুনতে শুনতে তার ধরে চোখ বোজেন। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এটা একটা সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত। ইতিবাচক ঘটনা। আপনার এই গল্পে একজন নেতির আতঙ্কে পড়া শিক্ষিত যুবককে নানাভাবে দেখাচ্ছেন। নানাভাবে এই কালীচরণ বাবুরা নিপীড়ণের শিকার হচ্ছেন। তাদের দেশত্যাগের কারণগুলো মোটেই কমেনি। ক্ষেত্র বিশেষে বেড়েছে। তাদের পক্ষে কথা বলাটাও এক ধরণের রোষের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি একটু অদ্ভুত লাগে। এই সম্প্রীতির বিষয়টিকে কি আপনি অদ্ভুত করে ভেবেই লিখেছেন? না, ফান করে লিখেছেন?
হামীম কামরুল হক /৬
মোটেও ফান করে নয়। কালীচরণের মতো মানুষরা হয়তো তলে তলে একটি সত্য জানেন, নিজের দেশ, নিজের দেশই। যে যোগ্য সে সব জায়গায় যোগ্য। ফলে হিন্দু হোক কি মুসলমান, যোগ্যতার প্রশ্নই আসলে শেষ কথা। এই যোগ্যতার জোরেই মানুষ টিকে থাকে। কালীচরণ নিজে এবং তার সন্তানরা তার প্রমাণ। আমি কল্পনাও করি না-- এটা আমি কোনো কৌতুক বা ফান করার মানসিকতা থেকে লিখেছি। আপনি কি বলবেন না বাংলাদেশে এমন পরিবার একেবারেই নেই?
এবার আমি একটা উদারহরণ দিই। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু-- লেখক, সাংবাদিক দীপংকর গৌতমকে একজন প্রস্তাব দিয়েছিল, যে, ‘দীপংকরদা, এদেশে থেকে কী করবেন, দেখতেছেনই তো অবস্থা। মাইনোরিটি হয়ে বেঁচে থাকাটা কোনো মানুষের বাঁচা না। চলেন ইন্ডিয়া চলেন।’ উত্তরের দীপংকর গৌতম বলেছিলেন, ‘আমি তো এদেশে কেবল একটা ক্যাটাগরিতে সংখ্যালঘু, কিন্তু ভারতে যদি যাই, তাহলে সেখানে আমি তেরো ক্যাটাগরিতে সংখ্যালঘুতে পরিণত হবো।’ দীপংকরদা আমাকে সেই তেরোভাবে সংখ্যালঘু হওয়াটা কী কী সেটা বলেছিলেন। শুনে আমি রীতিমতো চমৎকৃত হয়েছিলাম। আসলে এই যে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু হিসেবে বোধ করা-- এটা কাটিয়ে ওঠার জায়গাটা আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে যদি না থাকে, মানুষ যদি নিজেকে বিশ্বের মানুষ না ভাবতে পারে, তাহলে একজন বাঙালি মুসলমান তো কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াতে সংখ্যালঘু। এই সংখ্যালঘু ও গুরুর ব্যাপারটা নানানভাবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এটা সভ্যতার একটা বিশেষ অভিশাপ। আমি তো বললামই-- বিনায়ক সেনরা নিজেকে সেটা মনে করেন না। মনোজ ভার্গব, ফাইভ আওয়ার এনার্জি-খ্যাত, আমেরিকায় থাকেন, তিনি কি নিজেকে সংখ্যালঘু মনে করেন? বা রোহিতন মিস্ত্রিদের মতো লোকেরা? কেন মনে করেন না সেটা নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা দিতে হবে না। আরো জানেন বেনিয়া সভ্যতা একটা ভালো দিক হলো, এটা মূলত ধর্মটর্ম মানে না, কিন্তু এর শয়তানিটা হলো এটা ধর্মতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখে। অন্য শ্রেণিকে শোষণ ও নানান সুবিধার জন্য ধর্মতন্ত্রটাকে কৃত্রিমভাবে টিকিয়ে রাখা হয়। ব্যবসাটাই হল আসলে তাদের ধর্ম।
এবার আমি একটা উদারহরণ দিই। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু-- লেখক, সাংবাদিক দীপংকর গৌতমকে একজন প্রস্তাব দিয়েছিল, যে, ‘দীপংকরদা, এদেশে থেকে কী করবেন, দেখতেছেনই তো অবস্থা। মাইনোরিটি হয়ে বেঁচে থাকাটা কোনো মানুষের বাঁচা না। চলেন ইন্ডিয়া চলেন।’ উত্তরের দীপংকর গৌতম বলেছিলেন, ‘আমি তো এদেশে কেবল একটা ক্যাটাগরিতে সংখ্যালঘু, কিন্তু ভারতে যদি যাই, তাহলে সেখানে আমি তেরো ক্যাটাগরিতে সংখ্যালঘুতে পরিণত হবো।’ দীপংকরদা আমাকে সেই তেরোভাবে সংখ্যালঘু হওয়াটা কী কী সেটা বলেছিলেন। শুনে আমি রীতিমতো চমৎকৃত হয়েছিলাম। আসলে এই যে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু হিসেবে বোধ করা-- এটা কাটিয়ে ওঠার জায়গাটা আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে যদি না থাকে, মানুষ যদি নিজেকে বিশ্বের মানুষ না ভাবতে পারে, তাহলে একজন বাঙালি মুসলমান তো কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াতে সংখ্যালঘু। এই সংখ্যালঘু ও গুরুর ব্যাপারটা নানানভাবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এটা সভ্যতার একটা বিশেষ অভিশাপ। আমি তো বললামই-- বিনায়ক সেনরা নিজেকে সেটা মনে করেন না। মনোজ ভার্গব, ফাইভ আওয়ার এনার্জি-খ্যাত, আমেরিকায় থাকেন, তিনি কি নিজেকে সংখ্যালঘু মনে করেন? বা রোহিতন মিস্ত্রিদের মতো লোকেরা? কেন মনে করেন না সেটা নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা দিতে হবে না। আরো জানেন বেনিয়া সভ্যতা একটা ভালো দিক হলো, এটা মূলত ধর্মটর্ম মানে না, কিন্তু এর শয়তানিটা হলো এটা ধর্মতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখে। অন্য শ্রেণিকে শোষণ ও নানান সুবিধার জন্য ধর্মতন্ত্রটাকে কৃত্রিমভাবে টিকিয়ে রাখা হয়। ব্যবসাটাই হল আসলে তাদের ধর্ম।
কুলদা রায় /৭
গল্পটি ভাষাভঙ্গি আমাদের দেশের মূলধারার লেখার সঙ্গে খুব একটা খাপ খায় না। পড়লেই কেন জানি মনে গল্পটির টোন বিদেশি দিকশনের সঙ্গে যায়। আমার তো ঝুম্পা লাহিড়ীর ভাষাভঙ্গীটিকেই মনে পড়ে। খণ্ড খণ্ড করে মৃদুমানুষের মত কথক বলে চলেছেন। দিচ্ছেন নিঁখুত ডিটেইলস। শুরুর দিকে বলছিলেন—মেয়েদের পায়ের কথা। বলেছিলেন কেন সুন্দরী যত্নশীল মেয়েদের চেনা যায় তাদের পা দেখে। এই দেখার ভঙ্গিটি পড়ে যে কোনো পাঠক শুধু চোখে নয়—মনেও রক্তমাংসের পা’টি দেখতে পান। গল্পটির ভেতর দিয়ে একটি বিষাদের চিহ্ন এঁকে দেন। এই রকম ভাষাভঙ্গীটি আয়ত্ব করার পেছনের কথাটি বলুন।
হামীম কামরুল হক /৭
আমি ঠিক বলতে পারবো না। কিন্তু অনেকেই আমাকে সাহিত্যরুচির দিক থেকে পশ্চিমাভাবধারার মনে করে। আমি নাকি খুবই ওয়েস্টার্নাইজড। আমি সচেতনভাবে এটা কখনো মনে করি না, যে একটা বাংলাদেশি গল্প লিখবো, বা পশ্চিমাধারার কোনো গল্প লিখবো। আমি যে নিটোল কোনো গল্প লিখবো, তাও মনে করি না। আমি সময়ের কোনো একটা কথা নিয়ে যদি কিছুটা বিপর্যস্ত বোধ করি, হয়তো সেখান থেকে কিছু একটা মনে-মস্তিষ্কে গড়ে উঠতে থাকে। সেখান থেকে গল্পের ভেতর দিয়ে কিছু বলতে চেষ্টা করি। ঝুম্পা লাহিড়ীর গল্প পড়েছিলাম। সেই যখন তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পান, সেই ২০০০ সালে। ২০০১-এর দিকে মনে হয় পড়েছিলাম, তাঁর গল্প। কে জানে, সে তো অনেক আগের ব্যাপার। আর এই গল্পটা ইদানীংকালে আগে লেখা। আমি তো নানান সময় নানান জনের লেখা পড়ার ভেতরে থাকি। এখন যেমন ব্রুস চ্যাটউইনের ‘উৎজ’ উপন্যাসটা পড়তে চেষ্টা করছি। আগামী পাঁচ বছর পর বা আগামী কোনো লেখায় তাঁর ছাপ, প্রভাব পড়তেই পারে। কোনো না কোনো প্রভাব তো পড়েই। আর যেহেতু আমার পশ্চিমাসাহিত্যের চর্চাটা একটু বেশি হয়। তাতে মনে হয় আমার ওপর ছাপ পড়ে। এ নিয়ে আমি মোটেও বিচলিত নই। লেখাটা লিখতে পারছি কিনা-- সেটা যদি পাঠকের ভেতর কোনোভাবে কোনো কিছু একটা সঞ্চার করতে পারে-- সেটাই আসল। কিছু না ঘটলেও আমি নিজে কীইবা করতে পারি। লেখার বেশি তো আমার হাতে আর কোনো ক্ষমতা নেই। তাই না।
কুলদা রায় /৮
গল্পটি লেখার সময়কার গল্পটি বলুন যেন একজন পাঠক হিসেবে আপনাকে দেখতে পাই—আপনি কিভাবে গল্পটির বীজ পাচ্ছেন, সেটাকে বিস্তার ঘটাচ্ছেন। তার ছক কাটছেন। ভাষা দিচ্ছেন। টাইপ করছেন। ঘষামাজা করছেন। পূর্ণরূপে ফুটে উঠেছে গল্পটি।
হামীম কামরুল হক /৮
এই গল্পটি হঠাৎ করেই লিখিছিলাম। হয়তো ব্লগারহত্যার প্রতিক্রিয়া থেকে। এভাবে একের পর এক ব্লগারকে হত্যা করা হচ্ছে, কেন? কাউকে কাউকে বলা হচ্ছে, তাদের চরিত্রে দোষ আছে। তাদের লুচ্চা-বদমাস বলেও প্রচার করার চেষ্টা হয়েছে।-- এখান থেকেই হয়তো বীজটা পাওয়া। আমি খুব পরিকল্পনা করে এই গল্পটা লিখিনি। গল্পটা লিখতে লিখতে এগিয়েছে। এবং বলতে গেলে এক কি দুই তিনবার কেবল পি.সি ছেড়ে উঠে ঘরের ভেতরেই একটু হাঁটাহাঁটি করে আবার লিখতে বসেছি। বলতে গেলে একটানাই গল্পটা লেখা। খুব একটা কাটাকাটিও করিনি। গল্পের ‘যতটুকু আমি বুঝতে পারি’ নামটাও দুম করে রেখেছি। খুব ভেবেটেবে নয়।
কুলদা রায় /৯
সব শেষে বলুন, গল্পটি যেভাবে ভেবেছিলেন সেরকম কি লিখতে পেরেছেন গল্পটি?
হামীম কামরুল হক /৯
কুলদা রায়/১০
ধন্যবাদ।
হামীম কামরুল হক /১০
0 মন্তব্যসমূহ