১৯৭১ সালের হেমন্তে এক ভদ্রলোক আমাদের বাড়িতে আসতেন। তাঁর পকেটে থাকত লজেঞ্জ-চকোলেট আর বুকে তাঁর পরিবারের জীবন-মৃত্যুর নিশ্চিত খবর পাওয়ার আশা। তাঁর নাম ছিল মি. পিরজাদা। তিনি ঢাকা থেকে এসেছিলেন। ঢাকা এখন বাংলাদেশের রাজধানী, কিন্তু তখন পাকিস্তানের অংশ ছিল।
সে বছর পাকিস্তান গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। সেই পূর্ব সীমান্ত যেখানে ঢাকা অবস্থিত, পশ্চিমের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করছিল। মার্চ মাসে পাকিস্তানি সেনা ঢাকায় হানা দিয়ে, আগুন লাগিয়ে, গুলিগোলা চালিয়েছিল। শিক্ষকদের রাস্তায় টেনে এনে গুলি করে মারা হয়েছিল। মেয়েদের ব্যারাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিল। শোনা যাচ্ছিল যে, গ্রীষ্মকালের মধ্যে ৩,০০,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল। ঢাকায় মি. পিরজাদার একটা তিনতলা বাড়ি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপনা ছিল, কুড়ি বছরের বিবাহিতা স্ত্রী ছিলেন এবং ছ’ থেকে ষোলোর সাতটি মেয়ে ছিল, যাদের সকলের নাম শুরু হয়েছিল ‘এ’ অক্ষর দিয়ে। ‘ওদের মায়ের ইচ্ছে,’ তিনি একদিন আমাদের, তাঁর মানি ব্যাগ থেকে একটা সাদা-কালো ছবি বের করে দেখিয়ে বুঝিয়েছিলেন। সাতটি মেয়ে একটি পিকনিকে সারি দিয়ে বাবু হয়ে বসে কলাপাতায় মুরগির মাংসের ঝোল খাচ্ছে। সকলের বিনুনি ফিতে দিয়ে বাঁধা। ‘কী করে চিনব আমি? আয়েষা, আমিরা, আমিনা, আজিজা, বুঝতে পারছ তো, কত কঠিন?
প্রতি সপ্তাহে মি. পিরজাদা স্ত্রীকে চিঠি লিখতেন এবং প্রত্যেকটি মেয়েকে কমিক্স বই পাঠাতেন। কিন্তু ঢাকায় আর সবকিছুর মতোই ডাকব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছিল। ছ’মাসের ওপর তিনি তাদের কোনও খবর পাননি। সেই সময় মি. পিরজাদা এক বছরের জন্য আমেরিকা এসেছিলেন। কারণ পাকিস্তানি সরকার তাঁকে নিউ ইংল্যান্ডের গাছের পত্রালি নিয়ে পড়াশুনা করার জন্য জলপানি দিয়েছিল। বসন্ত এবং গ্রীষ্মকালে তিনি ভার্মান্ট এবং দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। হেমন্তকালে তিনি বোস্টনের উত্তরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন তাঁর আবিষ্কার নিয়ে একটি ছোট বই লিখতে। আমরা সেখানেই থাকতাম। জলপানিটা খুবই সম্মানের ছিল, যদিও ডলারে তার মূল্য নির্ধারণ করতে গেলে সেটা পর্যাপ্ত মনে হত না। তাই মি. পিরজাদা একটি গ্রাজুয়েট ডর্মেটরিতে থাকতেন। তাঁর কোনও নিজস্ব টিভি বা স্টোভও ছিল না, সেজন্য তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন টিভিতে সন্ধেবেলার খবর দেখতে এবং রাতের খাবার খেতে।
প্রথমদিকে আমি তাঁর আসার কারণ কিছুই বুঝতাম না। আমার তখন মাত্র দশ বছর বয়স। আমার মা-বাবা ছিলেন ভারতীয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের সঙ্গে পরিচিত অনেক ভারতীয় ছিল। তাই মি. পিরজাদাকে তাঁরা আমাদের সঙ্গে খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানানোয় আমি অবাক হইনি। ছোট ক্যাম্পাসটায় ইটের সরু ফুটপাথ এবং সাদা রংওয়ালা বিল্ডিং ছিল। যে শহরের প্রান্তে ক্যাম্পাসটা অবস্থিত, সেটা যেন আরও ছোট। সুপারমার্কেটে সরষের তেল পাওয়া যেত না, ডাক্তাররা বাড়িতে রুগী দেখতে যেতেন না, বিনা নিমন্ত্রণে কেউ পড়শিদের বাড়ি যেত না, এইসব নিয়ে আমার মা-বাবা খুব অভিযোগ করতেন। স্বদেশবাসীর খোঁজে প্রতি সেমিস্টারের শুরুতে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেক্টরিতে আঙুল দিয়ে নাম খুঁজতেন। তাঁদের দেশের পরিচিত পদবির কোনও নাম পেলে সেটা গোল দাগ দিয়ে রাখতেন। এইভাবেই তাঁরা মিঃ পিরজাদাকে খুঁজে পেয়ে ফোন করেছিলেন এবং বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন।
তাঁর প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আসার কথাও আমার মনে নেই। কিন্তু সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আমি আমাদের বসার ঘরে মি. পিরজাদার উপস্থিতির সঙ্গে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে, একদিন জলের জগে বরফ ঢালার সময় আমি মাকে চতুর্থ গেলাসটা আমার নাগালের বাইরের একটা তাক থেকে পেড়ে দিতে বলেছিলাম। মা স্টোভের সামনে এক কড়াই ভরতি ভাজা পালং শাক মুলো নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। একজস্ট ফ্যান আর জোরে জোরে হাতা নাড়ানোর শব্দে আমার কথা শুনতে পাননি। বাবা ফ্রিজে হেলান দিয়ে মুঠো থেকে তুলে মশলা মাখানো কাজুবাদাম খাচ্ছিলেন। আমি তাঁর দিকে ফিরলাম।
‘’কী হয়েছে লিলিয়া?”
“ভারতীয় ভদ্রলোকটির জন্য একটা গেলাস চাই।”
“মি. পিরজাদা আজ আসবেন না। তার চেয়েও বড় কথা মি. পিরজাদাকে আর ভারতীয় মনে করা হয় না,” বাবা ঘোষণা করলেন। তাঁর পরিপাটি করে ছাঁটা কালো দাড়ি থেকে কাজুর নুন ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, “পার্টিশনের পর থেকে আর না। ১৯৪৭-এ আমাদের দেশ ভাগ হয়ে গিয়েছিল।”
আমি যখন বললাম যে, আমার ধারণা ছিল সেটা ব্রিটেনের শাসন থেকে ভারতের স্বাধীনতার তারিখ, তখন বাবা বললেন, “ সেটাও ঠিক। এক মুহূর্তে আমাদের ভাগ করে দেওয়া হল।” কাউন্টার-টপের ওপর আঙুল দিয়ে একটা ক্রস চিহ্ন এঁকে তিনি বোঝালেন, “ঠিক একটা পিঠের মতো ভাগ করা হল। হিন্দুরা এখানে, মুসলমানরা ওখানে। ঢাকা আর আমাদের নেই।” তিনি বললেন, পার্টিশনের সময় হিন্দু-মুসলমানরা পরস্পরের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। এখনও অনেকের কাছেই, অন্য ধর্মের কারও উপস্থিতিতে খাওয়া অভাবনীয়।
আমি এর কিছুই বুঝতে পারলাম না। মি. পিরজাদা এবং আমার মা-বাবা একই ভাষায় কথা বলতেন, একই কথায় হাসতেন, অনেকটা একইরকম দেখতেও ছিল ওঁদের। তাঁরা খাবারের সংগে আমের চাটনি খেতেন, প্রতি রাতে হাত দিয়ে ভাত খেতেন, হজমের জন্য মৌরি চিবোতেন, মদ খেতেন না, খাওয়ার পর মিষ্টির বদলে একের পর এক চায়ের কাপে কোনও সাধারণ বিস্কুট ডুবিয়ে খেতেন। এসব সত্ত্বেও, বাবা চাইছিলেন যেমন আমি তঁদের মধ্যে তফাতটা বুঝতে পারি। তিনি ডেস্কের ওপরের দেওয়ালে সাঁটা সারা পৃথিবীর একটা মানচিত্র দেখাতে নিয়ে গেলেন। মনে হল, বাবা যেন এই ভেবে চিন্তিত যে, ভুল করে মি. পিরজাদাকে ভারতীয় বলে ফেললে তিনি অপমানিত বোধ করতে পারেন। আমি অবশ্য কল্পনাই করতে পারছিলাম না, মি. পিরজাদা কোনও কথাতেই অপমানিত বোধ করবেন। ‘মি. পিরজাদা বাঙালি, কিন্তু তিনি মুসলমান,” বাবা আমাকে বোঝালেন। “তাই তিনি পূর্ব পাকিস্তানে থাকেন, ভারতে নয়।” তাঁর আঙুল অতলান্তিকের ওপর দিয়ে এগিয়ে গেল। ইউরোপ , মেডিটেরিয়ান, মিডল ইস্ট এবং অবশেষে সেই ছড়িয়ে থাকা কমলা রঙের হিরেটা। মা বলেছিলেন সেটা দেখে যেন মনে হয় যেন কোনও শাড়ি পরা মহিলা বাঁ হাতটা বাড়িয়ে আছে। আমার মা বাবার সফর বোঝানোর জন্য অনেকগুলো শহরের চারপাশে গোল করে দাগ দেওয়া ছিল। সেই শহরগুলো একটা লাইন দিয়ে জোড়া। এবং তাঁদের জন্মস্থান কলকাতা একটা ছোট তারা দিয়ে চিহ্নিত ছিল। আমি সেখানে শুধু একবারই গিয়েছিলাম। সেই যাত্রার কোনও স্মৃতি ছিল না আমার। “দেখেছিস লিলিয়া, ওটা একটা আলাদা দেশ, আলাদা রঙ,” বাবা বললেন। পাকিস্তানের রঙ কমলা নয়--হলুদ। আমি লক্ষ করলাম যে, দেশটার দুটো আলাদা অংশ আছে। একটা অন্যটার চেয়ে অনেক বড়। ভারতের এক বিস্তৃত অংশ দিয়ে দুটো ভাগ করা। আমেরিকা থেকে আলাদা হয়ে, ক্যালিফোর্নিয়া আর কানেকটিকাট দিয়ে একটা দেশ তৈরি হলে যেমন হয়, তেমন।
বাবা তাঁর আঙুলের ডগা দিয়ে আমার মাথায় টোকা মারলেন। “তুই নিশ্চয়ই বর্তমান পরিস্থিতি জানিস। জানিস তো যে পূর্ব পাকিস্তান সার্বভৌম ক্ষমতার জন্য লড়াই করছে?”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম যদিও আমি কিছুই জানতাম না।
আমরা রান্নাঘরে ফিরে এলাম। মা একটা ঝাঁঝরি দিয়ে এক হাঁড়ি সেদ্ধ ভাত থেকে জল ঝরাচ্ছিলেন। বাবা কাউন্টারের ওপরের ক্যানটা খুলে আরও কাজু বাদাম খেতে খেতে চশমার ফ্রেমের ওপর দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। “তোকে স্কুলে ঠিক কী পড়ায় বল তো। ইতিহাস পড়িস? ভূগোল?”
“লিলিয়ার স্কুলে অনেক কিছুই পড়ায়,” মা বললেন। “আমরা এখন এখানেই থাকি। ও তো এখানেই জন্মেছে।” মা’র কথা শুনে মনে হল তিনি এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব গর্বিত, যেন সেটা আমার কোনও ব্যক্তিগত গুণ। আমি জানতাম যে, তাঁর ধারণা অনুযায়ী, মার জন্য এক নিরাপদ সহজ জীবন, ভাল শিক্ষাদীক্ষা এবং সব রকমের সুযোগ নিশ্চিত ছিল। আমাকে কখনও রেশনের খাবার খেতে হবে না, কারফিউ মানতে হবে না, ছাদে দাঁড়িয়ে কোনও দাঙ্গার সাক্ষী হতে হবে না বা কোনও পড়শিকে গুলি খেয়ে মরা থেকে বাঁচানোর জন্য জলের ট্যাঙ্কে লুকিয়ে রাখতে হবে না, যেমন তাঁদের করতে হয়েছিল। “ একবার ভাবো, ওদের একটা ভদ্রসভ্য স্কুলে ভরতি করা, লোডশেডিং হলে কেরোসিনের লণ্ঠনের আলোয় পড়তে বসানো। পড়ার চাপ, টিউটর, একের পর এক পরীক্ষা,” মা তাঁর ব্যাঙ্ক টেলারের কাজের উপযোগী ছাঁটা চুলের মধ্যে দিয়ে হাত চালালেন। “তুমি কী করে আশা করো যে ও পার্টিশন সম্পর্কে জানবে। বাদামগুলো রাখো এবার।”
“কিন্তু ও পৃথিবীর সম্পর্কে কী শিখছে?” বাবা কাজুর কৌটাটা হাতে ঝাঁকিয়ে বললেন। “কী শিখছে ও?”
বলাবাহুল্য, আমরা আমেরিকার ইতিহাস শিখতাম এবং আমেরিকার ভূগোল। সে বছর এবং মনে হত যেন প্রতি বছরই, আমরা রেভলিউশনারি ওয়ার দিয়ে পড়াশোনা করতাম। স্কুলবাসে চেপে আমাদের প্লাইউমাউথ রক দেখতে, ফ্রিডম ট্রেল-এর ওপর হাঁটতে এবং বাঙ্কার হিল মনুমেন্ট-এর ওপর চড়তে নিয়ে যাওয়া হত। রঙিন কাগজ দিয়ে মডেল তৈরি করতাম, জর্জ ওয়াশিংটন ডেলাওয়্যার নদীর উত্তাল জল পার হচ্ছেন। সাদা রঙের টাইট্স এবং কালো রঙের বো পরা কিং জর্জের পুতুল তৈরি করতাম। পরীক্ষার সময় আমাদের তেরোটি কলোনির ফাঁকা ম্যাপ দিয়ে নাম, তারিখ এবং রাজধানী লিখতে বলা হত। আমি চোখ বুজে ওই কাজগুলো করতে পারতাম।
পরের দিন সন্ধেবেলা, মি. পিরজাদা নিয়মমতো ছ’টার সময় আমাদের বাড়ি এলেন। অনেকদিনের পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি এবং আমার বাবা দেখা হওয়ার সময় হাত মেলানোর অভ্যাসটা ছাড়তে পারেননি।
“আসুন, লিলিয়া, মি. পিরজাদার কোটটা নাও।”
নিখুঁত স্যুট, স্কার্ফ এবং কলারে সিল্কের টাই পরিহিত মি. পিরজাদা সামনের ঘরে এসে দাঁড়ালেন। প্রতিদিন তিনি প্লাম, অলিভ এবং চকোলেট ব্রাউন রঙের সাজে উপস্থিত হতেন। পিরজাদা ছিলেন একজন পরিপাটি মানুষ। যদিও তার পা দুটো বাইরের দিকে ছড়িয়ে থাকত এবং একটু ভুঁড়ি ছিল, তাও তিনি বেশ একটা কর্মদক্ষ ভঙ্গি বজায় রাখতেন, যেন দু’হাতে দুটো সমান ওজনের সুটকেস ধরে আছেন। তাঁর কানে কয়েকটি চুলের গোছা পেকে গিয়েছিল। দেখে মনে হত, সেগুলো জীবনের অপ্রীতিকর শব্দ থেকে তাঁর কান ঢেকে রেখেছে। তাঁর ঘন পলকওয়ালা চোখে ছিল ধূসরের ছোঁয়া। হৃষ্টপুষ্ট গোঁফটি যেন মজা করে দু’পাশে উঠে আছে আর, বাঁ গালের ঠিক মধ্যিখানে একটা চ্যাপটা কিশমিশের মতো জড়ুল। মাথায় পারসি ভেড়াদের লোম থেকে বানানো একটি কালো রঙের ফেজটুপি পরতেন। ববি পিন দিয়ে আটকানো এই টুপিটি ছাড়া আমি তাঁকে কখনো দেখিনি। আমার বাবা সসময়ই তাঁকে আমাদের গাড়ি করে নিয়ে আসার প্রস্তাব দিতেন, কিন্তু তিনি ডরমিটরি থেকে আমাদের পাড়ার গাছপালা, ঝোপঝাড় দেখতে দেখতে হেঁটে যখন এসে পৌঁছতেন, তখন হেমন্তের তাজা হাওয়ায় তাঁর আঙুলের গাঁটগুলো গোলাপি হয়ে যেত।
“ভারতে আরও এক উদ্বাস্তু।”
“শেষ যা গোনা হয়েছে, তাতে আন্দাজ ন’মিলিয়ন দাঁড়িয়েছে,” আমার বাবা বললেন।
মি. পিরজাদা আমার তাঁর কোটটা দিলেন । আমার কাজ ছিল সিঁড়ির নীচের র্যাকে সেটা ঝুলিয়ে রাখা। ধূসর আর নীল রঙের উল দিয়ে ছোট ছোট চেক কাটা, কোটটায় ডোরাকাটা লাইনিং এবং শিং-এর বোতাম লাগানো। বুনটের মধ্যে লেবুর হালকা গন্ধ থাকত। ভিতরে চেনার মতো কোনও লেবেল লাগানো ছিল না। শুধু হাতে সেলাই করা একটা লেবেলে টানা টানা হাতের লেখায় চকচকে কালো সুতো দিয়ে এমব্রয়ডারি করা ছিল ‘জেড সৈয়দ, সুটর্স’। কোনও কোনও দিন বার্চ বা মেপল গাছের একটা পাতা পকেটে ঢোকানো থাকত। তিনি জুতোর ফিতে খুলে জুতোজোড়া বেসবোর্ডের গায়ে হেলান দিয়ে রাখলেন। আমাদের ভিজে, পাতাঝরা লনের ওপর দিয়ে হাঁটায় তাঁর জুতোর ডগায় এবং গোঁড়ায় এক ধরনের সোনালি কাদাটে মিশ্রণ লেগে ছিল। এইসব পোশাকআশাক থেকে মুক্ত হওয়ার পর তিনি তাঁর বেটে, অস্থির আঙ্গুলগুলো আমার গলায় চাপড় দিলেন, ঠিক যেমনভাবে কেউ দেওয়ালে পেরেক গাঁথার আগে সেই জায়গাটা চাপড়ে দেখে নেয় সেটা নিরেট কি না। তারপর তিনি বাবার পিছন পিছন বসবার ঘরে ঢুকলেন। সেখানে টিভিতে স্থানীয় খবর চালানো ছিল। তাঁরা বসবার সঙ্গে সঙ্গে মা রান্নাঘর থেকে এক প্লেট কাবাব আর ধনেপাতার চাটনি নিয়ে আসলেন। মি. পিরজাদা একটা নিয়ে মুখে পুরলেন।
“আমরা শুধুমাত্র আশা করতে পারি যে,” আর-একটা কাবাবের দিকে হাত বাড়িয়ে তিনি বললেন, “ঢাকার রিফিউজিরাও এত ভাল খেতে পায়। এই কথা থেকে মনে পড়ে গেল।” তিনি সুটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দারচিনির হার্ট ভরতি একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের ডিম বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, “ বাড়ির ‘লেডি’র জন্য।” তার সঙ্গে ওই ছড়ানো পায়ে প্রায় বোঝাই যায় না এমনভাবে সামান্য ঝুঁকে আমাকে ‘বাও’ করলেন।
“সত্যি মি. পিরজাদা,” মা আপত্তি জানালেন। “রাতের পর রাত। আপনি ওকে বিগড়ে দিচ্ছেন একেবারে।”
“আমি শুধু সেই বাচ্চাদেরই বিগড়ে দেই, যারা বিগড়ে যেতে পারে না।”
আমার কাছে সেটা ছিল একটা অস্বস্তিকর মুহূর্ত। কিছুটা ভয়ে, কিছুটা উৎফুল্ল হয়ে আমি এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতাম। মি. পিরজাদার হৃষ্টপুষ্ট, দরাজ আভিজাত্য আমাকে মুগ্ধ করত, আমার প্রতি তাঁর মনোযোগে যে আধো-নাটকীয়তা ছিল, তাতে আমি তৃপ্ত বোধ করতাম, কিন্তু তাঁর ভাবভঙ্গিতে যে চূড়ান্ত স্বাচ্ছন্দ্য ছিল, তা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলত। মুহূর্তের জন্য মনে হত যেন, আমি নিজের বাড়িতেই আগন্তুক। আমাকে কিছু দেওয়াটা তাঁর একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেক সপ্তাহ ধরে, পরস্পরের সঙ্গে আরও সহজ হওয়ার আগে ওটাই একমাত্র উপলক্ষ ছিল, যখন তিনি আমার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন। আমার কোনও উত্তর ছিল না, যখন তিনি আমার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন। কোনও মন্তব্য করতাম না আমি ভাবলেশহীন মুখে আমি তাঁর কাছ থেকে মধুভরা লজেঞ্জ, র্যাস্পবেরি ট্রাফল, টক প্যাস্টিলের সরু সরু রোল গ্রহণ করে যেতাম। আমি তাঁকে ধন্যবাদও জানাতে পারতাম না। কারণ, একবার বেগুনি সেলোফেনে মোড়া বিশেষভাবে লোভনীয় পিপারমেন্ট ললিপপ পাওয়ার জন্য আমি যখন তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম, তখন তিনি বলেছিলেন, “ধন্যবাদ আবার কীসের? ব্যাঙ্কের ভদ্রমহিলা আমাকে ধন্যবাদ জানান, দোকানের ক্যাশিয়ার আমাকে ধন্যবাদ জানান, নির্ধারিত তারিখের পর বই ফেরত দিলে লাইব্রেরিয়ান আমাকে ধন্যবাদ জানান, ঢাকায় আমার ফোনটা লাগানোর চেষ্টা করা হলে ওভারসিস অপারেটর আমাকে ধন্যবাদ জানান। আমাকে যদি এইদেশে সমাধিস্থ করা হয়, তা হলে নিঃসন্দেহে আমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময়ও আমাকে ধন্যবাদ জানানো হবে।”
মি. পিরজাদার দেওয়া মিষ্টিটা যেমন তেমন ভাবে খাওয়া আমার অশোভন মনে হত। প্রতিটি সন্ধের উপহারের মূল্য আমার কাছে ধনরত্ন বা গুপ্তধনের একটি রত্ন বা মুদ্রার মতোই ছিল। আমি সেটি আমার খাটের পাশে একটি কারুকার্য করা ছোট চন্দনকাঠের বাক্সে রাখতাম। বহু বছর আগে আমার ঠাকুরমা ওই বাক্সে চানের পর খাওয়ার জন্য সুপারি রাখতেন। যে ঠাকুরমাকে আমি কোনোদিন দেখিনি, আমার কাছে সেই ঠাকুরমার একমাত্র চিহ্ন ছিল সেই বাক্সটি। মি. পিরজাদা আমাদের জীবনে আসার আগে পর্যন্ত আমি ওই বাক্সে রাখার মতো কিছুই খুঁজে পেতাম না। মাঝে মাঝেই দাঁত মাজার এবং পরের দিনের জন্য স্কুলের জামাকাপড় বের করে রাখার আগে আমি বাক্সের ঢাকনা খুলে তাঁর দেওয়া মিষ্টিগুলোর মধ্যে খেতাম।
রোজ রাতের মতো সেই রাতেও আমরা ডাইনিং টেবিলে বসে খেলাম না। কারণ টেবিলে বসে ভাল করে টিভি দেখা যেত না। তাই আমরা বাক্যালাপ ছাড়াই, কফি টেবিলের চারপাশে, হাঁটুর ওপর খাবার প্লেট রেখে জড়ো হয়ে বসলাম। মা রান্নাঘর থেকে একের পর এক খাবার আনলেন। ভাঁজা পেয়াজ দেওয়া মুসুরডাল, নারকেল দেওয়া সবুজ বিন, দই-কিশমিশ দেওয়া মাছ। জলের গেলাস, প্লেটভরতি লেবুর টুকরো এবং লঙ্কা নিয়ে আমি তাঁর পিছন পিছন এলাম। শেষের বস্তুটি প্রতি মাসে চায়নাটাউনে গিয়ে পাউন্ডদরে কেনা হত এবং ফ্রিজে জমিয়ে রাখা হত। বড়রা সেগুলো ছিঁড়ে, খাবারে ঘষে খেতে ভালবাসতেন।
খাওয়ার আগে মি. পিরজাদা সবসময় এক অদ্ভুত কাজ করতেন। বুকপকেট থেকে একটা ব্যান্ডহীন, সাদাসিধে রুপোর ঘড়ি বের করতেন, কয়েক মুহূর্তের জন্য সেটি কানের কাছে ধরতেন এবং তর্জনী এবং বুড়ো আঙুলের তিনটে দ্রুত টোকায় ঘড়িটায় দম দিতেন। তিনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন যে, তাঁর পকেট ঘড়িটা তাঁর রিস্টওয়াচের মতো নয়। সেটা ঢাকার স্থানীয় সময় অনুযায়ী ঠিক করা আছে। আমাদের সময়ের চেয়ে ১১ ঘণ্টা এগিয়ে। খাওয়ার সময় ঘড়িটা কফি টেবিলে, তাঁর মুড়ে রাখা কাগজের ন্যাপকিনের ওপর রাখা থাকত। তিনি কখনও ঘড়িটা দেখতেন বলে মনে হয় না।
মি. পিরজাদা ভারতীয় নন, এটা জানতে পারার পর আমি তাঁকে ভালভাবে লক্ষ করতাম। কোন দিক দিয়ে তিনি আমাদের চেয়ে আলাদা, তা বোঝবার চেষ্টা করতাম। মনে হল যে, পকেটঘড়িটা তেমনই একটা জিনিস। সে রাতে, তাঁকে সেটি দম দিয়ে কফিটেবিলের ওপর রাখতে দেখে আমার কেমন অস্বস্তি হল। উপলব্ধি করলাম যে, জীবনটা আগে ঢাকায় প্রবাহিত হচ্ছে। কল্পনা করলাম, মি. পিরজাদার মেয়েরা ঘুম থেকে উঠেছে, চুলের ফিতে বাঁধছে, প্রাতরাশের তোড়জোড় করছে, স্কুলের জন্য তৈরি হচ্ছে। আমাদের খাওয়া-দাওয়া, আমাদের কাজকর্ম সবই সেখানে আগেই যাওয়া কাজকর্মের ছায়ামাত্র। মি. পিরজাদা আদতে যেখানকার মানুষ, সেই জায়গাটির এক পিছিয়ে পড়া ছায়া।
সাড়ে ছ’টা জাতীয় খবরের সময়। বাবা ভলিউম বাড়িয়ে এন্টেনাগুলো ঠিক করে দিতেন। আমি সাধারণত কোনও বই নিয়ে বসতাম, কিন্তু সে রাতে বাবা বললেন আমার মন দিয়ে শোনা উচিত। দেখলাম ধুলোয় ঢাকা রাস্তার ওপরে ট্যাঙ্ক গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে, কত বিল্ডিং ধসে পরেছে, অচেনা গাছের জঙ্গলে পূর্ব পাকিস্তানের রিফিউজিরা পালিয়ে ভারতের সীমান্তে আশ্রয় খুঁজছে। পাখার মতো পালতোলা নৌকা প্রশস্ত কফি রঙের নদীতে ভেসে যাচ্ছে, কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা পড়েছে ব্যারিকেডের পিছনে, খবরের কাগজের অফিস পুড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি মি. পিরজাদার দিকে তাকালাম। ছবিগুলো ছোট্ট হয়ে একের পর এক তাঁর চোখের ওপরেও ভেসে উঠছিল। দেখার সময় তাঁর মুখে এক অচঞ্চল ভাব ছিল। অবিচলিত, কিন্তু সজাগ। যেন কেউ তাঁকে অচেনা কোনও জায়গায় পৌঁছানোর নির্দেশ দিচ্ছে।
বিজ্ঞাপনের বিরতির সময় আমারও ভাত আনতে রান্নাঘরে গেলেন মা। বাবা এবং মি. পিরজাদা ইয়াহিয়া খান নামে কোনও জেনারেলের নীতির নিন্দে শুরু করলেন। তাঁরা যেসব চক্রান্তের আলোচনা করছিলেন, আমি সে-সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না। আমি সেই বিপর্যয়ের কিছুই বুঝছিলাম না। আমাকে আর-এক টুকরো মাছ দিতে দিতে বাবা বললেন, “ দেখ, তোর বয়সী সব ছেলেমেয়ে, বেঁচে থাকার জন্য কী করতে হচ্ছে তাদের।” কিন্তু আমি আর খেতে পারছিলাম না। আমি শুধু আড়চোখে মি. পিরজাদার দিকে তাকাচ্ছিলাম। তিনি জলপাই-সবুজ জ্যাকেট গায়ে আমার পাশে বসে শান্তভাবে তাঁর ভাতের স্তূপে দ্বিতীয় হাতা ডালের জন্য কুয়ো তৈরি করছিলেন। ওই ধরনের গুরুগম্ভীর ব্যাপারে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষকে যেমন লাগে বলে আমার ধারণা ছিল, তার সঙ্গে মি. পিরজাদার মিল ছিল না। আমি ভাবতাম, উনি কি সবসময় অত পরিপাটিভাবে জামাকাপড় পরে থাকেন যাতে আকস্মিক কোনও দুঃসংবাদ পেলে যথোচিত গাম্ভীর্য এবং সম্মানের সঙ্গে তা সহ্য করতে পারবেন? এমন-কী দরকার পড়লে মুহূর্তের মধ্যে কারও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত হতে পারবেন? আরও ভাবতাম, কেমন হবে, যদি হঠাৎ তাঁর সাত মেয়েকে টিভিতে দেখা যায়? যদি তারা কোনও বারান্দা থেকে মি. পিরজাদার দিকে হেসে, হাত নাড়িয়ে চুমু ছুড়ে দেয়? কল্পনা করতাম, তা হলে তিনি কত আশ্বস্ত হবেন। কিন্তু সেরকম কখনও হত না।
সে রাতে যখন আমি দারচিনির হার্টওয়ালা প্লাস্টিকের ডিমটা আমার খাটের পাশে বাক্সে রাখলাম, তখন অন্য দিনের মতো প্রাপ্তির আনন্দ হল না। আমি লেবুর গন্ধওলা ওভারকোট পরা মি. পিরজাদার কথা মনে না করার চেষ্টা করছিলাম। কয়েক ঘণ্টা আগে, আমাদের উজ্জ্বল, কার্পেট-বিছানো বসবার ঘরে যে বিশৃঙ্খল, গরমে ঝলসানো জগতের ছবি দেখছিলাম, তার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আছে। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে আমি ওই কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারলাম না। টিভির পরদায় মাঝে মাঝেই যে তাড়িত, অশান্ত মানুষের দল দেখা যাচ্ছিল, মি. পিরজাদার স্ত্রী এবং সাত মেয়ে তেমন কোনও দলের সদস্য, এই দুর্ভাবনায় আমার পেটের ভিতর কীরকম করছিল। ছবিটা মন থেকে তাড়ানোর জন্য আমি ঘরের চারপাশে তাকালাম, হলুদ চাদর দেওয়া আমার বিছানা, তার সঙ্গে রঙ মিলিয়ে জালি দেওয়া পরদা, সাদা-বেগুনি কাগজ লাগানো দেওয়ালে টাঙানো ফ্রেমে সাঁটা ক্লাসের ছবি, দেওয়াল-আলমারির দরজার ওপর পেনসিলের লেখা, সেখানে বাবা প্রতি জন্মদিনে আমার উচ্চতা মাপেন। কিন্তু যতই আমি নিজের মনটাকে অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করলাম, ততই আমি নিজেকে বোঝাতে থাকলাম যে, মি. পিরজাদার স্ত্রী-কন্যারা হয়তো মারাই গিয়েছেন। শেষে আমি বাক্স থেকে এক টুকরো চৌকো সাদা চকোলেট বের করে, মোড়ক খুললাম। তারপর আমি এমন একটা কাজ করলাম, যা আগে কখনও করিনি। চকোলেটটা মুখে পুরে, সেটা মুখে রেখে যথাসম্ভব গলে যেতে দিলাম। তারপর আস্তে আস্তে সেটা চিবানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থনা করলাম যে, মি. পিরজাদার পরিবার যেন নিরাপদে সুস্থ থাকে। আমি এর আগে কখনও কিছুর জন্য প্রার্থনা করিনি। আমাকে কখনো প্রার্থনা করতে বলা বা শেখানোও হয়নি। কিন্তু আমি ঠিক করলাম যে, সেই পরিস্থিতিতে আমার প্রার্থনা করা উচিত। কারণ, আমার ভয় হচ্ছিল, সত্যি সত্যি দাঁত মাজে হয়ত তার সঙ্গে প্রার্থনাও ধুয়ে যাবে। আমি ব্রাশটা ভিজিয়ে, টুথপেস্টের টিউবটা একটু সরিয়ে রাখলাম যাতে আমার মা বাবা কোনও প্রশ্ন না করেন। তারপর জিভে চিনি লেগে থাকা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পরলাম।
যে যুদ্ধের বৃত্তান্ত আমাদের বসবার ঘরে এত বিশ্বস্তভাবে শোনা হত, সেই যুদ্ধ নিয়ে আমাদের স্কুলে কোনও হত হত না। আমরা আমেরিকার বিদ্রোহ নিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে গেলাম। প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কর মকুব করা কত অন্যায় তা শিখলাম এবং ডিক্লারেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স-এর কয়েকটি অংশ মুখস্থ করলাম। টিফিন টাইমে ছেলেরা দু’দলে ভাগ হয়ে দোলনা, ঢেঁকির চারদিকে পরস্পরকে তাড়া করে বেড়াত। একপক্ষে লালকোট, বিপক্ষে কলোনি। ক্লাসরুমে আমাদের শিক্ষিকা মিসেস কেনিয়ন মাঝে মাঝে ই আমাদের একটা ম্যাপ দেখাতেন । সিনেমার পরদার মতো মানচিত্রটা চকবোর্ডের ওপর থেকে বেরিয়ে আসত, মিসেস কেনিয়ন আমাদের ‘মে-ফ্লাওয়ারের’র যাত্রাপথ বা লিবার্টি বেল কোথায় অবস্থিত দেখাতেন। প্রতি সপ্তাহে ক্লাসের দু’জন সদস্য রেভলিউশন-এর কোনও একটি বিশেষত্বের ওপর রিপোর্ট পেশ করত। তাই একদিন, ইয়র্কটাউনে আত্মসমর্পণের অধ্যায় সম্পর্কে শেখার জন্য আমার বন্ধু ডোরার সঙ্গে স্কুলের লাইব্রেরিতে পাঠানো হল। মিসেস কেনিয়ন আমাদের একটা কাগজে তিনটে বইয়ের নাম লিখে দিলেন যেগুলো কার্ড ক্যাটালগে খুঁজে বের করতে হবে। আমরা বইগুলো একবারেই খুঁজে পেলাম; পড়ে নোটস নেওয়ার জন্য একটা নিচু গোল টেবিলে বসলাম। কিন্তু আমি পড়ায় মন দিতে পারছিলাম না। ব্লন্ডুডের তাকগুলোর যে অংশে আমি ‘এশিয়া’ লেখা লেবেল দেখেছিলাম সেখানে ফিরে গেলাম। চিন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া সম্পর্কে বই রয়েছে সেখানে। শেষ ‘পাকিস্তান : আ ল্যান্ড অ্যান্ড ইটস পিপল’ নামে একটা বই দেখে একটা টুলে বসে বইটা খুললাম। বইয়ের মলাটটা আমার আঙুলের ভিতর খসখস করে উঠল। নদী, ধানক্ষেত, সৈন্যের পোশাক-পরা লোকদের ছবিওয়ালা পাতাগুলো ওলটাতে শুরু করলাম। একটা অধ্যায় ঢাকা নিয়ে লেখা। আমি ঢাকার বৃষ্টিপাত আর চটের উৎপাদন সম্পর্কে পরতে শুরু করলাম। জনসংখ্যার ওপর একটা চার্ট পড়ছিলাম, এমন সময় ডোরা এসে দাঁড়াল।
“এখানে কী করছিস? মিসেস কেনিয়ন লাইব্রেরিতে এসেছেন। আমরা ঠিক করে পরছি কি না দেখতে এসেছেন।”
আমি চটাস করে বইটা বন্ধ করলাম। শব্দটা একটু বেশি জিরেই হয়ে গেল। মিসেস কেনিয়ন এলেন। তাকের মাঝখানের সরু চলাচল-পথটার পুট (স্পাইন) ধরে এমনভাবে তুললেন যেন আমার সোয়েটারে লেগে থাকা কোনও চুল তুলছেন। মলাটটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তারপর আমার দিকে তাকালেন।
“এই বইটা কি তোমার রিপোর্টে কাজে লাগবে, লিলিয়া?”
‘না, মিসেস কেনিয়ান।”
“তা হলে বইটা পরার কোনও কারণ দেখছি না,” তিনি বইটা তাকের সরু ফাঁকে রেখে দিয়ে বললেন। “তুমি কি দেখছ?”
যত সপ্তাহ যেতে লাগল, খবরে ঢাকার কোনও ছবি দেখতে পাওয়া কঠিন হয়ে পরল। প্রথম বা কখনও দ্বিতীয় বিরতির পর রিপোর্ট পাওয়া যেত। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করে, সাংবাদিকদের সরিয়ে, আটকে, অন্য পথে চালিত করা হচ্ছিল। কোনও কোনও দিন, প্রায়দিনই, শুধু মৃতের সংখ্যা জানানো হত। আর তার আগের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি। আরও কয়েকজন কবিকে মেরে ফেলা হয়েছিল, আরও কয়েকটি গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এতসব হওয়া সত্ত্বেও, মা বাবা এবং মি. পিরজাদা রাতের পর রাত সময় নিয়ে, ধীরে সুস্থে রাতের খাবার খেতেন। টিভি বন্ধ করার পর, থালাবাসন ধুয়ে শোকানো হয়ে গেলে, তাঁরা মজা করতেন, গল্প করতেন এবং চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খেতেন। রাজনীতি নিয়ে আলোচনা একঘেয়ে হয়ে গেলে আলোচনার বিষয় ছিল, নিউ ইংল্যান্ডের পত্রমোচী বৃক্ষ সম্পর্কে মি। পিরজাদার বই কদ্দুর এগোল, আমার বাবার কার্যকালের মেয়াদের মনোনয়ন বা মায়ের ব্যাংকের আমেরিকান সহকর্মীদের খাওয়া-সংক্রান্ত অদ্ভুত অভ্যেস ইত্যাদি। কিছুক্ষণ পর আমাকে হোমওয়ার্ক করার জন্য ওপরে পাঠিয়ে দেওয়া হত, কিন্তু কার্পেটের মধ্যে দিয়ে আমি শুনতে পেতাম যে, তারা আরও চা খাচ্ছেন, ক্যাসেটে কিশোরকুমারের গান শুনছেন, কফি টেবিলের ওপর স্ক্র্যাবল খেলছেন, গভীর রাত পর্যন্ত ইংরেজি বানা নিয়ে তর্কাতর্কি, হাসাহাসি করছেন। আমি ওদের সঙ্গে যোগ দিতে চাইতাম। সবচেয়ে বেশি ইচ্ছে করত মি. পিরজাদাকে সান্ত্বনা জানাতে। কিন্তু তাঁর পরিবারের কথা ভেবে এক টুকরো চকোলেট খাওয়া এবং নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। তাঁরা এগারোটার খবর শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত স্ক্র্যাবল খেলতেন। তারপর মাঝরাত নাগাদ মি. পিরজাদা হেঁটে তাঁর ডর্মিটরিতে ফিরে যেতেন। সেইজন্য আমি কখনও তাঁকে চলে যেতে দেখিনি, কিন্তু রোজ রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমি তিনজনের কথাবার্তা শুনতে পেতাম। পৃথিবীর অপর প্রান্তে এক নতুন দেশের জন্মের সম্ভাবনার কথা।
অক্টোবর মাসে একদিন মি. পিরজাদা এসে জিজ্ঞেস করলেন, “ সব বাড়ির দরজায় ওই বড় বড় কমলা রঙের সবজিগুলো কী? কোনও ধরনের লাউ নাকি?”
“ওটা কুমড়ো,” মা বললেন। “লিলিয়া, মনে করিয়ে দিস তো সুপারমার্কেট থেকে একটা কিনতে হবে।”
“ওটা দিয়ে কী করে? এটা কীসের চিহ্ন?”
“এটা দিয়ে জ্যাক-ও-ল্যান্টার্ন বানায়,” আমি জানালাম। বোঝানোর জন্য দাঁত খিঁচিয়ে একটা হিংস্র হাসি হাসলাম। “এভাবে ভয় পাওয়ানোর জন্য।”
“বুঝলাম,” মি. পিরজাদা প্রত্যুত্তরে হাসলেন। “খুবই উপকারী মনে হচ্ছে।”
পরের দিন মা একটা দশ পাউন্ডের মোটাসোটা, গোলগাল কুমড়ো কিনলেন। সেটা ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা হল। খাওয়ার আগে, যখন বাবা এবং মি. পিরজাদা স্থানীয় খবর দেখছিলেন, তখন মা আমাকে বললেন পেন দিয়ে ফলটা সাজাতে। কিন্তু আমি পাড়ায় যেমন দেখেছিলাম, সেভাবে ওটাকে কেটে সাজাতে চাইছিলাম।
“হ্যাঁ, চলো, ওটাকে কেটে সাজানো যাক,” মি. পিরজাদা সোফা থেকে উঠলেন। “আজ খবর চুলোয় যাক।” কিছু জিজ্ঞেস না করে রান্নাঘরে গেলেন।, একটা ড্রয়ার খুললেন, তারপর একটা লম্বা খাঁজকাটা ছুরি নিয়ে ফিরে এলেন। সম্মতির জন্য তিনি আমার দিকে তাকালেন। “আমি করি?”
আমি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাম। সেই প্রথমবার আমরা সকলে ডাইনিং টেবিলের চারপাশে জড়ো হলাম। মা, বাবা, মি. পিরজাদা এবং আমি। টিভি চলা সত্ত্বেও কেউ আর ওদিকে মন দিল না। আমরা খবরের কাগজ দিয়ে টেবিলটা ঢাকলাম। মি. পিরজাদা তাঁর জ্যাকেটটা খুলে একটা চেয়ারের পিঠে ঝুলিয়ে উপল পাথরের একজোড়া কাফলিঙ্ক খুলে রেখে তাঁর মাড় দেওয়া শার্টের হাতাগুলো গুটিয়ে নিলেন।
“প্রথমে ওপরদিকটা কাটুন। এভাবে,” আমি তর্জনী ঘুরিয়ে কায়দাটা দেখিয়ে নির্দেশ দিলাম।
মি. পিরজাদা প্রথমে ছুরির ফলার গায়ে ঢুকিয়ে সেটাকে চারপাশে ঘোরালেন। একটা গোটা বৃত্ত কাটা হয়ে যাওয়ার পর তিনি ওপরের ঢাকার মতো অংশটার বোঁটা তুলে ধরলেন। সেটা খুব সহজেই আলগা হয়ে উঠে আসল। এক মুহূর্তের জন্য মি. পিরজাদা ফলটার ওপর ঝুঁকে পড়ে ভিতরটা দেখলেন এবং শ্বাস ভরে গন্ধটা নিলেন। তারপর মা তাঁকে একটা লম্বা ধাতব চামচ দেওয়াতে সেটা দিয়ে ভিতরের অংশটা পরিষ্কার করে চেঁছে বের করলেন যতক্ষণ না শেষ সুতো, শেষ বীজটাও বেরিয়ে গেল। ইতিমধ্যে বাবা শাঁস থেকে বীজ বাদ দিয়ে একটা বিস্কুট করার শীট-এর ওপর শুকোতে দিয়েছিলেন, যাতে পরে আমরা সেগুলো ঝলসে খেতে পারি। ফলটার দাগকাটা গায়ে আমি দুটো ত্রিভুজ আঁকলাম। মি. পিরজাদা সে দুটো কেটে দিলেন। তারপর আমি ভুরুর জন্য দুটো অর্ধচন্দ্রাকার এবং নাকের জন্য আর একটা ত্রিভুজ আঁকলাম। ধুধু মুখটাই বাকি ছিল। মনে হল দাঁত তৈরি করাটা একটু কঠিন হবে, আমি ইতস্তত করছিলাম।
“হাসবে, নাকি মুখ বেঁকিয়ে থাকবে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“তুমিই বলো,” মি. পিরজাদা বললেন।
সমঝোতা করার জন্য একটা সোজাসাপটা গম্ভীর মতো মুখ আঁকলাম, বিষণ্ণ নয়, হাসি-হাসিও নয়। মি. পিরজাদা একটুও না দমে গিয়ে কাটতে শুরু করলেন, যেন সারা জীবন জ্যাক_ও ল্যান্টার্ন কেটে এসেছেন। তাঁর কাজ প্রায় শেষ হয়েই গিয়েছিল যখন জাতীয় খবর শুরু হল। সাংবাদিক ঢাকার নাম উল্লেখ করলেন এবং আমরা সকলেই শোনার জন্য টিভির দিকে ফিরলাম। একজন ভারতীয় কর্মকর্তা ঘোষণা করলেন যে, বাকি পৃথিবী যদি পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দেয়, তা হলে ভারতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। খবরটা শোনানোর সময় সাংবাদিকটির মুখ থেকে ঘাম ঝরে পরছিল। কোনও টাই বা জ্যাকেট ছাড়াই এমন জামাকাপড় পরেছিলেন যেন, তিনি নিজেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছেন। ক্যামেরাম্যানকে চিৎকার করে কথাগুলো বলার সময় তিনি তাঁর রোদে পোড়া মুখটা সূর্যের তাপ থেকে বাঁচানোর জন্য হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন। মি. পিরজাদার হাত থেকে ছুরিটা ফসকে পরে গিয়ে কুমড়োটার নীচের দিকটা কেটে গেল।
“প্লিজ আমাকে ক্ষমা করবেন,” মি. পিরজাদা তাঁর তাঁর মুখের একপাশে একটা হাত তুললেন, যেন কেউ তাঁকে সেই গালে থাপ্পড় মেরেছে। “আমি --এ তো ভয়ংকর ব্যাপার। আমি আর-একটা কিনে দেব। আমরা আবার চেষ্টা করব।”
“আরে না, না, “ বাবা বললেন। তিনি মি. পিরজাদার হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে ফলটা এমনভাবে কাটলেন যাতে ভুলটা ঢাকা পড়ে যায়। আমার আঁকা দাঁতগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল। তার জায়গায় একটা বেখাপ্পা রকমের বড় পাতিলেবুর মাপের ফুটো তৈরি হল এবং তার ফলে আমাদের জ্যাক-ও-ল্যান্টার্নের মুখে এক শান্ত স্তম্ভিত ভাব এসে গেল। ভুরুগুলো আর রাগী রাগী দেখতে রইল না। বরং এক শূন্য, জ্যামিতিক দৃষ্টির ওপর বিস্ময়ে স্থির হয়ে ভাসতে থাকল।
হ্যালোউইনে আমি ডাইনি সেজেছিলাম। আমরা ট্রিক-অর ট্রিট-এর সঙ্গী ডোরাও ডাইনি হয়েছিল। বালিশের ওয়াড় রঙ করে আমরা কালো কেপ (হাতকাটা ক্লক) বানিয়েছিলাম, সেই সঙ্গে কার্ডবোর্ডের চওড়া কানাওয়ালা আইসক্রিম কোনের মত টুপি। ডোরার মায়ের একটা ভাঙ্গা আইশ্যাডো দিয়ে আমরা আমাদের মুখে সবুজ রঙ লাগালাম। আমার মা লজেঞ্জ রাখার জন্য আমাদের দুটো মোটা ক্যানভাসের বস্তা দিলেন, যার মধ্যে একসময় বাস্মতী চাল ছিল। সে বছর আমাদের মা-বাবাদের মনে হয়েছিল যে, আমরা একা একা পাড়ায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য যথেষ্ট বড় হয়ে গিয়েছি। কথা ছিল আমি আমাদের বাড়ি থেকে ডোরার বাড়ি হেঁটে যাব, সেখান থেকে ফোন করে জানাব যে আমি নিরাপদে পৌঁছেছি এবং তারপর ডোরার মা আমাকে গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দেবেন। বাবা আমাদের টর্চ দিলেন। আমাকে ঘড়ি পরতে হল এবং তাঁর ঘড়ির সঙ্গে সময় মিলিয়ে নিতে হল। আমাদের ন’টার চেয়ে বেশি দেরি করার অনুমতি ছিল না।
সেই সন্ধেয় মি. পিরজাদা এসে আমাকে এক বাক্স মিন্ট ভরতি চকোলেট দিলেন।
“এর মধ্যে,” আমি বস্তাটা খুলে ধরে বললাম, “ট্রিক অর ট্রিট।”
“বুঝতে পেরেছি যে, আজ তোমার আমার উপহারের দরকার নেই,” বাক্সটা জমা দিয়ে তিনি বললেন। মি. পিরজাদা আমার সবুজ মুখ এবং টুপির দিকে তাকালেন। টুপিটা একটা সুতো দিয়ে আমার চিবুকের তলায় বাঁধা ছিল। খুব সাবধানে তিনি আমার টুপিটার প্রান্ত একটু তুলে ধরলেন। আমি টুপির নীচে একটা একটা সোয়েটার এবং ভেড়ার লোমের চিন দেওয়া জ্যাকেট পরেছিলাম। “তোমার শীত করবে না তো?”
আমি ঘাড় নাড়লাম, টুপিটা একদিকে হেলে গেল।
মি. পিরজাদা টুপিটা সোজা করে দিলেন। “স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাই বোধ হয় ভাল।”
আমাদের সিঁড়ির নীচটা ছোট ছোট লজেঞ্জের বাক্সে ভরতি হয়ে ছিল। মি. পিরজাদা জুতো খুলে অন্যদিনে মতো সেখানে না রেখে দেওয়াল আলমারির ভিতর রেখে কোটের বোতাম খুলতে শুরু করলেন। আমি তাঁর কোটটা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, কিন্তু ডোরা বাথরুম থেকে আমাকে ডেকে বলল যে, চিবুকে একটা জড়ুল আঁকার জন্য আমার সাহায্য চাই। আমরা প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার পর মা ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড় করিয়ে আমাদের একটা ফোটো তুললেন। তারপর আমি বেরোব বলে সদর দরজা খুললাম। মি. পিরজাদা এবং আমার বাবা তখনও বসার ঘরে যাননি, সামনের ঘরেই ঘোরাঘুরি করছিলেন। বাইরে আঁধার নেমে এসেছিল। হাওয়ায় ভিজে পাতার গন্ধ। দরজার পাশে ঝোপের সামনে আমাদের জ্যাক-ও ল্যান্টার্নটা মিটমিট করে কিন্তু সদর্পে জ্বলছিল। দূর থেকে দ্রুতপায়ে দৌড়ানোর শব্দ, যে ছেলেরা শুধুই একটি করে রাবারের মুখোশ পরে বেরিয়েছিল, তাদের চিৎকার এবং ছোট ছোট বাচ্চাদের জামাকাপড়ের খসখসানি ভেসে এলো। কেউ কেউ এত ছোট ছিল যে, মা-বাবারা কোলে করে তাদের দরজায় দরজায় নিয়ে যাচ্ছিলেন।
“যে বাড়িটা চেনো না, সেখানে যেয়ো না যেন,” মা সাবধান করলেন।
মি. পিরজাদা ভুরু কোঁচকালেন। “কোনও বিপদের সম্ভাবনা আছে নাকি?”
“না না,” মা তাঁকে আশ্বস্ত করলেন। “সব ছেলেমেয়েই বেরোবে আজকে। এটা তো একটা ঐতিহ্য।’’
“আমার বোধ হয় ওদের সংগে যাওয়া উচিত?” মি. পিরজাদা প্রস্তাব দিলেন। মোজা পরা ছড়ানো পায়ে দাঁড়ানো দেখে হঠাৎ কেমন ক্লান্ত, ছোটখাটো মনে হল তাঁকে। তাঁর চোখে একটা আতঙ্কের ছাপ দেখলাম, যে আগে কখনও দেখিনি। যথেষ্ট ঠাণ্ডা সত্ত্বেও আমি আমার বালিশের ওয়াড়ের মধ্যে ঘামতে শুরু করলাম।
“না না মি. পিরজাদা,” মা বললেন। “লিলিয়া ওর বন্ধুর সঙ্গে একদম নিরাপদ থাকবে।”
“কিন্তু যদি বৃষ্টি পড়ে? যদি ওরা হারিয়ে যায়?”
“চিন্তা করবেন না,” আমি বললাম। সেই প্রথমবার আমি ওই কথাগুলো মি. পিরজাদাকে বললাম। খুব সামান্য কয়েকটি কথা, কিন্তু যেগুলো সপ্তাহের পর সপ্তাহ তাঁকে বলার চেষ্টা করেও পারিনি। শুধু আমার প্রার্থনাতেই বলতে পেরেছিলাম। এবার আমার লজ্জা লাগল ভেবে যে, আমি শুধু নিজের জন্যই কথাগুলো বললাম।
মি. পিরজাদা তাঁর একটা মোটাসোটা আঙুল আমার গালে রাখলেন। তারপর আঙুলটা নিজের হাতের পিছনে চেপে ধরলেন। একটা হালকা সবুজ ছাপ পড়ল। “যদি ‘লেডি’ তাই চান,” তিনি মেনে নিলেন। তারপর ছোট্ট করে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালেন।
আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের কালো ছুঁচোলো সস্তা জুতা পায়ে অল্প হোঁচট খেতে খেতে এগোলাম। ড্রাইভ-ওয়ের শেষে হাত নাড়ার জন্য ফিরে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম দরজার ফ্রেমের মধ্যে, আমার মা আর বাবার মাঝখানে বেঁটেখাটো মানুষটি দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন।
“ওই লোকটি আমাদের সঙ্গে আসতে চাইছিল কেন?” ডোরা জিজ্ঞেস করল।
“ওর মেয়েদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।” বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমার আফসোস হল। মনে হল যেন আমার বলার জন্য কথাটা সত্যি হয়ে গেল, যেন মি. পিরজাদার মেয়েদের সত্যিই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এবং তিনি আর কখনও তাদের দেখতে পাবেন না।
“মানে তাদের কি ছেলেধরায় নিয়ে গিয়েছে? ডোরা প্রশ্ন করল।
“পার্ক বা কোনও জায়গা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে।”
“ঠিক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তা নয়। আমি বলতে চাইছিলাম যে, মেয়েদের কথা ওঁর খুব মনে পড়ে। তারা একটা অন্য দেশে থাকে আর তিনি অনেকদিন তাদের দেখেননি তো, তাই।”
আমরা ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে কলিং বেল বাজালাম। কেউ কেউ ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করার জন্য সব আলো নিভিয়ে রেখেছিলেন। কেউ জানালায় রাবারের বাদুড় ঝুলিয়েছিলেন। ম্যাকেন্টয়ারদের দরজার সামনে একটা কফিন রাখা ছিল। মি. ম্যাকেন্টয়ার চকের গুঁড়ো মেখে নিঃশব্দে কফিন থেকে উঠে আমাদের বস্তার ভিতর মুঠোভরতি ক্যান্ডি কর্ন ঢেলে দিলেন। অনেকেই আমাকে বললেন যে, তাঁরা আগে কখনও ভারতীয় ডাইনি দেখেননি। অন্যরা কোনও মন্তব্য না করে যা দেওয়ার দিয়ে দিলেন। টর্চের সমান্তরাল আলোর রেখা ফেলে এগোতে এগোতে আমরা দেখলাম রাস্তার মাঝখানে ফাটা ডিম, শেভিং ক্রিম মাখানো দাড়ি, গাছের মরা ডালে মালার মতো করে ঝোলান টয়লেট পেপার। যতক্ষণে আমরা ডোরার বাড়ি পৌঁছলাম, ততক্ষণে ভারি বস্তাগুলো বয়ে আমাদের হাতে দাগ হয়ে গিয়েছে। পা ফুলে ব্যথা করছে। ডোরার মা আমাদের কালশিটের জন্য ব্যান্ডেজ দিলেন, উষ্ণ সিডার এবং ক্যারামেল্ পপকর্ন খেতে দিলেন। তিনি আমাকে মনে করালেন যে, মা-বাবাকে ফোন করে জানাতে যে আমি নিরাপদে পৌঁছে গিয়েছি। আমি যখন ফোন করলাম তখন পিছনে টিভির আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমার গলা শুনে মা যে খুব আশ্বস্ত হলেন তা মনে হল না। ফোনটা রাখার পর খেয়াল হল যে, ডোরার বাড়িতে টিভি চলছিল না। ডোরার বাবা সোফায় শুয়ে একটা পত্রিকা পড়ছিলেন। কফি-টেবিলের ওপর এক গেলাস ওয়াইন রাখা ছিল, স্টিরিয়োতে স্যাক্সোফোন সংগীত বাজছিল।
ডোরা আর আমি আমাদের লুট পরীক্ষা করলাম। গোনাগুনি, নমুনা চেখে দেখা, লেনদেন ইত্যাদি করার পর আমরা সন্তুষ্ট হলে ডোরার মা তাঁদের গাড়িতে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিলেন। আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে দরজা অবধি পৌঁছানো পর্যন্ত তিনি ড্রাইভওয়েতে অপেক্ষা করলেন। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখতে পেলাম যে, আমাদের কুমড়োটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। মোটা খোসাটা টুকরো টুকরো হয়ে ঘাসের ওপর ছড়িয়ে ছিল। আমার চোখ জ্বালা করে উঠল, গলার কাছে একটা ব্যথা অনুভব করলাম। যেন আমার অবসাদগ্রস্ত পায়ের তলায় প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে যে ছোট্ট ধারালো নুড়িপাথরগুলো আওয়াজ তুলছিল, সেগুলো কেউ আমার গলায় ঠেসে দিয়েছে। আমি দরজা খুললাম। ভেবেছিলাম যে ওঁরা তিনজন সামনের ঘরে দাঁড়িয়ে আমাকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষা করবেন। আমাদের নষ্ট হয়ে যাওয়া কুমড়োটার জন্য দুঃখ প্রকাশ করবেন। কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না। বসার ঘরে মি. পিরজাদা, বাবা এবং মা সোফার ওপর পাশাপাশি বসে ছিলেন। টিভিটা বন্ধ। মি. পিরজাদা মাথায় হাত দিয়ে বসে।
সেই সন্ধে এবং তার পরবর্তী অনেক সন্ধেবেলায় তাঁরা যা শুনেছিলেন, তা এই যে, ভারত এবং পাকিস্তান ক্রমশই যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে। দু’পক্ষের সৈন্যরাই সীমান্তে উপস্থিত। স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুতেই ঢাকা সন্তুষ্ট হতে চাইছিল না। শোনা গেল যে, যুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতেই হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানকে সমর্থন করছিল। ভারত এবং শীঘ্রই যা বাংলাদেশ বলে পরিচিত হবে, তাদের পক্ষে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষিত হল। বারো দিন পর তাদের রসদের থেকে ৩,০০০ মা ইল দূরে যুদ্ধ করতে করতে দুর্বল হয়ে পর পাকিস্তানি সৈন্য ঢাকায় আত্মসমর্পন করল। এসব কথা আমি এখন জানতে পেরেছি। কারণ, এখন যে-কোনও ইতিহাস, যে-কোনও গ্রন্থাগারে এসব তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সেই সময়, কয়েকটি এলোমেলো যোগসূত্র ছাড়া ব্যাপারটা বেশিরভাগই আমার কাছে এক রহস্য ছিল। সেই বারো দিনের যুদ্ধের যেটুকু স্মৃতি আমার আছে, তা হল, বাবা আমাকে আর তাঁদের সঙ্গে খবর শুনতে বলতেন না। মি. পিরজাদা আমার জন্য লজেঞ্জ আনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মা রাতের খাবারের জন্য ভাত আর সেদ্ধ ডিম ছাড়া কিছুই রাঁধতেন না। মনে আছে কোনও কোনও রাতে আমি মাকে সোফার ওপর চাদর-কম্বল পাততে সাহায্য করতাম যাতে মি. পিরজাদা সেখানে শুতে পারেন। মাঝরাতে যখন মা-বাবা কলকাতায় আমাদের আত্মীয়স্বজনদের ফোন করে পরিস্থিতির খুঁটিনাটি খবরাখবর জানতে চাইতেন, তখন আমি তাঁদের তীক্ষ্ণ কণ্ঠের উচ্চস্বরে কথোপকথন শুনতে পেতাম। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে, সেই সময় তিনজন যেন একজন মানুষের মতোই ব্যবহার করছিলেন যেন একটাই শরীর, একই খাবার, একই নৈঃশব্দ এবং ভয়।
জানুয়ারি মাসে মি. পিরজাদা ঢাকায় তাঁর তিনতলা বাড়িতে ফিরে গেলেন বাড়িটার কতটা অবশিষ্ট আছে দেখার জন্য। বছরের সেই সপ্তাহগুলোয় আমরা তাঁর বেশি দেখা পেতাম না। তিনি তাঁর লেখা শেষ করতে ব্যস্ত ছিলেন। আমরাও ফিলাডেলফিয়া গিয়েছিলাম মা-বাবার বন্ধুর সঙ্গে বড়দিনের ছুটি কাটাতে। ঠিক যেমন আমাদের বাড়িতে তাঁর প্রথমবার আসার কথা মনে নেই, তেমনই তাঁর শেষবার আসার কথাও মনে নেই। এক দুপুরে, আমি যখন স্কুলে ছিলাম, তখন বাবা মি. পিরজাদাকে গাড়ি করে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিলেন। তারপর অনেকদিন আমরা তাঁর কোনও খবর পাইনি। টিভিতে খবরের সামনে খাবার খেতে খেতে আমাদের সন্ধেগুলো আগের মতোই কাটতে লাগল। একমাত্র তফাত ছিল যে, মি. পিরজাদা এবং তাঁর বাড়তি ঘড়িটি আমাদের সঙ্গে আর থাকত না। খবর অনুযায়ী, ঢাকা একটি নতুন সংসদীয় সরকার গঠন করে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। নতুন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। যুদ্ধে যে দশ লক্ষেরও বেশি বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তার জায়গায় নতুন নির্মাণের জন্য তিনি অনেক দেশের কাছ থেকে নির্মাণ-সামগ্রী চাইলেন। ভারত থেকে অসংখ্য উদ্বাস্তু ফিরে আসল। আমরা জানলাম, বেকারত্ব এবং দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা তাদের স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে। মাঝে মাঝেই আমি বাবার ডেস্কের ওপর টাঙানোর মানচিত্রটা খুঁটিয়ে দেখতাম এবং সেই ছোট হলুদ অংশটায় গলদঘর্ম মি. পিরজাদাকে কল্পনা করার চেষ্টা করাতাম। কল্পনা করতাম যে, একটা স্যুট পরিহিত অবস্থায় তিনি তাঁর পরিবারকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ততদিনে অবশ্য সেই ম্যাপটা অকেজো হয়ে গিয়েছিল।
অবশেষে কয়েকমাস পর ইসলামী নববর্ষের স্মরণে মি. পিরজাদা আমাদের একটি কার্ড এবং একটি ছোট চিঠি পাঠালেন। তিনি লিখেছিলেন যে, তিনি তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানদের সঙ্গে পুনর্মিলিত হয়েছেন। সকলেই ভাল আছেন। আগের বছরের ঘটনাগুলোর সময় তাঁর স্ত্রী-কন্যারা শিলং-এর পাহাড়ে, তাঁর স্ত্রীর দাদু-দিদিমার এস্টেটে থেকে নিজেদের রক্ষা করেছেন। তাঁর সাত মেয়ে আগের চেয়ে বেশি লম্বা হওয়া ছাড়া একইরকম আছে। তিনি এখনও তাদের নাম মনে রাখতে পারেন না। চিঠির শেষে তিনি আমাদের আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে লিখলেন যে, যদিও তিনি এখন ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ কথাটির অর্থ জানেন, তবুও কথাগুলো তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট নয়। সুসংবাদ পাওয়ার খুশিতে মা সে রাতে ভাল ভাল রান্না করলেন। কফিটেবিলে খেতে বসে আমরা নিজেদের জলের গেলাস তুলে শুভকামনা করলাম। কিন্তু আমার শুভ সংবাদ পালন করতে ইচ্ছে করছিল না। যদিও আমি তাঁকে কয়েক মাস দেখিনি, মি. পিরজাদার অনুপস্থিতি আমি যেন তখনই উপলব্ধি করলাম। সেই মুহূর্তেই, তাঁর নামের র জলের গেলাসটা উঠিয়ে, আমি যেন বুঝতে পারলাম যে, বহু মেইল এবং অনেক সময়ের দূরত্বে থাকা কারও কথা মনে পড়লে কীরকম মনখারাপ লাগে। যেমন অতদিন ধরে মি. পিরজাদার তাঁর স্ত্রী-কন্যার কথা মনে পড়ত। তাঁর আমাদের কাছে ফিরে আসার কোনও কারণ ছিল না। বা-বাবাই ঠিক বলেছিলেন যে, তাঁর সঙ্গে আমাদের আর কখনও দেখা হবে না। জানুয়ারি মাস থেকে, মি. পিরজাদার পরিবারের কথা মনে করে প্রতি রাতে শুতে যাওয়ার আগে আমি হ্যালোউইন থেকে বাঁচিয়ে রাখা একটা করে লজেঞ্জ খেতাম। সে রাতে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত একদিন আমি পড়ে-থাকা উপহারগুলো ফেলে দিলাম।
সে বছর পাকিস্তান গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। সেই পূর্ব সীমান্ত যেখানে ঢাকা অবস্থিত, পশ্চিমের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করছিল। মার্চ মাসে পাকিস্তানি সেনা ঢাকায় হানা দিয়ে, আগুন লাগিয়ে, গুলিগোলা চালিয়েছিল। শিক্ষকদের রাস্তায় টেনে এনে গুলি করে মারা হয়েছিল। মেয়েদের ব্যারাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিল। শোনা যাচ্ছিল যে, গ্রীষ্মকালের মধ্যে ৩,০০,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল। ঢাকায় মি. পিরজাদার একটা তিনতলা বাড়ি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপনা ছিল, কুড়ি বছরের বিবাহিতা স্ত্রী ছিলেন এবং ছ’ থেকে ষোলোর সাতটি মেয়ে ছিল, যাদের সকলের নাম শুরু হয়েছিল ‘এ’ অক্ষর দিয়ে। ‘ওদের মায়ের ইচ্ছে,’ তিনি একদিন আমাদের, তাঁর মানি ব্যাগ থেকে একটা সাদা-কালো ছবি বের করে দেখিয়ে বুঝিয়েছিলেন। সাতটি মেয়ে একটি পিকনিকে সারি দিয়ে বাবু হয়ে বসে কলাপাতায় মুরগির মাংসের ঝোল খাচ্ছে। সকলের বিনুনি ফিতে দিয়ে বাঁধা। ‘কী করে চিনব আমি? আয়েষা, আমিরা, আমিনা, আজিজা, বুঝতে পারছ তো, কত কঠিন?
প্রতি সপ্তাহে মি. পিরজাদা স্ত্রীকে চিঠি লিখতেন এবং প্রত্যেকটি মেয়েকে কমিক্স বই পাঠাতেন। কিন্তু ঢাকায় আর সবকিছুর মতোই ডাকব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছিল। ছ’মাসের ওপর তিনি তাদের কোনও খবর পাননি। সেই সময় মি. পিরজাদা এক বছরের জন্য আমেরিকা এসেছিলেন। কারণ পাকিস্তানি সরকার তাঁকে নিউ ইংল্যান্ডের গাছের পত্রালি নিয়ে পড়াশুনা করার জন্য জলপানি দিয়েছিল। বসন্ত এবং গ্রীষ্মকালে তিনি ভার্মান্ট এবং দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। হেমন্তকালে তিনি বোস্টনের উত্তরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন তাঁর আবিষ্কার নিয়ে একটি ছোট বই লিখতে। আমরা সেখানেই থাকতাম। জলপানিটা খুবই সম্মানের ছিল, যদিও ডলারে তার মূল্য নির্ধারণ করতে গেলে সেটা পর্যাপ্ত মনে হত না। তাই মি. পিরজাদা একটি গ্রাজুয়েট ডর্মেটরিতে থাকতেন। তাঁর কোনও নিজস্ব টিভি বা স্টোভও ছিল না, সেজন্য তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন টিভিতে সন্ধেবেলার খবর দেখতে এবং রাতের খাবার খেতে।
প্রথমদিকে আমি তাঁর আসার কারণ কিছুই বুঝতাম না। আমার তখন মাত্র দশ বছর বয়স। আমার মা-বাবা ছিলেন ভারতীয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের সঙ্গে পরিচিত অনেক ভারতীয় ছিল। তাই মি. পিরজাদাকে তাঁরা আমাদের সঙ্গে খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানানোয় আমি অবাক হইনি। ছোট ক্যাম্পাসটায় ইটের সরু ফুটপাথ এবং সাদা রংওয়ালা বিল্ডিং ছিল। যে শহরের প্রান্তে ক্যাম্পাসটা অবস্থিত, সেটা যেন আরও ছোট। সুপারমার্কেটে সরষের তেল পাওয়া যেত না, ডাক্তাররা বাড়িতে রুগী দেখতে যেতেন না, বিনা নিমন্ত্রণে কেউ পড়শিদের বাড়ি যেত না, এইসব নিয়ে আমার মা-বাবা খুব অভিযোগ করতেন। স্বদেশবাসীর খোঁজে প্রতি সেমিস্টারের শুরুতে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেক্টরিতে আঙুল দিয়ে নাম খুঁজতেন। তাঁদের দেশের পরিচিত পদবির কোনও নাম পেলে সেটা গোল দাগ দিয়ে রাখতেন। এইভাবেই তাঁরা মিঃ পিরজাদাকে খুঁজে পেয়ে ফোন করেছিলেন এবং বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন।
তাঁর প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আসার কথাও আমার মনে নেই। কিন্তু সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আমি আমাদের বসার ঘরে মি. পিরজাদার উপস্থিতির সঙ্গে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে, একদিন জলের জগে বরফ ঢালার সময় আমি মাকে চতুর্থ গেলাসটা আমার নাগালের বাইরের একটা তাক থেকে পেড়ে দিতে বলেছিলাম। মা স্টোভের সামনে এক কড়াই ভরতি ভাজা পালং শাক মুলো নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। একজস্ট ফ্যান আর জোরে জোরে হাতা নাড়ানোর শব্দে আমার কথা শুনতে পাননি। বাবা ফ্রিজে হেলান দিয়ে মুঠো থেকে তুলে মশলা মাখানো কাজুবাদাম খাচ্ছিলেন। আমি তাঁর দিকে ফিরলাম।
‘’কী হয়েছে লিলিয়া?”
“ভারতীয় ভদ্রলোকটির জন্য একটা গেলাস চাই।”
“মি. পিরজাদা আজ আসবেন না। তার চেয়েও বড় কথা মি. পিরজাদাকে আর ভারতীয় মনে করা হয় না,” বাবা ঘোষণা করলেন। তাঁর পরিপাটি করে ছাঁটা কালো দাড়ি থেকে কাজুর নুন ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, “পার্টিশনের পর থেকে আর না। ১৯৪৭-এ আমাদের দেশ ভাগ হয়ে গিয়েছিল।”
আমি যখন বললাম যে, আমার ধারণা ছিল সেটা ব্রিটেনের শাসন থেকে ভারতের স্বাধীনতার তারিখ, তখন বাবা বললেন, “ সেটাও ঠিক। এক মুহূর্তে আমাদের ভাগ করে দেওয়া হল।” কাউন্টার-টপের ওপর আঙুল দিয়ে একটা ক্রস চিহ্ন এঁকে তিনি বোঝালেন, “ঠিক একটা পিঠের মতো ভাগ করা হল। হিন্দুরা এখানে, মুসলমানরা ওখানে। ঢাকা আর আমাদের নেই।” তিনি বললেন, পার্টিশনের সময় হিন্দু-মুসলমানরা পরস্পরের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। এখনও অনেকের কাছেই, অন্য ধর্মের কারও উপস্থিতিতে খাওয়া অভাবনীয়।
আমি এর কিছুই বুঝতে পারলাম না। মি. পিরজাদা এবং আমার মা-বাবা একই ভাষায় কথা বলতেন, একই কথায় হাসতেন, অনেকটা একইরকম দেখতেও ছিল ওঁদের। তাঁরা খাবারের সংগে আমের চাটনি খেতেন, প্রতি রাতে হাত দিয়ে ভাত খেতেন, হজমের জন্য মৌরি চিবোতেন, মদ খেতেন না, খাওয়ার পর মিষ্টির বদলে একের পর এক চায়ের কাপে কোনও সাধারণ বিস্কুট ডুবিয়ে খেতেন। এসব সত্ত্বেও, বাবা চাইছিলেন যেমন আমি তঁদের মধ্যে তফাতটা বুঝতে পারি। তিনি ডেস্কের ওপরের দেওয়ালে সাঁটা সারা পৃথিবীর একটা মানচিত্র দেখাতে নিয়ে গেলেন। মনে হল, বাবা যেন এই ভেবে চিন্তিত যে, ভুল করে মি. পিরজাদাকে ভারতীয় বলে ফেললে তিনি অপমানিত বোধ করতে পারেন। আমি অবশ্য কল্পনাই করতে পারছিলাম না, মি. পিরজাদা কোনও কথাতেই অপমানিত বোধ করবেন। ‘মি. পিরজাদা বাঙালি, কিন্তু তিনি মুসলমান,” বাবা আমাকে বোঝালেন। “তাই তিনি পূর্ব পাকিস্তানে থাকেন, ভারতে নয়।” তাঁর আঙুল অতলান্তিকের ওপর দিয়ে এগিয়ে গেল। ইউরোপ , মেডিটেরিয়ান, মিডল ইস্ট এবং অবশেষে সেই ছড়িয়ে থাকা কমলা রঙের হিরেটা। মা বলেছিলেন সেটা দেখে যেন মনে হয় যেন কোনও শাড়ি পরা মহিলা বাঁ হাতটা বাড়িয়ে আছে। আমার মা বাবার সফর বোঝানোর জন্য অনেকগুলো শহরের চারপাশে গোল করে দাগ দেওয়া ছিল। সেই শহরগুলো একটা লাইন দিয়ে জোড়া। এবং তাঁদের জন্মস্থান কলকাতা একটা ছোট তারা দিয়ে চিহ্নিত ছিল। আমি সেখানে শুধু একবারই গিয়েছিলাম। সেই যাত্রার কোনও স্মৃতি ছিল না আমার। “দেখেছিস লিলিয়া, ওটা একটা আলাদা দেশ, আলাদা রঙ,” বাবা বললেন। পাকিস্তানের রঙ কমলা নয়--হলুদ। আমি লক্ষ করলাম যে, দেশটার দুটো আলাদা অংশ আছে। একটা অন্যটার চেয়ে অনেক বড়। ভারতের এক বিস্তৃত অংশ দিয়ে দুটো ভাগ করা। আমেরিকা থেকে আলাদা হয়ে, ক্যালিফোর্নিয়া আর কানেকটিকাট দিয়ে একটা দেশ তৈরি হলে যেমন হয়, তেমন।
বাবা তাঁর আঙুলের ডগা দিয়ে আমার মাথায় টোকা মারলেন। “তুই নিশ্চয়ই বর্তমান পরিস্থিতি জানিস। জানিস তো যে পূর্ব পাকিস্তান সার্বভৌম ক্ষমতার জন্য লড়াই করছে?”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম যদিও আমি কিছুই জানতাম না।
আমরা রান্নাঘরে ফিরে এলাম। মা একটা ঝাঁঝরি দিয়ে এক হাঁড়ি সেদ্ধ ভাত থেকে জল ঝরাচ্ছিলেন। বাবা কাউন্টারের ওপরের ক্যানটা খুলে আরও কাজু বাদাম খেতে খেতে চশমার ফ্রেমের ওপর দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। “তোকে স্কুলে ঠিক কী পড়ায় বল তো। ইতিহাস পড়িস? ভূগোল?”
“লিলিয়ার স্কুলে অনেক কিছুই পড়ায়,” মা বললেন। “আমরা এখন এখানেই থাকি। ও তো এখানেই জন্মেছে।” মা’র কথা শুনে মনে হল তিনি এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব গর্বিত, যেন সেটা আমার কোনও ব্যক্তিগত গুণ। আমি জানতাম যে, তাঁর ধারণা অনুযায়ী, মার জন্য এক নিরাপদ সহজ জীবন, ভাল শিক্ষাদীক্ষা এবং সব রকমের সুযোগ নিশ্চিত ছিল। আমাকে কখনও রেশনের খাবার খেতে হবে না, কারফিউ মানতে হবে না, ছাদে দাঁড়িয়ে কোনও দাঙ্গার সাক্ষী হতে হবে না বা কোনও পড়শিকে গুলি খেয়ে মরা থেকে বাঁচানোর জন্য জলের ট্যাঙ্কে লুকিয়ে রাখতে হবে না, যেমন তাঁদের করতে হয়েছিল। “ একবার ভাবো, ওদের একটা ভদ্রসভ্য স্কুলে ভরতি করা, লোডশেডিং হলে কেরোসিনের লণ্ঠনের আলোয় পড়তে বসানো। পড়ার চাপ, টিউটর, একের পর এক পরীক্ষা,” মা তাঁর ব্যাঙ্ক টেলারের কাজের উপযোগী ছাঁটা চুলের মধ্যে দিয়ে হাত চালালেন। “তুমি কী করে আশা করো যে ও পার্টিশন সম্পর্কে জানবে। বাদামগুলো রাখো এবার।”
“কিন্তু ও পৃথিবীর সম্পর্কে কী শিখছে?” বাবা কাজুর কৌটাটা হাতে ঝাঁকিয়ে বললেন। “কী শিখছে ও?”
বলাবাহুল্য, আমরা আমেরিকার ইতিহাস শিখতাম এবং আমেরিকার ভূগোল। সে বছর এবং মনে হত যেন প্রতি বছরই, আমরা রেভলিউশনারি ওয়ার দিয়ে পড়াশোনা করতাম। স্কুলবাসে চেপে আমাদের প্লাইউমাউথ রক দেখতে, ফ্রিডম ট্রেল-এর ওপর হাঁটতে এবং বাঙ্কার হিল মনুমেন্ট-এর ওপর চড়তে নিয়ে যাওয়া হত। রঙিন কাগজ দিয়ে মডেল তৈরি করতাম, জর্জ ওয়াশিংটন ডেলাওয়্যার নদীর উত্তাল জল পার হচ্ছেন। সাদা রঙের টাইট্স এবং কালো রঙের বো পরা কিং জর্জের পুতুল তৈরি করতাম। পরীক্ষার সময় আমাদের তেরোটি কলোনির ফাঁকা ম্যাপ দিয়ে নাম, তারিখ এবং রাজধানী লিখতে বলা হত। আমি চোখ বুজে ওই কাজগুলো করতে পারতাম।
পরের দিন সন্ধেবেলা, মি. পিরজাদা নিয়মমতো ছ’টার সময় আমাদের বাড়ি এলেন। অনেকদিনের পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি এবং আমার বাবা দেখা হওয়ার সময় হাত মেলানোর অভ্যাসটা ছাড়তে পারেননি।
“আসুন, লিলিয়া, মি. পিরজাদার কোটটা নাও।”
নিখুঁত স্যুট, স্কার্ফ এবং কলারে সিল্কের টাই পরিহিত মি. পিরজাদা সামনের ঘরে এসে দাঁড়ালেন। প্রতিদিন তিনি প্লাম, অলিভ এবং চকোলেট ব্রাউন রঙের সাজে উপস্থিত হতেন। পিরজাদা ছিলেন একজন পরিপাটি মানুষ। যদিও তার পা দুটো বাইরের দিকে ছড়িয়ে থাকত এবং একটু ভুঁড়ি ছিল, তাও তিনি বেশ একটা কর্মদক্ষ ভঙ্গি বজায় রাখতেন, যেন দু’হাতে দুটো সমান ওজনের সুটকেস ধরে আছেন। তাঁর কানে কয়েকটি চুলের গোছা পেকে গিয়েছিল। দেখে মনে হত, সেগুলো জীবনের অপ্রীতিকর শব্দ থেকে তাঁর কান ঢেকে রেখেছে। তাঁর ঘন পলকওয়ালা চোখে ছিল ধূসরের ছোঁয়া। হৃষ্টপুষ্ট গোঁফটি যেন মজা করে দু’পাশে উঠে আছে আর, বাঁ গালের ঠিক মধ্যিখানে একটা চ্যাপটা কিশমিশের মতো জড়ুল। মাথায় পারসি ভেড়াদের লোম থেকে বানানো একটি কালো রঙের ফেজটুপি পরতেন। ববি পিন দিয়ে আটকানো এই টুপিটি ছাড়া আমি তাঁকে কখনো দেখিনি। আমার বাবা সসময়ই তাঁকে আমাদের গাড়ি করে নিয়ে আসার প্রস্তাব দিতেন, কিন্তু তিনি ডরমিটরি থেকে আমাদের পাড়ার গাছপালা, ঝোপঝাড় দেখতে দেখতে হেঁটে যখন এসে পৌঁছতেন, তখন হেমন্তের তাজা হাওয়ায় তাঁর আঙুলের গাঁটগুলো গোলাপি হয়ে যেত।
“ভারতে আরও এক উদ্বাস্তু।”
“শেষ যা গোনা হয়েছে, তাতে আন্দাজ ন’মিলিয়ন দাঁড়িয়েছে,” আমার বাবা বললেন।
মি. পিরজাদা আমার তাঁর কোটটা দিলেন । আমার কাজ ছিল সিঁড়ির নীচের র্যাকে সেটা ঝুলিয়ে রাখা। ধূসর আর নীল রঙের উল দিয়ে ছোট ছোট চেক কাটা, কোটটায় ডোরাকাটা লাইনিং এবং শিং-এর বোতাম লাগানো। বুনটের মধ্যে লেবুর হালকা গন্ধ থাকত। ভিতরে চেনার মতো কোনও লেবেল লাগানো ছিল না। শুধু হাতে সেলাই করা একটা লেবেলে টানা টানা হাতের লেখায় চকচকে কালো সুতো দিয়ে এমব্রয়ডারি করা ছিল ‘জেড সৈয়দ, সুটর্স’। কোনও কোনও দিন বার্চ বা মেপল গাছের একটা পাতা পকেটে ঢোকানো থাকত। তিনি জুতোর ফিতে খুলে জুতোজোড়া বেসবোর্ডের গায়ে হেলান দিয়ে রাখলেন। আমাদের ভিজে, পাতাঝরা লনের ওপর দিয়ে হাঁটায় তাঁর জুতোর ডগায় এবং গোঁড়ায় এক ধরনের সোনালি কাদাটে মিশ্রণ লেগে ছিল। এইসব পোশাকআশাক থেকে মুক্ত হওয়ার পর তিনি তাঁর বেটে, অস্থির আঙ্গুলগুলো আমার গলায় চাপড় দিলেন, ঠিক যেমনভাবে কেউ দেওয়ালে পেরেক গাঁথার আগে সেই জায়গাটা চাপড়ে দেখে নেয় সেটা নিরেট কি না। তারপর তিনি বাবার পিছন পিছন বসবার ঘরে ঢুকলেন। সেখানে টিভিতে স্থানীয় খবর চালানো ছিল। তাঁরা বসবার সঙ্গে সঙ্গে মা রান্নাঘর থেকে এক প্লেট কাবাব আর ধনেপাতার চাটনি নিয়ে আসলেন। মি. পিরজাদা একটা নিয়ে মুখে পুরলেন।
“আমরা শুধুমাত্র আশা করতে পারি যে,” আর-একটা কাবাবের দিকে হাত বাড়িয়ে তিনি বললেন, “ঢাকার রিফিউজিরাও এত ভাল খেতে পায়। এই কথা থেকে মনে পড়ে গেল।” তিনি সুটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দারচিনির হার্ট ভরতি একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের ডিম বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, “ বাড়ির ‘লেডি’র জন্য।” তার সঙ্গে ওই ছড়ানো পায়ে প্রায় বোঝাই যায় না এমনভাবে সামান্য ঝুঁকে আমাকে ‘বাও’ করলেন।
“সত্যি মি. পিরজাদা,” মা আপত্তি জানালেন। “রাতের পর রাত। আপনি ওকে বিগড়ে দিচ্ছেন একেবারে।”
“আমি শুধু সেই বাচ্চাদেরই বিগড়ে দেই, যারা বিগড়ে যেতে পারে না।”
আমার কাছে সেটা ছিল একটা অস্বস্তিকর মুহূর্ত। কিছুটা ভয়ে, কিছুটা উৎফুল্ল হয়ে আমি এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতাম। মি. পিরজাদার হৃষ্টপুষ্ট, দরাজ আভিজাত্য আমাকে মুগ্ধ করত, আমার প্রতি তাঁর মনোযোগে যে আধো-নাটকীয়তা ছিল, তাতে আমি তৃপ্ত বোধ করতাম, কিন্তু তাঁর ভাবভঙ্গিতে যে চূড়ান্ত স্বাচ্ছন্দ্য ছিল, তা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলত। মুহূর্তের জন্য মনে হত যেন, আমি নিজের বাড়িতেই আগন্তুক। আমাকে কিছু দেওয়াটা তাঁর একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেক সপ্তাহ ধরে, পরস্পরের সঙ্গে আরও সহজ হওয়ার আগে ওটাই একমাত্র উপলক্ষ ছিল, যখন তিনি আমার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন। আমার কোনও উত্তর ছিল না, যখন তিনি আমার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন। কোনও মন্তব্য করতাম না আমি ভাবলেশহীন মুখে আমি তাঁর কাছ থেকে মধুভরা লজেঞ্জ, র্যাস্পবেরি ট্রাফল, টক প্যাস্টিলের সরু সরু রোল গ্রহণ করে যেতাম। আমি তাঁকে ধন্যবাদও জানাতে পারতাম না। কারণ, একবার বেগুনি সেলোফেনে মোড়া বিশেষভাবে লোভনীয় পিপারমেন্ট ললিপপ পাওয়ার জন্য আমি যখন তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম, তখন তিনি বলেছিলেন, “ধন্যবাদ আবার কীসের? ব্যাঙ্কের ভদ্রমহিলা আমাকে ধন্যবাদ জানান, দোকানের ক্যাশিয়ার আমাকে ধন্যবাদ জানান, নির্ধারিত তারিখের পর বই ফেরত দিলে লাইব্রেরিয়ান আমাকে ধন্যবাদ জানান, ঢাকায় আমার ফোনটা লাগানোর চেষ্টা করা হলে ওভারসিস অপারেটর আমাকে ধন্যবাদ জানান। আমাকে যদি এইদেশে সমাধিস্থ করা হয়, তা হলে নিঃসন্দেহে আমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময়ও আমাকে ধন্যবাদ জানানো হবে।”
মি. পিরজাদার দেওয়া মিষ্টিটা যেমন তেমন ভাবে খাওয়া আমার অশোভন মনে হত। প্রতিটি সন্ধের উপহারের মূল্য আমার কাছে ধনরত্ন বা গুপ্তধনের একটি রত্ন বা মুদ্রার মতোই ছিল। আমি সেটি আমার খাটের পাশে একটি কারুকার্য করা ছোট চন্দনকাঠের বাক্সে রাখতাম। বহু বছর আগে আমার ঠাকুরমা ওই বাক্সে চানের পর খাওয়ার জন্য সুপারি রাখতেন। যে ঠাকুরমাকে আমি কোনোদিন দেখিনি, আমার কাছে সেই ঠাকুরমার একমাত্র চিহ্ন ছিল সেই বাক্সটি। মি. পিরজাদা আমাদের জীবনে আসার আগে পর্যন্ত আমি ওই বাক্সে রাখার মতো কিছুই খুঁজে পেতাম না। মাঝে মাঝেই দাঁত মাজার এবং পরের দিনের জন্য স্কুলের জামাকাপড় বের করে রাখার আগে আমি বাক্সের ঢাকনা খুলে তাঁর দেওয়া মিষ্টিগুলোর মধ্যে খেতাম।
রোজ রাতের মতো সেই রাতেও আমরা ডাইনিং টেবিলে বসে খেলাম না। কারণ টেবিলে বসে ভাল করে টিভি দেখা যেত না। তাই আমরা বাক্যালাপ ছাড়াই, কফি টেবিলের চারপাশে, হাঁটুর ওপর খাবার প্লেট রেখে জড়ো হয়ে বসলাম। মা রান্নাঘর থেকে একের পর এক খাবার আনলেন। ভাঁজা পেয়াজ দেওয়া মুসুরডাল, নারকেল দেওয়া সবুজ বিন, দই-কিশমিশ দেওয়া মাছ। জলের গেলাস, প্লেটভরতি লেবুর টুকরো এবং লঙ্কা নিয়ে আমি তাঁর পিছন পিছন এলাম। শেষের বস্তুটি প্রতি মাসে চায়নাটাউনে গিয়ে পাউন্ডদরে কেনা হত এবং ফ্রিজে জমিয়ে রাখা হত। বড়রা সেগুলো ছিঁড়ে, খাবারে ঘষে খেতে ভালবাসতেন।
খাওয়ার আগে মি. পিরজাদা সবসময় এক অদ্ভুত কাজ করতেন। বুকপকেট থেকে একটা ব্যান্ডহীন, সাদাসিধে রুপোর ঘড়ি বের করতেন, কয়েক মুহূর্তের জন্য সেটি কানের কাছে ধরতেন এবং তর্জনী এবং বুড়ো আঙুলের তিনটে দ্রুত টোকায় ঘড়িটায় দম দিতেন। তিনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন যে, তাঁর পকেট ঘড়িটা তাঁর রিস্টওয়াচের মতো নয়। সেটা ঢাকার স্থানীয় সময় অনুযায়ী ঠিক করা আছে। আমাদের সময়ের চেয়ে ১১ ঘণ্টা এগিয়ে। খাওয়ার সময় ঘড়িটা কফি টেবিলে, তাঁর মুড়ে রাখা কাগজের ন্যাপকিনের ওপর রাখা থাকত। তিনি কখনও ঘড়িটা দেখতেন বলে মনে হয় না।
মি. পিরজাদা ভারতীয় নন, এটা জানতে পারার পর আমি তাঁকে ভালভাবে লক্ষ করতাম। কোন দিক দিয়ে তিনি আমাদের চেয়ে আলাদা, তা বোঝবার চেষ্টা করতাম। মনে হল যে, পকেটঘড়িটা তেমনই একটা জিনিস। সে রাতে, তাঁকে সেটি দম দিয়ে কফিটেবিলের ওপর রাখতে দেখে আমার কেমন অস্বস্তি হল। উপলব্ধি করলাম যে, জীবনটা আগে ঢাকায় প্রবাহিত হচ্ছে। কল্পনা করলাম, মি. পিরজাদার মেয়েরা ঘুম থেকে উঠেছে, চুলের ফিতে বাঁধছে, প্রাতরাশের তোড়জোড় করছে, স্কুলের জন্য তৈরি হচ্ছে। আমাদের খাওয়া-দাওয়া, আমাদের কাজকর্ম সবই সেখানে আগেই যাওয়া কাজকর্মের ছায়ামাত্র। মি. পিরজাদা আদতে যেখানকার মানুষ, সেই জায়গাটির এক পিছিয়ে পড়া ছায়া।
সাড়ে ছ’টা জাতীয় খবরের সময়। বাবা ভলিউম বাড়িয়ে এন্টেনাগুলো ঠিক করে দিতেন। আমি সাধারণত কোনও বই নিয়ে বসতাম, কিন্তু সে রাতে বাবা বললেন আমার মন দিয়ে শোনা উচিত। দেখলাম ধুলোয় ঢাকা রাস্তার ওপরে ট্যাঙ্ক গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে, কত বিল্ডিং ধসে পরেছে, অচেনা গাছের জঙ্গলে পূর্ব পাকিস্তানের রিফিউজিরা পালিয়ে ভারতের সীমান্তে আশ্রয় খুঁজছে। পাখার মতো পালতোলা নৌকা প্রশস্ত কফি রঙের নদীতে ভেসে যাচ্ছে, কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা পড়েছে ব্যারিকেডের পিছনে, খবরের কাগজের অফিস পুড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি মি. পিরজাদার দিকে তাকালাম। ছবিগুলো ছোট্ট হয়ে একের পর এক তাঁর চোখের ওপরেও ভেসে উঠছিল। দেখার সময় তাঁর মুখে এক অচঞ্চল ভাব ছিল। অবিচলিত, কিন্তু সজাগ। যেন কেউ তাঁকে অচেনা কোনও জায়গায় পৌঁছানোর নির্দেশ দিচ্ছে।
বিজ্ঞাপনের বিরতির সময় আমারও ভাত আনতে রান্নাঘরে গেলেন মা। বাবা এবং মি. পিরজাদা ইয়াহিয়া খান নামে কোনও জেনারেলের নীতির নিন্দে শুরু করলেন। তাঁরা যেসব চক্রান্তের আলোচনা করছিলেন, আমি সে-সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না। আমি সেই বিপর্যয়ের কিছুই বুঝছিলাম না। আমাকে আর-এক টুকরো মাছ দিতে দিতে বাবা বললেন, “ দেখ, তোর বয়সী সব ছেলেমেয়ে, বেঁচে থাকার জন্য কী করতে হচ্ছে তাদের।” কিন্তু আমি আর খেতে পারছিলাম না। আমি শুধু আড়চোখে মি. পিরজাদার দিকে তাকাচ্ছিলাম। তিনি জলপাই-সবুজ জ্যাকেট গায়ে আমার পাশে বসে শান্তভাবে তাঁর ভাতের স্তূপে দ্বিতীয় হাতা ডালের জন্য কুয়ো তৈরি করছিলেন। ওই ধরনের গুরুগম্ভীর ব্যাপারে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষকে যেমন লাগে বলে আমার ধারণা ছিল, তার সঙ্গে মি. পিরজাদার মিল ছিল না। আমি ভাবতাম, উনি কি সবসময় অত পরিপাটিভাবে জামাকাপড় পরে থাকেন যাতে আকস্মিক কোনও দুঃসংবাদ পেলে যথোচিত গাম্ভীর্য এবং সম্মানের সঙ্গে তা সহ্য করতে পারবেন? এমন-কী দরকার পড়লে মুহূর্তের মধ্যে কারও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত হতে পারবেন? আরও ভাবতাম, কেমন হবে, যদি হঠাৎ তাঁর সাত মেয়েকে টিভিতে দেখা যায়? যদি তারা কোনও বারান্দা থেকে মি. পিরজাদার দিকে হেসে, হাত নাড়িয়ে চুমু ছুড়ে দেয়? কল্পনা করতাম, তা হলে তিনি কত আশ্বস্ত হবেন। কিন্তু সেরকম কখনও হত না।
সে রাতে যখন আমি দারচিনির হার্টওয়ালা প্লাস্টিকের ডিমটা আমার খাটের পাশে বাক্সে রাখলাম, তখন অন্য দিনের মতো প্রাপ্তির আনন্দ হল না। আমি লেবুর গন্ধওলা ওভারকোট পরা মি. পিরজাদার কথা মনে না করার চেষ্টা করছিলাম। কয়েক ঘণ্টা আগে, আমাদের উজ্জ্বল, কার্পেট-বিছানো বসবার ঘরে যে বিশৃঙ্খল, গরমে ঝলসানো জগতের ছবি দেখছিলাম, তার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আছে। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে আমি ওই কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারলাম না। টিভির পরদায় মাঝে মাঝেই যে তাড়িত, অশান্ত মানুষের দল দেখা যাচ্ছিল, মি. পিরজাদার স্ত্রী এবং সাত মেয়ে তেমন কোনও দলের সদস্য, এই দুর্ভাবনায় আমার পেটের ভিতর কীরকম করছিল। ছবিটা মন থেকে তাড়ানোর জন্য আমি ঘরের চারপাশে তাকালাম, হলুদ চাদর দেওয়া আমার বিছানা, তার সঙ্গে রঙ মিলিয়ে জালি দেওয়া পরদা, সাদা-বেগুনি কাগজ লাগানো দেওয়ালে টাঙানো ফ্রেমে সাঁটা ক্লাসের ছবি, দেওয়াল-আলমারির দরজার ওপর পেনসিলের লেখা, সেখানে বাবা প্রতি জন্মদিনে আমার উচ্চতা মাপেন। কিন্তু যতই আমি নিজের মনটাকে অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করলাম, ততই আমি নিজেকে বোঝাতে থাকলাম যে, মি. পিরজাদার স্ত্রী-কন্যারা হয়তো মারাই গিয়েছেন। শেষে আমি বাক্স থেকে এক টুকরো চৌকো সাদা চকোলেট বের করে, মোড়ক খুললাম। তারপর আমি এমন একটা কাজ করলাম, যা আগে কখনও করিনি। চকোলেটটা মুখে পুরে, সেটা মুখে রেখে যথাসম্ভব গলে যেতে দিলাম। তারপর আস্তে আস্তে সেটা চিবানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থনা করলাম যে, মি. পিরজাদার পরিবার যেন নিরাপদে সুস্থ থাকে। আমি এর আগে কখনও কিছুর জন্য প্রার্থনা করিনি। আমাকে কখনো প্রার্থনা করতে বলা বা শেখানোও হয়নি। কিন্তু আমি ঠিক করলাম যে, সেই পরিস্থিতিতে আমার প্রার্থনা করা উচিত। কারণ, আমার ভয় হচ্ছিল, সত্যি সত্যি দাঁত মাজে হয়ত তার সঙ্গে প্রার্থনাও ধুয়ে যাবে। আমি ব্রাশটা ভিজিয়ে, টুথপেস্টের টিউবটা একটু সরিয়ে রাখলাম যাতে আমার মা বাবা কোনও প্রশ্ন না করেন। তারপর জিভে চিনি লেগে থাকা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পরলাম।
যে যুদ্ধের বৃত্তান্ত আমাদের বসবার ঘরে এত বিশ্বস্তভাবে শোনা হত, সেই যুদ্ধ নিয়ে আমাদের স্কুলে কোনও হত হত না। আমরা আমেরিকার বিদ্রোহ নিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে গেলাম। প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কর মকুব করা কত অন্যায় তা শিখলাম এবং ডিক্লারেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স-এর কয়েকটি অংশ মুখস্থ করলাম। টিফিন টাইমে ছেলেরা দু’দলে ভাগ হয়ে দোলনা, ঢেঁকির চারদিকে পরস্পরকে তাড়া করে বেড়াত। একপক্ষে লালকোট, বিপক্ষে কলোনি। ক্লাসরুমে আমাদের শিক্ষিকা মিসেস কেনিয়ন মাঝে মাঝে ই আমাদের একটা ম্যাপ দেখাতেন । সিনেমার পরদার মতো মানচিত্রটা চকবোর্ডের ওপর থেকে বেরিয়ে আসত, মিসেস কেনিয়ন আমাদের ‘মে-ফ্লাওয়ারের’র যাত্রাপথ বা লিবার্টি বেল কোথায় অবস্থিত দেখাতেন। প্রতি সপ্তাহে ক্লাসের দু’জন সদস্য রেভলিউশন-এর কোনও একটি বিশেষত্বের ওপর রিপোর্ট পেশ করত। তাই একদিন, ইয়র্কটাউনে আত্মসমর্পণের অধ্যায় সম্পর্কে শেখার জন্য আমার বন্ধু ডোরার সঙ্গে স্কুলের লাইব্রেরিতে পাঠানো হল। মিসেস কেনিয়ন আমাদের একটা কাগজে তিনটে বইয়ের নাম লিখে দিলেন যেগুলো কার্ড ক্যাটালগে খুঁজে বের করতে হবে। আমরা বইগুলো একবারেই খুঁজে পেলাম; পড়ে নোটস নেওয়ার জন্য একটা নিচু গোল টেবিলে বসলাম। কিন্তু আমি পড়ায় মন দিতে পারছিলাম না। ব্লন্ডুডের তাকগুলোর যে অংশে আমি ‘এশিয়া’ লেখা লেবেল দেখেছিলাম সেখানে ফিরে গেলাম। চিন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া সম্পর্কে বই রয়েছে সেখানে। শেষ ‘পাকিস্তান : আ ল্যান্ড অ্যান্ড ইটস পিপল’ নামে একটা বই দেখে একটা টুলে বসে বইটা খুললাম। বইয়ের মলাটটা আমার আঙুলের ভিতর খসখস করে উঠল। নদী, ধানক্ষেত, সৈন্যের পোশাক-পরা লোকদের ছবিওয়ালা পাতাগুলো ওলটাতে শুরু করলাম। একটা অধ্যায় ঢাকা নিয়ে লেখা। আমি ঢাকার বৃষ্টিপাত আর চটের উৎপাদন সম্পর্কে পরতে শুরু করলাম। জনসংখ্যার ওপর একটা চার্ট পড়ছিলাম, এমন সময় ডোরা এসে দাঁড়াল।
“এখানে কী করছিস? মিসেস কেনিয়ন লাইব্রেরিতে এসেছেন। আমরা ঠিক করে পরছি কি না দেখতে এসেছেন।”
আমি চটাস করে বইটা বন্ধ করলাম। শব্দটা একটু বেশি জিরেই হয়ে গেল। মিসেস কেনিয়ন এলেন। তাকের মাঝখানের সরু চলাচল-পথটার পুট (স্পাইন) ধরে এমনভাবে তুললেন যেন আমার সোয়েটারে লেগে থাকা কোনও চুল তুলছেন। মলাটটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তারপর আমার দিকে তাকালেন।
“এই বইটা কি তোমার রিপোর্টে কাজে লাগবে, লিলিয়া?”
‘না, মিসেস কেনিয়ান।”
“তা হলে বইটা পরার কোনও কারণ দেখছি না,” তিনি বইটা তাকের সরু ফাঁকে রেখে দিয়ে বললেন। “তুমি কি দেখছ?”
যত সপ্তাহ যেতে লাগল, খবরে ঢাকার কোনও ছবি দেখতে পাওয়া কঠিন হয়ে পরল। প্রথম বা কখনও দ্বিতীয় বিরতির পর রিপোর্ট পাওয়া যেত। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করে, সাংবাদিকদের সরিয়ে, আটকে, অন্য পথে চালিত করা হচ্ছিল। কোনও কোনও দিন, প্রায়দিনই, শুধু মৃতের সংখ্যা জানানো হত। আর তার আগের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি। আরও কয়েকজন কবিকে মেরে ফেলা হয়েছিল, আরও কয়েকটি গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এতসব হওয়া সত্ত্বেও, মা বাবা এবং মি. পিরজাদা রাতের পর রাত সময় নিয়ে, ধীরে সুস্থে রাতের খাবার খেতেন। টিভি বন্ধ করার পর, থালাবাসন ধুয়ে শোকানো হয়ে গেলে, তাঁরা মজা করতেন, গল্প করতেন এবং চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খেতেন। রাজনীতি নিয়ে আলোচনা একঘেয়ে হয়ে গেলে আলোচনার বিষয় ছিল, নিউ ইংল্যান্ডের পত্রমোচী বৃক্ষ সম্পর্কে মি। পিরজাদার বই কদ্দুর এগোল, আমার বাবার কার্যকালের মেয়াদের মনোনয়ন বা মায়ের ব্যাংকের আমেরিকান সহকর্মীদের খাওয়া-সংক্রান্ত অদ্ভুত অভ্যেস ইত্যাদি। কিছুক্ষণ পর আমাকে হোমওয়ার্ক করার জন্য ওপরে পাঠিয়ে দেওয়া হত, কিন্তু কার্পেটের মধ্যে দিয়ে আমি শুনতে পেতাম যে, তারা আরও চা খাচ্ছেন, ক্যাসেটে কিশোরকুমারের গান শুনছেন, কফি টেবিলের ওপর স্ক্র্যাবল খেলছেন, গভীর রাত পর্যন্ত ইংরেজি বানা নিয়ে তর্কাতর্কি, হাসাহাসি করছেন। আমি ওদের সঙ্গে যোগ দিতে চাইতাম। সবচেয়ে বেশি ইচ্ছে করত মি. পিরজাদাকে সান্ত্বনা জানাতে। কিন্তু তাঁর পরিবারের কথা ভেবে এক টুকরো চকোলেট খাওয়া এবং নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। তাঁরা এগারোটার খবর শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত স্ক্র্যাবল খেলতেন। তারপর মাঝরাত নাগাদ মি. পিরজাদা হেঁটে তাঁর ডর্মিটরিতে ফিরে যেতেন। সেইজন্য আমি কখনও তাঁকে চলে যেতে দেখিনি, কিন্তু রোজ রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমি তিনজনের কথাবার্তা শুনতে পেতাম। পৃথিবীর অপর প্রান্তে এক নতুন দেশের জন্মের সম্ভাবনার কথা।
অক্টোবর মাসে একদিন মি. পিরজাদা এসে জিজ্ঞেস করলেন, “ সব বাড়ির দরজায় ওই বড় বড় কমলা রঙের সবজিগুলো কী? কোনও ধরনের লাউ নাকি?”
“ওটা কুমড়ো,” মা বললেন। “লিলিয়া, মনে করিয়ে দিস তো সুপারমার্কেট থেকে একটা কিনতে হবে।”
“ওটা দিয়ে কী করে? এটা কীসের চিহ্ন?”
“এটা দিয়ে জ্যাক-ও-ল্যান্টার্ন বানায়,” আমি জানালাম। বোঝানোর জন্য দাঁত খিঁচিয়ে একটা হিংস্র হাসি হাসলাম। “এভাবে ভয় পাওয়ানোর জন্য।”
“বুঝলাম,” মি. পিরজাদা প্রত্যুত্তরে হাসলেন। “খুবই উপকারী মনে হচ্ছে।”
পরের দিন মা একটা দশ পাউন্ডের মোটাসোটা, গোলগাল কুমড়ো কিনলেন। সেটা ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা হল। খাওয়ার আগে, যখন বাবা এবং মি. পিরজাদা স্থানীয় খবর দেখছিলেন, তখন মা আমাকে বললেন পেন দিয়ে ফলটা সাজাতে। কিন্তু আমি পাড়ায় যেমন দেখেছিলাম, সেভাবে ওটাকে কেটে সাজাতে চাইছিলাম।
“হ্যাঁ, চলো, ওটাকে কেটে সাজানো যাক,” মি. পিরজাদা সোফা থেকে উঠলেন। “আজ খবর চুলোয় যাক।” কিছু জিজ্ঞেস না করে রান্নাঘরে গেলেন।, একটা ড্রয়ার খুললেন, তারপর একটা লম্বা খাঁজকাটা ছুরি নিয়ে ফিরে এলেন। সম্মতির জন্য তিনি আমার দিকে তাকালেন। “আমি করি?”
আমি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাম। সেই প্রথমবার আমরা সকলে ডাইনিং টেবিলের চারপাশে জড়ো হলাম। মা, বাবা, মি. পিরজাদা এবং আমি। টিভি চলা সত্ত্বেও কেউ আর ওদিকে মন দিল না। আমরা খবরের কাগজ দিয়ে টেবিলটা ঢাকলাম। মি. পিরজাদা তাঁর জ্যাকেটটা খুলে একটা চেয়ারের পিঠে ঝুলিয়ে উপল পাথরের একজোড়া কাফলিঙ্ক খুলে রেখে তাঁর মাড় দেওয়া শার্টের হাতাগুলো গুটিয়ে নিলেন।
“প্রথমে ওপরদিকটা কাটুন। এভাবে,” আমি তর্জনী ঘুরিয়ে কায়দাটা দেখিয়ে নির্দেশ দিলাম।
মি. পিরজাদা প্রথমে ছুরির ফলার গায়ে ঢুকিয়ে সেটাকে চারপাশে ঘোরালেন। একটা গোটা বৃত্ত কাটা হয়ে যাওয়ার পর তিনি ওপরের ঢাকার মতো অংশটার বোঁটা তুলে ধরলেন। সেটা খুব সহজেই আলগা হয়ে উঠে আসল। এক মুহূর্তের জন্য মি. পিরজাদা ফলটার ওপর ঝুঁকে পড়ে ভিতরটা দেখলেন এবং শ্বাস ভরে গন্ধটা নিলেন। তারপর মা তাঁকে একটা লম্বা ধাতব চামচ দেওয়াতে সেটা দিয়ে ভিতরের অংশটা পরিষ্কার করে চেঁছে বের করলেন যতক্ষণ না শেষ সুতো, শেষ বীজটাও বেরিয়ে গেল। ইতিমধ্যে বাবা শাঁস থেকে বীজ বাদ দিয়ে একটা বিস্কুট করার শীট-এর ওপর শুকোতে দিয়েছিলেন, যাতে পরে আমরা সেগুলো ঝলসে খেতে পারি। ফলটার দাগকাটা গায়ে আমি দুটো ত্রিভুজ আঁকলাম। মি. পিরজাদা সে দুটো কেটে দিলেন। তারপর আমি ভুরুর জন্য দুটো অর্ধচন্দ্রাকার এবং নাকের জন্য আর একটা ত্রিভুজ আঁকলাম। ধুধু মুখটাই বাকি ছিল। মনে হল দাঁত তৈরি করাটা একটু কঠিন হবে, আমি ইতস্তত করছিলাম।
“হাসবে, নাকি মুখ বেঁকিয়ে থাকবে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“তুমিই বলো,” মি. পিরজাদা বললেন।
সমঝোতা করার জন্য একটা সোজাসাপটা গম্ভীর মতো মুখ আঁকলাম, বিষণ্ণ নয়, হাসি-হাসিও নয়। মি. পিরজাদা একটুও না দমে গিয়ে কাটতে শুরু করলেন, যেন সারা জীবন জ্যাক_ও ল্যান্টার্ন কেটে এসেছেন। তাঁর কাজ প্রায় শেষ হয়েই গিয়েছিল যখন জাতীয় খবর শুরু হল। সাংবাদিক ঢাকার নাম উল্লেখ করলেন এবং আমরা সকলেই শোনার জন্য টিভির দিকে ফিরলাম। একজন ভারতীয় কর্মকর্তা ঘোষণা করলেন যে, বাকি পৃথিবী যদি পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দেয়, তা হলে ভারতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। খবরটা শোনানোর সময় সাংবাদিকটির মুখ থেকে ঘাম ঝরে পরছিল। কোনও টাই বা জ্যাকেট ছাড়াই এমন জামাকাপড় পরেছিলেন যেন, তিনি নিজেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছেন। ক্যামেরাম্যানকে চিৎকার করে কথাগুলো বলার সময় তিনি তাঁর রোদে পোড়া মুখটা সূর্যের তাপ থেকে বাঁচানোর জন্য হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন। মি. পিরজাদার হাত থেকে ছুরিটা ফসকে পরে গিয়ে কুমড়োটার নীচের দিকটা কেটে গেল।
“প্লিজ আমাকে ক্ষমা করবেন,” মি. পিরজাদা তাঁর তাঁর মুখের একপাশে একটা হাত তুললেন, যেন কেউ তাঁকে সেই গালে থাপ্পড় মেরেছে। “আমি --এ তো ভয়ংকর ব্যাপার। আমি আর-একটা কিনে দেব। আমরা আবার চেষ্টা করব।”
“আরে না, না, “ বাবা বললেন। তিনি মি. পিরজাদার হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে ফলটা এমনভাবে কাটলেন যাতে ভুলটা ঢাকা পড়ে যায়। আমার আঁকা দাঁতগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল। তার জায়গায় একটা বেখাপ্পা রকমের বড় পাতিলেবুর মাপের ফুটো তৈরি হল এবং তার ফলে আমাদের জ্যাক-ও-ল্যান্টার্নের মুখে এক শান্ত স্তম্ভিত ভাব এসে গেল। ভুরুগুলো আর রাগী রাগী দেখতে রইল না। বরং এক শূন্য, জ্যামিতিক দৃষ্টির ওপর বিস্ময়ে স্থির হয়ে ভাসতে থাকল।
হ্যালোউইনে আমি ডাইনি সেজেছিলাম। আমরা ট্রিক-অর ট্রিট-এর সঙ্গী ডোরাও ডাইনি হয়েছিল। বালিশের ওয়াড় রঙ করে আমরা কালো কেপ (হাতকাটা ক্লক) বানিয়েছিলাম, সেই সঙ্গে কার্ডবোর্ডের চওড়া কানাওয়ালা আইসক্রিম কোনের মত টুপি। ডোরার মায়ের একটা ভাঙ্গা আইশ্যাডো দিয়ে আমরা আমাদের মুখে সবুজ রঙ লাগালাম। আমার মা লজেঞ্জ রাখার জন্য আমাদের দুটো মোটা ক্যানভাসের বস্তা দিলেন, যার মধ্যে একসময় বাস্মতী চাল ছিল। সে বছর আমাদের মা-বাবাদের মনে হয়েছিল যে, আমরা একা একা পাড়ায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য যথেষ্ট বড় হয়ে গিয়েছি। কথা ছিল আমি আমাদের বাড়ি থেকে ডোরার বাড়ি হেঁটে যাব, সেখান থেকে ফোন করে জানাব যে আমি নিরাপদে পৌঁছেছি এবং তারপর ডোরার মা আমাকে গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দেবেন। বাবা আমাদের টর্চ দিলেন। আমাকে ঘড়ি পরতে হল এবং তাঁর ঘড়ির সঙ্গে সময় মিলিয়ে নিতে হল। আমাদের ন’টার চেয়ে বেশি দেরি করার অনুমতি ছিল না।
সেই সন্ধেয় মি. পিরজাদা এসে আমাকে এক বাক্স মিন্ট ভরতি চকোলেট দিলেন।
“এর মধ্যে,” আমি বস্তাটা খুলে ধরে বললাম, “ট্রিক অর ট্রিট।”
“বুঝতে পেরেছি যে, আজ তোমার আমার উপহারের দরকার নেই,” বাক্সটা জমা দিয়ে তিনি বললেন। মি. পিরজাদা আমার সবুজ মুখ এবং টুপির দিকে তাকালেন। টুপিটা একটা সুতো দিয়ে আমার চিবুকের তলায় বাঁধা ছিল। খুব সাবধানে তিনি আমার টুপিটার প্রান্ত একটু তুলে ধরলেন। আমি টুপির নীচে একটা একটা সোয়েটার এবং ভেড়ার লোমের চিন দেওয়া জ্যাকেট পরেছিলাম। “তোমার শীত করবে না তো?”
আমি ঘাড় নাড়লাম, টুপিটা একদিকে হেলে গেল।
মি. পিরজাদা টুপিটা সোজা করে দিলেন। “স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাই বোধ হয় ভাল।”
আমাদের সিঁড়ির নীচটা ছোট ছোট লজেঞ্জের বাক্সে ভরতি হয়ে ছিল। মি. পিরজাদা জুতো খুলে অন্যদিনে মতো সেখানে না রেখে দেওয়াল আলমারির ভিতর রেখে কোটের বোতাম খুলতে শুরু করলেন। আমি তাঁর কোটটা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, কিন্তু ডোরা বাথরুম থেকে আমাকে ডেকে বলল যে, চিবুকে একটা জড়ুল আঁকার জন্য আমার সাহায্য চাই। আমরা প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার পর মা ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড় করিয়ে আমাদের একটা ফোটো তুললেন। তারপর আমি বেরোব বলে সদর দরজা খুললাম। মি. পিরজাদা এবং আমার বাবা তখনও বসার ঘরে যাননি, সামনের ঘরেই ঘোরাঘুরি করছিলেন। বাইরে আঁধার নেমে এসেছিল। হাওয়ায় ভিজে পাতার গন্ধ। দরজার পাশে ঝোপের সামনে আমাদের জ্যাক-ও ল্যান্টার্নটা মিটমিট করে কিন্তু সদর্পে জ্বলছিল। দূর থেকে দ্রুতপায়ে দৌড়ানোর শব্দ, যে ছেলেরা শুধুই একটি করে রাবারের মুখোশ পরে বেরিয়েছিল, তাদের চিৎকার এবং ছোট ছোট বাচ্চাদের জামাকাপড়ের খসখসানি ভেসে এলো। কেউ কেউ এত ছোট ছিল যে, মা-বাবারা কোলে করে তাদের দরজায় দরজায় নিয়ে যাচ্ছিলেন।
“যে বাড়িটা চেনো না, সেখানে যেয়ো না যেন,” মা সাবধান করলেন।
মি. পিরজাদা ভুরু কোঁচকালেন। “কোনও বিপদের সম্ভাবনা আছে নাকি?”
“না না,” মা তাঁকে আশ্বস্ত করলেন। “সব ছেলেমেয়েই বেরোবে আজকে। এটা তো একটা ঐতিহ্য।’’
“আমার বোধ হয় ওদের সংগে যাওয়া উচিত?” মি. পিরজাদা প্রস্তাব দিলেন। মোজা পরা ছড়ানো পায়ে দাঁড়ানো দেখে হঠাৎ কেমন ক্লান্ত, ছোটখাটো মনে হল তাঁকে। তাঁর চোখে একটা আতঙ্কের ছাপ দেখলাম, যে আগে কখনও দেখিনি। যথেষ্ট ঠাণ্ডা সত্ত্বেও আমি আমার বালিশের ওয়াড়ের মধ্যে ঘামতে শুরু করলাম।
“না না মি. পিরজাদা,” মা বললেন। “লিলিয়া ওর বন্ধুর সঙ্গে একদম নিরাপদ থাকবে।”
“কিন্তু যদি বৃষ্টি পড়ে? যদি ওরা হারিয়ে যায়?”
“চিন্তা করবেন না,” আমি বললাম। সেই প্রথমবার আমি ওই কথাগুলো মি. পিরজাদাকে বললাম। খুব সামান্য কয়েকটি কথা, কিন্তু যেগুলো সপ্তাহের পর সপ্তাহ তাঁকে বলার চেষ্টা করেও পারিনি। শুধু আমার প্রার্থনাতেই বলতে পেরেছিলাম। এবার আমার লজ্জা লাগল ভেবে যে, আমি শুধু নিজের জন্যই কথাগুলো বললাম।
মি. পিরজাদা তাঁর একটা মোটাসোটা আঙুল আমার গালে রাখলেন। তারপর আঙুলটা নিজের হাতের পিছনে চেপে ধরলেন। একটা হালকা সবুজ ছাপ পড়ল। “যদি ‘লেডি’ তাই চান,” তিনি মেনে নিলেন। তারপর ছোট্ট করে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালেন।
আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের কালো ছুঁচোলো সস্তা জুতা পায়ে অল্প হোঁচট খেতে খেতে এগোলাম। ড্রাইভ-ওয়ের শেষে হাত নাড়ার জন্য ফিরে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম দরজার ফ্রেমের মধ্যে, আমার মা আর বাবার মাঝখানে বেঁটেখাটো মানুষটি দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন।
“ওই লোকটি আমাদের সঙ্গে আসতে চাইছিল কেন?” ডোরা জিজ্ঞেস করল।
“ওর মেয়েদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।” বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমার আফসোস হল। মনে হল যেন আমার বলার জন্য কথাটা সত্যি হয়ে গেল, যেন মি. পিরজাদার মেয়েদের সত্যিই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এবং তিনি আর কখনও তাদের দেখতে পাবেন না।
“মানে তাদের কি ছেলেধরায় নিয়ে গিয়েছে? ডোরা প্রশ্ন করল।
“পার্ক বা কোনও জায়গা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে।”
“ঠিক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তা নয়। আমি বলতে চাইছিলাম যে, মেয়েদের কথা ওঁর খুব মনে পড়ে। তারা একটা অন্য দেশে থাকে আর তিনি অনেকদিন তাদের দেখেননি তো, তাই।”
আমরা ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে কলিং বেল বাজালাম। কেউ কেউ ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করার জন্য সব আলো নিভিয়ে রেখেছিলেন। কেউ জানালায় রাবারের বাদুড় ঝুলিয়েছিলেন। ম্যাকেন্টয়ারদের দরজার সামনে একটা কফিন রাখা ছিল। মি. ম্যাকেন্টয়ার চকের গুঁড়ো মেখে নিঃশব্দে কফিন থেকে উঠে আমাদের বস্তার ভিতর মুঠোভরতি ক্যান্ডি কর্ন ঢেলে দিলেন। অনেকেই আমাকে বললেন যে, তাঁরা আগে কখনও ভারতীয় ডাইনি দেখেননি। অন্যরা কোনও মন্তব্য না করে যা দেওয়ার দিয়ে দিলেন। টর্চের সমান্তরাল আলোর রেখা ফেলে এগোতে এগোতে আমরা দেখলাম রাস্তার মাঝখানে ফাটা ডিম, শেভিং ক্রিম মাখানো দাড়ি, গাছের মরা ডালে মালার মতো করে ঝোলান টয়লেট পেপার। যতক্ষণে আমরা ডোরার বাড়ি পৌঁছলাম, ততক্ষণে ভারি বস্তাগুলো বয়ে আমাদের হাতে দাগ হয়ে গিয়েছে। পা ফুলে ব্যথা করছে। ডোরার মা আমাদের কালশিটের জন্য ব্যান্ডেজ দিলেন, উষ্ণ সিডার এবং ক্যারামেল্ পপকর্ন খেতে দিলেন। তিনি আমাকে মনে করালেন যে, মা-বাবাকে ফোন করে জানাতে যে আমি নিরাপদে পৌঁছে গিয়েছি। আমি যখন ফোন করলাম তখন পিছনে টিভির আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমার গলা শুনে মা যে খুব আশ্বস্ত হলেন তা মনে হল না। ফোনটা রাখার পর খেয়াল হল যে, ডোরার বাড়িতে টিভি চলছিল না। ডোরার বাবা সোফায় শুয়ে একটা পত্রিকা পড়ছিলেন। কফি-টেবিলের ওপর এক গেলাস ওয়াইন রাখা ছিল, স্টিরিয়োতে স্যাক্সোফোন সংগীত বাজছিল।
ডোরা আর আমি আমাদের লুট পরীক্ষা করলাম। গোনাগুনি, নমুনা চেখে দেখা, লেনদেন ইত্যাদি করার পর আমরা সন্তুষ্ট হলে ডোরার মা তাঁদের গাড়িতে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিলেন। আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে দরজা অবধি পৌঁছানো পর্যন্ত তিনি ড্রাইভওয়েতে অপেক্ষা করলেন। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখতে পেলাম যে, আমাদের কুমড়োটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। মোটা খোসাটা টুকরো টুকরো হয়ে ঘাসের ওপর ছড়িয়ে ছিল। আমার চোখ জ্বালা করে উঠল, গলার কাছে একটা ব্যথা অনুভব করলাম। যেন আমার অবসাদগ্রস্ত পায়ের তলায় প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে যে ছোট্ট ধারালো নুড়িপাথরগুলো আওয়াজ তুলছিল, সেগুলো কেউ আমার গলায় ঠেসে দিয়েছে। আমি দরজা খুললাম। ভেবেছিলাম যে ওঁরা তিনজন সামনের ঘরে দাঁড়িয়ে আমাকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষা করবেন। আমাদের নষ্ট হয়ে যাওয়া কুমড়োটার জন্য দুঃখ প্রকাশ করবেন। কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না। বসার ঘরে মি. পিরজাদা, বাবা এবং মা সোফার ওপর পাশাপাশি বসে ছিলেন। টিভিটা বন্ধ। মি. পিরজাদা মাথায় হাত দিয়ে বসে।
সেই সন্ধে এবং তার পরবর্তী অনেক সন্ধেবেলায় তাঁরা যা শুনেছিলেন, তা এই যে, ভারত এবং পাকিস্তান ক্রমশই যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে। দু’পক্ষের সৈন্যরাই সীমান্তে উপস্থিত। স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুতেই ঢাকা সন্তুষ্ট হতে চাইছিল না। শোনা গেল যে, যুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতেই হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানকে সমর্থন করছিল। ভারত এবং শীঘ্রই যা বাংলাদেশ বলে পরিচিত হবে, তাদের পক্ষে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষিত হল। বারো দিন পর তাদের রসদের থেকে ৩,০০০ মা ইল দূরে যুদ্ধ করতে করতে দুর্বল হয়ে পর পাকিস্তানি সৈন্য ঢাকায় আত্মসমর্পন করল। এসব কথা আমি এখন জানতে পেরেছি। কারণ, এখন যে-কোনও ইতিহাস, যে-কোনও গ্রন্থাগারে এসব তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সেই সময়, কয়েকটি এলোমেলো যোগসূত্র ছাড়া ব্যাপারটা বেশিরভাগই আমার কাছে এক রহস্য ছিল। সেই বারো দিনের যুদ্ধের যেটুকু স্মৃতি আমার আছে, তা হল, বাবা আমাকে আর তাঁদের সঙ্গে খবর শুনতে বলতেন না। মি. পিরজাদা আমার জন্য লজেঞ্জ আনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মা রাতের খাবারের জন্য ভাত আর সেদ্ধ ডিম ছাড়া কিছুই রাঁধতেন না। মনে আছে কোনও কোনও রাতে আমি মাকে সোফার ওপর চাদর-কম্বল পাততে সাহায্য করতাম যাতে মি. পিরজাদা সেখানে শুতে পারেন। মাঝরাতে যখন মা-বাবা কলকাতায় আমাদের আত্মীয়স্বজনদের ফোন করে পরিস্থিতির খুঁটিনাটি খবরাখবর জানতে চাইতেন, তখন আমি তাঁদের তীক্ষ্ণ কণ্ঠের উচ্চস্বরে কথোপকথন শুনতে পেতাম। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে, সেই সময় তিনজন যেন একজন মানুষের মতোই ব্যবহার করছিলেন যেন একটাই শরীর, একই খাবার, একই নৈঃশব্দ এবং ভয়।
জানুয়ারি মাসে মি. পিরজাদা ঢাকায় তাঁর তিনতলা বাড়িতে ফিরে গেলেন বাড়িটার কতটা অবশিষ্ট আছে দেখার জন্য। বছরের সেই সপ্তাহগুলোয় আমরা তাঁর বেশি দেখা পেতাম না। তিনি তাঁর লেখা শেষ করতে ব্যস্ত ছিলেন। আমরাও ফিলাডেলফিয়া গিয়েছিলাম মা-বাবার বন্ধুর সঙ্গে বড়দিনের ছুটি কাটাতে। ঠিক যেমন আমাদের বাড়িতে তাঁর প্রথমবার আসার কথা মনে নেই, তেমনই তাঁর শেষবার আসার কথাও মনে নেই। এক দুপুরে, আমি যখন স্কুলে ছিলাম, তখন বাবা মি. পিরজাদাকে গাড়ি করে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিলেন। তারপর অনেকদিন আমরা তাঁর কোনও খবর পাইনি। টিভিতে খবরের সামনে খাবার খেতে খেতে আমাদের সন্ধেগুলো আগের মতোই কাটতে লাগল। একমাত্র তফাত ছিল যে, মি. পিরজাদা এবং তাঁর বাড়তি ঘড়িটি আমাদের সঙ্গে আর থাকত না। খবর অনুযায়ী, ঢাকা একটি নতুন সংসদীয় সরকার গঠন করে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। নতুন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। যুদ্ধে যে দশ লক্ষেরও বেশি বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তার জায়গায় নতুন নির্মাণের জন্য তিনি অনেক দেশের কাছ থেকে নির্মাণ-সামগ্রী চাইলেন। ভারত থেকে অসংখ্য উদ্বাস্তু ফিরে আসল। আমরা জানলাম, বেকারত্ব এবং দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা তাদের স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে। মাঝে মাঝেই আমি বাবার ডেস্কের ওপর টাঙানোর মানচিত্রটা খুঁটিয়ে দেখতাম এবং সেই ছোট হলুদ অংশটায় গলদঘর্ম মি. পিরজাদাকে কল্পনা করার চেষ্টা করাতাম। কল্পনা করতাম যে, একটা স্যুট পরিহিত অবস্থায় তিনি তাঁর পরিবারকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ততদিনে অবশ্য সেই ম্যাপটা অকেজো হয়ে গিয়েছিল।
অবশেষে কয়েকমাস পর ইসলামী নববর্ষের স্মরণে মি. পিরজাদা আমাদের একটি কার্ড এবং একটি ছোট চিঠি পাঠালেন। তিনি লিখেছিলেন যে, তিনি তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানদের সঙ্গে পুনর্মিলিত হয়েছেন। সকলেই ভাল আছেন। আগের বছরের ঘটনাগুলোর সময় তাঁর স্ত্রী-কন্যারা শিলং-এর পাহাড়ে, তাঁর স্ত্রীর দাদু-দিদিমার এস্টেটে থেকে নিজেদের রক্ষা করেছেন। তাঁর সাত মেয়ে আগের চেয়ে বেশি লম্বা হওয়া ছাড়া একইরকম আছে। তিনি এখনও তাদের নাম মনে রাখতে পারেন না। চিঠির শেষে তিনি আমাদের আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে লিখলেন যে, যদিও তিনি এখন ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ কথাটির অর্থ জানেন, তবুও কথাগুলো তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট নয়। সুসংবাদ পাওয়ার খুশিতে মা সে রাতে ভাল ভাল রান্না করলেন। কফিটেবিলে খেতে বসে আমরা নিজেদের জলের গেলাস তুলে শুভকামনা করলাম। কিন্তু আমার শুভ সংবাদ পালন করতে ইচ্ছে করছিল না। যদিও আমি তাঁকে কয়েক মাস দেখিনি, মি. পিরজাদার অনুপস্থিতি আমি যেন তখনই উপলব্ধি করলাম। সেই মুহূর্তেই, তাঁর নামের র জলের গেলাসটা উঠিয়ে, আমি যেন বুঝতে পারলাম যে, বহু মেইল এবং অনেক সময়ের দূরত্বে থাকা কারও কথা মনে পড়লে কীরকম মনখারাপ লাগে। যেমন অতদিন ধরে মি. পিরজাদার তাঁর স্ত্রী-কন্যার কথা মনে পড়ত। তাঁর আমাদের কাছে ফিরে আসার কোনও কারণ ছিল না। বা-বাবাই ঠিক বলেছিলেন যে, তাঁর সঙ্গে আমাদের আর কখনও দেখা হবে না। জানুয়ারি মাস থেকে, মি. পিরজাদার পরিবারের কথা মনে করে প্রতি রাতে শুতে যাওয়ার আগে আমি হ্যালোউইন থেকে বাঁচিয়ে রাখা একটা করে লজেঞ্জ খেতাম। সে রাতে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত একদিন আমি পড়ে-থাকা উপহারগুলো ফেলে দিলাম।
1 মন্তব্যসমূহ
েএটা কার অনুবাদ?
উত্তরমুছুন