[১]
[লেটারহেড : ওয়ারকার্স অ্যাকসিডেন্ট ইনসিওরেন্স ইনস্টিটিউট]
প্রাহা, ২০ সেপ্টেম্বর ১৯১২
প্রিয়তমা,
খুব সম্ভব আমার কথা আপনার আর মনে নেই। তাই, ফের আমি আমার পরিচয়টুকু দিয়ে রাখছি। আমার নাম ফ্রানত্স কাফকা। আমি সেই লোক, প্রাহায় পরিচালক ব্রডের [ম্যাক্স ব্রডের বাবা অ্যাডলফ ব্রড] বাড়িতে এক সন্ধ্যায় যাঁর সঙ্গে আপনার প্রথম পরিচয় হয়। আমি সেই লোক, যে টেবিলের বিপরীত প্রান্ত থেকে হাত বাড়িয়ে আপনার সঙ্গে করমর্দন করেছিলাম।
দেখতে দিয়েছিলাম বেশকিছু ছবি। আপনি ওই থালিয়া ভ্রমণের ছবিগুলোতেই আমাকে দেখতে পাবেন। আমি সেই লোক, যে এখন বড় আশা নিয়ে হাতে ধরা চাবির গোছা নাড়ানো বন্ধ করে দিয়ে আপনার হাত আঁকড়ে ধরতে চাইছে। কেননা, মনে আছে, আগামী বছর আপনি তার সঙ্গে ফিলিস্তিন বেড়াতে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার ইচ্ছে যদি আপনার এখনও থাকে — হ্যাঁ, তার আগে বলে নিই, ওই ওয়াদা আপনি যখন করেছিলেন তখন কিন্তু আপনার মধ্যে কোনো অস্থিরতা ছিল না। বিচলিত হওয়ার বিন্দুমাত্র লক্ষণ আমি আপনার মধ্যে দেখিনি। ফলে শুধু যৌক্তিক কারণেই নয় বরং এটা আমাদের উভয়ের ক্ষেত্রে জরুরি যে অতি দ্রুত এই যাত্রার ব্যাপারে আমাদের সমস্ত আলোচনা সেরে ফেলতে হবে। কেননা, আমাদের ছুটির দিনগুলোর প্রতিটি মুহূর্ত, যে-কোনও কারণেই হোক না কেন, খুবই সংক্ষিপ্ত। বিশেষ করে ফিলিস্তিন যাত্রার পক্ষে খুব বেশি নয়। আমরা এই অসুবিধেটুকু সহজেই অতিক্রম করে আসতে পারি যদি এ বিষয়ে যতটা সম্ভব বিস্তৃত আলোচনা আমরা আগে থেকেই সেরে নিই। সেই সঙ্গে আরও ভলো হয় যদি যাবতীয় প্রস্তুতির ব্যাপারে আমাদের মধ্যে সহমত গড়ে ওঠে।
শুনতে যতই খারাপ লাগুক আর না-ই লাগুক, আমার অসুস্থ মনের ছবি ফুটে উঠুক আর না-ই উঠুক, অবশ্যই স্বীকার করবো যে আমি এক অস্থির চিত্তের পত্রলেখক। হ্যাঁ, আমার এই অস্থিরতা মারাত্মক হয়ে ওঠে যখন আমার নাগালের মধ্যে টাইপরাইটার থাকে না। কেননা, চিঠি লেখার মেজাজ না থাকলেও আমার আঙুল সবসময় লেখালেখি করার জন্যে উশখুশ করতে থাকে।। আমি কিন্তু কখনোই একটি চিঠি লেখার পর তার উত্তর না আসা অব্দি ধৈর্য্য ধরে শান্তভাবে বসে থাকতে পারি না। আবার এমনও হয়, হয়তো চিঠি পাওয়ার জন্য দিনের পর দিন আশা নিয়ে বসে আছি অথচ চিঠি এলো না। এ সময়েও আমি বিন্দুমাত্র হতাশ হই না। আর শেষ পর্যন্ত চিঠি যদি সত্যিই এসে পৌঁছায়, তখন এর আকস্মিকতায়, বিস্ময়াভূত হয়ে আমি চমকে উঠি। সাদা কাগজ নিয়ে লিখতে বসে বেশ বুঝতে পারি, আমি নিজে যা চাই তা ঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে না পেরে নিজেকেই আরও জটিল করে ফেলছি। আর আজ যদি সেই ভুল করে থাকি তাহলে আমার উদ্দেশ্য সফলই বলবো, কেননা, তা না হলে, শুধু শুধু কেনই-বা আমি ছ-ছটি ঘণ্টা একটানা অফিসে কাটিয়ে দিয়ে এই চিঠিটি এখনই, এভাবে লিখতে বসবো? এদিকে আবার আমার আছে এমনই একটি টাইপরাইটার, যেটি আমি কখনোই ব্যবহার করি না। তবু. হ্যাঁ, টাইপরাইটার ব্যবহারের আসল অসুবিধা হলো, যদি সন্দেহ জাগে তাহলে এতে কাজ করতে করতে খেই হারিয়ে যায়। আমি কিন্তু বাস্তব সন্দেহের কথা বলছি। ওই ভ্রমণের সময় ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে, প্রদর্শক হিসেবে, আমি কিন্তু আপনার পছন্দের সঙ্গী হয়ে উঠতে পারবো না। হয়তো বা কোনও না কোনওভাবে আমি আপনার বোঝা হয়ে উঠবো, পীড়াদায়ক বা অন্যকিছু। এরকম মনে করলে, আশা করি চিঠিতে অন্তত সেকথা আগে থেকে আমাকে জানিয়ে দিতে আপনার আপত্তি থাকবে না। আগামী কিছুদিন এইসব বিয়ষই আমাদের চিঠির বিষয় হয়ে উঠুক, আমি সেটাই চাই। সেই ভালো, আপনি আমাকে আপনার ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে যাচাই করে নিন।
আপনার বিশ্বস্ত,
ড. ফ্রানত্স কাফকা
পোরিক ৭, প্রাহা
[২]
[লেটারহেড : ওয়ারকার্স অ্যাকসিডেন্ট ইনসিওরেন্স ইনস্টিটিউট]
প্রাহা, ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯১২
প্রিয়তমা ফ্রাউলিন বাউয়ার,
টাইপরাইটার ব্যবহার না করবার জন্য ক্ষমা করে দেবেন। আপনাকে বলার মতো অনেক কথা জমে আছে, অথচ টাইপরাইটারটি পড়ে রয়েছে করিডোরের বাইরে। এদিকে এই চিঠিটি লিখে ফেলাও ভীষণ জরুরি। আজ ছুটির দিন, এখানে, এই বোহেমিয়ায় (এটা কোনও অজুহাত হতে পারে না)। সত্যি বলতে কী, আসলে টাইপরাইটারটি আমার মনের মতো গতিতে ছুটতে পারে না। আজজের আবহাওয়াটা বেশ সুন্দর। উষ্ণ। জানালাটা খোলা (আমার জানালা সব সময়ই খোলা থাকে) এবং আমি আজ এমনকিছু কাজ করে ফেলেছি যা দীর্ঘদিন ধরেও করে উঠতে পারিনি। ব্যস্তসমস্ত হয়ে অফিসে গিয়ে পৌঁছেছি। শুধুমাত্র আপনার চিঠি পাওয়ার আশায় যাওয়া ছাড়া এই ছুটির দিনে আমার অফিসে যাওয়ার কোনও মানেই ছিল না।
হয়তো ভাবছেন, আপনার ঠিকানা কিভাবে পেলাম? প্রশ্নটি কিন্তু আদৌ কোনো প্রশ্ন নয় যা আসলে আপনি আমাকে করতে চাইছেন। আপনার চিঠিটা আমি আসলে এ ওর কাছে চেয়ে-চিন্তে লিখছি। ঠিকানাটা সেভাবেই সংগ্রহ করেছি। প্রথমে আমি পাই একটি কর্পোরেশনের ঠিকানা। কিন্তু তাতে আমার মন ভরলো না। তারপরে পেলাম আপনার অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানা। কিন্তু তাতে আবার নম্বর নেই। সবশেষে পেলাম নম্বরযুক্ত ঠিকানা। এবার আমার মন ভরলো এবং সঙ্গে সঙ্গেই আমি চিঠি লিখতে বসে গেলাম। ঠিকানা নিয়ে কিছুক্ষণ গবেষণা করলাম। কেন জানি না সন্দেহ হলো, ঠিকানাটা ঠিক আছে তো? ঠিকানায় একটা নাম ছিল — ইম্যানুয়েল কিরচ। ভাবতে লাগলাম ইনি আবার কে! আর বুঝতেই পারছেন সন্দেহভাজন ঠিকানায় কোনও চিঠি পাঠানো কতখানি পীড়াদায়ক। এরকম ঠিকানায় চিঠি পাঠানো আর না পাঠানো একই কথা, তাই না? লজ্জা আর কি! তারপর যখন আবিষ্কার করলাম আপনার বাড়ির রাস্তায় ইমানুয়েল নামে একটা চার্চ আছে তখন সমস্ত ভাবনাচিন্তা আর সন্দেহের অবসান হলো। আপনার ঠিকানার সঙ্গে আবার কোনো কম্পাস-পয়েন্টের উল্লেখ থাকতে পারে বলে আমার মাথায় এলো। কেননা বার্ির্লনের প্রায় সমস্ত ঠিকানাতেই আমি এর উপস্থিতি লক্ষ করেছি। আমার মনে হলো, হয়তো এই পয়েন্টের উত্তর দিকে আপনি থাকেন। এটা কেন মনে হলো বলতে পারবো না। আমি যদিও জানতাম, জেলা হিসেবে এটা খুব বড় কোনো শহর নয়।
আপনার ঠিকানা নিয়ে এই উদ্বেগ উত্কণ্ঠা ছাড়াও (প্রাহা ২০ না প্রাহা ৩০, কোথায় আপনি থাকেন সেটাও আমার জানা ছিল না)। এছাড়া আপনাকে চিঠি লেখার আগে আরও কী করুণ অবস্থা আমার হয়েছিল, সেটা একটু বলি। মনে হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত তাহলে আমাদের দুজনের মধ্যবর্তী দরোজাটি খুলতে চলেছে কিংবা আর কিছু না হোক ওই দরজার হাতলে আমরা দুজনেই হাত রাখতে চলেছি। আর এটা আমি পারি, অবশ্যই। অতি অবশ্যই বললে হয়তো ঠিক হতো। আহ্, এখন চিঠি লেখার যে মুড আমার এসেছে, ফ্রাউলিন বাউয়ার, আপনাকে কী আর বলবো! এক অদ্ভুত হিমস্রোত অবিশ্রান্তভাবে আমার সমস্ত স্নায়ু বেয়ে নামতে শুরু করেছে। এখন যা চাইছি, পরমুহূর্তে হয়তো চাইবো অন্যকিছু। এইভাবে চলতে চলতে যখন এক তুমুল অনুভূতির উচ্চগ্রামে এসে পৌঁছুলাম, তখন কিন্তু আমি একেবারেই ভাবতে পারছিলাম না, হায়, প্রথম চিঠি লিখতে বসেই যদি আমার এই অবস্থা হয়, তাহলে প্রথম যেদিন আপনার অ্যাপার্টমেন্টের শেষ সিঁড়িতে গিয়ে পা রাখবো তখন আমার কী অবস্থা হবে। মনের দিক থেকে স্থির হওয়ার আগে বা চিঠি লেখার আগে আমি হয়তো নিজের মধ্যে অনেক অনিশ্চয়তা ঘনিয়ে তুলবো। এভাবেই আমার কিছুটা সময় কেটে গেল। পরে এই অনুভূতি কিছুটা থিতিয়ে এলে লক্ষ করলাম, যে চিঠি আপনাকে আমি লিখবো তার খসড়া আমার মনের মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। কত যে সন্ধা, বাড়িয়ে না বলে বলতে পারি ঠিক দশটি সন্ধ্যা আমি আপনাকে প্রথম চিঠিতে কী লিখবো তার কাল্পনিক খসড়া মনে মনে তৈরি করে ফেলেছি। আর এই খসড়া ঘুমাতে না যাওয়া অব্দি মাথা থেকে কিছুতেই সরাতে পারিনি। এও আমার একধরনের ব্যর্থতা যে আমি কোনো স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো তর তর করে লিখে উঠতে পারি না। বিশেস করে সেই ধরনের লেখা যা আমি সিরিয়াসলি লিখবো বলে ঠিক করেছি। আসলে আমার স্মৃতিশক্তি অনেক দুর্বল। কিন্তু এই স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর হলে যে লেখাটি আমি আগে থেকেই লিখবো বলে স্থির করি, সেই লেখার ন্যূনতম একটি অনুচ্ছেদও স্মৃতি থেকে নিখুঁতভাবে তুলে এনে লেখা আমার পক্ষে সম্ভবপর বলে আমার মনে হয় না। কেননা, আমি মনে করি, একটি লেখার প্রত্যেকটি লাইনের মধ্যবর্তী ফাঁকটুকুর মধ্যেও বিরাট ব্যঞ্জনা লুকিয়ে থাকে। একটি লেখা সম্পূর্ণভাবে লিখে ফেলার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এটা কেমন দাঁড়াবে, নির্ধারণ করা একেবারেই অসম্ভব। তাছাড়া স্মৃতি থেকে আমি যখন কোনও পঙিক্ত উদ্ধার করে লিখে ফেলবো বলে মনে করি, লক্ষ করে দেখেছি, পূর্ণ পঙক্তিটি তখন আর পূর্ণ থাকে না, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আর এই টুকরোগুলোর দু-এক টুকরোর মধ্যে না পাই কোনও অর্থ, না কোনও অর্থেও প্রাগবর্তী অর্থ। ফলে, এইসময়ে আমি এত মুষড়ে পড়ি যে কলমটিকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার থাকে না। এরকম হওয়া সত্ত্বেও আমি আপনাকে কী লিখবো, সেই প্রথম চিঠি নিয়ে অনেক ভেবেছি। যেহেতু ওই চিঠিটি যে-কোনোভাবে হোক লিখে ফেলার জন্য আমি মনস্থির করে ফেলেছিলাম, তখন বলতে দ্বিধা নেই, এরকম ভাবনাচিন্তাই চিঠিটি লেখার সময় আমার সামনে প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্পষ্ট মনে পড়ছে, একবার ভাবতে ভাবতে তড়াক করে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে পড়ি। আপনাকে অতি দ্রুত যা লিখবো বলে ভেবেছিলাম তা আর লেখা হলো না। যত দ্রুত বিছানা থেকে উঠেছিলাম ঠিক তত দ্রুত আমি আবার বিছানায় ফিরে যাই। এটা ছিল আমার দ্বিতীয় ব্যর্থতা। আমি আমার এই বোকামি আর উদ্বেগের জন্যে নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিয়েছিলাম!
কিন্তু এইভাবে লেখার কথা ভাবলে কী আমার লেখা কোনোদিন শেষ হবে? আপনাকে আজ আমার যা যা বলার আছে সেসব না বলে, দেখুন, আমি আমার আগের চিঠি নিয়েই এখনও বকবক করে চলেছি। অনুগ্রহ করে একটু বোঝার চেষ্টা করুন, কেন সেই প্রথম চিঠিটা আমার কাছে আজ এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সেটা আসলে এই কারণে যে, আমি ওই চিঠির উত্তর আপনার কাছ থেকে পেয়েছি আর সেই উত্তরটা এইতো এইখানে, আমার হাতেই রয়েছে। টিঠিটি সত্যি আমাকে বিপুল আনন্দ দিয়েছে। আমি চিঠিটাকে হাতে তুলে নিয়ে অনুভব করছি — এটি আমার — এই অনুভূতি পরম উষ্ণতার। প্লিজ, আমাকে আবার লিখুন, আরও একটি চিঠি। অতি দ্রুত। চিঠি লেখার জন্য প্রস্তুতির দরকার হয় এটা ঠিক, সে কারণে ঘটা করে আমি কখনোই আপনাকে চিঠি লিখতে বলবো না। আপনি শুধু ছোট একটা ডায়েরি রাখেন, আমার জন্যে। কেননা ডায়েরির চাহিদা তেমন নাই, অথচ ডায়রি আমাদের দেয় অনেক কিছু, আপনি তাতে লিখে ফেললেই হলো। যদিও বাস্তবে আমি এখনও আপনাকে ঠিক তেমনভাবে জানি না, তবে অনেককিছুই আপনি তাতে লিখতে পারেন। যেমন ধরুন আপনি তাতে লিখতে পারেন — ক'টায় আপনি অফিসে যাওয়ার জন্য বেরুলেন, ব্রেকফাস্টে কী কী খেলেন, অফিসের জানালা দিয়ে আপনি কী কী দেখলেন, অফিসে কী ধরনের কাজ আপনাকে করতে হলো। তারপর, আপনার পুরুষ বন্ধুদের নাম কী, মেয়ে বন্ধুদের নাম কী। কোনও উপহার পেলে কেন আপনি উপহারটি পেলেন, কে আপনাকে দারুণ উপহার দিয়ে আপনার স্বাস্থ্যের ক্ষতিসাধন করার চেষ্টা করছে — এইরকম আর কি। এইভাবে নানান জিনিস আপনি আপনার দিনপঞ্জিতে লিখে রাখতে পারেন, যদিও কী লিখবেন তার অস্তিত্ব বা সম্ভাবনা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। ও! আরেকটা কথা বলে রাখি, আমাদের ফিলিস্তিন ভ্রমণের কী হলো? অদূর ভবিষ্যতে কিংবা অদূর ভবিষ্যতে নয়, যাই হোক, আগামী বসন্ত কিংবা শরতের মধ্যেই অতি অবশ্যই আমাদের কিন্তু ভ্রমণ করা চাই। এদিকে ম্যাক্সের নাটকের এখনও কোনো খবর নাই। নাটকটি মনে হয় ঘুমোচ্ছে। ম্যাক্স মনে হয় এখন ইটালিতে। অতি সম্প্রতি তিনি বিশালকার একটা লিটের্যারি ইয়ারবুক নিয়ে সমগ্র জার্মান কাঁপাবেন বলে মনে হচ্ছে। আমার বই, পুস্তিকা, খোলা চিঠি অবশেষে প্রকাশের জন্যে গৃহীত হয়েছে। কিন্তু এই কাজটিকে খুব ভালো বলা যাবে না। আরও ভালো কিছু আমাকে লিখতে হবে, আর আমার এই মতামত জানাবার মধ্য দিয়েই আপনাকে বিদায় জানাচ্ছি!
ফ্রানত্স, কে.
[৩]
১৩ অক্টোবর ১৯১২
প্রিয়তমা ফ্রাউলিন বাউয়ার,
আপনার প্রথম চিঠিটি পনের দিন আগে, সকাল দশটায়, আমার হাতে এসে পৌঁছেছিল। এর কয়েক মিনিট পরেই আমি আপনাকে উত্তর দিতে বসি এবং লিখে ফেলি চার পৃষ্ঠার একটা দীর্ঘ অবশ্য এর জন্য কোনো অনুতাপ নেই আমার। কেননা, এর থেকে আরো বেশি আনন্দ পেতে পারি এমন করে সময় কাটানোর কোনও সুযোগ আমার নেই। দুঃখ শুধু এই যে, চিঠিটি যখন লেখা শেষ করলাম, দেখলাম, আমি আসলে যা বলতে চেয়েছি তার খুব সামান্যই বলতে পেরেছি। ফলে, ওই না-লেখা অংশগুলো বেশ কিছুদিন ধরে আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমি ছটফট করছিলাম। শেষে, ওই চিঠির উত্তর পাওয়ায় উদ্বেগাকুল সমস্ত ভাবনা আমার মাথা উবে যায় আর একধরনের তীব্র অনুভব অধীশ্বর হয়ে আমার মাথায় বিরাজ করতে করতে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন আপনি আমাকে এতদিন লেখেননি? এটা কী করে সম্ভব হলো? এখন বুঝতে পারছি, ওই চিঠির ভাষ্য অনুসারে এটা হয়তো প্রমাণ করাও যাবে যে, আমার ওই চিঠিতে নিশ্চয়ই বোকামি করে ফেলেছি এমন কিছু ছিল, যা আপনাকে অস্থির এবং অথবা বিব্রত করেছে। আবার এও হয়তো অসম্ভব নয় যে, আমার ব্যবহূত প্রত্যেকটি শব্দের অন্তর্নিহিত মহত্ ইচ্ছাই আপনাকে শেষ পর্যন্ত ওই অস্থিরতা বা বিব্রতকর অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়। আসলে সত্ উদ্দেশ্যে লিখলে কোনো চিঠি কী কখনো বিফলে যায়? আমি কিন্তু এক তুমুল উত্কণ্ঠার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে আমার চিঠিটা আপনাকে পাঠিয়েছিলাম। উত্কণ্ঠাটা ছিল এরকম যে শেষ পর্যন্ত চিঠিটা ঠিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে তো? একইসঙ্গে ছিল উত্তর পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, আর সত্যি সত্যিই কী একটি চিঠি কখনো হারিয়ে যায়? যিনি সেই চিঠিটি পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন তাঁর মানসিক জগত্ থেকে? বিশেষ করে তিনি যখন কেবলই ওই ব্যাখ্যা ছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যাই নিজের কাছে দাঁড় করাতে পারেন না, চিঠি না পাওয়ার কারণ হিসেবে? আমার প্রাপ্য চিঠি আসলে আপনার কাছেই জমা ছিল, পোস্ট করা হয়নি! আমাদের ফিলিস্তিন ভ্রমণের প্রতি আপনার বিরাগজনিত কারণে একথা বলা কি ঠিক হবে? কোনো পরিবারেই কী এরকমটা কখনও ঘটে? বিশেষ করে আপনার পরিবারে? আমার ধারণা অনুসারে চিঠিটা পৌঁছানোর কথা রবিবার সকালেই। তাহলে বাকি রইলো অন্য যে দুঃখদায়ক সম্ভাবনাটি, সেটা হলো আপনার অসুস্থতা। কিন্তু তাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। কেননা, নিশ্চতভাবেই আমি জানি আপনি স্বাস্থ্যবতী এবং প্রাণবান এক নারী — ফলে আমার সমস্ত ব্যাখ্যাই শেষ অব্দি মার খাচ্ছে, তাই না? উত্তর পাওয়ার খুব বেশি আশা না নিয়েই আজ আপনাকে এই চিঠিটা লিখছি। বলা ভালো, আমি আমার নিজের কাছে কর্তব্যপরায়ণ থাকতে চাই বলেই এই চিঠিটা লেখা। ইম্যানুয়েলকিরচত্রাসের যে পোস্টম্যান আপনাদের বাড়িতে চিঠি পৌঁছে দেয়, আমি যদি সেই ব্যক্তি হতাম, তাহলে আমি আপনাদের বাড়ির দরোজায় অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে পড়া কোনো সদস্যের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তাম না। সোজা আপনাদের বাড়ির ভেতরে ঢুকে, সমস্ত কক্ষ অতিক্রম করে, সশরীরে সটান আপনার সামনে গিয়ে হাজির হয়ে আপনার হাতে চিঠিটা তুলে দিয়ে আসতাম। কিংবা এরকমটা যদি হতো, তাহলেও মন্দ হতো না, কি বলেন? ধরুন, আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম এবং মনের আনন্দে আপনাদের কলিং বেল টিপতেই থাকলাম। কাজটা এমন আনন্দে করতে থাকলাম যাতে একটি মানুষ তার সমস্ত টেনশন থেকে মুক্তি পায়!
আপনার,
ফ্রানত্স কে.
পোরিক ৭, প্রাহা
[৪]
[লেটারহেড : ওয়ারকার্স অ্যাকসিডেন্ট ইনসিওরেন্স ইনস্টিটিউট]
২৩ অক্টোবর ১৯১২
প্রিয়তমা ফ্রাউলিন বাউয়ার,
এমনকি এই মুহূর্তে আমার অফিসের তিনজন পরিচালকও যদি আমার টেবিলের পেছনে এসে আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়েন, আমার লেখার উপর হামলে পড়েন, আমি আমার লেখা চালিয়ে যাবো, যা লিখতে চাই, লিখে ফেলবো। কেননা, আপনার চিঠি আজ মেঘের বুক চিরে আমার ওপর পুষ্পবৃষ্টির মতো ঝরছে। এ হলো সেই চিঠি, যে-চিঠির জন্যে আমি অধীর আগ্রহ, উদ্বেগ আর উত্কণ্ঠা নিয়ে গত তিন সপ্তাহ ধরে অপেক্ষা করছি (এই মুহূর্তে নিকটবর্তী ওপরওয়ালার কাছ থেকেও যা কিছু চাওয়া ও পাওয়ার আশা করতে পারি, তাও আমার পরিপূর্ণভাবে পাওয়া হয়ে গেছে)। আমাকে যদি আপনার জীবন সম্পর্কে কারুর সঙ্গে তুলনা করতে হয় তাহলে আমি অবশ্যই আপনাকে বলবো, আমার জীবনের অর্ধেক অংশই আমি আপনার চিঠির অপেক্ষায় কাটিয়ে দিয়েছি। এই অপেক্ষার মধ্যে রয়েছে আমার ছোট্ট তিনটি চিঠি যা ওই তিন সপ্তাহের মাঝেই আপনাকে লেখা, কিন্তু পোস্ট করা হয়নি। এর মধ্যেকার অন্তত দুটি চিঠি এখনো আপনাকে পোস্ট করা যায় (এইমাত্র আমার কাছে জনৈক ক্লায়েন্ট জানতে চাইলেন সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের ইনসিওরেন্সের বিষয়টা আসলে কী, হায় ঈশ্বর) এবং তৃতীয়টি — যা আসলে প্রথমে লেখা, আপনাকে পাঠাবো না। ধরে নিতে পারেন আপনাকে লেখা ওই চিঠিটি হারিয়ে গেছে (দেখেছেন, এইমাত্র আমাকে আবার জানাতে হবে ক্যাথারিনবার্গে, জোসেফ ভাগনারের মন্ত্রীপরিষদীয় আপিলের ভাগ্যে কী ঘটেছিল)। ফলে, আমি আমার ওই চিঠিতে যে কথাগুলো লিখেছিলাম সেই সব প্রশ্নের কোনো উত্তর স্বাভাবিকভাবেই পাব না, যদিও এই চিঠিটি হারিয়ে ফেলার জন্য সম্পূর্ণভাবে আমিই দায়ী।
জানেনম আমি ভীষণ চঞ্চল আর অস্থিরচিত্তের মানুষ! কখনো স্থির থাকতে পারি না; সবসময় মুডে থাকি আর বৃত্তের মতো ঘুরে ঘুরে একই অভিযোগ তুলি। যদিও 'আজ' কোনোভাবেই 'গতকাল' নয়, তবু, ওই স্তূপই জমতে জমতে একদিন ভালোর দিকে উপচে পড়বে বলে আমি বিশ্বাস করি।
এই মুহূর্তে আমি আজ যা লিখছি তা কিন্তু আদৌ আপনার চিঠির উত্তর নয়। সম্ভবত এর উত্তর আপনি পেয়ে যাবেন আমার আগামীকালের চিঠিতে। সম্ভবত, যদি না দিনটি পরশু হয় কিংবা তার পরের দিন, বা তারও পরের দিন। আমার লেখার ধরনটিকে নিশ্চয়ই পাগলামি বলা যাবে না, যদিও আমার বর্তমান জীবনধারার অনেকখানি প্রতিচ্ছবি তাতে ফুটে ওঠে। ফলে, আমার লেখার ধরনটাকে কখনো কখনো পাগলামি বলে মনে হলেও হতে পারে। এই বিষয়েও দু-একদিনের মধ্যে আমি আপনাকে কিছু কথা বলবো।
এটুকু জানবেন, আমি এখন আপনাকে আমার বর্তমান অবস্থার কথাই লিখছি। এই যে বই, চকোলেট এবং ফুল কী আপনার অফিসের সারা ডেস্ক জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে? আমার টেবিলে কিন্তু এক বন্য উদ্দামতা, উচ্ছৃঙ্খলতা ছাড়া আর কিছুই পাবেন না। আপনার ফুল, যার জন্যে আমি আপনার হাত দুটিতে চুমু খেতে চাই, অতি দ্রুত আমি আমার যন্ত্রপাতি, কাগজপত্র, চিঠি, বই, আমার যা কিছু রাখার একমাত্র সম্বল ওই ওয়ালেটে গুঁজে রেখেছি। তবে ওখানে রাখলেও আমার চিঠিপত্র কীভাবে যে হারিয়ে যায়, সেটাও লক্ষ করেছি। কোথায় যে ওইসব ঢুকে পড়ে, কে জানে। কিছুতেই আর খুঁজে পাই না। হোক না এমন, তবু এই ওয়ালেটেই কিন্তু আপনার আরো দুটি চিঠি রক্ষিত আছে। আমি ম্যাক্সকে একবার বলেছিলাম, ওকে লেখা আপনার চিঠিগুলো আমাকে দেখাতে। তো উনি সেগুলো আমাকে দিয়েও ছিলেন। ওই চিঠিগুলো এখনো ওই ওয়ালেটেই আছে। পুরো ব্যাপারটা হয়তো আপনার কাছে হাস্যাস্পদ মনে হতে পাওে, কিন্তু এছাড়া আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মতো আপনার কিছু থাকবে না। ওখানে এমন কিছু আর নেই।
আমাদের যোগাযোগের প্রাথমিক পর্বে এই ধরনের আকস্মিক দুর্ঘটনা হয়তো 'সু'-এরই লক্ষণ। বিশেষ করে এটা এখন আমার কাছে পরিষ্কার, চিঠিগুলো যদি হারিয়েও যায়, তাতেও আপনাকে লিখতে আমার কোনো বাধা থাকবে না। কিন্তু এভাবে চিঠি হারানোর ব্যাপারটার এখানেই ইতি ঘটা উচিত। — বিদায়, ছোট্ট একটা ডায়েরির কথা ভেবে দেখবেন।
আপনার
ফ্রানত্স কাফকা
চিঠির প্রথম পৃষ্ঠার একেবারে ওপরে লেখা ছিল : 'সম্ভাব্য আর কোনো চিঠির খোয়া যাওয়ার ভয়ে আমি ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে আছি, আর আপনি কিন্তু আমার ঠিকানাটাও এখনও ঠিকভাবে লিখতে পারছেন না। লিখবেন 'পোরিক সেভেন', অর্থাত্ 'আর' এবং 'সি' বর্ণ দুটির কথা বলছি। সেইসঙ্গে 'ওয়ারকার্স অ্যাকসিডেন্ট ইনসিওরেন্স ইনস্টিটিউট' কথাটা লিখে দিলে ঠিকানটাা নিরাপদ হয়। ফ্রাও সোফির জন্মদিন কবে, আমি আপনাকে আগামীকাল জানাবো।'
[৫]
১১ নভেম্বর ১৯১২
ফ্রাউলিন ফেলিস!
একটা অনুরোধ করবো আপনাকে? হয়তো পাগলামি হবে। আসলে এই ব্যাপারটার প্রতি যথেষ্ট সম্মান জানিয়েই বলছি, আমি কী আদৌ আপনার চিঠি পাওয়ার যোগ্য? কী মনে হয় আপনার? এটা অবশ্য এমন একটা অনুরোধ যা যথেষ্ট সংবেদনশীল মানুষকেও করা যায় না। হ্যাঁ, যা বলছিলাম আর কি, অনুরোধটা ঠিক এরকম। অনুগ্রহ করে আপনি আমাকে সপ্তাহে মাত্র একবারই চিঠি দেবেন, যাতে আপনার চিঠিটি আমার কাছে রোববার এসে পৌঁছোয়। কারণটা আসলে কিছুই নয়, আমি আপনার প্রত্যেক দিনের প্রতিটি চিঠি ঠিক সহ্য করতে পারছি না। আমার পক্ষে এটা সওয়া অসম্ভব। যেমন ধরেন আমি আপনার একটি চিঠির উত্তর দিলাম, তারপর শান্তভাবে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কিন্তু তখনও যে আমার বুক ঠিপঠিপ করতে থাকে আর সারা শরীর জুড়ে সেই স্পন্দন অনুভূত হয়। এইসময় আমি কেবল আপনাকে নিয়েই মগ্ন থাকি। আমি যে আসলেই তোমার; [এই প্রথম, কাফকা তার চিঠিতে 'আপনি'-র জড়তা ভেঙে ফেলিসকে 'তুমি' বলে সম্বোধন করলেন] সত্যি বলছি, এই কথাটি আর অন্য কোনোভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এই প্রকাশভঙ্গিও, মনে হচ্ছে যেন আন্তরিকতার দিক থেকে ঠিক ততখানি গভীর হয়ে উঠছে না।
আর, শুধুমাত্র এই কারণেই আমি জানিতে চাইছি না ঠিক এই মুহূর্তে তুমি কেমন ধরনের পোশাক পরে আছ। কেননা এই তথ্যটিও আমাকে এত দ্বিধান্বিত করে তুলবে যে শেষ পর্যন্ত আমি আমার জীবনযুদ্ধটাই হারিয়ে ফেলবো। ফলে এই সামান্য ব্যাপারটাও তোমাকে প্রশ্ন করে জানতে চাই না যে তুমি আমাকে ভালোবাসো কিনা। সত্যি সত্যি যদি জেনে ফেলি, হ্যাঁ, ব্যাপারটা ইতিবাচক, তাহলে এভাবে অফিসে বসে থাকার বোকামি করাটা কী আমার পক্ষে আর কখনো সম্ভব হবে? কিংবা ঘরে বসে থাকা? এরকম হলে তো আমাকে লাফ মেরে ট্রেনে উঠে, তোমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের কাছাকাছি ছুটে গিয়ে, তোমার চোখে চোখ রেখে আমাকে বসে থাকতে হবে। ওহ্, তাতেই আমার যত দুঃখ। সেটা করতে পারছি না বলেই ব্যথা অনুভব করছি। সংক্ষেপে বললে : আমার শরীর ঠিক ততটুকুই সুস্থ, যতখানি সুস্থতা কেবল নিজের জন্যে একজন মানুষের প্রয়োজন হয়। বিয়ের জন্যে যে সুস্থতা থাকা দরকার তা আমার নেই। এভাবেই আমি মনে করি, নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব হয়ে উঠুক আমার একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। তবু আমি যখন তোমার চিঠি পড়ি, কেন জানি না আমার মনে হয়, যা থেকে দৃষ্টি এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়, তাও আমি অনায়াসেই এড়িয়ে চলতে পারি। ইশ! এই মুহূর্তে যদি তোমার উত্তরটি পেতাম। ওহ্, কী সাংঘাতিক, এরকম একটা চিঠি লিখে — নোংরা একটি চিঠি — এর আগে তোমার ডেস্কে গিয়ে কখনও পড়েনি, তোমাকে লিখে সচকিত করে দিলাম, তাই না? অথচ তুমি এতক্ষণ বেশ ছিলে তোমার নিজের ঘরে, নিজের মত করে। কী-ই, তাই না? সত্যি কথা বলতে কি, মাঝে মাঝে এই ব্যাপারটাই আমাকে বেশ নাড়া দিয়ে যায়, আমার মতো একটা ভূতগ্রস্ত মানুষ তোমার মতো পূতপবিত্র সুন্দর একটা নামের পিছু নিয়েছে। আমি আমার শনিবারের চিঠিটা তোমাকে পাঠালে বুঝতে পারতে কেন এসব কথা বলছি। ওই চিঠিতে জানিয়েছিলাম, আমাকে তোমার আর চিঠি দেওয়ার প্রয়োজন নেই, আমিও তোমাকে দেব না। হায় ঈশ্বর! ভাগ্যিস তোমাকে চিঠিটা পাঠাইনি! গব হয়তো ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু এখনো সেটা হবে কী? আচ্ছা, আমরা সপ্তাহে মাত্র একটা করে চিঠি দিলে কেমন হয়? তাতে কী কোনো উপকার হবে? আরে না না, আমার ভোগান্তি যদি তাতে আদৌ সারতো, তাহলে তার অভিঘাত নিশ্চয়ই এতটা তীব্রতা হতো না। ইতিমধ্যে আমি বেশ বুঝে ফেলেছি, কেবল রোববারে তোমার চিঠি পেলে তাতে কোনো ফল হবে না। ওই চিঠি সহ্য করতে পারাটাও তো আমার পক্ষে বেশ বিপজ্জনক। তাই শনিবারের সুযোগটি হাতছাড়া করলে আমার যে ক্ষতি হয়ে যাবে তা পুষিয়ে নেয়ার জন্য আমি তোমাকে একটা অনুরোধ করছি। অন্তত যত দিন আমরা আমাদের জীবনের মূল্যটুকু খুঁজে না পাবো, তত দিন যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক। ক্ষতি কি?
আমি কী তোমাকে এই 'তুমি' সম্বোধন করার কথা আগে কখনো ভেবেছিলাম? না। এর থেকে বড় মিথ্যা আর কিছু হতে পারে না। আমি নিজের কাছেই নিজে চিরদিনের মতো বাধা পড়ে গেছি, আর এই হচ্ছি আমি। এভাবেই আমি বেঁচে থাকতে চাই।
[৬]
১৪ নভেম্বর, ১৯১২
প্রিয়তমা,
অনুগ্রহ করে তোমাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখার সুযোগ তুমি আমাকে দিও না। আমি শুধু বলতে চাই, শুভরাত্রি। আর এটুকু বলার জন্যে এই মাঝরাতে আমি একটা কাগজ টেনে নিয়ে তোমাকে লিখতে বসে গেছি। আমার ভয় হয়, খুব দ্রুতই হয়তো আমি তোমাকে লেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবো। কেননা, কাউকে কিছু লেখার জন্যে (আমি অবশ্য তোমাকে সমস্ত নামগুলিই জানাবো, আমি 'কাউকে' শব্দটা ব্যবহার করলাম) প্রত্যেকের সম্পর্কে কিছু-না-কিছু ধারণা থাকা উচিত। বিশেষ করে যাকে সে লিখছে তার চেহারা সম্পর্কে ধারণা থাকাটা জরুরি। তোমাকে লেখার সময় তোমার চেহারার পরিষ্কার একটা ছবি অবশ্য আমার চোখের সামনে থাকে। ফলে, অন্তত আমার ক্ষেত্রে তোমাকে লেখাটা সেই অর্থে কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু এর চাইতেও অনেক বেশি স্বচ্ছ একটা ছবি, তোমার, এখন আমার চোখে প্রায়ই ভেসে ওঠে। এই যেমন দেখ, তোমার কাঁধে আমি মাথা রেখে কথা বলছি। কেমন ধোঁয়াটে, অস্পষ্ট কিছু কথা। এমনভাবে বলছি যেন কথাগুলো আমি নিজেকেই বলছি। অথচ কি বলছি সে সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা তৈরি হচ্ছে না। তুমি কী ঘুমিয়ে পড়েছো, নাকি এখনও পড়াশুনা করছো, যে-কারণে তোমাকে বিরক্ত করা আমার ঠিক হবে না। নাকি তুমি এখন নাটকের মহড়া দিচ্ছ? আশা করছি তুমি এখন এসবের কোনো কিছুই করছো না। আমার ঘড়ি সবসময় ধীর গতিতে চলে। তবে কখনও পুরোপুরি থেমে যায় না। আমার ঘড়িতে এখন রাত্রি একটা বাজতে সাত মিনিট বাকি। মনে রেখ, অন্যদের তুলনায় তোমার একটু বেশি ঘুমানো প্রয়োজন। যেহেতু আমি ঘুমাই কম, অনেকের তুলনায় অবশ্য খুব কম নয়। আমি আমার এই না-ঘুমোনো সময়টুকু একমাত্র তোমার চোখে জমা রাখা ছাড়া আর কারুর কথা ভাবতেও পারছি না।
কোনো গভীর স্বপ্ন দেখো না, প্লিজ! মনে মনে আমি তোমার বিছানার চারপাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি সকলকে সাবধান করে দেবার জন্যে, এই চুপ, ও এখন ঘুমাচ্ছে!
তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে, এমনকি ইম্যানুয়েলকিচের পথে আজেবাজে বকে যাওয়া এক মাতালকে তাড়িয়ে আমি ফিরে আসছি। ফিরে আসছি নিজেকে আরও সুসংহত করে ফের আমার লেখায় ডুবে যাওয়ার জন্য। অথবা এও হতে পারে, ফিরে এসেই সোজা আমিও ঘুমিয়ে পড়বো।
আমি যে সময়টাতে তোমাকে এই চিঠিটা লিখছি, ঠিক তখনি তুমি কী করছিলে সেটা জানাতে ভুলো না। তাহলে আমার কল্পনাকে বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারবো। সম্ভব হলে, আমার কল্পনার সঙ্গে সামান্য মিলছে বা কিছুটা ধারে কাছেও যাচ্ছে এমন ঘটনার কথা জানিও। তাহলে একটা অবিশ্বাস্য পরিণতি সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা করা যাবে। বোঝা যাবে এই যে এটা-সেটা করছি, তার ফলাফল কী দাঁড়ায়। এরকম হলেই আসলে কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের মিল ঘটানো সম্ভবপর হয়ে উঠতে পারে, আর কল্পনা আর বাস্তবের মিল হলো কিনা, সে বিষয়েও আমরা নিশ্চিত হতে পারবো। এইমাত্র টাওয়ারের ঘড়িতে রাত্রি একটা বাজার ঘন্টাধ্বনি হলো। এটা প্রাহার সময়।
ফেলিস, তোমাকে ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করলাম। বিদায়! আচ্ছা, তোমার এই সুন্দর নামটা কে রেখেছিল? আমার জীবন থেকে তুমি হুট করে উড়ে পালিয়ে যাবে না তো? কেন জানি না, এরকম মনে হয়। যদিও 'ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করলাম' এই শব্দগুচ্ছের মধ্যে অনেক উঁচু আকাশে উড়ে চলে যাওয়ার একটা ব্যঞ্জনা আছে। আমার মনে হয় একটি মানুষ অসম্ভব তৃপ্তি পেতে পারে যদি সে অনেক উঁচু আকাশে ওড়ার সুযোগ পায়, আর তার সুতো যদি বাঁধা থাকে অন্য কারো হাতে। যেমন আমার সুতোটি ধরে আছো তুমি। এই যে তোমাকে উড়ে যাবার কথা বললাম, বললাম নিবৃত্তির কথা, এতে রাগ কোরো না, প্লিজ! তুমি ছাড়া আমি বাঁচবো না, আমার এই বিশ্বাস (নাকি প্রবঞ্চনা!) নিয়ে একটু গভীরভাবে ভেবে দেখো, প্লিজ। মনে রেখ, এতে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। তুমি যদি কোনোদিন আমার জীবন থেকে মুক্তি পেতে চাও, সেটাও থাকবে তোমার হাতে, কথা দিচ্ছি। কিন্তু তার আগে তুমি তো অসাধারণ একটা কিছু উপহার আমাকে দিয়ে যাবে, যা এ জীবনে আমি কখনও পাবো বলে ভাবিনি! সত্য কথাগুলোই বললাম আমি, সে তুমি তোমার ঘুমের মধ্য থেকে 'না' বলে মাথা নাড়ালেও।
ফ্রানত্স
[৭]
১৭ নভেম্বর ১৯১২
প্রিয়তমা, আমার প্রিয়তমা!
তোমার মতো স্বাস্থ্যবতী, উচ্ছল একটি মেয়েকে এভাবে অসুস্থ করে তোলার জন্য সত্যিই আমার দোজখে স্থান হওয়া উচিত! নিজের প্রতি যত্ন নিও। কী, শুনতে পাচ্ছ তুমি? বলছি, নিজের প্রতি যত্ন নিও। আমাকে অন্তত মুক্তি দেওয়ার জন্যে তুমি দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠো। উঃ, কী নিষ্ঠুরই না আমি। চিঠি না লেখার জন্য তোমাকে অযথা বকাঝকা করছি আর নিজের উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষার মধ্যে নিজেকে এত ডুবিয়ে রাখছি যে তুমি যে অসুস্থ, তাও খেয়াল করছি না। কোথায় আমি তোমার সেবা করবো, তা না যত্তো সব হাস্যকর সন্দেহের তীর ছুঁড়তে শুরু করেছি। বলি, তুমি পার্টিতে অথবা রিহার্সালে তো অনেক সময় নষ্ট করো, অথচ আমাকে চিঠি লেখা তোমার হয়ে ওঠে না। সত্যি বলতে কী, আমরা দুজনে যদি দুই মহাদেশে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকি আর তুমি যদি থাক এশিয়া মহাদেশের কোথাও, তাহলে হয়তো তার থেকে বেশি আর আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা যাবে না। তোমার প্রত্যেকটি চিঠিই, কত ছোট্ট সেটা, কোনো ব্যাপার নয়; আমার কাছে তা অনিঃশেষ, অফুরন্ত (ঈশ্বর সমস্ত কিছুই আমার জন্যে বকুনি খাওয়ার বিষয়বস্তু করে তোলেন। যেমন আজকের চিঠিটি আদৌ সংক্ষিপ্ত নয়, এটি ঠিক ১০,০০০ গুণ বড়, আমি যতটা পাওয়ার যোগ্য অন্তত তার থেকে বড়)। অবশেষে চিঠিটা আমি পড়ে শেষ করে ফেললাম, ফের প্রথম থেকে শুরু করলাম এবং এইভাবে অনিঃশেষ চক্রাকারে আমার পাঠ চলতে থাকলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে স্বীকার করতেই হবে, কোথাও না কোথাও পূর্ণছেদ নিশ্চয়ই আছে। এই যে তুমি ইতিমধ্যে উঠে পড়েছো, আমার পাশ থেকে সরে যাচ্ছ। কিন্তু আমার কথাতো আমাকে বলতে হবে, আমি ডুবে আছি এক ভয়াবহ অন্ধকারে। হতাশায় ডুবে যাওয়ার পক্ষে সেটাই যথেষ্ট!
তোমার চিঠি আজ এসে পৌঁছেছে। আজই ছিল চিঠিটা পৌঁছানোর শেষ দিন। তোমার মতো আমি ঠিক অতটা দৃঢ়চেতা নই। বার্লিনে যাওয়ার কথা আমি ভাবিনি। আমি শুধু এই সংকল্পটুকুই করেছিলাম যে, তোমার চিঠি না-আসা অব্দি আমি আমার এই বিছানা ছেড়ে কোত্থাও যাবো না। এই সংকল্পের জন্য বিশেষ কোনো ক্ষমতার দরকার হয় না, আসলে বিছানা ছেড়ে উঠতেই আমার ভালো লাগছিল না। এই ব্যাপারটাও আমাকে আঘাত করে, গতরাতে উপন্যাসের যে অংশটুকু আমি লিখেছি, তার মান বেশ নেমে গেছে এবং বোধহয় কাল আমি আমার ক্ষমতার নিম্নতমম সীমার মধ্যে বাধা ছিলাম। তবু এই রেজিস্টার্ড চিঠি যে আমাকে ভীষণ আনন্দ দিয়েছিল সেটা স্পষ্ট মনে আছে। তখন নিজের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম, আমি এত জঘন্য, তারপরও অনেক অনেক উঁচুতে কী সুখেই না বিচরণ করছি। গতরাতের আগের রাতে দ্বিতীয়বার তোমাকে স্বপ্নে দেখলাম। একজন পোস্টম্যান, তোমার দুটি রেজিস্টার্ড চিঠি নিয়ে এলো, চিঠি দুটি আমাকে দিল, একটি একটি করে দুই হাতে দুটি, আর তার বাহু দুটি নির্ভুলভাবে, নিখুঁতভাবে এগিয়ে এলো কোনও বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের পিস্টনের মতো ঝাঁকুনি দিতে থাকলো। হায় ঈশ্বর! ও ছিল আসলে যাদুর চিঠি! আমি পাতার পর পাতা উল্টে যেতে থাকলাম, তবু চিঠি দুটি আর শেষ হয় না। আমি দাঁড়িয়ে পড়ছিলাম, লম্বা টানা সিঁড়ির ঠিক মাঝখানে (রেলিং না ধরে), এতদূর অব্দি সিঁড়িতে উঠতে উঠতে যে পৃষ্ঠাগুলি পড়ে ফেলেছি সেগুলি ফেলে দিয়ে, খামদুটি থেকে আরও চিঠি বের করার চেষ্টা করছিলাম। পুরো সিঁড়িঘরটাই তখন ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত খোলা পাতার স্তূপে ভরে গেছে এবং সেই স্থিতিস্থাপক স্তূপের মর্মরধ্বনিতে ভরে উঠছে সমস্ত সিঁড়িঘর। এটা সত্যি সত্যিই ছিল আমার এক ইচ্ছাস্বপ্ন!
কিন্তু আজ সকালে পোস্টম্যানকে আকর্ষণ করার জন্য আমাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা পথ অবলম্বন করতে হলো। এখানকার পোস্টম্যানগুলো ভীষণ অনিয়মিত। তোমার চিঠি সকাল সোয়া এগারোটা অব্দি পৌঁছালো না। প্রায় দশবার হবে, আমি বিছানা থেকে বারবার লোক পাঠিয়ে খোঁজ নিয়েছি চিঠি এল কিনা! এলেই যাতে আমি বিছানা ছেড়ে উঠতে পারি, সেটাই ছিল আমার ইচ্ছা! অবশেষে ঘড়িতে যখন সোয়া এগারোটা বাজে তখন এসে পৌঁছালো তোমার চিঠি। আর আসামাত্রই সেটি খুলে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। তোমার অসুস্থতার খবরে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অবশ্য এতে আমার স্বভাবটাও বোঝা যাবে। যদি জানতাম তুমি সুস্থ তবু চিঠি লেখনি, তাহলে তো আমার মনটা আরও খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু এবার থেকে আমাদেও সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করা উচিত যাতে আমরা দুজন দুজনকে সুস্থ করে তুলতে পারি এবং ভবিষ্যতেও সুস্থ থাকতে পারি। আরও একবার, এই চিঠিতে আমি হয়তো কোনো কিছুরই উত্তর দিলাম না। কিন্তু উত্তর যে আমাকে সামনাসামনি দিতে হবে। চিঠিতে হবে না, কেননা লিখে খুব একটা ভালো ফল পাওয়া যায় না, স্বস্তির সামান্য পূর্বস্বাদ ছাড়া। যাই হোক, আজ আমি তোমাকে আবার চিঠি লিখবো, যদিও আমাকে এখন আমার অন্তর্গত অস্থিরতার কারণে বেশ কিছুক্ষণ ছুটোছুটি করতে হবে। কেননা ভীষণ অস্বস্তি ও দীনতার মধ্যে যখন বিছানায় পড়ে ছিলাম তখন আমার মাথায় একটা ছোট্ট গল্প আসে। আর সেটাই আমাকে আরো অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। গল্পটির চাহিদা এমনই যে তাকে এক্ষুনি লিখে ফেলতে হবে। না হলে স্বস্তি পাবো না।
তোমার ফ্রানত্স
[এই চিঠির মার্জিনে লেখা আছে]
উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। নিশ্চিত থেকো আমি তোমাকে টেলিফোন করবো না। তোমারও টেলিফোন করার দরকার নেই; কেননা, টেলিফোনের কথা আমি ঠিক শুনতে পাই না।
আমার এই অপবিত্র শব্দমালার, নিষ্পাপ ওই গোলাপের পথ অনুসরণের প্রচেষ্টাকে কি বলবো? কারুণ্য! নাকি দীনতায় ভরা! কিন্তু এও সম্ভব, বহির্বিশ্ব এত ক্ষুদ্র, এত সরলভাবে চলে এবং এতটাই অনিবার্য যে, কোনো মানুষের সমস্ত গুণ সম্পর্কে ধারণা করা মানুষের সাধ্যের বাইরে। কিন্তু একজন মানুষ সব সময়ই নিজেকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করে, তা যে কোনো মূল্যেই হোক না কেন। বিশেষ করে সে যখন অনুভব করে, অন্য কোনো একজনের ওপর সে নির্ভরশীল, ঘুরিয়ে বললে, ঠিক এখানেই কি ব্যাপারটা একেবারে অসম্ভব?
[৮]
[লেটারহেড : ওয়ারকার্স অ্যাকসিডেন্ট ইনসিওরেন্স ইনস্টিটিউট]
২১ নভেম্বর ১৯১২
প্রিয়তমা,
হায়রে বেচারী! কী, তাহলে তোমারও একজন মারাত্মক আর ভীষণ উচ্ছৃঙ্খল জবুথবু বেমানান অপটু অপ্রতিভ হতবুদ্ধিসম্পন্ন জটিল সমস্যায় ডুবে থাকা গুণগ্রাহী আছে? সে দুদিন তোমার চিঠি না পেলেই অন্ধের মতো, পাগলের মতো চারিদিকে আঘাত করতে শুরু করে। যদিও এসবই শুধু শব্দমাত্র, আর আঘাত করার সময় সে বুঝতেও পারে না আঘাতটা সে আসলে তোমাকেও করে। তবে, এর ঠিক পরপরই সে তার ভুলটা বুঝতে পারে এবং তখন তীব্র অনুতাপ ও অনুশোচনায় ভুগতে থাকে। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পার, তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলবার কারণে তাকেও অস্বস্তিতে পড়তে হয়। আর সেটা শুরু হয়ে যায় তোমার নরম ঠোঁট দুটির সামান্যতম বাঁক নেওয়ার ভঙ্গি কল্পনা করে। প্রিয়তমা, আজকের দুটি চিঠি দেখে মনে হচ্ছে অন্তত আরও কিছুদিন তুমি আমাকে সহ্য করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছ। প্লিজ, দয়া করে গতকালের চিঠির জন্যে তুমি তোমার মন পাল্টে ফেল না। যাই হোক, আজ সম্ভবত আমি তোমাকে টেলিগ্রাম করবো, ক্ষমা প্রার্থনা করে।
কিন্তু তোমাকে নিয়ে আমার অবস্থাটা একবার চিন্তা করে দেখ। আমার মারাত্মক অস্থিরতা, শুধু একটি ব্যাপারই মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। কেবল একটিই চিন্তা, অসম এলোমেলো ব্যাপার আমার অক্ষমতা। অফিসের জীবন আমার এমনই যেখানে সবসময় চোখদুটি পড়ে থাকে দরজার দিকে — কখন বেরুবো। আমার বিছানা, আমার অসহ্য কল্পভাবনা, ঘোরের মতো হাঁটা এবং রাস্তায় উদাসীন হয়ে হোঁচট খাওয়া; এসবের মাঝে আমার হূত্স্পন্দনও যেন খুঁজে পাওয়া যায় না। মনে হয় পেশিটুকুই শুধু ওঠানামা করছে, লেখালেখির পাঠও চুকেবুকে যাচ্ছে। এই দিকগুলো একবার ভেবে দেখ। প্লিজ রাগ করো না। আমাকে তোমার চিঠি না লেখার কারণটা অবশ্য আমার কাছে এখন পরিষ্কার। তবে শোনো, আমি সোমবার তোমার কেনো চিঠিই পাইনি। যে-চিঠির কথা তুমি বলছো সোমবার পাওয়া উচিত ছিল, সেটি নিশ্চয়ই তুমি পোস্ট করেছিলে শনিবার সন্ধ্যায়; এবং সেই চিঠি যে কোনোভাবে হোক খোয়া গেছে। আমি রোববার যে চিঠি পেয়েছি সেটা তোমার শনিবার সকালে পাঠানো। শনিবারের ওই চিঠিতে তুমি কী লিখেছিলে দয়া করে আর একবার জানাবে, যদি তোমার মনে থাকে। আর তাহলে আমার সোমবারের ভয়াবহ অস্বস্তির স্মৃতিটুকু অন্তত কিছুটা শমিত হয়ে আসবে। ভালো কথা, আমি সোমবার আদৌ কোনো চিঠি পাইনি। মঙ্গলবার একটি পেলাম, সেটাতে তারিখ রয়েছে রোববারের এবং জরুরি ডাকে যে চিঠিটি পেলাম সেটি তো প্রায় জোর করেই তোমার কাছ থেকে আমার আদায় করা। বুধবারও ফের সেই একই অবস্থা। কোনো চিঠি নাই। আর সেটাই আমার সহ্যের সীমাকে ভেঙে দিয়েছে। সুতরাং বুঝতেই পারছো গতকালের চিঠিটি আমি লিখেছিলাম এক অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে, যখন এক ভয়াবহ অনুভুতি আমাকে ছিঁড়ে প্রায় টুকরো করে ফেলছিল! একটু ভাবো তো ওই সময়ে আমার আর কী করার ছিল? মনে হচ্ছিল তুমি হয়তো স্বেচ্ছায় সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছো, আর সেটা মনে হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। তোমার মা আমাকে চিঠি লিখতে তোমাকে নিষেধ করেছেন। সেই মা, যিনি তোমার প্রথম চিঠি অনুযায়ী, আমার বেশ মনে আছে, তুমি বাইরে বেরুলেই সহমর্মী হয়ে ঝুলবারান্দা থেকে হাত নাড়িয়ে তোমাকে অভ্যর্তনা জানাতো। সকালের খাবার না খাওয়ার জন্যে তোমাকে স্নেহপরবশ হয়ে বকাবকি করতেন। অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে দেরি করলে টেলিফোন করে জানতে চাইতেন কখন তুমি ফিরবে, কেন তোমার এত দেরি হচ্ছে, ইত্যাদি। তিনিও কী তাহলে ক্রমশ বিরূপ হয়ে উঠছেন আর তোমাকে সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজ করার জন্য চাপ দিচ্ছেন? তোমার অফিসের কাজে সন্তুষ্ট হতে না পেরে অতিথি আপ্যায়নের ব্যাপারটাও তোমাকে দেখতে বলছেন? তোমার বলেছো, এসব করার কোনো প্রয়োজন নেই তাঁর। তিনি কী তাহলে এখন রাতে তুমি বিছানায় শুতে যাওয়ার আগে অন্যকিছু লিখতে বসলে তোমার ঘরে এসে শাপ-শাপান্ত করছেন? তোমার মৃত্যু কামনা করছেন? আসলে এসব কারণেই ওই সময়ে, যখন তোমার চিঠি আমার হাতে আসেনি, দুটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা আমার মাথায় এসেছিল। আমি এসব ভাবনাকে এড়িয়ে থাকতে পারিনি আর এই কারণেই ওই চিঠি। এখন বুঝতে পারছি আসলে দিনটা ছিল বার্লিনের ছুটির দিন। এটা আমি আমার ক্যালেন্ডারের দিকে একবার তাকালেই বুঝতে পারতাম। আর সে কারণেই মঙ্গলবারের চিঠিটি আজ বৃহস্পতিবারও এসে পৌঁছাল না। আমার এই ভ্রান্তি আবার একসঙ্গে করে তোমার সামনে তুলে ধরে আমি কী ক্ষমা পেতে পারি না? আমি কি একটি চুম্বনের বিনিময়ে মুছে ফেলতে পারি না সমস্ত হতাশা ও আজকের অস্বস্তিকে?
হ্যাঁ, স্ট্রিডবার্গের কথাগুলো আমি অবশ্যই পড়েছি। কিন্তু এটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না ওই ব্যাপারে তোমাকে লিখতে আমি কেন ভুলে গেলাম। এসবই ভয়াবহ সত্য এবং এত খোলাখুলিভাবে ব্যাপারগুলো বলে ফেলা হয়েছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। কিন্তু এমন কিছু সময় থাকে যখন একজন মানুষ বেশ বুঝতে পারে, এর চেয়েও আরো ভয়াবহ কিছু সত্য তাকে আলোড়িত করছ। এর অন্তর্নিহিত সত্যটা হলো একজন মানুষ যখন ভালোবাসে তখন সে এক নতুন আত্মসংরক্ষণের শক্তি অর্জন করে। কিছু কিছু ভাবনা-চিন্তাকে সে তখন এড়িয়ে যেতে চায়। কিছু শব্দ, কিছু কথা সে শুনতে চায় না। অন্য কিছু ব্যাপার, যা সে অনবধানবশত নিজেই গ্রহণ করেছে, সেগুলো তখন তার নিজেরই বিরক্তি কারণ হয়ে উঠতে পারে। যেমন হালকা ধরনের খাবারের অভ্যাস নতুন করে গড়ে তোলা অসম্ভব। এটা ঠিক, পান করার অভ্যাস থাকলে মদের বদলে ফলের রস খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু নতুন করে এই অভ্যাস গড়ে তুলতে পারে খুব কম লোকই।
আমি দিনে তিনবার খাই, এবং এই খাবারের মাঝে আর কিছুই খাই না। আক্ষরিক অর্থেই না। সকালে ভাপে সেদ্ধ করা ফল, বিস্কুট এবং দুধ। দুপুর আড়াইটায় আর সবার মতো সামান্য মাংস এবং বেশি পরিমাণে সব্জী। শীতকালে রাত সাড়ে নটায় ঘোল, সোডা বা লেমনেড, মাখন, সবরকমের বাদাম, আখরোট, খেজুর, ডুমুর, আঙুর, কাঠবাদাম, মনাক্কা, কিসমিস, পাকা কুমড়ো, কলা, আপেল, লেবু, নাসপাতি ইত্যাদি থাকে আমার খাবারের তালিকায়। এই যে ফল খাই তাও বেছে খাই, সব নয়, যদিও আমার সামনে থাকে এই ফলের অফুরন্ত সম্ভার। এছাড়া আর কোনো খাবার আমার শরীরে সয় না। অনুগ্রহ কওে তাই আমাকে আরও তিনবার খাওয়ার জন্যে অনুরোধ করো না। খেলে তোমার উপকার হবে, অর্থাত্ তোমার কথা রাখা হবে, কিন্তু তাতে আমার শরীরের বারোটা বাজবে।
তোমার চিঠি সম্পর্কে অত ভাবার কিছু নাই। একমাত্র এই সম্পদটিই আমার ঠিকমত গোছানো থাকে। চিঠিগুলো যেখানে রাখি তাতেও তালাচাবি দেওয়া থাকে। এছাড়া আমার ডেস্কে আর যা কিছু থাকে সেসব ভূতের মতো সারা ডেস্কময় এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। আমি যখন তোমার চিঠিগুলো বের করি, পড়ি বা নাড়াচাড়া করি — যা প্রায়ই ঘটে — কাজ হয়ে গেলে ফের যে জায়গায় ছিল সেখানেই সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখি। হায় ঈশ্বর, এখনও তোমাকে বলার মতো কত কথাই না রয়ে গেল! কত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো না। অথচ আমাকে তো চিঠিটা শেষ করতে হচ্ছে। তাছাড়া ঘড়িতে এখন দুপুর তিনটে বাজতে চলেছে। ও হ্যাঁ ভালো কথা, তুমি ভেবো না, কাল আবার লিখবো। আরেকটা কথা, তুমি আমাকে লেখা চিঠি শনিবার ডাকে দিলে রোববারেই আমি সেটা পেয়ে যেতে পারি। সেক্ষেত্রে রোববার সারা দিনটাই আমার স্বাভাবিকের চেয়ে আরও ভালো কাটতো আর কি।
ফ্রানত্স
[এই চিঠির একদম ওপরে মার্জিনে এই কথাগুলো লেখা ছিল]
মনে হচ্ছে আজ আর টেলিগ্রাম না পাঠানোই ভালো। শুধু শুধু কেন আর তোমাকে বিব্রত করা! চারটে চিঠি নিশ্চয়ই তুমি আজ পাচ্ছ। এর মধ্যে ভালো আর মন্দ ঠোকাঠুকি করে হয়তো একটি আরেকটিকে বাতিল করে দেবে। তুমি কী কৌতুকাভিনয় করেছিলে? ছবি তোলা আছে ওই অভিনয়ের? আমার ছবির কথা আজ নয়, আগামীকাল বলা যাবে।
[৯]
২৫ নভেম্বর ১৯১২
প্রিয়তমা,
উদ্বেগ্ন উত্কণ্ঠা যখন কাউকে গ্রাস করে তখন তাকে কী অস্বস্তিতেই না পড়তে হয়। এমন দিনও ছিল যখন তোমার চিঠির জন্যে আমি স্থৈর্য্য সহকারে অপেক্ষা করতাম। চিঠি এলে শান্তভাবে তা হাতে তুলে নিতাম। এরপর সেটা একবার পড়েও ফেলতাম। পড়ে পকেটে পুরে রাখতাম। কিছুক্ষণ পর আবার সেটা বের করে পড়তাম। আবার রেখে দিতাম। কিন্তু সমস্তটাই ঘটতো সহজ শান্তভাবে। আবার এমন কিছু দিন গেছে যখন তোমার চিঠির জন্যে অসহ্য উত্তেজনায় আমি কাঁপতে থাকতাম। প্রাণ ফিরে পাওয়ার মতো চিঠিটি আমার হাতে এসে পৌঁছালে সেটাকে কিছুতেই হাতছাড়া করতে পারতাম না। আজকের দিনটি ঠিক সেরকমই একটি দিন বলে মনে হচ্ছে।
প্রিয়তমা, তুমি কী লক্ষ্য করেছো, আমরা দুজনেই আমাদের চিঠিতে কী আশ্চর্যজনকভাবে একই মনের দুটি মানুষ হয়ে উঠেছি? একজনের মনে যখন একটি প্রশ্ন জাগছে, তার পরদিনই আমরা তার উত্তর পেয়ে যাচ্ছি। আবার ধরো, কোনোদিন হয়তো তুমি আমাকে বলতে চাইছো 'আমি তোমাকে ভালোবাসি'। দেখা গেল ঠিক সেইদিনই আমিও একই কথা তোমাকে বলছি। দুজনের এই আন্তরিক কথপোকথন সেইরাতে চিঠির আকারে মাঝপথে একে অপরকে অতিক্রম করে পরদিন আমাদের দুজনের হাতে এসে পৌঁছাচ্ছে। যে-কোনো কারণেই হোক, এটা অবশ্যম্ভাবী ছিল যে আমার প্রথম চিঠির প্রথম শব্দটি লেখা কিংবা তোমাকে আমার প্রথম চোখ তুলে দেখার ঘটনাটি একদিন না একদিন ঘটতোই। আমাদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার উদাহরণ এত বেশি যে সেটা আমি গুণেটুনে রাখতেও ভুলে গেছি। কিন্তু আজকের দিনটিকেই মনে হচ্ছে আমাদের পারস্পরিক অনুভবে সব চেয়ে ভালো দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে।
গতকালই আমি তোমাকে জানিয়েছিলাম আজ সন্ধ্যায় আমি বেরিয়ে যাবো। একা-একাই সারারাত পাহাড়ের দেশে। যদিও তুমি এখনও জানো না, এ যাত্রায় তোমার পাঠানো এই ছোট আকর্ষণীয় মেয়েটিই আমার সঙ্গী হয়ে থাকবে। কী প্রাণবন্ত এই মেয়েটি। সরু কাঁধ! এত নরম যে একে স্পর্শ করতেই ভালো লাগে। খুব সহজে ওকে ধরাও যাচ্ছে! সে বিনয়ী আর শান্তও। কেউ তাকে কখনো উগ্বেগে ফেলেনি বা উত্কণ্ঠায় রাখেনি অথবা তাকে কাঁদায়নি বলেই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তার হূত্স্পন্দনও ভীষণ ভীষণ স্বাভাবিক। জানো, ওর দিকে যতক্ষণ খুশি তাকিয়ে থাকা যায়। একটানা এই ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকলে আবেগে ভালোবাসায় যেকোনো মানুষই কেঁদে ফেলতে বাধ্য। তুমি কী সত্যিই চাও এটি তোমাকে কখনো ফেরত দিই? ঠিক আছে, তুমি চাইলে দেব। কিন্তু তার আগে আমার বুকের কাছে, ভেতরের পকেটে ও কিছুক্ষণ থাকুক। লুকিয়ে থাকুক। আমার সঙ্গে ঘুরেও আসুক। ট্রেনে বিভিন্ন হোটেলে। যদিও এই মেয়েটি বলতে চাইছে, হোটেলে সে থাকতে অস্বস্তি বোধ করবে। হ্যাঁ, ওর হাতের ছোট্ট ঘড়িটিও বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ঘড়ির চেনটি ভারি সুন্দর, চুলগুলো ঢেউ খেলানো এবং বেশ যত্ন করেই বাঁধা। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তোমাকে খুব সহজেই চেনা যায়। একটা মুহূর্ত আমার বেশ মনে পড়ছে, তোমাকে ঠিক এই ছবির মতোই, একই ভঙ্গীতে, টেবিলের ওপাশে বসে থাকতে দেখেছিলাম। তুমি থালিয়া ভ্রমণের ছবিগুলোর একটা ছবি হাতে তুলে নিয়ে দেখছিলে। ওই সময় আমি বোকার মতো তোমাকে কী যেন একটা কথা বলে ফেলি। শুনে তুমি আমার দিকে তাকালে এবং তাকিয়েই মুহূর্তের মধ্যে তোমার দৃষ্টিকে টেবিলের সিকি বৃত্ত জুড়ে একবার ঘুরিয়ে আনলে। শেষে তোমার দৃষ্টি গিয়ে নিবদ্ধ হলো ব্রডের ওপর। তিনিই তখন ছবিটার ব্যাখ্যা দিলেন। তোমার সেই ক্রম-পরিবর্তিত চেহারার দৃশ্য, ধীরে ধীরে মাথাটি ঘুরিয়ে নেওয়ার সময় যেমন দেখছিলাম, আমার মধ্যে একটা ধারণার জন্ম দেয়। এখন সেই ছোট্ট মেয়েটিই, যার কাছে বলা নিস্প্রয়োজন, আমি ভীষণভাবে অচেনা। এই মেয়েটিই এখন আমার মধ্যে সেই অপার আনন্দের স্মৃতি জাগিয়ে তুলছে।
আমাদের আরো একটি বিষয়ে যে কতটা মিল, একটা উদাহরণ দিচ্ছি। গতকাল আমি তোমাকে ছাপা হরফের কিছু লেখা পাঠাতে অনুরোধ করেছিলাম। অথচ আজই দেখছি তুমি নিজের থেকেই এরকম কিছু লেখা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছ। কিন্তু এই যে হূত্কম্পন, প্রিয়তমা! এই হূত্কম্পনের মাঝে কী করে বোঝা যাবে আমি তোমারই হূিপ্লের কোনো অংশ? এই হূত্স্পন্দন যদি এইভাবে দ্রুত স্পন্দিত হতে থাকে তখন কী হবে আমার? বিশেষ করে আমি যখন চাইছি শান্ত হয়ে যেতে?
তোমার ফ্রানত্স
[১০]
৬-৭ ডিসেম্বর ১৯১২
প্রিয়তমা,
এবার শোনো, আমার ছোট্ট গল্পটির লেখা শেষ হয়েছে। কিন্তু আজকের শেষাংশ আমাকে আদৌ তৃপ্তি দিতে পারেনি। সত্যি সত্যি এই গল্পটিকে যে আরও একটু ভালো করা যেত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। গল্পটি লিখে শেষ করার পরপরই তৃপ্তির সঙ্গে যে অতৃপ্তি আমার উপর ভর করলো, তাও অনিবার্য ছিল। এই অতৃপ্তিটুকু হলো আমার বেঁচে থাকার জন্যে তুমি যেহেতু এখনও একান্তভাবেই আমার, তখন অন্য কারুর আর তোমার অস্তিত্বের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকার যুক্তি খাড়া করা অত্যন্ত লজ্জাকর।
ওই ছবিটি, প্রিয়তমা, আমাকে তোমার সন্নিকটে নিয়ে এসেছে — আবার তোমার শ্বাসের কাছাকাছি। ছবিটি আমার মনে হয় বেশ পুরানো। (তুমি ছবিটির কোনও বিবরণ দাওনি। আমাকে হয়তো তুমি একটি ফাঁদের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছো। কিন্তু তৃপ্তি আর কৃতজ্ঞতার বোধ আমাকে দুঃসাহসী করে তুলেছে। আমি এখন আর ভীত নই।) আলোক সম্পাত, অবস্থান এবং ওই মুহূর্তে সকলের মেজাজ — সব মিলেমিশে ছবিটিতে সকলের চেহারাই বেশ রহস্যময় লাগছে এবং সেই রহস্যের চাবিকাঠি রয়ে গেছে সামনের টেবিলটিতে। বাক্সের ঠিক পাশেই পড়ে আছে সেটি। কিস্তু তাও ছবিটিকে সামগ্রিকভাবে স্পষ্ট করেনি। দেখতে পাচ্ছি, তোমার ঠোঁটে এক অদ্ভুত উদ্দেশ্যপূর্ণ হালকা হাসি লেগে আছে। হতে পারে এটা নেহাতই আমার কল্পনা যা আমাকে তোমার ঠোঁটের ওই হাসি আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছে। তোমার দিকে আমার খুব বেশি তাকিয়ে থাকা উচিত নয়, থাকলে শেষ অব্দি আমি হয়তো কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারবো না। তোমার পরনে রয়েছে সুন্দর একটা ব্লাউজ। বাঁ কব্জিতে হয় একটুকরো সুতো কিংবা একটা ব্রেসলেট। আমার ব্যক্তিগত মতামতর এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। এই মতামতের উর্ধ্বে উঠে বলা যায়, তুমি এই ছবির মধ্যমণি। অন্যান্য দর্শকের কাছেও তুমি তাই বিবেচিত হবে। শুধুমাত্র মাঝখানে বসে থাকার কারণে নয় বরং তোমার মা যে তোমার বাহুটি ধরে আছেন, সেই কারণেও বটে। অথবা বলা যায়, তোমার মা ঠিক যেমন সেরকমই তাঁকে দেখতে লাগছে। আর এটা তোমাকে এক বিশেষ ধরনের স্বীকৃতি দিচ্ছে। সর্বোপরি পরিবারের সকলেই ঠিক যেদিকে তাকিয়ে আছেন, তোমার দৃষ্টি আবার সেদিকে নেই। অন্যদের মধ্যে তোমার মাকেই আমার সব থেকে নিকটবর্তী বলে মনে হচ্ছে (তোমার মা এই ছবিতে না থাকলেও আমি এই একই কথা বলতাম)। তাঁর সম্পর্কে আমার ধারণা কিছুটা অনিশ্চিত। কেননা, সব থেকে উজ্জ্বল এবং বিচ্ছুরিত আলোকছটা সরাসরি তাঁর মুখম্ললের ওপর গিয়ে পড়েছে। উনি বেশ দীর্ঘদেহী এবং স্বাস্থ্যও ভালো, তাই না? আমার পিতার পরিবারে এরকম মহিলা খুব কমই আছেন। ওকে দেখে সহমর্মী এক মহিলা বলে মনে হচ্ছে। এই ছবি দেখে ওর সম্পর্কে আমার আগের ধারণা পাল্টে গেল। ওর সঙ্গে কথা বলতে আমার আর ভয় লাগবে না। কিন্তু তোমার বাবাকে দেখে বেশ মর্যাদাপূর্ণ এবং গম্ভীর প্রকৃতির পুরুষ বলেই মনে হচ্ছে। ওর সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে আমি খুব একটা নিশ্চিত নই। তিনি আসলে ঠিক কী কাজ করেন? আমি বিন্জ সৈকতাবাসের ছবিতে আগেই দেখেছি বলে এই ছবিতে উপস্থিত তোমার ভাইকে চিনে ফেললাম। ওর মধ্যে নতুন কিছু আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আমার মনে হয়, এই ছবির বাইরের দিকে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা সবাই তোমার বোন (অবশ্য আমার ধরে নেওয়াটা সহজ হয়ে যাচ্ছে যেহেতু তোমার ভাই এখনও বিয়ে করেনি); আর যে বয়স্কা মহিলাটি রয়েছেন তিনি নিশ্চয়ই বুদাপেস্টের মেয়ে এবং তোমার পাশের যুবকোচিত চেহারার ছেলেটি তোমার বুদাপেস্টের দুলাভাই। শুধুমাত্র এরাই হাসাহাসি করছেন। ফলে মনে হচ্ছে এরা একই পরিবারের মানুষ। আর উল্টো দিকের মেয়েটি নিশ্চয়ই তোমার ম্রিয়মান হয়ে থাকা বোন? বলা দরকার, আমি এটা বুঝতে পারছি ওর আত্মতৃপ্ত, নিদ্রালু হাসির রেখা দেখে (২০ বছরের একটি মেয়ে যদি স্থির করে ফেলে যে সে কিছুই পড়বে না, সেটা আমার কাছে কোনো বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু পড়তে গিয়ে অমনোযোগী হয়ে পড়াটা খুবই খারাপ)। তুমি আসলে কোন ঘরে বসবাস কর? এই ঘরটি কি তোমাদের এখনকার বসার ঘর? এটাই কি সেই টেবিল যে-টেবিলকে ঘিরে তুমি তোমার ভাই ও বাবার সঙ্গে তাস নিয়ে খেল? মনে পড়ে, একটি চিঠিতে তুমি এই খেলার কথাই তুমি জানিয়েছিলে আমাকে? আর ছবিটা কে তুলেছে? এটা কী তোমাদের পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠানে তোলা ছবি? দেখে মনে হচ্ছে তোমার বাবা ও ভাই গাঢ় রঙের স্যুট পরে আছেন, সঙ্গে সাদা টাই। কিন্তু তোমার দুলাভাইকে দেখছি বেশ চটকদার পোশাক পরেছেন। প্রিয়তমা, একটি ছবির সামনে একটি মানুষ কত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে পারে লক্ষ করেছো? অথচ বাস্তবে সে কতটা ক্ষমতাহীন? তোমার পরিবারের সমস্ত সদস্যের উপস্থিতিকে ছবিটাতে শূন্য করে দিয়ে আমি কিন্তু আমার কল্পনায় খুব সহজেই তোমাকে রেখে দিতে পারছি। আমি যদি এই ছবি থেকে তোমার চোখ দুটি খোঁজার চেষ্টা করে সফল হই, তাহলে মহা আনন্দে মৃত্যুকেও বরণ করে নিতে পারি। প্রিয়তমা, প্রত্যেকের ছবিই সুন্দর, প্রত্যেকের ছবিই দরকারি। কিন্তু সেই সঙ্গে এই ছবিগুলো মানসিক পীড়নের কারণ হতে পারে। এইমাত্র আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম, রাত সোয়া তিনটে বেজে গেছে। এত রাত হয়ে গেছে, সত্যিই খুব বাজে ব্যাপার। কিন্তু আমি যে মাঝরাতের আগে চিঠি লেখা শুরুই করতে পারিনি। শুভরাত্রি, প্রিয়তমা! তুমি যেন আমাকে ভালোবাসতে গিয়ে বিরতি দিয়ে না ফেল। পরের সপ্তাহে তুমি আমার ছোট্ট বইটি পেয়ে যাবে। আমি জানি না, এর প্রতিদান হিসেবে কটা চুমু তুমি আমাকে দেবে। অবশ্য এও এক স্বপ্নের আনন্দদায়ক বিষয়। প্রিয়তমা, আর নয়, এটাই আজকের শেষ শব্দ হোক। প্রিয়তমা।
তোমার ফ্রান্ত্স
ডাকবিভাগ কতটা দায়িত্ব পালন করে বোঝানোর জন্য উল্লেখ থাক : আজ শুধু তোমার দ্রুতগামী ডাকে পাঠানো চিঠিটিই আমার হাতে এসে পৌঁছেছে।
[১১]
১৪ এপ্রিল ১৯১৪
আমি নিশ্চিত এফ্, তোমার সঙ্গে বন্ধুতার কোনো পর্যায়ে কখনও কেনোদিন এতটা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে, প্রত্যয় জাগানো এমন কোনো ঘটনা আমার ক্ষেত্রে ঘটেনি। তখনও নয়, এখনও নয়। সন্দেহাতীতভাবে তো কখনোই নয়। আর তুমি? তোমার কী খবর? তোমারও কী আমার মতো একইরকম মনে হয়? এই চিঠির উত্তর দিয়েই না হয় আবার চিঠি লেখা শুরু কর। কি করবে?
আমার ওই দুদিনের অসম্ভব ক্লান্তি, বিহ্বলতা, অন্যমনস্কতা, অমনোযোগিতা এবং সম্ভবত উদাসীনতার জন্যেও প্লিজ এফ্ অশুভ কিছু তোমার মাথায় এনো না। এর অর্থ হলো, আমি আমার মধ্যে ছিলাম না। তবে কোনো-না-কোনোভাবে সম্ভবত তোমার না চাওয়া সত্ত্বেও, না মানা সত্ত্বেও, এমনকি তুমি এ ব্যাপারে সচেতন না থাকা সত্ত্বেও আমি তোমারই অংশ হয়ে পড়েছিলাম।
যাই হোক, আমি অবশ্য বলতে চাইছি না যে ওই দিনগুলো ভালো কেটেছে বা এর থেকে ভালো কাটার কোনও সম্ভাবনা ছিল। আমাদের প্রথম সন্ধ্যা কেটেছিল একসঙ্গে। অনেকটা বিক্ষিপ্তভাবে ওপরে ওপরে এবং আমার নিজের ভেতরেও, আমার অন্তত তাই-ই অনুমান, সংক্ষেপে বললে, খুব গভীরভাবে মিশতে পারিনি আমরা। আমি এটাই অনুমান করেছিলাম। আমি ঠিক করে রেখেছিলাম পরদিন সন্ধ্যায় তোমার বাবার সঙ্গেও কথা বলবো। আগের দিন তোমার সঙ্গে আমার যে আলোচনা হবে, বাস্তবে সেটা হয়েও ছিল, এর ওপর ভিত্তি করে কিন্তু তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলার ভাবনা আমার মাথায় আসেনি। আসেনি তোমার কথা মাথায় রাখার ভাবনাও। ফেলিস, তোমার ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। হ্যাঁ পূর্ণ আস্থা, এটা তোমার মেনে নেওয়া উচিত। এ ব্যাপারে তুমি নিঃসন্দেহ থাকতে পারো, অবশ্য যতটা তোমার পক্ষে সম্ভব। এটা ঠিক যে আমি তোমাকে অনেক প্রশ্ন করেছিলাম এবং হয়তো করেও যাব। হূদয়ের দাবি ছাড়া এর অন্য কোনও কারণ খোঁজা স্বভাবতই আমার কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ এবং তা আমার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। এটা যে আবার নির্ভুর কিছু তা-ও নয়। কেননা, যুক্তির গভীরতার নিচেই রয়ে গেছে আমার ভোগান্তির কষ্টের ঝর্ণার উত্সমুখ। (গ্রেতি ব্লকের যে টেলিগ্রামটি এইমাত্র হাতে পেলাম, তাতে ব্লক কী বোঝাতে চাইছে বলতে পারো? তিনি লিখেছেন, 'আন্তরিক ধন্যবাদ, উত্ফুল্ল, আনন্দিত গ্রেতি ব্লকের পক্ষ থেকে।')
যাই হোক, জঘন্য, অতি নোংরা এবং অত্যন্ত বাজে অধ্যায়টা হলো, রাস্তায় রাস্তায় কিছু সংক্ষিপ্ত মুহূর্ত ছাড়া আমরা কখনো একান্ত হবার সুযোগ পেলাম না। ফলে তোমার একটি প্রগাঢ় চুম্বন পাওয়ার মতো স্বস্তিকর অবস্থাতেও আমি আর পৌঁছাতে পারলাম না। তুমি আমাকে সুযোগ দিলেই পারতে, তবু তুমি তা করলে না, অথচ জোর করে নেবার মতো মানসিক অবস্থা থেকে আমিও ছিলাম যোজন যোজন দূরে।
প্রচলিত রীতি অনুসারে আমাদের বাগদান পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে যে ঐক্য ও সামঞ্জস্যবিধানের কথা বলা হয় সেসব কথা শুনলে আমার ভীষণ বিরক্তি লাগে। এটা রুচিহীনও বটে এবং ভীষণভাবে অপ্রয়োজনীয় একটা ব্যাপার। যাই হোক আজকাল বাগদানে আবদ্ধ হওয়া আমাদের জন্যে বা কোনও যুবক-যুবতীর জন্যে বিয়ের একটা ধাপ ছাড়া বিশেষ কিছু নয়। এই বাগদানও যথাযথভাবে সম্পন্ন হয় না। হলেও অনেক সময়ে উল্টো আমাদের নানা ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময় আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই এই কারণে যে আমরা দুজন এই মুহূর্তে একই শহরে বসবাস করছি না। কিন্তু অন্য সময়ে আবার এই ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে করে না এই কারণে যে, একই শহরে বসবাস করলে আমরা হয়তো অবধারিতভাবে অতি দ্রুত বিয়েটা সেরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু সে যাই হোক, প্লিজ চেষ্টা কর দ্রুত চলে আসার। সম্ভবত, তোমার মা, তোমার চিঠিতে আমার বাবা-মাকে দু-এক লাইন লিখতে পারেন। সেটা করলে অতি অবশ্যই তোমরা ভীষণ আন্তরিক ও প্রাণময় আমন্ত্রণ এদিক থেকেও পেতে পারো। তোমার বাগ্দানের কথা তুমি কী তোমার অফিসের কাউকে বলেছো? আর তোমার ডিরেক্টরের সঙ্গে কী তোমার ছুটির ব্যাপাওে কোনো কথা হয়েছে? ছুটির সম্ভাব্য তারিখের ব্যাপারে ওর সঙ্গে একমত হতে পেরেছো? ডাক্তারকে জানিয়েছো? নাটকের কাজ কী বন্ধ? আমার এইসব অনুরোধের ভেতর কোনো একটা যদি তোমার অনুমোদন পায় তাহলে সেটা হবে আমার এই অনুরোধ — বেশি পরিশ্রম করো না, রোজ পায়ে হেঁটে বেড়াতে বেরুবে, ব্যায়াম করবে, যা তোমার ইচ্ছে তাই করবে। তবে অফিসের বাইরে কোনো কাজ কখনও করো না। তোমার অবসর সময়ের কাজ আমি তোমাকে দেব। এর পারিশ্রমিকও তোমাকে দেব, যা তুমি চাইবে এবং যতবার তুমি চাইবে। এই রইলো আমার অনুমোদন ও স্বীকৃতির স্বাক্ষর।
ফ্রান্ত্স
[মার্জিনে লেখা : 'তোমার বাবা ও মা-র প্রতি রইল আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা।']
[১২]
মেরিয়েনবাদ, ২০ জুলাই ১৯১৬
[পোস্টকার্ড]
ফেলিস, এবার সত্যি সত্যিই তুমি হলে আমার ফ্রাউ এলস্তার [ম্যাগপাই জাতীয় ধরনের পাখি]। আমার সম্পূর্ণ একটা বিকেল তুমি পুরোপুরি চুরি করে নিলে। নিলে আবার সেই সময়টা যখন আমি মানসিকভাবে তোমার সঙ্গে কাটাই। আজ কিছুটা ঘুমিয়েছিও ভালো। ফলে অপেক্ষাকৃতভাবে এখন ভালই লাগছে। আরামবোধ করছি। যদিও দুপুরের খাবারের পর আর ঘুমাইনি। গতরাত থেকে এত গরম পড়ছে যে ঝুল-বারান্দায় বসা যাচ্ছিল না। যে রুমটাতে আছি, সেই রুমটা অবশ্য বেশ ভালো লাগতে শুরু করেছে। আজ এক নতুন দম্পতির সঙ্গে কিছু বাচ্চা ছেলে, আমার পাশের রুমে এসে উঠলো (এদের কিন্তু বেশ বয়স)। ছেলেগুলি বেশ কাজের আর প্রাণবন্ত। এ কারণেই হয়তো টানা গত পাঁচ মিনিট ধরে দেওয়ালের একটা পেরেকে বা অন্য কিছুতে হাতুড়ির বাড়ি ঠুকেই যাচ্ছিল। আমার নিদ্রাহীনতা আর মাথার যন্ত্রণার কথা বাদ দিয়ে বলতে পারি, আমার স্বাস্থ্য একটু ভালো হয়েছে। অবশ্য আমাদের ডিরেক্টরের মতে অতটা মোটা নাকি হইনি। শুধু আমার স্বাস্থ্যের গড়ন অনুপাতে সামান্য একটু মোটা হয়েছি, এই যা। আমার গতকালের মেনু ছিল সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে দুবার দুধ, মধু, দুবার মাখন, দুটি রোল খাওয়া; বেলা এগারোটায় আড়ইশো গ্রাম চেরি; দুপুর বারোটায় গরুর মাংস, শাক, আলু, পুরু পুডিং ও রোল; বিকেল তিনটায় এক কাপ দুধ, দুটি রোল, বিকেল পাঁচটায় চকোলেট, মাখন, দুটি রোল; সন্ধ্যে সাতটায় সবিজ, সালাড, পাউরুটি, চীজ: রাত্রি নটায় দুই পিস কেক, দুধ এই সব খাওয়া। ঠিক আছে তো?
ফ্রানত্স
[১৩]
৫ নভেম্বর ১৯১৬
[পোস্টকার্ড]
প্রিয়তমা,
গ্রামে ছুটি কাটাতে যাওয়ার আগে ফের এই ভোরে তোমাকে লিখতে বসলাম। গতকাল থেকে তোমার কোনো খবর নেই, এবং আমাকেও স্বীকার করতেই হচ্ছে যে আমিও তোমাকে লিখিনি। দিনকে দিন আমার যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে। যাই হোক, বুধবার কী বৃহস্পতিবার আমি তোমাকে একটি টেলিগ্রাম পাঠাচ্ছি। তাতে হয় 'আমরা যাচ্ছি' এই সুন্দর কথাটি লেখা থাকবে, নয়তো লেখা থাকবে 'না' — এই বাজে শব্দটি।
ফ্রানত্স
0 মন্তব্যসমূহ