অনুবাদ: শামসুজ্জামান হীরা
জ্যাক দ্য রাঁদাল, ঘরেই খাওয়া-দাওয়া সেরে তার গৃহপরিচারককে চলে যেতে বলে টেবিলে গিয়ে চিঠি লিখতে বসল।
এভাবেই সে বছরের সমাপ্তি টানে, লিখে এবং স্বপ্ন দেখে। জীবনের ঘটনাগুলোর মূল্যায়ন করে সে বিগত বছরের শুরু থেকে, যে বিষয়গুলো ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে: এবং যে আনুপাতিক গুরুত্ব নিয়ে তার বন্ধুদের চেহারা তার সম্মুখে হাজির হয়, জানুয়ারির প্রথম দিনেই নববর্ষের অভিনন্দন জানিয়ে সে তাদেরকে কয়েক ছত্র লেখে।
সুতরাং সে বসে পড়ল, ড্রয়ারটা খুলল, বার করল এক মহিলার ফটোগ্রাফ, কয়েক মুহূর্ত ওটার দিকে তাকিয়ে থাকল, চুমু খেল। তারপর ওটাকে এক টুকরো কাগজের ওপর বিছিয়ে রেখে সে শুরু করল:
“আমার প্রিয় ইরেনি: তুমি নিশ্চয়ই এরই মধ্যে আমার পাঠানো ক্ষুদ্র উপহারটি পেয়ে থাকবে, পরিচারিকাকে
তুমি যেভাবে বলেছিলে। আজ সন্ধ্যায় আমি সবকিছু থেকে নিবৃত রয়েছি তোমাকে এ-কথা বলতে যে...”
কলম এখানেই থেমে গেল। জ্যাক উঠে দাঁড়াল এবং এদিক-ওদিক পায়চারি করতে লাগল।
গত দশ মাস যাবত তার একজন প্রেমিকা রয়েছে। অন্য কারও মত নয়, যেমন নাট্যজগত বা অভিজাতসমাজের কোনও রমণী যার সঙ্গে কেউ গোপন কিছুতে লিপ্ত হয়। এমন একজন মহিলা যাকে সে ভালোবাসে এবং জয় করেছে। যদিও এখন তার সেই যৌবন আর নেই, তবে তুলনামূলকভাবে অনেকের চেয়েই সে এখনও যথেষ্ট যুবক। জীবনকে সে দেখে বাস্তব ও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে।
সে নিয়মমাফিক আবেগের ব্যালান্সশিট, মানে স্থিতিপত্র তৈরি করে সেইভাবে, যেভাবে সাংবৎসরিক হিসাব কষে ছেড়ে-যাওয়া বন্ধুদের এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে তার জীবনে নতুনভাবে আবির্ভূত ব্যক্তিদের।
তার প্রাথমিক প্রবল প্রেমানুভূতি কিছুটা থিতিয়ে এলেও, মহিলাটির সঙ্গে তার হৃদয়ের সম্পর্কটা কোন পর্যায়ে এবং ভবিষ্যতে এটা কী রূপ নিতে পারে, একজন ব্যবসায়ীর নির্ভুলতা নিয়ে হিসাব কষে ওটার ওপর একটা ধারণা সে গড়ে তোলে।
সে দেখল, মহিলাটির প্রতি তার প্রবল এবং গভীর মমত্ববোধ গড়ে উঠেছে করুণা, কৃতজ্ঞতা এবং হাজারও অস্পষ্ট অনুভূতির সমন্বয়ে, এবং তা জন্ম দিয়েছে দীর্ঘ ও শক্তিশালী এই সম্পর্কের।
দরজায় ঘণ্টা বেজে ওঠায় সে সচকিত হল; কিছুটা ইতস্তত করল। দরজা খুলবে কি? অতঃপর আপন মনেই বলল, নববর্ষের রাতে প্রত্যেকেরই দরজা খোলা উচিত। যেই হোক না কেন, কড়া নাড়লে অপরিচিত হলেও সাড়া দেওয়া উচিত।
সে মোমবাতিটা হাতে তুলে নিল, বৈঠকখানার মধ্য দিয়ে এগোল, ছিটকিনি খুলল, চাবি ঘোরাল, কপাট টানল এবং দেখল মৃত মানুষের মত ফ্যাকাশে চেহারা নিয়ে তার প্রেয়সী দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সে অবাক হয়ে তোতলাল:
“কী হয়েছে তোমার?”
মহিলা পাল্টা প্রশ্ন করল:
“তুমি কি একা?”
“হ্যাঁ।”
“চাকর-বাকর নেই?”
“উহুঁ।”
“তুমি বাইরে যাচ্ছ না?”
“না।”
মেয়েলি ঠাঁট নিয়ে সে তার চেনা ঘরটিতে প্রবেশ করল। ড্রয়িংরুমে ঢুকেই সে সোফাতে গা ডুবিয়ে দিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে করুণ সুরে কান্না শুরু করে দিল।
রাঁদাল তার পায়ের কাছে হাঁটুগেড়ে বসে মুখের ওপর থেকে তার হাত সরানোর চেষ্টা করল, যেন সে ওর চেহারা দেখতে পায়, এবং বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল:
“ইরেনি, ইরেনি, তোমার কী হয়েছে? আমি মিনতি করছি, বল, কী হয়েছে তোমার?”
তখন ফোঁপাতে ফোঁপাতে অনুচ্চ সুরে সে বলল:
“আমি এভাবে আর বাঁচতে পারব না।”
“এভাবে বাঁচতে পারবে না, কী বোঝাচ্ছ তুমি?”
“হ্যাঁ। আমি আর এভাবে বাঁচতে পারব না। অনেক সহ্য করেছি। আজ বিকেলে আমার গায়ে হাত তুলেছে সে।”
“কে? তোমার স্বামী?”
“হ্যাঁ, আমার স্বামী।”
“আহ্, বলো কী !”
সে রীতিমত আশ্চর্য, কখনও ভাবতেই পারেনি যে তার স্বামী এত নিষ্ঠুর হতে পারে। সে একজন সামাজিক ব্যক্তি, উঁচু শ্রেণির, আড্ডাবাজ, ঘোড়ার ভালো সমঝদার, নাট্যামোদী এবং একজন দক্ষ তলোয়ারচালক। সে অনেকের পরিচিত, তাকে নিয়ে সোচ্চার অনেকে, সর্বত্র প্রশংসিত, অতি ভদ্র ব্যবহার, যদিও খুব মাঝারি গোছের বুদ্ধিমত্তা, শিক্ষাদীক্ষার বালাই নেই, তবুও সদ্বংশীয় লোকেরা যেভাবে চিন্তা করে সেরকম সব প্রয়োজনীয় খাঁটি সংস্কৃতি, মোদ্দা কথায় চিরাচরিত প্রথার প্রতি আছে তার অটল শ্রদ্ধাবোধ।
একজন ধনী এবং সদ্বংশীয় লোকের যেমনটি মানায় তেমনই সে তার স্ত্রীর প্রতি অনুগত। স্ত্রীর ইচ্ছা, স্বাস্থ্য, পোশাক এবং এর বাইরেও অনেককিছু নিয়ে সে সবসময় চিন্তায় থাকে; তাকে দেয় পরিপূর্ণ স্বাধীনতা।
ইরেনির বন্ধু হওয়াতে প্রীতিভরে তার হাত ধরার অধিকার জ্যাক লাভ করে, যা প্রতিটি ভদ্রস্বভাবের স্বামী তার স্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনকে দিয়ে বাধিত হয়। তারপর, যখন জ্যাক বন্ধু থেকে প্রেমিকে পরিণত হল তখন ইরেনির স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক যথাযথ মাত্রায় অধিকতর আন্তরিক হয়ে উঠল।
জ্যাক স্বপ্নেও ভাবেনি যে, এই পরিবারের ওপর দিয়ে কখনও ঝড়ঝঞ্ঝা বইতে পারে, এবং সেকারণেই সে এই ঘটনা শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ল।
সে জিজ্ঞেস করল:
“ঘটনাটা ঘটল কীভাবে?”
ইরেনি তখন সব খুলে বলতে লাগল, বিয়ের পর থেকে বিস্তারিত কাহিনি, তাদের প্রথম মতবিরোধ, যা ঘটেছিল তেমন কোনও কারণ ছাড়াই, তারপর থেকে একের পর এক মতপার্থক্য দেখা দিয়ে চলে দু’জন ভিন্ন প্রকৃতির মানুষের মধ্যে।
তারপর শুরু হয় ঝগড়া, সম্পূর্ণ আলাদাভাবে বসবাস, কথার-কথা নয়, সত্যি সত্যিই। পরে তার স্বামী আক্রমণাত্মক ও সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। এখন সে ঈর্ষাকাতর, জ্যাককে নিয়ে ঈর্ষাকাতর হয়ে উঠেছে এবং ঠিক সেদিনের সেই ঘটনার পর সে তার গায়ে হাত তোলে।
সিদ্ধান্ত জানানোর ভঙ্গিতে সে যোগ করল:
“আমি আর তার কাছে ফিরে যাব না। আমাকে নিয়ে তুমি যা খুশি কর।”
হাঁটু গেড়ে জ্যাক তার মুখোমুখি বসল, তাদের একে অন্যের হাঁটুতে হাঁটু লেগে রইল। সে তার হাত চেপে ধরে বলল:
“ইরেনি, আমার প্রেম, তুমি একটা বিরাট এবং অসংশোধনযোগ্য বোকামি করতে যাচ্ছ। তুমি যদি তোমার স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদই চাও তাকে খারাপ অবস্থায় ফেল, যাতে ভালো মেয়ে হিসাবে তোমার অবস্থান অটুট থাকে।
জ্যাকের দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করল:
“তাহলে আমাকে তুমি কী পরামর্শ দিতে চাইছ?”
“ঘরে ফিরে যাও, যতদিন পর্যন্ত-না সম্মানজনকভাবে তুমি আলাদা থাকার বা বিচ্ছেদের লড়াইয়ে জিতছ, ততদিন ঘরে থাক।”
“তুমি কী আমাকে এমন কাজ করতে বলছ না, যা কিছুটা ভীরুতার শামিল?”
“না; এটা সঠিক এবং যুক্তিযুক্ত। সমাজে তোমার আছে উঁচু অবস্থান, সুনাম, এসব তোমাকে রক্ষা করতে হবে, রক্ষা করতে হবে বন্ধুদের এবং অক্ষুণ্ন রাখতে হবে সব সম্পর্ক। খামখেয়ালির বশবর্তী হয়ে তুমি এগুলো খোয়াতে পার না।”
সে উঠে দাঁড়াল এবং ঝাঁজ মেশানো সুরে বলল:
“না, আমি এ-অত্যাচার আর সহ্য করতে পারব না! এটা শেষ প্রান্তে এসে ঠেকেছে! একেবারে শেষ প্রান্তে!”
তারপর তার প্রেমিকের কাঁধের ওপর দু’হাত রেখে, এবং সরাসরি তার মুখের দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করল:
“তুমি কি আমাকে ভালোবাস?”
“হ্যাঁ।”
“সত্যিসত্যি এবং আন্তরিকভাবে?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে আমার দায়িত্ব নাও।”
সে চেঁচিয়ে উঠল:
“তোমার দায়িত্ব? আমার বাড়িতে? এখানে? তুমি কেন পাগলামি করছ। এর অর্থ দাঁড়াবে তোমাকে চিরতরে হারানো; তোমাকে ফিরে পাওয়ার সব আশা দূর হয়ে যাওয়া! তুমি পাগল হলে!”
সে জবাব দিল ধীরে এবং গুরুত্ব সহকারে, এমন একজন মহিলার মত যে জানে তার কথার গুরুত্ব:
“শোনো জ্যাক, সে আমাকে তোমার সাথে দেখা করতে নিষেধ করেছে, আর আমি তোমার ঘরে গোপনে আসা-যাওয়া করার এই রঙ্গ চালিয়ে যেতে চাই না। তুমি হয় আমাকে গ্রহণ কর, না-হয় চিরতরে হারাও।”
“আমার প্রিয় ইরেনি, সেক্ষেত্রে তুমি তালাক নাও, আমি তোমাকে বিয়ে করব।”
“হ্যাঁ, তুমি আমাকে বিয়ে করবে — খুব তাড়াতাড়ি হলেও দুবছর পর। তোমার প্রেম খুবই ধৈর্যশীল!”
“দ্যাখো! চিন্তা কর! তুমি এখানে থাকলে সে কালই তোমাকে নিতে এখানে চলে আসবে। সে তোমার স্বামী, তার অধিকার আছে এবং আইন তার পক্ষে।”
“আমি তোমার ঘরে আমাকে রাখতে বলিনি জ্যাক, বলেছি তোমার পছন্দমত যেকোনও জায়গায় আমাকে নিয়ে যেতে। আমি মনে করেছিলাম, তুমি আমাকে যথেষ্ট ভালোবাস তাই তেমন কিছু করবে। আমি ভুল করেছি। চলি, শুভ বিদায়!”
সে ঘুরে দাঁড়ালো এবং দরজার দিকে এত দ্রুত ছুটে গেল যে, জ্যাক কোনওক্রমে ঘরের বাইরে গিয়ে তাকে ধরে ফিরিয়ে নিয়ে এল।
“শোনো ইরেনি।”
সে নিজের সঙ্গে লড়ছিল, ওর কথায় কান দিচ্ছিল না। তার দু’চোখ জলে ভরে উঠল এবং সে তোতলাতে লাগল:
“আমাকে একা থাকতে দাও! আমাকে একা থাকতে দাও! একা থাকতে দাও আমাকে!”
জ্যাক তাকে জোর করে বসাল, এবং আরেকবার তার পায়ের কাছে হাঁটুগেড়ে বসে আউড়ে চলল এন্তার যুক্তি। তাকে বোঝাতে চেষ্টা করল তার পরিকল্পনার ভ্রান্তি এবং ভয়ঙ্কর ঝুঁকি সম্পর্কে। তার উত্তেজিত দৃঢ় মতের প্রতি নিজের যথেষ্ট অনুরাগ টের পেলেও তাকে বোঝানোর জন্য তার জানামত প্রয়োজনীয় এমন কোনও কিছুই সে বাদ রাখল না।
সে নিশ্চুপ এবং শীতল ছিল বরফের মত। জ্যাক তার কছে অনুনয় করল, আবেদন জানাল তার কথা শুনবার জন্য, তাকে বিশ্বাস করবার জন্য এবং তার উপদেশ মানবার জন্য।
তার কথা শেষ হওয়ার পর সে শুধুমাত্র প্রত্যুত্তর করল:
“তুমি কি চাও আমি চলে যাই? তোমার হাত সরাও, আমাকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে দাও।”
“দ্যাখো, ইরেনি।”
“আমাকে যেতে দেবে?”
“তোমার সিদ্ধান্ত কি অপরিবর্তনীয়, ইরেনি?”
“তুমি কি আমাকে যেতে দেবে?”
“আমাকে শুধু বল, এই সিদ্ধান্ত, উদ্ভট এই সিদ্ধান্ত, যার জন্য তোমাকে খুব পস্তাতে হবে, একেবারেই অপরিবর্তনীয়?”
“হ্যাঁ — আমাকে যেতে দাও!”
“তাহলে থাকো। ভালোভাবেই জানো যে এখানে থাকতে তোমার কোনও অসুবিধা হবে না। কাল সকালেই আমরা অন্য কোথাও চলে যাব।”
সে কারও সাহায্য ছাড়াই নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াল এবং কড়া সুরে বলল:
“না, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি কারও ত্যাগ চাই না; চাই না আনুগত্য।”
“দাঁড়াও! আমার যা করা উচিত ছিল তাই করেছি; তাই বলেছি যা বলা উচিত ভেবেছি, তোমার ব্যাপারে এ-ছাড়া আমার আর কোনও দায়িত্ব ছিল না। আমার বিবেক এখন শান্তি পাচ্ছে। এখন বল আমাকে কী করতে হবে, যা বলবে আমি তাই করব।”
সে পুনরায় বসল, তার দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ, এবং তারপর অত্যন্ত শান্ত স্বরে বলল:
“ঠিক আছে, তাহলে খুলে বল।”
“কী খুলে বলব? বল, আমার কাছ থেকে কী জানতে চাও?”
“সবকিছু — সবকিছু, তোমার মন পরিবর্তনের আগে যা-কিছু ভাবছিলে। তখন আমি ভাবব আমার কী করা উচিত।”
“কিন্তু আসলে আমি কিছু নিয়েই ভাবছিলাম না। আমি তোমাকে শুধু সতর্ক করে দিচ্ছিলাম, তুমি একটি নির্বুদ্ধিতার কাজ করতে যাচ্ছ। কিন্তু যখন দেখলাম তুমি নিজ সিদ্ধান্তে অনড়; তখন আমি তোমার এই জেদের ভাগিদার হওয়ার কথা ভাবলাম; বলতে কী, আমি দৃঢ়ভাবেই তোমার মতের পক্ষে অবস্থান নিলাম।”
“অত তাড়াতাড়ি কারও মন বদলানো স্বাভাবিক নয়।”
“শোনো, আমার সোনামণি, এটা ত্যাগ বা আনুগত্যের ব্যাপার নয়। যেদিন, যখন আমি বুঝলাম যে তোমাকে আমি ভালোবাসি, আমি নিজেকে তাই বললাম যা এরকম ক্ষেত্রে প্রতিটি প্রেমিকের নিজেকে বলা উচিত: ‘যে লোক কোনও মেয়েকে ভালোবাসে, চেষ্টা করে তাকে জয় করবার, যে তাকে পায়, যে তাকে গ্রহণ করে, সে নিজের এবং সেই নারীর সঙ্গে একটি পবিত্র চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এটা অবশ্যই তোমার মত নারীর সঙ্গে, তেমন নারীর সঙ্গে নয় যারা অস্থিরমনা এবং সহজেই মুগ্ধ হয়।’
“বিয়ের আছে বিশাল সামাজিক মূল্য, বিরাট আইনি মূল্য, যদিও আমার চোখে সেটার সামান্যই নৈতিক মূল্য আছে, যেভাবে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে তা বিবেচনায় নিলে।
“সুতরাং, যখন একজন নারী স্বামীর সাথে এই আইনের দ্বারা যুক্ত হয় কিন্তু স্বামীর সঙ্গে থাকে না কোনও মানসিক বন্ধন, যাকে সে পারে না ভালোবাসতে; সেক্ষেত্রে একজন নারী যার হৃদয় মুক্ত, এমন কোনও পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে যাকে সে পছন্দ করে, এবং নিজেকে সমর্পণ করে তার কাছে, যখন একজন পুরুষেরও অন্য কোনও বন্ধন নেই, একজন নারীকে এভাবে গ্রহণ করে। আমি বলি, তারা একে অন্যেতে স্বাধীন এক অঙ্গীকারে আবদ্ধ থাকে, যা কিনা ‘মেয়র’-এর সম্মুখে ‘হ্যাঁ’ উচ্চারণ করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
“আমি বলি, যদি তারা উভয়েই সম্মানীত ব্যক্তি হয়, বিবাহ সংক্রান্ত সব পূন্যকর্ম সম্পাদন করার চেয়েও তাদের বন্ধন অবশ্যই অনেক বেশি আন্তরিক, বাস্তব, সর্বাত্মক।
“এই নারী সবকিছুতে ঝুঁকি নেয়। প্রেমের কারণে সে সবকিছুই উজাড় করে দেয়, তার হৃদয়, তার দেহ, তার আত্মা, তার সম্ভ্রম, এমনকি তার জীবন পর্যন্ত — সে সাহস পায় বেপরোয়াভাবে এবং নিঃসংকোচে কাজ করতে, এমনকি ভবিষ্যতের সমস্ত দুর্দশা, বিপদ, মহাদুর্যোগ দেখতে পেয়েও সে যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রস্তুত থাকে — এমনকি তার স্বামীর হাতে খুন, কিংবা সমাজচ্যুত হতেও সে পরোয়া করে না। এই জন্যই সে ভালোবাসা এবং সম্মান পাওয়ার যোগ্য, তার বৈবাহিক জীবনের অসততার মধ্যেও, এ-কারণেই তার প্রেমিকেরও তাকে গ্রহণ করা উচিত সবকিছু আগে থেকে ভেবেই, এবং পরিণামে যা কিছুই ঘটুক না কেন তাকেই সবার চেয়ে বেশি পছন্দ করা উচিত। আর কিছুই বলার নেই আমার। একজন সচেতন ব্যক্তি হিসাবে আমার দায়িত্ব ছিল তোমাকে সাবধান করা, শুরুতেই বলেছি; এবং এখনও বলছি আমি নেহাত একজন ব্যক্তি, যে কেবল তোমাকে ভালোবাসে — আদেশ কর, আর আমি তা পালন করি।”
আনন্দে অভিভূত ইরেনি গভীর চুম্বনে তার মুখ বন্ধ করে দিল এবং নিচু স্বরে বলল:
“যা-কিছু বলেছি, তা একটুও সত্যি নয়, প্রিয়! এধরনের কিছুই ঘটেনি! আমার স্বামী কিছুই সন্দেহ করেনি। কিন্তু আমি দেখতে চেয়েছিলাম, আমি জানতে চেয়েছিলাম, আমি চাইলে তুমি নববর্ষের উপহার হিসাবে আমাকে কী দিতে পার — যে নেকলেসটি উপহার হিসাবে পাঠিয়েছ তারচেয়েও বেশি কিছু, তোমার হৃদয়। হ্যাঁ, তুমি ওটা আমাকে দিয়েছ। ধন্যবাদ! ধন্যবাদ তোমাকে! আমাকে যে সুখ তুমি দিয়েছ সেজন্য ঈশ্বরকেও ধন্যবাদ!”
অনুবাদক
শামসুজ্জামান হীরা
0 মন্তব্যসমূহ