মূলঃ ইউজেনিয়া ভিতেরি
অনুবাদঃ ফজল হাসান
কক্ষের অন্য প্রান্তে শিশু পাবলো শুয়ে আছে । একদিকে প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত তার ফোলা চোখ দু’টো জ্বালাপোড়া থেকে নিস্কৃতি চায় এবং অন্যদিকে তার শুকনো ঠোঁট ফিসফিসিয়ে ডাকে, ‘মা, এখানে আসো মা, মাআআআআআ ... !’
মা তার শিশু পুত্রের কাছ থেকে অনেক দূরে । কিন্তু নাড়ীর টানে মা পুত্রের সঙ্গে অলৌকিক ভাবে যোগাযোগ রাখতে পারছে, এমনকি নিজের রক্ত-মাংসে গড়া ছেলের যন্ত্রণা অনুভব করতে পারছে, যে যন্ত্রণা শিশু পাবলোর কচি দেহটাকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে ।
ছেলের দুশ্চিন্তায় মা সারারাত একটুও ঘুমোতে পারেনি ।
পরদিন সকালে মহিলা গভীর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়ায় ।
‘এদুয়ার্দো, ছেলেকে দেখতে চাই । আমি আজই যাবো ।’
‘চুপ কর, গাধা, তুই যাবি না । কোনো চিন্তা করিস না । দেখিস, তুই ভালো হয়ে যাবি । নাকি তোরা দু’জনে এক সঙ্গে মরতে চাস ? ওকে এক নজর দেখে কি হবে ? তুই শুধু ছেলেকে রোগজীবানু দিবি ।’
চোখেমুখে দীপ্ত, অথচ নীরব, প্রতিবাদের চিহ্ন ফুটিয়ে মহিলা হাত কচলাতে থাকে । সে জানে, স্বামী তাকে কড়া শাসনে রাখে ।
এবার রাগে-ক্ষোভে মহিলা ঠোঁট কামড়ায় এবং গলার ভেতর যন্ত্রণা আটকে রাখে, যা চাপা গোঙানির মতো শোনায় ।
কিন্তু সেই গোঙানি মাত্র এক সেকেন্ড আটকে থাকে ।
মহিলা অগ্নিমূর্তি ধারন করে আচমকা উঠে দাঁড়ায় এবং তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা স্থির, অটল । হঠাৎ সেই মুহূর্তে তার মস্তিস্কের অন্দরমহলে কোথা থেকে উড়ে এসে এক ঝটকা উত্তেজনার গরম হাওয়া ঢুকে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে সে মূর্ছা যায় । এবারও সে পরাজয় বরণ করে ।
ছেলের জন্য মহিলা মানসিক কষ্টে ভুগছে । তার অবুঝ মন বলছে, ছেলেটি অসুস্থতার চেয়েও একাকীত্ব এবং অবহেলার জন্য কাঁদছে ।
সময় গড়িয়ে যায় । শিশুটি সন্নাসিনীদের তত্ত্বাবধানে আছে ।
অনেক কষ্ট করে কাশি দিয়ে শিশুটি ছোট্ট শরীরের সমস্ত শক্তি উজাড় করে ডাকে, ‘মা, মা, তুমি এক্ষুণি আসো ।’
সঙ্গে সঙ্গে শক্ত মেঝের ওপর পায়ের আওয়াজ শোনা যায় । সন্নাসিনীরা সবাই যখন শিশুটির বিছানার পাশে এসে দাঁড়ায়, তখন ভীড়ের মাঝ থেকে একটা মিষ্টি কন্ঠস্বর শিশুটির অস্থির মনের মাঝে শান্তির বারতা নিয়ে আসে ।
‘এই যে আমি এখানে । আমার সোনা মানিক, লক্ষী বাবা ।’
‘মা, কাছে আসো, আরো কাছে । তোমাকে স্পষ্ট দেখতে পারছি না । তোমার মুখটা আমাকে স্পর্শ করতে দাও ... হ্যাঁ, ঠিক এভাবে ... আমি শুধু তোমার হাত ধরে রাখতে চাই । মা, তুমি কাঁদছো ? কিন্তু কেন ? আমি যদি চলে গিয়ে আকাশের তারা হয়ে অপেক্ষা করি ... ।’
‘চুপ করো, চুপ করো আমার সোনা মানিক ।’
‘মা, তুমি কি আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু দেবে, অনেক বড় চুমু ?’
‘বাবা, আমার লক্ষী সোনা !’
শিশুটি পুনরায় ভীষণ জোরে কাশতে শুরু করে এবং সে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে ।
‘মা, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না । আমাকে শ্বাস নিতে দাও । চারদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে । আমাকে একটু আলো দাও ... ।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই শিশুটি শান্ত হয়ে যায় । নেতিয়ে পড়া তার ছোট্ট হাত দু’টো সন্নাসিনীর গলা জড়িয়ে ধরে, যাকে সে মা বলে বিশ্বাস করে মেনে নিয়েছিল ।
এভাবেই শিশু পাবলো পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যায় অচেনা ভুবনে ।
সন্নাসিনীর চোখেমুখে এক ধরনের তৃপ্তির ছবি ফুটে ওঠে । সেসময় শিশুটির জন্য তার কোমল মনের স্নিগ্ধ সরোবরে প্রশান্তির নির্মল ঢেউ বয়ে যায় ।
শিশুটি কখনই জানবে না যে, সন্নাসিনী বন্ধ্যা । তারপরেও সন্নাসিনীর মনে হয় সে অলৌকিক শিশুটিকে ধোকা দিয়েছে এবং নিজেকে পরিপক্ক ও উর্বরা ভাবছে ।
আজ থেকে আমি ওর মা । মা, হোক না মৃত সন্তানের ।
লেখক পরিচিতিঃ
ইকুয়েডোরের স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক ইউজেনিয়া ভিতেরি । তার পুরো নাম ইউজেনিয়া ভিতেরি ব্লাঙ্কা সেগুরা । তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, গল্পকার এবং অধ্যাপক । তার জন্ম উপকূলীয় গায়াকিল শহরে, ১৯২৮ সালের ১৪ এপ্রিল। তিনি ছিলেন বিধবা মায়ের ছয় সন্তানের একজন । মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি গল্প লেখা শুরু করেন । প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘রিং এন্ড আদার স্টোরিজ’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে । তার অন্যান্য গল্প সংকলনের মধ্যে রয়েছে ‘টুয়েলভ্ স্টোরিজ’ (১৯৬২), ‘শুজ এন্ড ড্রীমস্’ (১৯৭৭) এবং ‘সিলেক্টেড স্টোরিজ’(১৯৮৩) । ‘ওনলি নাইনটি মাইলস্’ তার প্রথম উপন্যাস, যা ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় । ‘ব্ল্যাক অ্যালকোভস্’ (১৯৮৩) তার অন্য উপন্যাস । লেখালেখির স্বীকৃতি হিসাবে তিনি একাধিক সাহিত্য পুরস্কার অর্জণ করেন । ব্যক্তিগত জীবনে তিনি মার্ক্স মতবাদে বিশ্বাসী । ১৯৬৩ সালে স্বৈরাচারী সরকারের অত্যাচার থেকে নিস্কৃতি লাভের আশায় চিলিতে নির্বাসিত হন । সেখানে চিলির লেখক পেড্রো জর্জে ভেরাকে বিয়ে করেন । পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে সামরিক শাসনের পতন হলে তিনি সপরিবারে স্বদেশে ফিরে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস করেন ।
গল্পসূত্রঃ ‘মাতৃত্ব’ গল্পটি ইউজেনিয়া ভিতেরির ইংরেজিতে অনূদিত ‘মাদারহুড’ গল্পের অনুবাদ । স্পেনীশ ভাষা থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন এল এস থমাস । গল্পটি ‘এ টেইষ্ট অফ ইকুয়েডরঃ দ্য কালেক্টেড স্টোরিজ অফ ইউজেনিয়া ভিতেরি’ গল্প সংকলনে প্রকাশিত হয় ।
এই গল্পটিতে লেখিকা একজন বন্ধ্যা নারীর মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণের জন্য যারপরনাই আকুলতা অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং মর্মস্পর্শী ভাষায় তুলে ধরেছেন ।
অনুবাদক পরিচিতি
ফজল হাসান
গল্পকার, ছড়াকার। অনুবাদক।
অনুবাদঃ ফজল হাসান
কক্ষের অন্য প্রান্তে শিশু পাবলো শুয়ে আছে । একদিকে প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত তার ফোলা চোখ দু’টো জ্বালাপোড়া থেকে নিস্কৃতি চায় এবং অন্যদিকে তার শুকনো ঠোঁট ফিসফিসিয়ে ডাকে, ‘মা, এখানে আসো মা, মাআআআআআ ... !’
মা তার শিশু পুত্রের কাছ থেকে অনেক দূরে । কিন্তু নাড়ীর টানে মা পুত্রের সঙ্গে অলৌকিক ভাবে যোগাযোগ রাখতে পারছে, এমনকি নিজের রক্ত-মাংসে গড়া ছেলের যন্ত্রণা অনুভব করতে পারছে, যে যন্ত্রণা শিশু পাবলোর কচি দেহটাকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে ।
ছেলের দুশ্চিন্তায় মা সারারাত একটুও ঘুমোতে পারেনি ।
পরদিন সকালে মহিলা গভীর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়ায় ।
‘এদুয়ার্দো, ছেলেকে দেখতে চাই । আমি আজই যাবো ।’
‘চুপ কর, গাধা, তুই যাবি না । কোনো চিন্তা করিস না । দেখিস, তুই ভালো হয়ে যাবি । নাকি তোরা দু’জনে এক সঙ্গে মরতে চাস ? ওকে এক নজর দেখে কি হবে ? তুই শুধু ছেলেকে রোগজীবানু দিবি ।’
চোখেমুখে দীপ্ত, অথচ নীরব, প্রতিবাদের চিহ্ন ফুটিয়ে মহিলা হাত কচলাতে থাকে । সে জানে, স্বামী তাকে কড়া শাসনে রাখে ।
এবার রাগে-ক্ষোভে মহিলা ঠোঁট কামড়ায় এবং গলার ভেতর যন্ত্রণা আটকে রাখে, যা চাপা গোঙানির মতো শোনায় ।
কিন্তু সেই গোঙানি মাত্র এক সেকেন্ড আটকে থাকে ।
মহিলা অগ্নিমূর্তি ধারন করে আচমকা উঠে দাঁড়ায় এবং তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা স্থির, অটল । হঠাৎ সেই মুহূর্তে তার মস্তিস্কের অন্দরমহলে কোথা থেকে উড়ে এসে এক ঝটকা উত্তেজনার গরম হাওয়া ঢুকে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে সে মূর্ছা যায় । এবারও সে পরাজয় বরণ করে ।
ছেলের জন্য মহিলা মানসিক কষ্টে ভুগছে । তার অবুঝ মন বলছে, ছেলেটি অসুস্থতার চেয়েও একাকীত্ব এবং অবহেলার জন্য কাঁদছে ।
সময় গড়িয়ে যায় । শিশুটি সন্নাসিনীদের তত্ত্বাবধানে আছে ।
অনেক কষ্ট করে কাশি দিয়ে শিশুটি ছোট্ট শরীরের সমস্ত শক্তি উজাড় করে ডাকে, ‘মা, মা, তুমি এক্ষুণি আসো ।’
সঙ্গে সঙ্গে শক্ত মেঝের ওপর পায়ের আওয়াজ শোনা যায় । সন্নাসিনীরা সবাই যখন শিশুটির বিছানার পাশে এসে দাঁড়ায়, তখন ভীড়ের মাঝ থেকে একটা মিষ্টি কন্ঠস্বর শিশুটির অস্থির মনের মাঝে শান্তির বারতা নিয়ে আসে ।
‘এই যে আমি এখানে । আমার সোনা মানিক, লক্ষী বাবা ।’
‘মা, কাছে আসো, আরো কাছে । তোমাকে স্পষ্ট দেখতে পারছি না । তোমার মুখটা আমাকে স্পর্শ করতে দাও ... হ্যাঁ, ঠিক এভাবে ... আমি শুধু তোমার হাত ধরে রাখতে চাই । মা, তুমি কাঁদছো ? কিন্তু কেন ? আমি যদি চলে গিয়ে আকাশের তারা হয়ে অপেক্ষা করি ... ।’
‘চুপ করো, চুপ করো আমার সোনা মানিক ।’
‘মা, তুমি কি আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু দেবে, অনেক বড় চুমু ?’
‘বাবা, আমার লক্ষী সোনা !’
শিশুটি পুনরায় ভীষণ জোরে কাশতে শুরু করে এবং সে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে ।
‘মা, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না । আমাকে শ্বাস নিতে দাও । চারদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে । আমাকে একটু আলো দাও ... ।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই শিশুটি শান্ত হয়ে যায় । নেতিয়ে পড়া তার ছোট্ট হাত দু’টো সন্নাসিনীর গলা জড়িয়ে ধরে, যাকে সে মা বলে বিশ্বাস করে মেনে নিয়েছিল ।
এভাবেই শিশু পাবলো পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যায় অচেনা ভুবনে ।
সন্নাসিনীর চোখেমুখে এক ধরনের তৃপ্তির ছবি ফুটে ওঠে । সেসময় শিশুটির জন্য তার কোমল মনের স্নিগ্ধ সরোবরে প্রশান্তির নির্মল ঢেউ বয়ে যায় ।
শিশুটি কখনই জানবে না যে, সন্নাসিনী বন্ধ্যা । তারপরেও সন্নাসিনীর মনে হয় সে অলৌকিক শিশুটিকে ধোকা দিয়েছে এবং নিজেকে পরিপক্ক ও উর্বরা ভাবছে ।
আজ থেকে আমি ওর মা । মা, হোক না মৃত সন্তানের ।
লেখক পরিচিতিঃ
ইকুয়েডোরের স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক ইউজেনিয়া ভিতেরি । তার পুরো নাম ইউজেনিয়া ভিতেরি ব্লাঙ্কা সেগুরা । তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, গল্পকার এবং অধ্যাপক । তার জন্ম উপকূলীয় গায়াকিল শহরে, ১৯২৮ সালের ১৪ এপ্রিল। তিনি ছিলেন বিধবা মায়ের ছয় সন্তানের একজন । মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি গল্প লেখা শুরু করেন । প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘রিং এন্ড আদার স্টোরিজ’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে । তার অন্যান্য গল্প সংকলনের মধ্যে রয়েছে ‘টুয়েলভ্ স্টোরিজ’ (১৯৬২), ‘শুজ এন্ড ড্রীমস্’ (১৯৭৭) এবং ‘সিলেক্টেড স্টোরিজ’(১৯৮৩) । ‘ওনলি নাইনটি মাইলস্’ তার প্রথম উপন্যাস, যা ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় । ‘ব্ল্যাক অ্যালকোভস্’ (১৯৮৩) তার অন্য উপন্যাস । লেখালেখির স্বীকৃতি হিসাবে তিনি একাধিক সাহিত্য পুরস্কার অর্জণ করেন । ব্যক্তিগত জীবনে তিনি মার্ক্স মতবাদে বিশ্বাসী । ১৯৬৩ সালে স্বৈরাচারী সরকারের অত্যাচার থেকে নিস্কৃতি লাভের আশায় চিলিতে নির্বাসিত হন । সেখানে চিলির লেখক পেড্রো জর্জে ভেরাকে বিয়ে করেন । পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে সামরিক শাসনের পতন হলে তিনি সপরিবারে স্বদেশে ফিরে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস করেন ।
গল্পসূত্রঃ ‘মাতৃত্ব’ গল্পটি ইউজেনিয়া ভিতেরির ইংরেজিতে অনূদিত ‘মাদারহুড’ গল্পের অনুবাদ । স্পেনীশ ভাষা থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন এল এস থমাস । গল্পটি ‘এ টেইষ্ট অফ ইকুয়েডরঃ দ্য কালেক্টেড স্টোরিজ অফ ইউজেনিয়া ভিতেরি’ গল্প সংকলনে প্রকাশিত হয় ।
এই গল্পটিতে লেখিকা একজন বন্ধ্যা নারীর মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণের জন্য যারপরনাই আকুলতা অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং মর্মস্পর্শী ভাষায় তুলে ধরেছেন ।
অনুবাদক পরিচিতি
ফজল হাসান
গল্পকার, ছড়াকার। অনুবাদক।
0 মন্তব্যসমূহ