অনুবাদ
: এমদাদ রহমান
একজন
অভিযাত্রী আর একজন রাজ্যজয়ী পরস্পরের সঙ্গে বিনিময় করছেন অভিজ্ঞতা। মার্কো পোলো ভ্রমণ শেষে তাঁর দেখে আসা নগরগুলির বর্ণনা করছেন কুবলাই
খানের কাছে... পাঠকের কাছে এক অদ্ভুত
জগতের দরোজা খুলে দিচ্ছেন কালভিনো। ইনভিজিবল
সিটি'জ উপন্যাসের সেই জাদুবাস্তবতার ঘোরলাগা জগৎ। মার্কো পোলো বলছেন তাঁর উপলব্ধির কথা আমাদেরকে-
এই পৃথিবী আশাবাদের জায়গা নয়, এই পৃথিবী-
নিয়ত ক্ষয়িষ্ণু... এইভাবে 'অদৃশ্য নগর' কিংবা 'ইনভিজিবল
সিটিজ' উপন্যাসের সুত্র ধরে, আরও
বিস্তারে ইতালো কালভিনো'র মত একজন লেখকের লেখার শৈলী জেনে
নেবার উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হয়--প্রতিদিনকার জীবন-যাপনের মাঝখান থেকে-- নিজেকে একটুখানি মুক্ত করে।
প্যারিস রিভিউয়ের 'দি আর্ট অভ ফিকশন' সাক্ষাৎকারে পাওয়া গেল আমাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর। মৃত্যুর দুই বছর আগে, ১৯৮৩ সালে উইলিয়াম ওয়েভার এবং ডিমেইন পেটিগ্রি'র নেয়া দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়েছেন এই শ্রেষ্ঠ লেখক...
প্যারিস রিভিউয়ের 'দি আর্ট অভ ফিকশন' সাক্ষাৎকারে পাওয়া গেল আমাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর। মৃত্যুর দুই বছর আগে, ১৯৮৩ সালে উইলিয়াম ওয়েভার এবং ডিমেইন পেটিগ্রি'র নেয়া দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়েছেন এই শ্রেষ্ঠ লেখক...
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সাক্ষাৎকারী
লেখক
জীবনের কোনও এক পর্যায়ে কি আপনার মধ্যে প্রচণ্ড মানসিক বিকার কিংবা চিত্ত বিভ্রমের
জন্ম হয়েছিল?
ইতালো কালভিনো
মানসিক বিকার...
হ্যাঁ, আমাকে একটু ভেবে উত্তর দিতে হবে,
একটু পূর্বধারণা থেকে বলি- আমি কিন্তু সব
সময়ই যুক্তির ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলি। কোথাও
কিছু বলছি কিংবা লিখছি- যা-ই করছি না কেন, সব কিছুর পেছনেই কারণ থাকে,
উদ্দেশ্যটা কিন্তু স্পষ্ট থাকে, আর আমার
বিষয়-কে প্রতিষ্ঠা করি যুক্তি দিয়ে। আমার সম্পর্কে আপনি কী কী ভাবতে পারেন?
আপনি হয়তো ভাববেন- আমি পুরোপুরি অন্ধ যখন
প্রকাশের বেদনায় আমি অস্থির, যেন কিছুটা মানসিক বিকার কিংবা
ভ্রমগ্রস্থ হয়ে পড়েছি। আবার,
ধরেন, আপনার এই প্রশ্নের উত্তরে আমি যদি
এভাবে বলি- ওহ হ্যাঁ, আমি সত্যিই
বিকারগ্রস্থ। আমার কাঙ্ক্ষিত লেখাটি লেখবার
কালে আমার মনে হয় আমি যেন সমাধিতে আছি, কিংবা আমি যেন ঘোরগ্রস্থ। এরকম
স্নায়বিক উত্তেজনার সময় আমার জানা থাকে না যে আমি লিখব কীভাবে!
তখন আপনি আমাকে হয়তো অন্তঃসারশূন্য ভাববেন। মনে করবেন এক অবিশ্বস্থ লোক। আমি
মনে করি যে-প্রশ্নটি দিয়ে আমরা শুরু
করতে পারতাম আমাদের কথোপকথন- সেটা এরকম- আমি কী লিখি যখন নিজেকে আমি লেখায় বসিয়ে দিই, কী
করি তখন নিজের সঙ্গে, লেখার ভিতরে নিজেকে কতটুকু প্রবেশ করাই?
উত্তরে বলব- লেখার ভিতর আমি ঢুকিয়ে দিই লেখার
কারণটিকে, ঢুকিয়ে দিই লেখার পক্ষে আমার যুক্তি, উদগ্র ইচ্ছাগুলো, আমার জীবনতৃষ্ণা আর আমার সংস্কৃতি;
সংস্কৃতি- যাকে আমি আমার নিজের মধ্যেই বহন
করি। কিন্তু সেই একই সময়ে আমি আমার
খ্যাপাটে বিভ্রম কিংবা মনোবৈকল্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমি
এভাবেই বলব, যাকে আমরা বলছি-
মানসিক বিকার।
সাক্ষাৎকারী
আপনার
স্বপ্নগুলোর প্রকৃতি কীরকম? এক সময় আপনি ফ্রয়েডে যে-রকম আগ্রহী হয়েছিলেন, সেরকম আগ্রহ কি জুং-এর প্রতিও জন্মেছিল?
কালভিনো
একদিন
ফ্রয়েডের 'দি ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিম'জ' বইটির পাঠ শেষ করেই ঘুমিয়ে পড়লাম আর স্বপ্ন
দেখতে শুরু করলাম। পরদিন সকালে সেই স্বপ্নটাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে
মনে করতেও পারলাম। তার মানে আমি আমার স্বপ্নে ফ্রয়েডের
পদ্ধতিটাকে প্রয়োগ করতে পেরেছিলাম, সমস্ত খুঁটিনাটিসহ তার ব্যাখ্যাও করতে সক্ষম হয়েছিলাম। সক্ষমতার সেই মুহূর্তটি থেকেই আমার জন্য একটা নতুন কিছু যেন উন্মুক্ত
হলো, নতুন এক ভাবনা'র দরোজা খুলে
গেল আমার জন্য। স্বপ্নগুলো যেন আমার কাছে কিছুই
আর গোপন করছে না। আগে আর কখনো এমন হয়নি। সেই তখন ফ্রয়েডই আমার অবচেতনে আলো ফেলতে পেরেছিলেন আর তখন থেকেই আমি
নিরন্তর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম ঠিক যেমনটা আগেও দেখেছিলাম,
কিন্তু আগে আমি তাদেরকে ভুলে যেতাম কিংবা যদি তাদের মনে করতে সক্ষমও
হতাম সেগুলোকে তখন বুঝতে পারতাম না। স্বপ্নগুলো
নিয়ে ভাবনার সূচনাও তার মাধ্যমে শুরু হলো, কিন্তু পরে অবশ্য স্বপ্নগুলোর প্রকৃতি ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে ফ্রয়েডের
বিশ্লেষণী আমাকে আর তৃপ্ত করতে পারল না, যতোটা পারল জুং-এর বিশ্লেষণ। আমার
ফ্রয়েড-পাঠের কারণ হলো তাঁকে আমি একজন অসামান্য লেখক হিসেবে
আবিষ্কার করেছিলাম। পুলিশ
থ্রিলার লেখেন এমন একজন লেখক যাকে গভীর ঔৎসুক্যে অনুসরণ করা যায়। ফ্রয়েড-পাঠের মতো প্রবল আগ্রহ নিয়ে
জুং-কেও পড়েছি, যিনি এমন সব বিষয়ের
প্রতি আগ্রহী ছিলেন যেসব বিষয়ের প্রতি লেখকদের আগ্রহ থাকে যেমন প্রতীক আর মিথ। কিন্তু জুং, ফ্রয়েড যেমন অসামান্য লেখক
তেমন অসামান্য নন কিন্তু যেভাবেই হোক- আমি এই দুজনের প্রতি
সমান আগ্রহী।
সাক্ষাৎকারী
আপনার
উপন্যাসে সেই যে কিছুটা বিভ্রম, যাকে মানুষের
ভাগ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায় আর এবং ধীরে ধীরে দৈবাৎ কিংবা ভাগ্যের খেলা বা সম্ভাবনা
ইত্যাদি যেন লক্ষণীয় হয়ে ওঠে, খেলার সেই কার্ডগুলোর এলোমেলো
মিলতে থাকার মতো ব্যাপারগুলিকে আপনি একটার পর একটা লেখায় সুবিন্যস্তভাবে ছড়িয়ে দেন। আপনার লেখার জটিলতার সঙ্গে এই ব্যাপারগুলি কী করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে উঠে?
কালভিনো
কার্ড
নিয়ে লেখা আমার বই- 'দ্য ক্যাসল অব ক্রসড ডেস্টিনিস'
হচ্ছে একমাত্র বই যাকে আমি খুব ভেবেচিন্তে হিসেব করে লিখেছি। এখানে দৈবাৎ কিংবা সম্ভাবনা জাতীয় তেমন কিছুরই স্থান হয়নি,
এমন কি এসব ঘটবেও না। আমার
লেখায় দৈবক্রম কিংবা সম্ভাবনা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে-
এমনটা আমি বিশ্বাসই করি না।
সাক্ষাৎকারী
কীভাবে
লেখেন? লেখালেখির নিরন্তর প্রক্রিয়ার সঙ্গে কীভাবে একাত্ম
থাকেন?
কালভিনো
হাতেই
লিখি আর অনেক, অনেক কাটাকুটি করি,
ঠিকঠাক করি। আমি
বলতে চাই- যতটুকু লিখি কেটে ফেলি তার
চেয়েও বেশি। আমি যখন কথা বলি,
তখন আমি আসলে শব্দকে খুঁজে বেড়াই। এবং
যখন লিখতে বসি ঠিক তখনও- এই কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়ে
যাই। তারপর লেখায় আসে অসংখ্য যোগ-বিয়োগ, সংযোজন- আমার ছোট্ট
হাতে যা লিখেছি... আর তখনই সেই মুহূর্তটি আসে, যখন আমি কিছুতেই নিজের হাতের লেখার পাঠোদ্ধার করতে পারি না। লিখি তো অনেকটা সঙ্কেতলিপির মত। তারপর
একটা মুহূর্ত আসে যখন দেখা যায়- আমি নিজেই
আমার হাতের লেখা পড়তে পারছি না, আর তখন আমাকে আতশীকাচ ব্যবহার
করতে হয়, কী লিখেছি তার পাঠোদ্ধার করতে গিয়ে। আমার হাতের লেখাও আবার দুই ধরনের। একটা
লেখায় অক্ষরগুলো হয় বেশ বড় বড়, সঙ্কেতধর্মী
শব্দগুলোর আ-কার, ই-কার ইত্যাদির মাঝখানে কীভাবে যেন বড় বড় গর্ত হয়ে থাকে। যখন লেখার অনুলিপি তৈরি করি কিংবা যখন আমি নিশ্চিত হয়ে যাই নিজের হাতের
লেখার পাঠোদ্ধার সম্পর্কে, তখনই লেখার ধরন হয় বড়। অন্যরকমের হাতের লেখা আমি তখনই লিখি যখন আত্মবিশ্বাসটা একেবারে তলানিতে
গিয়ে ঠেকে, আর লেখাও হয় ছোটো,
ক্ষুদ্র, সঙ্কেতগুলি হয়ে যায় অনেকটাই যেন
বিন্দুর মতো। আর আমার নিজের জন্যই এই সঙ্কেতলিপি
উদ্ধার করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
লিখিত
পৃষ্ঠাগুলি কাটাকুটি করা অজস্র লাইনে প্রায়ই ভরে উঠে,
রেখায় রেখায় লেখা ঢেকে যায়- পুনঃলিখিত লাইনে। মাঝে একটা সময় গেছে যখন আমি হাতে লিখে শুধু খসড়াটি তৈরি করতাম,
আর এখন প্রথম খসড়ার পর পুরো লেখাটাই হাতে লিখে ফেলি, যার সম্পূর্ণতাই ছিল হিজিবিজি লেখা ঠেকে উদ্ধারকৃত বাক্যরাশি। তারপর লেখাটাকে টাইপ করে ফেলি- দুর্বোধ্য লিপি'র পাঠোদ্ধার করতে করতে ঠিক যেমনটা
আমি মনে মনে করতে চেয়েছিলাম। যখন
চূড়ান্ত প্রতিলিপিটাকে আবার পড়তে যাই- আমি আবিষ্কার করি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা টেক্সট। আর তখন আমার কাজ হয়ে পড়ে এই টেক্সটটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া আর পুনর্লিখন। আবারও অনেক অনেক কাটাকুটি করব। সংশোধন
করব। এই অবস্থায় আমি সব সময় চেষ্টা
করি টাইপরাইটারে বসে কাজটা করতে। তবুও,
নিজ হাতে কিছুটা সংশধনের কাজ করি। তখন
কী হয়, কাগজের পাতাটা পুরোটাই পাঠের অযোগ্য হয়ে পড়ে যখনই
তার উপর দ্বিতীয়বার টাইপ করতে শুরু করি। আমি
সেইসব লেখককে ঈর্ষা করি যারা এরকম কাটাকুটি ছাড়াই লেখাটিকে লিখতে পেরেছেন।
সাক্ষাৎকারী
আপনি কি প্রতিদিনই লেখেন কিংবা লেখার জন্য কোনও
নির্দিষ্ট দিন বা নির্দিষ্ট সময় আছে?
কালভিনো
তাত্ত্বিকভাবে লেখার ইচ্ছা আমার প্রতিদিনই হয়
কিন্তু প্রতিদিন সকালেই দেখি যে লিখতে বসবার সম্ভাব্য কারণগুলি আমার ভেতর ক্রিয়াশীল
হচ্ছে না, এভাবে- আমাকে নানা কারণে ঘোরের বাইরে যেতে হবে, কিছু কেনাকাটা
করতে হবে, পত্রিকা কিনতে হবে; এভাবে,
সকালে লিখতে শুরু করেও সকালটাকে মাটি করে ফেলবার সমস্ত আয়োজন করে
যেতে যেতে ঠিক বিকেলের দিকে লেখার কাজটা শেষ করে উঠতে পারি। আসলে আমি একজন দিনের বেলার লেখক, কিন্তু তবু আমি সকালটাকে নষ্ট করে ফেলি আর পরিণত হই বিকেলবেলার লেখকে। আমি অবশ্য রাতেও লিখতে পারি কিন্তু যখনই রাতে লিখতে বসি-
আমি আর কিছুতেই ঘুমাতে পারি না। তাই
লিখতে বসবার জন্য রাতটাকে আমি এড়িয়ে চলি।
সাক্ষাৎকারী
আপনার কি পূর্ব নির্ধারিত কিছু থাকে,
বিশেষ কোনও কিছু যাকে আপনি কোনও একদিন লিখবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে
রেখেছেন? কিংবা আপনি কি একসঙ্গে নানারকমের লেখা লেখেন?
কালভিনো
লেখার ক্ষেত্রে সবসময়ই আমার বেশকিছু বিশেষ পরিকল্পনা
থাকে। কমপক্ষে বিশটি বইয়ের একটা তালিকা
আমি করে রেখেছি যেগুলো আমি আস্তে আস্তে লিখব, কিন্তু যখন সেই মুহূর্তটি আসবে তখন আমি সিদ্ধান্ত নেব যে আমি বইটি এবার
লিখতে যাচ্ছি। আমি হলাম এমন একজন উপন্যাসিক যে
কেবল উপলক্ষ্যেই লেখে। আমার অনেক বই লিখিত হয়েছে বেশ
কিছু সংক্ষিপ্ত টেক্সটকে একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে, কখনো কয়েকটি ছোটগল্প একসঙ্গে মিলে কিংবা বলা যায়- তারা আসলে বই হয়ে উঠেছে কারণ কাঠামোগত দিক থেকে সেগুলি তাই কিন্তু সেগুলি
রচিত হয়েছে বিভিন্ন ধরণের টেক্সট দিয়ে। একটি
বিশেষ আইডিয়া যখন সম্পূর্ণ একটি বইকেই গড়ে তোলে সেটা আমার কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। একটি বইকে গড়ে তুলতে আমি প্রচুর সময় দিই এবং সেটা করতে গিয়ে একটা সংক্ষিপ্তসার
যাকে রূপরেখা বলা যায়- সেরকম করে রাখি যাতে পরবর্তী
সময়ে আর কোথাও সেটা আমাকে ব্যবহার না করতে হয়, পরে সেগুলোকে
আমি ফেলে দিই। তার মানে হলো বইটি যে লিখিত হচ্ছে
সে সম্পর্কে আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আর রূপরেখাটি প্রকৃত অর্থেই লিখিত পৃষ্ঠাগুলোতে চলে এসেছে।
লেখা শুরু করার ক্ষেত্রে আমি খুবই ধীর গতির। যদি একটি উপন্যাসের আইডিয়া আমার থাকে, হ্যাঁ, যদি আইডিয়াটা থাকে তাহলে প্রতিটি বাধাকে,
লেখার কাজ দেরিতে শুরু করবার অজুহাতগুলোকে কল্পনা করে করে খুঁজে বের
করি যাতে এসব নিয়ে অযথা ভাবতে না হয়। আমি
যদি একটি গল্পের বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে থাকি যেখানে থাকে সংক্ষিপ্ত কিছু টেক্সট,
তাহলে তাদের প্রত্যেকটিরই থাকবে শুরু করবার একটা নির্দিষ্ট সময়,
সেটা কাজ শুরুর দিকটাকে শুধু পিছিয়েই দেয়, এমনকি একটি গদ্যগুলি লিখতে গিয়েও আমি শুধু দেরি করতে থাকি। এমনকি লেখাগুলি যদি সংবাদপত্রের জন্যও হয়,
তাহলেও আমি সেই একই পথে এগিয়ে যায়, শুরু
করতে লেগে যায় অনেকটা সময়। আর
একবার যখন শুরু করে দিই, তখন কিন্তু বেশ দ্রুত লিখতে
থাকি। অন্যভাবে বললে বলতে হয় যে-
আমি খুব দ্রুতই লিখতে থাকি কিন্তু লেখায় তখন যেন সময়ের একটা বড় ফাঁক
থেকে যায়, চীনের সেই মহান শিল্পীর গল্পটির মতোই যেন অনেকটা-
সম্রাট তাকে একটা কাঁকড়া আঁকতে বললে, শিল্পী
উত্তর দিলেন- কাঁকড়া আঁকতে হলে আমাকে দশ বছর সময় দিতে হবে,
দিতে হবে একটি চমৎকার বাড়ি, আর বিশজন ভৃত্য। দশ বছর কেটে গেল, এবং সম্রাট
তাঁর কাছে কাঁকড়ার ছবি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমার
আরও দুইটি বছর লাগবে, তিনি জানালেন। দুই বছর কেটে গেলে শিল্পী সময় চাইলেন আরও কয়েকটি সপ্তাহ। তারপর একদিন এক মুহূর্তমাত্র সময়ে আঁকলেন সেই কাঁকড়াটিকে,
একটানে।
সাক্ষাৎকারী
লিখতে বসে আপনি কি অনেকগুলি পারম্পর্যহীন আইডিয়া
কিংবা অনেক বড় কোনও পরিকল্পনা বা ছক ইত্যাদি ভেবে নিয়ে লেখাটি শুরু করেন আর ধীরে ধীরে
কাজটি সম্পূর্ণ করতে পারেন?
কালভিনো
আমার
লেখা শুরু হয় একটা খুব ছোট্ট ছবি থেকে, পড়ে ধীরে ধীরে এই ছবিটি বড় হতে শুরু করে।
সাক্ষাৎকারী
তুর্গেনেভ
বলেছেন- আমি খুব ছোটো একটা কিছু তৈরির নকশা করেছিলাম কিন্তু
পরে সেটা অনেক বড় হয়ে যায় কারণ যে-সত্যটিকে আমি বলতে চাইছি
নকশাটা সেখানে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। আপনার
লেখাপত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত করে এই কথাটার উপর কোনও মন্তব্য করবেন?
কালভিনো
হ্যাঁ,
এটা তো সত্যিই যে, আমি বলব বিগত দশ বছর ধরে,
আমার বইগুলোর গড়ন-কৌশল একটা বিশেষ জায়গায়
পৌঁছেছে, হতে পারে বইয়ের নির্মাণ-রীতিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু
যখন আমি এটা অনুভব করি যে বই লিখতে গিয়ে আসলে আমি একটা তীব্রতাস্পর্শী কাঠামোকে আয়ত্ত্ব
করেছি আর এই কারণে এই বিশ্বাসটি জন্মেছে যে আমি এমন কিছু একটা করতে পেরেছি যা দু'পায়ে খাড়া হতে সক্ষম- একটা পূর্ণাঙ্গ কাজ। এর পক্ষে আমার কাছে উদাহরণও আছে, যেমন- আমি যখন 'অদৃশ্য
নগরগুলি' লিখতে শুরু করেছিলাম, তখন
আমার কাছে এই উপন্যাসের ফ্রেইম সম্পর্কে কেবল কিছু আবছা, ঘোলাটে,
অনিশ্চিত ধারণা ছিল, আমি এই বইয়ের নির্মাণ-নকশা নিয়ে সংশয়ে ছিলাম যে কী হবে তার চূড়ান্ত রূপ! কিন্তু পরে, একটু একটু করে, মনের ভিতরে থাকা ডিজাইনটি-ই আমাকে পথ দেখাল,
পুরো বইটিতে নকশাটি যুতসই রূপে দাঁড়িয়ে গেল। ডিজাইনটাই বইয়ের প্লট হয়ে গেল যা আদৌ প্লট ছিল না। 'দ্য ক্যাসল অব ক্রসড ডেস্টিনিজ' সম্পর্কেও সেই
একই কথা বলা যায়- বইটির রচনা-রীতি-ই এখানে সবকিছু। কিন্তু
পরে দেখা গেল আমি উপন্যাসের কাঠামো নিয়ে যেন একটা আচ্ছন্নতার পর্যায়ে পৌঁছে গেছি,
মনে হলো কিছুটা যেন অত্যুৎসাহী হয়ে পড়েছি। 'ইফ অন অ্যা উইন্টার'স নাইট অ্যা ট্র্যাভেলার'
সম্পর্কে বলা যায় যে একটা বিশেষ সূক্ষ্মতা, একটা সুস্পষ্ট কাঠামো ছাড়া এই বইটি কিন্তু অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। তবে আমার বিশ্বাস যে আমি এক্ষেত্রে সফল হয়েছি,
যা আমাকে কিছুটা হলেও পূর্ণতার একটা তৃপ্তি দিয়েছে। হ্যাঁ, অবশ্যই, এই ধরনের প্রচেষ্টাগুলি কিন্তু কোনোভাবেই পাঠকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
নয়, আসল বিষয় হলো আমার বইটি পড়ে আনন্দ পাওয়া, যে-আনন্দকে আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বইয়ের ভিতর ভরে
দিয়েছি।
সাক্ষাৎকারী
আপনি তো নানান জায়গায় থাকেন,
বিভিন্ন শহরে, রোম থেকে প্যারিস,
সেখান থেকে তুরিন- এইসব জায়গায় আপনি ক্রমাগত
যাতায়াত করতে থাকেন; এবং সমুদ্রের কাছের সেই বাড়িটাতেও যান
প্রায়ই। কোনও বিশেষ জায়গা কি আপনার লেখার
উপর কোনওরকমের প্রভাব তৈরি করে?
কালভিনো
আমি আসলে এভাবে বিষয়টা নিয়ে ভাবিনি। আমাদের প্রতিদিনকার জীবন যাপনের অভিজ্ঞতায় কোনও একটি বিশেষ জায়গার কিছুটা
প্রভাব হয়তো থাকে, সেটা কিন্তু লেখার ক্ষেত্রেও
হতে পারে। কিন্তু সেটা কোনওভাবেই তেমন লক্ষণীয়
কিছু নয় যে আপনাকে এখানে কিংবা সেখানে কোনও বিশেষ জায়গায় গিয়ে লিখতে হবে। এই এখন আমি একটি বই লিখছি, যার বিশয়বস্তুর সঙ্গে তুস্কান-এর সেই বাড়িটির একটা
যোগাযোগ আছে, সংযুক্তি আছে, বিগত
বছরগুলোর গ্রীষ্মকালগুলি আমি সেখানেই কাটিয়েছি। তবে
আমাকে সেখানে যেতেই হবে আমি যখন অন্যান্যসব জায়গা নিয়ে লিখতে যাব।
সাক্ষাৎকারী
আপনি কি হোটেলের কক্ষে বসেও লিখতে পারেন?
কালভিনো
এই কথাগুলি বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে লেখার
জন্য হোটেলের কক্ষ হল সবচেয়ে আদর্শ জায়গা- এখানে শুধুই শূন্যতা এবং অপরিচয়। হোটেলে
উত্তর দেবার মত চিঠিপত্রের স্থুপ নেই, (কিংবা উত্তর না দেবার তীব্র অনুশোচনাও নেই); এখানে
আমার লেখালেখি করা ছাড়া আর অন্য কোনও কিছুই করার থাকে না। সেই অর্থে হোটেলের কক্ষ হল আদর্শ স্থান। কিন্তু
আমি বুঝতে পেরেছি- আমার জন্য একান্ত নিভৃত
একটা জায়গা দরকার। গুহার মত নিজের জন্য একটা জায়গা,
যদিও আমি ধরে নিয়েছি যে কখনও সত্যিকারভাবে কোনোকিছু আমার মনটাকে যদি
নির্মল করে দেয়, তাহলে আমি হোটেলের একটি কক্ষে বসেও নিজের
লেখাটি লিখতে পারব।
সাক্ষাৎকারী
ভ্রমণের সময় কি আপনি নোটবুক,
কাগজ এইসব সঙ্গে রাখেন?
কালভিনো
হ্যাঁ, আমি প্রায়ই নোটবুক সঙ্গে নিয়েই ঘুরি, এসব তো আমার
চারপাশেই কোথাও না কোথাও থাকে, লেখার রূপকল্প নোটবুকে টুকে
রাখি। গত দশ বছর ধরে কিংবা হয়তো তারও
বেশি হবে, আমার জীবনের রূপরেখাগুলি
যেন এক ধরনের আচ্ছন্নতার রূপ নিয়েছে।
সাক্ষাৎকার
আপনার মা-বাবা দু'জনই বিজ্ঞানী, তারা কি আপনাকেও সেই পথে নিতে চাননি?
কালভিনো
আমার বাবা ছিলেন একজন কৃষিতত্ত্ববিদ আর মা ছিলেন
উদ্ভিদতত্ত্ববিদ। তারা দুজনেই,
একবারে গভীর অর্থে যা বোঝায়, শাকসবজি'র প্রকৃতি বিশেষ করে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু তারা আমার ব্যাপারে বেশ আগে থেকেই সতর্ক ছিলেন যে আমি যেন তাদের
পথে আগিয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষা না করি, কিন্তু সন্তানরা তো তাদের বাবা-মাকেই অনুসরণ করে
থাকে... আমার এই ভেবে অনুতাপ হল যে আমি কখনোই তাদের জ্ঞান-কে স্বীকরণ করতে পারব না, যতোটা করতে পারার মতো
ক্ষমতা আমার ছিল। আমার প্রতিক্রিয়া ছিল আসলে তাদের
দিকটিকে বিবেচনা করে, তাদের কথামতো এগিয়ে না যাওয়া,
কারণ ইতোমধ্যে তারা বুড়ো হয়ে গেছেন। আমার
জন্ম হল যখন- মা তখন তাঁর চল্লিশে পা
দিয়েছেন আর বাবা পঞ্চাশের কাছাকাছি- আমাদের মাঝে দূরত্ব ছিল
অনেক।
সাক্ষাৎকারী
ঠিক কখন থেকে লিখতে শুরু করেছিলেন?
কালভিনো
যখন কিশোর ছিলাম তখন আমার কোনও ধারণাই ছিল না
যে আমি আসলে কী করতে চাই। লিখতে শুরু করেছিলাম বেশ আগে কিন্তু
যখনই লেখাটা লিখে শেষ করলাম, তখন থেকেই
ছবি আঁকা আমার আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়াল। আমি
আমার ক্লাসমেটদের, শিক্ষকদের ব্যাঙ্গচিত্র
আঁকতে শুরু করে দিলাম। এসব
খুবই সাদামাটা খেয়ালি রেখাচিত্র। ছোট্ট
বালক থাকা কালে মা আমাকে শিল্পকলার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। সেটা
ছিল পত্রযোগে ছবি আঁকার একটা বিশেষ কোর্স। আমার
প্রথম আঁকাটি তখন প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল। ছবির
সেই কপিটি এখন আমার কাছে নেই, সেটা খুঁজে
বের করাও সম্ভব নয়। আমি
তখন এগারোয় পড়েছি। যে স্কুলে এসব পড়ানো হতো সেখানেই,
তাদের একটি ম্যাগাজিনে ছবিটা স্থান পেয়েছিল। আমি ছিলাম তাদের সবচেয়ে কম বয়েসি ছাত্র। কবিতা
লিখতাম একেবারে তরুণ বয়সে। বয়স
যখন ষোলো'র কাছাকাছি হল, তখন থিয়েটারের জন্য কাহিনী লেখার চেষ্টা করা শুরু করলাম। সম্ভবত এটাই ছিল আমার সেই সময়ের তীব্র আবেগ আর অনুরাগের ব্যাপার,
কারণ, সেই সময়ে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের
একমাত্র মাধ্যম ছিল একটা রেডিও। আমি
তখন রেডিও'য় প্রচার হওয়া নাটকগুলি শুনতে
অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। সুতরাং
আমি লেখালেখির চেষ্টাটা শুরু করে দিলাম- নাটক দিয়ে। আমার
নাটক এবং বেশকিছু গল্পের অলঙ্করণের কাজও লেখক হিসেবে আমিই করলাম। কিন্তু তখনই, অত্যন্ত স্থিরতার সঙ্গে
আমি লিখতে শুরু করলাম- যথাযথ স্থিরতার সঙ্গে- ঠিক যখন আমার মনে হল যে আমার রেখাচিত্রে কোনও বিশেষ শৈলী নেই। নেই তো কী করব? কোনও একটিকে
তো গড়ে তুলতেই হবে! ছবি আঁকা ছাড়লাম। উদাহরণ হিসেবে বলছি, কিছু লোককে দেখা যায় ভিড়ের মধ্যেও আনমনা হয়ে থাকে আর কাগজে ছোট ছোট ছবি
আঁকে। আমি নিজেকে বুঝিয়েছি যে এরকম কাজ
আর নয়।
সাক্ষাৎকারী
থিয়েটার ছাড়লেন কেন?
কালভিনো
যুদ্ধোত্তর ইতালির থিয়েটার বিশেষভাবে চোখে পড়ে
এমন কাউকেই তুলে ধরতে পারেনি। ইতালির
গল্প, উপন্যাস তখন খুব দ্রুত সমৃদ্ধি লাভ করছে যেন,
জোয়ার এসেছে। প্রবল
জোয়ার। তাই আমিও তখন ফিকশন লিখতে শুরু
করি। তখজ বেশ কয়েকজন লেখককে জানলাম,
পড়লাম, তারপরে নিজের লেখাটা লিখতে শুরু করলাম। এই ব্যাপারটা আসলে এক মানসিক নির্মাণ-কৌশল। যদি কেউ অন্য একজনের অভিজ্ঞতাকে
উপন্যাসে ধরতে পারে, হ্যাঁ, সেটা অভিজ্ঞতা, সেটা আইডিয়া- তখনই বলা যায় যে উপন্যাসটা সত্যিকারের উপন্যাস হতে পেরেছে। সাহিত্যপ্রকাশের অন্যান্য ফর্ম থেকে কেউ কোনও কাঁচামাল সঙ্গে নিয়ে আসে
না। আমার গদ্য লেখবার প্রক্রিয়াটা
একজন কবির কবিতা লেখবার পদ্ধতির সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়। দীর্ঘায়ত
উপন্যাস লেখেন- এমন উপন্যাসিক আমি নই। আমি একটি আইডিয়ার উপর পূর্ণ মনোযোগ দিই কিংবা কোনও একটি বিশেষ অভিজ্ঞতার
উপর, সেটা ঢুকে পড়ে একটি সংক্ষিপ্ত সংশ্লেষী টেক্সট-এর ভিতর যা অন্যান্য টেক্সটের পাশাপাশি চলতে চলতে একটা সিরিজ তৈরি হয়,
একটা ধারাবাহিকতা তৈরি করে। আমি
তাদের ছন্দ, তাদের ধ্বনি, এবং তারা যে ছবিগুলি আমাদের স্মৃতির ভিতর থেকে জাগিয়ে তোলে তার সঙ্গে অভিব্যক্তি
আর শব্দের প্রতি আমার থাকে পূর্ণ মনোযোগ। আমি
বিশ্বাস করি, ব্যাপারটাকে উদাহরণের মাধ্যমেই
বলা যাক, 'অদৃশ্য নগরগুলি' হচ্ছে
এমন এক বই যার স্থান আসলে কাব্য আর উপন্যাসের মাঝামাঝি। যদি পুরো বইটি আমি পদ্যে রচনা করতাম, তাহলে বইটা কিন্তু আরও বেশি গদ্যময় হয়ে উঠত। অদৃশ্য নগরগুলি আসলে এক পদ্য-উপাখ্যান অথবা খুব সম্ভবত লিরিক-কাব্য। লিরিক-কাব্য এমন এক জিনিস যাকে
আমি খুবই পছন্দ করি। মহৎ
কবিদের লিরিক কবিতাগুলি আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি।
সাক্ষাৎকারী
তুরিনের সাহিত্য জগতে কীভাবে প্রবেশ করেছিলেন,
সেখানে তো একটি গোষ্ঠী ছিল যারা গুইলিও এনাউদির প্রকাশনালয় এবং সেই
লেখকরা যেমন চেসারে পাভিসি আর নাতালিয়া জিংগবার্গ-কে কেন্দ্র
করে গড়ে উঠেছিল? আপনি তো তখন একেবারে তরুণ!
কালভিনো
তুরিনে আমি আসলে দৈবক্রমে গিয়েছিলাম। আমার জীবন পুরোদমে শুরুই হয়েছিল যুদ্ধের পর কিন্তু তার আগে আমি ছিলাম
সান রেমো'য়, জায়গাটা ছিল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীগুলি থেকে বহুদূরে। সেখান থেকে আমি যখন চলে যাওয়ার কথা চন্তা করলাম,
তখন কিছু সম্ভাব্য গন্তব্য হিসেবে তুরিন আর মিলান-কে নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। সেই
দু'জন লেখক যাদের মধ্যে একজন এক দশকের আগ্রজ ছিলেন,
তিনি প্রথম আমার লেখা পড়লেন- চেসারে পাভিসি,
থাকেন তুরিনে, এবং- ইলিও ভিত্তরিনি হলেন আরেকজন জ্যেষ্ঠ লেখক, তিনি
থাকেন মিলানে; আর এই কারণেই এই দুটি নগরী নিয়ে আমি দ্বিধায় ভুগেছি। আমি যদি মিলান-কে বেছে নিতাম,
প্রাণোচ্ছল আর সাহিত্যের নগরী মিলান, যার
সবকিছুই অন্যরকম। এদিকে-
তুরিন ছিল গভীর আর একগ্রচিত্ত আর যেন দুনিয়ার এক আড়ম্বরহীন স্থান!
তাই, তুরিন-কে বেছে
নেয়াটা ছিল নীতিগতভাবে এই নগরীটির সাহিত্য এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি এক ধরনের
আগ্রহ। তুরিন দিনে দিনে যেন হয়ে উঠছিল
ফ্যাসিবিরোধী বুদ্ধিজীবীদের নগরী। কারণ
আরও কিছু আছে। তুরিন এক গুরুত্বপূর্ণ প্রটেস্টান্ট
শহর আর আমার জন্ম এক চরম নীতিবান পরিবারে। আমার
ডাকনাম কালভিন, ইতালি-উচ্চারণে যা হয় কালভিনো। সান
রেমো'য়, আমার ছ'বছর বয়স থেকেই বেসরকারি প্রটেস্টান্ট এলিমেন্টারি স্কুলের শিক্ষকরা আমার
মাথায় শুধু বাইবেল ঢুকাতেন, সেই থেকেই আমার ভিতর বেশ কিছু
দ্বন্দ্ব জন্ম নিয়েছিল। ভাবনাচিন্তাহীন
আর অনেকবেশি বিশৃঙ্খল ইতালিতে আমি এক চরম বিপন্নতা অনুভব করলাম,
আর এই অনুভবটাই এক সময় আমাকে ইতালির উল্লেখযোগ্য কয়েকজন চিন্তকের
সঙ্গে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে ফেলল। সেইসব
চিন্তকরা বিশ্বাস করতেন যে দেশটির বিশৃঙ্খলার পেছনে কাজ করছে প্রটেস্টান্টদের সংস্কারের
অভাব। অন্যদিকে,
পিউরিটানের যেরকম মন মেজাজ থাকে, আমার কিন্তু
আদৌ সেরকম কিছু ছিল না। আমার
কুলনাম কালভিনো কিন্তু পারিবারিক নাম অবশ্যই- ইতালো।
সাক্ষাৎকারী
আপনি কি এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরছেন যে আপনার
প্রজন্মের তরুণদের চেয়ে আজকের তরুণরা চারিত্রিকভাবে একেবারে ভিন্ন প্রকৃতির। আপনার তো বয়স হয়েছে, এখন এই বয়সে আপনি কি আজকের তরুণদের কাজকর্মকে অপছন্দ করছেন?
কালভিনো
তরুণদের ব্যাপারে ভাবতে গিয়ে আমি যেন উন্মাদ
হয়ে পড়ছি, হ্যাঁ, বিভিন্ন সময়ে, তাদের নিয়ে ভাবতে হয়। আমি আসলে ভাবছিলাম নৈতিকতা সম্পর্কিত এক দীর্ঘ অভিভাষণের কথা যা কখনোই
বলা হবে না কোথাও, তার কারণটা প্রথমত-
আমি ধর্মোপদেশ দিতে পছন্দ করি না, এবং দ্বিতীয়ত,
কেউ আমার কথা মানে তুলবে না। সুতরাং
এখানে আমার করার মতো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই কিন্তু তরুণদের সঙ্গে যোগাযোগের গভীর সমস্যাটি
যেন সবসময়ই দগদগে ঘায়ের যন্ত্রণার মতো টের পাওয়া যাচ্ছে। আমার
প্রজন্ম আর তাদের মাঝখানে কিছু একটা তো হয়েছেই, অভিজ্ঞতার নিরবিচ্ছিন্নতা যেন এই দুই প্রজন্মের মধ্যে পরম্পরা তৈরি করতে
পারছে না। সম্ভবত আমরা আমাদের সকলের জন্য
বিবেচ্য বিষয়গুলোকে বুঝতে পারছি না। কিন্তু
আমি যদি এটা ভাবি যে আমি যদি আবার আমার সেই তারুণ্যে ফিরে যাই তাহলে সমালোচনাকে একটুও
গুরুত্ব দেব না। সমালোচনা,
নিন্দা এবং উপদেশ- যাই হোক না কেন আমি তাতে
মনোযোগ দেব না। তাই,
তাদের সম্পর্কে কিছু বলবার আমি কোনও অথোরিটি নই। আমি কেউ নই।
সাক্ষাৎকারী
শেষ পর্যন্ত আপনারা তুরিন-কেই বেছে নিলেন এবং সেখানে চলেও গেলেন। সেখানে
গিয়েই কি এনাউদি'র সঙ্গে কাজ করতে শুরু করলেন?
কালভিনো
তুরিনে গিয়েই কাজ করলাম,
তবে গুইলিও এনাউদি'র সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর,
পাভিসেই তার সঙ্গে যোগাযোগটা করিয়ে দিলেন। এনাউদি-ই আমাকে তার কাছে নিয়ে আসলেন
কাজ করবার জন্য, দায়িত্ব দিলেন তাদের বিজ্ঞাপনী অফিসের। এনাউদি ছিলেন ফ্যাসিবাদ বিরোধীদের একেবারে প্রধান ব্যক্তি,
মানে তিনিই ছিলেন সবকিছুর কেন্দ্র। আমার
মনে হ লো যে নিজেকে তৈরি করে নেওয়ার পক্ষে এই জায়গাটা একটা পটভূমিকা,
যদিও অভিজ্ঞতা বলতে আমার তেমন কিছুই ছিল না। আমার মতো একজন বহিরাগতের জন্য এটা বোঝা বেশ কঠিনই ছিল যে ইতালিতে অনেকগুলি
এরকম কেন্দ্র আছে যেগুলিতে তাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাস আর ঐতিহ্যের প্রাণটাকে উজ্জীবিত
করে। আমি তুরিনে এসেছি কাছাকাছি একটি
অঞ্চল 'লিগুরিয়া' থেকে যার কোনও
সাহিত্যিক ঐতিহ্য কিংবা পরম্পরা ছিল না, কোনও সাহিত্য চর্চাকেন্দ্রও
ছিল না। একজন লেখক,
যার পেছনে তার স্থানীয় সাহিত্য-ঐতিহ্য নেই
সেই লেখক মাঝেমাঝেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবে যে আসলে সে একজন আগন্তুক মাত্র। এই শতাব্দীর প্রথম ধাপে, ইতালির বৃহৎ সাহিত্যকেন্দ্রগুলি ছিল ফ্লোরেন্স, রোমা এবং মিলান। তার
ধারাবাহিকতায়, এখানে, তুরিনের বুদ্ধিজীবীরা বিশেষ করে এনাউদি'র সাহিত্যগোষ্ঠী
জোর দিয়েছিলেন ইতিহাসের উপর, জোর দিয়েছিলেন সামাজিক সমস্যাবলীর
উপর। সাহিত্য ছিল এসবের পরের স্থানে। ইতালিতে তার তাৎপর্যও অনেক ছিল। উত্তরকালের
বছরগুলোতে আমার মনে হয়েছিল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের সাহিত্য বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনে
খাঁটি ইতালিয়ান সাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছিল তার শক্তির কারণে। এমনকি লেখক হওয়ার আগে এক পাঠক হিসেবে আমার পাঠরুচি এমন ছিল যে আমি বিশ্বসাহিত্যের
অমৃতধারা থেকে তার রসটাকে আস্বাদন করছি।
সাক্ষাৎকারী
কে সেই লেখক যাকে আপনি পাঠ করেন গভীর আনন্দের
সঙ্গে আর যিনি আপনার উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছেন?
কালভিনো
সময়ে সময়ে, সেই কৈশোরকাল থেকেই, কৈশোর পেরিয়ে যুবকন যখন,
তখন থেকেই বহু বইকেই আমি বারে বারে পড়েছি। এভাবে ফিরে পড়তে গিয়ে আমি আমাকেই যেন বারবার আবিষ্কার করেছি,
আবিষ্কার করে বিস্মিত হয়েছি; যদিও বিষয়গুলি
আমার ভিতরে আমার অজান্তেই ক্রিয়াশীল ছিল। কিছুক্ষণ
আগে, একটা উদাহরণ দিয়েই বলি, কিছুক্ষণ আগে আমি আবারও পড়তে শুরু করেছিলাম সেইন্ট জুলিয়েনের লা'হসপিতালিয়া, আর পড়তে পড়তেই আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল
প্রাণিজগতের প্রতি লেখকের সেই দৃষ্টিভঙ্গিটি, যেন সুসজ্জিত
এক গথিক বস্ত্রখণ্ড, আমার উপন্যাস আর গল্পের উপর যার প্রভাব
পড়েছিল। ছেলেবেলায় আরও কয়েকজন লেখককে পড়েছি,
যেমন- স্টিভেনশন। লেখার স্টাইলের কারণে তিনি আমার কাছে এক অনুকরণীয় লেখক। লেখার স্টাইল, হালকা চালে
বলে চলা, আখ্যানের গতি আর লেখার মধ্যকার সেই অদ্ভুত শক্তি- স্টিভেনশনের এই বিষয়গুলির পর আমি
বলব- লা শারত্রুয়েসে দে পারমা'র স্তাদাল-কে।
সাক্ষাৎকারী
এনাউদি'র সেই সংঘে পাভিসে এবং অন্যান্য লেখকদের সঙ্গে আপনারও ছিল সাহিত্যিক বন্ধুত্ব,
তাই না? তাদেরকে আপনি পাণ্ডুলিপি পড়তে দিতেন
এবং তাদেরকে পাঠকৃতি জানাতে বলতেন।
কালভিনো
হ্যাঁ, তবে সেই সময়টায় আমি বেশকিছু সংখ্যক ছোটোগল্প লিখেছিলাম। গল্পগুলো পাভিসে-কে দেখালাম। নাতালিয়া জিংগবার্গকেও দেখানো হলো, জিংগবার্গ তখন তরুণ লেখক এবং সংঘের একজন কর্মী। কখনো আবার এটাও করতাম- মিলানে ভিত্তরিনির কাছে গল্পগুলো নিয়ে যেতাম, মিলান
ছিল তুরিন থেকে মাত্র দুই ঘণ্টার দূরত্বে। তো,
তাদের মতামতের উপর আমি কিন্তু গুরুত্ব দিতে শুরু করলাম। হঠাৎ খুব জরুরি নির্দেশ দিচ্ছেন এমনভাবে পাভিসে আমাকে বললেন-
আমরা বুঝতে পারলাম যে তুমি ছোটোগল্প লিখতে পারবে। এখন তোমাকে নিমগ্ন হতে হবে এবং উপন্যাসে হাত দিতে হবে। আমি জানতাম এটা আমার জন্য ভাল না খারাপ,
কেননা তখনও আমি কেবল এক ছোটোগল্প লেখক। আমাকে যদি কিছু বলতে হয় তো ছোটোগল্পের ফর্মেই বলতে হবে আর আমাকে লিখতেও
হবে অনেকগুলো গল্প, কারণ এখনও তাদেরকে আমি লিখে
উঠতে পারিনি। সে যা-ই হোক, এর মধ্যে আমার প্রথম উপন্যাসটি প্রকাশ হয়ে
গেলো আর সেটা সফলও হলো। তারপরে
বেশ কয়েকটি বছর ধরে আমি অন্য আরেকটি উপন্যাস লিখতে সচেষ্ট থেকেছি কিন্তু ততোদিনে,
সাহিত্যে নব্য-বাস্তবতাবাদ বেশ জায়গা করে
নিয়েছে, কিন্তু আমার সেটা ভাল করে জানা ছিল না। শেষ পর্যন্ত আমি কল্পকথার জগতেই ফিরলাম,
লিখে শেষ করলাম 'দ্য ক্লভেন ডিসকাউন্ত',
যে-বইটিতে আমি নিজেকে সত্যিকার অর্থেই উন্মোচন
করতে পারলাম। ব্যাপারটাকে আমি বলব-
'ফিরে আসা', কারণ সম্ভবত এটাই ছিল আমার আসল
প্রকৃতি, কারণ আমার ছিল যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, সেইসব বছরগুলোয় ইতালির মানুষের ভাগ্যের উত্থানপতন আমাকে আমার আগের জায়গায়
ফিরতে সাহায্য করল। এই
'ফিরে আসা'টা আমাকে দিয়ে যেন ভিন্নধারার
কিছু কাজ করিয়ে নিল যতক্ষণ না আমি পুরোমাত্রায় ফিরতে পারছি আর তাতে আমি যেন খুঁজে পেলাম
এক ধরনের উদ্ভাসন পদ্ধতি যা আসলে আমার নিজস্বতা।
সাক্ষাৎকারী
উপন্যাসিকরা কি মিথ্যুক?
আর, তারা যদি মিথ্যুক না হন, তাহলে ঠিক কোন সত্যটি তারা বলতে চান?
কালভিনো
উপন্যাসিকরা সেই সত্যটিকেই বলতে চান-
যে-সত্যটি আমাদের প্রত্যেকের জীবনের গভীরে
লুকিয়ে থাকে। যাকে আপনি সত্য কিংবা মিথ্যা বলছেন
তা কিন্তু একজন মনঃসমীক্ষণবিদের কাছে কিন্তু এটা তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়,
কারণ মিথ্যা হচ্ছে একটি কৌতূহলোদ্দীপক, সহজাত
এবং উন্মোচনকারী ব্যাপার, যে-কোনও
স্বীকৃত সত্য যেমনটা হয়ে থাকে।
লেখকদের সম্পর্কে আমি কিছুটা সন্দেহ পোষণ করি
তখনই যখন তারা তাদের নিজেদের জীবনের কিংবা এই পৃথিবীর যাবতীয় সত্যকে যখন তারা প্রকাশ
করে ফেলেন। কিন্তু আমি তো সেই সত্যের সঙ্গে
সম্পর্কিত হয়ে থাকতে চাই, যে-সত্যকে আমি সেইসব লেখকের মধ্যে খুঁজে পাব যারা নিজেদেরকে উপস্থাপন করবেন
এক একজন তেজস্বী মিথ্যুক হিসেবে। আমার
'ইফ অন অ্যা উইন্টার'স নাইট অ্যা ট্র্যাভেলার'
এই উপন্যাসটি দাঁড়িয়ে আছে সম্পূর্ণ অলীক কল্পনার উপর যার উদ্দেশ্য
ছিল একটি সত্যকে খুঁজে পাওয়ার পথ বের করা, যাকে আমি হয়তো আমি
আর কোনওভাবেই সন্ধান করতে পারতাম না।
সাক্ষাৎকারী
লেখকরা লেখেন যা তারা করতে পারেন কিংবা যা তারা
করতে চান- আপনি কি তা বিশ্বাস করেন?
কালভিনো
যা তারা করতে চান বা করতে পারেন-
লেখকরা তা-ই লেখেন। লেখালেখি ব্যাপারটা হচ্ছে একটা বিশেষ ধরনের কাজ,
যা কার্যকরী হয় একমাত্র তখনই যখন একজনের অন্তর্জগৎটাকে প্রকাশ করবার
জন্য সে অনুমতি দেয়। একজন
লেখক বিভিন্ন রকমের সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হন- সাহিত্যিক সীমাবদ্ধতা, যেমন- একটি সনেটের পঙক্তি সংখ্যা কিংবা ধ্রুপদী ট্র্যাজেডির রীতি। লেখকের ব্যক্তিত্ব তার নিজেকে প্রকাশের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে তা আসলে
তার কাজের ধরনের বিভিন্ন অংশ, লেখকের ব্যক্তিত্ব
যার সঙ্গে একাত্ম হয়, কিন্তু তার বাইরে আছে বেশ কিছু সামাজিক
সীমাবদ্ধতা, যেমন ধর্ম সম্পর্কিত, নৈতিকতা সম্পর্কিত, দর্শনগত এবং রাজনৈতিক দায়িত্ব
যা সরাসরি কোনও লেখাতেই আরোপ করা যায় না, লেখকের অন্তর্জগত-কেন্দ্রিক মিথস্ক্রিয়ায় ছেঁকে নিয়ে ব্যবহার করতে হয় তাকে। বিষয়গুলি যখন লেখকের ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে যাবে ঠিক তখনই সেগুলোর কণ্ঠ
রোধ না করে তিনি ব্যবহার করতে পারবেন।
সাক্ষাৎকারী
কোনও এক সময় বলেছিলেন যে আপনি হেনরি জেমস-এর মতো গল্প লিখতে চান। এখন
কি এমন কেউ আছেন যাকে আপনি আপনার ঘরানার মনে করছেন?
কালভিনো
হ্যাঁ, আমি এক সময় দ্য জলি কর্নারের নাম উল্লেখ করেছিলাম। আর এখন কী বলতে চাইব? আমি এখন একেবারে ভিন্নভাবে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেব : এদেলবার্থ ফন চামিসো'র পিটার শেলমেহল।
সাক্ষাৎকারী
কোথাও
কি জয়েস কিংবা অন্য কোনও আধুনিকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন?
কালভিনো
আমার লেখক হচ্ছেন কাফকা আর আমার প্রিয় উপন্যাস
আমেরিকা।
সাক্ষাৎকারী
দেখা
যাচ্ছে যে আপনি দিনে দিনে ইংলিশ লেখকদের, যেমন- কনরাড, জেমস,
এমনকি স্টিভেনশন- এই লেখকদের মননের নিকটবর্তী
হয়ে চলেছেন, তারপর আসছে ইতালির গদ্য-ঐতিহ্যের কেউ কেউ। এর
পেছনের কারণটা কী?
কালভিনো
কিন্তু
আমি তো সবসময় গিয়োকোমো লিওপার্দিকে অনুভব করি। সারাক্ষণ
একজন অতুলনীয় কবির সংস্পর্শে থাকি- হাস্যরস, কল্পনা আর নিগূঢ়তা নিয়ে লিওপার্দি ছিলেন
একজন বিরল শৈলীর গদ্য-লিখিয়ে।
সাক্ষাৎকারী
ইতালি ও আমেরিকার লেখকদের সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি
নিয়ে আপনি একসময় বলেছেন- প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে
ইতালির লেখকদের বেশ একটা আন্তরিক সম্পর্ক থাকে আমেরিকার প্রকাশনা সেখানে একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলোর
সঙ্গেই যেন বেশি সম্পর্কিত।
কালভিনো
একটি উপন্যাসের ব্যাপ্তি হিসেবে ভাবতে গেলে
আর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও-- আমেরিকার উপন্যাসের মধ্যে
যা প্রায়ই দেখা যায়-- যেন সবকিছুই একঘেয়ে (নভোকভ একজন বড় ব্যতিক্রম), তেমনি চরম একঘেয়ে হলো
সেই প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠানগুলো, যেখানে
কিছু ইতালিয়ান উপন্যাসও প্রকাশিত হয়ে থাকে।
সাক্ষাৎকারী
এনাউদি'র জন্য আপনাকে কী করতে হতো? আপনার সৃষ্টিশীল কাজে
সেগুলো কি কোনও ধরনের সমস্যা তৈরি করেছিল?
কালভিনো
এনাউদি হলেন এমন এক প্রকাশক যিনি ইতিহাস,
বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সমাজনিরীক্ষা, দর্শন এবং ধ্রুপদী সাহিত্য প্রকাশে
বিশেষজ্ঞ। গল্প,
উপন্যাস অর্থাৎ ফিকশনধর্মী বইয়ের স্থান ছিল শেষ দিকে। সুতরাং, এখানে কাজ করার মানে হলো
আপনি একটি জ্ঞানকোষের দুনিয়ায় বসে আছেন।
সাক্ষাৎকারী
আপনার লেখাপত্রে এই ব্যাপকভাবেই এই বিষয়টা এসেছে,
প্রায়ই লক্ষ্য করি- মানুষের মধ্যকার লড়াই
করবার স্পৃহাটা যেন একসূত্রে মিলে যাওয়ার একটা পথকে বিচ্ছিনতার মধ্য থেকেও খুঁজে বের
করে ফেলে। আমি ভাবছিলাম,
বিশেষ করে আপনার 'ইফ অন অ্যা উইন্টার নাইট'
এবং তার পাঠক সম্পর্কে, যে বইটির পরবর্তী
অধ্যায়টি পড়বে বলে খুজছে, না পাওয়া পর্যন্ত খুঁজতেই থাকবে।
কালভিনো
দেখুন, বিশ্বপ্রকৃতির পছন্দ আর মানুষের সেই নিরবিচ্ছিন্ন বেদনাবোধ, ভয়, ভাবনা, পীড়িত হওয়া,
মানসিক যন্ত্রণা অর্থাৎ যাকে বলে অবসেশন- এই দুইয়ের মধ্যকার দ্বন্দ্ব মিলেমিশে একটা বিশেষ বোধ জন্ম নিতে থাকে তাদের
ভেতর আর বারবার তা আবর্তিত হয় সেখানে- আমার লেখায়।
সাক্ষাৎকারী
আপনার লেখায় বাস্তবধর্মীতা এবং উদ্ভট কল্পনা'র একটা দোলাচল থাকে। আপনি
কি এই বিষয় দু'টি-কে উপভোগ করেন?
কালভিনো
আমি যখন একটি বই লিখি,
তা হয় সম্পূর্ণ নতুন একটি উন্মোচন, একটা
নতুন কিছু আবিষ্কার। লেখালেখির
জন্য আমি এক আকুল আকাঙ্ক্ষা অনুভব করি, যা আমার প্রতিদিনকার জীবন-যাপন, আমার কর্ম-কাজ এবং আমার চিন্তাভাবনাগুলোর সঙ্গে
সরাসরি সম্পর্কিত হয়ে থাকে। এই
মুহূর্তে যে বইটি লেখার কথা ভাবছি, সেখানে অন্য কেউ থাকবে, আমি থাকব না। অন্যদিকে, যখন শুধুমাত্র আমি নিজের
জীবনস্মৃতিমূলক কোনও লেখা লিখব আমার প্রতিদিনের খুঁটিনাটিগুলোকে উপজীব্য করে,
ঠিক তখন কিন্তু আমার আকাঙ্ক্ষা হয়ে যাবে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। বইটি একটি নতুন উন্মোচনের পথে ক্রমাগত এগিয়ে যাবে। বইটি শুধু আমাকেই ধরবে না, আমাকে সে মুক্ত করে রাখবে, আর; সম্ভবত, এই কারণেই বইটি হয়ে উঠবে আন্তরিকতায় ভরে
থাকা এক আখ্যান।
সাক্ষাৎকারী
আপনার উপন্যাস নিয়ে আমেরিকার প্রতিক্রিয়া কেমন
ছিল?
কালভিনো
'অদৃশ্য নগরগুলি' ছিল বইগুলোর
মধ্যে একটি, আমেরিকা যাকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। ব্যাপারটা কিন্তু বিস্ময়কর, কারণ এই বইটি কিন্তু সহজ সরল কোনও বই নয়, এটা আদৌ
উপন্যাস তো নয়-ই, আদ্যোপান্ত একটি
গদ্যকবিতা-সংগ্রহ। আরও
একটি বই খুব আলোচিত হয়েছিল- ইতালির লোকগাথা। একদিন যে-বইটি সম্পূর্ণ অনূদিত হয়ে
প্রকাশিত হয়েছিল সেই বই মূল ভাষায় ইতালিতে প্রকাশ পায়- দীর্ঘ
পঁচিশ বছর পর।
'অদৃশ্য নগরগুলি' যেখানে বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত
থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের
পুরোধাদের দ্বারা সমাদৃত হয়েছিল, সেখানে 'ইতালির লোকগাথা' পেয়েছিল অভাবিত জনপ্রিয়তা। আমেরিকায় আমার পরিচিতি প্রথমে একজন কাহিনীকার,
তারপর ফ্যান্টাসি-লেখক।
সাক্ষাৎকারী
আপনি কি বিশ্বাস করেন যে ইউরোপ ব্রিটিশ আর আমেরিকার
সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে?
কালভিনো
না। আমি
অন্ধভক্তের মতো আপনার কাছে কিছু বলতে চাইছি না। যেকোনো
সংস্কৃতির জন্য আসলে সংস্কৃতি-সম্পর্কিত প্রজ্ঞাটাই
হলো চরম অপরিহার্য উপাদান। আমি
এটা কখনোই বিশ্বাস করতে পারিনি যে এই প্রজ্ঞা আমরা অর্জন করতে পেরেছি। একটি সংস্কৃতি, একটি বিশেষ
জীবনধারা ভিনদেশী প্রভাবে প্রভাবিত হওয়ার জন্য অবশ্যই খোলা বা মুক্ত থাকবে-
যদি স্বয়ং সে তার নিজস্ব সৃষ্টিশীল ক্ষমতাটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। এই ইতালির সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের অন্যতম প্রধান উপাদান হয়ে আছে ফরাসি সাহিত্য। আমেরিকার সাহিত্য, অবশ্যই,
আমার উপর একটা স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পেরেছে, সম্মিলিতভাবে। পো
ছিলেন আমার আগ্রহের প্রথম লেখক যিনি আমাকে শিখিয়েছেন উপন্যাস কী। পরে আমি উপলব্ধি করলাম যে হওথর্ণ মাঝেমাঝেই পো থেকে বড়। তবে সেটা মাঝেমাঝেই, সব সময় নয়। আর
একজন হলেন- মেলভিল। তাঁর একটি উৎকৃষ্ট উপন্যাস, 'বেনিতো সেরেনো'- এমনকি মবি ডিকের চেয়েও মূল্যবান। আসল কথা হয় লো- আমার প্রথম
শিক্ষানবশি শুরু হয়ে ছিল চেসারে পাভেসি'র ছায়ায়, যিনি ছিলেন মেলভিলের প্রথম ইতালিয়ান অনুবাদক। তাদের সঙ্গে আরও আছেন আমার জীবনের প্রথম সাহিত্যিক আদর্শ,
উনিশ শতকের শেষপাদের কয়েকজন গৌণ আমেরিকান লেখক- স্টিফেন ক্রেইন এবং অ্যামব্রোস বায়ার্স। আমি
যখন সাহিত্যে কিছুটা নিজস্বতা খুঁজে পেয়েছি, চল্লিশের শুরুতে, তখন হেমিংওয়ে, ফকনার আর ফিটজিরাল্ড-রা দাপটের সঙ্গে লিখছেন আর
সেই সময়ে এখানে, ইতালিতে আমেরিকান সাহিত্যের দ্বারা অভিজ্ঞতা
প্রাপ্ত হচ্ছি, যেন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ছি, এমনকি একেবারে গৌণ লেখক যেমন- সারয়ান, কডওয়েল, এবং কেইন-রা লেখন-শৈলীর উৎকৃষ্টতার মডেল হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করলেন। তারপর... পেয়ে গেলাম নভোকভ-কে। আমি তার ভক্ত হয়ে গেলাম,
এবং এখনও আছি। আমি
অবশ্যই বলব যে আমেরিকার সাহিত্যের প্রতি আগ্রহটা আসলে আমাদের নিজেদের আকাঙ্ক্ষায় চালিত
হতে হতে সমাজে আসলে কী ঘটছে শুধু তা-ই দেখতে চাওয়া কিংবা দেখতে পাওয়া নয়, পরবর্তী বছরগুলিতে
ইউরোপে প্রকৃত অর্থে কী ঘটতে যাচ্ছে তা-ও বুঝতে চেষ্টা করা-
পরের বদলে যাওয়ার পটভূমি তো এই সময়টাই, এই
তো বর্তমান, আর তা তো লুকিয়ে রয়েছে আমাদের আকাঙ্ক্ষার ভিতরে। এই অর্থে, সেইসব লেখক, যেমন- সল বেলো, মেরি ম্যাককার্থি,
গোর ভিদেলে-রাই হলেন গুরুত্বপূর্ণ,
সময়ের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কারণে, যা প্রকাশ
পেয়েছে তাদের রচিত গদ্যের উৎকর্ষতায়। একই
সময়ে আমি অবশ্য নতুন এক লেখক- প্রতিভার সন্ধানে
উন্মুখ হয়ে ছিলাম মধ্য পঞ্চাশে জন আপডাইকের উপন্যাসগুলির আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে।
সাক্ষাৎকারী
বিশ্ব-যুদ্ধোত্তর সেই সংকটপূর্ণ বছরগুলোতে, আপনি প্রায়
অবিচ্ছিন্নভাবেই ইতালিতে থেকেছেন, এবং এখনও আছেন; আমার জানতে চাওয়ার বিষয়টা এখানেই যে- আপনার সেই
ব্যতিক্রমধর্মী নভেলা 'দ্য ওয়াচার' এবং আপনার গল্পগুলোতে কিন্তু ইতালির রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছে অতি
সামান্য, যদিও গল্পগুলো লেখবার সময়ে আপনি খুব সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে
জড়িয়ে পড়েছিলেন।
কালভিনো
'দ্য ওয়াচার' ছিল একটা ত্রয়ীর
একটি যা কখনোই সম্পূর্ণ হয়নি- ত্রয়ীটির নাম এরকম ঠিক করেছিলাম-
১৯৫০-এর একটি কালানুক্রম। আমার আরাধ্য সময়টা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বছরগুলি। সেই বছগুলিতে সব কিছু এত দ্রুত বদলে যাচ্ছিল যে আমি তখন উপলব্ধি করতে
চাইলাম ভয়ঙ্কর ট্রমা'র প্রকৃত অর্থ টা আসলে কী। যে প্রচণ্ড স্নায়বিক অসুস্থতার ভিতরে আমি বেঁচে থাকছি,
বিশেষ করে জার্মান দখলদারিত্বের মধ্যে। আমার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের শুরুর দিকের রাজনৈতিক সক্রিয়তা ছিল কিছুটা
তাৎপর্যপূর্ণ। আমি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলাম,
যদিও ইতালির কমিউনিস্ট পার্টি ছিল দুনিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে ভিন্ন
প্রকৃতির। আমাকে এমন কিছু বিষয় মেনে নিতে
বাধ্য হতে হয় যা আমার অনুভবের পক্ষে বহুদূরের। পরে,
ক্রমান্বয়ে আমি বুঝতে শুরু করি যে ইতালিতে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার
ধারণাটি আসলে একটি বিশেষ মডেল বা মিথ-কে ব্যবহার করছে-
রাশিয়া যেখানে পুনরায় মিত্র হতে কঠোর থেকে আরও কঠোর অবস্থানে চলে
যাচ্ছে, দ্বন্দ্ব এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে আমি ভাবতে
থাকি কমিউনিস্ট বিশ্ব থেকে নিজেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে, এবং সবশেষে- রাজনীতি থেকে। সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় ধাপে অর্থাৎ রাজনীতির পরের স্থানে
থাকে সাহিত্য। আমাদের জন্য সেটা ছিল একটা বড়
রকমের ভুল। তার কারণ হলো-
রাজনীতি সম্পর্কে মোটামুটি এই কথাটা বলা যায় যে রাজনীতি কখনোই তার
আদর্শকে অর্জন করতে পারে না; অন্যদিকে, সাহিত্য সম্পর্কে তো এই কথাটা বলা-ই যায় যে-
সাহিত্য তার নিজের জায়গাটিতে কিছু না কিছু অর্জন করে ফেলতে পারে আর
দীর্ঘ মেয়াদে হলেও সাহিত্যের কিছু কার্যকর প্রভাবও পরিলক্ষিত হয়। এই সময়ে এসে আমি এটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে মূল্যবান বিষয়গুলি অর্জিত
হয় বেশ দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে।
সাক্ষাৎকারী
এই শতাব্দীর প্রায় সকল বড় লেখকই চলচ্চিত্রের
জন্য লিখেছেন কিংবা নিজেদের রচনাকে ছবি করতে দিয়েছেন কিন্তু আমরা দেখলাম যে আপনি নিজেকে
মায়াবী পর্দা থেকে সরিয়ে রেখেছেন। তা
আসলে কেন এবং কীভাবে সম্ভব হলো?
কালভিনো
তারুণ বয়সে খুব সিনেমা-ভক্ত ছিলাম, আসলে সিনেমা বলতে পাগল ছিলাম,
কিন্তু সব সময়ই আমি ছিলাম দর্শকমাত্র, শুধুই
এক দর্শক। উল্টো দিক থেকে পর্দার উপর ছবি
প্রদর্শনের ব্যাপারটা আমাকে তেমন একটা আকর্ষণ করতে পারেনি। পর্দায়
কীভাবে ব্যাপারটা সংগঠিত হচ্ছে এটা বুঝে ফেলবার পর সিনেমার প্রতি আমার ছেলেমানুষি আবেগ
ধীরে ধীরে কেটে যায়। তারপরও বলি-
আমি জাপান আর সুইডেনের ছবি পছন্দ করি, যথার্থ
অর্থেই পছন্দ করি, কারণ এই ছবিগুলি নিঃস্পৃহ আর বহুদূরবর্তী।
সাক্ষাৎকারী
আপনি কি ক্লান্ত?
কালভিনো
হ্যাঁ, আমার শৈশবে ক্লান্তি এসেছিল। কিন্তু
এই ব্যাপারটাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে মনে রাখতে হবে যে শৈশবের একঘেয়েমিজনিত ক্লান্তিটা
আসলে এক বিশেষ ধরণের ক্লান্তি। এটা
আসলে এমন এক ক্লান্তিকর অবস্থা যা কেবল স্বপ্ন দিয়ে পূর্ণ হয়ে থাকে আর থাকে চোখ ধাঁধানো
নতুন সব জায়গার সন্ধান, নিজেকে অন্য কোথাও,
অন্য কোনও বাস্তবতার মাঝে অবিরাম অনুভব। প্রাপ্তবয়স্ক'র যে বিরক্তি,
যে-ক্লান্তি- তা
কিন্তু পুনরাবৃত্তিপ্রবণ। এই
বিরক্তি এমন কিছুর এক চলমান প্রক্রিয়া যার মানে হ লো আমরা এই জীবনে আর কখনোই কোনও বিস্ময়ের
জন্য আকাঙ্ক্ষিত হবো না। আর আমি-
আজ এই সময়ে কি আর বিরক্তিতে ভোগার সময় আছে? আমার সাহিত্যকর্মে নিজেকে পুনরাবৃত্তির ভয়টাকে আমি কী করব? এসবের সেই একটাই তো কারণ যার জন্য আমাকে প্রত্যকবার নতুন নতুন ঝুঁকিকে মোকাবেলা
করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। আর
এই মোকাবেলা করতে গিয়ে আমি অবশ্যই এমন একটা কিছু খুঁজে পাবো যা আসলেই অভিনব,
এমন একটা কিছু যা আমার ক্ষমতাকে অতিক্রম করতে পারবে।
অনুবাদক পরিচিতি
এমদাদ রহমান
গল্পকার। অনুবাদক।
ইংল্যান্ড প্রবাসী।
0 মন্তব্যসমূহ