নদীর তৃতীয় কূল

মূলঃ জায়ও গিমারিস রোসা

অনুবাদঃ ফজল হাসান


আমার বাবা ছিলেন কর্তব্যপরায়ন, নিয়ম মেনে চলা মানুষ এবং স্পষ্টবাদী। বাবার সম্পর্কে আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা সবাই একই কথা বলেছে যে, বাবা এসব গুণাবলী সেই যৌবনে, এমনকি শিশুকাল থেকে, রপ্ত করেছিলেন । আমার যতদূর মনে পড়ে, আমাদের জানা মতে তিনি অন্যান্যদের তুলনায় বেশি আমুদে ছিলেন না কিংবা মন-খারাপের বিষণ্নতায়ও ডুবে থাকতেন না । তিনি ছিলেন শান্ত-স্বভাবের একজন নিরীহ মানুষ । আমাদের মা, বাবা নন, ছিলেন সংসারের হর্তা-কর্ত। তিনি আমার ভাই, আমার বোন এবং আমাকে প্রতিদিন গালিগালাজ করতেন । কিন্তু একদিন এক অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটে । সেদিন বাবা একটা নৌকা কেনার কথা বলেন ।

নৌকা কেনার ব্যাপারে বাবা ছিলেন ভীষণ আন্তরিক এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ । শুধু তার জন্যই বিশেষ ধরনের মিমোসা কাঠ দিয়ে নৌকাটি তৈরি করা হয়েছিল । নৌকাটি ভীষণ মজবুত ছিল এবং অনায়াসে কুড়ি থেকে ত্রিশ বছর টিকতো । তবে নৌকাটিতে মাত্র একজনের বসার মতো পর্যাপ্ত পরিমানে জায়গা ছিল। আমার মা সেই নৌকা নিয়ে অনেক আকাশ-পাতাল ভেবেছিলেন । তাহলে কি হঠাৎ করে তার স্বামী জেলে হয়ে মাছ ধরবে ? মায়ের উৎকন্ঠা শুনে বাবা কিছু বলেননি । তিনি চুপ করে থেকেছেন । আমাদের বাড়ি থেকে নদী প্রায় অর্ধ মাইল দূরে । নদীটা ছিল বেশ গভীর, শান্ত এবং ভীষণ প্রশস্ত । নদীর এক তীর থেকে অন্য তীর দেখা যেত না ।

লোকজন এসে যেদিন নৌকাটি দিয়ে যায়, সেদিনের স্মৃতি আমি কোনোদিনই ভুলবো না । তবে বাবার চোখেমুখে আনন্দ বা উল্লাসের কোনো চিহ্ন ফুটে ওঠেনি, এমনকি চেহারায় কোনো ভাবান্তরও দেখা যায়নি । কিছুক্ষণ পর বাবা মাথায় হ্যাট পড়েন, যা তিনি বাইরে বেরোনোর আগে সব সময় পরিধান করেন, এবং আমাদের বিদায় জানান । তিনি সঙ্গে কোনো খাদ্য-খাবার কিংবা আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র নেননি । আমরা আশা করেছিলাম, মা হয়তো চ্যাঁচামেচি করবেন । না, তিনি তা করেননি । বরং তিনি মলিনতার ধূসর ছায়া সমস্ত মুখমন্ডলে ছড়িয়ে রেখেছেন এবং উৎকন্ঠায় ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে রাখে।

একসময় বাবাকে উদ্দেশ্য করে মা বললেন, ‘যদি যেতে চাও, যাও । তবে কোনদিনও আর ফিরে এসো না ।’

বাবা পুনরায় নিরুত্তর । তিনি শুধু প্রসন্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন এবং ইশায় বলেছিলেন, আমি যেন তার সঙ্গে যাই । যদিও আমি মায়ের অগ্নিমূর্তিকে ভীষণ ভয় করি, কিন্তু সেই সময় বাবার ইশারা অগ্রাহ্য করতে পারিনি । আমরা একসঙ্গে নদীর দিকে হাঁটতে থাকি । আমি বাবার সঙ্গী হতে পেরে এত বেশি সাহসী এবং উল্লসিত ছিলাম যে, একসময় আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল, ‘বাবা, আপনি কি আমাকে আপনার সঙ্গে নৌকা চড়তে নিয়ে যাবেন ?’

বাবা শুধু আমার মুখের দিকে একবার স্নেহের দৃষ্টিতে তাকান এবং আমাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে আশির্বাদ করেন । তারপর তিনি চোখেমুখে এমন ভঙ্গি ফুটিয়ে তোলেন, যার অর্থ আমি যেন একাকী বাড়ি ফিরে যাই । বাবার কথা মতো আমি উল্টো পথে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি । যেই তিনিও ঘুরে নদীর দিকে হাঁটতে শুরু করেন, তখন আমি বাবার কর্মকান্ড দেখার জন্য চোখের পলকে পাশের ঝোপঝাড়ের ভেতর লুকোই । একসময় বাবা নৌকায় চড়েন এবং বৈঠা বেয়ে মাঝ নদীর দিকে যেতে থাকেন । নৌকার দীর্ঘ শান্ত ছায়া পানির ওপর ভাসমান কুমিরের মতো ভেসে থাকে ।

বাবা সেই যে গেলেন, আর ফিরে আসেননি । বস্তুতঃ তিনি কোথাও যাননি । তিনি শুধু নদীতে নৌকার দাঁড় টেনে এদিক-ওদিক ভেসে বেড়াচ্ছিলেন । সবাই আতঙ্কিত । যে ঘটনা কোনোদিনই ঘটার কথা নয় কিংবা হয়তো কখনই ঘটতো না । কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই ঘটনাই ঘটেছে । আমাদের আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশি এবং বন্ধু-বান্ধব সবাই এসে বাবার অন্তর্ধান নিয়ে নিয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা করেছে ।

বাবার ছেলেমানুষী কর্মকান্ডের জন্য মা রীতিমতো লজ্জিত । এ প্রসঙ্গে মা তেমন কোনো কথা বলেননি, বরং কঠিন ভাবে আত্মসংবরণ করেছেন । ঘটনাক্রমে সবাই মনে করেছে (যদিও কেউ মুখ খুলে সরাসরি বলেনি) যে, কান্ডজ্ঞানহীন ভাবে বাবা এ কাজ করেছেন । যাহোক, তবে কয়েকজন মন্তব্য করে বলেছেন, বাবা হয়তো ঈশ্বরের কাছে কোনো প্রতিজ্ঞা করেছিলেন এবং তা পালন করার জন্য গিয়েছেন । তিনি হয়তো আধ্যাত্বিক কোনো ব্যাক্তির কাছে গিয়েছেন কিংবা হয়তো তার কোনো জটিল রোগ, যেমন কুষ্ঠব্যাধি, ছিল । এছাড়া এমনও হতে পারে যে তিনি পরিবারের জন্য এ কাজ করেছেন এবং একই সঙ্গে আশেপাশে কোথাও অন্তরালে থাকতে চেয়েছেন ।

নদীতে চলাচলকারী পর্যটক এবং দুই তীরের বাসিন্দারা বলেছে যে, রাতে বা দিনে তারা কখনই বাবাকে নদীর পাড়ে হাঁটতে দেখেনি । তিনি শুধু দিগভ্রান্ত এবং উদ্বাস্তুর মতো নদীর বুকে নৌকায় একাকী ঘুরে বেরিয়েছেন । মা এবং আমাদের আত্মীয়-স্বজনের ধারনা যে, বাবা যেটুকু খাদ্য সঙ্গে করে নিয়েছেন, তা ফুরিয়ে গেলে তিনি অবশ্যই তীরে ফিরে আসবেন, অথবা অন্য কোনো অচিন জায়গায় যাবেন (নিদেন হলেও এটা অন্যগুলোর তুলনায় অনেকটা সম্মানজনক), নতুবা তিনি ভুল স্বীকার করবেন এবং ক্ষমা চেয়ে বাড়ি ফিরে আসবেন ।

কিন্তু আসল সত্য থেকে এসব চিন্তা কতটুকু দূরে ! খাবার-দাবারের জন্য বাবার একটা গোপন সূত্র আছে এবং সেই গোপন সূত্র আমি । প্রতিদিন চুরি করে আমি তার কাছে খাবার নিয়ে যেতাম । যেদিন বাবা চলে গেলেন, সেই প্রথম রাতে আমরা নদীর ধারে আগুণ জ্বালিয়ে বাবার জন্য বিশেষ প্রার্থনা করেছি এবং চিৎকার করে বাবাকে ডেকেছি । আমরা সবাই শোকে খুবই বিষাদগ্রস্ত ছিলাম এবং আমার মনে হয়েছিল এত কিছু করার পরেও আরো অন্যকিছু করা অত্যন্ত জরুরী ছিল । পরদিন আমি একটা ভুট্টার রুটি, এক ছড়া পাকা কলা এবং কয়েক টুকরো বাদামী চিনি নিয়ে একা নদীর তীরে যাই । অধৈর্য্য হয়ে আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি । হঠাৎ একসময় আমি অনেক দূরে নদীতে নৌকা ভাসতে দেখেছি । শান্ত নদীতে ভাসমান সেই নৌকাটি অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল । বাবা নৌকার নিচে বসেছিলেন । তিনি আমাকে দেখতে পেয়েছিলেন । কিন্তু তারপরেও নৌকা চালিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসেননি, এমনকি কোনো অঙ্গ-ভঙ্গিও করেননি । আমি হাত উপরে তুলে খাবার দেখাই এবং তারপর নদীর তীরে একটা গর্তের মতো জায়গায় খাবার রেখে ফিরে আসি । জায়গাটা মোটামুটি আড়ালে-আবডালে ছিল এবং কোনো জন্তু-জানোয়ারের দৃষ্টিগোচর হওয়ার কথা নয় । এছাড়া রোদ-বৃষ্টি এবং শিশির থেকে খাবার রক্ষা করার জন্য নিরাপদ জায়গা ছিল । আমি দিনের পর দিন একই কাজ করেছি । পরে আমি বুঝতে পেরেছি যে, মা আমার কর্মকান্ড জানতে পেরেছিলেন । তবে জানার পর থেকে তিনি রান্নাঘরে এমন জায়গায় খাবার রাখতেন যেন আমি সহজে চুরি করে বাবার জন্য নিয়ে যেতে পারি । আসলে বাবার প্রতি মায়ের ভীষণ দূর্বলতা ছিল, কিন্তু তিনি তা কখনো প্রকাশ করতেন না।

আমাদের বাড়িতে মামাকে আসার জন্য মা লোক পাঠিয়েছেন এবং আসার পর থেকে মামা খামারে সাহায্য এবং ব্যবসা দেখাশনা শুরু করেন । বাবার সেই অন্তর্ধানের সময় আমাদের লেখাপড়ার ক্ষতি সামলে নেওয়ার জন্য মা বাড়িতে একজন গৃহশিক্ষিকা নিয়োগ করেন । একদিন সেই শিক্ষিকার অনুরোধে স্থানীর ধর্মযাজক ধর্মীয় পোশাক পরিধান করে নদীর তীরে যান এবং বাবার কাঁধে ভর করা শয়তানকে বিতারিত করার জন্য ঝাড়ফুঁক এবং বিশেষ প্রার্থনা করেন । তারপর তিনি চেঁচিয়ে বলেন যে, অপশক্তির হাত থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার জন্য বাবার দায়বদ্ধতা আছে । এছাড়া বাবাকে ভয় দেখানোর জন্য আমাদের গৃহশিক্ষিকা অন্য আরেকদিন দু’জন সৈনিককে ডেকে আনেন । গৃহশিক্ষিকার সব চেষ্টা বিফলে গেছে । বাবা অনেক দূরে চলে গেছেন । কখনোবা তাকে অস্পষ্ট দেখা যেত । তিনি কারোর ডাকে সাড়া দেননি এবং কেউ তার কাছাকাছি যেতে পারেনি । যখন সংবাদপত্রের কয়েকজন লোক এসে বাবার ছবি তুলতে চেয়েছিল, তখন বাবা নৌকা চালিয়ে নদীর উল্টোদিকে আরো দূরে ঝোপঝাড়ের আড়ালে চলে গেছেন । সেই ঝোপঝাড় সম্পর্কে বাবা সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন, কিন্তু সেখানে অনায়াসে অন্যদের হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি ছিল । সেখানে বিস্তীর্ণ জায়গায় বাবা একধরনের গোলকধাঁধা তৈরি করে রেখেছিলেন, যা কয়েক মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং পাতা দিয়ে ঘেরা ঘন ছাউনিতে ঢাকা ছিল । সেখানে গোপন আস্তানায় তিনি নির্ভার ছিলেন ।

বাবা নৌকা নিয়ে নদীতে গেছেন – এই কথাটি মেনে নিয়ে আমাদের অভ্যস্ত হতে হয়েছে । অবশ্যই আমাদের মেনে নিতে হয়েছে, কিন্তু পুরোপুরি মেনে নিতে পারিনি এবং কখনই পারবো না । আমার মনে হয় আমিই একমাত্র ব্যাক্তি যে বাবার মনের গোপন কথা কিঞ্চিত হলেও বুঝতে পারে এবং তিনি যা চান না, তা-ও । তবে আমি আদৌ যা বুঝতে পারিনি, তাহলো তিনি কেমন করে এই কঠিন জীবন মোকাবেলা করছেন । দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর বাবা মাথায় শুধু একটা টুপি এবং যৎসামান্য কাপড়-চোপড় নিয়ে অবলীলায় দিন এবং রাত, রোদ এবং বৃষ্টি, প্রচন্ড গরম এবং বছরের মাঝামাঝি ভয়ংকর শীতের সময় কাটাচ্ছেন । তার জীবন থেকে নীরবে সময় চলে যাচ্ছে । ঘটনার পর থেকে তিনি কখনই কোনো দ্বীপ বা মূল ভূখন্ডের মাটি কিংবা সবুজ ঘাস স্পর্শ করেননি । কোনো সন্দেহ নেই যে, কখনও তিনি কোনো অজানা দ্বীপের গোপন জায়গায় নৌকা বেঁধে ঘুমিয়ে নেন । কখনই তিনি আগুন জ্বালাননি, এমনকি দেশলাইয়ের কাঠি নিয়ে ঘষাঘষি করেননি । এছাড়া তার সঙ্গে কোনো ফ্ল্যাশবাতিও নেই । তিনি শুধু অল্প পরিমানে খাবার নিয়ে গেছেন, যা আমি নদীর পাড়ে গর্তের ভেতর রেখে এসেছিলাম । বেঁচে থাকার জন্য সেই খাবার পর্যাপ্ত পরিমানে ছিল না । তাহলে এখন তার শরীর কেমন আছে ? এতদিন নৌকার দাঁড় টেনে নিশ্চয়ই তার স্বাস্থ্যের অনেক অবনতি হয়েছে ? এছাড়া কেমন করে তিনি বাৎসরিক বন্যার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করেন, যখন নদীর দু’কূল ছাপিয়ে দুরন্ত পানি ছুটে চলে এবং সেই দুরন্ত স্রোত গাছের ভাঙা ডালপালা ও মৃত জন্তু-জানোয়ার ভাসিয়ে নিয়ে যায় ?

চলে যাওয়ার পর থেকে বাবা কখনই কোনো জীবন্ত প্রাণীর সঙ্গে কথা বলেননি । আমরাও তার সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করিনি । আমরা শুধু তাকে আপনমনে ভেবেছি । না, আমাদের ভাবনা-চিন্তা থেকে বাবাকে কখনও বাদ দিইনি । তবে অনেক সময় হয়তো বাবার কথা আমাদের মন থেকে উধাও হয়ে যেত, কিন্তু তা ছিল স্বল্প সময়ের জন্য । কিন্তু তার সংগ্রামী জীবনের কথা মনে হলেই আমরা আবার সচেতন হয়ে যেতাম ।

আমার বোনের বিয়ে হয়েছে । সেই বিয়েতে মা কোনো অনুষ্ঠান করতে চাননি । কেননা সে-টা খুবই মন-খারাপের ঘটনা হতো । আমরা যখন কোনো ভালো খাবার খাই, তখনই বাবার কথা আমাদের মনে পড়ে । প্রচন্ড শীতের অথবা তুমুল ঝড়ের রাতে যখন আমরা নরম বিছানায় শুয়ে থাকি, তখন বাবার অনুপস্থিতি গভীর ভাবে অনুভব করি । সেই দুর্যোগের সময় তিনি একাকী নৌকা সামাল দিতে হিমশিম খান । কখনো কখনো কেউ বলে যে, আমাকে দেখতে নাকি অনেকটা বাবার মতো লাগে । কিন্ত আমি জানি, এতদিনে বাবার চুল এবং দাঁড়িতে জট বেঁধেছে এবং হাতের নখ বড় হয়েছে । আমার মনের ক্যানভাসে আমি বাবার ভাঙাচোরা মলিন চেহারার ছবি আঁকি, যে ছবিতে তার ছিপছিপে দেহের গড়ন এবং তিনি প্রায় উলঙ্গ । কেননা মাঝেমাঝে আমি তার জন্য যেসব কাপড়-চোপড় রেখে এসেছি, তা মোটেও পর্যাপ্ত ছিল না ।

আমাদের নিয়ে বাবা আদৌ কোনো ভাবনা-চিন্তা করতেন না । কিন্তু তার প্রতি আমি একধরনের গভীর টান অনুভব করতাম, এমনকি তার প্রতি আমার অফুরন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল । সবাই যখন ভালো কাজের জন্য আমাকে প্রশংসা করতো, তখন আমি বলতামঃ ‘বাবা এভাবেই আমাকে শিখিয়েছেন ।’

আসলে ব্যাপারটা ঠিক এরকম ছিল না । তবে বলা যায়, সে-টা ছিল একধরনের বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যা । আমি আগেই বলেছি, বাবা আমাদের নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা করতেন না । তাহলে কেনো তিনি এত বছর সংসারের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন ? এতদিন কেনো তিনি নদীতে যাননি, তাহলে তো আমাদের দেখা-সাক্ষাত বন্ধ হতো না ? আসলে এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব একমাত্র তিনিই ভালো জানেন ।

আমার বোনের একটা ছেলে হয়েছে । বাবাকে তার শিশু নাতিকে দেখানোর জন্য আমার বোন খুবই পীড়াপিড়ি করে । এক সুন্দর দিনে আমরা সবাই মিলে নদীর ধারে যাই । সেদিন বোনের পড়নে ছিল তার বিয়ের সাদা পোশাক । সে দু’হাতে শিশু ছেলেকে উঁচু করে তুলে ধরেছে । বোনের স্বামী তাদের মাথার ওপর একটা ছাতা মেলে দিয়েছে । আমরা চিৎকার করে বাবাকে ডাকি এবং অপেক্ষা করি । তিনি আমাদের ডাকে কোনো সাড়া দেননি । সেদিন আমার বোন ভীষণ কেঁদেছিল । আমরা সবাই একজন আরেকজনের বাহুতে মুখ রেখে ভীষণ কেঁদেছি ।

বিয়ের পর আমার বোন তার স্বামীর সঙ্গে অনেক দূরে চলে যায় । বসবাসের জন্য আমার ভাইও শহরমুখী হয় । দ্রুততার সঙ্গে সময় বদলে গেছে । অবশেষে মা-ও চলে যান । তিনি বুড়ো হয়েছেন এবং তার মেয়ের কাছে চলে গেছেন । শুধু আমি পেছনে পড়েছিলাম, উচ্ছ্বিষ্টের মতো । আমি কখনই নিজের বিয়ের কথা ভাবিনি । আমার জীবনের সংগৃহীত লটবহর নিয়ে আমি একই জায়গায় থেকেছি । বাবা, বাউন্ডুলের মতো নদীতে একাকী হারিয়ে গিয়েছেন, হয়তো আমাকে চান । আমি জানতাম, তিনি আমাকে চাইবেন । আমাকে কখনো বলেননি যে, তিনি কেন এহেন কান্ডজ্ঞানহীন কাজ করেছেন । আমি যখন সবার কাছে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করি, তখন তারা সবাই এক বাক্যে বলেছে যে বাবা নাকি নৌকার মিস্ত্রিকে সব কথা বলে গিয়েছেন । কিন্তু এখন সেই মিস্ত্রি মৃত । তাই বাবার মনের কথা কেউ জানে না । একনাগাড়ে তুমুল বৃষ্টি পতনের সময় বোকার মতো অনেক আজেবাজে কথা হয়েছে। যেমন বাবা নাকি নূহের মতো জ্ঞানী ছিলেন এবং আসন্ন বন্যার কথা ভেবে নৌকা বানিয়েছিলেন । এসব ফালতু কথাবার্তা এখন আমার আবছা মনে পড়ে । যাহোক, এত ঘটনার পরেও আমি আমার বাবাকে কোনো দোষ দিই না । ইতিমধ্যে আমার চুলেও শুভ্রতার হাওয়া লেগেছে ।

বলার মতো আমার মনে ভেতর শুধু দুঃখের কথা জমা হয়ে আছে । আমি কি কি কাজ করেছি ? আমার এমন কি অপরাধ ? বাবা সবসময়ই আমাদের কাছ থেকে দূরে থেকেছেন এবং তার এই দীর্ঘ অনুপস্থিতি কেবল আমাকেই পীড়া দেয় । নদী, সে-তো নদীই । তবুও তার মধ্যে জোয়ার-ভাঁটার নিত্য আসা-যাওয়া আছে । নদী, শুধু নদী । বার্ধক্য জনিত রোগবালাই আমাকে চারপাশ থেকে আঁকড়ে ধরেছে, যা হয়তো জীবনকে সামান্য টেনে নিয়ে শেষপ্রান্তে যাবে । বিভিন্ন ধরনের অসুখ এবং দুশ্চিন্তা আমার নিত্যদিনের সঙ্গী । আমার অসহ্য বাতের ব্যথা । কিন্তু তার ? তিনি কেন এমন কাজ করেছেন ? নিশ্চয়ই তিনি মারাত্বক কোনো রোগশোকে ভুগছেন । ইতিমধ্যে তিনি আরোও বৃদ্ধ হয়েছেন । একদিন হয়তো তিনি সেই ভাঙা শরীরে নৌকা সামাল দিতে পারবেন না । তখন নৌকা ডুবে গেলেও তার কিছু করার থাকবে না । এমনও হতে পারে যে তিনি হয়তো নৌকাটি ভাটির অভিমুখে ছেড়ে দিয়েছেন । হয়তো একসময় সেই নৌকা অজানা কোথাও গিয়ে থামবে । একথা মনে হলে আমার বুক ধ্বক করে ওঠে । বাবা দূরে চলে গেছেন, কিন্তু সঙ্গে করে আমার জীবনের সমস্ত সুখ-শান্তিও নিয়ে গিয়েছেন । ঘটনার নেপথ্য কাহিনী না-জানার জন্য আমি নিজেকে অপরাধী মনে করি এবং কষ্টটা আমার বুকের ভেতরে অহরহ গুমড়ে ওঠে । হয়তো ঘটনা অন্যরকম হলে আমি জানতে পারতাম । তাই আমি সন্দেহ করা আরম্ভ করি ।

আমি কি পাগল হয়ে গেছি ? না, আমাদের ঘরে এই শব্দটা কোনোদিন উচ্চরিত হয়নি । কেউ কাউকে পাগল বলে সম্বোধন করেনি । হয়তো আমরা সবাই পাগল ছিলাম । তাই একজন অন্যজনকে বুঝতে পারিনি । যাহোক, আমি নদীর তীরে যাই এবং হাতে রুমাল উঁচিয়ে এমন ভঙ্গিতে ইশারা করি, যেন বাবা আমাকে দেখতে পারেন । আমি ছিলাম একা, নিজেই নিজের নিয়ন্ত্রক । আমি দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছি । অবশেষে অনেক দূরে বাবার ছায়া উদয় হয় এবং নৌকার পেছনের দিকে বসা অবস্থায় আমি একটা অস্পষ্ট ছায়া দেখতে পাই ।

‘বাবা, আপনি অনেকদিন ধরে ওখানে আছেন । ঢের হয়েছে । আপনি বুড়ো হয়েছেন । ফিরে আসুন । আপনাকে কিছু করতে হবে না । আপনি ফিরে আসুন । প্রয়োজন হলে আমি যাবো । আপনি চাইলে এখনই যাবো । আমি নৌকায় গিয়ে আপনার আসন গ্রহণ করবো ।’

আমি যখন এ কথাগুলো বললাম, তখন আমার বুকের ধুকপুকানি আরো বেশি জোরে শুরু হলো ।

আমার কথা বাবা শুনতে পেয়েছেন এবং একসময় উঠে দাঁড়ালেন । তারপর নৌকা ঘুরিয়ে তিনি আমার দিকে দাঁড় টানতে থাকেন । নিশ্চয়ই তিনি আমার প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন । হঠাৎ আমার সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠে । বাবা আমার দিকে হাত উঁচিয়ে নাড়ছেন । অনেক বছর বাদে এই প্রথম তিনি সাড়া দিলেন । এক অলৌকিক ভয়ে আমার মাথার সব চুল খাঁড়া হয়ে গেছে । আমি উদভ্রান্তের মতো তার দিকে দৌঁড়ুতে থাকি । আমার মনে হলো, তিনি যেন ভিন্ন পৃথিবী থেকে ফিরে আসছেন । আমি চিৎকার করে তার কাছে ভিক্ষা চাইছি, আমাকে মাফ করুন, ক্ষমা করুন, ক্ষমা করুন ।

সেই ভয়ংকর ভয় এবং আতঙ্ক থেকে আমার সমস্ত শরীর হিমশীতল হয়ে যায় এবং আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি । তারপর থেকে আমরা কেউ কখনো বাবার দর্শণ লাভ করিনি । সেই ব্যর্থতার পরও কি আমি একজন পুরুষ ? আসলে আমি তাই, যা কোনোদিন থাকার কথা ছিল না । আমি রীতিমতো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি । জানি, বড্ড দেরি হয়ে গেছে । জীবন চলার পথে আমার নিঃসঙ্গ থাকাই উচিত । তবে আমাকে নেওয়ার জন্য যখন মৃত্যু এসে সামনে দাঁড়াবে, তখন আমি মৃত্যুকে বলবো আমাকে যেন একটা নৌকার মধ্যে রেখে এই বিস্তীর্ণ পানিতে ভাসিয়ে দেয় । আমি নদীর বুকে হারিয়ে যাবো, তলিয়ে যাবো গভীরে, অতলে ... ।



লেখক পরিচিতিঃ
বিংশ শতাব্দির ব্রাজিলের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্প লেখক জায়ও গিমারিস রোসার জন্ম মিনাস জিরাইস প্রদেশের কর্দিসার্গোতে, ১৯০৮ সালের ২৭ জুন । দাদীর মুখে গল্প-কাহিনী শোনা থেকে তিনি লোকসাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন । মাত্র ষোল বছর বয়সে মিনাস জিরাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৩২ সালে স্বেচ্ছাসেবী ডাক্তার হিসাবে প্রত্যাঞ্চলে কর্মজীবন শুরু করেন । তার লেখার মূল বিষয় ছিল শ্বেতাঙ্গ এবং আদিবাসীদের মধ্যে ব্যবধান, নাগরিক এবং গ্রামীন জীবনের পার্থক্য এবং অস্থিরতা ও প্রকৃতিস্থতা । এছাড়া তিনি তার লেখায় আধুনিক ব্রাজিলের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা একসময়ের অন্ধকার বিষয়গুলো উন্মোচিত করেছেন । ‘দ্য ডেভিল পে ইন দ্য ব্যাকল্যান্ডস্’ (১৯৫৬) তার সফল উপন্যাস । তার প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘সাগারানা’ (১৯৪৬) প্রকাশের মাধ্যমে তিনি লেখক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন । তবে তার বিখ্যাত ছোটগল্প সংকলন হলো ‘দ্য থার্ড ব্যাঙ্ক অফ দ্য রিভার এন্ড আদার স্টোরিজ’ (১৯৬২) । তিনি ১৯৫৮ সালে ভয়ঙ্কর হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং পরবর্তীতে তার জীবন-দর্শণ এবং লেখালেখির ধরণ (স্টাইল) পাল্টে যায় । অনেকে মনে করেন তার লেখায় আইরীশ লেখক জেমস্ জয়েসের (১৮৮৪-১৯৪১) প্রভাব রয়েছে । তিনি ১৯৬৩ সালে ‘ব্রাজিল একাডেমী অফ লেটারস্’-এর সম্মানিত প্রধান পদে নির্বাচিত হন । মাত্র ৫৯ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৯৬৭ সালের ১৯ নভেম্বর রিও ডি জেনিরোতে দেহত্যাগ করেন ।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ