জনপ্রিয় মার্কিন কথাসাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনার(১৮৯৭-১৯৬২)সাহিত্যে নোবেল ও পুলিৎজার পুরস্কারসহ পেয়েছেন বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার। মার্কেসের মতো বহু বিখ্যাত লেখকদের প্রিয় লেখক ছিলেন তিনি। এখনো বিশ্বব্যাপী তার বই গুরুত্বসহকারে পঠিত হয়। ফকনার জীবন শুরু করেন কবিতা লিখে। এদের কিছু প্রকাশিতও হয়। ১৯২১ সালে তাঁর লেখা একটি নাটক মঞ্চায়িত হয়। ১৯২৪ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়। ১৯২৫ সালে তাঁর সাথে শেরউড অ্যান্ডারসনের সাক্ষাৎ হয়।
অ্যান্ডারসন তাঁকে কল্পকাহিনী লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। অন্যান্য মার্কিন লেখকদের অনুসরণ করে ১৯২৫ সালে ফকনার ছয় মাসের জন্য ইউরোপ সফর করে আসেন। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসে তিনি মনোযোগ দিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। ১৯২৬ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস বেরোয়, ১৯২৭ সালে বের হয় দ্বিতীয়টি। সার্টোরিস নামের তৃতীয় উপন্যাসটি ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৩০ ও ১৯৪০—এর দশকের শুরুর দিকে ফকনার চিত্রনাট্যলেখক হিসেবে হলিউড গিয়েছিলেন। জীবনের বাকী সময় তিনি অক্সফোর্ডে গল্প ও উপন্যাস লিখে কাটিয়ে দেন।
প্যারিস রিভিউতে প্রকাশিত ফকনারের সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হল।
অনুবাদ করেছেন কথাসাহিত্যিক মোজাফফর হোসেন
একদম না। কখনো কখনো কৌশলই আপনাকে আদর্শ শিল্পের দিকে চালিত করবে। কারণ আপনি শব্দ, বাক্য, গল্পটা জানেন। কৌশলচালিত হয়ে সেগুলো আপনি শক্তভাবে একটার পর একটা বসিয়ে যাবেন। যেটি ঘটেছে এজ আই লে ডাইং এর ক্ষেত্রে। তবে কাজটা মোটেও সহজ না। আবার সহজ এই অর্থে যে, সব মাল-মশলা আমার হাতেই ছিল। এটা শেষ করতে আমার ছয় সপ্তাহ লেগেছে। তাও অবসরে কাজটা করা। আমি কেবল একদল মানুষ কল্পনা করেছি, তাদের পৃথিবীর চিরায়ত গতির মধ্যে ফেলে দিয়েছি। আমার কাছে, লিখতে লিখতে চরিত্ররা জেগে ওঠে, নেতৃত্ব দখল করে। আমি একপৃষ্ঠা আগে বই শেষ করলে জানব না, পরের পৃষ্ঠায় কি ঘটত। নিজের কাজ মূল্যায়নের সময় শিল্পীকে অবশ্যই নৈর্ব্যক্তিক হতে হবে। আমার কোনো কাজই আমার আদর্শমানকে স্পর্শ করতে পারেনি, তাই লেখার যে দিকটি আমাকে অতৃপ্ত করে তোলে সেই দিকটি ধরে মূল্যায়ন করতে হবে। যেভাবে মা তার পুরোহিত ছেলের চেয়ে বকে যাওয়া ছেলেকে বেশি ভালোবাসে।
আমি অনুপ্রেরণা বলতে কি বোঝায় জানি না। আমি এটা সম্পর্কে শুনেছি কিন্তু প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ পাইনি।
অ্যান্ডারসন তাঁকে কল্পকাহিনী লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। অন্যান্য মার্কিন লেখকদের অনুসরণ করে ১৯২৫ সালে ফকনার ছয় মাসের জন্য ইউরোপ সফর করে আসেন। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসে তিনি মনোযোগ দিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। ১৯২৬ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস বেরোয়, ১৯২৭ সালে বের হয় দ্বিতীয়টি। সার্টোরিস নামের তৃতীয় উপন্যাসটি ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৩০ ও ১৯৪০—এর দশকের শুরুর দিকে ফকনার চিত্রনাট্যলেখক হিসেবে হলিউড গিয়েছিলেন। জীবনের বাকী সময় তিনি অক্সফোর্ডে গল্প ও উপন্যাস লিখে কাটিয়ে দেন।
প্যারিস রিভিউতে প্রকাশিত ফকনারের সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হল।
অনুবাদ করেছেন কথাসাহিত্যিক মোজাফফর হোসেন
জীন স্টীন--
আপনি বলছিলেন, সাক্ষাৎকার দেয়াটা পছন্দ করেন না?
উইলিয়াম ফকনার--
এটা বলার কারণ হল, আমি ব্যক্তিগত বিষয়ে উত্তর দিতে পছন্দ করি না। আমার কাজ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, আমি তার উত্তর দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু আমার সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে উত্তর নাও দিতে পারি। যদি দিইও, তবে একই প্রশ্ন আগামীকাল জিজ্ঞেস করলে আমি হয়ত ভিন্ন উত্তর করব।
জীন স্টীন--
যদি একজন লেখক হিসেবে আপনার সম্পর্কে আমি জানতে চাই?
উইলিয়াম ফকনার--
যদি লেখক হিসেবে আমার অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে অন্য কেউ আমার লেখাগুলো লিখতেন। হেমিংওয়ে-দইয়েফস্কি—সবার ক্ষেত্রেই আমি একই কথা বলব। তার প্রমাণ হল শেসকপিয়ারের নাটকের লেখক হিসেবে আমরা তিনজন প্রার্থীর নাম জানি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, হ্যামলেট, মিডসামার’স নাইট ড্রিম, কে লিখলো সেটি না; কেউ না কেউ লিখতই। শিল্পী গুরুত্বপূর্ণ নন, শিল্পকর্ম গুরুত্বপূর্ণ; যেহেতু নতুন করে আর কিছু বলবার নেই। শেকসপিয়ার, বালজাক, হোমার সকলে প্রায়ই এক বিষয়েই লিখেছেন। এবং তারা যদি আরো হাজার বছর বেঁচে থাকতেন, তাহলে প্রকাশকদের বই প্রকাশের জন্য নতুন লেখকের দরকার হত না।
জীন স্টীন--
যদি নতুন করে কিছু বলার নাও থাকে, তারপরও একজন লেখকের স্বকীয়তা কি গুরুত্বপূর্ণ না?
উইলিয়াম ফকনার--
হুম। তার নিজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যরা তার কাজ নিয়ে এত মগ্ন থাকবে যে ব্যক্তি সেখানে উপলক্ষ হয়ে থাকবে মাত্র।
জীন স্টীন--
সমসাময়িকদের ক্ষেত্রে?
উইলিয়াম ফকনার--
আমরা সকলে আমাদের পারফেকশন নিয়ে যে স্বপ্ন সেটি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। এই অসম্ভবের কাছে পৌঁছানোর যে বিশাল ব্যর্থতা তা দিয়েই আমি আমাদের মূল্যায়ন করি। আমার মতে, আমি যদি আমার লেখাগুলো আবার নতুন করে লিখতে পারতাম, আমি নিশ্চিত যে সেগুলো আরো ভালো হত। একজন শিল্পীর জন্যে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে শিল্পীরা কাজ করতে থাকেন, নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যান। প্রতিবারেই তিনি মনে করেন, এবার তিনি পারবেন। কিন্তু যথারীতি ব্যর্থ হন। আমি একজন ব্যর্থ কবি। হতে পারে প্রত্যেক ঔপন্যাসিক প্রথমে কবিতা লিখতে চান, দেখেন যে হচ্ছে না, এরপর ছোটগল্প লেখেন, কবিতার পর সবচেয়ে আবেদনময়ী সাহিত্যবিভাগ এটি। এরপর এখানেও ব্যর্থ হয়ে তিনি উপন্যাস লিখতে শুরু করেন।
জীন স্টীন--
ভালো ঔপন্যাসিক হওয়ার জন্যে কি কোনো সম্ভাব্য সূত্র আছে?
উইলিয়াম ফকনার--
৯৯ শতাংশ মেধা। ৯৯ শতাংশ নিয়মবর্তিতা। ৯৯ শতাংশ অধ্যবসায়। লেখককে তার লেখা নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়া চলবে না। এটা কখনই যত ভালো হওয়া সম্ভব, তত ভালো হয় না। তুমি তোমার সাধ্যের বাইরে স্বপ্ন দেখো। নিজে যা আছ, তার চেয়ে ভালো হওয়ার চেষ্টা করো। শিল্পীরা হল শয়তান তাড়িত সৃষ্টিসত্তা। সে তার কাজ সম্পূর্ণ করার জন্যে হেন কাজ নেই করবে না—চুরি, ডাকাতি, কর্জ, ভিক্ষা—সব।
জীন স্টীন--
আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, লেখকদের ছন্নছাড়া-নিষ্ঠুর হতে হবে?
উইলিয়াম ফকনার--
লেখকের একমাত্র দায়িত্ববোধ ও দায়বদ্ধতা হল তার শিল্পের প্রতি। সে ভালো লেখক হলে তাকে নির্মম হতেই হবে। তার একটি স্বপ্ন আছে। সেই স্বপ্ন তাকে এমনভাবে তাড়িত করে যে, যে-কোনো উপায়ে সে তা থেকে মুক্তি খোঁজে।
জীন স্টীন--
তবে কি সুখ-সম্মান থেকে দূরে থাকা শিল্পীর সৃজনশীলতার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ?
উইলিয়াম ফকনার--
না। এগুলো কেবল শান্তি এবং আত্মতৃপ্তির জন্য দরকার। শিল্পের সঙ্গে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই।
জীন স্টীন--
তাহলে শিল্পীর জন্যে কোন ধরনের পরিবেশ অনুকুল বলে বিবেচিত হতে পারে?
উইলিয়াম ফকনার--
উৎকৃষ্ট শিল্পসৃষ্টির সঙ্গে নির্দিষ্ট করে কোনো পরিবেশের সম্পর্ক নেই। শিল্প কোনো অবস্থান বা পরিস্থিতি সাপেক্ষ তৈরি হয় না। যদি কেউ আমাকে সবচেয়ে ভালো কোনো চাকরি অফার করত, তাহলে সেটি হত কোনো ব্রোথেলের মালিক হওয়া। আমার মতে, একজন শিল্পীর জন্যে কাজ করার এটাই সেরা জায়গা। সে এখানে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পাবে। ক্ষুধা ও ভয় তাকে তাড়া করবে না। তার মাথার ওপর নিরাপদ ছাদ থাকবে। মাঝে মধ্যে পুলিশকে টুকটাক ঘুস দেয়া ছাড়া কোনো ঝামেলা থাকবে না। সকালের দিকে জায়গাটি নীরব-শান্ত থাকবে, শিল্পীর কাজ করার জন্যে এর চেয়ে উপযুক্ত সময় আর হতে পারে না। সন্ধ্যায় বিরক্ত হলে কথাবলার অনেক মানুষ পাবে। নারীরা তার গৃহ দেখাশুনা করবে, স্যার বলে সম্বোধন করবে। আর সে পুলিশদের নাম ধরে ডাকবে।
জীন স্টীন--
আপনি বলছেন অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা। এটা লেখকের জন্য কতটা অপরিহার্য?
উইলিয়াম ফকনার--
না, লেখকের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রয়োজন নয়। তার যেটা দরকার সেটা হল কাগজ আর কলম। হঠাৎ অর্থাগমের কারণে লেখায় উন্নতি ঘটে বলে আমি মনে করি না। ভালো লেখকরা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার জন্যে মুখিয়ে থাকেন না। তিনি লেখালেখি নিয়েই সদা ব্যস্ত থাকেন। ভালো শিল্প চোর-বাটপার-মুচির কাছ থেকেও আসতে পারে। লোকজন হয়ত কতটা অর্থাভাব ও পরিশ্রম সহ্য করতে পারবে, সেটা ভেবে চিন্তিত হয়। কোনোকিছুই আসলে একজন ভালো লেখককে ধ্বংস করতে পারে না। একমাত্র মৃত্যুই পারে লেখকের অবসান ঘটাতে। প্রকৃত শিল্পীদের ধনী হওয়া কিংবা সফল হওয়া এসব নিয়ে ভাবনার সময় থাকে না। সফলতা অনেকটা নারীসুলভ বিষয়। যদি তুমি তার কাছে নত হও, তাহলে সে তোমার মাথায় উঠে নাচবে। তাই উচিত হবে তাকে হাতের উল্টোপিঠ দেখানো, তাতে করে সে নত হয়ে ধরা দেবে।
জীন স্টীন--
আপনি আপনার কাঙ্খিত আদর্শে পৌঁছানোর জন্যে কোন ধরনের কৌশল ব্যবহার করেন?
উইলিয়াম ফকনার--
ভালো লেখা বের করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। কোনো শর্টকাট এখানে কাজে দেবে না। তরুণ লেখকরা যদি কোনো তত্ত্ব অনুসরণ করে, তাহলে বড় ধরনের ভুল করবে। নিজের ভুল থেকে শেখো। একমাত্র নিজের ভুল থেকেই শেখা সম্ভব। ভালো শিল্পীরা বিশ্বাস করে, কারো উপদেশই তার জন্য যথেষ্ট নয়। তার একটা আত্মসম্মানবোধও থাকে। অগ্রজ লেখকদের সে যতই শ্রদ্ধা করুক, সে আসলে তাদের পরাজিত করতে চায়।
জীন স্টীন--
তবে কি আপনি কৌশলের বিষয়টিকে উড়িয়ে দেবেন?
একদম না। কখনো কখনো কৌশলই আপনাকে আদর্শ শিল্পের দিকে চালিত করবে। কারণ আপনি শব্দ, বাক্য, গল্পটা জানেন। কৌশলচালিত হয়ে সেগুলো আপনি শক্তভাবে একটার পর একটা বসিয়ে যাবেন। যেটি ঘটেছে এজ আই লে ডাইং এর ক্ষেত্রে। তবে কাজটা মোটেও সহজ না। আবার সহজ এই অর্থে যে, সব মাল-মশলা আমার হাতেই ছিল। এটা শেষ করতে আমার ছয় সপ্তাহ লেগেছে। তাও অবসরে কাজটা করা। আমি কেবল একদল মানুষ কল্পনা করেছি, তাদের পৃথিবীর চিরায়ত গতির মধ্যে ফেলে দিয়েছি। আমার কাছে, লিখতে লিখতে চরিত্ররা জেগে ওঠে, নেতৃত্ব দখল করে। আমি একপৃষ্ঠা আগে বই শেষ করলে জানব না, পরের পৃষ্ঠায় কি ঘটত। নিজের কাজ মূল্যায়নের সময় শিল্পীকে অবশ্যই নৈর্ব্যক্তিক হতে হবে। আমার কোনো কাজই আমার আদর্শমানকে স্পর্শ করতে পারেনি, তাই লেখার যে দিকটি আমাকে অতৃপ্ত করে তোলে সেই দিকটি ধরে মূল্যায়ন করতে হবে। যেভাবে মা তার পুরোহিত ছেলের চেয়ে বকে যাওয়া ছেলেকে বেশি ভালোবাসে।
জীন স্টীন--
আপনার কাজ থেকে একটা উদাহরণ?
উইলিয়াম ফকনার--
The Sound and the Fury। আমি এটা পাঁচবার আলাদা আলাদা সময়ে লিখেছি। যে স্বপ্নটি আমাকে তাড়িত করেছে, সেটা থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত লিখে গেছি। ডিলসে আমার নিজের খুব পছন্দের চরিত্র। সে সাহসী, ভদ্র এবং সৎ চরিত্র। সে আমার চেয়ে সৎ-সাহসী এবং বিনয়ী।
জীন স্টীন--
আপনার লেখার কতভাগ ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ থেকে উৎসারিত?
উইলিয়াম ফকনার--
আমি বলতে পারবো না। আমি ঠিক ভেবে দেখিনি। কারণ সেটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে হয়নি। একজন লেখকের তিনটি জিনিসের প্রয়োজন পড়ে—অভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও কল্পনাশক্তি—এর যে কোনো একটার ঘাটতি থাকলে অন্যগুলোতেও টান পড়বে। আমার ক্ষেত্রে, একটা গল্প শুরু হয় একটা একক ধারণা, স্মৃতি বা মানসিক চিত্র থেকে। এরপর কোনো ঘটনা কেন ঘটল, তার ফলে আবার কি ঘটল এভাবে কাজটা এগিয়ে যায়।
জীন স্টীন--
কেউ কেউ বলে যে, আপনার লেখা বুঝতে পারেনি। এমনকি দুই থেকে তিনবার পড়ার পরও। তাদের উদ্দেশ্য করে আপনি কি কিছু বলবেন?
উইলিয়াম ফকনার--
চতুর্থ বারের মতোন পড়ুন।
জীন স্টীন--
আপনি লেখালেখির তিনটা অপরিহার্য উপাদানের কথা বললেন। এরসঙ্গে কি আপনি অনুপ্রেরণাকে যোগ করবেন?
উইলিয়াম ফকনার--
আমি অনুপ্রেরণা বলতে কি বোঝায় জানি না। আমি এটা সম্পর্কে শুনেছি কিন্তু প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ পাইনি।
জীন স্টীন--
লেখক হিসেবে আপনি নৃশংসতা-আসক্ত বলে অনেকে মন্তব্য করে।
উইলিয়াম ফকনার--
এটা বলা মানে হল, কাঠ মিস্ত্রি হাতুড়ে-আসক্ত বলা।
জীন স্টীন--
কিভাবে আপনি লেখালেখিটা শুরু করলেন?
উইলিয়াম ফকনার--
আমি তখন নিউ অরলিন্স এ বাস করি। বেঁচে থাকার জন্য সবধরনের ছোটখাটো কাজ করছি। সেখানে শেরউড অ্যান্ডারসনের সঙ্গে দেখা হয়। আমরা বিকেলে শহরটি নিয়ে আলাপ করতাম। শহরের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতাম। সন্ধ্যায় আবার আমাদের দেখা হত, আমরা বোতল নিয়ে বসতাম, তিনি বলতেন, আমি শুনতাম। সন্ধ্যার পর আর তার সঙ্গে দেখা হত না। সে নিজেকে সবকিছু থেকে সরিয়ে নিত। লিখত। এভাবে পরের দিন আবার আমাদের দেখা হত। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, যদি এই হয় লেখকের জীবন তাহলে আমাকে লেখক হতে হবে। তারপর আমি আমার প্রথম বইলেখা শুরু করি। লেখালেখিকে ভীষণ ভাবে উপভোগ করতে থাকলাম। ভুলেই গেলাম যে, তিন সপ্তাহের জন্য শেরউডের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়নি। এরপর একদিন সে নিজেই আমার ঘরের দরজার হাজির হল। ‘কি ব্যাপার? তুমি কি আমার ওপর রেগে আছ?’ সে বলল। আমি একটা বই লিখছি বলে জানালাম। ‘হায় ঈশ্বর!’ বলে সে বেরিয়ে গেল। Soldier’s Pay শেষ করে আমি রাস্তায় মিসেস এন্ডারসনের সঙ্গে দেখা করলাম। বইটি শেষ হয়েছে শুনে সে বলল, ‘শেরউড বলেছে যে, তোমার সঙ্গে সে একটি চুক্তি করবে। যদি তুমি তাকে তোমার পাণ্ডুলিপি পড়তে বাধ্য না করো, তবে সে তার প্রকাশককে বলবে বইটি প্রকাশ করে দিতে।’ আমি বললাম, ঠিক আছে। সেই থেকে আমি লেখক হয়ে গেলাম।
জীন স্টীন--
সেই সময় আপনি জীবনযাপনের জন্য কি ধরনের কাজ করতেন?
উইলিয়াম ফকনার--
যা পেতাম। নৌকা চালানো, বাড়ি রং করা, উড়োজাহাজ চালানো। আমার কেবল একটা ঘুমানোর জায়গা, কিছু খাবার, সিগারেট আর হুইস্কির বন্দোবস্ত করতে পারলেই হত। আমি চরিত্রগতভাবে বাউণ্ডুলে ছিলাম। পয়সার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে যাওয়ার মানুষ আমি না। সবচেয়ে কষ্টের কথা হল, মানুষ টানা আটঘণ্টা দিনের পর দিন যা করতে পারে তা হল কাজ। আপনি আট ঘণ্টা টানা খেতে পারবেন না, পান করতে পারবেন না, প্রেম করতে পারবেন না, যেটা আপনি পারবেন সেটা হল কাজ। যে কারণে মানুষ নিজেকে এত অসুখী করে তোলে।
জীন স্টীন--
তাহলে তো আপনি শেরউডের কাছে ঋণী? লেখক হিসেবে আপনি তাকে কিভাবে দেখেন?
উইলিয়াম ফকনার--
আমার প্রজন্মের আমেরিকার লেখকের তিনি পিতার মতো ছিলেন। আমরা যে ঐতিহ্য আমাদের মাঝে লালন করে চলেছি, সেটি তার কাছ থেকে পাওয়া। তিনি যথার্থভাবে মূল্যায়িত হননি। ড্রেইজার ছিল তার বড় ভাই আর মার্ক টোয়েন তাদের দুজনেরই বাবা।
জীন স্টীন--
সে সময়ে ইউরোপের বড় সাহিত্যিক কে কে ছিলেন?
উইলিয়াম ফকনার--
আমার সময়ে দুজন মহান সাহিত্যিক হলেন জয়েস এবং মান।
জীন স্টীন--
আপনি কি নতুন লেখকদের পড়েন?
উইলিয়াম ফকনার--
না। আমি ছোটবেলায় যে বইগুলো পড়েছি এবং তাদের প্রেমে পড়েছি, সেই বইগুলো পড়ি। এটা পুরনো বন্ধুর কাছে ফিরে যাওয়ার মতো অনুভূতি। ওল্ড টেস্টামেন্ট, ডিকেন্স, কনরাড, সার্ভেন্তেস, ফ্লবেয়ার, বালজাক আমি তাদের প্রতিবছর পড়ি। দস্তইয়েফস্কি, তলস্তয়, শেকসপিয়ার, মেলিভিলে—এদের আমি প্রায়ই পড়ি। একটি বই হাতে নিয়ে যেখানে ইচ্ছে সেখান থেকে শুরু করি। অল্প কিছু পড়ে রেখে দিই, যেন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করার মতো।
জীন স্টীন--
উপন্যাসের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার মত কি?
উইলিয়াম ফকনার--
আমার মনে হয়, যতদিন মানুষ উপন্যাস পড়বে, ততদিন লেখা হবে।
জীন স্টীন--
আর সমালোচকের ভূমিকা নিয়ে আপনার মন্তব্য?
উইলিয়াম ফকনার--
শিল্পীর সময় নেই সমালোচকের কথা শোনার।
জীন স্টীন--
তাহলে আপনি আপনার কাজ নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করা পছন্দ করেন না?
উইলিয়াম ফকনার--
না। আমি লেখালেখি নিয়েই ব্যস্ত আছি। যদি লিখে শান্তি পাই, তাহলে কারো সঙ্গে আলাপ করার প্রয়োজন নেই। আর যদি লিখে সন্তুষ্ট না হতে পারি তাহলে কারো সঙ্গে কথা বলে তার উন্নতি হবে না। উন্নতি ঘটবে সেটির ওপর কাজ করে গেলে। আমি কোনো সাহিত্য ব্যক্তি না, কেবলই লেখক। আমি কথা বলে কিংবা আড্ডা থেকে কোনো মজা পাই না।
1 মন্তব্যসমূহ
fine, interesting intervie
উত্তরমুছুন