লাকসাম রেলওয়ে স্টেশনের ওভারব্রিজের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মেয়েটি। সাধারণ বাঙালি মেয়েদের তুলনায় লম্বা। টানা টানা টলটলে চোখ দুটোতে বিষাদের ছায়া। একসময় চেহারায় জেল্লা ছিল, খুঁটিয়ে দেখলে আঁচ করা যায়। কিন্তু এখন যা অবস্থা, একবার তাকালে চোখ ফিরিয়ে নিতে হয়। লম্বা চুলে জট বাঁধতে শুরু করেছে। মলিন মুখে মেচতা আর চোখের নিচে কালি। পরনে নোংরা ডোরাকাটা শাড়ি। নিচে দাঁড়িয়ে-থাকা সারি সারি রেলগাড়ির দিকে ফাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মেয়েটি। পায়ের কাছে রাখা পুরনো একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ। ওভারব্রিজ দিয়ে লোকজনের ব্যস্ত চলাচল, কেউ খালি হাতে, কারও হাতে ব্যাগ, মাথায় বোঝা নিয়ে কুলি।
রাত ভালোই হয়েছে। হিমহিম বাতাস। পচা ইলিশের মত ঝাঁক ঝাঁক কুয়াশা ঝুলে আছে বাতাসের গায়। অঘ্রানের শেষ বোধ হয়। দিনের আয়ু এখন অনেক কম। ক’টা বাজে? মেয়েটি আন্দাজ করতে চেষ্টা করে। স্টেশনের লাউডস্পিকারে ঘোষণা শোনে, ‘৪ নম্বর ডাউন মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেন ২ নম্বর প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে আছে। রাত সোয়া নয়টায় ছেড়ে যাবে। যাত্রী সাধারণদের ...।’
ওভারব্রিজ থেকে স্টেশনের আশপাশের এলাকার আলোঝলমল দোকানপাট চোখে পড়ে। হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো থেকে হিন্দি গানের চড়া শব্দ ভেসে আসছে। লোকজন ছুটাছুটি করছে এদিক ওদিক।
অদূরে কোন এক ইসলামি জলসায় চলছে দরাজ গলায় ওয়াজ। একসময়কার হিন্দি ছবির হিট গান ‘চোলিকে পিছে কেয়া হ্যায়’ আর পবিত্র ওয়াজ-নসিহতের শব্দতরঙ্গ বাতাসে ধাক্কাধাক্কি করায় বিচিত্র এক শব্দজটের সৃষ্টি হয়েছে।
তীব্র হর্ন বাজিয়ে অতিকায় এক অজগরের মত ৪ নম্বর ডাউন ট্রেনটি সচল হয়, ক্রমশ গতি বাড়ে, একসময় গার্ডগাড়ির পেছনে লাগানো লাল বাতিটা ধীরে ধীরে দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায়।
মেয়েটির থেকে একটু দূরে এক ভিখারি পরম যত্নে তার সারাদিনের রোজগারের পয়সা গুনছিল। ভিখারির একমাথা উষ্কখুষ্ক চুল। রোদে পুড়ে গায়ের চামড়া কুচকুচে কালো। আদুড় গা। পরনে হাঁটু অব্দি গোটানো লুঙ্গি। উদোম শরীরের স্থানে স্থানে ছোপ ছোপ দাগ, সাপের খোলসের মত মরা চামড়া। চৌকোমত মুখে মোটা ঠোঁট, নিচেরটা ঝুলে থাকে। মোটা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ছাতলা-পড়া সামনের ক’টা দাঁত দেখা যায়। সারা মুখে খোঁচা খোঁচা তামাটে দাড়ি। দিনের পর দিন বিচিত্র স্বরে ভিক্ষা চাওয়ার কারণে অথবা কোনও রোগের কারণে গলার একপাশ পটকা মাছের মত ফোলা। ডান চোখে দগদগে ঘা, ফুলে বেরিয়ে এসেছে, কষ গড়াচ্ছে গাল বেয়ে। ভিখারিটা ওভারব্রিজের সিঁড়ির কোণে সকাল থেকে রাত নয়টা সাড়ে নয়টা পর্যন্ত তার পেশা খুবই মনোযোগ দিয়ে চালিয়ে আসছে বেশ ক’বছর ধরে। বাঁ-হাতের কনুই পর্যন্ত কাটা। নুলো হাতটা অনবরত নাড়ে, ডানে-বাঁয়ে মাথা ঝাঁকায় আর মুখে অদ্ভুত সুরে ‘আল্লা-হু আল্লা-হু’ আওড়ায়। বয়স? দেখে মনে হয় পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ।
মেয়েটি ভিখারির কাছে সরে আসে। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে গামছার ওপর জড়ো-করা ওর ধাতব ও একটাকা দু’টাকার কাগুজে নোটগুলোর দিকে। একদৃষ্টিতে চেয়েই থাকে। ভিক্ষার পয়সাগুলো ওর কাছে অনেক টাকা বলে মনে হয়। কদাকার ভিক্ষুকটাকে বেশ পয়সাঅলা একজন সুখী লোক বলে মনে হয়।
মেয়েটির দিকে আচমকা আড়চোখে তাকিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় প্রশ্ন ছোড়ে ভিখারি, ‘কেডা তুমি, অ্যাঁ?’
ক্লান্ত স্বরে মেয়েটি বলে, ‘দ্যাখতাছো না, মাইয়ামানুষ...। তোমার আয়-ইনকাম দ্যাখতাছি।’
বিস্ময় মেশানো সুরে বলে ভিক্ষুক, ‘আমার ইনকাম! তো হেইডা দেইখ্যা তোমার লাভ? হাইজাকার নি কুনো?’
খুব কষ্টে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে তোলে মেয়েটি ওর ফ্যাকাসে ঠোঁটে, তারপর বলে, ‘একসময় কুমিল্লার পাড়ায় আছিলাম। পাড়া তো ভাইঙ্গা দিল বালা মানুষগুলা, আল্লার নেক বান্দারা। ’
‘হের পর?’
‘হের পর অনেক ঘটনা। তোমার হুইন্যা লাভ? অহন তো দ্যাখতাইছো পথে পথে...। ’
‘অ’,— সংক্ষিপ্ত শব্দ বেরোয় ভিখারির মুখ থেকে।
পায়ের ভারি থপ্ থপ্ শব্দে সচকিত হয় মেয়েটি। রাইফেল কাঁধে রেলপুলিশের এক সেপাই ওভারব্রিজের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে আসছে। ওদের কাছে এসে মেয়েটির দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে খেঁকিয়ে ওঠে, ‘এই মাগি, ছাল-ওঠা কুত্তি, এইখানে কী? কী করস্ এইখানে? ...ভাগ এন্ থন্,... মনমিজাজ খুব খারাপ কইলাম।’
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটি — মাথা হেঁট করে; নড়ে না একচুলও। দুয়েকবার তাকিয়ে সেপাইটি কী জানি কী মনে করে পা চালায়। যেতে যেতে আপন মনেই গজরাতে থাকে, ‘মাদারচোৎ ব্লাকারগুলা সুযোগ পাইলেই ফাঁকি মারে, কয় আইজ মাল নাই ওস্তাদ, ব্যবসা খুব খারাপ। আরে তোগর ব্যবসার মায়েরে …; ওই খবর দিয়া আমি কী করুম রে শুয়ারেরবাচ্চারা? আমার সংসার কেমনে চলব হেই খবর রাখে কোন হালায়!’ — হাতে-ধরা সিগারেটে লম্বা একটা দম দিয়ে ছুড়ে ফেলে বেশ জোরে পা দিয়ে পিষে দেয়।
ছাল-ওঠা কুত্তি, ভাবে মেয়েটি, পুলিশের একজন সেপাই কিনা আজ তাকে হেলাফেলা করে, চ্যাৎ দেখায়, খারাপ ভাষায় গালাগালি করে। হায় কপাল! অথচ যখন ভরা যৌবন, পাড়ার ভাল মালের মধ্যে স্থান, তখন পুলিশ তো পুলিশ, কত নামজাদা লোক আদরসোহাগে মাতিয়ে রাখত ওকে। বিছানায় শুয়ে কাম সারবার আগে কেউ আবার মাসে তিরিশবার বিয়ে করে ঘর বাঁধবার স্বপ্ন দেখাত। ওদের কথায় হাসি পেত — তারপরও ভাল লাগত। শহরের খানদানি লোকদের কাছ থেকে ডাক এলে পাড়ার বাইরেও মাঝে মাঝে খেপ মারতে যেতে হত। কি মধুর ছিল ওই দিনগুলো, আহা!
পাড়ার কথা মনে হলে বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে এখনও। বুদ্ধি হবার আগে থেকেই তো পাড়ায়। বয়স যখন নয় কি দশ, মা মারা যায়। মায়ের ছবি এখনও মাঝেমধ্যে চোখে ভাসে। কী সুন্দর ছিল দেখতে। মায়ের কাছে যারা আসত সবাই ধোপদুরস্ত — ভদ্দরলোক। একজন প্রায় প্রতিদিনই আসত। উৎসব-পার্বণে অনেক কিছু নিয়ে আসত। ওর জন্যও আনত শখের কত কী। কোলে নিয়ে আদরও করত কখনও-সখনও। মাকে ও জিজ্ঞেস করেছে, ‘ওই লোকটা কেডা মা? খুব বালা মানুষ। হেতে কি আমার বাপ?’
‘আমি তোর মা। বাপ দিয়া কী করবি? তোরার বাপ থাহে না। বড় অইলে বুজবি সব।’
পাড়া ভেঙে দেওয়ার পর পুরাতন এক খদ্দেরের আশ্রয়ে ছিল অনেক বছর, কত বছর হিসাব করতে পারে না মেয়েটি। আরও দুজন মেয়ে ছিল ভাড়া-করা বাড়িটাতে। কিন্তু ওকে নিয়েই সবার টানাটানি। নাগরদের মুখ থেকেই শোনা, দেখতে নাকি ও ছিল বেহেস্তের হুরপরির মত। কথার সাইজ কী, বান্দররা কী মইরা বেস্তে গিয়া হুরপরিগর লগে ঘুমাইয়া আইছে — হাসি পায় মেয়েটির। ওখানে, ওই বাড়িটাতে আনন্দ-মাস্তি করে কেটে গেল অনেক সময় — অনেক বছর। কিন্তু আজ থেকে বছর দেড়েক আগে কেমন জানি লাগতে শুরু করল ওর। ফাঁপা ফাঁপা কেমন এক অনুভূতি। শরীরের তেজ তেল-ফুরিয়ে-আসা কুপিবাতির মত নিবে যেতে থাকে ক্রমশ। তারপর হঠাৎই জ্বর আর কাশি। প্রথম প্রথম আমল দেয়নি। কিন্তু যখন কাশির সঙ্গে রক্ত যেতে শুরু করল তখন আতঙ্ক ছেঁকে ধরল ওকে। আশ্রয়দাতা আশ্বাস দিল, ‘এই রোগ অহন তো পানিভাত। চিকিচ্ছা করাইলে সাইরা যাইব। তয় সময় আর পয়সা, এই যা; দুরচিন্তা করিস না...।’
চিকিৎসা চলতে থাকল। এক পর্যায়ে ধরা পড়ল আসল রোগটা। এইডস, না কী জানি বলে। একবার কারও দেহে বাসা বাঁধলে জান কবজ না করা পর্যন্ত নাকি ছাড়ে না। মেয়েটি বোঝে, হাতেগোনা ক’টা দিন আর মাত্র আয়ু।
তারপর আজ থেকে ক’দিন আগে গভীর রাতে নিজেকে আবিষ্কার করে স্টেশনের কাছটায় এক স্কুলঘরের বেঞ্চির ওপর। বুঝতে পারে বেশ ক’ঘন্টা বেহুঁশ ছিল। একবার ভাবে, ফিরে যাবে আস্তানায়, একটা বিহিত করে ছাড়বে। আবার ভাবে, লাভ কী; এক সময় অনেক দুধ দিলেও মরা গরুর স্থান তো ভাগাড়েই।
মাথা ঝিমঝিম করছে মেয়েটির। যে সামান্য পয়সা সঙ্গে ছিল, কাল পর্যন্ত চলেছিল কোনওমতে। আজ সারাদিন পেটে কিছুই পড়েনি। ভিখারির পাশে বসে পড়ে ও। মাথাটা দুই হাঁটুর ফাঁকে ঝুলিয়ে বড় বড় শ্বাস নিতে থাকে।
ভিখারি বিরক্তি ভরা স্বরে বলে ওঠে, ‘এইডা আবার কোন ইস্টাইল?’
ফ্যাসফেসে শব্দ বেরোয় মেয়েটির গলা থেকে, ‘শইল্যে বল নাই গো, খিদা, খিদায় জান বারাইয়া যায়।’
ঘাড় বেঁকিয়ে পিচ্ করে ছ্যাপ ফেলে লোকটি। বেশ তো নিজের ধান্দায় ছিল, উটকো এক ঝামেলা এসে চাপল কোত্থেকে! ঝাঁজাল স্বরে বলে, ‘তয় আমি কি করুম, অ্যাঁ? ফকিরের কাছে সাইজ্য!’
কোনও কথা সরে না মেয়েটির মুখ থেকে। চুপচাপ বসে থাকে যেমনটি ছিল।
জলসার ওয়াজের ধ্বনি জোরালো হয়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জলসা জমতে থাকে। মাইকে ঘোষণা শোনা যায়, ‘হাজেরানে মজলিশ, এখন মহামূল্যবান ওয়াজ ফরমাইবেন শাইখুল হাদিস ওলামায়ে কেরাম আল্লামা হযরত মাওলানা মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন জায়িদী পরিন্দাপুরি। লিল্লাহে তাকবির ...’
জমায়েত থেকে বুলন্দ আওয়াজ ওঠে, ‘আল্লাহু আকবার।’
মেয়েটি এখন একটু ভাল বোধ করছে। চোখ তুলে তাকায় লোকটার দিকে। লোকটা নিজের জিনিসপত্তর গুছিয়ে নিয়ে উঠবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অস্ফুট স্বরে জানতে চায় মেয়েটি, ‘তোমার লগে আছে কেডা?’
জবাব দেয় ভিক্ষুক, ‘কেডা থাকব আবার, কেউ না ...’
ফের প্রশ্ন মেয়েটির, ‘বউ বাল-বাচ্চা?’
‘মাঝখানেরটা আছে খালি, এই যে...’ হাঁটু পর্যন্ত গোটানো তবনের সম্মুখভাগ তুলে ধরে, মুখ বিকৃত করে ভিক্ষুকটি বলে ওঠে, ‘তোর তো সবতেরটা দ্যাখনের অরভ্যাস আছে ...দ্যাখ...।’
আল্লামা জায়িদী দরদঢালা ভরাট গলায় সুর করে ওয়াজ চালিয়ে যাচ্ছেন, ‘অ আল্লার পেয়ারা নবির উম্মতরা, কন দেহি দুনিয়াদারি কয় দিনের? অথচ এই দুনিয়াদারি নিয়া মানুষ আইজকাইল কতই না বেচইন। দ্বীনের পথ থেইক্যা মানুষ সইর্যা গিয়া নিজেগরের আখেরাত, কুটি কুটি বচ্ছরের আখেরাতের ক্ষতি করতাছে। আবার কিছু মানুষ আছে, কাফের মুরতাদ, হেতারা কয়, দুনিয়াদারিই আসল কথা। ভাত-কাপড়, ঘর, চিকিচ্ছা, আর কী জানি কয়, হ মনে পড়ছে শিক্ষা, শিক্ষা আগে দরকার। আরে শিক্ষা কী? শিক্ষা কি হেতাগর কুফরি শিক্ষা, অ্যাঁ? কুরআনি শিক্ষার থন বড় কোন শিক্ষা আছে?’
উপস্থিত শ্রোতারা এক সাথে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘নাই...নাই...।’
‘হেতারা কয়, মাইয়ালোকগরেরও স্বাধীনতা দরকার। আওরাতরা বেগানা মরদের লগে মাঠে-ঘাটে অফিস-আদালতে কাম করব, বুক ফুলাইয়া চলব — নাউজুবিল্লাহ্, লানৎ ওগর উপর ...। কুরআন মজিদে সুরা আন্নিসার ৩৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, আরিজা — লু ক্বওয়্যামূনা আলান্নিসা...মিন আমওয়ালিহিম; মাইনে হইল গিয়া, পুরুষরা মাইয়ালোকের কর্তা। আল্লাহ্ একজনের উপর অন্যজনরে বড় করছেন। কারণ পুরুষরা হেতাগর পয়সাকড়ি খরচা করে নিজেগর আওরাতের লাইগ্যা...।’
ওয়াজে উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্য থেকে মাঝে মাঝেই উচ্চকণ্ঠে নারা উঠছে। ওভারব্রিজের ওপর থেকে জলসা দেখা যায়। হাজি মোহাম্মদ কেরামত আলী সিনিয়র মাদ্রাসার মাঠে বিশাল প্যান্ডেল খাটিয়ে বসেছে ইসলামি জলসার মজলিশ। প্রতিবছর শীতের শুরুতে জলসার আয়োজন করা হয়, মাদ্রাসা উন্নয়নের অর্থ সংগ্রহের জন্য।
ভিক্ষুকটি উঠে দাঁড়ায়, চলে যেতে নিয়ে ফিরে তাকায় মেয়েটির দিকে। মেয়েটি নিশ্চল বসে আছে ওভারব্রিজের কংক্রিটের শীতল পাটাতনে।
গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে লোকটি, ‘তয় তুমি কি বইয়াই থাকবা?’
বিস্মিত হয় মেয়েটি। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকায় ব্রিজের রেলিঙে ঠেস-দেওয়া কদাকার পুরুষটির দিকে। ওর চোখে কী এক অদ্ভুত ভাষা। হাঁটুতে দুই হাতের ভর দিয়ে কাহিল শরীরটা তুলে দুই পায়ের ওপর রাখে। তারপর লোকটার পিছু পিছু হাঁটতে থাকে নিঃশব্দে।
‘ওয়াজ হুনছস্, ওয়াজ?’ —মোটা গলায় জিজ্ঞেস করে ভিক্ষুকটি।
‘হুঁ, হুনছি ...কথাগুলা তো খুব বালাই...’ — মেয়েটি বলে।
‘হ খুব বালা... পেটে ভাত না থাকলে হুজুরগর ওয়াজ বাইর অইয়া যাইত’— বলেই ঠোঁট বেঁকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গি করে একটু হাসে ভিখারিটা, ‘হুনলাম, হেতারাও নাকি অই কাম কইরাই প্যাটের ভাত জুটায়... কথাডা হাছা না মিছা জানি না। তুই কী কস্?’
মেয়েটি নিরুত্তর।
‘আর অই যে অত ফরেজগার লোক দ্যাখতাছস্, ওয়াজ হুনতাছে; হেতারার বিত্রে কয়জনের ইমান পরিষ্কার, ক দেহি? আল্লা তুমি মাফ কইরো...।’
আশ্চর্য হয় মেয়েটি; ও মা, বালাই তো কথা কয় ফকিরডা! এই রকম তো ভাবি নাই আগে।
বেশ্যাপল্লির কথা মনে পড়ে যায়। মুখে কাপড় জড়িয়ে ওর ঘরে কিছু কাস্টমার এসে ঢুকত মাঝেমধ্যে। দরজা লাগানোর পর মুখের কাপড় সরালে দেখা যেত আসল চেহারা। কপালে কালো দাগ, মুখে দাড়ি। হেসে কুটিকুটি হয়ে ও বলত, ‘শরমের কী আছে চাচা মিয়া? শইল্যে খিদা, মুখে কাপড় দিয়া লাভ কী?’ কারও কারও অপ্রতিভ অবস্থা, আনাড়ির মত আচরণ ওর মনে হাসির উদ্রেক করত, কখনও করুণার।
‘সিঁড়ি দিয়া আস্তে আস্তে নাম, চাইস্ পইড়া যাবি,’ লোকটার সাবধানবাণীতে সংবিৎ পায় ও। বেশ সমীহ দেখা দেয় ভিক্ষুকটার প্রতি। কিন্তু ঠেস দিয়ে বলে, ‘আন্নেও তো সারাদিন চিৎ অইয়া হুইয়া নুলা হাত লাড়েন আর আল্লাহু আল্লাহু জিকির করেন, করেন না?’
ভিক্ষুক মুখ ভেংচে বলে, ‘তুই দ্যাখতাছি আস্তা একটা ভোঁদাই, তোগো মত মাইয়ারা এত ভোঁদাই অয় হুনি নাই। ওই রকম না করলে আমার ব্যবসা চলব?’
ওভারব্রিজের গোড়াতেই হোটেল আর রেস্টুরেন্টের সারি। কোনওটার সামনে রুটি সেঁকার তন্দুর, কাবাব বানানোর ব্যবস্থা, কোনওটার সামনে চা-পরোটা তৈরির চুলা। মিটসেফগুলোতে থরে থরে সাজানো বহু পদের খাবার। কুয়াশায় ভর করে পোড়া ঘুঁটের গন্ধ কেমন এক আমেজ ছড়াচ্ছে স্টেশনএলাকা জুড়ে। এখন রাত প্রায় দশটা। অন্যদিন এসময় কিছুটা নিরিবিলি থাকে, কোনও ট্রেন থাকে না তো। কিন্তু আজ জলসা থাকাতে লোকের বেশ আনাগোনা। ভিখারি ওর বাঁধা হোটেলে গিয়ে বসে। বাঁশের তরজার ওপর পলিথিন বিছানো ছাপরা। বসবার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে-যাওয়া সিমেন্টের স্লিপার। রান্নাবান্না হোটেল-মালিক বাড়িতেই সারে। হোটেলটির এজন্যই যথেষ্ট সুনাম পা-ফাটা লোকদের কাছে। ছোট একটা টিনের সাইনবোর্ডও ঝোলানো — ‘বিলকিচ ঘরোয়া হোটেল’।
মেয়েটিকে নিয়ে ভিখারি বসে পড়ে এক কোণে। হোটেল-মালিক আড়চোখে একঝলক দেখে নিয়ে রংচটা এনামেলের প্লেটে খাবার এগিয়ে দেয়। ঠ্যালঠেলে ডালের ভেতর জেগে-থাকা চরের মতো ভাত, তার ওপর চাপানো সবজির লাবড়া — মুখে পানি আসে মেয়েটার।
খাওয়া শেষ হলে উঠে পড়ে ওরা। হোটেলের লাগোয়া যে টঙ, পানবিড়ির দোকান, তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দোকানির হাত থেকে এক খিলি পান নিয়ে মুখে পোরে লোকটি। মেয়েটার দিকে পিটপিট তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘চলব নি একটা?’
মাথা নেড়ে অসম্মতি জানায় মেয়েটি।
টঙের একপাশে-রাখা গোটানো কম্বলটা তুলে নিয়ে পা টেনে টেনে হাঁটতে থাকে লোকটা। বিকালে কিন্যা রাখছিলাম টালমার্কেট থাইক্যা, তিরিশ টাকা নিল’ —আপন মনেই বলে যায় লোকটা। মানুষের করুণা কাড়ার জন্য ভিক্ষার সময় আদুড় গা থাকতে হয় ওকে; শীতে কষ্ট যে হয় না তা নয়; তবে ওভাবে থাকতে থাকতে গা সওয়া হয়ে গেছে এখন। কিন্তু ঘরে একটু আরাম কে না চায়। মাথা গোঁজার ঠাঁই ওর স্টেশনের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে তৈরি-করা নৌকার ছইয়ের মত ঝুপড়িটা; সঙ্গে ল্যাংড়া এক ফকিরও থাকে। মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়া যায় কোথায় — কোথায় যাওয়া যায়? হাঁটতে হাঁটতেই ভাবতে থাকে লোকটা। একসময় দোকানপাট পেছনে ফেলে ওরা দু’জন হাঁটতে থাকে, ধীর পায়ে হাঁটতে থাকে রেললাইন ধরে। স্টেশনের এদিকটা মোটামুটি নির্জন। মালগাড়ি দাঁড়ানো, সার বেঁধে সমান্তরালভাবে। বাতাসে ভেসে-থাকা হেমন্তের কুয়াশার ভেতর দিয়ে দৃষ্টি খুব বেশি দূর এগোতে পারে না।
মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, ‘যাইতাছি কোন মুই? থাক কুনখানে তুমি?’
লোকটি বলে, ‘দেখবিনি, চল।’
একটা খালি মালগাড়ির বগিতে নিপুণ দক্ষতায় উঠে পড়ে লোকটি। তারপর হাতের ইশারায় উঠতে বলে মেয়েটিকে। দু’জনই বসে পড়ে ধুলো আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে-থাকা আবর্জনার ওপর। কেমন গুমোট আর ঘুটঘুটে অন্ধকার বগিটির ভেতর। রেললাইনের ওপর পড়ে-থাকা মানুষের শুকনো গুয়ের গন্ধ নাকে এসে সুড়সুড়ি দেয়।
‘তোর ব্যাগটা কই, দে দেহি।’ —নিচু গলায় বলে লোকটা।
‘উয়ার মদ্যি আমার শাড়ি, বেলাউজ, গামছা এইগুলা আছে; কী করবা তুমি? ... ঠিক আছে দ্যাহ;’ ব্যাগটা ঠেলে দিতে দিতে মেয়েটি বলে।
সশব্দ ঢেকুর তুলে পরম আয়েশে ভিখারিটা সটান শুয়ে পড়ে মেয়েটির ব্যাগের ওপর মাথা রেখে। এক হাত দিয়ে টেনে নিয়ে গায়ে চাপিয়ে দেয় টালমার্কেটের কম্বলটা।
মেয়েটি চুপচাপ বসে থাকে লোকটার সিথানের কাছে। পেটে দানাপানি পড়ায় একটু আরাম বোধ করছে, ঘুম ঘুম লাগছে। লোকটার কোনও সাড়াশব্দ নেই। খানিক বাদে হঠাৎই অন্ধকারে সে অনুভব করে খরখরে একটি হাতের স্পর্শ। চাপা শব্দ কানে আসে, ‘আয়, শুইয়া পড় কম্বলের নিচে, ঠাণ্ডা লাগতাছে না?’
‘তুমি শোও, আমার খারাপ অসুখ আছে’— বলে মেয়েটি, ‘শইলডাও খারাপ।’
‘খারাপ অসুখ আমারও, অসুবিধা নাই।’
বাজখাঁই আওয়াজ মেয়েটির কানে এসে ঝাপটা দেয়। অন্য চিন্তায় মগ্ন থাকায় এতক্ষণ টের পায়নি। জলসায় ওয়াজ চলছেই, নারা উঠছে ঘন ঘন। কোন্ দানবীর কত টাকা দান করল তার ঘোষণা, সঙ্গে সঙ্গে তার নামে জিন্দাবাদ, তার জান্নাতবাসী ওয়ালেদ-ওয়ালেদার এবং আত্মীয়-স্বজনের নামে দোআ, ইত্যাদি।
খ্যাঁক করে হেসে ওঠে ভিখারিটি, বলে, ‘বালাই কামাইতেছে । কামাউক, আমি কওনের কেডা!’ তারপর একটু থেমে বলে, ‘কী আরচয্য, ওহন পরযন্ত তোর নামই তো জানা অইল না, কী নাম তোর?’
মিহিকণ্ঠে বলে মেয়েটি, ‘মায়ে ডাকতো রোজিনা — মাইনষে রূপবান।’
‘রূপবান — কী সোন্দর নাম’, বলতে বলতে ডান হাতের হেঁচকা টানে মেয়েটিকে কম্বলের নিচে ঢুকিয়ে নেয় লোকটা।
ওয়াগনের পাশ দিয়ে কে যেন যাচ্ছিল টর্চ মেরে, নাইটগার্ড হতে পারে, হাঁক ছাড়ে, ‘কেডা কতা কয় বিত্রে, কেডা রে?’
হাঁপাতে হাঁপাতে সরীসৃপের মত হিস্ হিস্ শব্দে ভিখারিটি বলে ওঠে, ‘রহিম বাদশা ...।’
রাত এগারোটার ৮ নম্বর আপ তূর্ণানিশীথা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঝমঝম্ শব্দ তুলে স্টেশনে এসে থামে।
রাত ভালোই হয়েছে। হিমহিম বাতাস। পচা ইলিশের মত ঝাঁক ঝাঁক কুয়াশা ঝুলে আছে বাতাসের গায়। অঘ্রানের শেষ বোধ হয়। দিনের আয়ু এখন অনেক কম। ক’টা বাজে? মেয়েটি আন্দাজ করতে চেষ্টা করে। স্টেশনের লাউডস্পিকারে ঘোষণা শোনে, ‘৪ নম্বর ডাউন মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেন ২ নম্বর প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে আছে। রাত সোয়া নয়টায় ছেড়ে যাবে। যাত্রী সাধারণদের ...।’
ওভারব্রিজ থেকে স্টেশনের আশপাশের এলাকার আলোঝলমল দোকানপাট চোখে পড়ে। হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো থেকে হিন্দি গানের চড়া শব্দ ভেসে আসছে। লোকজন ছুটাছুটি করছে এদিক ওদিক।
অদূরে কোন এক ইসলামি জলসায় চলছে দরাজ গলায় ওয়াজ। একসময়কার হিন্দি ছবির হিট গান ‘চোলিকে পিছে কেয়া হ্যায়’ আর পবিত্র ওয়াজ-নসিহতের শব্দতরঙ্গ বাতাসে ধাক্কাধাক্কি করায় বিচিত্র এক শব্দজটের সৃষ্টি হয়েছে।
তীব্র হর্ন বাজিয়ে অতিকায় এক অজগরের মত ৪ নম্বর ডাউন ট্রেনটি সচল হয়, ক্রমশ গতি বাড়ে, একসময় গার্ডগাড়ির পেছনে লাগানো লাল বাতিটা ধীরে ধীরে দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায়।
মেয়েটির থেকে একটু দূরে এক ভিখারি পরম যত্নে তার সারাদিনের রোজগারের পয়সা গুনছিল। ভিখারির একমাথা উষ্কখুষ্ক চুল। রোদে পুড়ে গায়ের চামড়া কুচকুচে কালো। আদুড় গা। পরনে হাঁটু অব্দি গোটানো লুঙ্গি। উদোম শরীরের স্থানে স্থানে ছোপ ছোপ দাগ, সাপের খোলসের মত মরা চামড়া। চৌকোমত মুখে মোটা ঠোঁট, নিচেরটা ঝুলে থাকে। মোটা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ছাতলা-পড়া সামনের ক’টা দাঁত দেখা যায়। সারা মুখে খোঁচা খোঁচা তামাটে দাড়ি। দিনের পর দিন বিচিত্র স্বরে ভিক্ষা চাওয়ার কারণে অথবা কোনও রোগের কারণে গলার একপাশ পটকা মাছের মত ফোলা। ডান চোখে দগদগে ঘা, ফুলে বেরিয়ে এসেছে, কষ গড়াচ্ছে গাল বেয়ে। ভিখারিটা ওভারব্রিজের সিঁড়ির কোণে সকাল থেকে রাত নয়টা সাড়ে নয়টা পর্যন্ত তার পেশা খুবই মনোযোগ দিয়ে চালিয়ে আসছে বেশ ক’বছর ধরে। বাঁ-হাতের কনুই পর্যন্ত কাটা। নুলো হাতটা অনবরত নাড়ে, ডানে-বাঁয়ে মাথা ঝাঁকায় আর মুখে অদ্ভুত সুরে ‘আল্লা-হু আল্লা-হু’ আওড়ায়। বয়স? দেখে মনে হয় পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ।
মেয়েটি ভিখারির কাছে সরে আসে। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে গামছার ওপর জড়ো-করা ওর ধাতব ও একটাকা দু’টাকার কাগুজে নোটগুলোর দিকে। একদৃষ্টিতে চেয়েই থাকে। ভিক্ষার পয়সাগুলো ওর কাছে অনেক টাকা বলে মনে হয়। কদাকার ভিক্ষুকটাকে বেশ পয়সাঅলা একজন সুখী লোক বলে মনে হয়।
মেয়েটির দিকে আচমকা আড়চোখে তাকিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় প্রশ্ন ছোড়ে ভিখারি, ‘কেডা তুমি, অ্যাঁ?’
ক্লান্ত স্বরে মেয়েটি বলে, ‘দ্যাখতাছো না, মাইয়ামানুষ...। তোমার আয়-ইনকাম দ্যাখতাছি।’
বিস্ময় মেশানো সুরে বলে ভিক্ষুক, ‘আমার ইনকাম! তো হেইডা দেইখ্যা তোমার লাভ? হাইজাকার নি কুনো?’
খুব কষ্টে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে তোলে মেয়েটি ওর ফ্যাকাসে ঠোঁটে, তারপর বলে, ‘একসময় কুমিল্লার পাড়ায় আছিলাম। পাড়া তো ভাইঙ্গা দিল বালা মানুষগুলা, আল্লার নেক বান্দারা। ’
‘হের পর?’
‘হের পর অনেক ঘটনা। তোমার হুইন্যা লাভ? অহন তো দ্যাখতাইছো পথে পথে...। ’
‘অ’,— সংক্ষিপ্ত শব্দ বেরোয় ভিখারির মুখ থেকে।
পায়ের ভারি থপ্ থপ্ শব্দে সচকিত হয় মেয়েটি। রাইফেল কাঁধে রেলপুলিশের এক সেপাই ওভারব্রিজের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে আসছে। ওদের কাছে এসে মেয়েটির দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে খেঁকিয়ে ওঠে, ‘এই মাগি, ছাল-ওঠা কুত্তি, এইখানে কী? কী করস্ এইখানে? ...ভাগ এন্ থন্,... মনমিজাজ খুব খারাপ কইলাম।’
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটি — মাথা হেঁট করে; নড়ে না একচুলও। দুয়েকবার তাকিয়ে সেপাইটি কী জানি কী মনে করে পা চালায়। যেতে যেতে আপন মনেই গজরাতে থাকে, ‘মাদারচোৎ ব্লাকারগুলা সুযোগ পাইলেই ফাঁকি মারে, কয় আইজ মাল নাই ওস্তাদ, ব্যবসা খুব খারাপ। আরে তোগর ব্যবসার মায়েরে …; ওই খবর দিয়া আমি কী করুম রে শুয়ারেরবাচ্চারা? আমার সংসার কেমনে চলব হেই খবর রাখে কোন হালায়!’ — হাতে-ধরা সিগারেটে লম্বা একটা দম দিয়ে ছুড়ে ফেলে বেশ জোরে পা দিয়ে পিষে দেয়।
ছাল-ওঠা কুত্তি, ভাবে মেয়েটি, পুলিশের একজন সেপাই কিনা আজ তাকে হেলাফেলা করে, চ্যাৎ দেখায়, খারাপ ভাষায় গালাগালি করে। হায় কপাল! অথচ যখন ভরা যৌবন, পাড়ার ভাল মালের মধ্যে স্থান, তখন পুলিশ তো পুলিশ, কত নামজাদা লোক আদরসোহাগে মাতিয়ে রাখত ওকে। বিছানায় শুয়ে কাম সারবার আগে কেউ আবার মাসে তিরিশবার বিয়ে করে ঘর বাঁধবার স্বপ্ন দেখাত। ওদের কথায় হাসি পেত — তারপরও ভাল লাগত। শহরের খানদানি লোকদের কাছ থেকে ডাক এলে পাড়ার বাইরেও মাঝে মাঝে খেপ মারতে যেতে হত। কি মধুর ছিল ওই দিনগুলো, আহা!
পাড়ার কথা মনে হলে বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে এখনও। বুদ্ধি হবার আগে থেকেই তো পাড়ায়। বয়স যখন নয় কি দশ, মা মারা যায়। মায়ের ছবি এখনও মাঝেমধ্যে চোখে ভাসে। কী সুন্দর ছিল দেখতে। মায়ের কাছে যারা আসত সবাই ধোপদুরস্ত — ভদ্দরলোক। একজন প্রায় প্রতিদিনই আসত। উৎসব-পার্বণে অনেক কিছু নিয়ে আসত। ওর জন্যও আনত শখের কত কী। কোলে নিয়ে আদরও করত কখনও-সখনও। মাকে ও জিজ্ঞেস করেছে, ‘ওই লোকটা কেডা মা? খুব বালা মানুষ। হেতে কি আমার বাপ?’
‘আমি তোর মা। বাপ দিয়া কী করবি? তোরার বাপ থাহে না। বড় অইলে বুজবি সব।’
পাড়া ভেঙে দেওয়ার পর পুরাতন এক খদ্দেরের আশ্রয়ে ছিল অনেক বছর, কত বছর হিসাব করতে পারে না মেয়েটি। আরও দুজন মেয়ে ছিল ভাড়া-করা বাড়িটাতে। কিন্তু ওকে নিয়েই সবার টানাটানি। নাগরদের মুখ থেকেই শোনা, দেখতে নাকি ও ছিল বেহেস্তের হুরপরির মত। কথার সাইজ কী, বান্দররা কী মইরা বেস্তে গিয়া হুরপরিগর লগে ঘুমাইয়া আইছে — হাসি পায় মেয়েটির। ওখানে, ওই বাড়িটাতে আনন্দ-মাস্তি করে কেটে গেল অনেক সময় — অনেক বছর। কিন্তু আজ থেকে বছর দেড়েক আগে কেমন জানি লাগতে শুরু করল ওর। ফাঁপা ফাঁপা কেমন এক অনুভূতি। শরীরের তেজ তেল-ফুরিয়ে-আসা কুপিবাতির মত নিবে যেতে থাকে ক্রমশ। তারপর হঠাৎই জ্বর আর কাশি। প্রথম প্রথম আমল দেয়নি। কিন্তু যখন কাশির সঙ্গে রক্ত যেতে শুরু করল তখন আতঙ্ক ছেঁকে ধরল ওকে। আশ্রয়দাতা আশ্বাস দিল, ‘এই রোগ অহন তো পানিভাত। চিকিচ্ছা করাইলে সাইরা যাইব। তয় সময় আর পয়সা, এই যা; দুরচিন্তা করিস না...।’
চিকিৎসা চলতে থাকল। এক পর্যায়ে ধরা পড়ল আসল রোগটা। এইডস, না কী জানি বলে। একবার কারও দেহে বাসা বাঁধলে জান কবজ না করা পর্যন্ত নাকি ছাড়ে না। মেয়েটি বোঝে, হাতেগোনা ক’টা দিন আর মাত্র আয়ু।
তারপর আজ থেকে ক’দিন আগে গভীর রাতে নিজেকে আবিষ্কার করে স্টেশনের কাছটায় এক স্কুলঘরের বেঞ্চির ওপর। বুঝতে পারে বেশ ক’ঘন্টা বেহুঁশ ছিল। একবার ভাবে, ফিরে যাবে আস্তানায়, একটা বিহিত করে ছাড়বে। আবার ভাবে, লাভ কী; এক সময় অনেক দুধ দিলেও মরা গরুর স্থান তো ভাগাড়েই।
মাথা ঝিমঝিম করছে মেয়েটির। যে সামান্য পয়সা সঙ্গে ছিল, কাল পর্যন্ত চলেছিল কোনওমতে। আজ সারাদিন পেটে কিছুই পড়েনি। ভিখারির পাশে বসে পড়ে ও। মাথাটা দুই হাঁটুর ফাঁকে ঝুলিয়ে বড় বড় শ্বাস নিতে থাকে।
ভিখারি বিরক্তি ভরা স্বরে বলে ওঠে, ‘এইডা আবার কোন ইস্টাইল?’
ফ্যাসফেসে শব্দ বেরোয় মেয়েটির গলা থেকে, ‘শইল্যে বল নাই গো, খিদা, খিদায় জান বারাইয়া যায়।’
ঘাড় বেঁকিয়ে পিচ্ করে ছ্যাপ ফেলে লোকটি। বেশ তো নিজের ধান্দায় ছিল, উটকো এক ঝামেলা এসে চাপল কোত্থেকে! ঝাঁজাল স্বরে বলে, ‘তয় আমি কি করুম, অ্যাঁ? ফকিরের কাছে সাইজ্য!’
কোনও কথা সরে না মেয়েটির মুখ থেকে। চুপচাপ বসে থাকে যেমনটি ছিল।
জলসার ওয়াজের ধ্বনি জোরালো হয়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জলসা জমতে থাকে। মাইকে ঘোষণা শোনা যায়, ‘হাজেরানে মজলিশ, এখন মহামূল্যবান ওয়াজ ফরমাইবেন শাইখুল হাদিস ওলামায়ে কেরাম আল্লামা হযরত মাওলানা মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন জায়িদী পরিন্দাপুরি। লিল্লাহে তাকবির ...’
জমায়েত থেকে বুলন্দ আওয়াজ ওঠে, ‘আল্লাহু আকবার।’
মেয়েটি এখন একটু ভাল বোধ করছে। চোখ তুলে তাকায় লোকটার দিকে। লোকটা নিজের জিনিসপত্তর গুছিয়ে নিয়ে উঠবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অস্ফুট স্বরে জানতে চায় মেয়েটি, ‘তোমার লগে আছে কেডা?’
জবাব দেয় ভিক্ষুক, ‘কেডা থাকব আবার, কেউ না ...’
ফের প্রশ্ন মেয়েটির, ‘বউ বাল-বাচ্চা?’
‘মাঝখানেরটা আছে খালি, এই যে...’ হাঁটু পর্যন্ত গোটানো তবনের সম্মুখভাগ তুলে ধরে, মুখ বিকৃত করে ভিক্ষুকটি বলে ওঠে, ‘তোর তো সবতেরটা দ্যাখনের অরভ্যাস আছে ...দ্যাখ...।’
আল্লামা জায়িদী দরদঢালা ভরাট গলায় সুর করে ওয়াজ চালিয়ে যাচ্ছেন, ‘অ আল্লার পেয়ারা নবির উম্মতরা, কন দেহি দুনিয়াদারি কয় দিনের? অথচ এই দুনিয়াদারি নিয়া মানুষ আইজকাইল কতই না বেচইন। দ্বীনের পথ থেইক্যা মানুষ সইর্যা গিয়া নিজেগরের আখেরাত, কুটি কুটি বচ্ছরের আখেরাতের ক্ষতি করতাছে। আবার কিছু মানুষ আছে, কাফের মুরতাদ, হেতারা কয়, দুনিয়াদারিই আসল কথা। ভাত-কাপড়, ঘর, চিকিচ্ছা, আর কী জানি কয়, হ মনে পড়ছে শিক্ষা, শিক্ষা আগে দরকার। আরে শিক্ষা কী? শিক্ষা কি হেতাগর কুফরি শিক্ষা, অ্যাঁ? কুরআনি শিক্ষার থন বড় কোন শিক্ষা আছে?’
উপস্থিত শ্রোতারা এক সাথে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘নাই...নাই...।’
‘হেতারা কয়, মাইয়ালোকগরেরও স্বাধীনতা দরকার। আওরাতরা বেগানা মরদের লগে মাঠে-ঘাটে অফিস-আদালতে কাম করব, বুক ফুলাইয়া চলব — নাউজুবিল্লাহ্, লানৎ ওগর উপর ...। কুরআন মজিদে সুরা আন্নিসার ৩৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, আরিজা — লু ক্বওয়্যামূনা আলান্নিসা...মিন আমওয়ালিহিম; মাইনে হইল গিয়া, পুরুষরা মাইয়ালোকের কর্তা। আল্লাহ্ একজনের উপর অন্যজনরে বড় করছেন। কারণ পুরুষরা হেতাগর পয়সাকড়ি খরচা করে নিজেগর আওরাতের লাইগ্যা...।’
ওয়াজে উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্য থেকে মাঝে মাঝেই উচ্চকণ্ঠে নারা উঠছে। ওভারব্রিজের ওপর থেকে জলসা দেখা যায়। হাজি মোহাম্মদ কেরামত আলী সিনিয়র মাদ্রাসার মাঠে বিশাল প্যান্ডেল খাটিয়ে বসেছে ইসলামি জলসার মজলিশ। প্রতিবছর শীতের শুরুতে জলসার আয়োজন করা হয়, মাদ্রাসা উন্নয়নের অর্থ সংগ্রহের জন্য।
ভিক্ষুকটি উঠে দাঁড়ায়, চলে যেতে নিয়ে ফিরে তাকায় মেয়েটির দিকে। মেয়েটি নিশ্চল বসে আছে ওভারব্রিজের কংক্রিটের শীতল পাটাতনে।
গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে লোকটি, ‘তয় তুমি কি বইয়াই থাকবা?’
বিস্মিত হয় মেয়েটি। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকায় ব্রিজের রেলিঙে ঠেস-দেওয়া কদাকার পুরুষটির দিকে। ওর চোখে কী এক অদ্ভুত ভাষা। হাঁটুতে দুই হাতের ভর দিয়ে কাহিল শরীরটা তুলে দুই পায়ের ওপর রাখে। তারপর লোকটার পিছু পিছু হাঁটতে থাকে নিঃশব্দে।
‘ওয়াজ হুনছস্, ওয়াজ?’ —মোটা গলায় জিজ্ঞেস করে ভিক্ষুকটি।
‘হুঁ, হুনছি ...কথাগুলা তো খুব বালাই...’ — মেয়েটি বলে।
‘হ খুব বালা... পেটে ভাত না থাকলে হুজুরগর ওয়াজ বাইর অইয়া যাইত’— বলেই ঠোঁট বেঁকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গি করে একটু হাসে ভিখারিটা, ‘হুনলাম, হেতারাও নাকি অই কাম কইরাই প্যাটের ভাত জুটায়... কথাডা হাছা না মিছা জানি না। তুই কী কস্?’
মেয়েটি নিরুত্তর।
‘আর অই যে অত ফরেজগার লোক দ্যাখতাছস্, ওয়াজ হুনতাছে; হেতারার বিত্রে কয়জনের ইমান পরিষ্কার, ক দেহি? আল্লা তুমি মাফ কইরো...।’
আশ্চর্য হয় মেয়েটি; ও মা, বালাই তো কথা কয় ফকিরডা! এই রকম তো ভাবি নাই আগে।
বেশ্যাপল্লির কথা মনে পড়ে যায়। মুখে কাপড় জড়িয়ে ওর ঘরে কিছু কাস্টমার এসে ঢুকত মাঝেমধ্যে। দরজা লাগানোর পর মুখের কাপড় সরালে দেখা যেত আসল চেহারা। কপালে কালো দাগ, মুখে দাড়ি। হেসে কুটিকুটি হয়ে ও বলত, ‘শরমের কী আছে চাচা মিয়া? শইল্যে খিদা, মুখে কাপড় দিয়া লাভ কী?’ কারও কারও অপ্রতিভ অবস্থা, আনাড়ির মত আচরণ ওর মনে হাসির উদ্রেক করত, কখনও করুণার।
‘সিঁড়ি দিয়া আস্তে আস্তে নাম, চাইস্ পইড়া যাবি,’ লোকটার সাবধানবাণীতে সংবিৎ পায় ও। বেশ সমীহ দেখা দেয় ভিক্ষুকটার প্রতি। কিন্তু ঠেস দিয়ে বলে, ‘আন্নেও তো সারাদিন চিৎ অইয়া হুইয়া নুলা হাত লাড়েন আর আল্লাহু আল্লাহু জিকির করেন, করেন না?’
ভিক্ষুক মুখ ভেংচে বলে, ‘তুই দ্যাখতাছি আস্তা একটা ভোঁদাই, তোগো মত মাইয়ারা এত ভোঁদাই অয় হুনি নাই। ওই রকম না করলে আমার ব্যবসা চলব?’
ওভারব্রিজের গোড়াতেই হোটেল আর রেস্টুরেন্টের সারি। কোনওটার সামনে রুটি সেঁকার তন্দুর, কাবাব বানানোর ব্যবস্থা, কোনওটার সামনে চা-পরোটা তৈরির চুলা। মিটসেফগুলোতে থরে থরে সাজানো বহু পদের খাবার। কুয়াশায় ভর করে পোড়া ঘুঁটের গন্ধ কেমন এক আমেজ ছড়াচ্ছে স্টেশনএলাকা জুড়ে। এখন রাত প্রায় দশটা। অন্যদিন এসময় কিছুটা নিরিবিলি থাকে, কোনও ট্রেন থাকে না তো। কিন্তু আজ জলসা থাকাতে লোকের বেশ আনাগোনা। ভিখারি ওর বাঁধা হোটেলে গিয়ে বসে। বাঁশের তরজার ওপর পলিথিন বিছানো ছাপরা। বসবার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে-যাওয়া সিমেন্টের স্লিপার। রান্নাবান্না হোটেল-মালিক বাড়িতেই সারে। হোটেলটির এজন্যই যথেষ্ট সুনাম পা-ফাটা লোকদের কাছে। ছোট একটা টিনের সাইনবোর্ডও ঝোলানো — ‘বিলকিচ ঘরোয়া হোটেল’।
মেয়েটিকে নিয়ে ভিখারি বসে পড়ে এক কোণে। হোটেল-মালিক আড়চোখে একঝলক দেখে নিয়ে রংচটা এনামেলের প্লেটে খাবার এগিয়ে দেয়। ঠ্যালঠেলে ডালের ভেতর জেগে-থাকা চরের মতো ভাত, তার ওপর চাপানো সবজির লাবড়া — মুখে পানি আসে মেয়েটার।
খাওয়া শেষ হলে উঠে পড়ে ওরা। হোটেলের লাগোয়া যে টঙ, পানবিড়ির দোকান, তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দোকানির হাত থেকে এক খিলি পান নিয়ে মুখে পোরে লোকটি। মেয়েটার দিকে পিটপিট তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘চলব নি একটা?’
মাথা নেড়ে অসম্মতি জানায় মেয়েটি।
টঙের একপাশে-রাখা গোটানো কম্বলটা তুলে নিয়ে পা টেনে টেনে হাঁটতে থাকে লোকটা। বিকালে কিন্যা রাখছিলাম টালমার্কেট থাইক্যা, তিরিশ টাকা নিল’ —আপন মনেই বলে যায় লোকটা। মানুষের করুণা কাড়ার জন্য ভিক্ষার সময় আদুড় গা থাকতে হয় ওকে; শীতে কষ্ট যে হয় না তা নয়; তবে ওভাবে থাকতে থাকতে গা সওয়া হয়ে গেছে এখন। কিন্তু ঘরে একটু আরাম কে না চায়। মাথা গোঁজার ঠাঁই ওর স্টেশনের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে তৈরি-করা নৌকার ছইয়ের মত ঝুপড়িটা; সঙ্গে ল্যাংড়া এক ফকিরও থাকে। মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়া যায় কোথায় — কোথায় যাওয়া যায়? হাঁটতে হাঁটতেই ভাবতে থাকে লোকটা। একসময় দোকানপাট পেছনে ফেলে ওরা দু’জন হাঁটতে থাকে, ধীর পায়ে হাঁটতে থাকে রেললাইন ধরে। স্টেশনের এদিকটা মোটামুটি নির্জন। মালগাড়ি দাঁড়ানো, সার বেঁধে সমান্তরালভাবে। বাতাসে ভেসে-থাকা হেমন্তের কুয়াশার ভেতর দিয়ে দৃষ্টি খুব বেশি দূর এগোতে পারে না।
মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, ‘যাইতাছি কোন মুই? থাক কুনখানে তুমি?’
লোকটি বলে, ‘দেখবিনি, চল।’
একটা খালি মালগাড়ির বগিতে নিপুণ দক্ষতায় উঠে পড়ে লোকটি। তারপর হাতের ইশারায় উঠতে বলে মেয়েটিকে। দু’জনই বসে পড়ে ধুলো আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে-থাকা আবর্জনার ওপর। কেমন গুমোট আর ঘুটঘুটে অন্ধকার বগিটির ভেতর। রেললাইনের ওপর পড়ে-থাকা মানুষের শুকনো গুয়ের গন্ধ নাকে এসে সুড়সুড়ি দেয়।
‘তোর ব্যাগটা কই, দে দেহি।’ —নিচু গলায় বলে লোকটা।
‘উয়ার মদ্যি আমার শাড়ি, বেলাউজ, গামছা এইগুলা আছে; কী করবা তুমি? ... ঠিক আছে দ্যাহ;’ ব্যাগটা ঠেলে দিতে দিতে মেয়েটি বলে।
সশব্দ ঢেকুর তুলে পরম আয়েশে ভিখারিটা সটান শুয়ে পড়ে মেয়েটির ব্যাগের ওপর মাথা রেখে। এক হাত দিয়ে টেনে নিয়ে গায়ে চাপিয়ে দেয় টালমার্কেটের কম্বলটা।
মেয়েটি চুপচাপ বসে থাকে লোকটার সিথানের কাছে। পেটে দানাপানি পড়ায় একটু আরাম বোধ করছে, ঘুম ঘুম লাগছে। লোকটার কোনও সাড়াশব্দ নেই। খানিক বাদে হঠাৎই অন্ধকারে সে অনুভব করে খরখরে একটি হাতের স্পর্শ। চাপা শব্দ কানে আসে, ‘আয়, শুইয়া পড় কম্বলের নিচে, ঠাণ্ডা লাগতাছে না?’
‘তুমি শোও, আমার খারাপ অসুখ আছে’— বলে মেয়েটি, ‘শইলডাও খারাপ।’
‘খারাপ অসুখ আমারও, অসুবিধা নাই।’
বাজখাঁই আওয়াজ মেয়েটির কানে এসে ঝাপটা দেয়। অন্য চিন্তায় মগ্ন থাকায় এতক্ষণ টের পায়নি। জলসায় ওয়াজ চলছেই, নারা উঠছে ঘন ঘন। কোন্ দানবীর কত টাকা দান করল তার ঘোষণা, সঙ্গে সঙ্গে তার নামে জিন্দাবাদ, তার জান্নাতবাসী ওয়ালেদ-ওয়ালেদার এবং আত্মীয়-স্বজনের নামে দোআ, ইত্যাদি।
খ্যাঁক করে হেসে ওঠে ভিখারিটি, বলে, ‘বালাই কামাইতেছে । কামাউক, আমি কওনের কেডা!’ তারপর একটু থেমে বলে, ‘কী আরচয্য, ওহন পরযন্ত তোর নামই তো জানা অইল না, কী নাম তোর?’
মিহিকণ্ঠে বলে মেয়েটি, ‘মায়ে ডাকতো রোজিনা — মাইনষে রূপবান।’
‘রূপবান — কী সোন্দর নাম’, বলতে বলতে ডান হাতের হেঁচকা টানে মেয়েটিকে কম্বলের নিচে ঢুকিয়ে নেয় লোকটা।
ওয়াগনের পাশ দিয়ে কে যেন যাচ্ছিল টর্চ মেরে, নাইটগার্ড হতে পারে, হাঁক ছাড়ে, ‘কেডা কতা কয় বিত্রে, কেডা রে?’
হাঁপাতে হাঁপাতে সরীসৃপের মত হিস্ হিস্ শব্দে ভিখারিটি বলে ওঠে, ‘রহিম বাদশা ...।’
রাত এগারোটার ৮ নম্বর আপ তূর্ণানিশীথা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঝমঝম্ শব্দ তুলে স্টেশনে এসে থামে।
1 মন্তব্যসমূহ
অসামান্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুষ্ঠরোগীর বউ মনে করিয়ে দিল।
উত্তরমুছুনশ্রাবণী দাশগুপ্ত।