অনুবাদ : এমদাদ রহমান
ধূসর বৃষ্টিকণা মাটির ওপর ছড়িয়ে দিচ্ছে সূক্ষ্ম ভেজা ধূলো। আমি শুনতে পাচ্ছি ফোর্ট ইকোতে কামানের গর্জন-- শত্রু বোধ হয় তাদের আক্রমণ করেছে। সন্ধানী আলোর লম্বা জিভ রাতের মেঘগুলোকে লেহন করে যাচ্ছে; দৃষ্টিকে ও বড় আঘাত করে-- ও যেন ভুলতে দেয় না শয়তানের আবিষ্কার যুদ্ধকে।
আমি শেখভের লেখা পড়ছিলাম। দশ বছর আগে তিনি মারা না গেলে এই যুদ্ধ মানুষ জাতটার ওপর আগে তার মন ঘৃণায় বিষিয়ে দিয়ে তারপর নিশ্চই তাঁকে মেরে ফেলত। তাঁর অন্ত্যেষ্টির কথা আমার মনে পড়েছে।
মস্কোর মানুষের প্রিয়তম ছিলেন লেখক-- তাঁর শবাধার আনা হচ্ছিল সবুজ রঙের একটা ভাড়াটে গাড়িতে, গাড়ির পাশে বড় বড় অক্ষরে লেখা 'ঝিনুকের জন্য' (শেখভের বিখ্যাত এক রচনা)। লেখককে শেষ বিদায় জানানোর জন্য যে জনতা স্টেশনে এসে জড়ো হয়েছিল-- তার একটা বড় অংশ জেনারেল কেলারের শবাধারকে অনুসরণ করল। কারণ ঠিক ওই সময়ে মাঞ্চুরিয়া থেকে জেনারেলের শবাধারও এসে পৌঁছেছিল। সবাই সবিস্ময়ে দেখল-- পুরোপুরি মিলিটারি সম্মানে শেখভের সমাধি দেওয়া হচ্ছে। ভুলটা যখন ধরা পড়ল তখন কেউ কেউ খুশিতে খল্খল্ করে হেসে উঠল এবং ঠাট্টা তামাশা শুরু করে দিলে। শেখভের শবানুগমনে শ'খানেক লোকের বেশি ছিল না। তার মধ্যে দু'জন উকিলকে আমার বেশ মনে পড়ছে, পায়ে নতুন জুতো, গলায় বিচিত্র নেকটাই আঁটা, 'প্রেমিক প্রেমিক' ভাব। তাদের পেছনে যেতে যেতে তাদের একজন-- ভি. এ. মাকলাকফকে আলোচনা করতে শুনলাম কুকুরের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে; অন্যজনকে চিনিনে-- তিনি তাঁর দেশের বাড়ির স্বাচ্ছন্দ্য এবং তার চারপাশের সৌন্দর্য সম্পর্কে ব্যাখ্যান দিচ্ছিলেন। নীলাভ পোশাক-পরা একটি মহিলা, হাতে লেশ দেওয়া ছাতা, এক মস্ত চশমা পরা বৃদ্ধ ভদ্রলোককে মৃতের গুণপনা সম্পর্কে বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন। 'ওঃ, তিনি কি আশ্চর্য রকমের মধুর ছিলেন-- আর কি তীক্ষ্ণবুদ্ধি। ...'' বৃদ্ধ ভদ্রলোক সন্ধিগ্ধভাবে কাশলেন। দিনটা ছিল গরম এবং ধুলিধূসর। মিছিলের আগে আগে একটা মোটাসোটা সাদা ঘোড়ায় চেপে রাজকীয় গাম্ভীর্যে চলেছে দীর্ঘদেহ, গাট্টাগোট্টা এক পুলিস। সবটাকে বোধ হচ্ছিল বড় নিষ্ঠুর ভাবে সাধারণ এবং অশিষ্ট--সেই বিরাট এবং সূক্ষ্ম এক শিল্পীর স্মৃতির অযোগ্য।
বৃদ্ধ এ. এস. সুভোরিনকে (নভোজে ভ্রেমজা পত্রিকার সম্পাদক) শেখভ তাঁর এক চিঠিতে লিখেছিলেন :
''বলতে গেলে, বেঁচে থাকার গদ্যময় জীবন-সংগ্রাম অপেক্ষা ক্লান্তিকর ও কবিত্বহীন আর কিছু নেই-- জীবনের সব আনন্দকে তা শুষে নেয় এবং ঠেলে দেয় ঔদাসীন্যের দিকে।''
কথাগুলো অতিমাত্রায় রুশ চিন্তাধারারই প্রতিফলন। কিন্তু আমার মনে হয়--শেখভের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও রকম ছিল না। রাশিয়ায় সব কিছুর যেখানে এত প্রাচুর্য-- অথচ মানুষের যেখানে কর্মের প্রতি অনুরাগ নেই-- সেখানে বেশির ভাগ লোক ওই রকমই চিন্তা করে থাকে। রাশিয়া শক্তির প্রশংসা করে-- কিন্তু তার ওপরে বিশ্বাস রাখতে সক্ষম নয়। জ্যাক লন্ডনের দৃষ্টান্ত ধরা যাক, ওই রকম একটা সক্রিয় লেখক রাশিয়ায় হওয়া অসম্ভব। যদিও তাঁর বইগুলো এখানে খুবই জনপ্রিয়-- কিন্তু রাশিয়ার মানুষকে তা কর্মোদ্দিপনায় প্রেরণা দিতে দেখি না। তা শুধু রুশদের কল্পনাকে উত্তেজিত করে!
এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শেখভ পুরোপুরি রুশ নন। তাঁর ক্ষেত্রে 'জীবনের সংগ্রাম' শুরু হয়েছিল যৌবনের আরম্ভ থেকেই। এই দাস্যবৃত্তি, প্রাত্যহিক জীবনের ক্ষুদ্রতা, এক টুকরো রুটির জন্যে চেষ্টা ও চিন্তা--এ শুধু তাঁর নিজের জন্য নয়; কারণ তাঁর বৃহৎ পরিবারে বেশ বড় টুক্রোর রুটিরই দরকার ছিল। সেই আনন্দহীন চেষ্টার মধ্যে যৌবনের সমস্ত শক্তি তাঁর নিয়োজিত হয়েছিল এবং আমরা অবাক হই এই ভেবে জে, তিনি কি করে তাঁর রসজ্ঞানকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। পরিতুষ্টি এবং শান্তির জন্য জীবনকে তিনি দেখেছিলেন শুধু একটা বিবর্ণ উচ্চ আশা রূপে। তাঁর যে বিরাট নাটকীয়তা এবং ব্যর্থতার বেদনা-- তা প্রাত্যহিক জীবনের ঘন আস্তরণের আড়ালে তাঁর চোখের সামনে চাপা পড়ে গিয়েছিল। কেবল যখন সংসারের সমস্ত লোকের মুখে পরিমিত আহার তুলে দেওয়ার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারলেন তখনই তাঁর সুগভীর দৃষ্টি গিয়ে পড়ল সেই জীবন-নাট্যের মূলে।
সমস্ত সংস্কৃতির মূলে শ্রমের যে গুরুত্ব এবং তার যে বৈচিত্র-- শেখভের চেয়ে আর কেউ বেশি অনুভব করেছিল বলে আমি জানি না। জীবনের ছোটখাটো ব্যাপারগুলোর মধ্যেও তাঁর এই অনুভূতির প্রকাশ দেখতে পাই : তাঁর স্বভাবে, তাঁর পছন্দে এবং মানুষের শ্রমের প্রতি সেই মহান ভালোবাসায় ও মানুষের সৃষ্টিশীল শক্তির প্রশংসায় তাঁর ক্লান্তি ছিল না। কোনো কিছু গড়তে, বাগান তৈরি করতে, পৃথিবীকে অলংকৃত করতে তিনি ভালবাসতেন। শ্রমের সঙ্গীতকে তিনি অনুভব করতেন। কী মর্মস্পর্শী মমতায় তাঁর বাগানে লাগানো ফলের গাছ এবং বাগান সাজানোর খুদে ঝোপগুলোকে তিনি বড় হয়ে উঠতে দেখতেন, আউট্কায় তাঁর বাড়ি তৈরির পরিকল্পনায় মশগুল তিনি, বলতেন :
''প্রত্যেক লোকে, তার যতটুকু জমিই থাক, তাকে যদি সাজিয়ে-গুছিয়ে তোলে তা হলে পৃথিবীটা কি সুন্দর হয়ে ওঠে!''
'ভাস্কা বুসালেভ' (মন্ত্গোরদ কাব্যের নায়ক) নামে একটা নাটক তখন লিখতে শুরু করেছিলাম। একদিন আমি ভাস্কার একটা গর্বোদ্ধত একোক্তি পড়ে শোনাচ্ছিলাম :
''আরও শক্তি ও আরও ক্ষমতার অধিকারী হত যদি এই দেহ,
আতপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে গলাতেম জমাট তুষার!
পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে চষে ফেলতেম তাকে!
চলতেম বছরের পর বছর, গড়তেম শহরের পর শহর,
তৈরি করতেম সংখ্যাতীত গির্জা, সাজিয়ে দিতেম বাগানে বাগানে;
সাজাতেম এ পৃথিবীকে--যেন এক সুন্দরী কুমারী;
জড়াতেম বাহুর আড়ালে--প্রেয়সীর মত;
হৃদয়ের কাছে তুলে ধরে বয়ে নিয়ে যেতাম ঈশ্বরের কাছে :
হে ঈশ্বর দেখ, এখানে এই মর্ত্যের ধূলায়,
দেখ, কী চমৎকার সাজিয়েছে ভাসাকা!
তুমি একে পাথরের মত ছুঁড়ে দিয়েছিলে শূন্যে,
অমূল্য হীরার মত বানিয়েছি তাকে!
দেখ-- হে ঈশ্বর দেখ, আমার আনন্দে যোগ দাও!
দেখ এর উজ্জ্বল দ্যুতি সূর্যের আলোতে!
তোমাকে দিয়েছি হে ঈশ্বর এ সুন্দর উপহার--
শুধু--না, তা হওয়ার নয়, আমি নিজে ভালবাসি একে!''
এই একোক্তিটা শেখভ খুব ভালবাসতেন এবং খুব উত্তেজিতভাবে কাশতে কাশতে আমাকে এবং উপস্থিত ডক্টর এ. এইচ. আলক্সিনকে বললেন :
''ভারী সুন্দর! অত্যন্ত সত্যি, অত্যন্ত মানবীয়! এতেই আছে সমস্ত দর্শনের সার। এ পৃথিবীকে মানুষ বাসযোগ্য করে তুলেছে-- তাই তার নিজের জন্য একে স্বাচ্ছন্দ্যদায়কও অবশ্যই করে তুলবে।''
বেশ জেদের সঙ্গে, মাথা ঝাঁকি দিয়ে কথাটাকে তিনি সমর্থন করলেন এবং আবার বললেন : 'সে করবেই!''
ভাসকার গর্বোদ্ধত বক্তৃতাটা আবার আমাকে পড়বার জন্য বললেন। আমি পড়লাম এবং তিনি মন দিয়ে শেষ পর্যন্ত শুনলেন। তারপর মন্তব্য করলেন : ''শেষ দুটো লাইনের দরকার নেই--ও দুটো অপ্রাসঙ্গিক। ওর কোনো প্রয়োজন নেই।''
* * *
তাঁর নিজের সাহিত্যকর্ম সম্বন্ধে তিনি বলতেন খুব কম এবং খুব অনিচ্ছায়। লিও টলস্টয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি যেমন খুব সংযত ও হুঁশিয়ার হয়ে কথা বলেছেন-- তেমনি। ক্বচিৎ, যখন খুব মনের আনন্দে থাকতেন, তখন মাথায় কোনো নতুন ভাব এলে হাসতে হাসতে বলতেন সাধারণত রসিকতা করে। একদিন বললেন :
''জান, একটি শিক্ষয়িত্রীকে নিয়ে লিখব ভাবছি। তিনি হবেন একজন নাস্তিক, ডারুইনকে শ্রদ্ধা করেন, লোকের গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করা দরকার বলে মনে করেন। কিন্তু প্রেমের বশীকরণের জন্য একটা বিশেষ হাড় দরকার বলে মাঝরাতে স্নানের ঘরে একটা কালো বেড়ালকে সেদ্ধ করতে তার কিছুমাত্র আটকাবে না।''
তাঁর নাটকগুলি সম্পর্কে তিনি বলেছেন--'আনন্দ ভরা' এবং আমি মনে করি, তিনি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতেন-- আনন্দময় নাটক তিনি লিখে গেছেন। সম্ভবত তাঁর এই বিশ্বাসের প্রভাবেই সাভা মকোজোফও (মস্কোর এক ব্যবসায়ি--একজন বিপ্লবী এবং শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন) বলতেন : ''গীতিময় কমেডি হিসেবেই শেখভের নাটকগুলি মঞ্চস্থ হওয়া উচিত।''
সাধারণভাবে তিনি সাহিত্যকে দেখেছেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিতে, সাহিত্য যারা সবে শুরু করেছে তাদের সম্পর্কে তাঁর মনোযোগ বিশেষ ভাবে প্রণিধান যোগ্য। অপূর্ব ধৈর্যে বি. লাজারেভস্কি, এন. অলিগি ও আরও অনেকের অনেক পাণ্ডুলিপি তিনি সতর্ক ভাবে পড়েছেন।
''আমাদের অনেক লেখকের দরকার'', তিনি বলতেন। ''সাহিত্য আমাদের দেশে এখনও একটা নতুনত্বের মত, এমন কি শিক্ষিতদের মধ্যেও। নরওয়েতে প্রতি দু'শ ছাব্বিশজন লোক পিছু একজন লেখক আর রাশিয়ায় প্রতি দশ লক্ষের জন্য একজন। ...''
* * *
তাঁর অসুস্থতা মাঝে মাঝে তাঁকে করে তুলত মানসিক বিকারগ্রস্ত--প্রায় মানব-বিদ্বেষী। ওই সব দিনে তাঁর বিচার হতো খামখেয়ালি এবং সমস্ত মানুষ জনের ওপর ব্যবহারে হয়ে উঠতেন কর্কশ। একদিন কৌচে শুয়ে শুয়ে কাশছিলেন এবং একটা থার্মোমিটার নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। বললেন :
''মরেও যেতে পারি-- এই জন্যে বেঁচে আছি, এটা খুব সুখের নয়। কিন্তু বেঁচে আছি এইটে জেনে যে, সময় হওয়ার আগেই মরে যাব-- সে বড় মর্মান্তিক।...''
আর একদিন, খোলা জানালার সামনে বসে সমুদ্রের সুদূর দিগ্বলয় রেখার দিকে তাকিয়ে ক্রুব্ধ কণ্ঠে হঠাৎ গর্ গর্ করে বলে উঠলেন :
''চমৎকার আবহাওয়া, ভালো ফসল, মধুর ভালোবাসার ঘটনা, বড়লোক হওয়া অথবা পুলিশের বড় কর্তার একটা চাকরি-- এই সব আশার মধ্যে বেঁচে থাকতে আমরা অভ্যস্থ হয়ে গেছি কিন্তু এমন লোক আমি দেখিনি যে আরও চতুর ও বুদ্ধিমান হয়ে ওঠার আশায় বেঁচে থাকতে চায়। আমরা ভাবি, 'নতুন জারের অধীনে আমরা আরও ভালো থাকবো এবং আরও ভালো থাকবো দুশো বছরের মধ্যে'-- কিন্তু আগামীকালের জীবনটাকে একটু উন্নত করে তোলার কষ্ট কেউ স্বীকার করে না। সামগ্রিক ভাবে জীবন ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে প্রত্যেক দিন এবং গড়িয়ে চলেছে তার নিজের ইচ্ছে মতো। এদিকে লোকে যেন ক্রমশ নির্বোধ হয়ে উঠছে প্রত্যেক দিন এবং ক্রমশ বেশি সংখ্যায় জীবন ধারার বাইরে গিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অলস ভাবে। ''
কয়েক মিনিট তিনি গভীর চিন্তায় ডুবে রইলেন, তারপর ভুরু কুঁচকে বলে উঠলেন : ''ঠিক গির্জার মিছিলে খোঁড়া ভিক্ষুকের মত।''
তিনি ছিলেন ডাক্তার এবং সাধারণ রোগীর চেয়ে ডাক্তারের অসুস্থতার বোঝা বহন করা কঠিনতর। রোগী শুধু অনুভব করে, আর ডাক্তার অনুভূতির সঙ্গে এ-ও জানে যে, কোন ধারায় তার দেহযন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এই রকম ক্ষেত্রে আমরা জ্ঞানকে আসন্ন মৃত্যুর কারণ বলে ধরে নিতে পারি।
* * *
যখন তিনি হাসতেন তাঁর চোখ দুটো হয়ে উঠত বড় সুন্দর; কমনীয়, স্নেহাতুর ও কোমল-- মেয়েদের মতো। আর তাঁর হাসি-- প্রায় শব্দহীন-- এমন এক অস্বাভাবিক রকমের হাসি ছিল তাঁর। তিনি যে আনন্দিত, উচ্ছলিত-- সহজেই ধরা পড়ত। আমি বলতে পারি-- এম্ন ভাবুকতায় ভরা হাসি আর কারুকে হাসতে দেখিনি। অমার্জিত কোনো কথা কখনো তাঁর হাসির উদ্রেক করত না।
তাঁর সেই খুশির হাসি হাসতে হাসতে একদিন তিনি বললেন :
''তুমি জানো, তোমার ওপরে টলস্টয়ের মনোভাব এত বদলে গেছে কেন? এ তাঁর ঈর্ষা। তিনি মনে করেন-- সুলারজিৎস্কিকে তিনি যতটা ভালবাসেন, তার চেয়ে সুলার তোমাকে ভালবাসেন বেশি। হ্যাঁ হে-- ব্যাপারটা এই রকমই। তিনি গতকাল আমাকে বললেন : ''গোর্কিকে আমি সরল বলে মনে করতে পারিনে-- আমি জানি না কেন এমন হয়-- তবে আমি পারিন না। সুলার যে ওর সঙ্গে এক জায়গায় থাকে-- এ জেনেও আমার খুব খারাপ লাগে। সুলারের পক্ষে ওটা খারাপ। গোর্কি একটা নির্দয় লোক। ওর কথায় এক ধর্মতত্ত্বের ছাত্রের কথা আমার মনে পড়ে যায়। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে তার ওপরে মঠের কেতা মাফিক সাজ-সজ্জা চাপিয়ে দেওয়া হলো এবং তার ফলে সে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল সকলের ওপরে। গোর্কির আত্মা গোয়েন্দার আত্মা, ও যেন এসে পড়েছে কানানদের দেশে-- যেখানে সে নিজেকে বিদেশী বলে মনে করে, তার চারদিকে যা ঘটছে সবই সে লক্ষ্য করে, সকলকেই সে লক্ষ্য করে এবং তার নিজের দেবতার কাছে বিবরণ দাখিল করে। এবং তার দেবতা হলো একটা দানব, অর্ধেক ছাগল--অর্ধেক মানুষ অথবা কিসান মেয়েদের উপকথার সেই জলের অপদেবতার মতো একটা কিছু।''
এই কথা বলতে বলতে শেখভ হাসতে শুরু করলেন যতক্ষণ না তাঁর চোখে জল এসে পড়ল। তারপর চোখ মুছে বলে চললেন :
''আমি তাঁকে বললাম--গোর্কি খুব হৃদয়বান মানুষ! কিন্তু তিনি সজোরে বললেন : 'না, না, আমি তার সম্পর্কে সব জানি! তার নাকটা হাঁসের মত-- কেবল অসুখী এবং নির্দয় মানুষদের নাকই ওই রকম হয়। মেয়েরাও তাকে ভালোবাসে না এবং মেয়েরা হলো কুকুরের মতো-- গন্ধ শুঁকে ভালো লোক চিনে নেয়। সুলার-- সে অবশ্য অন্য ব্যাপার-- মানুষকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসার সত্যিই দুর্লভ ক্ষমতা আছে তার। ও ব্যাপারে সে একটা প্রতিভা! কেমন ক'রে ভালোবাসতে হয় জানার মানেই হলো সব কিছু জানা।' ''
শেখভ এক মুহূর্ত থেমে আবার বলে উঠলেন :
''হ্যাঁ হে, বৃদ্ধকে ঈর্ষায় পেয়ে বসেছে... কী অপূর্ব মানুষটি!''
* * *
টলস্টয় সম্পর্কে তিনি যখনি কোন কথা বলেছেন তখনি দেখেছি তাঁর চোখে লেগেছে অদ্ভুত, দুর্বোধ্য কিন্তু কমনীয় এবং ভাবুক একটা হাসি, কণ্ঠস্বর এসেছে নেমে-- যেন বলছেন কোনো রূপকথা বা অতীন্দ্রিয় কিছু, ভাষা হয়েছে কোমল এবং সতর্ক। তিনি এমন অনুযোগ প্রায়ই করতেন যে, টলস্টয়ের কোনো এর্কমানের মতো সমালোচক নেই যিনি এই বৃদ্ধ যাদুকরের সমস্ত তীক্ষ্ণ, আকস্মিক এবং প্রায়ই পরস্পর-বিরুদ্ধ চিন্তাগুলো বিচার বিশ্লেষণ করে তুলে ধরেন।
''তোমার এটা করা উচিত,'' তিনি সুলারজিৎস্কিকে বলতেন। ''টলস্টয় তোমাকে এত পছন্দ করেন, এত সুন্দর ভাবে তোমার সঙ্গে কথা বলেন এবং এত কথাও সব বলেন। ...''
সুলার সম্পর্কে একবার শেখভ আমায় বলেছিলেন, ''ও বিজ্ঞলোক। ...'' কথাটা অত্যন্ত সত্য।
একদিন টলস্টয় শেখভের কোনো একটা গল্প সম্পর্কে বলতে গিয়ে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন, বোধ হয় গল্পটার নাম 'দুশেংকা'। ''এ যেন একটা লেস,'' তিনি বলেছিলেন, '' কোনো শুদ্ধমতি তরুণীর বোনা! সেকালে এই রকম লেস বোনার মানুষ ছিল; লেসের নক্সায় তাঁরা তুলতেন তাঁদের জীবন, তাঁদের সুখের যত স্বপ্ন। তাঁদের কাছে যা ছিল প্রিয়-- তাই তাঁরা স্বপ্ন দেখতেন নক্সায়-- বুনে তুলতেন তাঁদের নির্মল, অনিশ্চিত প্রেম।''
বিচলিত কণ্ঠে কথা বলছিলেন টলস্টয়, তাঁর চোখে ভরে এসেছিল জল। সেই দিনই আবার শেখভের শরীরের তাপটাও বেড়ে গিয়েছিল খুব। তিনি বসে ছিলেন মাথা নিচু করে, জ্বরের তাপে গাল দুটো লাল হয়ে উঠেছে, আস্তে আস্তে চশমার কাচ মুছছিলেন। অনেকক্ষণ ধরে তিনি চুপচাপ বসেছিলেন, তারপর একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। কথা বললেন চাপা, লজ্জিত কণ্ঠে : ''অনেকগুলো ছাপার ভুল থেকে গেছে ওটায়।''
* * *
শেখভ সম্পর্কে অনেক কিছু লেখা যায় কিন্তু সে লেখা হওয়া চাই সুন্দর সূক্ষ্ম বিচারক্ষম-- যা আমার নেই। তিনি নিজে যেমন করে লিখেছেন 'প্রান্তর' (দি স্টেপ)-- অদ্ভুত সে গল্পের বাতাবরণ, এত মৃদু এবং রুশীয় ধারায় এত করুণ বিষণ্ণ-- তেমনি ভাবেই লেখা চাই। যেন একটা গল্প -- কারুর নিজের জন্য। এমন মানুষের স্মৃতিচারণ মঙ্গলকর, এ জীবনে এনে দেয় একটা নতুনতর শক্তি, একটা পরিষ্কার সুস্পষ্ট অর্থ।
পাপ এবং বিচ্যুতি সত্ত্বেও মানুষ এ পৃথিবীর কেন্দ্র-গত শক্তি। সহযাত্রী মানুষের প্রেমের জন্য আমরা ক্ষুধিত এবং যখন ক্ষুধার্ত-- তখন আধ-সেঁকা রুটিও আমাদের কাছে মিষ্টি লাগে।
0 মন্তব্যসমূহ