অনুবাদ গল্প।। বিম্বিত এগারো নয় দু- হাজার এক

পাওলো কোয়েলহো
ভাষান্তর: বিপ্লব বিশ্বাস

এখনই কেবল,ক' বছর পর,এসব ঘটনার কথা লিখতে পারি। তখন লিখিনি,এড়িয়ে গেছি,যাতে করে সবাই নিজের মতো করে সেই আক্রমণের ফলাফল নিয়ে ভাবতে পারে।

কোনও বিয়োগান্তক ঘটনার যে কোনও না কোনও ভাবে ইতিবাচক ফল থাকতে পারে তা মেনে নেওয়া সবসময়ই কঠিন। কল্পবিজ্ঞানের সিনেমার কোনও দৃশ্য যেন ভয়াল দৃষ্টি নিয়ে দেখছি-- এমনভাবে যখন যমজ মিনারকে হাজার হাজার মানুষ পেটে নিয়ে ধ্বসে যেতে দেখলাম,তাৎক্ষণিকভাবে দুটি কথা মাথায় এল: এক,যা ঘটল তার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের আতঙ্কিত আর নপুংসক মনে হল; দুই,মনে হল, পৃথিবীটা যেন আর আগের জায়গায় ফিরবে না।

সেই একই বিশ্বকে আর পাবনা ঠিকই,কিন্তু ঘটনা ঘটে যাবার পর এতটা ভাবনাচিন্তার পথ পেরিয়ে এখনও মনে হয়,হঠাৎই যে অতগুলি মানুষ মরে গেল তা কি সব বৃথা? না কি বিশ্ব বাণিজ্যকেন্দ্রের ধ্বংসাবশেষের নিচে দোমড়ান ইস্পাত, ধুলো, মরণচিহ্ন ছাড়া ভিন্ন কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে?

আমি বিশ্বাস করি,প্রতিটি মানুষের জীবনকে কোনও না কোনও সময় চরম দুঃখ ভয়ঙ্করভাবে ছুঁয়ে যায়। তা হতে পারে কোনও নগরের ধ্বংস, কোনও শিশুর অকালমৃত্যু, কোনও ভিত্তিহীন অভিযোগ অথবা বিনা নোটিশে কোনও অসুখের আক্রমণ যা স্থায়ী পঙ্গুত্বের পথে মানুষকে ঠেলে দেয়। জীবন এক অবিরাম ঝুঁকি এবং তা যদি কেউ ভুলে বসে থাকে তবে কপাললিখনের মুখো মুখি হবার প্রস্তুতিটুকুও তার থাকবে না। আমরা যখন অনিবার্য কষ্টের সামনাসামনি হই,আমরা চেষ্টা করতে বাধ্য হই,এবং কী ঘটছে আঁচ করে আমাদের ভয়কে পরাস্ত করতে চাই আর পুনর্নির্মাণের কাজে উঠেপড়ে লাগি।

এহেন দুঃখকষ্টের ও নিরাপত্তাহীনতার মোকাবিলায় প্রথম যে কাজটি আমাদের করা আবশ্যিক তা হল,যেমনভাবে সে আসবে তেমনিভাবেই তাকে গ্রহণ করা। এমনতর অনুভবের সাথে আমরা এমন আচরণ করব না, এগুলিকে নিয়ে কিছুই করার নেই,অথবা সেগুলিকে শাস্তিতে রূপ দিয়ে আমাদের শাশ্বত দোষীভাবকে খানিকটা তৃপ্ত করা যায়।

সেদিনের সেই বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রে আমাদের মতো সেইসব মানুষই ছিল যারা নিজেদের নিরাপদ বা অসুখী ভাবছিল,পরিপূর্ণ মনে করছিল বা সংগ্রামের পথে আরও বড় হতে চাইছিল যাদের পরিবারের লোকজন ঘরে তাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল অথবা বিশাল নগরীর একাকিত্বে কেমন যেন বিষাদে ডুবে যাচ্ছিল। তারা কেউ আমেরিকী,কেউ ইংরেজ, জার্মান, ব্রেজিলীয় বা জাপানি ; বিশ্বের বিভিন্ন কোণ থেকে জড়ো হওয়া মানুষ, একই সাধারণ অথচ রহস্যময় ভাগ্যজালে আটকে থাকা লোকজন প্রায় সকাল নটায় একই জায়গায় যা কারও কাছে খুব মনোরম আবার কারও কাছে খুবই পীড়াদায়ক। দুটি আকাশছোঁয়া মিনার যখন ভুস করে ভেঙে পড়ল,শুধু এই মানুষগুলিই যে মরে গেল তা নয়; আমরা সবাই খানিকটা হলেও মরে গেলাম আর এই বিশাল বিশ্ব যেন ক্ষুদ্রতর হয়ে গেল।

কোনও বিশাল ক্ষতির মুখে পড়ে তা সে বস্তুগত, আধ্যাত্মিক বা মনস্তাত্ত্বিক যাই হোক না কেন,সেই জ্ঞানীপুরুষের কথা আমাদের মনে করতে হবে: ধৈর্য এবং সেই নিশ্চিন্তিবোধ যে জীবনে তা সবই অস্থায়ী। সেই বিশেষ মতবাদ থেকেই আমাদের প্রচলিত মূল্যবোধগুলিকে নতুনভাবে দেখতে হবে। এ বিশ্ব যদি পুনরায় নিরাপদে বাসযোগ্য না হয়,অন্তত বেশ কিছু বছরের জন্য না হলেও, তাহলে এই হঠাৎ পরিবর্তনের সুযোগ আমরা নেব না কেন,কেনই বা যা করতে চেয়েছি, সবসময়, অথচ সাহস করে করতে পারিনি, তা করব না?২০০১- এর এগারোই সেপ্টেম্বরের সেই সকালে কত মানুষ তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেই বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রে ছিল,তাদের অযোগ্য বৃত্তির পিছনে ছুটছিল, অপছন্দের কাজ করছিল-- শুধুমাত্র সেই কারণেই যে কাজটি নিরাপদ, প্রচুর উপার্জন তাতে আর বুড়ো বয়সের অবসর ভাতাও যথেষ্ট।

পৃথিবীতে সেটাই ছিল বিরাট এক পরিবর্তন, আর যারা ঐ দুই ধ্বস্ত মিনারের নিচে চাপা পড়ে গেল তারা আমাদের নিজনিজ জীবন ও মূল্যবোধ বিষয়ে নতুন ভাবনা উস্কে দিল। মিনার দুটি ভেঙে পড়ার সাথে সাথে চাপা পড়া মানুষের স্বপ্ন আর আশাও হিঁচড়ে পড়ে গেল; কিন্তু তারা আমাদের সামনে নতুন দিগন্ত খুলে দিল আর জীবনের মানে নতুন করে খোঁজার পথ করে দিল। 

কথিত যে,ড্রেসডেন- এ বোমাপতনের পরপরই এক পথিক এক জমিতে ধ্বংসস্তূপের পাশ দিয়ে যাবার সময় তিনজন শ্রমিককে দেখল। জানতে চাইল,তোমরা এখানে কী করছ? 

প্রথম শ্রমিক ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,দেখতে পাচ্ছ না,আমি এই পাথরসব সরাচ্ছি!
দেখছ না? আমি মজুরির ধাঁদা করছি,দ্বিতীয়জন বলল।

দেখছ তো,তৃতীয়জন বলল,আমি এই বিশপ গীর্জাটিকে নতুন করে গড়ছি!

যদিও এই তিনজনই একই কাজে নিযুক্ত, শুধু একজনেরই জীবন ও তার কাজের প্রকৃত অর্থ বিষয়ে সম্যক বোধ আছে। তাই এস,সব্বাই মিলে এই আশাই করি,১১ই সেপ্টেম্বর ২০০১- এর পর এ বিশ্বে যা কিছু থেকে গেল, আমাদের আবেগসর্বস্ব ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উঠে এসে নিজেদের সক্ষম প্রমাণ করি আর সেই গীর্জার পুনর্নির্মাণ করি যা ছিল স্বপ্নের ভিতর অথচ তা সৃষ্টি করতে কখনও সাহস হয়নি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ