নগ্নপদ ইলিয়াড ও আসুয়েলার বিপ্লব

রাজু আলাউদ্দিন 

নিকারাগুয়ার রুবেন দারিও, কিংবা পেরুর সেসার বাইয়েহোর নামটি স্মরণে রেখেই আমরা প্রায়শই বলতে শুনি যে লাতিন আমেরিকায় চিলেই হচ্ছে কবিতার সেই দেশ যা সৃষ্টির বৈচিত্র ও গভীরতা দিয়ে বিশ্বের বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীকে অভিভূত করেছে। এমনটা বলার কারণও আমাদের অজানা নয়, কারণ চিলেতে প্রায় কাছাকাছি সময়ে বিসেন্তে উইদোব্রো, গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, পাবলো নেরুদা, পাবলো দে রোকা ও নিকানোর পাররার মতো বিশ্বমানের কবির আর্বিভাব।
অন্যদিকে, কথাসাহিত্যের জন্য আর্হেন্তিনাকেই পরানো হয় প্রশংসার অতুল্য মুকুট; কেননা এস্তেবান এচেবেররিয়া থেকে শুরু করে মাসেদোনিও ফের্নান্দেস, হোর্হে লুইস বোর্হেস, আদোল্ফো বিয়ই কাসারেস, দানিয়েল মোইয়ানো, হুলিও কোর্তাসার ও মানুয়েল পুুইগ-এর মতো লেখকরা কেবল লাতিন আমেরিকার প্রেক্ষাপটেই নয়, গোটা বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষাপটেই বিস্ময়কর উত্থান হিসেবে স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে আছেন। কিন্তু লাতিন আমেরিকার একেবারে উত্তরে অবস্থিত মেহিকো সম্পর্কে এমন কিছু কখনোই বলতে শুনা যায় না। অথচ মেহিকো, কী কবিতায়, কী প্রবন্ধে, কী কথাসাহিত্যে-বলতে গেলে সাহিত্যের এই তিনটি শাখায়ই রয়েছে তার অনন্য অর্জন। কবিতায়, সেই ঔপনিবেশিক যুগের বিস্ময়কর প্রতিভা সর হুয়ানা ইনেস্ দে লা ক্রুস থেকে শুরু করে আমাদো নের্বো, রামোন লোপেস বেলার্দে, হাবিয়ের বিইয়াউররুতিয়া, হোসে গরোস্তিসা কিংবা লাতিন আমেরিকার প্রথম ঔপন্যাসিক হোসে হোয়াকিন ফের্নান্দেস দে লিসার্দি, তিনিও মেহিকানো। প্রবন্ধে দার্শনিক ও ভাবুক হোসে বাসকন্সেলোস, এদমুন্দো ওগোরমান, আলফোনসো রেইয়েস, অক্তাবিও পাস। অর্থাৎ তিনটি ক্ষেত্রেই মেহিকোর রয়েছে অসামান্য অর্জন। আর কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা যদি সময়ক্রমের ধারাবাহিকতায় দেখতে চাই তাহলে লক্ষ্য করবো লিসার্দি দিয়ে গোটা লাতিন আমেরিকার উপন্যাসের যে শুরু, তার পরে ধীরে ধীরে এসে যুক্ত হচ্ছেন বিস্ময়কর সব ঔপন্যাসিক, যেমন হুয়ান রুলফো, আগুস্তিন ইয়ানঞেস, হুয়ান গার্সিয়া পন্সে, হোসে এমিলিও পাচেকো, ফের্নান্দো দেল পাসো কিংবা কার্লোস ফুয়েন্তেস। কিন্তু এদের সবার আগে উচ্চারণ করতে হবে মারিয়ানো আসুয়েলার নাম, যিনি কেবল মেহিকোরই নয়, গোটা লাতিন আমেরিকার প্রেক্ষাপটেই প্রথম সত্যিকারের এক উল্লম্ফন ঘটিয়েছিলেন কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে।

ঔপন্যাসিক মারিয়ানো আসুয়েলা লিসার্দির সূচনাকে সবচেয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে বিস্ময়কর উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ মেহিকো সাহিত্যের কেবল একটি মাত্র শাখায় নয়, প্রায় তিনটি শাখাতেই তার সৃষ্টিশীলতা ও মননের বিশ্বজনীন বিস্তারকে নিশ্চিত করে তুলেছে নিভৃতে। নিভৃতেই তো, কারণ এক অক্তাবিও পাস ও কার্লোস ফুয়েন্তেস ছাড়া উল্লেখিত আর কার কথা আমরা তেমনভাবে জেনেছি? আর আসুয়েলাতো আরও পরের কথা, যিনি আমাদের অজ্ঞতার তলানিতে পড়ে আছেন বহুকাল যাবৎ। আমাদেরই বা আর দোষ কতটুকু, ১৯১৫ সালে লোস দে আবাহো বাংলায় যাকে বলা যেতে পারে নিচের মহল-এই যুগান্তকারী উপন্যাসটি লেখা সত্ত্বেও স্বভাষী পরিমন্ডলেই তিনি বহুদিন ছিলেন উপেক্ষিত এবং যাকে প্রায় এক দশক অপেক্ষা করতে হলো এই উপন্যাসের গুরুত্ব সম্পর্কে নিজ দেশে নড়াচড়া লক্ষ্য করার জন্য। এবং প্রকাশের পর আরও প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর অপেক্ষা করতে হলো এটুকু জানার জন্য যে লোস দে আবাহো চূড়ান্ত বিচারে এমনই এক উপন্যাস যাকে এড়িয়ে লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যের ইতিহাসের লক্ষ্যযোগ্য বাঁকগুলোকে চিহ্নিত করাই সম্ভব নয়। কিন্তু এই স্বীকৃতির মুকুট পাওয়ার পরও বিতর্কের বিরোধী বুলেটে আসুয়েলা ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন বহুবার। বিপ্লবী নাকি প্রতিবিপ্লব–এই তর্কে বিভক্ত হয়েছে দুই শিবির। ভর্ৎসনা ও গঞ্জনার কাঁটায় তাকে রক্তাক্ত করা হয়েছে দুই শিবিরের অসার ও বুনো আক্রমণে। কেউ তাকে চিহ্নিত করেছেন বিপ্লবীর ছদ্মবেশে ‘প্রতিবিপ্লবী’ হিসেবে আর প্রতিবিপ্লবীরাও তাকে চিহ্নিত করেছেন ‘বিশ্বাসঘাতক’ রূপে। তাই তার্কিকদের কাছে তিনি বহুদিন যাবৎ দ্বিধাদ্বন্ধের বিষয় হয়ে থাকলেন কী বলে তাকে অভিহিত করা হবে: ‘বিপ্লবী ঔপন্যাসিক’ নাকি ‘বিপ্লবের ঔপন্যাসিক’।

মেহিকোতে বলিষ্ঠ (Virile) সাহিত্য আছে কিনা-১৯২৪ সালের ২০ ডিসেম্বর হিমেনেস রুয়েদার এই উত্তেজক প্রশ্ন দিয়ে তর্কের শুরু হলেও, রুয়েদার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়তে গিয়েই তখনকার তরুণ সাহিত্য-সমালোচক ফ্রান্সিস্কো মনতের্দে ঐ তর্কের সদ্যজাত আগুনে লোস দে আবাহো নামক আসুয়েলার বিস্ফোরক জ্বালানিটি ছুঁড়ে মারেন। আর তাতেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো বিতর্কের চন্ড শিখা। এই সূত্রে তর্কের কাফেলায় যুক্ত হয়েছেন তখন অনেকেই, তাদেরই একজন, এদুয়ার্দো কলিন, উপন্যাসটির পক্ষে প্রশস্তি জানালেও, এটি আদৌ মেহিকোনো বিপ্লবের সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব করে কিনা সে ব্যাপারে তার উত্তর ছিল আক্রমণকারীদের মতোই নেতিবাচক। তার মতে, “আমাদের জাতীয় সারবত্তা, এমন কি বিপ্লবও কেবল যুদ্ধ আর রক্তপাত নয়, বরং অন্যকিছু।”
Our national essence, the revolution itself, is not merely war and blood, but other things (Mariano Azuela, The Underdogs, University of Pittsburgh press, 1990, p 159)
অর্থাৎ পক্ষ আর বিপক্ষও শেষ পর্যন্ত একই রসুনের কোয়া যাদের তলদেশ অভিন্ন এক জায়গায় গ্রথিত। 

সেই সময় প্রভাবশালী আরেক সাহিত্য সমালোচক, বিক্তোরিয়ানো সালাদো আলবারেস ১৯২৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন: “(লোস দে আবাহো) বৈপ্লবিক নয়, কারণ বিপ্লবকে এটি ঘৃণা করে, আবার এটি প্রতিক্রিয়াশীলও নয়, কারণ বিগত যুগের জন্য এর নেই ব্যাকুল আগ্রহ, কারণ এটি যখন লেখা হয়েছে তখন ফ্রান্সিস্কো (বিইয়া) ছিলো প্রতিক্রিয়াশীলতারই নামান্তর। এটা বিশুদ্ধভাবে এবং অকপটভাবেই নাস্তিবাদী। যদি এটা থেকে শিক্ষণীয় কিছু থেকে থাকে, তবে সেটা হচ্ছে বৃথাই ছিল এই আন্দোলন, এতে এমন কোনো বিখ্যাত বিপ্লবীরা ছিল না যারা তাদের কাজ সম্পর্কে পরিপূর্ণ সচেতনতা নিয়ে শুভ বিশ্বাস থেকে কাজ করেছেন। কিংবা যদি তা হয়েও থাকে তাহলে এজন্য তারা অনুতপ্ত ছিল, এমনকি এ কারণে শত্রুদের চেয়েও নিজেদের কর্মকাণ্ডকেই তারা বেশি ঘৃণা করতো।”
(Los de Abajo) is not revolutionary, because it abhors revolution; not is it reactionary, because it does not long for any past epoch and because reaction went by the name Francisco Villa when the work was written. It is purely and frankly nihilist. If any lesson could be extracted from it (and pray God there be no reason to posit any),it would be that the movement was in vain, that there were no famous revolutionaries who acted in good faith with full awareness of what they were doing, or if there were they repented of their actions, detesting them even more than their enemies. ( Mariano Azuela, The Underdogs, University of Pittsburgh press, 1990, p 160)

এ ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো যখন বের হচ্ছিল আসুয়েলা তখনও জীবিত। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে তিনি এসবে ভীষণভাবে ক্ষুদ্ধ ও বিরক্ত হয়েছিলেন। যদিও তিনি এসব প্রতিক্রিয়া ও আক্রমণের প্রতি কোনো সাড়া দেননি। তবে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি যখন স্মৃতিকথা লিখলেন, সেখানে তিনি তার পুঞ্জীভূত ক্রোধ আর সামলে রাখতে পারেননি:
“ইদাল্গো নাট্যশালার এক সম্ভ্রান্ত মহিলা যখন আমার উপন্যাসের মঞ্চায়ন করেছিল তখন বিপ্লবের কিছু পোষা কুকুর(Lapdogs) আর মুনাফাখোর আমাকে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করেছে আর আমার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে প্রতিক্রিয়াশীলতার চিহ্ন।”
(Certain lapdogs and profiteers of the revolution declared me persona non grata and hung around my neck the level of reactionary when an influential and high-born lady did a stage version of my novel for performance in Hidalgo Theater.” (Mariano Azuela, Underdogs, University of Pittsburgh press, 1990, p 161)
একই স্মৃতিকথায় তিনি আরও জানাচ্ছেন: “আমার বইগুলোতে (বিপ্লবীদের) এই খুঁতগুলো উল্লেখ করার কারণে আমাকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ আখ্যায়িত করায় কতটা বিস্মিত হয়েছিলাম তা আপনি অনুমান করতে পারছেন। ওই শূন্যগর্ভ শব্দ ছাড়া চোর আর গুপ্তঘাতকগুলো আত্মরক্ষার জন্য এর চেয়ে ভালো আর কোনো উপায় খুঁজে পায়নি।”
“বিপ্লবের বিজয়ের পরপরই সর্বোচ্চ শক্তি ও স্বচ্ছতার সঙ্গে যখন আমি নতুন ধনিক শ্রেণীর উত্থানের বিষয়টি দেখিয়ে দিলাম, তখন উচ্ছিষ্টজীবী পোষা কুকুরগুলো আমাকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো।”
You can imagine how surprise I was that when I pointed out those defects [of the revolutionaries] in my books I was branded a `reactionary’! The thieves and assassins were unable to find any better defense than that hollow word.

When right after the triumph of the revolution I pointed out with absolute clarity and energy the appearance of a new class of rich, the lapdogs who pick up table scraps, they barked at me, calling me a reactionary.” (Mariano Azuela, Underdogs, University of Pittsburgh press, 1990, p 161)

লোস দে আবাহো সম্পর্কে বিভিন্ন মহলের ভুল ধারণা তার মনকে কতটা বিষিয়ে তুলেছিলো এই ছোট উদ্ধৃতি থেকে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবে স্বদেশে ডান এবং বাম শিবিরে এই উপন্যাস নিয়ে যত বাক-বিতন্ডাই থাকুক না কেন, বিদেশে এর গুরুত্ব সম্পর্কে কোন (রাজনৈতিক) মতাদর্শিক দ্বিধা ছিল না। ১৯৪৫ সালে এক বক্তৃতায় লেখক নিজেই সে কথা জানিয়েছিলেন এভাবে:
“জীবনে লেখক হিসেবে অন্যতম চূড়ান্ত তৃপ্তি ভোগের জন্য The Underdogs উপন্যাসটির কাছে আমি ঋণী। খ্যাতিমান কম্যুনিষ্ট, বিখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক অঁরি বারবুস এটি অনুবাদ করে প্যারিসে পরিচালিত তার Le Monde পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন, ফ্রান্সে রাজতন্ত্রপন্থী ও চরম ডানপন্থী সংগঠন L’action francaise আমার উপন্যাসটিকে প্রশংসার সাথে গ্রহণ করেছে। একজন স্বাধীন লেখকের জন্য এই ঘটনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর বাকিটা বলা নিষ্প্রয়োজন।”
I owe to my novel Los de abajo one of the greatest satisfactions which I have enjoyed in my life as a writer. The famous French novelist Henri Barbusse, a renowned communist, had it translated and published in the magazine Le Monde, in Paris, which he directed. The Accion Francesa, an organ of the monarchists and right-wing extremists in France, welcomed my novel with praise. This fact is very significant for an independent writer and needs no comment. (Mariano Azuela, The Underdogs, University of Pittsburgh press, 1990, p 162)

কিন্তু একটা বিষয় জানানো প্রয়োজন যে এইসব বিতর্কের মূলে যে-বিষয়টি জ্বালানি বা উস্কানি হিসেবে কাজ করেছে তাহলো উপন্যাসটির ঐতিহাসিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বিশেষ করে বিপ্লবের আগুনে মোড়ানো একটি দশক যার কালপরিধি ১৯১০ থেকে ১৯২০। ১৮৫৭ সালে মেহিকানো সংবিধানের আদর্শ ও নীতিমালা লঙ্ঘন করে পোর্ফিরিও দিয়াস নামক সিন্দাবাদের যে-বুড়োটি মেহিকোর কাঁধে চেপেছিল তাকে হটাতেই উদারপন্থী ও বুদ্ধিজীবীরা তৎপর হয়ে উঠলেন। এই তৎপরতার প্রথম রাজনৈতিক অভিব্যক্তি ঘটে ফ্রান্সিস্কো মাদেরোর ‘সান লুইস দে পতোসি পরিকল্পনা’র (Plan de San Luis Potosi) মাধ্যমে। ওটাই ছিলো বিপ্লবের প্রথম প্রজ্জ্বলন। 

যাকে হটাতে গিয়ে এই পরিকল্পনা তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে নির্বাসনে গেলেও মেহিকো শান্ত ও স্থিতির পরিবর্তে প্রবেশ করে বিপ্লবী ও প্রতিবিপ্লবীদের বহুমুখী মত ও পথের এক জটিল ঘুর্ণিপাকে। ‘মত’ ও ‘পথ’ যদিও বলছি, আসলে ‘মত’-এর চেয়ে ‘পথ’-এর প্রভাবই ছিল প্রবল। মত বললেই রাজনৈতিক বা আদর্শিক মতাদর্শের এক বিশ্বাস আমাদের মনে জেগে উঠতে চায়। কিন্তু রুশ বিপ্লবেরও সাত বছর আগে ঘটে যাওয়া মেহিকোর বিপ্লবে তেমন কোনো ‘মত’-এর অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞ ও পন্ডিতকুলের সবাই। রুশ বিপ্লব যে-আদর্শ থেকে বিস্ফোরিত হয়েছিলো, এরই সাত বছর আগে ঘটে যাওয়া মেহিকোর বিপ্লব তেমনটা ছিল না। “মতাদর্শিক পূর্বসূরীর অভাব আর সর্বজনীন আদর্শের সাথে সংযোগের অপ্রতুলতাই এই বিপ্লবের বৈশিষ্টপূর্ণ দিক, এবং তা পরবর্তী বহু সংঘাত ও সংশয়েরও বীজ।” (This lack of ideological precursors and the scarcity of links with a universal ideology are characteristic aspects of the Revolution, and the seeds of many later conflicts and confusions. —-Octavio Paz, The labyrinth of Solitude, Grove Weidenfeld, New York, 1985, p 137) “এই বিপ্লবের মধ্যে আসলেই কোনো ধারণা (ideas) ছিল না। এ হচ্ছে বাস্তবতার এক বিস্ফোরণ।” (The Revolution has hardly any ideas. It is an explosion of reality—-Octavio Paz, The labyrinth of Solitude, Grove Weidenfeld, New York, 1985, p 149) তবে ‘আদর্শ’ বা ‘ধারণা’ এর পেছনে থাক বা না থাক, অস্বীকার করার উপায় নেই যে এটি মেহিকোর ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। মেহিকোর সাংস্কৃতিক জীবনে এর প্রভাব কতটা পরেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যাবে যদি আমরা তাদের ইতিহাসের দিকে তাকাই। এই বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী প্রধান চরিত্ররা মেহিকানোদের কাছে এখনও জনপ্রিয় কিংবদন্তী–দোষ ও গুণের বিচার বিবেচনা ছাড়াই। যদিও তাদের চরিত্রের মধ্যে ‘নৃশংসতা ও জংলিপনার’(Brutality and uncouthness—Octavio Paz) কোনো কমতি ছিল না।

আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করবো, আজ বিপ্লবকে ঐতিহাসিকরা কিংবা অক্তাবিও পাস-এর মতো লেখকরাও যে দৃষ্টিতে দেখছেন, মারিয়ানো আসুয়েলা প্রায় নির্ভুল পর্যবেক্ষণ ও বর্ণনায় তার সেই ইঙ্গিতগুলো রেখে গিয়েছিলেন উপন্যাসের মুখোশে। এই একই কারণে কার্লোস ফুয়েন্তেস এই উপন্যাসে বিপ্লবের চিত্রায়ন সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিকে আরও গভীরে নিয়ে জানালেন যে:

“বহু শতাব্দির পাথরের নিচ থেকে আসুয়েলার নারী পুরুষেরা বেরিয়ে আসে: এরা সবাই নতুন বিশ্বের (Nuevo mundo) যাবতীয় দুঃস্বপ্ন ও স্বপ্নের শিকার। আমরা কি বিস্মিত হবো পাথরের নিচ থেকে বেরিয়ে আসার সময় এদেরকে যদি কখনো কখনো মনে হয় সূর্যের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া কীটপতঙ্গ, অন্ধ বৃশ্চিক যারা আসতেক, ইবেরীয় এবং প্রজাতন্ত্রের শক্তির শিলাখন্ডের নিচে দমিত এবং শত শত বছরের অন্ধকারে দিকভ্রান্ত হয়ে চক্রাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে? তারা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসেছে, তারা এই পৃথিবীকে ঠিক ঠাহর করতে পারে না, তারা ঘুরে বেড়ায়, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়, মারমারি করে, তারা বিপ্লবে যায়।” (Debajo de esta losa de siglos aparecen los hombres y mujeres de Azuela: son las victimas de todos los sueños y todas las pesadillas de Nuevo Mundo: Hemos de sorprendernos de que, al salir de debajo de la piedra, parezcan a veces insectos, alacranes ciegos, deslumbrados por el sol, girando en redondo, perdido el sentido de la orientacion por siglos y siglos de oscuridad y oprecion bajo las rocas del poder azteca, iberico y republicano? Emergen de esa oscuridad: no pueden ver con claridad el mundo, viajan, se mueven, emigran, combaten, se van a la revolucion.—Carlos Fuentes, La Gran Novela Americalatina, Alfaguara, Mexico, 2011, p114 )
মারিয়ানো আসুয়েলা প্রায় নির্ভুল অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তার সময়ে ঘটে যাওয়া বিপ্লবের ছবিটি এঁকেছেন মহাকাব্যিক ইশারায় ঠাসা মাত্রই সোয়াশ’ পৃষ্ঠার পরিসরে। মহাকাব্যিক বললাম বটে, কিন্তু ফুয়েন্তেসের ভাষায়, আসুয়েলার হাতে ‘অধঃপতন’ ঘটেছে মহাকাব্যের, কারণ “সঠিক বলে দাবী করা তো দূরের কথা, মহাকাব্যকে কেবল প্রতিফলন হিসেবে দেখাকেও আসুয়েলা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি হচ্ছেন সেই ঔপন্যাসিক যিনি সাধারণ ঐক্যকে ভেঙে মহাকাব্যকে দুমড়ে মুচড়ে বদলে দেয়ার উদ্দেশ্যে মহাকাব্যিক বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। এক অর্থে, আসুয়েলা এইভাবে বের্নাল দিয়াস কর্তৃক সূচিত চক্রটিকে পরিণতি দেন: তিনি বিজয়ের (Conquista) শিলাখন্ড উত্তোলন করে আমাদেরকে দেখতে বলেন পিরামিড ও চার্চ, মিথ ও জমিদারি, স্থানীয় সামন্তপ্রভু ও জাতীয় স্বৈরাচারের চাপে পিষ্ট প্রাণীদের।” (Azuela rehusa una epica que se conforme con reflejar, mucho menos con justificar: es una novelista tratando un material epico para vulnerarlo, dañarlo, afectarlo con el acto que rompe la unidad simple. En cierto modo, Azuela cumple asi el ciclo abierto por Bernal Diaz, levanta la piedra de la conquista y nos pide mirar a los seres aplastados por las piramides y las iglesias, la mita y la hacienda, el casicazgo local y la dictadura nacional.—- Carlos Fuentes, La Gran Novela Americalatina, Alfaguara, Mexico, 2011, p118)

আসুয়েলা মাত্রই তিনটি অধ্যায়ে গোটা উপন্যাসটিকে সাজিয়েছেন। কিন্তু এই সজ্জার মধ্য দিয়ে তিনি পশ্চিমের মহাকাব্যিক ঐতিহ্যের এমন এক দ্বার উন্মোচন করেছেন যার বিষয়বস্তুগত ও কাঠামোগত নিরীক্ষা আমরা লক্ষ্য করবো তারই পরবর্তী লেখক হুয়ান রুলফোর পেদ্রো পারামোয় দান্তের ডিভাইন কমেডির সৃষ্টিশীল পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে কিংবা আরও দূরে আর্হেন্তিনায় হোর্হে লুইস বোর্হেস তার একাধিক গল্পে এই সৃষ্টিশীল দুঃসাহসকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন বহুদূর, কিন্তু তা আরও ছোট্ট পরিসরে, যেমন ‘এল আলেফ’ নামক গল্পে আমরা দেখবো ডিভাইন কমেডিকে তিনি ব্যাঙ্গ্যাত্মক ভঙ্গিতে সংকুচিত করে নিয়ে আসবেন মাত্রই কয়েক পৃষ্ঠার পরিসরে যেখানে বোর্হেস নিজেই দান্তে আর বোর্হেসের বেয়াত্রিস বিতার্বো হয়ে ওঠে দান্তের বেয়াত্রিস পোর্তিনারি। কিন্তু রুলফো বা বোর্হেস যে জটিল প্রক্রিয়ায় এই বিন্যাসকে মূর্ত করে তোলেন, আসুয়েলা আপাতদৃষ্টে প্রায় এলোমেলো ভঙ্গিতে সাজিয়ে তোলেন মহাকাব্যের ‘অধঃপতন’কে। ফুয়েন্তেসের বুদ্ধিদীপ্ত বর্ণনায় এই উপন্যাসের বৈপ্লবিক ভূমিকাটি যদি আমরা বুঝতে চাই তাহলে এর অর্থ দাড়ায়:
“মহাকাব্যের ভিত ক্ষইয়ে দিয়েছে উপন্যাস, আর উপন্যাসের ভিত ক্ষইয়ে দিয়েছে ঘটনাপঞ্জী, বিভিন্ন জনরায়(Genres) সাঁতার কাটছে দ্ব্যার্থক ও অশান্ত টেক্সট এবং তা এইসব জনরার (Genres) সম্ভাব্যতা ও অসম্ভাব্যতার এক ইস্পানো-আমেরিকান সংস্করণ হাজির করছে।’(Epic undermined by the novel, the novel undermined by the chronicle, an ambiguous and disquieting text that swims in the waters of several genres and offers a Spanish American version of the possibilities and impossibilities of those genres.—-Mariano Azuela,The Underdogs, University of Pittsburgh press, 1990, p 129)

আসুয়েলার এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র, অর্থাৎ দেমেত্রিয় মাসিয়াস ইলিয়াড-র হেক্টর বা একিলিস, কিংবা চানসন দে রোলাঁ, রাজা আর্থার-এর বীর কিংবা স্পানঞল মিও সিদ-এর বীরের দূরবর্তী ছায়া নিয়ে সে হয়ে ওঠে এমন এক চরিত্র যে বিপ্লবের লক্ষ্য সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ। দেমেত্রিয় বিপ্লবে এসেছে রাজনৈতিক আদর্শ থেকে নয়, বরং স্থানীয় জমিদারের (Casique) সাথে বিরোধের সূত্র ধরে। গুরুত্বের বিচারে এর পরেই আসবে লুইস সের্বান্তেসের নাম যে দেমেত্রিয়কে রাজনৈতিক দীক্ষা ও পরামর্শদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। দেমেত্রিয়র অন্য সব অনুসারীদের মধ্যে লুইসই একমাত্র শিক্ষা দীক্ষায় আলাদা চরিত্রের মানুষ। পেশায় সাংবাদিক, চিকিৎসাশাস্ত্রেও আছে যার এলেম। বিপ্লবের পর নিজের আখের গুছিয়ে নেয়া সে-ই একমাত্র ব্যক্তি এই উপন্যাসে।
সত্যিকারের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে এ উপন্যাসে যে চরিত্রটি স্বল্প পরিসরেও উজ্জল হয়ে আছে সে আলবের্তো সলিস। “বিপ্লবের কারণে নয়, বরং বিপ্লবের নানা ত্রুটির কারণে সলিসের মোহভঙ্গ হয়েছে।” (Solis esta desilusionado, no de la revolucion, sino de sus fallas.—-E. Anderson Imbert, Historia de la literature Hispanoamericana, Fondo de cultura Economica, Mexico, 1997, p 441)| । সলিস ছাড়াও এই উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ আরও কয়েকটি চরিত্র হচ্ছে বেনান্সিও, আনাস্তাসিও মন্তানঞেস, মেকো মান্তেকা, দন মনিকো আর পাশবিক চরিত্রের গুয়েরো মার্গারিতো।

আরও কিছু গৌণ চরিত্রসহ এরাই এই উপন্যাসের গতি ও বিস্তারের মূল চালিকা শক্তি। কাহিনীও তেমন শাখা প্রশাখাময় বহু-বিস্তারী জটিল কোনো আদল নিয়ে গড়ে ওঠেনি। ব্যক্তিগত দ্বন্ধ থেকে প্রতিশোধের বাসনায় জড়ো হয়ে দেমেত্রিয়র দলটি বিপ্লবের স্বপ্নে একের পর এক অভিযান শেষে তারা গন্তব্যে পৌঁছায়। ইতালিয় চলচ্চিত্র পরিচালক সের্জিও লিওনের হাতে এই কাহিনী দুর্দান্ত ওয়েস্টার্ন ম্যুভি হয়ে উঠতে পারতো। কারণ সে রকম উপাদান এতে যথেষ্টই ঠাসা আছে।

কিন্তু এই উপন্যাসের মূল শক্তি ও অভিনবত্ব অন্যত্র: স্পানঞলভাষী কোনো উপন্যাসে এই প্রথম প্রায় সিনে চিত্রনাট্যের মতো কিছুটা ছাড়া ছাড়া ভঙ্গিতে কাহিনী বা ঘটনার বুনন দেখা যাবে। কাহিনীর দ্রুততার স্বার্থে শাখাপ্রশাখাময় ঘটনাংশের অনুপস্থিতিও এর গদ্যকে দিয়েছে গতিশীলতা। কিন্তু কী এমন বিষয় এই উপন্যাসে রয়েছে যা বিপ্লবী ও প্রতিবিপ্লবী উভয় পক্ষকেই অসন্তুষ্ট করেছিল? এর উত্তর দিতে গেলেও এই উপন্যাসের শৈলীগত বৈশিষ্ট্যের দিকেই আমাদের ফিরে তাকাতে হবে। এর কাহিনী বিন্যাস ও সংলাপ এমন ভঙ্গিতে রচিত হয়েছে যা কোনো পরম বা চরম বিশ্বাসের আভাস দেয় না কোনোভাবে, ফলে এটিকে যেমন বিপ্লবের উপন্যাস হিসেবে পড়া যেতে পারে, আবার একে প্রতিবিপ্লবের উপন্যাস হিসেবেও পড়া যেতে পারে। সম্ভবত এই কারণেই উভয়দিক থেকে আসুয়েলা আক্রান্ত হয়েছিলেন। এছাড়া উপন্যাসের কয়েকটি চরিত্রের মাধ্যমে ঔপন্যাসিক মেহিকানো বিপ্লবের চরিত্র ও চূড়ান্ত ফলাফলকে যেভাবে প্রকাশ করেছেন সেটাও ছিল এই উপন্যাসের বিতর্কিত হওয়ার একটা বড় কারণ। লুইস সের্বান্তেসের দূরদৃষ্টি আমাদেরকে বিপ্লবের চূড়ান্ত ফলাফল সম্পর্কে আভাস দিয়ে রাখে প্রথম অধ্যায়ে আগেভাগেই: “বিপ্লব শেষ হলে সব শেষ। কত রক্তপাত, কত মৃত্যু! বিধবা ও পিতৃহীন শিশুদের দুঃখের অন্ত নেই। এতসব কিসের জন্য? কয়েকজন বদমাশ শুধু ধনী হবে, আর বাকিরা আগের মতোই থাকবে বা অবস্থা আরও খারাপ হবে।” (প্রথম ভাগ, অধ্যায়-১৩)
অন্যদিকে সলিসের জবানীতে আমরা দেখতে পাবো বিপ্লবের কীটদষ্ট রূপটিকে:
“‘বর্বরতার মধ্যেও বিপ্লব কত সুন্দর।’ আবেগভরা কণ্ঠে সোলিস বলে। তার কন্ঠে ধীরে ধীরে নেমে আসে বিষাদ: “দুঃখজনক হলো ভবিষ্যতে যা ঘটবে তা এরকম নয়। আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। যখন যুদ্ধবিগ্রহ শেষ, কোনো গোলাগুলি নেই, তখনই শুরু হবে লুটপাট। আমাদের গণমনস্তত্ত্বে কেবল দুটোই শব্দ: লুট এবং হত্যা। আমরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে নেমেছি অত্যাচারী শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য, তাদের জন্য এটা কতই না হতাশাজনক। আমাদের সমগ্র প্রচেষ্টা কি তবে কয়েক হাজার অসুরের উত্থানের জন্য? হায় আদর্শহীনদের দেশ! স্বৈরাচারীদের দেশ! সমস্ত রক্তপাত বৃথা যাবে।”(প্রথমভাগ, অধ্যায়-২১)

এই উপন্যাসের দুটো জায়গায় আখ্যানকারের দুটি ছোট্ট বর্ণনায় উভয় পক্ষের চারিত্রিক সাযুজ্য আমরা দেখতে পাবো। ফেদেরালদের সৈন্যবাহিনীর প্রসঙ্গে ঔপন্যাসিক আসুয়েলার ইঙ্গিতময় প্রতীকি বর্ণনাটি হচ্ছে এরকম: “ছোট ছোট ঘোড়ায় ছোট ছোট লোক।” (প্রথম ভাগ, অধ্যায় -৩) আবার প্রতিপক্ষের অর্থাৎ বিপ্লবীদের কাহিনীর বর্ণনা দিতে গিয়ে মারিয়া আন্তোনিয়ার চোখ দিয়ে আমাদেরকে তিনি দেখাচ্ছেন:
“দূর থেকে কেমন খেলনা সৈনিকের মতো লাগছে।” (প্রথম ভাগ , অধ্যায়-১৫)
এই উপন্যাসের তৃতীয় ভাগে আমরা যখন কবি বালদেররামাকে এই বিপ্লবের জয়গান করতে শুনি, সাবেক এক সরকারী কর্মচারী (ফেদেরাল) তখন যা বলে তা বিপ্লবের আসল চেহারাটি চিনিয়ে দিতে আমাদেরকে আরেকটু সাহায্য করবে:
“বালদেররামা তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে প্রার্থনায় রত হয়: ‘হুচিপিলা, ১৯১০ সালের বিপ্লবের জন্মভূমি, কেবল ভালো লোকজন…স্বাপ্নিক ও শহীদ বিপ্লবীদের রক্তে রঞ্জিত পূণ্যভূমি।’
‘….কারণ তারা খারাপ হবার সময় পায়নি,’ পাশ দিয়ে যেতে যেতে একজন প্রাক্তন ফেদেরাল অফিসার রুঢ়ভাবে কথাটা শেষ করে। ভালদেররামা মুখ্যব্যাদান করে আকাশ ফাটিয়ে অট্টহাসি হাসে। পাহাড়ে পাহাড়ে সেই হাসির প্রতিধ্বনি ওঠে” (তৃতীয় ভাগ, অধ্যায়-৪)

এই উপন্যাসে বিপ্লবের চিত্রায়ন সম্পর্কে ফুয়েন্তেস আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ফরাসী বিপ্লবের স্যাঁ জুস্ত-এর হতাশা করোজ্জ্বল সেই অমোঘ উক্তি: “সব শিল্পই–বলেছেন ফরাসী তরুণ বিপ্লবী–জন্ম দিয়েছে বিস্ময়ের। রাষ্ট্র পরিচালনার শিল্প কেবল দানবের জন্ম দিয়েছে।” (Todas las artes—dijo el joven revolucionario frances—han producido maravillas. El arte de gobernar solo ha producido monstrous.—-Carlos Fuentes, La gran Novela Americalatina, Alfaguara, Mexico, 2011, p 118-119)
এই উদ্ধৃতির পরপরই ফুয়েন্তেস বলতে ভোলেন নি যে শুধু রাষ্ট্রই নয়, এমনকি “পরে বিপ্লবও তার নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়ায় আর এটাই হচ্ছে বিপ্লবের ট্রাজিক বিন্যাস।”

“Pero luego la revolucion se vuelve contra si mismo y este seria el orden tragico de la revolucion.”( Carlos Fuentes, La gran Novela Americalatina, Alfaguara, Mexico, 2011, p119) 

এই ভূমিকার শুরুতে ফুয়েন্তেসের বরাতে বলেছিলাম যে এই উপন্যাসের মাধ্যমে আসুয়েলা ক্ষইয়ে দিয়েছেন মহাকাব্যের ভিত। কিন্তু কিভাবে এই ধ্বংসের প্রক্রিয়ায় তিনি মহাকাব্যকে সম্পর্কিত করেছেন তা একটু খতিয়ে দেখা যাক। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র দেমেত্রিয় হচ্ছে কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর প্রতিভূ, গ্রীক পুরাণে আমরা যেমন দিমেতারকে দেখতে পাই ভূট্টা ও শস্যের দেবী রূপে। পুরাণের বীজ থেকে দেমেত্রিয় ধীরে ধীরে প্রবেশ করে মহাকাব্যের চরিত্রে, রোলাঁর (La Chanson de Roland-এর নায়ক) মতোই এই নতুন বীর অনুগত সঙ্গীদেরকে জড়ো হওয়ার জন্য পরপর তিনবার শিঙ্গা ফুঁকে সংকেত পাঠায়। একই ঘটনা আমরা লক্ষ্য করবো দেমেত্রিয়র ক্ষেত্রেও:

“সে পিঠে ঝুলে থাকা শিঙ্গাটি হাতে নিয়ে মুখের কাছে আনে। তারপর দম নিয়ে জোরে ফুঁ দেয়। তিনবার। প্রত্যুত্তরে পার্শ্ববর্তী পাহাড়চূড়া থেকেও তিনটা হুইসেলের সংকেত আসে।” (প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় অধ্যায়)

এই জড়ো হওয়ার পর থেকে দেমেত্রিয় প্রায় কখনোই আর তার সঙ্গীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। আরও এক জায়গায় আমরা মহাকাব্যের ছায়াপাত লক্ষ্য করবো। দেমেত্রিয়র বাড়ি পোড়ানো এবং নিজের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াটা দেমেত্রিয় ও অন্যান্য কৃষিজীবী মেহিকানোদের বিদ্রোহকে কেবল বৈধতাই দেয় না, একই সঙ্গে তা মহাকাব্যের বীরকে মানবীয় গুণাবলীতে সমৃদ্ধ করে তোলে। বাড়ি থেকে দেমেত্রিয়র প্রস্থানের সঙ্গে ইলিয়াড ও পোয়েম অব দ্য সিড (Poem of the cid)-এর বিভিন্ন দৃশ্যের সাযুজ্য অনিবার্য রূপে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে।

আয়তন ও শৈলীগত ভিন্নতা সত্ত্বেও নিচের মহল (Los de Abajo) এবং ইলিয়াড মূলত যুদ্ধের আখ্যানকে অবলম্বন করেই গড়ে উঠেছে। উপন্যাসের শেষের দিকে দেমেত্রিয়র দ্বিতীয় প্রস্থানের সঙ্গে ইলিয়াড–এর সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ রূপে দেখতে পাবো আমরা যখন এন্ড্রোমাকে-এর মতোই দেমেত্রিয়র স্ত্রী সন্তানদেরকে সঙ্গে করে এসে স্বামীকে দেখতে পেয়ে খুশী হয়। কিন্তু মৃত্যুর আশঙ্কা থেকে স্বামীকে মিনতি জানায় লড়াই না করার জন্য: “কসম লাগে, দেমেত্রিয়! আবার চলে যেও না! …আমার মন বলছে এবার তোমার কিছু একটা ঘটবে।” (দ্বিতীয় পর্ব, ষষ্ঠ অধ্যায়)। ইলিয়াড-এ হেক্টরের উদ্দেশ্যে এন্ড্রোমাকে-এর মিনতি ছিল এরকম:
“তুমি দুর্ভাগা! তোমার হিম্মত তোমাকে ধ্বংস করবে: না এই কচি শিশুটির জন্য, না আসন্ন বিধবা এই দুর্ভাগা নারীর জন্য তোমার কোনো মায়া আছে।”

ইউরোপের অন্যান্য মহাকাব্য ও হোমারের ইলিয়াড-এর সাথে নিচের মহল-এর এইসব সংযোগ বা পরোক্ষ সম্পর্কের মাধ্যমে আসুয়েলা একদিকে মহাকাব্যের ধারণাকে যেমন করেছেন অবনমিত, অন্যদিকে মহাকাব্যের বীরবিষয়ক ধারণার জেল্লা থেকে নায়ককে মুক্ত করার মাধ্যমে একে করে তুলেছেন সমকালিন, সুনির্দিষ্টভাবে বললে, শুধু সমকালিনই নয়, বীরকে দেবতুল্য চূড়া থেকে নামিয়ে এনেছেন নিম্নবর্গের সাড়িতে আর তাকে হাটতে শিখিয়েছেন খালি পায়ে। নিচের মহল-এর মাধ্যমে আসুয়েলা আমাদের সামনে হাজির করলেন–ফুয়েন্তেসের ভাষায়–প্রথম এক নগ্নপদ ইলিয়াডকে। আর এই নগ্নপদ ইলিয়াডই পরবর্তী লাতিন আমেরিকার আরও অন্যান্য বহু সাহিত্যিক বীরের প্রেরণা হয়ে উঠেছিল সাহিত্যে।

স্বভাষী সাহিত্যে নিচের মহল-এর এই সুদূর-প্রসারী ভূমিকার পাশাপাশি আমাদের এও মনে পরবে যে এই উপন্যাসটির বিপ্লবী ভূমিকা ছিল গোটা বিশ্বসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতেও। অভিনব শিল্পকুশলতার কারণে এটি সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্যে একেবারেই আলাদা চরিত্রের মহিমায় দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠেছিল। ঔপন্যাসিক হিসেবে আসুয়েলার গাঠনিক-পর্বে ছিল এমিল জোলা, লিও তলস্তয়, ফ্যাঙ্ক নরিস এবং আরও পরে থিওডোর ড্রেইজারের স্বভাববাদী (Naturalistic) উপন্যাসের প্রতাপ। অন্যদিকে ছিল টমাস মান ও আরও পরে জন গলসওয়ার্দির দীর্ঘ পারিবারিক আখ্যানের কুজন। আবার এদেরই পাশাপাশি ভিন্ন কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল দস্তয়েভস্কি ও হেনরি জেমসের মনস্তাত্ত্বিক দীর্ঘ উপন্যাসগুলোর নিঃসঙ্গ প্রবাহ। অন্যদিকে, হুইন্মান, দান্নুনজিও, বাইয়ে-ইনক্লান আর মার্সেল প্রুস্তের দীর্ঘ, বিস্তারপ্রবণ শৈলীঋদ্ধ নান্দনিক সাহিত্যকৃতির উপস্থিতি। আসুয়েলা এই বহুমুখী স্রোতের প্রতিধ্বনি এড়িয়ে উপন্যাসে ঘটনার চূর্ণোপম বিন্যাস, বর্ণনার পরিবর্তে সংলাপের আধিপত্য, ঐতিহ্যবাহী জীবনপঞ্জী ধরনের পরিবর্তে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ও কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে চরিত্রদেরকে ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে নিচের মহল-এ ১৯১৫ সালে সত্যিকারের বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। অর্থাৎ এটি কেবল মেহিকোর বিপ্লবকে অবলম্বন করেছে বলেই বিপ্লবী নয়, বরং সাহিত্যিক প্রথাবিরোধিতার জন্যও এটি সমান বিপ্লবী। 





অনুবাদক
রাজু আলাউদ্দিন
কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ