ইরানী গল্প : পরিযায়ী পাখি

মূল: সিমিন দানেশ্বর
অনুবাদ: ফজল হাসান

ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছিলাম যে আম্মাজান আমাকে নিয়ে স্বপ্নে বিভোর আছেন এবং তার স্বপ্নের মাঝে আমি একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করছি। যদিও কথাটা শুনতে অনেকের কাছে অযৌক্তিক বলে মনে হবে,কিন্তু জীবনের সবকিছুই কি আমরা যুক্তি-তর্কের পাল্লায় মেপে বিচার করি ? স্বপ্নে আম্মাজান দেখেছেন,কাঁচি হাতে একজন আমার মাথার দিকে এগিয়ে এসেছে এবং একসময় সে আমার মাথার চুল কেটে মেঝেতে ফেলে রেখেছে । স্কুলের বইপত্র আমি বগলের নিচে শক্ত করে ধরে রেখেছি ।

সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময় আমাকে দেখে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা চিৎকার করে বললেন, ‘এই মেয়ে, ঠিকমতো ওড়না পড়ো ।’

‘আমাদের স্কুলে কোনো পুরুষ মানুষ নেই ।’ সঙ্গে সঙ্গে আমি নিচু গলায় আরো বললাম, ‘এমনকি স্কুলের দারোয়ানও একজন মহিলা । এছাড়া স্কুলের গেটের সামনে ভারি পর্দা ঝোলানো এবং গেট বন্ধ।’

প্রধান শিক্ষিকা পুনরায় চিৎকার করে বললেন, ‘যা বলছি, তাই করো । ছন্নছাড়া যত্তসব জঞ্জাল ।’

‘মোটেও আমি ছন্নছাড়া নই । আমার মা আছেন এবং বড় এক ভাইও আছেন । সবেমাত্র তিনি যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছেন এবং জানালায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন, ‘প্রতিবাদের ভঙ্গিতে আমি বললাম ।

আমাকে ভয় দেখিয়ে প্রধান শিক্ষিকা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘এমন শাস্তি দেবো যে ... ।’

জ্যামিতি ক্লাশের শিক্ষিকা বললেন, ‘দু’টি সমান্তরাল রেখা কখনই একে অপরকে অতিক্রম করতে পারবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত খোদা ইচ্ছে প্রকাশ করেন ।’

বিজ্ঞের মতো আমি বললাম, ‘খোদা হচ্ছে প্লাস ইনফিনিটি বা অসীম এবং একমাত্র অসীমেই দু’টি সমান্তরাল রেখা একে অপরকে অতিক্রম করতে পারে ।’

‘সাবাস !’ প্রশংসার ভঙিতে জ্যামিতি ক্লাশের শিক্ষিকা বললেন ।

উৎসাহিত হয়ে আমি আরো বললাম, ‘এর জন্য কিন্তু পৃথিবীর গোল আকৃতির একটা বিশেষ এবং আলাদা ভূমিকা আছে ।’

বলেই আমি জ্যামিতির সূত্র লিখি: খোদা হচ্ছেন প্লাস ইনফিনিটি এবং শয়তান হচ্ছে মাইনাস ইনফিনিটি । 

জ্যামিতি ক্লাশের শিক্ষিকা ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে এগিয়ে গেলেন । একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, ‘শুধু একজনই আছেন, যিনি গোটা জিনিসকে বাস্তবে রূপদান করতে পারেন এবং একে অপরের সঙ্গে মেশাতে পারেন ।’ একটু থেমে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলতে পারো, সংখ্যা কি ?’

‘এক শব্দের সঙ্গে আরেক শব্দ যোগ করলে বাক্য তৈরি হয়, ‘জবাবে আমি বললাম । ‘খোদা এক এবং অদ্বিতীয় । সবকিছু এবং সবার থেকে তিনি সম্পূর্ণ একা,’ পুনরায় আমি বললাম ।

‘শয়তান হচ্ছে খোদার দোস্ত,’ হঠাৎ সহপাঠীদের মধ্য থেকে কেউ একজন বেফাঁস মন্তব্য করে ।

‘কখনই না,’ জবাবে জ্যামিতি ক্লাশের শিক্ষিকা বললেন, ‘তবে আমরা যদি কথাটাকে আমাদের সুবিধার জন্য ঘুরিয়ে বলিঃ খোদা হলো প্লাস এবং মাইনাস ইনফিনিটি’ । তাহলে চলো, আমরা এখন নাসের খসরুর কবিতা১ আবৃত্তি করি, খোদার জুতার ভেতর যদি নুড়ি পাথর না থাকে, তাহলে শয়তানকে সৃষ্টি করার কি প্রয়োজন ছিল ?’

কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুলের ঘন্টা বাজে । প্রধান শিক্ষিকা কেনো এত তাড়াতাড়ি ঘন্টা বাজালেন ? তিনি তো ভালো করেই জানেন, আমরা সব পরিস্থিতিতেই জ্যামিতি ক্লাশের শিক্ষিকার কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনি । 

আমি জানি না, স্বপ্নে আম্মাজান আমার মনকে আদৌ বুঝতে পেরেছেন কি না । তবে আমি জানি, আমার মনে কেনো খোদা এবং শয়তানের প্রসঙ্গ এসেছে । আম্মাজান তো আর আমার সঙ্গে জ্যামিতি ক্লাশে উপস্থিত নেই । আমি আপনমনে বললাম, সৃষ্টির পূর্বে হয়তো খোদাও এ নিয়ে ভেবেছিলেন । আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, ‘শয়তান কি একমাত্র খোদার দোস্ত হতে পারে ? তাই যদি হয়, তবে খোদা কেনো দেবদূত, যারা সরাইখানার দরজায় করাঘাত২ করেছে, সৃষ্টি করেছেন ? আমি নিজের কানে দরজায় করাঘাতের শব্দ শুনেছি । আমি নিজের চোখে দেখেছি অসীমের বুকে দু’টি সমান্তরাল রেখা একে অপরকে অতিক্রম করেছে । আমি দেখেছি, বৌগ্যানভিলিয়া৩ ছাড়া আমার মনের বাগানে আর কোনো ফুল প্রস্ফুটিত হয়নি । তবে আমার মনের বাগানে আদৌ যদি বৌগ্যানভিলিয়া ফোটে, তাহলে আমি তা দেখিনি । উঁচু গাছ, একই ধরনের পীচ ঢালা রাস্তা, আমাদের বাড়ির উল্টোদিকের মুদি দোকানের সবুজ শাক-সবজি আর ছোট্ট লাল মূলা এবং বৌগ্যানভিলিয়া অথবা ঔলিঅ্যান্ড্যার৪ – আমার মনে হয় এগুলোর মধ্যে ঔলিঅ্যান্ড্যারই ওখানে ছিল এবং প্রধান শিক্ষিকাকে ভয় দেখিয়েছে । আম্মাজানের স্বপ্নে হয়তো আরো কিছু জিনিস কিংবা দৃশ্য, যেমন পীচ ঢালা রাস্তার উপর পড়ে থাকা আমার মৃত দেহ, প্রতিবেশির ছাদে শুকোতে দেওয়া বিছানার সাদা চাদর, সাইরেনের আতংকিত শব্দ, বিশাল নীল আকাশের বুকে উড়ন্ত কোনো পরিযায়ী পাখি, এসে ধরা দিয়েছে ।’ 

ছাদের উপর দিয়ে ডানা মেলে একঝাঁক পরিযায়ী পাখি উড়ে যাচ্ছে । হঠাৎ সামনের উড়ন্ত পাখিটা নিচে পড়ে যায় । হয়তো ওকে কেউ গুলি করেছে, নতুবা পাখিটা ক্লান্তি এবং অবসাদে উড়তে না পারার জন্য নিচে পড়ে গেছে । তবে আমি গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েছি । ভাইয়ের পিস্তলটা আমি আমার মাথার পেছনের দিকে তাক করে রেখেছি । পিস্তলটা আমি এমনভাবে ধরেছি যেন গুলি করার পরও কোনোভাবেই তিনি আমার হাত থেকে ওটা ছিনিয়ে নিতে না পারেন । কাঁদতে কাঁদতে ভাই বলছিলেন, ‘কেনো আমি আমার আদরের বোনকে আঘাত করলাম । পূর্ণাঙ্গ শরীর কিংবা অঙ্গ ছাড়া শবদেহ দাফনের কাজটা খুবই কষ্টকর ।’ 

কিচিরমিচির শব্দ করে এক ঝাঁক পরিযায়ী পাখি উড়ে যাচ্ছে । ওদের ওড়ার ভঙ্গিটা এমন যেন ওরা নতুন কোনো দলনেতা খুঁজছে । মুহূর্তে আমি মৃতদেহ থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠি এবং অন্য পাখিদের কাছে উড়ে যাই । আমাকে পেয়ে ওরা ভীষণ আনন্দিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গেই ওদের দলনেতা হিসেবে আমাকে নির্বাচিত করে । শুধু তাই নয় । ওরা আমার জন্য একজন সহকারী দলনেতাও নিয়োগ করে । তারপর আমরা সবাই ত্রিভুজের মতো সারি বেঁধে খোলা আকাশে উড়তে থাকি । কিন্তু আমরা কোথায় যাচ্ছি ? হয়তো অন্তবিহীন অসীমের পানে, নতুবা অজানা ভুবনে । যাহোক, আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি মুদি দোকানের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম । দোকানি তখন শাক-সবজি এবং ছোট্ট লাল মূলার ঝুড়িতে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছিল ।

স্কুলের অ্যাসেম্বলির পরে ক্লাশে ঢোকার জন্য আমরা লাইন করে দাঁড়িয়ে আছি । প্রধান শিক্ষিকা আমাকে হাত ধরে টেনে লাইন থেকে বের করে আনেন । আমরা দু’জন অন্যদের দিকে মুখ করে দাঁড়াই । রাগে-ক্ষোভে প্রধান শিক্ষিকা আমার মাথা থেকে স্কার্ফ সরিয়ে এলোমেলো ভাবে বেশ কিছু চুল কাটেন । তখন আমার মাথাটা দেখতে আফ্রিকা মহাদেশ অথবা আমার দেশের মানচিত্রের মতো লাগছিল । তারপর তিনি মেয়েদের আদেশ করেন, ‘এই অবাধ্যটাকে তিরস্কার করো ।’

স্পষ্ট করে কেউ কিছু বললো না । তবে আমি অস্পষ্ট শুনতে পেলাম, বিড়বিড় করে কয়েকজন কি যেন বললো । 

আদেশের ভঙ্গিতে প্রধান শিক্ষিকা বললেন, ‘খোদার দোহাই, ঠিক মতো স্কার্ফ পড়ো ।’

প্রধান শিক্ষিকার আদেশ আমি পালন করিনি । তাই তিনি নিজেই আমার মাথার উপর স্কার্ফ মেলে দিলেন এবং থুতুনির নিচে শক্ত করে বাঁধলেন । মনে হলো, এখনই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে । তারপর তিনি আমাকে রীতিমতো টেনে-হিঁচড়ে অফিসের ভেতর নিয়ে যান । সেখানে তখন প্রিন্সিপাল তার বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিলেন । আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েও তিনি একবার মাথা তুলে তাকালেন না । বরং মুখ নিচু করে তিনি তার বাচ্চার কানের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন । বসন্তকালে প্রস্ফুটিত কোনো ফুলের পাঁপড়ির মতো বাচ্চার কান দু’টি মাথার দু’পাশে মেলে আছে । 

কেরানির কাছে প্রধান শিক্ষিকা আমার ফাইল চাইলেন । 

কেরানি জিজ্ঞেস করে, ‘ও কি করেছে ?’

‘জানি না, এদের নিয়ে আমি কি করবো ?’ উত্তরে প্রধান শিক্ষিকা বললেন । তারপর তিনি বিরক্তির সঙ্গে বিড়বিড় করে বললেন, ‘প্রিন্সিপাল তো স্কুলটিকে রীতিমতো তার দ্বিতীয় বাড়ি বানিয়ে নিয়েছেন । ঘরের সমস্ত ময়লা কাপড়-চোপড় এনে স্কুলের বাথরুমে ধোওয়া ছাড়াও তিনি স্কুলে বসেই সকালের নাস্তা সেরে নেন, এমনকি স্কুলের বেয়ারাকে দিয়ে প্রতিদান সংসারের বাজার-সওদা করান ।’ 

ফাইল খোঁজার ফাঁকে কেরানি জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কিন্তু এখনও বলেননি, ও কি অপরাধ করেছে ।’

‘ও একটা আস্ত বেয়াদব ! অধার্মিকের মতো কথা বলেছে । জ্যামিতি ক্লাশের শিক্ষিকা ধর্মীয় নিয়মানুসারে ছাত্রীদের কোনো ভালো শিক্ষা দিতে পারেনি । কখনই সে ভালো কাজ করা এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার কথা বলেনি । আমি নিজের কানে তার কথা শুনেছি । বরং সে বলেছে, খোদার জুতার ভেতর নুড়িপাথর আছে এবং বেয়াদব মেয়েটা বলেছে, শয়তান খোদার দোস্ত । মেয়েটির সম্পর্কে আমি নালিশ করেছি । ধর্ম ক্লাশের শিক্ষিকাও বাদ যাবে না । তারও বিষয়টা আমি দেখবো ।’

মিনমিনে গলায় কেরানি বললো, ‘কিন্তু মেয়েটি তো উপরের ক্লাশের ছাত্রী ।’

বলেই সে এক মুহূর্তের জন্য থামে । তারপর আমার বুদ্ধিমত্তা এবং প্রখর মেধা সম্পর্কে রীতিমতো একটা সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেয় । এছাড়া সে আমার গত বার্ষিক পরীক্ষার দূর্দান্ত ফলাফল সম্পর্কেও ভূয়সী প্রশংসা করেছে । তবে সে যাই বলুক না কেন, তাতে কিছু যায় কিংবা সে না । আমি জানি, প্রধান শিক্ষিকা আমার বিষয়টা অবশ্যই খতিয়ে দেখবেন । 

আমার বগলের নীচে ফাইল ধরিয়ে প্রধান শিক্ষিকা গম্ভীর গলায় বললেন, ‘স্কুল থেকে তোমাকে বহিস্কার করা হলো । নিঃসন্দেহে এটা অন্যদেরও শিক্ষা দেবে । আগামিকাল তোমার বাবা-মাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো ।’

‘আমি আগেই বলেছি, আমার কোনো বাবা নেই, ‘সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রতিবাদ করে বললাম ।

তারপর একটু থেমে আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করি, ‘তাহলে আপনি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে গুপ্তচরগিরি করেছেন ? যাহোক, আপনি যা জানেন, তা সম্পূর্ণ ভুল এবং সেই ভুলটাই আপনি অভিযোগ করেছেন । আমি কিন্তু কখনই বলিনি যে, শয়তান খোদার বন্ধু । জ্যামিতি ক্লাশের শিক্ষিকা, এমনকি ধর্ম ক্লাশের শিক্ষিকাও কোনো নাফরমানি কথা বলেননি ।’

আমার কথা শুনে প্রধান শিক্ষিকা বাঘের মতো গর্জে উঠেন, ‘খামোশ !’

সঙ্গে সঙ্গে তিনি চোখের পলকে ডেস্কের উপর থেকে একটা লাইন টানার রুলার নিয়ে আমার মাথায়, মুখে এবং ঘাড়ে এলোপাথারি মারতে শুরু করেন । আমি পায়ের জুতা দিয়ে তার হাঁটুতে আঘাত করি এবং সঙ্গে সঙ্গেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে একটা চেয়ারের উপর ধপাস করে পড়ে যান । চটজলদি কেরানি এক গ্লাস পানি এনে খাওয়ালো । তারপর আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে কেরানি বললো, ‘এখন বাড়ি যাও । তার পুরনো অসুখটা আবার মাথাচড়া দিয়েছে ।’ 

আমি কোনো নাফরমানি কথা বলিনি । আমি জানি না, ধর্মীয় কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানের তৃতীয় দিনে রোযা রাখা ফরজ কি না । এছাড়া আমি মোটেও ভাবিনি যে, এ জন্য শাস্তি হিসেবে আমাকে আলাদা করা হবে । তবে আমি যদি আগে জানতাম, তাহলে আমার মনের ভেতর বৌগ্যানভিলিয়া বাগানে গিয়ে নির্জনে সময় কাটাতাম এবং শয়তানের সঙ্গ ত্যাগ করে একাকীত্বকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতাম । আসলে আমি এ কথাটাই ধর্ম ক্লাশের শিক্ষিকাকে বলতে চেয়েছি ।’

যাহোক, ধর্ম ক্লাশের শিক্ষিকা আমার কথা শুনে হালকা স্বরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এসব আঁতেল কথা কার কাছে শিখেছ ?’

পরিযায়ী পাখিদের দল থেকে আমি বেরিয়ে আসি । দলছুট হওয়ার আগে আমি সঙ্গীদের বললাম, ‘তোমরা সামনের দিকে সোজা উড়তে থাকো । অতি সত্ত্বর আমি তোমাদের সঙ্গে মিলিত হবো ।’

‘তোমাকে ছাড়া কখনই আমরা উড়ে যাবো না, ‘রীতিমতো আবদারের সুরে অন্য পাখিরা বললো ।

আমি বললাম, ‘তোমরা আমার সহকারীর সঙ্গে যাও ।’

‘আমরা ঝরণার কাছে থেমে পানি পান করবো, যা চিরঞ্জিব হওয়ার জন্য একধরনের সুপেয় পানি৫,’ উত্তরে পাখিরা বললো ।

‘তুমিও এই বিশেষ পানির জন্য তৃষ্ণার্ত, ‘আমাকে উদ্দেশ্য করে সহকারী বললো ।

আমি জিজ্ঞেস করি, ‘তোমরা কী চল্লিশ বছর অপেক্ষা করতে পারবে ?’

‘তোমার জন্য আমরা হাজার বছর অপেক্ষা করতে পারি,’ একসঙ্গে ওরা সবাই বললো ।

আমি বললাম, ‘খোদার ধৈর্য্য ধরার সময় হচ্ছে চল্লিশ বছর ।’

ক্লাশের জানালা খোলা ছিল । জানলার ফাঁক গলিয়ে আমি ভেতরে প্রবেশ করি । আমার সহপাঠীরা সিলিংয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । ধর্ম ক্লাশের শিক্ষিকা ইতঃস্তত করছে এবং তিনিও উপরের দিকে তাকিয়ে আছেন । মনে হয় না, ওরা আমাকে আদৌ দেখতে পেয়েছে । না, আসলেই ওরা আমাকে দেখতে পায়নি । ওরা আমার বসার জায়গায় একটা পাত্রে বৌগ্যানভিলিয়া রেখেছে । সহপাঠীদের মাথার উপর বসে আমি বললাম, ‘তোমরা সবাই রানী বিলকিস এবং একদিন ঝুটিওয়ালা পাখি এসে তোমাদেরকে সোলেমানের কাছে নিয়ে যাবে ।’ সহপাঠীরা আমার কন্ঠস্বর শুনতে পায়নি । তবে মনে হয় ওরা এবং আমার ধর্ম ক্লাশের শিক্ষিকা কোথাও থেকে ভেসে আসা কোন অস্পষ্ট কথা কিংবা আওয়াজ শুনতে পেয়েছে ।

হঠাৎ প্রধান শিক্ষিকা দরজা খুলে ক্লাশের ভেতরে প্রবেশ করেন । তাকে দেখে মেয়েরা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ভেংচি কাটে । একসময় তিনি অনুযোগের ভঙ্গিতে বললেন, ‘তোমরা কেনো আমার কাঁধের উপর সমস্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছ ?’

ধর্ম ক্লাশের শিক্ষিকা বললেন, ‘যে পুকুর তোমরা সেচে খালি করবে, সেই পুকুর কিছুতেই পানি দিয়ে ভর্তি করতে পারবে না । যাহোক, তোমরা যদি মাথায় ধূলোবালি মাখতে চাও, তাহলে কোনো পাহাড়ের উঁচু থেকে মাটি নিয়ে আসবে, নতুবা নিদেন হলেও সুউচ্চ পাহাড়ে গিয়ে দাঁড়াবে, কিন্তু কোনোমতেই ধ্বংসস্তুপে যাবে না ... ।’ 

একসময় ক্লাশ শেষে শিক্ষিকা নোটবই এবং ব্যাগ নেওয়ার সময় মেয়েদের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন এবং আর্দ্র গলায় বললেন, ‘এই মেয়েরা,বিদায় ।’

বলেই তিনি এক মুহূর্তের জন্য থামলেন । তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,‘আসলে হাই স্কুল আমার জন্য নয় ।’

পাইপ বেয়ে পানি নিচে গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায় আমি ছাদে বসে আছি । রোদে শুকোতে দেওয়া প্রতিবেশির বিছানার সাদা চাদর বাতাসে উড়ছে । ঝকঝকে পরিস্কার আকাশ । একবার মনে হয়, আকাশের সমস্ত ময়লা যেন দেবদূতেরা চেটেপুটে সাফ করে দিয়েছে । আবার অন্য সময় মনে হয়, গোসল কিংবা অজু করার পর কাউকে যেমন পবিত্র দেখায়, আকাশটাও ঠিক তেমনই পবিত্র লাগছে। এছাড়া সূর্য্যের উজ্জ্বল আলোয় পুরো আকাশটাই চকচক করছে । একটা ঠান্ডা হাওয়া আমার পাখার পালক ছুঁয়ে যায় । একসময় সহকারী পাখিটা সামনে এসে আমার পালকের নিচে গোলাপ-পানি ভরা ওর ঠোঁট রাখে । একসময় গোলাপ-পানির মিষ্টি ঘ্রাণে চারপাশ ভরে যায় ।

পরিযায়ী পাখিদের সঙ্গে আমি পুনরায় যাত্রা শুরু করি । দু’পাশে ছড়ানো আমাদের পাখায় সূর্য্যের আলো এসে ঠিকরে পড়েছে । নিচের সমতল ভূমি এবং সবুজ গাছপালা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । হয়তো ধরণী আজ কোনো বিশেষ উৎসবে মেতেছে । আমাদের বাড়ির উল্টোদিকের মুদির দোকানের সবুজ শাক-সবজির মতোই শ্যামল শস্যভূমি । বাগানে অসংখ্য বৌগ্যানভিলিয়া ফুটে আছে । বৌগ্যানভিলিয়ার টকটকে লাল পাঁপড়ি আমাকে দোকানের লাল ছোট্ট গোল মূলার কথা মনে করিয়ে দেয় । কিন্তু জানি না, কেনো আমি পীচ ফল কিংবা ডুমুরের কথা এত বেশি ভাবছি । ডুমুর গাছে বসে ঠোঁট দিয়ে ফল খাওয়া আমাদের জন্য সহজ । কেনোনা আমাদের কারোরই ঠোঁট ভাঙ্গা নেই । আমি আম্মাজানের কন্ঠস্বর স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি । তিনি বলছেন, ডুমুর ফল কেউ দান করে না । গোধূলির আলো নিভে গেলে আকাশের বুকে অসংখ্য তারা ফুটে উঠে । অগণিত তারার ভিড়ে ঠিকই আমি আমার নিজস্ব তারাটি চিনতে পেরেছি । একসময় আমরা একটা গোরস্তানের উপর দিয়ে উড়ে যাই ।

আম্মাজান স্বপ্নের ভেতর আমার ভাইকে বললেন, ‘তুমি কি চাও ? তুমি যা চাইবে, তার জন্য আমি আমার জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত আছি ।’

আবদারের ভঙ্গিতে ভাই বললো, ‘আমি শুধু বোনকে ফেরত চাই ।’

আম্মাজান আমার কবরের উপর গোলাপ-পানি ছিটিয়ে দেন । গোলাপ-পানির সঙ্গে আম্মাজানের এবং ভাইয়ের অশ্রু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় । আমি তাদের কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি । 

কবরের ভেতর থেকে আমি চিৎকার করে বলছি, ‘তোমরা চলে যেও না । প্লিজ, আমাকে একা ফেলে তোমরা যেও না ।’ 

কিন্তু আমি জানি, কবরের অন্ধকার থেকে আমার চিৎকারের শব্দ তাদের কানে পৌঁছুবে না । আমরা, পরিযায়ী পাখিরা, শুধু অনন্ত অসীমের পানে ক্রমাগত উড়ে যাবো । আর আমাদের ডানা বিদীর্ণ করে মায়াবী চাঁদের স্নিগ্ধ আলো বুকের নরম পালক স্পর্শ করবে । 


টিকা.......................................................................................
১ পঞ্চম শতাব্দীর ইরানের অন্যতম কবি এবং লেখক নাসের খসরুর বিখ্যাত কবিতার পংক্তি । তিনি শয়তানের উৎস সম্পর্কে খোদার কাছে জানতে চেয়েছিলেন ।

২ কবি হাফিজের কবিতার পংক্তি ‘গত রাতে আমি সরাইখানার দরজায় দেবদূতদের আঘাত করতে দেখেছি,কাদামাটি নিয়ে মানব দেহের ছাঁচ তৈরি করার সময় তারা এক পানপাত্রের সঙ্গে আরেক পানপাত্র দিয়ে ঝংকার তুলেছে’ বোঝানো হয়েছে ।

৩ ফার্সিতে কাগজের ফুল ।

৪ ফার্সিতে ঔলিঅ্যান্ড্যারকে বলা হয় ‘গর্দভের পিত্তকোষ’ এবং যখন কোনো লোক ভীষণ ভয় পায়,তখন অন্যরা বলে,‘ওর পিত্তকোষ ফেটে গেছে ।’

৫ ‘চিরঞ্জিব হওয়ার জন্য সুপেয় পানি’ - পৌরাণিক কাহিনীর অন্যতম অলৌকিক বিষয় হিসেবে ফার্সি সাহিত্যে অতি পরিচিত ।


গল্পসূত্রঃ 
‘পরিযায়ী পাখি’ সিমিন দানেশ্বরের ইংরেজিতে ‘আস্ক দ্য মাইগ্রেটিং বার্ডস্’ গল্পের অনুবাদ । ফার্সি থেকে ইংরেজিতে গল্পটি অনুবাদ করেছেন রয়া মোনাজেম । ইংরেজিতে গল্পটি ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত একই শিরোনামের গল্প সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে ।


লেখক পরিচিতিঃ 
ইরানের প্রথিতযশা উপন্যাসিক,গল্পকার এবং অনুবাদক সিমিন দানেশ্বর ১৯২১ সালে সিরাজ শহরে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্সি সাহিত্যে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন । দু’বছর (১৯৫২-১৯৫৪) আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে থাকার পর তিনি ইরানে ফিরে এসে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন । মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন । সেই সময় সিরাজ শহরের এক দৈনিক খবরের কাগজে তার প্রথম লেখা ‘উইন্টার ইজ নট আনলাইক আওয়ার লাইফ’ প্রকাশিত হয় । ১৯৪১ সালে পিতার মৃত্যুর পর তিনি ‘রেডিও তেহরানে’ চাকুরী নিতে বাধ্য হন এবং ‘দ্য আননোন সিরাজী’ শিরোনামে সিরিজ প্রোগ্রাম লেখেন । একসময় রেডিওর চাকুরীতে একঘেঁয়েমী চলে আসে । ফলে রেডিওর চাকুরী ছেড়ে পত্রিকায় যোগদান করেন । ১৯৫০ সালে তিনি ইরানের প্রখ্যাত সাহিত্যিক জালাল আল-এ আহমেদের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন । তার প্রথম ছোটগল্প সংকলন (‘দ্য ক্যোয়েনশড্ ফায়্যার’) ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হয়, যা কোনো ইরানি নারী লেখকের সর্বপ্রথম গল্প সংকলন । এছাড়া ‘এ সিটি লাইক প্যারাডাইস’ (১৯৬১),‘টু হুম শ্যাল আই গ্রীট’ (১৯৮০) এবং ‘সূত্রা অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ (১৯৯৪) তার অন্য ছোটগল্প সংকলন । তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকে উপজীব্য করে আধুনিক ইরানের সামাজিক পরিস্থিতি নির্ভর তার প্রথম উপন্যাস ‘সাউশুন’ (১৯৬৯),যা ইরানি কোনো নারী লেখকের প্রথম উপন্যাস,ইরানের ইতিহাসে সবচেয়ে বহুল প্রচারিত এবং বিক্রিত উপন্যাসের মর্যাদা লাভ করেছে । এছাড়া তিনি আন্তন চেকভ,বার্নার্ড শ এবং অন্যান্য প্রথিতযশা লেখকদের উপন্যাস ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেন । তিনি ২০১২ সালের ৮ মার্চ তেহরানে ইন্তেকাল করেন ।


অনুবাদক :
ফজল হাসান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ