ট্রুম্যান ক্যাপোট'এর গল্প : একবার বড়দিনে

অনুবাদ: অভিজিৎ মুখার্জী

প্রথমেই একটু সংক্ষিপ্ত করে আত্মজীবনীমূলক একটি মুখবন্ধ। আমার মা ছিল একাধারে অসাধারণ বুদ্ধিমতী আবার অ্যালাবামার সবচেয়ে ডাকসাইটে সুন্দরীও বটে। সকলেই এমনটা বলতো, এবং ঠিকই বলতো; যখন বয়েস ষোল, সেই সময় মা বিয়ে করলো আঠাশ বছর বয়স্ক এক ব্যবসায়ীকে।
নিউ অর্লিয়েন্সের এক সম্পন্ন পরিবারের ছেলে সে। বিয়েটা এক বছর টিকেছিল। জননী কিম্বা গৃহিণী হওয়ার পক্ষে মা-র বয়েসটা ছিল খুবই কম; তাছাড়া মা-র ছিল মাত্রাছাড়া উচ্চাকাঙ্ক্ষা--কলেজে পড়বে, তারপর কেরিয়ার তৈরি করবে। অগত্যা স্বামীটিকে পরিত্যাগ করতে হল আর আমায় নিয়ে কী করা যায়–আমাকে গচ্ছিত রেখে গেল অ্যালাবামায় ওঁর সুবৃহৎ পরিবারের হেফাজতে।

বছরের পর পছর কেটে যাচ্ছিল যখন আমি বাবা কিম্বা মা-র দেখা প্রায় পেতামই না। বাবার কাজ ছিল নিউ অর্লিয়েন্সে আর মা তখন কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে ক্রমশই উন্নতি করছে নিউইয়র্কে। আমার কথা যদি বলেন, আমার কিন্তু দিনগুলো আদৌ খুব খারাপ কাটছিল না। আমি যেখানে ছিলাম ভালোই ছিলাম। চারপাশে ছিলেন অনেক সহৃদয় আত্মীয়স্বজন, মামীরা, মামারা আর মামাতো ভাইবোনরা, বিশেষ করে একজন মামাতো দিদি, একটু বয়স্কা, সাদা চুল, সামান্য পঙ্গু এক নারী যার নাম ছিল সুক। মিস সুক ফক। অন্যান্য বন্ধুও ছিল, কিন্তু আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল সে-ই।

সুক-ই আমাকে বলেছিল সান্টাক্লজের কথা। সান্টাক্লজের দীর্ঘ শ্মশ্রু, লাল পোষাক, ঠুং-ঠুং আওয়াজ করে চলা উপহার ভর্তি শ্লেজ গাড়ি। আমি সেই সবই বিশ্বাসও করতাম, যেমন বিশ্বাস করতাম যে, সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা বা প্রভুর ইচ্ছা, সুক ওই নামেই ডাকতো তাকে। আমার বুড়ো আঙুলটা ঠোক্কর খেলো কিম্বা হয়তো ঘোড়া থেকে পড়ে গেলাম, বা খাঁড়িতে একটা বড়ো মাছ ধরলাম–ভালো হোক বা খারাপ হোক সবই প্রভুর ইচ্ছায়। এবং যেবার নিউ অর্লিয়েন্স থেকে সেই দুশ্চিন্তা উদ্রেককারী বার্তাটি এলো যে আমার বাবা চাইছেন সেবারের বড়দিনটা আমি যেন নিউ অর্লিয়েন্সে গিয়ে ওঁর সঙ্গে কাঁটাই, তখনও সুক সেটা ওই প্রভুর ইচ্ছা হিসেবেই জ্ঞান করল।

আমার কান্না এসে গেছিল। যেতে চাইনি। বন, খামার আর নদী পরিবেষ্টিত এই ছোট্ট বিচ্ছিন্ন অ্যালাবামা শহর ছেড়ে কখনও কোথাও যাইনি। সুক আমার মাথার চুলের ভেতর দিয়ে আঙুল চালিয়ে না দিলে, আর গুড-নাইট বলে চুমু না খেয়ে দিলে কখনো ঘুমোতে যাইনি। তাছাড়াও, আমি অচেনা লোকেদের ভয় পেতাম, আর বাবা তো তখন অচেনা লোকই। বেশ কয়েকবার দেখেছি ওঁকে কিন্তু সেই স্মৃতি খুবই ঝাপসা; কেমন যে ঠিক দেখতে সে সম্বন্ধে তেমন কোনো ধারণাই নেই তখন আর। কিন্তু সুক-এর সেই কথা, ‘সবই প্রভুর ইচ্ছা। আর, কে বলতে পারে, তুমি হয়তো স্নো দেখতে পেয়ে গেলো।’

স্নো, তুষার! নিজে যদ্দিন না পড়তে পারছি, সুক আমাকে নানা গল্প পড়ে পড়ে শোনাতো, আর সেই সব গল্পেই ছিল অনেক অনেক তুষার। ভাসতে ভাসতে নেমে আসছে, আলো ঝালকানো রূপকথার তুষার সব। আমি এই নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম; কেমন যাদুময়, রহস্যমাখা জিনিস যা আমি দেখতে চাই, ছুঁয়ে অনুভব করতে চাই। অবশ্যই আমারও দেখা হয়নি, সুকেরও না; কী করে দেখবো, অ্যালাবামার মতো গরম একটা জায়গায়? কেন যে ওর মনে হয়েছিল যে আমি নিউ অর্লিয়েন্সে তুষার দেখতে পাবো কে জানে, নিউ অর্লিয়েন্স তো আরও গরম। যাক গে, নেহাতই আমাকে যাওয়ার ব্যাপারে আরেকটু সাহস যোগাতে চেয়েছিল।

নতুন সুট হোলো আমার। একটা কার্ডে আমার নাম, ঠিকানা লিখে পিন দিয়ে সেঁটে দেওয়া হল ল্যাপেলে। আমি যদি হারিয়ে যাই তবে ওটা কাজে লাগবে। একা একাই তো পথটা যেতে হবে আমাকে। বাসে চড়ে। যাই হোক, ওই কাগজটা যখন আছে তখন আমার তেমন বিপদ কিছু হবে না বলেই ভাবলো সবাই। সবাই ভাবলেও আমি ভাবলাম না। ভয়েই মরে যাচ্ছিলাম; সঙ্গে রাগ। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল বাবার ওপর, একটা অচেনা লোক, বড়দিনের সময় জোর করে আমাকে বাড়ি ছেড়ে, সুককে ছেড়ে দূরে চলে যেতে বাধ্য করছে।

প্রায় চারশো’ মাইলের রাস্তা। প্রথম থামা মোবাইল-এ। সেখানে বাস পাল্টে চললাম তো চললামই, জলাভূমির মধ্য দিয়ে, সমুদ্রের তীর ধরে, যতক্ষণ না এসে পৌঁছাই একটা কোলাহলে ভরা শহরে, ঠুং ঠাং শব্দ করে ট্রলি-কার চলছে সেখানে আর গিজগিজ করছে বিদেশিদের মতো দেখতে ভীষণদর্শন সব লোক।

নিউ অর্লিয়েন্স শহর।

তারপর যেই আমি বাস থেকে নামলাম, একটা লোক দু-হাতের মধ্যে আমায় তুলে নিল, তার নিষ্পেষণে দম আটকে আসছিল আমার; লোকটা কিন্তু হাসছে, আবার কাঁদছিলও—বেশ লম্বা, সুন্দর দেখতে একটা লোক, হাসছে, আবার কাঁদছে। বললো, ‘আমায় চিনতে পারছো না? বাবাকে চিনতে পারছো না?’

আমি কোনো কথাই বলছিলাম না। একটা কথাও বলিনি, শেষটায় ট্যাক্সিতে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম: 'কোথায়?’

‘আমাদের বাড়ি? বেশি দূর নয়।—’

‘বাড়ি না। তুষার?’

‘কীসের তুষার?’

‘আমি ভেবেছিলাম অনেক বরফ থাকবে।’

অদ্ভুতভাবে তাকালো লোকটা আমার দিকে, কিন্তু হাসলো। ‘নিউ অর্লিয়েন্সে কখনো বরফ পড়ে নি। আমি অন্তত শুনিনি। কিন্তু ওই শোনো। বাজ পড়ার আওয়াজ পাচ্ছে? বৃষ্টি আসছে নির্ঘাৎ।’

কোনটা যে বেশি ভয় পাচ্ছিলাম বলতে পারি না, বাজ পড়ার শব্দ, নাকি তারপর আঁকাবাঁকা বিদ্যুতের ঝলকানি, না বাবাকে। সেই রাতে, যখন শুতে গেলাম তখনও বৃষ্টি পড়ছিলো। প্রার্থনা করলাম এবং চাইলাম যেন শিগগিরি বাড়িতে সুকের কাছে চলে যেতে পারি। বুঝতেই পারছিলাম না, সুক গুড-নাইট বলে চুমু না খেলে ঘুমোতে যাব কীভাবে। অতএব, ঘুম এলো না, আমিও ভাবার চেষ্টা করতে থাকলাম সান্টা ক্লজ আমার জন্য কী কী আনবে। আমার ইচ্ছা ছিল একটা মুক্তো বসানো বাঁটের ছুরি। জিগ্‌-স্‌ পাজলের একটা বড়ো সেট। একটা কাউবয় টুপি আর সঙ্গে মানানসই ল্যাসো। আর চড়ুইদের গুলি করার জন্য একটা বি.বি. রাইফেল। (এর বেশ কিছু বছর পরে, যখন সত্যি হাতে এসেছিল একটা বি. বি. বন্দুক, আমি একটা মকিংবার্ড আর একটা বব হোয়াইট গুলি করে মেরেছিলাম। তারপর সে যে কি অনুশোচনা আমার, কী যে শোক, আজও ভুলতে পারিনি; আর কখনো কিছু মারিনি, মাছ ধরলেও আবার জলে ছেড়ে দিয়ে এসেছি।) সঙ্গে ছবি আঁকার জন্য একবাক্স ক্রেয়ন। আর সবচেয়ে বড়ো চাহিদা যেটা ছিল, সেটা একটা রেডিও, কিন্তু জানতাম সেটি হবে না: রেডিও আছে যাদের এরকম দশজন লোকের কথাও তখন আমার জানা নেই। মনে রাখবেন, এটা সেই তিরিশের দশকের মন্দার সময়, দক্ষিণের অতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে রেডিও কিম্বা রেফ্রিজারেটর শোভিত বাড়ি তখন খুবই বিরল।

বাবার দুটোই ছিল। সবই যেন ছিল--পেছনে আলাদা একটা, ভাঁজ করা যায় এরকম সিটওয়ালা গাড়ি ছিল, ছোট্ট গোলাপি রঙের একটু পুরনো একটা বাড়ি তো ছিলই। ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারের ওই বাড়িটাতে আয়রন-লেস দেওয়া ব্যালকনি, একটা গোপন প্যাশিও গার্ডেন যাতে রং বেরং-এর ফুল, মৎস্যকন্যার আকৃতিতে একটা ফোয়ারা যেটা চারপাশটাকে অনেকটা ঠাণ্ডা রাখতো। বাবার অবশ্য হাফ-ডজন, তা-ই বা বলি কেন, পুরো এক ডজন মহিলা বান্ধবীও ছিল। মা-র মতোই, বাবাও আর বিয়ের মধ্যে যেতে চায়নি; তবে দুজনেরই এত অজস্র নাছোড়বান্দা গুণগ্রাহী ছিলেন যে ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছেয় হোক, গীর্জার বেদি অবধি হাঁটতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দুজনকেই—বাবাকে তো ছ’বার।

সুতরাং বুঝতেই পারছেন, বাবার ছিল মোহিত করে দেওয়ার ক্ষমতা; অধিকাংশ লোকই মোহিত হয়ে যেত–আমি ছাড়া সব্বাই। হবে না? বন্ধুদের দেখাতে আমাকে নিয়ে কেবলই এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি, আমার খুব বোকা বোকা লাগত। যে ব্যাংকারের কাছে টাকা রাখতো, সে থেকে শুরু করে রোজ যে নাপিত দাড়ি কামিয়ে দিত, সবার কাছে যাওয়া চাই। এবং অবশ্যই বান্ধবীদের কাছে তো বটেই। সবচেয়ে বাজে হলো: আদ্যন্ত আমাকে হয় জড়িয়ে ধরতো, নয় চুমু খেতো, আর না হলে আমার নানা কৃতিত্বের কথা। এত লজ্জা করতো। প্রথমত কৃতিত্বের কিছুই ছিলো না। একেবারেই মফস্বলের ছেলে আমি। যীশুতে বিশ্বাস করতাম, রোজ প্রার্থনা করতাম মনে বিশ্বাস এনে। সান্টাক্লজ বলে কেউ আছে বলেই জানতাম। আর অ্যালাবামার বাড়িতে, একমাত্র চার্চে যাওয়ার সময় ছাড়া, কখনো জুতো পরিনি; না গ্রীষ্মে, না শীতে।

স্রেফ অত্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়, সেই আঁট করে বাঁধা, অসহ্য গরম, এত ভারি যেন সীসের তৈরি জুতো পরিয়ে নিউ অর্লিয়েন্সের রাস্তা দিয়ে আমাকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তবে কোনটা যে বেশি খারাপ বলতে পারবো না–জুতো না খাবার দাবার। বাড়িতে আমি খেতাম ফ্রায়েড চিকেন, বাঁধাকপি কুচিকুচি করে কাটা আর বাটারবীন্‌স্‌ আর কর্নব্রেড বা এরকমই দিব্যি খেতে জিনিস। আর এই নিউ অর্লিয়েন্সের রেস্তোরাঁতে! প্রথম অয়েস্টার খাওয়ার কথা কোনওদিন ভুলবো না, গলা দিয়ে যেন একটা দুঃস্বপ্ন ধীরে ধীরে নেমে গেল; বহুযুগের মধ্যে ও জিনিস আর মুখে তুলিনি। আর ওইসব মশলাদার ক্রেওল রান্না–মনে করলেই বুকজ্বালা করে। না গো, আমার তখন একান্ত দরকার স্টোভ থেকে সদ্য নামানো বিস্কিট, গরুর থেকে সদ্য দুইয়ে আনা দুধ আর ঘড়া থেকে বের করে বাড়িতে তৈরি গুড়।

বেচারা বাবার কিন্তু তখন কোন আইডিয়াই নেই আমার কতটা করুণ অবস্থা, একটা কারণ হল, আমি সেটা ওর চোখে পড়তে দিইনি, মুখে তো বলিইনি; আরেকটা কারণ, মা-র প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই বড়দিনের ছুটিটুকুর জন্য আমাকে আইন মোতাবেক বাবার রক্ষণাবেক্ষণে রাখার অধিকার আদালত মঞ্জুর করেছিল।

বাবা বলতো: ‘আচ্ছা, সত্যি কথা বলো তো, তুমি কি নিউ অর্লিয়েন্সে এসে আমার সঙ্গে থাকতে চাও না?’

‘আমার তো উপায় নেই।’

‘উপায় নেই মানে ? কী বলতে চাইছো ?’

‘আমার সুক-এর জন্য মন খারাপ করে, কুইনির জন্যও করে; আমাদের একটা ছোট্ট র‍্যাটটেরিয়ার আছে, খুব মজার। আমরা দুজনেই ওকে ভালবাসি।’

বাবা বলতো, ‘আর আমাকে ভালবাসো না?’

আমি বলতাম: ‘হ্যা।’ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সুক, কুইনি, ক’জন মামাতো ভাইবোন আর বিছানার পাশে রাখা আমার সুন্দরী মা’র ছবি ছাড়া ভালবাসা সম্বন্ধে আর কোনো ধারণাই ছিল না আমার।

তবে কিছুদিনের মধ্যেই টের পেলাম। বড়দিনের আগের দিন, ক্যানাল স্ট্রিট ধরে হাঁটছিলাম আমরা, একটা বড়ো খেলনার দোকানের জানালায় একটা আশ্চর্য জিনিস দেখে সম্মোহিত হয়ে গিয়ে আমি স্থাণুবৎ, নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ভেতরে বসে পা দিয়ে বাইসাইকেলের মতো চালানো যায় এতটাই বড়ো একটা উড়োজাহাজের মডেল। রঙ সবুজ, শুধু প্রপেলারগুলো লাল। আমার তখন দৃঢ় ধারণা, যদি যথেষ্ট জোরে প্যাডেল করা যায় তবে জিনিসটা মাটি ছেড়ে উঠে উড়তে থাকবে! একটা জিনিস বটে! আমি মনশ্চক্ষে দেখতে পেলাম আমার মামাতো ভাইবোনেরা মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে আর আমি মেঘের মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছি। অথচ সবুজ। আমার হাসি পেল; কেবল হাসছিলাম। এই প্রথম এমন একটা কিছু করলাম যাতে বাবা যেন খানিকটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল, যদিও জানতো না আমার ঠিক কী কারণে এত হাসি পাচ্ছে।

সেই রাতে আমি প্রার্থনা করলাম সান্টাক্লজ যেন আমাকে ওই প্লেনটা দিয়ে যায়।

বাবা একটা ক্রিসমাস ট্রি কিনে রেখেছিল, সেটা সাজাতে আমরা ফাইভ এন’ ডাইম দোকানটায় এটা সেটা কিনতে অনেকটা সময় লাগালাম। এই সময় আমি করে বসলাম একটা অসমীচীন কাজ। গাছটার তলায় নিয়ে রাখলাম মায়ের একটা ছবি। ওটা দেখা মাত্র বাবা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গিয়ে কাঁপতে লাগলো। আমি তো ঠিকই করতে পারছি না। কী করবো। বাবা অচিরেই ঠিক করলো। গিয়ে একটা ক্যাবিনেট থেকে একটা লম্বা গ্লাস আর একটা বোতল বের করলো। বোতলটা আমি চিনতে পারলাম কেননা অ্যালবামাতে আমার মামাদের ঠিক ওরকম বহু বোতল ছিল। প্রহিবিশন মুনশাইন। গ্লাসটা ভরে নিয়ে একটুও না থেমে একবারে পুরোটা খেয়ে নিলো। এরপর আর ছবিটা যেন নেই বলেই ভান করা হতে থাকলো।

এইভাবেই এবার আমি বড়দিনের আগের রাতের অপেক্ষায় রইলাম, মোটাসোটা সান্টার সদাই উত্তেজনাময় অ্যাডভেঞ্চারের অপেক্ষায়। অবশ্যই আমি নিজে কখনোই দেখিনি কোনো ভুঁড়িওয়ালা, ভারিক্কি চেহারার বিশাল বাপু লোককে ঠুনঠুন করতে করতে চিমনি দিয়ে নেমে এসে খুশির মেজাজে ক্রিসমাস ট্রি-র নিচে নানা উপহার বিলোতে। আমার মামাতো ভাই বিলি বব, নচ্ছার বাটকুলাটা, যার মগজটা যেন লোহার মুঠির মতো, একবার বলেছিল। এসব নাকি ধাপ্পা, ওরকম নাকি কেউ নেই।

‘দূর দূর!’ ও বলেছিল। ‘যে সত্যিই ভাববে যে সান্টাক্লজ বলে কেউ আছে, সে একটা খচ্চরকে ঘোড়া বলেও ভাবতে পারে।’ তর্কটা হচ্ছিল অপরিসর কোর্ট হাউস স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে। আমি বললাম: ‘সান্টাক্লজ আছে, কারণ সে যা যা করে সবই প্রভুর ইচ্ছানুযায়ী করে আর প্রভু যা ইচ্ছা করেন। সে সবই সত্য।’ চিক্‌ করে থুথু ফেলে বিলি বব সে জায়গা ছেড়ে যেতে যেতে বলে যায়: ‘ওঃ দারুণ, মনে হচ্ছে আরও একজন পাদ্রি পাওয়া গেছে।’

আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে রাখতাম কিছুতেই বড়দিনের আগের রাতে ঘুমিয়ে পড়ব না, রেইন ডিয়াররা ছাদের ওপর লাফিয়ে নেমে নাচতে থাকলে সেই আওয়াজটা শুনতে হবে, চিমনির ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে থাকবো। আর সান্টাক্লজের সঙ্গে করমর্দন করবো। এই নির্দিষ্ট বড়দিনটির আগের রাতটায়, মনে হলো জেগে থাকার চেয়ে সহজ আর কিছু নেই।

বাবার বাড়িটা তিনতলা, সাতটা ঘর। কয়েকটা ঘর তো বিশাল বড়, বিশেষ করে প্যাশিও গার্ডেন সংলগ্ন তিনটে ঘর তো বটেই; একটা পার্লার, একটা ডাইনিং রুম আর যারা নাচতে কিম্বা তাস খেলতে ভালবাসে তাদের জন্য একটা ’মিউজিকাল রুম’। ওপরের দুটো তলা লেসওয়ালা ব্যালকনি পরিবেষ্টিত, লেস-এর ঘন সবুজ রঙের লোহার কারুকাজের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে বোগেনভিলিয়া আর স্কার্লেট স্পাইডার অর্কিড-এর ঢেউ খেলানো লতা—উদ্ভিদটাকে দেখলে মনে হয় যেন টিকটিকিরা তাদের লাল জিভ বের করে এগিয়ে দিয়েছে। এ ধরনের বাড়িতে সাধারণত গালাপালিশ করা মেঝে, উইকার, কোথাও বা খানিকটা ভেলভেট দিয়ে সাজানো থাকে। দেখে খুবই ধনী কোনো লোকের বাড়ি বলে মনে হতেই পারে, বরং বলা যায় এটা এমন কারো বাড়ি যার শখ দৃষ্টিনন্দন জিনিসের। অ্যালাবামার এক দরিদ্র (কিন্তু প্রসন্ন) অনাবৃত চরণ বালকের কাছে এ এক রহস্য, কী করে যে সেই লোক তার শখ মেটানোর উপায়ও করেন।

আমার মা-র কাছে সেটা অবশ্য কোনো রহস্যই নয়, সে তদ্দিনে কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে নিজের মনের মাধুরীকে পূর্ণ উপভোগ করতে করতে লড়ে যাচ্ছে নিউইয়র্কে একজন উপযুক্ত দয়িতের সন্ধান করতে, যার ক্ষমতা আছে সাট্রন প্লেস-এ অ্যাপার্টমেন্ট কেনার কিম্বা কালো নেউলের চামড়ার কোট। মায়ের কাছে কিন্তু বাবার বৈভবের উৎস অজানা ছিল না, যদিও সেটা সে প্রকাশ করে বহু বছর পরে, যদিনে নিজের গলায় কালো নেউলের চামড়ার কোটের আবরণ ঘিরে মুক্তোর একগাছা রজ্জু উঠেছে, তারও বেশ কিছুদিন পরে।

নিউ ইংল্যান্ডের এক উন্নাসিক বোর্ডিং স্কুলে (যেখানে আমার পড়ার খরচ যোগাতেন মা-র ধনাঢ্য অথচ উদার স্বামীটি) মা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল আর সেই সময় আমি এমন কিছু বলে ফেলেছিলাম যাতে রাগে তার পিত্তি জ্বলে যায়; চেচিয়ে বলে ওঠে: ’তুমি তাহলে জানোই না কীভাবে সে ওই লাটসাহেবের জীবন কাটায়? গ্ৰীসের দ্বীপে নৌকাভ্রমণ, ভাড়া করা ইয়ট এইসব? ওর বউরা! সারি সারি সব বউদের কথা ভাবো একবার। সবগুলো বিধবা। সবগুলো বড়োলোক। আর সবগুলোই ওর চেয়ে বয়েসেও বড়ো। মাথা খারাপ হয়নি এরকম কোনো অল্পবয়েসী লোক তো আর ওদের বিয়ে করতে যাবে না। সেই জন্যেই তো তুমি ছাড়া ওর আর কোনো ছেলেমেয়েও নেই। আর একই কারণে আমারও আর কোনো সন্তান হবে না।— সন্তান হওয়ার মতো বয়েস হয়েছে নাকি তখন আমার, জানোয়ারটা আমাকে একেবারে ডুবিয়েছে, শেষ করে দিয়েছে আমায়।’

জাস্ট এ জিগোলো, যেখানেই যাই লোকে থমকে দাঁড়ায়, তাকায়

... চাঁদ চাঁদ মায়ামির আকাশে চাঁদ

... আমার প্রথম প্রেম, একটু দয়া করুন প্লিজ।

... হে মিস্টার, একটা ডাইম* হবে নাকি?

… জাস্ট এ জিগোলো, যেখানেই যাই লোকে থমকে দাঁড়ায়, তাকায়

যতক্ষণ মা বলে যাচ্ছিল (আমি চেষ্টা করছিলাম না শোনার, আমার জন্ম হওয়াতে যে মা শেষ হয়ে গেল এটা বলে মা আমাকেই শেষ করে দিচ্ছিল) এই গানটার সুরটা আমার মাথায় ঘুরে ফিরে পাক খাচ্ছিল, এরকমই কিছু সুর। এতে একটা উপকার হচ্ছিল যে আমাকে আর মা-র কথা শুনতে হচ্ছিল না, সঙ্গে মনে পড়ে গেল সেবার বড়দিনে নিউ অর্লিয়েন্সে বাবা যে আশ্চর্য পার্টি দিয়েছিল সেই পার্টির কথা। ওই স্মৃতি সহজে আমার কাছছাড়া হবে না।

প্যাশিওতে তখন মোমবাতি গিজগিজ করছে, সংলগ্ন তিনটে ঘরেও। অতিথিদের অধিকাংশই জড়ো হয়েছে পার্লারে, সেখানে ফায়ার প্লেসের স্থিমিত আগুনের আলোয় ক্রিসমাস ট্রি-টা চকচক করছে; বাকি অনেকেই মিউজিক রুম আর প্যাশিওতে দম দেওয়া ভিক্টোলা** উৎসারিত সংগীতের তালে তালে নাচছে। অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে, আমার নানা বাহাদুরির কথা তাদের জানিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওপরতলায়; কিন্তু আমার শোওয়ার ঘরের ফ্রেঞ্চ শাটার দেওয়া দরজার সামনের টেরেসটুকুতে দাঁড়িয়ে আমি পুরো পার্টিটাই দেখতে পাচ্ছিলাম, জোড়ায় জোড়ায় যারা নাচছিল তাদের সবাইকেই দেখা যাচ্ছিল। মৎস্যকন্যা ফোয়ারা বেষ্টন করে যে জলাধারটুকু সেটাকে ঘিরে দেখলাম বাবা এক অভিজাত মহিলার সঙ্গে ওয়ালজ করছে। মহিলা খুবই অভিজাত, রুপোলি রঙের এক চিলতে পোষাক মোমের আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠছে; কিন্তু অনেক বয়েস—বাবা তখন পয়ত্ৰিশ, বাবার চেয়ে অন্তত দশ বছরের বড়ো মহিলা।

হঠাৎই খেয়াল করলাম যে বাবার দেওয়া পার্টিতে বাবাই সবচেয়ে বয়েসে ছোট, অন্যদের চেয়ে অনেকটাই বয়েস কম। মহিলারা সকলেই মোহিত করে দেওয়ার মতো কিন্তু কেউই ভাসমান রূপোলি পোশাকের নমনীয় ওয়ালজ নর্তকীর চেয়ে বয়েসে ছোট নয়। পুরুষদেরও একই ব্যাপার, এদের অনেকেই মিষ্টি গন্ধওয়ালা হাভানা চুরুট খাচ্ছিলেন; অর্ধেকের বেশিই বয়েসে আমার বাবারও বাবা হতে পারতেন।

একটা জিনিস চোখে পড়ে যেতে আমি চোখ সরিয়ে নিই। বাবা ও তার সেই ক্ষিপ্রদেহ সঙ্গিনীটি নাচতে নাচতে চলে গেছিল স্কালেট স্পাইডার অর্কিডের ছায়াচ্ছন্ন একটা কোণে; দুজন দুজনকে জড়িয়ে চুমু খাচ্ছিল। এমন চমকে গেছিলাম, এমন রাগ হয়েছিল, দৌড়ে শোওয়ার ঘরে ঢুকে বিছানায় কাঁপিয়ে পড়ে মাথা অবধি ঢেকে ফেলেছিলাম। ওরকম প্ৰবীণার থেকে আমার এত সুন্দর দেখতে এত অল্পবয়েসি বাবা কী পেতে পারে। নিচতলার লোকগুলো সব বাড়িতেই বা ফিরে যাচ্ছে না কেন, তাহলে তো সান্টাক্লজ এবার আসতে পারে। জেগে থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম তারা এক এক করে চলে যাচ্ছে, শেষবারের মতো বাবা কাকে যেন গুড-বাই জানালো, তারপর শুনতে পেলাম সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে আমার ঘরের দরজা খুলে উঁকি দিলো; আমি ঘুমের ভান করে রইলাম।

সে’রাতে এমন অনেক কিছুই ঘটলো যাতে আমি সারারাতই জেগে রইলাম। প্রথমত, পায়ের আওয়াজ, বাবা কেবলি সিড়ি দিয়ে উঠছে আর নামছে, গভীরভাবে শ্বাস নিতে নিতে। কী করছে সেটা দেখতে হবে তো। আমি গিয়ে বারান্দায় বোগেনভিলিয়ার মধ্যে লুকোলাম। সেখান থেকে পার্লার, ক্রিসমাস ট্রিটা, আর ফায়ার প্লেসের নীরিক্ত আগুন সব পুরোটা দেখা যাচ্ছিল। সঙ্গে বাবাকেও দেখা যাচ্ছিল। গাছটার নিচে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে অনেক প্যাকেটের একটা পিরামিড বানাচ্ছে বাবা। বেগুনি আর লাল আর সোনালি আর সাদা আর নীলরঙের সব মোড়ক। নাড়াচাড়া করলেই খসখস করে শব্দ হচ্ছিল। আমার কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছিল, যা দেখলাম তাতে সবকিছুই আবার নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছিলাম। যদি আমার জন্য আনা হয়ে থাকে তাহলে কিছুতেই এগুলো প্রভুর অর্ডার দেওয়া আর সান্টাক্লজের আনা উপহার নয়; নাঃ, বাবা-ই কিনে মুড়ে দিয়েছে এই উপহারগুলো। তার মানে হলো, আমার নচ্ছার মামাতো ভাই বিলি বব আর ওরই মতো আরও কয়েকটা নচ্ছার ছেলে যখন আমাকে ব্যঙ্গ করে বলেছিল যে সান্টাক্লজ বলে কেউ নেই তখন ওরা মিথ্যে বলছিলো না। সবচেয়ে মারাত্মক হলো: তাহলে কি সুক সব জেনেও আমাকে মিথ্যে বলেছিল? না, সুক কখনো মিথ্যে বলবে না। ও বিশ্বাসই করতো। ব্যাপারটা স্রেফ এরকম যে—যদিও ওর বয়েস যাট পেরিয়েছে, কোনো কোনো দিক দিয়ে অন্তত ও আমারই মতো বাচ্চাই।

যতক্ষণ না বাবা তার কাজ শেষ করে যে মোমগুলো তখনও জ্বলছিলো সেগুলো ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল, আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম। যতক্ষণ না নিশ্চিত হলাম যে বাবা বিছানায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আমি অপেক্ষা করলাম। তারপর পা টিপে টিপে পার্লারে গেলাম, সেখানে তখন গার্ডেনিয়া ফুল আর হাভানা চুরুটের গন্ধ ম’ ম’ করছে।

বসে বসে ভাবতে থাকলাম ; এবার আমাকেই সত্যি কথাটা সুককে গিয়ে বলতে হবে।

কেমন যেন একটা আক্ৰোশ, অদ্ভুত একটা অসূয়া আমার মধ্যে পাক খেয়ে উঠতে লাগলো: ঠিক বাবার প্রতি নয়, যদিও বাবা-ই হয়ে দাঁড়ালো ওটার শিকার।

ভোর হয়ে আসছিলো, আমি প্রত্যেকটা প্যাকেটের গায়ে লাগানো কাগজের টুকরোগুলো খুঁটিয়ে দেখলাম। প্রত্যেকটাতেই লেখা আছে ‘বন্ধুর জন্য’। একটা বাদ দিয়ে সবগুলোতে। ওই একটাতে লেখা:‘ইভানজেলিন-এর জন্য’। ইভানজেলিন একজন বয়স্ক অশ্বেতকায় মহিলা যে সারাদিন কোকাকোলা খেত। আর ওজন ছিল তিনশো পাউন্ড; বাবার ঘরের সব কাজ করতো।—বাবাকে বড়ো করে তুলেছিলোও সে। আমি ঠিক করলাম প্যাকেটগুলো খুলবো: বড়দিনের সকাল, আমিও জেগে, খুলবো না কেন? ভেতরে কী কী ছিল সেসব বলে লাভ নেই: শার্ট', সোয়েটার এরকম আরও সব মামুলি জিনিস। একমাত্র জিনিস যেটা আমার খুব মনে ধরলো সেটা হলো দারুণ দেখতে একটা ক্যাপ-পিস্তল। কিভাবে যেন মনে হলো ওটা ফাটিয়ে বাবাকে ঘুম থেকে জাগালে খুব মজা হবে। করলামও তাই। দুম, দুম, দুম। বড়ো বড়ো চোখ করে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল বাবা।

দুম, দুম, দুম। ‘বন্ধু–এসব কী করছো তুমি?’

দুম, দুম, দুম।

‘বন্ধ করো বলছি।’

আমি হাসলাম। ‘বাবা দ্যাখো। সান্টাক্লজ কীসব দারুণ জিনিস আমায় এনে দিয়েছে।’

এবার অনেক শান্ত হয়ে, পার্লারে এসে বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ‘সান্টাক্লজ যা এনে দিয়েছে তাতে তুমি খুশি হয়েছো?’

আমি বাবার দিকে চেয়ে স্মিত হাসলাম। বাবাও আমার দিকে চেয়ে হাসলো। একটা কোমলতা এক মুহূর্ত বজায় ছিল, কিন্তু খান খান হয়ে গেল যখন আমি বললাম: ‘হ্যাঁ। কিন্তু তুমি আমাকে কী দেবে বাবা?’ ওঁর হাসিটা উবে গেল। চোখটা সন্দিগ্ধভাবে কুঁচকে গেল--বোঝাই যাচ্ছিল যে বাবা ভাবছে আমি কিছু একটা চমক দিতে যাচ্ছি। কিন্তু তারপরেই লজ্জা পেল, যেন চিন্তায় যা এসেছে তার জন্যই লজ্জা পেল। আমার মাথায় মৃদু চাপড়ে দিয়ে, একবার কেশে নিয়ে বললো:‘আমি ভাবলাম তোমাকে খানিকটা সময় দিই, তুমি নিজেই যাতে ঠিক করে উঠতে পারো। আছে এরকম কিছু, যা তুমি চাও?’

আমি ক্যানাল স্ট্রীটের সেই খেলনার দোকানে দেখা এয়ারপ্লেনটার কথা মনে করিয়ে দিলাম। বাবার মুখটা কেমন ঝুলে গেল। মনে পড়েছে ঠিকই প্লেনটার কথা, তার সঙ্গে ওটার যে কি মাত্রাছাড়া দাম তা-ও মনে পড়েছে। তা হলেও পরদিন আমি সেই প্লেনটাতে বসে স্বপ্ন দেখছিলাম কীভাবে ক্ৰমে ক্ৰমে স্বর্গের দিকে উঠে যাব, বাবা তখন উল্লসিত সেলসম্যানটিকে একটা চেক কেটে দিচ্ছে। প্লেনটাকে জাহাজে অ্যালাবামা পাঠানো নিয়ে একটু মতান্তর হলো, আমি গো ধরে বসে আছি।—বারবারই জোর দিয়ে বলছি যে ওটা আমার সঙ্গে বাসেই যাবে। বাস সেইদিনই দুপুর দু’টোয় ছেড়ে যাবে। সেলসম্যান সেই বাস কোম্পানিকে ফোন করে সব ব্যবস্থা করে দিল, কোম্পানি জানালো তারা অনায়াসে এই ব্যবস্থা করতে পারবে।

কিন্তু নিউ অর্লিয়েন্স অতো সহজে আমাকে ছাড়ছে না। সমস্যার মূলে একটা রূপের বিরাট ফ্লাস্কে ভরা মুনশাইনা; হয়তো আমি চলে যাচ্ছি বলেই, বাবা সারাদিনই থেকে থেকে ওটা থেকে গলায় ঢালছিলো। বাসস্টেশনে যাওয়ার রাস্তায় আমাকে রীতিমতো ভয় পাইয়ে দিয়ে বাবা আমার হাত চেপে ধরলো আর কড়াগলায় ফিসফিস করে বলে উঠলো: ‘আমি তোমাকে যেতে দেব না। ওই সৃষ্টিছাড়া বাড়িতে ওই একটা সৃষ্টিছাড়া পরিবারে আর ফিরে যেতে দিতে পারি না। তাকিয়ে দ্যাখো, ওরা তোমার কী হাল করেছে। ছয় বছরের ছেলে, সাতই বলা যায়, বলছে সান্টাক্লজ! ওই ওদেরই কীর্তি, আইবুড়ো সব বুড়ি, তাদের বাইবেল আর উলবোনার কাঁটা, মাতাল মামারা সব। আমার থেকে শুনে রাখো বন্ধু, গড বলে কিছু নেই! সান্টাক্লজ বলেও কিছু নেই।' হাত এমন জোরে চেপে ধরে আছে যে আমার ব্যথা করছিলো। ‘একেক সময় মনে হয়, ওহ গড, তোমার মা আর আমার, দুজনেরই আত্মহত্যা করা উচিত, এই পরিণতির জন্য—’ (বাবা অবশ্য আত্মহত্যা করেনি কখনো, কিন্তু মা করেছিল: তিরিশ বছর আগেই সে সেকেন্ড রোড ধরে হেঁটে গেছে) ’একটু চুমু খাও আমাকে, প্লীজ, প্লীজ, চুমু খাও একটু। বাবাকে বলো যে তুমি ভালবাসো।’ কিন্তু আমি কিছু বলতে পারছি না। আতঙ্কিত, বাস বুঝি ছেড়ে গেল। প্লেনটা নিয়েও ভাবনা হচ্ছিল, ট্যাক্সির মাথায় দড়ি দিয়ে বাঁধা রয়েছে। ওটা। 'বলো, ‘আমি ভালবাসি’, বলো না। প্লীজ, বন্ধু, বলো একবার।’

আমার ভাগ্য ভালো যে ট্যাক্সি-ড্রাইভার লোকটি ছিল ভালো। সে, আর কয়েকজন বেশ চট্পটে পোর্টার আর একজন ফ্রেন্ডলি পুলিশ, এরা না থাকলে যে কী হতো ভাবতেই পারছি না। স্টেশনে যখন পৌঁছলাম, বাবা আর তখন হাঁটার অবস্থায় নেই। পুলিশটি এসে বাবার সঙ্গে কথা বলে কিছুটা শান্ত করলো যে বাবাকে ঠিকমতো বাড়ি ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু বাবা যাবে না, যতক্ষণ না নিজের চোখে দেখছে যে পোর্টাররা আমাকে নিয়ে বাসে তুলে দিয়েছে।

বাসে উঠে একটা সীটে গা ছেড়ে দিয়ে, চোখ বুজে ফেলেছিলাম। অদ্ভুত দুঃখ হচ্ছিল একটা। তীব্র বেদনা বোধে সব কিছু ছেয়ে। একবার মনে হলো এই রাক্ষুসে কালান্তক, ভারী, শহুরে জুতোটা ছাড়তে পারলে কষ্টটা একটু কমবে। খুলে ফেললাম জুতো জোড়া, কিন্তু যন্ত্রণাটা গেল না। একদিক থেকে বলতে গেলে, আর কখনো যায়ও নি, যাবেও না।

বারো ঘণ্টা বাদে আমি বাড়িতে, বিছানায়। ঘর অন্ধকার। আমার পাশে একটা রকিং চেয়ারে বসে সুক দুলছে, কি যে প্রশান্তির আওয়াজ, মহাসমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। যা যা ঘটেছে সবই সুককে বলার চেষ্টা করলাম, থামলাম যখন আমার গলার আওয়াজ কুকুরের ডাকের মতো শোনাতে থাকলো। সুক আমার চুলের ভেতর দিয়ে আঙুল চালিয়ে দিচ্ছিল, বললো: সান্টাক্লজ অবশ্যই আছেন। ব্যাপারটা হলো, তাকে যা যা করতে হয় সেসব তো আর কোনো একজন মাত্র লোক পেরে উঠবে না। তাই প্ৰভু সেই কাজ আমাদের সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। সবাই-ই তাই সান্টাক্লজ। আমিও। তুমিও। এমন কি তোমার ভাই বিলি বব। এবার ঘুমাও। তারা শুনতে থাকো। শান্ত কিছুর কথা ভাবতে থাকো। যেমন স্নো, তুষার। দুঃখ হচ্ছে তুমি দেখতে পেলে না। কিন্তু তারাদের ফাঁক দিয়ে এখন তুষার পড়ছে—আমার মাথার ভেতরে তারারা ঝকমক করলো, পাক খেতে খেতে তুষার নেমে এল; সর্বশেষ যে জিনিসটা আমার মনে পড়ছে সেটা হলো প্রভুর শান্ত স্বর, আমাকে যেন কী একটা করতে বলছেন। পরদিন আমি সেটা করলাম। সুকের সঙ্গে পোস্ট অফিসে গিয়ে একটা পেনি-পোস্টকার্ড কিনে আনলাম। পোস্টকার্ডটা আজও আছে। গত বছর বাবা মারা যাওয়ার পরে বাবার সেফটি ডিপোজিট বক্সে ওটাকে পাওয়া যায়। আমি লিখেছিলাম: হ্যালো বাবা ভাল আছ তো আমি ভাল আছি এমন জোরে চালাতে শিখেছি প্লেনটা শিগগিরই আকাশে উঠে পড়বো চোখ খোলা রেখো আর হ্যাঁ খুব ভালবাসি তোমাকে বন্ধু।
---------------
* দশ সেন্টের মুদ্রাকে বলে ডাইম। ** ভিক্টোলা হল পুরনো ধাঁচের গ্রামাফোন।



লেখক পরিচিতি :
জনৈক গ্লোরিয়া ডানফি-র জন্য ১৯৮২ সালে গল্পটা লেখা। ১৯৮৪ সালের অগাস্ট মাসে ক্যাপোট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জন্ম ১৯২৪ সালে নিউ অর্লিয়েন্সে আর বেড়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায়। মার্কিন দেশে সাহিত্য-টাহিত্যের পাঠক কখনোই খুব বেশি ছিল না। বিংশ শতকে মাত্র দুজন কাহিনীকার সে দেশের ঘরে ঘরে সমাদৃত নাম হয়ে ওঠেন--আর্নেস্ট হেমিংওয়ে আর ট্রুম্যান ক্যাপোট। পনেরো বছর বয়েসে স্কুল ছেড়ে একসময় যোগ দেন ’নিউ ইয়র্কার' পত্রিকায়। অন্য কোন চাকরি আর করেননি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  2. গল্প পড়ে আর কিছু হোক বা না হোক, বুকে আশ্বাস বসল। মনে হল এই সততার আওয়াজ যদি অন্তর থেকে ওঠে, হয়তো আমিও পারব। খালি উড়াল নেওয়া স্বপ্নকে সাজতে হবে বিশ্বাসযোগ্যতায়। গল্পের মূল জোর এখানেই। দেশ-কাল-পাত্র-সময়ের উর্ধে ওঠা এ গল্প থেকে অর্জন অঢেল।
    অবশেষে বলি,গল্পের মূল ভঙ্গীর খুব নিকট এই অনুবাদ না হলে এত কথা বলার অবকাশই তৈরি হতনা। মনোগ্রাহী অনুবাদের জন্য ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন