ইরানী গল্প : আয়না

মূল: ফারাহনাজ আব্বাসী

অনুবাদ: ফজল হাসান

প্রতি বছর মাহবানু একই পোশাক পরিধান করে এবং আয়নার সামনে বসে থাকে । অনেক সময় কোরান শরীফ খুলে সূরা ‘নিসা’ পাঠ করে । পাঠ করা শেষ হলে সে কোরান শরীফ বন্ধ করে টেবিলের মাঝে রাখে এবং রহমানের ফিরে আসার প্রতীক্ষার প্রহর গোণে ।
সেই অপেক্ষার দীর্ঘ সময়ে সে প্রজ্জ্বলিত মোমবাতির লিকলিকে অগ্নিশিখার দিকে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে । বাইরে থেকে দরজার ছিদ্রপথে চাবি ঢোকানোর শব্দে তার বুকের ভেতর ধুকপুকানি দ্রুত হয় । একসময় দরজার পাল্লা খুলে যায় । চার কদম এগিয়ে এসে রহমান ঘরে প্রবেশ করে । তখন সে উঠে দাঁড়ায় এবং পড়নের পোশাক ও মাথার চুল ঠিক মতো আছে কি না, তা পরখ করে । সে চার ঘন্টা আগে পোশাক পড়েছে এবং পরিপাটি করে চুল বেঁধেছে । তার ঘাড়ের উপর চুলের গোছা ঝুলে আছে । রহমানের ফিরে আসা পর্য্যন্ত সে অপেক্ষা করে । তাকে সেই সুসজ্জিত এবং পরিপাটি পোশাকে দেখে রহমান মিটিমিটি হাসে । মাহবানু উঠে এসে রহমানকে জড়িয়ে ধরে এবং তার কাঁধে আলতো করে মাথা রাখে। এ ভাবেই কয়েক মিনিট কেটে যায় । স্বভাবতই তখন তার চোখের পাতা বন্ধ থাকে । রহমান পকেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে মাহবানুর জন্য কিনে আনা উপহার খোঁজে । আসার সময় সে উপহার সযত্বে রঙিন কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে এনেছে । একসময় রহমান উপহার বের করে মাহবানুর উষ্ণ নরম হাতে তুলে দেয় । উপহার পেয়ে মাহবানুর ঠোঁটের ফাঁকে হাসি ফুটে উঠে এবং শিশুদের মতো আনন্দ-খুশিতে ডগমগ করে । তারপর সে ডাগর কালো চোখ খোলে এবং রহমানকে রীতিমত টেনে-হিঁচড়ে টেবিলের কাছে নিয়ে যায় । তারা আয়নার সামনে ঘন্টা খানেক বসে থাকে । তখন মাহবানু কোরান শরীফ থেকে সূরা ‘নিসা’ পাঠ করে রহমানকে শোনায় । রহমানের এক ঘেঁয়েমী লাগে । সে বলে, ‘তুমি কী অনেক বার পাঠ করোনি ?’ অভিমানে মাহবানুর চোখেমুখে বিরাগ ভাব ফুটে উঠে এবং ভুরু কুঁচকে সে স্বামীর দিকে তাকায় । রহমান নিশ্চুপ । তার মুখে কোন রা নেই । 

বানু আয়নার সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা একাকী বসে থাকে । যদিও তাকে দেখার জন্য রহমান প্রতি বছর আসে, তবে দীর্ঘ সময় সে একা বাস করে । রহমান ঠিক সময় মতো বছরে একবার বাড়ি আসে । রহমান এসেই দরজার বাইরে দাঁড়ায় এবং আদুরে গলায় স্ত্রীকে ডাকে । বানু উঠে গিয়ে দরজায় চাবি ঢোকানোর ছিদ্রপথে তাকায় । রহমানের মাথা থেকে পা অবধি সাদা পোশাকে আবৃত । 

রহমানকে উদ্দেশ্য করে বানু বললো, ‘না, রহমান । যাও, তোমার সাদা পোশাক বদল করে আসো ।

রহমান চলে যায় ।

রহমানের চলে যাওয়ার পর বানু আয়না এবং জ্বলন্ত মোমবাতির শিখার দিকে তাকায় । একসময় দরজার ছিদ্রপথে চাবি ঢোকানোর শব্দ তার কানে ভেসে আসে এবং পায়ের আওয়াজ ক্রমশ এগিয়ে আসে: এক, দুই, তিন, চার । বানুর হৃদপিন্ডের ভেতর ধুকপুকানির শব্দ দ্রুত হতে থাকে । দরজার কাছে আসার পর পায়ের আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায় । বানু জানে, রহমানের পায়ের আওয়াজ । বানু উঠতে চাইলো, কিন্তু পারলো না । তার মনে হলো, শরীরে কোন তাকত্ নেই । সে গালে পাউডার মেখেছিল । অথচ দীর্ঘ সময়ে সেই পাউডার মুছে গেছে । তাই তার মুখ বিবর্ণ দেখাচ্ছে । বিনুনী করা মাথার চুল তার উরোজের উপর ঝুলে আছে । একসময় সে উঠে দাঁড়ায় এবং দরজার দিকে এগিয়ে যায় । পুনরায় সে দরজার ছিদ্রপথে চোখ রাখে । এ বারও রহমানের পড়নে সাদা পোশাক। 

বানু বললো, ‘না, রহমান, কাপড় পাল্টে আসো ।’

উত্তরে রহমান বললো, ‘বানু, তুমি কী দরজা খুলবে না ?’

অন্য সময়ের তুলনায় সেই সময় বানুর হাত আরো বেশি কাঁপতে থাকে । সে দরজার ফাঁকে চাবি ঢোকায় । কাপড় বদলানোর একই কথা রহমানকে আর বলতে চায় না । আসলে রহমানের কাছ থেকে সে দূরে থাকতে নারাজ । অবশেষে দরজার পাল্লা খুলে যায় । রহমান ঘরের ভেতর প্রবেশ করে । তারপর সে বানুর দিকে এগিয়ে যায় । সাদা কাপড়ে রহমানকে সত্যি ভয়ঙ্কর দেখায় । আচমকা বানু সামান্য পেছনে সরে যায় । আগে যেভাবে রহমানকে জড়িয়ে ধরতো, সে এখন সেই ভাবে জড়িয়ে ধরতে চায় না ।

রহমান বললো, ‘তুমি একাকী থাকার সময় এই পোশাক কত বার পড়েছ ? এখন কিন্তু আমি তোমার কাছে এসেছি ।’

রহমানের দূর্বল এবং ঋজু দেহের দিকে বানু তাকিয়ে থাকে । বানুর হাত রহমান নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, ‘তুমি কী তোমার উপহার চাও না ?’ 

বানু হাসতে থাকে । তবে এই হাসি তিরিশ বছর আগের হাসির মতো নয় । এই হাসি শান্ত প্রকৃতির এবং শব্দহীন । সে দূর্বল দৃষ্টির চোখের পাতা বন্ধ করে । 

রহমান বললো, ‘না, বানু । এভাবে চোখ বন্ধ রাখলে হবে না । তুমি কী আমার সঙ্গে যাবে ?’ 

বানুর চোখেমুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে । তবুও সে বললো, ‘হ্যা, রহমান । যাওয়ার জন্য এখনই সময় ।’

রহমান এক ঝটকায় বানুকে কাছে টানে । বানু ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পেছন ফিরে তাকায় । নিজেকে সে ধবধবে পোশাকে আয়নার সামনে বসে থাকতে দেখে । সে বললো, ‘রহমান, বানুকে দেখ ...!’ 

রহমান বানুকে আরো কাছে টানে । ঘর থেকে টেনে বের হওয়ার সময় বানু দেখতে পেল পড়নের বিয়ের সাদা পোশাক ক্রমশ খুলে টেবিলের উপর জড়ো হচ্ছে এবং জ্বলন্ত মোমবাতির শিখা নিভিয়ে দিচ্ছে । 

মাহবানুকে অনেক দূরে নিয়ে যাচ্ছে রহমান । 




লেখক পরিচিতি: 

ফারাহনাজ আব্বাসী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি । তবে যেটুকু পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায় তিনি ১৯৮৮ সালের শুরুর দিকে ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে প্রকাশিত ‘আদিনেহ্’ ম্যাগাজিনে ‘আয়না’ গল্প প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন । ফারসি ভাষায় তাঁর ছোটগল্প সংকলন ‘রাজ-এ-সার-বে মোহর’ (ইংরেজিতে ‘সীলড্ সিক্রেট’) প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে । বর্তমানে তিনি ইরানের সিরাজ শহরে বসবাস করছেন ।


গল্পসূত্র: 
‘আয়না’ গল্পটি ফারাহনাজ আব্বাসীর ইংরেজিতে ‘দ্য মিরর’ গল্পের অনুবাদ । ফারসি ভাষা থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ফারজিন ইয়াজদানফার । ইংরেজিতে গল্পটি হেসমত মোয়াইয়াদ সম্পাদিত ‘স্টোরিজ ফ্রম ইরান : এ শিকাগো অ্যান্থলজি ১৯২১-১৯৯১’ ছোটগল্প সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ